পুরোনো টাওয়ার (শেষ পর্ব)

অলংকরণ: আরাফাত করিম

বিশ

‘সাবধানে ঢোকো,’ সতর্ক করল রবিন। ‘ট্র্যাপডোরে আর অ্যাকসিডেন্ট করতে চাই না।’

টাওয়ারের ছাদে উঠতে শুরু করল দুজনে। ওদের ভারে দুলতে শুরু করেছে ওটা। মারাত্মক ঝুঁকিটা টের পাচ্ছে ওরা।

‘এখন আর পিছপা হওয়ার উপায় নেই!’ বলল কিশোর। অতি সাবধানে, ছাদের সমতলে ট্র্যাপডোরটার কাছে পৌঁছাল সে। পেছনে রবিন। ছিটকিনি খুলে পাল্লা তুলল দুজনে। উঁকি দিল পরিত্যক্ত পানির ট্যাংকের অন্ধকার তলায়। সাত ফুটের মতো গভীর, বারো ফুট ব্যাস।

খোলা মুখ দিয়ে শরীর গলিয়ে দিল কিশোর। কিনারা ধরে ঝুলে পড়ে, আগে পা দিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিল মেঝেটা ভেঙে পড়ে কি না। ‘ঠিকই আছে,’ রবিনকে বলল সে। রবিনও একইভাবে নিচে নেমে এল।

আবছা আলোয়, উৎসুক দৃষ্টি মেলে চারপাশে তাকাল ওরা। জায়গাটা মনে হলো আজেবাজে জিনিসে ভরা। গাদাখানেক পুরোনো কাঠের টুকরা, নানা রকম স্টিলের ডালা, তোবড়ানো টিনের কৌটা আর লোহার শাবল। সব ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। প্রথম নজরে বিলসনদের চোরাই সম্পদের দেখা মিলল না।

‘গয়না আর বন্ডগুলো এখানেই কোথাও আছে,’ বলল রবিন। ‘কিন্তু এখানে রেখে থাকলে সেগুলো খোলা জায়গায় ফেলে রাখবে না ডোবার। সম্ভবত এই সব আবর্জনার নিচে কোথাও রেখেছে।’

পকেট থেকে টর্চলাইট বের করে জ্বালল কিশোর। ওই আলোতে খুঁজতে শুরু করল রবিন। পুরোনো কৌটা আর কাঠের টুকরা ছুড়ে ফেলছে এক পাশে।

পুরো টাওয়ারের এক পাশটাতে খোঁজা শেষ হয়ে গেল। কোনো লাভ হলো না। দূরের পাশটায় আলো ফেলে লক্ষ করল কিশোর, বেশ কতগুলো তক্তা স্তূপ করে রাখা ওখানটাতে। আড়াআড়ি সাজিয়ে রাখার মধ্যে খানিকটা যেন সুশৃঙ্খল ভাব।

‘রবিন,’ বলল কিশোর, ‘ওই তক্তাগুলো এমনি এমনি ভেতরে ছুড়ে ফেলা হয়নি। নিশ্চয়ই কিছু লুকানোর জন্য কেউ ইচ্ছে করে ওভাবে সাজিয়ে রেখেছে।’

‘ঠিকই বলেছ।’

স্তূপটার দিকে লাফ দিল রবিন। দ্রুত হাতে তক্তা সরাতে লাগল।

ভেতরে পরিপাটি একটা ছোট্ট গোপন জায়গা। তার ভেতরে পড়ে আছে একটা ব্যাগ। সাধারণ একটা চটের বস্তা। ওটা টেনে বের করার সময়ই বুঝে ফেলল রবিন, বিলসন সম্পত্তি খোঁজার সমাপ্তি হলো।

‘এটাই হবে!’ শ্বাস টানল সে।

‘টাওয়ার ম্যানশনের চোরাই মাল!’ আনন্দে দম আটকে আসছে কিশোরের।

ট্র্যাপডোরের আলোর নিচে বস্তাটা বয়ে নিয়ে এল রবিন।

‘জলদি খোলো!’ তাড়া দিল কিশোর।

কাঁপা হাতে বস্তার মুখে প্যাঁচানো ফিতেটা খুলতে শুরু করল রবিন। অনেকগুলো গিঁট। একটা একটা করে খুলছে রবিন আর উত্তেজনায় ছটফট করছে কিশোর।

‘আমি দেখি তো,’ থাকতে না পেরে বলল সে।

অবশেষে দুজনের চেষ্টায় নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলো অবাধ্য গিঁটগুলো। ফিতে খুলে আলগা করা হল বস্তার মুখ। চটপট হাত ঢুকিয়ে দিল রবিন। টেনে বের করে আনল মূল্যবান পাথর বসানো পুরোনো আমলের একটা ব্রেসলেট।

‘গয়না!’

‘বন্ডগুলো দেখ তো!’

বস্তার ভেতরে আবার হাত ঢোকাল রবিন। আঙুলে মোটা একটা প্যাকেট বাঁধল। ওটা বের করে আনতেই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল দুজন।

‘বন্ড!’

ইলাস্টিক ব্যান্ড দিয়ে প্যাঁচানো কাগজের বান্ডিলটা সিকিউরিটি বন্ডের। প্রথম দলিলটা রকি বিচ শহরের এক হাজার ডলার মূল্যের একটা বন্ড।

‘মি. বিলসনের সম্পত্তি!’ বিজয় উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। ‘রবিন, ব্যাপারটা বুঝতে পারছ? রহস্যটার সমাধান করে ফেলেছি আমরা!’

প্রায় অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে পরস্পরের দিকে তাকাল দুজনে। তারপরই একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে নাচতে শুরু করল।

‘পেয়ে গেছি! আমরা পেয়ে গেছি!’ বাচ্চা ছেলের মতো চিৎকার করছে রবিন।

খুশিতে বত্রিশ পাটি দাঁত বেরিয়ে পড়েছে কিশোরের। ‘এবং ফ্রেডকে ছাড়াই!’ বলল সে।

‘এবার নিশ্চিত ছাড়া পেয়ে যাবেন মি. পিটারসন!’ উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে রবিন। ‘রহস্যটার সমাধান হয়ে সবচেয়ে যেটা ভালো হলো।’

‘একেবারে ঠিক বলেছ!’

আরও এক মিনিট ধরে আবিষ্কারের আনন্দটা উদ্‌যাপন করল ওরা। তারপর সিদ্ধান্ত নিল, মহামূল্যবান থলেটা নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রকি বিচে ফিরে যেতে হবে।

‘তুমি আগে নেমে যাও, কিশোর,’ রবিন বলল, ‘বস্তাটা তোমার হাতে ছুড়ে দিয়ে আমি নেমে আসব।’

বস্তাটা নিয়ে কেবল কাঁধে তুলতে যাবে রবিন, ঠিক তখনই ছাদের ওপর পায়ের শব্দ হলো। মুখ তুলে তাকাতেই দেখল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি মুখে, বাজে চেহারার এক লোক উঁকি দিচ্ছে ওপর থেকে।

‘থামো!’ নির্দেশ দিল লোকটা।

‘আপনি কে?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর।

‘সবাই আমাকে মিলার নামে চেনে। এটা আমার ঘর। এখানে যা কিছু আছে, সব আমার। আমার রুমে ঢোকার কোনো এখতিয়ার নেই তোমাদের। কিচ্ছু নিতে পারবে না এখান থেকে। আর হ্যাঁ, মালের বস্তাটা বের করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। খোঁজার কথা মাথায়ই আসেনি আমার।’

মুহূর্তের জন্য হতবাক হয়ে গিয়েছিল রবিন। এখন বলল, ‘আপনি হয়তো ঘুমাতে পারেন এখানে। কিন্তু এটা রেল কোম্পানির জায়গা। টাওয়ারের জিনিসগুলোও আপনার না। এখন মই বেয়ে নেমে যান তো। আমাদের নামতে হবে।’

‘ও, তাহলে মারপিট করার ইচ্ছে তোমাদের, তা–ই না?’ কুৎসিত স্বরে বলল মিলার। ‘আচ্ছা, দেখে নেব!’

কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধাম করে নেমে এল ট্র্যাপডোর। লাগিয়ে দেওয়া হলো বাইরে থেকে!

একুশ

‘আমাদের বেরোতে দিন!’ মিলারের উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।

‘এসব করে কিন্তু পার পাবেন না বলে দিলাম,’ গর্জে উঠল রবিন।

খিকখিক করে হাসল ওয়াটার টাওয়ারের ছাদে থাকা লোকটা। ‘তোমাদের ধারণা আমার মাথায় বুদ্ধিসুদ্ধি কিছু নেই, তাই তো! ভালো কথা, কিন্তু এটুকু বোঝার বুদ্ধি আছে, কখন বড়লোক হচ্ছি আমি। টাওয়ারে তোমরা যে গুপ্তধন খুঁজে পেয়েছ, সেটা নেওয়ার কোনো তাড়া নেই আমার। আজ না হয়, কদিন পরে বেচলেও চলবে।’

‘কদিন পরে!’ আঁতকে উঠল রবিন। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ‘তত দিনে তো আমরা হয় দম আটকে, না হয় না খেয়ে মারা যাব।’

মুষড়ে পড়া রবিনের কাঁধে হাত রাখল কিশোর। নিচু স্বরে বলল, ‘দুটোর কোনোটাই হবে না, রবিন। আমার মনে হয় না এখান থেকে বেরোনো খুব একটা কঠিন হবে। ট্র্যাপডোর দিয়ে না বেরোতে পারলে ট্যাংকের এক পাশ দিয়ে রাস্তা করে নেওয়া যাবে।’

শান্ত হলো রবিন। দুজনেই নীরব হয়ে থাকল। তাতে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল ওপরে থাকা মিলার। ডাক দিল, ‘কী ব্যাপার, কী করছ তোমরা?’

কোনো উত্তর নেই।

‘বেশ, আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু গুপ্তধনগুলো নিতে ফেরত আসব। উল্টোপাল্টা কিছু করার চেষ্টা কোরো না কিন্তু, তাতে ব্যথাই শুধু পাবে!’

কয়েক মিনিট জবাবের অপেক্ষা করল ছাদে দাঁড়ানো লোকটা। তারপর ধুপধাপ পা ফেলে হাঁটতে শুরু করল মইয়ের দিকে।

‘মইয়ের ধাপগুলো সব ভেঙে না ফেলে,’ উদ্বেগ ফুটল রবিনের গলায়। ‘তাহলে আর নামতে পারব না আমরা।’

আবারও তার কাঁধ চাপড়ে দিল কিশোর। ‘একটা লোহার পাইপ লক্ষ করেছি আমি, ওপর থেকে সোজা নিচে নেমে গেছে,’ বলল সে। ‘প্রয়োজন হলে ওটা ধরে পিছলে নেমে যেতে পারব।’

‘যদি ভেঙে বেরোতে হয়, তাহলে কতক্ষণ অপেক্ষা করতে চাও?’ জানতে চাইল রবিন।

জবাব দেওয়ার আগে খানিকক্ষণ চিন্তা করল কিশোর। পরিস্থিতি বিচার করছে। মিলার সম্পর্কে কিছুই জানা নেই ওদের। টাওয়ার থেকে কত দূরে যাবে সে, বোঝা যাচ্ছে না। খুব বেশি দূরে না গেলে হয়তো দেখা যাবে ট্যাংক ভেঙে বেরিয়েই গুণ্ডা লোকটার মুখোমুখি পড়তে হচ্ছে। কিশোরের মনে হলো, লোকটা যেহেতু ঘণ্টাখানেকের ভেতর ফেরার কথা বলেছে, কাজেই দূরে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই। খুব সম্ভবত সাহায্যের জন্য ওর মতো আরও কয়েকজন দোস্তকে ডেকে আনতে গেছে।

‘আমার মনে হয়, পনেরো মিনিট পরে করাটাই নিরাপদ,’ কিশোরের উপসংহার।

প্রতিটি সেকেন্ড যেন এক একটি ঘণ্টা, তারপরও শেষ পর্যন্ত পনেরো মিনিট পার হলো। একটা তক্তা কুড়িয়ে, ট্র্যাপডোরটাকে নিচ থেকে ঠেলা দিতে লাগল দুজনে। কিন্তু নড়ল না ওটা।

‘এবার কী করব?’ জানতে চাইল রবিন।

টর্চলাইট জ্বেলে ট্র্যাপডোরের চারপাশের জোড়াটা পরীক্ষা করল কিশোর। অল্পক্ষণের ভেতর একটা জায়গা বের করে ফেলল যেখানের কাঠ শুকিয়ে মুড়মুড়ে হয়ে আছে।

‘ওখানটায় একটা ফুটো করা কঠিন হবে না, রবিন,’ ইশারায় দেখাল সে। ‘তারপর আমাকে উঁচু করে ধরবে তুমি, যাতে ওই পর্যন্ত হাত নিতে পারি। তখন ছিটকিনি সরিয়ে দিতে পারব।’

একটা লোহার শাবল তুলে নিয়ে চোখা মাথা দিয়ে প্রচণ্ড একটা খোঁচা দিল রবিন, ট্র্যাপডোরের কিনারায়। মড়াত করে একটা শব্দ হলো। শাবল  দিয়ে আবার একটা খোঁচা দিল রবিন। জোড়াটা ফাঁক হয়ে গেল। এবার সে আর কিশোর মিলে ফাঁকটার ভেতর দিয়ে শাবলের মাথা ঢুকিয়ে চাড় দিতে শুরু করল।

খানিক বাদেই পাশাপাশি দুটো চরাট আলগা করে ফেলতে পারল ওরা। এবার রবিনের কাঁধে দাঁড়িয়ে ফাঁকা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিল কিশোর। ট্র্যাপডোর আটকে রাখা ছিটকিনিতে হাত লাগতেই ওটা সরিয়ে দিল সে। নিচ থেকে তক্তা দিয়ে ঠেলা দিল রবিন।

ব্যস, মুক্তি আর ঠেকায় কে!

ফাঁকা দিয়ে নিজেকে টেনে তুলেই ঝটপট ছাদের কিনারে চলে এল কিশোর। নিচের চারপাশে নজর বুলিয়ে দেখল। মিলার নেই। এমনকি আর কোনো লোকেরও দেখা মিলল না কোথাও।

‘সামনে রাস্তা পরিষ্কার!’ হাঁক ছাড়ল সে।

এবার মূল কাজ। চোরাইমালগুলো বের করে নিয়ে যেতে হবে টাওয়ার থেকে। কিশোর ট্র্যাপডোরের কাছে ফিরে এলে নিচ থেকে থলেটা তুলে দিল রবিন। তারপর ছাদে উঠে এল কিশোরের কাছে। দ্রুত মই বেয়ে নিচে নেমে এল কিশোর। ওপর থেকে থলে ছুড়ে দিল রবিন, তারপর কালবিলম্ব না করে নিচে চলে এল।

‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেটে পড়তে হবে এখান থেকে!’ বলেই মোটরসাইকেলের দিকে দৌড় দিল কিশোর। সঙ্গে রবিন।

‘চলো, জিনিসগুলো ভাগ করে নিই। বহন করতে সুবিধে হবে,’ বলল কিশোর।

থলে খুলে বন্ডের কাগজগুলো রবিনের হাতে দিল সে। সঙ্গে সঙ্গে ওগুলো ঠেলে পকেটে ভরে ফেলল রবিন। গয়নাভরা থলেটা মুচড়ে নিজের প্যান্টের পকেটে চালান করে দিল কিশোর। লাফিয়ে মোটরসাইকেলে উঠল দুজনে। কিক দিয়ে স্টার্ট দিল, ইঞ্জিনের গর্জন তুলে ছুটতে শুরু করল রকি বিচের উদ্দেশে। পুরানো ওয়াটার টাওয়ার ছাড়িয়ে মাইল কয়েক আসার পর অবশেষে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ওরা। হাসি ফুটে উঠল মুখে।

‘সবচেয়ে বেশি অবাক হবে কে, সেটাই ভাবছি। জন নাকি কোরিয়া বিলসন, না চিফ ফ্লেচার, নাকি— ’

‘আরেকজনের কথা ভাবছি আমি—চাচা!’ কিশোর বলল।

‘ঠিকই বলেছ,’ একমত হলো রবিন। ‘আর সবচেয়ে নাখোশ যে ব্যক্তিটি হবেন, তিনি আমাদের ডগলাস ফ্রেড!’

‘তোমার কী ধারণা, কিসের সূত্রের কথা বলছিল ও সে সময়?’

‘আমার তো মনে হয়, আদৌ কোনো সূত্র পায়নি সে। হয়তো আমাদের সঙ্গে লেগে থাকত, তারপর আমরা চোরাইমালগুলো আবিষ্কার করলে নিজে বাহবা কুড়াত। যাতে চিফ ফ্লেচার ওকে পুলিশে চাকরি দেন।’

‘তা, এই মালগুলো নিয়ে প্রথমে কোথায় যাচ্ছি আমরা?’ খানিক বাদে জিজ্ঞেস করল রবিন।

বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে করতে এল ওরা। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো, যেহেতু মি. বিলসন জিনিসগুলো খোঁজার ভার দিয়েছিলেন ওদের চাচাকে, কাজেই তার হাত দিয়েই ওগুলো মালিককে পাঠানোটা সমীচীন হবে।

আধঘণ্টার মধ্যে বাড়ির গেটে পৌঁছাল দুই গোয়েন্দা। সুসংবাদটা শুনে আনন্দে আত্মহারা হলেন কিশোরের চাচা-চাচি।

‘অসাধারণ! এককথায় অতুলনীয়!’ চেঁচিয়ে উঠলেন মেরি চাচি।

মি. পাশার মুখে চওড়া হাসি। ‘নিঃসন্দেহে তোমাদের নিয়ে গর্বিত আমি।’ ছেলেদের পিঠ চাপড়ে দিলেন তিনি। ‘বিলসনদের সংবাদটা দেওয়ার সম্মানটুকু তোমাদেরই প্রাপ্য।’

‘চিফ ফ্লেচারকে জানানো হবে না?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর। ‘মিলারের খবরটা জানাতে চাই তাঁকে।’

‘আর পিটারসনদের দাওয়াত দিয়ে এনে সংবাদটা শোনাতে হবে,’ যোগ করল রবিন।

মি. পাশা বললেন, তিনি ঠিক করেছেন বিলসনদের বাড়িতে একটা মহাসম্মেলনের আয়োজন করবেন। টাওয়ার রহস্যের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকেই উপস্থিত থাকবে সেখানে। সবাইকে ফোন করে মিটিংয়ের কথা বলে দেওয়ার জন্য পরামর্শ দিলেন তিনি ছেলেদের।

জন বিলসনকে জানানোর দায়িত্বটা দেওয়া হলো কিশোরকে। এপাশ থেকেই বৃদ্ধের বিস্ময়মিশ্রিত চিৎকার শুনতে পেল সবাই। ‘বলো কী! আমি তো ভাবতেও পারিনি কাজটা তোমরা করতে পারবে!’ বারবার একই কথা বলতে লাগলেন তিনি।

চেঁচিয়ে বোনকে ডেকে সংবাদটা জানালেন। তারপর বললেন, ‘কোরিয়া বলতে বলেছে, ও নাকি রকি বিচের সবচেয়ে ভারমুক্ত মানুষ এখন। এসব কাজ ওর একেবারেই পছন্দ ছিল না।’

রাতে তাঁদের বাড়িতে মিটিংয়ের ব্যাপারে এককথায় রাজি হয়ে গেলেন মি. বিলসন। বললেন, মি. পিটারসন যেন অবশ্যই থাকেন। মি. পাশা যেন এই মুহূর্তে চিফ ফ্লেচারকে বলে তাঁকে আনানোর ব্যবস্থা করেন।

‘দারুণ মজা হবে,’ রাতের খাবারের সময় বলল কিশোর। ‘তুমিও চলো না, চাচি। যাবে?’

‘অবশ্যই যাব,’ বললেন মেরি চাচি। ‘দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছি, কী বলেন মি. পিটারসন আর বিলসনরা, আর চিফ ফ্লেচারই বা কী বলেন!’

‘মুসারও থাকা উচিত,’ বলল রবিন। ‘ওর গাড়ি চুরির সূত্র ধরেই তো রেড ডোবারের খোঁজ পেয়েছিলাম আমরা।’ মুসাকে ফোন করে জানাতেই আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল সে। জানাল, রাতে অবশ্যই ওদের সঙ্গে টাওয়ার ম্যানশনে দেখা করবে।

‘আর একজনকে বলা বাকি আছে,’ দুষ্টুমির ঝিলিক কিশোরের চোখে। ‘ডগলাস ফ্রেড। ওর মুখের ভাবটা কী হয়, দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছি আমি।’

‘এ কথাটা অন্তত বলা যায় ওকে, রহস্যটার সমাধান করে ফেলেছি আমরা,’ টিপ্পনী কাটল রবিন।

চিফ ফ্লেচারকে ফোন করলেন মি. পাশা। তখুনি মি. পিটারসনকে ছেড়ে দেবেন বলে কথা দিলেন চিফ। তাঁকে নিয়ে বিলসনদের বাড়িতে হাজির থাকবেন জানালেন। ধৈর্য ধরে চাচার ফোন শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল কিশোর। তারপর ও ফোন করল ডিটেকটিভ ফ্রেডের বাসায়। ইচ্ছে করে তাকে আর কিছু না বলে শুধু বিলসনদের বাসায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাল। মাথা মোটা লোকটাকে আরও কিছুক্ষণ অন্ধকারে রেখে, আকাশ-পাতাল অনুমান করতে দেওয়ার লোভটা সামলাতে পারল না সে।

রাত আটটার দিকে একটার পর একটা গাড়ি এসে হাজির হলো বিলি ম্যানশনের ফটকে। পাশা পরিবার ভেতরে ঢুকেই দেখল, ততক্ষণে পৌঁছে গেছে পিটারসনরা। যমজ দুই বোন দৌড়ে এসে কিশোর আর রবিনের হাত জড়িয়ে ধরল। বব আর ওর বাবাও ওদের হাত আঁকড়ে ধরে ঝাঁকাতে লাগলেন প্রবলভাবে। মি. পিটারসন বললেন, ‘কী বলে যে তোমাদের ধন্যবাদ দেব!’

পানিতে ভরে গেছে তার স্ত্রীর চোখ। তিন গোয়েন্দার প্রশংসা করতে গিয়ে গলা কাঁপতে লাগল তার। ‘তোমরা যে কতটা উপকার করলে, তা কল্পনাও করতে পারবে না,’ চোখের পানি মুছে বললেন তিনি।

ডগলাস ফ্রেড উপস্থিত হলো সবার শেষে। এসেই হাঁকডাক শুরু করল জানার জন্য, ঘটনাটা কী। কিশোর আর রবিন ভেবে রেখেছিল, খানিকটা মজা করবে ওকে নিয়ে। কিন্তু ডলি আর নিরা উৎসাহ চেপে রাখতে পারল না। চেঁচিয়ে উঠল, ‘গয়না আর বন্ডগুলো পেয়ে গেছে কিশোর আর রবিন! ওরাই সত্যিকারের হিরো!’

কিশোর আর রবিনের মুখের দিকে অবিশ্বাসীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ডিটেকটিভ ফ্রেড। ‘তোমরা!’ প্রায় চিৎকার করে উঠল সে। ‘তার মানে গুপ্তধন বের করে ফেলেছে তিন গোয়েন্দা?’ সবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল সে।

সবাই মাথা নেড়ে সায় দিতে বলল, ‘তার মানে আমার বাবা সম্পূর্ণ দায়মুক্ত এখন।’

‘তাহলে ওই ৯ শ ডলারের ব্যাপারটা?’ নাছোড়বান্দার মতো জিজ্ঞেস করল ফ্রেড। ‘কোত্থেকে ওটা পেলেন তোমার বাবা?’

গম্ভীর হয়ে গেল মি. পিটারসনের মুখ। ‘আমি দুঃখিত,’ সাফ জানিয়ে দিলেন তিনি, ‘টাকার ব্যাপারটা গোপন রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আমি, তাই বলতে পারছি না।’

সবাইকে অবাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন কোরিয়া বিলসন। মি. পিটারসনের পাশে গিয়ে বললেন, ‘আমিই বলছি কোথায় টাকা পেয়েছে সে। আমি নিজেই টাকাটা ওকে ধার দিয়েছিলাম।’

‘তুমি!’ অবিশ্বাসে চেঁচিয়ে উঠলেন তার ভাই।

‘হ্যাঁ। এই একটি কাজে তোমার কোনো পরামর্শ চাইনি আমি। জানতাম, তুমি রাজি হবে না। পিটারসনের টাকা লাগবে জেনে আমি জোর করে ওকে ধার দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলাম যে কাউকে কিছু বলতে পারবে না। এরপর যখন চুরিটা হলো, তখন একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়লাম। কীভাবে কী হলো, কিছুই মাথায় আসছিল না। চিন্তায় চিন্তায় পাগলের দশা। এখন সব মিটে যাওয়াতে আমি খুব খুশি।’

মিস বিলসনের বক্তৃতায় বাকহারা সবাই। মি. পিটারসন হ্যান্ডশেক করলেন মহিলার সঙ্গে। ‘থ্যাংক ইউ মিস কোরিয়া,’ কম্পিত কণ্ঠে শুধু এটুকু বলতে পারলেন।

কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলেন জন বিলসন। ‘একটা ঘোষণা দিতে চাই। দয়া করে সবাই একটু বসবেন?’

বিলি ম্যানশনের মস্ত লিভিংরুমে সবাই আসন গ্রহণ করতে তিনি বলে চললেন, ‘আমি আর আমার বোন কোরিয়া অনেক আলোচনা করেছি। এই চুরির পুরো ঘটনাটাতে দারুণ শিক্ষা পেয়েছি আমরা। ভবিষ্যতে রকি বিচের সবার থেকে আর বিচ্ছিন্ন থাকব না আমরা। আমাদের জমির খানিকটা—পুকুরওয়ালা অংশটা, আমরা দান করে দিচ্ছি শহরের লোকদের পিকনিক আর সুইমিং স্পট হিসেবে।’

‘হুর রে!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

মেরি চাচি বললেন, ‘সবাই দারুণ খুশি হবে।’

‘এখনো কথা শেষ হয়নি আমার,’ বলে গেলেন জন বিলসন। ‘মি. পিটারসনের কাছে সবার সামনে ক্ষমা চাইছি আমি। আমাদের কারণে যে সমস্যা হয়েছে তোমাদের, পিটারসন, তার জন্য ক্ষমা চাইছি আমি আর কোরিয়া। তুমি যদি আবার কাজে যোগ দাও আমাদের সঙ্গে, প্রতিজ্ঞা করছি, তোমার ভদ্রতার যথাযোগ্য সম্মান তুমি পাবে। তোমার বেতন বাড়িয়ে দেব আমি। আর তোমার শখের গ্রিনহাউসটাও তৈরি করে দেব। ইচ্ছেমতো যত খুশি বিরল ফুল ফোটাতে পারবে তুমি।’

দম আটকে এল ঘরে উপস্থিত লোকজনের। সবার চোখ গিয়ে পড়ল মি. পিটারসনের ওপর। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন সাবেক কেয়ারটেকার। মি. বিলসনের কাছে গিয়ে জোরে জোরে হ্যান্ডশেক করলেন।

‘কিচ্ছু মনে করিনি,’ বললেন তিনি। ‘খুশি মনে আগের কাজে যোগ দিতে প্রস্তুত আমি। আর ওই গ্রিনহাউসটা হলে তো কথাই নেই। আমি শিওর, অজস্র ব্লু-রিবন ফুটিয়ে দেব আপনাকে আর মিস কোরিয়াকে।’

কেয়ারটেকার তার চেয়ারে ফিরে গেলে আবার বললেন জন বিলসন, ‘আর একটা জিনিসই বাকি থাকল—পুরস্কারটা। ৫০ হাজার ডলারের পুরস্কারটা পাচ্ছে কিশোর, মুসা আর রবিন। যারা পুরানো টাওয়ার রহস্যের সমাধান করল।’

‘৫০ হাজার ডলার!’ চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসবে যেন ডিটেকটিভ ফ্রেডের। ‘এত টাকা—দুটো স্কুলপড়ুয়া ছেলের কপালে! আর আমার মতো এমন একজন গোয়েন্দা কিনা—’

ভাবনাটা তার জন্য বোধ হয় অতিরিক্তই হয়ে গেল। ধপ করে হাতে মাথা গুঁজে গুঙিয়ে উঠল সে। একে অন্যের দিকে তাকানোর ঝুঁকি নিল না কিশোর আর রবিন। অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখেছে দুজনে।

‘হ্যাঁ, ৫০ হাজার ডলার,’ আগের কথার খেই ধরলেন মি. বিলসন। ‘তিনজনে ভাগ করে নেবে।’

চেক বই বের করে লিখে কিশোরের হাতে দিলেন তিনি। ধন্যবাদ দিয়ে চেকটা নিল কিশোর। এবার সবাইকে ডাইনিংরুমে নিয়ে স্যান্ডউইচ, কেক আর কোল্ড-ড্রিংকস দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো।

খাওয়ার সময় প্রত্যেকে ভূয়সী প্রশংসা করতে লাগল ছেলেদের। মুখভরা হাসি নিয়ে বাহবা নিলেও রহস্যটা শেষ হয়ে যাওয়াতে ওদের খানিকটা খারাপই লাগছে। মনে মনে ভাবছে, কিশোর আরেকটা রহস্য পেলে কী ভালোই না হতো।

পরে, বাসায় ফেরার পথে ছেলেদের জিজ্ঞেস করলেন মি. পাশা, ‘এত টাকা দিয়ে কী করবে তোমরা?’

জবাব দিতে এক মুহূর্ত দেরি হলো না কিশোরের, ‘বেশির ভাগটা ব্যাংকে রেখে দেব।’

রবিন যোগ করল, ‘বহুদিন ধরে আমি আর কিশোর ঠিক করে রেখেছিলাম, খোঁয়াড়ের তিনতলায় একটা ক্রাইম ল্যাব বানাব। এবার সেটা করতে পারব। তুমি কী বলো, বাবা?’

মুচকি হেসে বললেন দুঁদে গোয়েন্দা, ‘দারুণ বুদ্ধি!’

(শেষ)