দুষ্টু মেয়ের দল (দ্বিতীয় পর্ব)

অলংকরণ: তুলি

মা বললেন, অ রাশেদা, উঠ। উঠ না!

রাশেদা পাশ ফিরে শুল। দরজার কবাট খুলে দিলেন মা। পুবমুখী ঘর। হালকা ফরসা আলো এসে ঢুকল ঘরে। একটু আগে আজান দিয়েছে। এখন ডাকতে শুরু করেছে পাখপাখালি।

রাশেদার মা উঠোন পেরিয়ে গেলেন গোয়ালের দিকে। গরুগুলোকে গোয়াল থেকে বাইরে এনে বিচালি খেতে দিলেন।

রাশেদা মাকে বলে রেখেছিল, ফজরের আজানের সুম ডাইকা দিবা!!

দৌড়ঝাঁপ করেছে সারা দিন। সন্ধ্যার সময় হারিকেনের আলোয় পড়তে বসেছে। তারপর গেছে রুনাদের বাড়ি। টেলিভিশন দেখতে। তারপর মেলা রাতে এসে শুয়েছে। এখন ঘুমুচ্ছে অঘোরে।

রাশেদার বাবাও ঘুম থেকে উঠে পড়লেন। একটা দাঁতন মুখে দিয়ে তিনি বেরোলেন জমি দেখতে। হাঁটবেন আর দাঁতন চালাবেন দাঁতে। বাবলাগাছের ডাল কেটে এই দাঁতন বানিয়ে নিয়েছেন তিনি।

রাশেদার মা পাকঘরের চুলার পাশ থেকে একটা কাঠকয়লা তুলে নিলেন। তিনি দাঁত মাজবেন কয়লা দিয়ে।

দাঁত মাজতে মাজতে তাঁর মনে হলো রাশেদা তাঁকে বারবার করে বলে রেখেছে, মা আমারে বিহানবেলায় ডাইকা দিয়ো। ও মা, শুনছ? কী কইলাম। এক্কেরে ভোরবেলা ডাইকা দিবা কিন্তু।

তিনি তাড়াতাড়ি টিউবওয়েলের পানিতে মুখ ধুয়ে নিলেন। ছুটে এলেন ঘরে। ও রাশেদা, রাশেদা, উঠ। রাশেদা, ও রাশেদা। মেয়ের গা ধরে ধাক্কা দিলেন তিনি।

রাশেদার ঘুম ভেঙে গেল। সে একটা মিষ্টি স্বপ্ন দেখছিল। তার ভাই রানা গাজীপুর থেকে সুন্দরপুরে এসেছে। হাতে একটা হলুদ রঙের মোবাইল ফোন। সেই ফোনটা একটা কাগজের ব্যাগ থেকে বের করে রানা বলছে, রাশেদা, এই মোবাইল ফোনটা আমি গিফট আনছি।

গিফট আনছ। কার লাইগা?

যার লাইগা আনছি, তার নামের প্রথম অক্ষর ‘র’।

‘র’-তে রাশেদা।

‘র’-তে রানা।

নিজেরে কেউ নিজে গিফট দেয় ভাইজান? কী যে কও না! দেও তো। আমার খুব শখ, আমার নিজের একটা মোবাইল ফোন থাকব।

ঠিক এই সময় মা তার ঘুমটা দিল ভাঙিয়ে।

সংবিৎ ফিরে পেতে খানিকটা সময় নিল রাশেদা। তার ভাই থাকে গাজীপুরে। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে টেকনিশিয়ানের কাজ করে। মাঝেমধ্যে বাড়ি আসে। নিজের মোবাইল ফোন আছে তার। তাদের বাড়িতে কারও মোবাইল ফোন নাই। বিদ্যুৎ নাই এই গ্রামে। মোবাইল ফোনে চার্জ দেওয়া অসুবিধা। যাদের বাড়িতে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে, তারাই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। আর আছে গঞ্জের দোকান। সেখানে ব্যাটারি দিয়ে অনেকেই মোবাইল ফোনে চার্জ দেয়। রাশেদাদের বাড়িতে কারও মোবাইল ফোন নাই, এটা রাশেদার পছন্দ নয়। সে বাবাকে বলে, বাবা, একটা মোবাইল ফোন কিনো।

বাবা বলেন, চার্জ দিমু কই?

তুমি না সুন্দরপুরে গঞ্জে কাপড়ের দোকানে কাম করো? সেইখানে চার্জ দিবা।

সেইখানে চার্জ দিলে কথা কমু কখন?

রাইতে কইবা।

রাইতের টাইম হইল ঘুমানোর টাইম। তখন কথা কইতে হয় না।

আসলে রাশেদার বাবা লেখাপড়া জানেন না। তিনি মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না, এই হলো তাঁর ধারণা। তাই তিনি মোবাইল ফোন নেন না। অথচ মোবাইল ফোন তাঁদের দরকার। তাঁদের ছেলে রানা দূরে থাকে। কথা বলার জন্য তাঁদের অন্যের মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে হয়।

রাশেদার হুঁশ হলো। মইন স্যার বলে দিয়েছেন, আজানের সাথে সাথে ঘুম থাইকা উঠবি। তারপর নাশতা খাবি। তারপর স্কুলের মাঠে আয়া পড়বি। সকাল সাড়ে ছয়টার মধ্যে আইসা পড়া চাই।

এখন কয়টা বাজে কে জানে। তাদের বাড়িতে কোনো ঘড়ি নাই। মোবাইল ফোনও নাই, ঘড়িও নাই। এইটা একটা সমস্যা।

রাশেদা বলল, ও মা, তুমি আমারে এত দেরি কইরা ডাকলা ক্যান?

মা বললেন, তোরে কয়বার ডাকছি। গায়ে ধাক্কা দিয়া দিয়া ডাকলাম। তুই উঠস না। আমি কী করতাম?

না। তুমি আমারে কোলে কইরা ধইরা কলপাড়ে নিয়া গিয়া ফেইলা দিতা!

হ। আমার অত শক্তি আছে? ধিঙি মাইয়ারে আমি কোলে তুলতে পারি?

রাশেদা চটপট তৈরি হয়ে নিল। কয়লা দিয়ে দাঁত মেজে স্কুলের ড্রেস পরে স্পঞ্জের স্যান্ডেলে পা গলিয়ে সে দৌড় ধরল স্কুলের দিকে।

মা চিত্কার করে বললেন, ও রাশেদা, নাশতা কইরা যা। গরুর দুধের দই পাতছি। খই আছে। খাইয়া যা।

না মা। এত বিহানে আমি কিছু খাইতে পারুম না। আইসা খামু।

রাশেদা দৌড়াচ্ছে। একটা স্যান্ডেল পট করে গেল ছিঁড়ে। স্যান্ডেল হাতে নিয়ে দৌড়াতে লাগল সে। শরতের সকাল। না ঠান্ডা না গরম। আরামদায়ক আবহাওয়া। হালকা বাতাস বইছে তিরতির করে। দৌড়ানোর ফলে শরীরটা একটু গরম গরম হয়েছে। নাকে-মুখে ঘাম। রাশেদা এক হাতে নাকের ঘাম মুছল। নইলে মারিয়া যদি তার নাকে ঘাম দেখে, বলবে, যার নাক ঘামে, তার বর তাকে খুব ভালোবাসে। এই সব কথা শুনলে রাশেদা ভীষণ লজ্জা পায়।

ঘামের শরীরে এসে লাগছে ভোরের নরম বাতাস, কী যে আরাম লাগছে।

স্কুলের কাছাকাছি আসতেই দেখা গেল রুনা আর তার বোন লুনা আসছে সাইকেলে। লুনা সাইকেল চালাচ্ছে আর রুনা তার সামনে রডের ওপরে বসে আছে। লুনা বেশ লম্বা-চওড়া আছে। তাকে তারা আড়ালে ডাকে তালগাছ বলে।

রুনাদের বাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ আছে। টেলিভিশন আছে। তাদের বাবা বিদেশে থাকেন।

রাশেদা আর মারিয়া রুনাদের বাড়িতে গিয়ে টেলিভিশন দেখে। টেলিভিশনের সবকিছুই তাদের ভালো লাগে। যখন বিজ্ঞাপন দেখায়, তখনো তারা হা করে দেখে। শুধু যখন খালি কথা বলে, তখন তারা বিরক্ত হয়। চ্যানেল বদলানোর উপায় নাই। তারা শুধু বাংলাদেশ টেলিভিশনই দেখতে পারে।

এরই মধ্যে মাঠে গোটা দশেক মেয়ে জড়ো হয়েছে। ক্লাস ফোর আর ফাইভের মেয়ে।

আরও কয়েকজনের আসার কথা।

গতকাল মইন স্যার বলেছেন, ২০ জন কমপক্ষে লাগবে। দুই দল বানিয়ে খেলা শুরু করব। পরে এখান থেকে ১৪ জনকে নিয়ে দল বানাব। তারা খেলতে যাবে জেলা সদরে। সামনে বেগম ফজিলাতুন্নেছা কাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা হবে। তাদের প্রাইমারি স্কুল এই কাপে অংশ নেবে।

শুনে প্রধান শিক্ষিকা দীপারানী সরকার খুব খুশি। খুব ভালো হবে। আমাদের স্কুলের নাম জেলার সবাই জানবে।

মইন স্যার বলেছেন, তার আগে আমাদের উপজেলায় চ্যাম্পিয়ন হতে হবে।

অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড স্যার জয়নাল আবেদীন বলেছেন, সেইটা কি আর সম্ভব? আমাদের উপজেলায় ১৮টা প্রাইমারি স্কুল আছে। ১৮টা দলের মধ্যে আমরা চ্যাম্পিয়ন হমু কেমনে? আমরা হইলাম গ্রামের স্কুল। আমাদের গ্রামে কারেন্ট নাই। মেয়েরা কোনো দিন ফুটবল খেলা টিভিতে দেখেও নাই। আমরা পারুম না। উপজেলা সদরের প্রাইমারি স্কুল উপজেলায় চ্যাম্পিয়ন হইব। তারা ভালো ভালো খাবার খায়। পেট ভইরা ভাত খায়। মুরগির রান খায়। হেগো পায়ে জোর বেশি। হেরা ভালো ভালো বুট পায়ে দিয়া নামব। আমগো মাইয়ারা পা ভাইঙ্গা কানতে কানতে আইব। হেগো আর কুনু দিন বিয়া হইব না।

দীপারানী সরকার তাঁকে ধমক দিয়েছেন। আরে জয়নাল স্যার, আপনি থামেন তো। আপনেরে কে কইছে বড়লোকের ছেলেমেয়েরা ফুটবল ভালো খেলে?

এইটা খাটনির খেলা, ম্যাডাম। শরীলে বল না থাকলে পায়েও বল থাকে না। এই জন্য এই খেলার নাম বল। যার শরীলে বল বেশি, সেই বল খেলে ভালা।

প্রধান শিক্ষিকা বলেছেন, আপনি ফুটবলের কী জানেন? বলেন তো পৃথিবীর এক নম্বর ফুটবল খেলোয়াড় কে?

সব জানি ম্যাডাম। এক নম্বর হইল আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা আর ব্রাজিলের পেলে।

ঠিক বলেছেন। এই দুজনের জন্মই বস্তিতে। ছোটবেলায় খাবার পেত না। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই প্র্যাকটিস করেছে। একদিন দুনিয়ার সেরা খেলোয়াড় হয়েছে।

মইন স্যার বললেন, এখন দুনিয়ার সেরা খেলোয়াড় হইল মেসি আর নেইমার। তারাও বস্তির ছেলে। তারাও ছোটবেলায় খাবার পাইত না।

কুয়াশা কেটে যাচ্ছে মাঠে। যদিও স্কুল মাঠের ঘাসের ডগায় এখনো শিশির জমে আছে। স্যার দুইটা ফুটবল এনেছেন। মাঠের দুপাশে বাঁশ পুতে গোলপোস্ট বানানো হয়েছে।

আজকে এসেছে মোট আঠারো জন। দুজন অনুপস্থিত।

মইন স্যার মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর নাম কী?

মারিয়া।

মইন স্যার বললেন, তাহলে দে ফুটবলটাকে মারিয়া।

সবাই হেসে উঠল।

মইন স্যার বললেন, তোর চুল কেন গেল তোকে ছাড়িয়া?

মইন স্যার মুখে মুখে ছড়া বানাতে পারেন।

মারিয়া কিছু বলে না।

রাশেদা বলল, স্যার, ওর মাথায় উকুন হইছিল স্যার।

মইন স্যার হাসতে লাগলেন। বললেন, উকুন গেল ছাড়িয়া, তাই তো এখন মারিয়া, বল নিবে কাড়িয়া। নে। মারিয়া, তুই সবার আগে বলে লাথি মার। এইটাকে শট মারা বলে। যা, পা দিয়া লাথি মার বলে।

সবার পা খালি। সবাই খালি পায়ে খেলতে নেমেছে।

সুন্দরপুর অজপাড়াগাঁ। এখানে কেউ জুতা পরে না। স্যান্ডেল যে পরে, এই বেশি। মেয়েরা জুতা পায়ে দেবে, এটা কেউ কল্পনাও করে না।

মারিয়া বল মারতে গেল। বলে পা লাগল না। বলের পাশ দিয়ে তার পা চলে গেল।

সবাই হাসছে। মারিয়া লাল হয়ে গেছে।

মইন স্যার বললেন, পারবি পারবি। মার। যা কাছে যা।

মারিয়া বলল, স্যার আমার বাম পায়ে জোর বেশি। আমি বাম পা দিয়ে চেষ্টা করি।

আরে সেইটা আগে বলবি তো। অবশ্যই। বাম পা দিয়ে ট্রাই কর।

মারিয়া বাম পায়ে শট নিল। চমত্কার শট হলো। হাততালি দিয়ে উঠল সবাই।

দুই লাইনে দাঁড়িয়েছে মেয়েরা। দুইটা বল লাইনের সামনে। সবাই একে একে যাচ্ছে আর বলে লাথি মারছে। আজকের ট্রেনিং এইটাই। বলে লাথি মারা।

প্র্যাকটিস শেষ হতে হতে রোদ উঠে গেল। মেয়েরা সব ঘেমে একাকার।

ততক্ষণে দীপারানী এসে গেছেন মাঠে। নিজের গাছ থেকে পেড়ে তিনটা পেঁপে এনেছেন তিনি। সঙ্গে এনেছেন ছুরি আর থালা।

তিনি বললেন, রুনা আর লুনা, তোমরা কি পেঁপে কাটতে পারবে?

পারব আপা।

তাহলে যাও। টিউবওয়েল থেকে হাত ধুয়ে এসো। মেয়েরা সবাই যাও। টিউবওয়েলের জলে ভালো করে হাত-মুখ-পা ধুয়ে এসো।

রুনা আর লুনা পেঁপে কাটল ফালি ফালি করে। একটা করে পেঁপে খেল মেয়েরা।

মইন স্যার আর দীপারানী খেলেন না।

এই সময় একটা মোটরসাইকেল এসে থামল মাঠের ধারে।

সবাই দেখল ধলা মাতব্বর।

ধলা মাতব্বরের গায়ের রং ধবধবে সাদা। এটা তার রোগ, নাকি আসল গায়ের রং, কেউ জানে না।

তিনি মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে হর্ন বাজাতে লাগলেন, পি-পি-পি-পি।

সবাই তার দিকে তাকাল।

তিনি হাত নেড়ে ডাকছেন।

দীপারানী সরকার সেদিকে রওনা দিলেন। পেছনে পেছনে চলল মেয়ের দলও।

ধলা মাতব্বর বললেন, এইটা কী? আপনেরা কি আমাদের গ্রামে গজব নামাইতে চান? মেয়েদেরকে ফুটবল খেলতে লাগাইছেন কেন?

অলংকরণ: তুলি

দীপারানী বললেন, মেয়েরা উপজেলা সদরে খেলতে যাইব। সরকারের চিঠি আসছে।

কে চিঠি দিছে?

থানা শিক্ষা অফিসার চিঠি দিছে।

থানা শিক্ষা অফিসার বড়, না আমি বড়?

থানা শিক্ষা অফিসার বড়, দীপারানী বললেন।

ক্যামনে?

কারণ, আমি সরকারি কর্মচারী। সরকার আমারে বেতন দেয়। আমি তাঁর কথা শুনব।

শুনেন। আপনে তাঁর কথা শুনেন। আমি এলাকার মাতব্বর। আমার কথাটা হইল, আপনে যদি এই ফুটবল বন্ধ না করেন, আপনেরে আমি গ্রামে ঢুকতে দিমু না। আপনে টাউনে গিয়া আপনের বেতন তুইলা খাইয়েন। আপনেরে আমি বদলি করুম।

মইন স্যার বললেন, আপনি কেডা?

আমারে চিনেন না? সুন্দরপুর গ্রামে মাস্টারি করেন। আমারে চিনেন না?

মইন স্যার বললেন, না চিনি না। আমি ওয়েট লিফটিংয়ে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন। আপনি আমারে চিনছেন তো, নাকি?

না চিনি নাই। ধলা মাতব্বর বললেন।

ওয়েট লিফটিং মানে বুঝেন? ভারোত্তোলন। বুঝছেন?

না বুঝি নাই।

মানে আমি তিন মণ ওজন ঘাড়ের ওপরে তুলতে পারি। আপনের এই মোটরসাইকেলের উপরে আপনে বইসা থাকেন। নাইমেন না। নামলে পইড়া ঘাড় ভাঙবেন। বইসা থাকেন। বলতে বলতেই মইন স্যার মোটরসাইকেলসমেত ধলা মাতব্বরকে নিজের ঘাড়ের ওপরে তুলে ফেললেন।

তারপর নিজে চক্কর মারতে লাগলেন। মাথার ওপরে মটরসাইকেল আর ধলা মাতব্বর চক্কর খেতে লাগলেন।

তিনি ‘ও আব্বা গো ও আম্মা গো আমারে নামায়ে দেও গো’ বইলা কাঁদতে লাগলেন।

মইন স্যার বললেন, আব্বা-আম্মার নাম নিয়া লাভ নাই। আল্লাহর নাম নেন।

ধলা মাতব্বর বললেন, ও মইন স্যার, আপনের হাতে ধরি, পায়ে ধরি, আমারে নামান।

ওপর থেকে পানি পড়তে লাগল।

মেয়েরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল।

দেখ, দেখ, পানি পড়তেছে। মারিয়া বলল।

পানি না। তেল পড়তাছে। মোটরসাইকেলের তেল। তয় স্যারে মাতব্বরের তেলও বাইর কইরা ফেলছে।

মইন স্যার মোটরসাইকেলসমেত ধলা মাতব্বরকে নিচে নামিয়ে আনলেন।

তারপর বললেন, যান, নিজের কাজ করেন। বাড়ি গিয়া আপনের পায়জামা আলমের এক নম্বর পচা সাবান দিয়া ধুইয়া দিয়েন। জামাকাপড় তো তেল পইড়া সব নষ্ট হইছে।

মোটরসাইকেলের কিক মারলেন ধলা মাতব্বর। মোটরসাইকেল স্টার্ট নিল।

তাঁর ফরসা মুখটা বাঁদরের পশ্চাদ্দেশের মতো লাল দেখা যাচ্ছে।

মোটরসাইকেল ধোঁয়া ছেড়ে চলে গেল।

খিলখিল করে হাসতে লাগল মেয়েরা।

দীপারানী চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ধলা মাতব্বর লোকটা ভালো না। ক্ষতি করতে পারে। না জানি কী প্রতিশোধ সে নেয়। একটা উপায় বের করতে হবে। একটা উপায়।

মইন স্যার বললেন, মেয়েরা তোমরা বাড়ি যাও। গোসল করে কাপড় পাল্টে ক্লাসে এসো। যারা খেলায় ভালো, তাদের লেখাপড়ায়ও ভালো করতে হবে। তা না হলে গার্জিয়ানরা খেলতে দেবে না।

রাশেদা বলল, স্যার, আমি তো স্কুলের ড্রেস পইরাই আসছি। আমি জামা বদলাইতে পারব না।

দীপারানী বললেন, কেন রে?

রাশেদা বলল, আপা, আমার তো একটাই বাইরে পরার জামা।

দীপারানী বললেন, আচ্ছা, তাইলে তুই এইটা পইরাই আসবি। কাইলকা থাইকা খেলার সময় বাড়িতে পরার জামা পইরা আসিস।

রুনা আর লুনা সাইকেলে চড়ে বাড়ি ফিরছে।

মারিয়া আর রাশেদা একটা কঞ্চি জোগাড় করল। কঞ্চিটাকে সাইকেল বানিয়ে দুজনে দৌড়ে বাড়ি যাবে।

সাবিনা পায়ে ব্যথা পেয়েছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে সে। কান্তা এসে তার পাশে দাঁড়াল। সে কান্তার কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটছে।

রুনা সেদিকে তাকিয়ে বলল, লুনা আপু, আমি হেঁটে যাই। তুমি সাবিনাকে সাইকেলে করে ওর বাড়ি পৌঁছে দাও।

আচ্ছা।

লুনা সাইকেল ঘোরাল। সাবিনাকে বলল, ওঠ, সাইকেলের রডে ওঠ।

রুনা আর কান্তা একসঙ্গে গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরছে।

রুনা বলল, আম্মাকে বলব আরেকটা সাইকেল কিনে দিতে। তাইলে আমি তোকে নিয়ে যেতে পারব।

কান্তা বলল, লাগব না।

ক্যান?

ধলা মাতব্বরের বন্দুক আছে। আইজকা যে অপমান সে হইছে, কাইলকা সে বন্দুক নিয়া আইব। আমগো আর ফুটবল খেলা হইব না।

রুনা বলল, সে বন্দুক আনব কেমনে? আগে তো তারে নিজের কাপড় পরিষ্কার করন লাগব।

কান্তা বলল, নারে ইয়ার্কির কথা না। লোকটা খুব খারাপ। সে এই অপমান মাইনা নিব না।

রুনা বলল, তাইলে উপায়?

গোলাম নাই উপায় হোসেন। গোলাম নাই।

আরও পড়ুন