দুষ্টু মেয়ের দল (প্রথম পর্ব)

অলংকরণ: তুলি
দক্ষিণ এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের মেয়েরা। নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা জিতল বাংলাদেশ। এর ফলে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের শিরোপা জিতল মেয়েরা। ময়মনসিংহের ‘কলসিন্দুর’-এ বেড়ে ওঠা আটজন আছেন এ দলে। ২০১৮ সালে কিআর পাতায় ছাপা হয়েছিল আনিসুল হকের ধারাবাহিক উপন্যাস ‘দুষ্টু মেয়ের দল’। উপন্যাসের চরিত্রগুলো কাল্পনিক হলেও এখানে আছে কলসিন্দুরের মেয়েদের গল্প, তাদের ফুটবলের গল্প। সেই কলসিন্দুরের মেয়েরা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে আমাদের ভাসাচ্ছে গর্বে। তাই কিশোর আলোর ওয়েবসাইটে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হলো ‘দুষ্টু মেয়ের দল’।

রাশেদা বলল, ‘একখান গরু খোঁজার যন্ত্র আবিষ্কার করতে হইব রে।’ ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। দীর্ঘশ্বাসটা বেশ দীর্ঘ। জোরে বাতাস বইল। নড়ে উঠল পেয়ারাগাছের পাতা।

পেয়ারাগাছের ডালে তার পাশে বসে ছিল মারিয়া। তার মাথায় উকুন হয়েছে। সে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, ‘গরু খোঁজার যন্ত্র আবিষ্কারের আগে উকুন মারার যন্ত্র আবিষ্কার করন বেশি দরকার।’

রাশেদা বলল, ‘না রে। উকুন মারার যন্ত্র আবিষ্কার করা লাগব না। এই যন্ত্র আছে।’

‘কী কস? এই যন্ত্র আসলেই আছে?

‘হ। আছে।’

‘কই পাওন যায়?’

‘আছে আমগো একখান। তুই চিন্তা করিস না। আমি একটা ব্যবস্থা করুমই।’—রাশেদা পা দোলাতে দোলাতে বলল।

মারিয়া বলল, ‘সই লো সই, তুই আমার সাত জনমের দোস্ত। মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। তুই আমারে অবশ্যই উকুন মারার যন্ত্রটা আইনা দিবি। ক দিবি?’

‘হ। দিমু।’

‘কখন দিবি?’

‘কাইলকা ভোর হওনের আগেই পাবি।’

‘থ্যাংক ইউ ফ্রেন্ড।’

মারিয়ার কথা শেষ হতেই পেয়ারার ডালে উঠে দাঁড়াল রাশেদা। উঠতে হলো বেশ সাবধানে। মাথার ওপরে আরেকটা ডাল। সেটা ধরল সে। তারা এখন মাটি থেকে বেশ খানিকটা ওপরে। ওই মগডালে একটা ডাঁসা পেয়ারা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এটা পাড়ার উপায় কী?

এই সময় রাশেদার মনে পড়ল, তারা বেরিয়েছে গরু খুঁজতে। তাদের লাল গাইটা ম্যালা হয়ে গেছে। মানে দড়ি ছিঁড়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে গরু। স্বাধীনতা খারাপ কিছু না। কিন্তু ওরে গরু, তুই কোথায় আছিস বলতে হবে তো। গরুটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রাশেদার মা তাই চিৎকার-চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলেছেন। ‘অ রাশেদা, অ রাশেদা, গাইটা কই গেল?’

‘কী হইছে?’

‘গাইটা এইহানে বান্দা আছিল। দড়ি ছেঁড়া। গেল কই?’

রাশেদা হেসে বলল, ‘স্বাধীন হইছে মা। শুনো, আমগো স্যার আমগো কবিতা পড়াইছেন, স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়, দাসত্ব শৃঙ্খল পায়ে কে বাঁধিতে চায় হে, কে বাঁধিতে চায়।’

‘আরে ধুর! এই গরু নিজে নিজে যায় নাই। বাছুরটা ওইহানে বান্দা। বাছুরটা কষ্ট পাইতাছে। কেমন ব্যা ব্যা কইরা হাঁক পাড়তাছে। হে স্বাধীন হইলে বাছুরটারে লইয়া যাইত না?’

‘ক্যামনে নিব মা? বাছুরটারে যে তুমি দড়ি দিয়া বাইন্দা রাখছ। হে নিজের দড়ি ছিঁড়তে পারে। কিন্তু বাছুরের দড়ি কেমনে ছিঁড়ব, কও! গরু তো, মাথায় কিছু নাই। তাই হে স্বাধীন হইয়া যেদিকে খুশি চইলা গেছে।’

‘যাহ্। পাগলের মতো কথা কইস না। হে যদি স্বাধীন হইত, তাইলে বাছুরের লাইগা চইলা আইত। তারে কেউ না কেউ ধইরা নিয়া গেছে। ধলা মাতুব্বরের কাম হইতে পারে। গরু ধইরা খোঁয়াড়ে দিতে পারলে বিশ ট্যাকা পাইব। সেই লোভে হের কামের ছ্যামড়াটা এই কাজ করতে পারে।’

কী নরম ছোট্ট বাছুরটার কান দুটো! রাশেদা বাছুরটার কান বুলিয়ে দেয়। পিঠ বুলিয়ে দেয়। হাম্বা হাম্বা রবে ডাকে বাছুরটা। রাশেদার মনে হয়, আহা রে, বেচারা মনে হয় মা মা বলে ডাকছে।

রাশেদার মনে হলো, গরুটাকে খুঁজতে বেরোনো দরকার।

সে বেরিয়ে পড়ল। দুটো টিনের ঘর, একটা খড়ের চালা দেওয়া রান্নাঘর। তার পেছনেই গোয়াল। ঘরের ওপরে দুটো আমগাছ, একটা কাঁঠালগাছ, কয়েকটা সুপারিগাছ। চালের ওপরে কুমড়ার লতায় ফুল ফুটেছে। নিমগাছ পেরোলে বেগুনখেত। তার মধ্য দিয়ে পায়ে চলা পথ। গরুটা এই দিকেই গেছে। প্রমাণ হিসেবে রেখে গেছে গোবর।

এই পথ ধলা মাতুব্বরের বাড়ির দিকেই গেছে। তার মানে খোঁয়াড়েই গেছে গরু। আজকে বিশ টাকা গচ্চা যাবে বাবার। মনে মনে ভাবল রাশেদা।

একটা বাঁশের কঞ্চি হাতে তুলে নিল সে। কঞ্চিটার মাথা মাটিতে ধরে সে দৌড়াতে লাগল। এটা তার সাইকেল। সে নিজেকে কল্পনা করে নিল মীনা হিসেবে। রুনাদের বাড়িতে টেলিভিশনে সে মীনা কার্টুন দেখেছে। মীনাকে সে দেখেছে সাইকেল চালাতে।

দৌড়াতে দৌড়াতে সে পৌঁছে গেল মারিয়াদের বাড়ির সামনে। কিন্তু মারিয়া কোথায়? মারিয়াদের ঘরের বারান্দায় যিশুখ্রিষ্টের ছবি। ছবিটা কাচ দিয়ে বাঁধানো। রাশেদা কাচে নিজের চেহারাটা একবার দেখে নিয়ে হাঁক পাড়ল, ‘মারিয়া! ওই মারিয়া!’

মারিয়া টিউবওয়েলের পাড়ে। থালাবাসন মাজছে।

ওকে দেখে রাশেদা বলল, ‘মারিয়া, চল তো চল।’

‘কই যামু?’

‘ধলা মাতুব্বরের বাড়ি।’

‘ক্যান?’

‘গরু খুঁজতে।’

‘খাড়া। থালাবাসন কয়টা পানি দিয়া একটু ধুইয়া লই।’

‘আইচ্ছা। আমি কল চাপতাছি। তুই ধো। চটপট কর। গরু না পাইলে মায়ে হার্টফেইল করব। সেইটা কুনু ব্যাপার না। বাছুরটা কষ্ট পাইতাছে। সেইটা হইল আসল ব্যাপার। ল। ধো না তাড়াতাড়ি।’

নলকূপের হাতলে বুক চেপে সর্বশক্তি প্রয়োগ করল রাশেদা।

ছোট্ট শরীরটা যেন ঝুলে আছে নলকূপের সঙ্গে।

রাশেদা আর মারিয়া। দুজনেই পড়ে ক্লাস ফোরে। সুন্দরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তবে আজকে স্কুল বন্ধ।

থালাবাসনগুলো ধোয়া হয়ে গেলে সেসব নিয়ে তাদের ঘরে চলে গেল মারিয়া।

তারপর জামার নিচে হাত মুছতে মুছতে বলল, চল।

রাশেদা বলল, ‘এই কঞ্চিটারে সাইকেল বানাইছি। সাইকেলে চইড়া যামু। ক্রিং ক্রিং। তাই দৌড় দেওয়া লাগব। সাইকেলের নিয়ম হইল, সাইকেলে চইড়া হাঁটন যায় না। দৌড়ান লাগে।’

মারিয়া বলল, ‘তাইলে আমারে দে। আমি সাইকেল চালাই। তুই রডের উপরে বস।’

হেসে ফেলল রাশেদা। ‘এহ্, শখ কত? সাইকেল চালাইতে চাস? সাইকেল চালান শিখছস?’

‘হ। কত চালাইছি। দে তো।’ মারিয়া কেড়ে নিল রাশেদার কঞ্চিটা। ওইটাই তো তাদের সাইকেল।

ধানখেতের আল দিয়ে তারা ছুটছে। একটা ছোট্ট খাল পড়ল পথে। গোড়ালি পরিমাণ পানি। খালের দুপাশে ঘন জঙ্গল। ঢোলকলমির দঙ্গল। নাম না-জানা কত ফুল। ফড়িং উড়ছে। ফণীমনসার হলুদ ফুলে রঙিন প্রজাপতি।

রাশেদা বলল, ‘মারিয়া, গরুটা মাতুব্বরের বাড়িতে যায় নাই।’

‘কেমনে বুঝলি?’

‘ওইখানে দেখ কত দূর্বাঘাস। এই পথ দিয়া গেলে এই দূর্বাঘাস না খাইয়া সে ধলা মাতুব্বরের খেতে ক্যান যাইব? ধরা পইড়া খোঁয়াড়ে যাওনের লাইগা?’

‘ক্যান যাইব হেইটা গরুরে জিগাইস। গরু কি আর তোর মতোন ক্লাস ফোরে পড়ে? হের মাথার বুদ্ধি শর্ট থাকতে পারে। তা না হইলে হে কি আর গরু হইছে?’

‘হ। গরুই হইছে। তোর মতো গাধা হয় নাই।’

খালের জলে রোদ পড়েছে। চিকচিক করছে পানি। মাছের পোনা কিলবিল করছে। মাছের পিঠে রোদ পড়ে ঝিকমিকিয়ে উঠছে।

রাশেদা আর মারিয়া মাছ দেখতে লাগল।

মারিয়া বলল, ‘গরুটা পাওয়া গেলে গামছা আইনা মাছ ধরুম, ঠিক আছে?’

রাশেদা মাঝেমধ্যেই ইংরেজি বলে। সে বলল, ‘ওকে ওকে। ভেরি গুড। চল।’

কঞ্চি দিয়ে একটা ঝাঁকড়া গাছের ডালে বাড়ি মারল মারিয়া।

রাশেদা অবাক হয়ে বলল, ‘কী করলি?’

‘ক্যান? কী করলাম?’

‘গাছের গায়ে বাড়ি মারলি ক্যান?’

‘এমনেই মারলাম।’

‘না, এমনে মারবি না। জয়েনউদ্দিন স্যার কী বলেছেন মনে নাই? গাছেরও প্রাণ আছে। তাদেরও বেদনা আছে।’

মারিয়া বলল, ‘হ। গাছেরও কাতুকুতু আছে। বগলে সুড়সুড়ি দিলে গাছেরাও হাসে, তাই না?’

‘মারব এক থাপ্পড়।’ রেগে বলল রাশেদা।

মারিয়া বলল, ‘আমি তর লগে আর যামু না। আমি বাড়ি যাই। ল তর সাইকেল।’ কঞ্চিটা ছুড়ে মারল সে।

রাশেদা বলল, ‘ও ফ্রেন্ড, ও ফ্রেন্ড। ডোন্ট মাইন্ড।’ সে মারিয়ার বগলে কাতুকুতু দেওয়ার চেষ্টা করল।  হেসে উঠল মারিয়া।

একটা বেজি মাথা উঁচু করে তাই দেখছে। মাটিতে পোকা খুঁটে খাচ্ছে তিনটা দোয়েল। একটা গরু অলস শুয়ে আছে। তার পিঠে দুটো কাদাখোঁচা পাখি।

রাশেদা আবারও সাইকেল ছোটাতে লাগল। মানে তার কঞ্চিটা। ক্রিং ক্রিং।

ধলা মাতুব্বরের বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড়। সেই বাঁশঝাড়ের মধ্য দিয়ে পায়ে চলার পথ। বাঁশপাতা ঝরে পড়ে আছে। ওই দিকে একটা কবর। ইট দিয়ে বাঁধানো কবরের দেয়ালে শেওলা পড়ে আছে। বাঁশঝাড়ের নিচটা অন্ধকার। গা ছমছম করে।

রাশেদা বুকে থুতু দিয়ে কালেমা পড়তে লাগল। মারিয়া বিড়বিড় করছে, ‘যিশু যিশু।’

বাঁশঝাড়ে ঝাপটা লাগল। একটা কাক উড়ে গেল বাঁশের ডগা থেকে।

‘ওই ওখানে কী যেন নড়তেছে।’

‘উরে বাবারে। কী ওইখানে?’

একটু পর ওরা ভালো করে তাকিয়ে দেখল ওখানে একটা ছাগল।

ধলা মাতুব্বরের বাড়িতে গিয়ে ওরা পেল ধলা মাতুব্বরের বড় মেয়েকে। তার নাম বীণা। তিনি কলেজে পড়েন।

রাশেদা বলল, ‘আন্টি, আমগো লাল গাইটা খুঁইজা পাইতাছি না। আপনাগো এই দিকে কি আইছিল?’

বীণা বললেন, ‘না তো সোনা। আর এই, তুমি আমাকে আন্টি বলছ কেন? আপা বলতে পারো না?’

রাশেদা বলল, ‘আপা, আপনাগো কাজের ছেলেটা খালি গরু ধইরা খোঁয়াড়ে দেয়। আইজকাও তাই করছে নাকি?’

বীণা বললেন, ‘কার কথা বলছ? আনসার? আনসার তো কয় দিন আমাদের বাড়িতেই নাই। রহমতপুর গেছে।’

মারিয়া বলল, ‘তাইলে তো গরু এইখানে আসে নাই।’

‘তাই হবে।’ বললেন বীণা।

রাশেদা বলল, ‘তাইলে যাই। গরু তো খুঁজতে হইব।’

‘তোমরা কোন পাড়ায় থাকো?’

মারিয়া বলল, ‘উত্তরপাড়ায়।’

‘তোমরা কি স্কুলে পড়ো?’

‘জি। আমরা স্কুলে পড়ি।’ জবাব দিল রাশেদা।

‘কোন ক্লাসে পড়ো?’

মারিয়া বলতে যাবে, এই সময় হুট করে রাশেদা বলল, ‘ক্লাস ফাইভ।’

‘বাহ্। তোমরা তো অনেক পড়াশোনা করেছ। বসো। তোমাদেরকে খই-মুড়ি খেতে দিই।’

রাশেদা বলল, ‘গরু খুঁইজা না পাওয়া গেলে মায়ে হার্টফেইল করব।’

বীণা হেসে বললেন, ‘তাহলে তো মুশকিল। আচ্ছা এক কাজ করো। দুইজনে দুটো মোয়া হাতে নিয়ে গরু খুঁজতে যাও।’

ওরা দাঁড়িয়ে রইল। বীণা আপা (আন্টি নয়) ঘরে ঢুকে একটা বয়াম হাতে বেরোলেন। তার ভেতরে মুড়ির মোয়া। তিনি দুজনের হাতে দুটো করে চারটা মোয়া দিলেন।

রাশেদা বলল, ‘আপা, থ্যাংক ইউ।’

বীণা বললেন, ‘থ্যাংক ইউ দিতে হবে না। আবার এসো।’

মারিয়া বলল, ‘আপা, আমরা আসলে ক্লাস ফোরে পড়ি। ফাইভে না।’

রাশেদা লাল হয়ে গেল।

বীণা বললেন, ‘তাহলে ক্লাস ফাইভ বললে কেন?’

রাশেদা বলল, ‘ক্লাস ফোর বললেই সবাই খেপায়। ক্লাস ফোর, হেডমাস্টারের জুতা চোর। ফাইভ বললে আর মিলাইতে পারে না।’

‘বসো তোমরা। তোমাদের আচার দেব। এই কথা যে বলে, তার জন্য রয়েছে আচার।’

তিনি রোদে শুকোতে দেওয়া বয়ামটা তুলে নিলেন। এতক্ষণ এই দুজন যে বয়ামের দিকে তাকাচ্ছিল, সেটা তিনি খেয়াল করেছেন।

ওরা বারান্দায় একটা বেঞ্চে বসে আচার খেল। তারপর টিউবওয়েলের পাড়ে গিয়ে হাত ধুলো। জামায় হাত মুছতে মুছতে ওরা বলল, ‘থ্যাংক ইউ আপা। টাটা বাই বাই আবার যেন দেখা পাই।’

রাশেদা আর মারিয়া ছুটতে লাগল আবারও। তাদের কঞ্চির সাইকেল নিয়ে।

এবার একটু অন্যদিকে যেতে হবে গরু খুঁজতে।

বাঁশঝাড়ের পেছনে একটা জঙ্গল। ওই জঙ্গলের ঝোপে অনেক আনারস। তার পেছনে একটা জায়গা পরিষ্কার। সেখানে অনেক ঘাস। একবার রাশেদাদের হারানো গরু এখানটায় খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল।

রাশেদা আর মারিয়া গেল সেই জঙ্গলের ওপারে। না, কোনো গরু নেই।

কিন্তু ওই ওখানটায় পেয়ারাগাছটায় ছেলেরা বোধ হয় প্রায়ই গাছচুন্নি খেলে। ডালগুলো পরিষ্কার। ওই ডালে তো উঠে পড়তে হয়।

তরতর করে দুই বাঁদর উঠে পড়ল গাছে।

গাছটার ডালও এমন করে সাজানো মনে হয় আরাম করে বসা যায়। দুজনে গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসল।

তখনই রাশেদার মনে হলো, একটা গরু খোঁজার যন্ত্র আবিষ্কার করতে পারলে দারুণ হয়।

আর তখনই মারিয়ার মনে হলো, উকুন মারা যন্ত্র আবিষ্কার করার কথা।

গাছ থেকে পেয়ারা পেড়ে খেতে খেতে ব্যর্থ মনোরথে দুজন ফিরে এল রাশেদাদের বাড়িতে। এসে দেখল, গরু জায়গামতো বাঁধা। মা বোধ হয় গাই দুইয়েছেন। বাছুর গরুর কাছে। মনের সুখে সে মাতৃদুগ্ধ পান করছে। আর গাইটা তার সন্তানের গা জিব দিয়ে চেটে দিচ্ছে।

মা বলল, ‘ওই বদের বাসা, কই আছিলি এতক্ষণ?’

রাশেদা বলল, ‘গরু খুঁজতে গেছিলাম মা। তুমিই তো পাঠাইলা।’

মা রাশেদা আর মারিয়ার মুখের দিকে তাকালেন। রোদে মুখ দুটো লাল। সারা গা ঘামে ভেজা।

বললেন, ‘যা, তাড়াতাড়ি গোসল কইরা আয়। ভাত দেই। ভাত খা। মারিয়া, তুমিও ভাত খাইয়া যাও।’

‘না চাচি। আমি বাড়ি যাই। মায়ে চিন্তা করব।’

‘আচ্ছা তাইলে দুধ দেই এক গেলাস। দুধ খাইয়া যাও। গরম গরম দুধ। মজা লাগব।’

রাশেদার মা কাঁসার গেলাসে দুধ এনে দিলেন।  ঢকঢক করে দুধ খেয়ে নিল মারিয়া। দুধের সর তার ঠোঁটে আটকে রইল।

রাশেদা বলল, ‘ওই দুপুরে ভাত খাইয়া কী করবি?’

‘কী করুম?’

‘ঘুম দিয়া ল। কাইলকা সকালবেলা না ফুটবল খেলতে যাইতে হইব? মইন স্যারে যাইতে কইছে। আজানের সুমে যাইতে কইছে’—রাশেদা স্মরণ করিয়ে দিল।

সেই কথাটা মনে পড়ল মারিয়ার। মইন স্যারের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তিনি বলেছেন, সুন্দরপুর স্কুলের মেয়েদের দিয়ে ফুটবল টিম বানাবেন। কাল সকাল সকাল স্কুলের মাঠে যেতে হবে। তাই তো। তাহলে তো আজ বিকেলে ঘুমিয়ে নিতে হয়।

রাশেদা বলল, ‘তুই দুপুরে ভাত খাইয়া দিবি ঘুম। এর মধ্যে আমি উকুন মারার যন্ত্র বানায়া ফেলুম। যা।’

বেলা তিনটার মতো বাজে। সূর্য পশ্চিম দিকে খানিকটা ঢলে পড়েছে। চরাচর নিঝুম। একটা ঘুঘু একটানা ডেকে চলেছে। রাশেদা চলল মারিয়ার বাড়ির দিকে।

সে সঙ্গে নিয়ে চলেছে উকুন মারার যন্ত্র। যন্ত্রটা একটা কাঁচি।

মারিয়ার বাড়ির মাটির বারান্দায় পা রাখল রাশেদা। যিশুর ছবির কাচে নিজের মুখটা দেখে নিল সে।

দরজা খোলা। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। একটা তক্তপোশে উপুড় হয়ে ঘুমুচ্ছে মারিয়া।

রাশেদা খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইল। এবার চোখ খুলল। হ্যাঁ। এবার আর ঘরটা অন্ধকার মনে হচ্ছে না।

সে মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগল, ঘুমাও দোস্ত, ঘুমাও। আমি আমার উকুন মারা যন্ত্রটা একটু পরীক্ষা করে দেখি।

মারিয়ার মুখ থেকে লালা পড়ে বালিশ ভিজে গেছে। দেখে হেসে ফেলল রাশেদা।

তারপর সে মারিয়ার চুলের গোছা মুঠো করে ধরে ক্যাচ ক্যাচ করে চুল কাটতে লাগল।

অর্ধেকটা চুল কাটা হয়ে যাওয়ার পর টের পেল মারিয়া।

ফিরে শুল।

তাতে রাশেদার আরেকটু সুবিধাই হচ্ছে। সে এবার সামনের দিকের চুল কাটবে।

হঠাৎ পুরোপুরি ঘুম ভেঙে গেল মারিয়ার।

সে বলল, ‘কে রে?’

‘আমি রাশেদা, ফ্রেন্ড।’

‘কী করিস?’

‘উকুন মারার যন্ত্র আনছি। তোর মাথার উকুন মারি।’

‘কেমনে?’

মারিয়া উঠে বসল।

তার চোখেমুখে পড়তে লাগল কাটা চুল। চিৎকার করে উঠল সে। ‘তুই কী করছিস, শয়তান?’

‘যন্ত্র আবিষ্কার করছি। উকুন মারা যন্ত্র। আরেকটু ফ্রেন্ড। আরেকটু।’

মারিয়া বিছানা ছেড়ে বেড়ায় রাখা আয়নায় মুখ দেখে কাঁদতে লাগল।

তারপর রেগেমেগে এসে রাশেদার চুল ধরে টানতে লাগল। ‘এইটা তুই কী করছিস? এইটা তুই কী করছিস?’

রাশেদা বলল, ‘শোন। তোর মাথার চুল সুন্দরবন হইয়া গেছে। সুন্দরবনে যত বাঘ আছে, তোর মাথার চুলে তার চায়া অনেক বেশি বাগ (ইঁম) আছে। বাঘ মারা খারাপ। বাগ মারা সওয়াবের কাম। চিন্তা করিস না। বারান্দায় আইয়া ব। হাতে আয়নাটা ল। আমি মাপমতোন কাইটা দেই। চুল কাটায় আমার সুনাম আছে। পাড়ার সক্কলেই আমার কাছে আসে চুল কাটাইতে। এতজনের চুল কাইটা দিলাম আর তোরটা কাটুম না? তুই না আমার প্রাণের বন্ধু?’

মারিয়া মেয়েটা আসলে লক্ষ্মী টাইপ। সে তাদের বারান্দায় টুল নিয়ে বসে পড়ল। তার চুল কেটে দিতে লাগল রাশেদা।

মারিয়াদের বিড়ালটা এসে পায়ের কাছে বসে মিউমিউ করছে।

রাশেদা বলল, ‘ওই ম্যাও, মিউমিউ করিস ক্যান? তোরও কি চুল কাটা লাগব নাকি?’

বিড়াল বলল, ‘মিউ।’

মারিয়া হেসে বলল, ‘কী বলছে, শুনছিস?’

‘কী?’

‘কিউ।’

‘কিউ মানে?’

‘কিউ মানে কেন।’

রাশেদা বলল, ‘কেন মানে? তোমার গায়ে যদি উকুন হয়ে থাকে, তাহলে আমার উকুন মারার যন্ত্র তোমার গায়েও চলবে। বুঝছ?’

বিড়াল বলল, ‘মিয়াউ।’

মারিয়া বলল, ‘ম্যাও কী বলছে, বুঝছিস?

‘কী?’

‘হোয়াই?’

‘হোয়াই না হোয়াই না। ও বলছে ওয়াও।’

মারিয়ার চুল একেবারে ছেঁটে দিয়েছে রাশেদা। মারিয়া আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ‘আমার চুল, আমার চুল।’

রাশেদা বলল, ‘তুই চুল হারায়া কানতাছোস। আর উকুনগুলো যে বাড়ি হারাইল। খাওন হারাইল। তোর মাথার রক্ত খাইত রোজ। কত আরামে আছিল। অহন ওরা খাওন পাইব কই?

মারিয়া চোখের জল মুছে হেসে উঠল।

চলবে...

আরও পড়ুন