দুষ্টু মেয়ের দল (তৃতীয় পর্ব)

অলংকরণ: তুলি

ধলা মাতুব্বরের কাজের ছেলে আনসার ফিরে এসেছে রহমতপুর থেকে।

বাড়ির বারান্দায় একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসে আছেন ধলা মাতুব্বর। খালি গায়ে সকালের রোদ লাগাচ্ছেন। আনসার মিয়া তাঁর গায়ে সরষের তেল মেখে দিচ্ছে।

মাথার ওপরে ঢেউটিনের চালা। সকালের রোদ পুবের আকাশ থেকে এসে পড়েছে বারান্দায়। উঠানে মোরগ-মুরগি চরছে।

ধলা মাতুব্বরের মেয়ে বীণা কলপাড়ে যাচ্ছে হাতে একটা প্লাস্টিকের জগ নিয়ে। তার পেছনে কতগুলো হাঁসের বাচ্চা।

হাঁসের বাচ্চাদের একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। মুরগি যখন ডিমে তা দেয়, তখন বীণা কতগুলো হাঁসের ডিমও দিয়ে দিয়েছিল। তারপর যখন বাচ্চা হলো, তখন মুরগির ডিম থেকে বেরোল মুরগির বাচ্চা। আর হাঁসের ডিম থেকে বেরোল হাঁসের বাচ্চা।

সবগুলো বাচ্চাই মুরগি মাকে নিজের মা বলে তার পিছু পিছু হাঁটতে লাগল।

মা মুরগিও সবাইকেই যত্ন করে। হাঁসের বাচ্চাগুলোকেও নিজের বাচ্চাই মনে করত মা মুরগিটা।

বাচ্চাগুলো যখন বড় হতে লাগল, তখন হাঁসের বাচ্চা আর মুরগির বাচ্চা দেখতে আলাদা হয়ে যেতে লাগল। হাঁসের বাচ্চাগুলোর স্বভাবও আলাদা হতে লাগল।

টিউবওয়েলের পাড়ে যেখানে পানি জমে, হাঁসের বাচ্চাগুলো সেই পানিতে নামতে শুরু করল।

বীণা বাচ্চাগুলোকে রোজ খাবার দেয়।

এখন হাঁসের বাচ্চাগুলো বীণাকেই ভাবে তাদের মা।

মা মুরগি তার বাচ্চাগুলোকে নিয়ে ঘোরে।

আর হাঁসের পাঁচটা বাচ্চা যখনই বীণাকে দেখে, তখনই তার পিছে পিছে হাঁটতে শুরু করে।

ধলা মাতুব্বরের গায়ে তেল মাখানো চলছে।

বীণা বলল, বাবা, তোমার এই গায়ে সরষের তেল মাখার দৃশ্যটা আমার অসহ্য লাগে।

ধলা মাতুব্বর বলল, ক্যান রে মা। অসহ্য লাগনের কী হইল?

তুমি খালি গায়ে বারান্দায় বসে আছো। আর আনসার তোমার গায়ে তেল মেখে দিচ্ছে। দৃশ্যটা বেশ আগলি।

আগলি মানে কী?

মানে কুিসত।

ধলা মাতুব্বর নাকের মধ্যে আঙুল চালিয়ে সরষের তেল মাখতে মাখতে বললেন, সরিষার ত্যাল হইল সর্বরোগের দাওয়াই। আমি এইটা মাখতাছি ঔষধ হিসাবে। ঔষধ মাখার ব্যাপার কুিসত হইলেও দরকারি। এইটা নিয়া তোর কথা তাই আমি মানতে পারলাম না।

বীণা বলল, বাবা, তুমি তাহলে গোসলখানায় যাও। সেইখানে গিয়ে তেল মাখো। আর শোনো, নিজের তেল নিজে মাখো। আনসারকে দিয়ে তেল মাখাচ্ছ, এইটাও বেশ আগলি। আগলি মানে কুিসত।

ধলা মাতব্বর বললেন, মা রে, এই সুন্দরপুর গ্রাম চলে আমার কথায়। আমি এই গ্রামের মাতুব্বর। আমার মুখের উপরে কেউ কথা কইতে সাহস পায় না। কিন্তু আমি তো একটা জায়গাতেই বান্দা। আমার মেয়ে বীণা যা বলে, তার উপরে কোনো কথা নাই। আচ্ছা আমি যাইতাছি গোসলখানায়। কিন্তু আমার বন্দুকটাতে কিন্তু ত্যাল মাখা হইব এই বারান্দাতেই। আর সেইটা মাখব আনসার মিয়াই। তাতে তোর আপত্তি নাই তো?

জি না। বন্দুকে তেল মাখালে আমার কী? খালি দেইখো, বন্দুকে য্যান গুলি না থাকে।

না মা। গুলি নাই। গুলি সব আলমারিতে তালা মাইরা রাখছি। গুলি আর বন্দুক এক জায়গায় রাখার মতোন বোকা আমি না।

বীণা বলল, তাহলে কোনো দুশ্চিন্তা নাই। তোমার কাজ তুমি করো। আনসারের কাজ আনসার করুক। আর আমার কাজ আমি করি।

স্কুলে তখন থার্ড পিরিয়ড চলছে।

জয়েন উদ্দীন স্যার পরিবেশ পরিচিতি ক্লাস নিচ্ছেন।

স্যার শুকনো কাঠির মতো। তাঁর মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। মাথার চুলে তিনি বোধ করি সুগন্ধি নারকেল তেল মাখেন।

রাশেদা, মারিয়া, কান্তা, রুনা সব হাঁ করে স্যারের কথা শোনে। ওদিকে আছে রাসেল, হামিদ, গণেশ, মিল্টন। তারা ডান পাশের বেঞ্চে বসেছে। মেয়েরা বসেছে বাঁ পাশের বেঞ্চে।

স্যার বললেন, গাছ কি খাবার খায়?

সবাই একযোগে চিৎকার করে ওঠে—জি স্যার।

স্যার বললেন, গাছ খাবার খায় কেমন করে? গাছের কি দাঁত আছে?

না স্যার। মেয়েরা হেসে কুটি কুটি। ছেলেরাও হাসে।

গাছের কি মুখ আছে?

না স্যার।

তাহলে?

সবাই চুপ।

কে বলবে?

রাসেল ক্লাসের ফার্স্টবয়। সে হাত তুলল।

রাসেল বলো—জয়েন স্যার বললেন।

রাসেল বলল, স্যার, গাছের শিকড় আছে। শিকড়কে মূল বলা হয়। গাছ মূল দিয়ে মাটি থেকে রস টেনে নেয়। সেই রসেই থাকে গাছের খাবার।

জয়েন স্যার বললেন, ভেরি গুড। কিন্তু গাছ কি খাবার কাঁচা খায়? গাছ খাবার রান্না করে না? কে বলবে।

রাসেল আবার হাত তুলল।

স্যার বললেন, এবার মেয়েদের মধ্য থেকে একজন বলো। কে বলবে?

কেউ হাত তোলে না।

স্যার বললেন, কান্তা বলো।

কান্তা দাঁড়াল। বলল, স্যার, গাছের পাতা খাবার রান্না করে। গাছের পাতা সূর্যের আলো দিয়ে খাবার রান্না করে।

সবাই খিলখিল করে হাসছে।

জয়েন স্যার বললেন, একদম ঠিক বলেছে কান্তা। গাছের পাতায় আছে ক্লোরোফিল। সূর্যের আলো দিয়ে ক্লোরোফিল রসগুলোকে রান্না করে ফেলে। এটাকে বলে সালোকসংশ্লেষণ।

এই সময় রাশেদা চিমটি দিল মারিয়াকে।

মারিয়া আর্তনাদ করে উঠল, উঁহু। কী করিস?

ওই ওদিকে রাশেদা ফিসফিস করে বলল মারিয়াকে। মারিয়া সামনের জানালা দিয়ে দেখল, স্কুলের মাঠে একটা মোটরসাইকেল এসে থামল। ধলা মাতুব্বর। তার পেছনে আনসার। আনসারের পিঠে একটা বন্দুক।

মারিয়া বলল, স্যার, একটু বাইরে যাব স্যার।

রাশেদা বলল, ওর সাথে আমাকেও যেতে হবে স্যার।

স্যার বললেন, আচ্ছা যা।

ওদের স্কুলে বাথরুম বানানো হয়েছে। ছেলেদের আলাদা বাথরুম। মেয়েদের আলাদা বাথরুম। সরকার স্কুলগুলোকে চালু রাখার ওপর জোর দিয়েছে। দেশে নতুন আওয়াজ উঠেছে, আমাদের স্কুল আমরাই গড়ব।

গ্রামের সবাই এখন স্কুলের খোঁজখবর নেয়।

লুনা আর রুনার বাবা স্কুলে বাথরুম বানিয়ে দিয়েছেন। তিনি দুবাইয়ে থাকেন। দুবাই থেকে তিনি টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন।

বাথরুমে যাওয়ার নাম করে রাশেদা আর মারিয়া বের হলো। তাদের আসল উদ্দেশ্য ধলা মাতুব্বরের কাণ্ড দেখবে।

ধলা মাতুব্বর বন্দুক নিয়ে এসেছেন। এবার না মইন স্যারকে তিনি অপমান করেন!

মাতুব্বর গেলেন শিক্ষকদের রুমে।

প্রধান শিক্ষিকা দীপারানী বললেন, কী খবর মাতুব্বর সাহেব? আসেন। বসেন।

ধলা মাতুব্বর বললেন, কই আপনার মইন মাস্টার কই। তারে ডাকেন।

দীপারানী বললেন, উনি অফিসের কাজে বাইরে আছেন।

ধলা মাতুব্বর বললেন, স্কুল টাইমে বাইরে থাকা? তার চাকরি আমি খামুই। মোবাইলে ফোন দেন। অহনই আসতে বলেন। লন। ফোন দেন।

দীপারানী বললেন, ফোন দিতে হবে না। মেয়েদের ফুটবলের জন্য হুইসেল কিনতে গেছেন। রেফারিগিরি করতে হলে বাঁশি লাগে। এসে পড়বেন।

না। আপনি ফোন দেন।

দীপারানী বললেন, আপনি যা বলার আমাকে বলেন।

আপনাকে বলব? আচ্ছা বলছি। এই যে আমার সাথে লোকটাকে দেখতাছেন, এর নাম আনসার আলী গুন্ডা। গুন্ডামিতে ওস্তাদ। আপনি আমারে থামাইতে পারবেন, এরে থামাইতে পারবেন না। এর মধ্যে সে আনছে বন্দুক। অহন মইন মাস্টার আইয়া পড়লে কী ঘটতে পারে, আমি এইটা জানি না। আনসাররে আমি থামাইতে পারি না।

রাশেদা বলল, ও ফ্রেন্ড। কী বুঝতাছ?

মারিয়া বলল, অবস্থা তো কেরাসিন।

রাশেদা বলল, অহন যদি মইন স্যার আইসা পড়ে, আনসার মিয়া না আবার স্যাররে অপমান করে।

মারিয়া বলল, আমার তো ডরে গা কাঁপতাছে। গুলি কইরা যদি দেয়?

রাশেদা বলল, অহন উপায় কী?

মারিয়া বলল, উপায় হোসেন, গোলাম নাই।

রাশেদা বলল, চল, রুনারে ডাইকা আনি। অর সাইকেলটা লাগব।

সাইকেল দিয়া কী করবি?

রাশেদা বলল, বীণা আপার কাছে যামু।

মারিয়া বলল, ঠিক। ঠিক।

ওরা তাড়াতাড়ি ফিরে গেল ক্লাসে। জয়েন স্যারকে বলল, স্যার, রুনাকে লাগব। তাড়াতাড়ি!

তারা হাঁপাচ্ছে।

কী হয়েছে? তোরা হাঁপাচ্ছিস কেন? স্যার বললেন।

রাশেদা বলল, ধলা মাতুব্বর বন্দুক আনছে স্যার। মইন স্যাররে খুঁজে। ফুটবল খেলা নিয়া গন্ডগোল হইছে। রুনারে লইয়া সাইকেলে একটা জায়গায় যাওন লাগব। স্যার সময় নাই। প্লিজ স্যার...

রুনা উঠে পড়ল। তারা দৌড়াচ্ছে।

সবার আগে রাশেদা। তার পেছনে মারিয়া। তার পেছনে রুনা।

রাশেদা বলল, রুনা আমি তোমার সাইকেলের রডে উঠি। তুমি ধলা মাতুব্বরের বাড়ি চলো। মারিয়া। তুই এক কাজ কর। বড় রাস্তার মোড়ে পাকুড়গাছের নিচে খাড়া। মইন স্যার আইলে তারে আটকা। আমি দেখি, বীণা আপারে পাই কি না।

রাশেদা সাইকেলের রডে বসেছে। রুনা সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিল। সাইকেল ছুটছে।

মাটির রাস্তা। সাবধানে সাইকেল চালাতে হয়। না হলে পড়ে যেতে হবে। রুনা সাবধানেই চালাচ্ছে। তবে রাশেদা বলছে, জোরে দোস্ত, জোরে।

রাশেদা আর রুনা পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেল ধলা মাতুব্বরের বাড়িতে।

বীণা তখন বারান্দায় বসে ভেজা চুল শুকাচ্ছে। তার হাতে একটা চিরুনি। তার সামনে একটা আয়না।

রাশেদা বলল, বীণা আপা। বীণা আপা।

বীণা মিষ্টি করে হাসল। বলল, এইবার ঠিক বলেছ। আন্টি না বলে আপা বলেছ। কী ব্যাপার তোমার রাশেদা? তোমার সঙ্গে এ কে?

ওর নাম রুনা। বীণা আপা, আমাদের বাঁচান।

কেন? কী হয়েছে?

আপনার আব্বা। বন্দুক নিয়া গেছেন আমাগো স্কুলে। আমাদের মইন স্যারকে মারার জন্য।

ক্যান?

মইন স্যারের সাথে মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়া আপনার আব্বার গন্ডগোল হইছিল। আমরা ফুটবল খেলি, আপনার আব্বা এইটা চায় না। সেইটা নিয়া গন্ডগোল। আপনের আব্বা অহন বন্দুক নিয়া গেছে আমাগো স্কুলে। মইন স্যাররে নাকি গুলি করব।

বীণা হাসল। বলল, না, গুলি করবে না। গুলি সব আলমারিতে তালা মারা। চাবি আমার কাছে আছে। আব্বা আমার কাছ থেকে চাবি চেয়েছিল। আমি দেই নাই। বন্দুক নিয়ে গেছে ভয় দেখাতে।

রাশেদা বলল, তবু আমার ভয় লাগতাছে। আপনি আমাগো সাথে চলেন স্কুলে।

বীণা বলল, আচ্ছা চলো।

আপনি সাইকেল চালাইতে পারেন? তাইলে আপনি সাইকেলটা নিয়া যান। আমরা হাঁইটা আসি।

বীণা বলল, তোমাদের এই ছোট সাইকেলে তো আমি উঠতে পারব না। আচ্ছা চলো বের হই। দেখি, একটা রিকশাভ্যান পাই নাকি।

রিকশাভ্যান পাওয়া গেল। রাশেদা আর বীণা সেই ভ্যানে উঠে পড়ল। রুনা সাইকেল চালিয়ে চলল আগে আগে।

এর মধ্যে স্কুলে মইন স্যার এসে গেছেন।

ধলা মাতুব্বর বললেন, মইন মাস্টার। আমি তো লোক খারাপ না। কিন্তু আনসার আলী গুন্ডা খুব খারাপ মানুষ। তিনটা খুন করছে। তারে তো আমি সামলাইতে পারতাছি না।

মইন স্যারের মুখ শুকিয়ে গেছে।

দীপারানী বললেন, আপনি মাতুব্বর মানুষ। আসছেন। বসেন। আমি চা আনাইতাছি। পাশের দোকানে খুব ভালো চা হয়। গরুর দুধের চা। ফ্লাস্কে কইরা আমজাদ মিয়া আইনা দিব।

ধলা মাতুব্বর বললেন, আমি তো চা খাইতে আহি নাই।

বীণা তখনই বলে উঠল, আব্বা, আমি গরুর দুধের চা খুব পছন্দ করি। আমি খাব।

ধলা মাতুব্বরের চোখে-মুখে বিস্ময়। তিনি বললেন, মা, তুমি ক্যান আইছ? ঘরদোর ফালায়া আইছ। দেখব কেডা?

জরিনার মা আছে আব্বা। এসেছি এ কথা বলার জন্য আব্বা, তুমি যে বন্দুক এনেছ তার গুলি তো আমার আলমারিতে। খালি বন্দুক দিয়ে তুমি কী করবে?

এহ রে। কলেজে পইড়া তোমার বুদ্ধি লোপ পাইছে বীণা। আমি আইছি ডর দেখাইতে। দিলা সব নষ্ট কইরা।

 কেন? স্কুলের মাস্টারদের তুমি ভয় দেখাবে কেন?

আমাকে খুব অপমান করেছে মা। এই মইন মাস্টার। তুমি তোমার আব্বার অপমান সহ্য করবা?

না। তা করব না। তবে আমি ন্যায়ের পক্ষে। আবার মিলমিশ করে চলার পক্ষে।

সমস্যা কী?

দীপারানী বললেন, আচ্ছা, আমি বলছি। মাতুব্বর সাহেব চান না মেয়েরা ফুটবল খেলুক। কিন্তু আমাদের কাছে সরকারের অর্ডার এসেছে। আমরা তো মেয়েদের টিম পাঠাতে বাধ্য। এই নিয়ে মইন স্যারের সাথে মাতুব্বর সাহেবের একটু কথা-কাটাকাটি হয়েছে। তেমন কিছু না। আমি স্কুলের পক্ষ থেকে ‘স্যরি’ বলছি।

বীণা বলল, আচ্ছা স্যরি বলেছে, ঠিক আছে।

ধলা মাতুব্বর তাকালেন মইন স্যারের দিকে। মইন স্যার যেই শুনেছেন, বন্দুক আছে গুলি নাই, অমনি তাঁর সাহস বেড়ে গেছে। তিনি বললেন, আমার মাথায় বুদ্ধি একটু শর্ট আছে, কারণ আমি ভারোত্তোলনের বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন। আমার গায়ে জোর বেশি। মাথায় বুদ্ধি শর্ট। এই যে দেখেন, এই যে ভদ্রলোক, কী নাম?

রাশেদা আর মারিয়া বলে উঠল, আনসার আলী গুন্ডা।

মইন স্যার বললেন, হ্যাঁ। আনসার আলী গুন্ডা। তাকে আমি এখনই মাথার ওপরে তুলে আছাড় মারতে পারব। দেখেন দেখেন। বলেই মইন স্যার আনসার আলীকে দুই হাতে ধরে মাথার ওপরে তুলে ফেললেন।

আনসার আলীও আল্লাহ-খোদা বাঁচাও বলে চিৎকার করে উঠল।

ধলা মাতুব্বর বলল, মা মা, দেখ। কী রকম বেয়াদব এই মাস্টার। আমি সহ্য করি কেমনে?

বীণা বলল, সত্যি তো আপনার মাথার বুদ্ধি শর্ট। এখন না হয় আব্বার সাথে গুলি নাই, কিন্তু আমি তো সঙ্গে করে গুলি এনেছি। তাকে দিলেই কিন্তু...

মইন স্যার বললেন, বন্দুক তো আমি এখনই কেড়ে নিতে পারব।

বীণা বলল, কতবার পারবেন? গন্ডগোল করলে কারোরই লাভ হবে না। সবাই মিলে এগিয়ে যেতে হয়। দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। আপনি আব্বাকে নিজে স্যরি বলেন। আর আমি আব্বার পক্ষ থেকে আপনাদের কাছে স্যরি বলছি। স্যরি স্যরি স্যরি।

মইন স্যার মুগ্ধ। এই মেয়ের চোখে-মুখে বোধ হয় জাদু আছে। তিনিও বললেন, স্যরি স্যরি স্যরি।

বীণা বলল, ওকে। এখন থেকে আমরা সবাই এক। আপনাদের মেয়েদের ফুটবল টিমের প্রধান পৃষ্ঠপোষক আমার আব্বা। হোসেন আলী মণ্ডল ওরফে ধলা মিয়া। আর এই টিমের কোষাধ্যক্ষ হলাম আমি। আমার নাম সাবিনা ইয়াসমিন ওরফে বীণা।

আর প্রধান কোচ হলেন মইন স্যার।

প্রধান শিক্ষিকা বললেন, তাইলে আমি কী?

বীণা বলল, আপনি হলেন আমাদের টিমের চেয়ারপারসন।

দীপারানীর মুখে হাসি ফুটে উঠল।

বীণা বলল, আব্বা, আমি তো কোষাধ্যক্ষ। আমার তো কোনো ফান্ড নাই। তুমি এখনই স্কুলের টিমের জন্য পাঁচ হাজার টাকা দান করো। বাচ্চারা কি খালি পায়ে ফুটবল খেলবে? আমি এদের প্রত্যেককে জুতা কিনে দেব।

স্কুলের বাচ্চারা সব স্যারদের কমনরুমের দরজায় ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। জানালার ওপাশেও অনেকেই।

তারা সবাই হাততালি দিয়ে উঠল।

রাশেদা আবেগে জড়িয়ে ধরল মারিয়াকে।

বীণা আবার রিকশাভ্যানে উঠেছে। তার চারদিকে ছেলেমেয়েরা।

রাশেদা বলল, বীণা আপা!

মারিয়া বলল, বীণা আপা!

বীণা বলল, বলো।

রাশেদা কাঁদতে লাগল।

মারিয়া কাঁদতে লাগল।

বীণা বলল, কী হয়েছে, তোমরা কাঁদছ কেন?

রাশেদা বলল, আপনি এত ভালো কেন?

মারিয়া বলতে গিয়ে কান্নার দমকে কিছুই বলতে পারল না।

তখন রাসেল স্লোগান ধরল, তোমার আপা আমার আপা,

সবাই সেই স্লোগানের জবাব দিল, বীণা আপা বীণা আপা।

মইন স্যারও এসেছেন। তিনি বললেন, দাঁড়া, তোদেরকে মিল দিয়ে স্লোগান বানিয়ে দিচ্ছি।

বলো, বীণা আপা চাঁদের আলো, বীণা আপা খুব ভালো।

বাচ্চারা স্লোগান দিতে লাগল, বীণা আপা চাঁদের আলো, বীণা আপা খুব ভালো।

বীণা বলল, স্যার। আপনার বুদ্ধি আসলেই শর্ট আছে। এই সব কী কথা! ওদের থামতে বলেন।

বীণা আপাকে নিয়ে রিকশাভ্যান তার বাড়ির দিকে যাচ্ছে। তাদের পাশ কাটিয়ে ধুলা উড়িয়ে ধলা মাতুব্বর আর আনসার আলীকে নিয়ে মোটরসাইকেল চলে গেল।

চলবে...

আরও পড়ুন