পুরোনো টাওয়ার (দশম পর্ব)

অলংকরণ: আরাফাত করিম

কী মনে হয়, টাওয়ারের ওই টর্চ হাতে লোকটা কি দেখেছে আমাদের?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর।

‘দেখতেও পারে, আবার না-ও পারে। অনেক দ্রুত নিচু হয়েছি আমরা।

টর্চের জোরালো আলোটা ওদের ওপর আর পড়ল না। টাওয়ারের একটা জানালা দিয়ে অন্যদিকে মারা হলো। তারপর নিভে গেল।

‘তা কী করবে এখন?’ জিজ্ঞেস করল রবিন। ‘আমরা কি ম্যানশনের ওপরে গিয়ে তদন্ত চালিয়ে যাব?’

রাজি হলো না কিশোর। ওর মতে, তাতে বিপদে পড়ে যেতে পারে ওরা। চিনতে না পারলেও ওদের হয়তো দেখেছে টাওয়ারের লোকটা।

‘টাওয়ারে কে ছিল, জানা দরকার,’ বলল রবিন। ‘এমনও হতে পারে, বিলসনরা হয়তো কিছুই জানে না লোকটার ব্যাপারে।’

নরম গলায় হাসল কিশোর। ‘লাগামছাড়া কল্পনা করে লাভ নেই, রবিন।’ পরামর্শ দিল সে।

চলে যাবে না সামনে এগোবে, তা–ই নিয়ে যখন তর্কবিতর্ক করছে ওরা, তখন হঠাৎ করেই ঘটনার মোড় অন্যদিকে ঘুরে গেল। টাওয়ারের পাশ ঘুরে ঘেউ ঘেউ করতে করতে ছুটে এল পুলিশের একটা প্রকাণ্ড কুকুর। পরিষ্কার বোঝা গেল, ছেলেদের গন্ধ পেয়েছে ওটা। সোজা ছুটে আসছে ওদের দিকে।

পড়িমরি করে ছুটল দুই গোয়েন্দা। কিন্তু পুলিশের কুকুরের সঙ্গে কি আর দৌড়ে পারা যায়! কয়েক মুহূর্তের ভেতর সামনে গিয়ে, দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ওদের পথ আটকে দাঁড়াল সে, গলা ফাটিয়ে ডাকতে শুরু করল।

‘ধরা পড়ে গেছি আমরা,’ বলল কিশোর। ‘এখন কুকুরটা আমার পায়ের মাংস খুবলে না নিলেই বাঁচি।’

নরম গলায় প্রাণীটার সঙ্গে খাতির জমানোর চেষ্টা করল দুজনে। ওদের পাত্তাই দিল না ওটা।

‘ভালোই, কী করব এখন?’ কুকুরটার বিকট চিত্কারে মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে রবিনের।

‘উদ্ধারের অপেক্ষায় থাকতে হবে আরকি,’ নিমের তেতো ঝরল কিশোরের গলায়।

একমুহূর্ত পর দেখল ওরা, লাফাতে লাফাতে একটা আলো এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। খানিক বাদেই হাজির হলেন মি. বিলসন। তাজ্জব হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন বৃদ্ধ।

‘একটু খান্ত আর দিতে পারলে না তোমরা?’ বললেন তিনি। ‘তা এবার কোন ধান্দায়—আরও খোঁড়াখুঁড়ি, নাকি?’

সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে পারল না ছেলেরা। ধরে পড়ায় দারুণ বিব্রত অবস্থা ওদের। তবে স্বস্তির বিষয় এই যে লোকটা ওদের আসল উদ্দেশ্যের কথা কিছু টের পাননি। উত্তর না পেয়ে নিজের অনুমানটাকেই সত্যি ধরে নিলেন প্রাসাদমালিক।

‘ওসব করে আমার জমির বারোটা বাজাতে দিচ্ছি না আমি আর,’ খেঁকিয়ে উঠলেন তিনি। ‘এই পাহারাদার কুকুরটাকে ধার এনেছি আমি। লুকা। সবাইকে দূরে রাখবে সে। কোনো কারণে যদি আমার সঙ্গে দেখা করার দরকার হয়, আগে ফোন দেবে। লুকাকে তখন বেঁধে রাখব।’

‘টর্চ হাতে টাওয়ারের ওই লোকটা কে?’ বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

‘আমার বোন। ওর ধারণা হয়েছিল যে তোমাদের চেয়ে ওর মাথায় বুদ্ধি বেশি, পুরোনো টাওয়ারে লুকানো জিনিসগুলো হয়তো খুঁজে বের করতে পারবে। কিছুই পেল না!’

হাসি চাপল কিশোর আর রবিন।

মি. বিলসন বলে চললেন, ‘তারপর কোরিয়ার মনে হলো, হাইপাওয়ারের টর্চটা দিয়ে মাটিতে আলো ফেলবে। ভেবেছিল, জানাজানি হওয়ায় অবাঞ্ছিত লোকজনের আনাগোনা বেড়ে যেতে পারে এখানে। দেখা যাচ্ছে, ঠিকই ভেবেছিল সে।’

হেসে ফেলল ছেলেরা। ‘তা অবশ্য ঠিক,’ স্বীকার করল কিশোর। ‘রেক্স আর উনি থাকলে ছিঁচকে চোর নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না আপনাকে।’

জন বিলসনকে ‘গুডনাইট’ জানিয়ে ড্রাইভওয়ে ধরে ফিরে আসতে লাগল ছেলেরা। কুকুরটা এবার আর লাগল না ওদের পেছনে। কিশোরেরা চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত বিলসনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকল ওটা।

লম্বা লম্বা পা ফেলে বাড়ির পথে হাঁটা ধরল ওরা। রবিন বলল, ‘মনে হচ্ছে উত্তেজনা দিয়ে শুরু হওয়া দিনটা কেমন ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেল।’

‘হ্যাঁ। এতগুলো কাজের কোনোটা থেকেই কোনো ফল হলো না।’

রাতের খাবারের সময় ছেলেদের মুখে কুকুরের সঙ্গে মোকাবিলার কাহিনি শুনে হাসতে লাগলেন মি. পাশা আর মেরি চাচি। কিন্তু বিলসনদের চুরির ঘটনাটা সাজানো হতে পারে কি না, কিশোর জিজ্ঞেস করতে, গম্ভীর হয়ে গেলেন দুজনই।

‘তা তো সম্ভব বটেই,’ জবাব দিলেন মি. পাশা। ‘কিন্তু বিলসনরা এত ধনী যে ওদের অমন একটা কাজ করার পেছনে কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছি না আমি। আমাদের বোধ হয় মূল চিন্তাধারার সঙ্গে লেগে থাকাই ভালো। অর্থাৎ সিন্দুক থেকে সত্যি সত্যি গয়না আর বন্ড চুরি হয়েছে, আর কাজটা ডোবারেরই।’

রাতে বিছানায় শুয়ে রবিনকে বলল কিশোর, ‘কাল শনিবার। সারা দিন ফ্রি পাচ্ছি। তাই বলছি কী, চলো, আগামীকাল রাতের আগেই পুরো রহস্যটা সমাধান করে ফেলব, এ রকম একটা টার্গেট হাতে নিই।’

‘বিশাল চাওয়া, কিন্তু আমি আছি তোমার সঙ্গে,’ হাসল রবিন।

পরদিন সকাল সকাল উঠে আলোচনা করতে বসল ওরা, তদন্তের ধরন কেমন হবে।

‘আমার মনে হয়, সম্পূর্ণ নতুন একটা দিকে তদন্ত করা উচিত আমাদের,’ পরামর্শ দিল রবিন।

‘কোন দিকে?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর।

‘রেল কোম্পানির সূত্র ধরে।’

ওর পরিকল্পনা বলল রবিন। একটা জিনিস ওদের দেখা বাকি, রকি বিচের আশপাশে কাজ করার সময় রেড ডোবারের অভ্যাস কি ছিল। ওর পরিচিত দু্–একজন লোকের সঙ্গে যদি কথা বলতে পারে ওরা, তাহলে হয়তো চোরাই সম্পদের ব্যাপারে কোনো নতুন তথ্য জানা যেতে পারে।

‘ভালো বুদ্ধি, রবিন,’ একমত হলো কিশোর। ‘চলো, দুপুরের খাবার সঙ্গে নিয়ে, সারা দিনের জন্য মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।’

‘ঠিক আছে।’

অনেক ভোরে বেরিয়ে পড়েছেন মি. পাশা। তাই তাঁর সঙ্গে আর দেখা হলো না ওদের। মেরি চাচি ছেলেদের পরিকল্পনার কথা শুনে বললেন, আইডিয়াটা চমত্কার। তখনই কতগুলো স্যান্ডউইচ বানিয়ে দিতে চাইলেন ওদের। বেরোনোর জন্য রেডি হতে হতেই ছোট দুই বাক্স খাবার ধরিয়ে দিলেন তিনি ছেলেদের হাতে, লাঞ্চের জন্য।

‘গুডবাই অ্যান্ড গুডলাক!’ ছেলেরা মোটরসাইকেলে উঠতে হেঁকে উঠলেন তিনি।

‘থ্যাঙ্কস, চাচি!’ সমস্বরে বলে রওনা হয়ে গেল দুজনে।

রকি বিচ রেলস্টেশনে পৌঁছাল কিশোর আর রবিন। স্টেশনমাস্টারকে জিজ্ঞেস করতে জানল, লোকটা মাত্র বছরখানেক হলো যোগ দিয়েছে এই কোম্পানিতে। রেড ডোবারকে চেনে না সে।

‘ও কি যাত্রীবাহী ট্রেনে কাজ করত?’ জানতে চাইল লোকটা।

‘মনে হয় না,’ জবাব দিল কিশোর। ‘সম্ভবত দেখাশোনার কাজ করত সে।’

‘সে ক্ষেত্রে,’ বলল স্টেশনমাস্টার, ‘আমার পরামর্শ হলো, হাইওয়ে ধরে সোজা রেলক্রসিংগুলোতে চলে যাও। ওখানকার পুরোনো দুজন ফ্লাগম্যানকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, যারা এখনো চাকরিতে আছে। ওরা দুজনই মনে হয় রেলের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে চেনে। গত ৫০ বছর পর্যন্ত রেলের নাড়িনক্ষত্র ওদের জানা।’ হাসল লোকটা।

শহরের কয়েক মাইল বাইরে, রেলক্রসিং দুটি ছেলেদের চেনা। এখন ওদিকেই যেতে লাগল ওরা। প্রথমটাতে এসে শুনল, নিয়মিত যে ফ্লাগম্যান থাকে ওখানে, অসুস্থ হয়ে বাড়িতে আছে সে। বদলি লোকটা নামও শোনেনি রেড ডোবারের। আগে বাড়ল কিশোর আর রবিন।

পরের ক্রসিংটাতে এসে বৃদ্ধ ফ্লাগম্যানের সঙ্গে দেখা হলো ওদের। ডেভ ওয়ারেন। কাজে ব্যস্ত। উজ্জ্বল নীল চোখ মেলে খানিকক্ষণ ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু খুঁজল। এরপরই ওদের অবাক করে দিয়ে বলল, ‘তুমি কিশোর, আর তুমি রবিন। বিখ্যাত তিন গোয়েন্দার সদস্য। গোয়েন্দা রাশেদ পাশা কিশোরের চাচা।’

‘আপনি আমাদের চেনেন!’ বলল কিশোর। ‘কিন্তু আপনাকে তো কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।’

‘তা দেখনি,’ প্রত্যুত্তরে বলল বৃদ্ধ। ‘কিন্তু আমার একটা নিয়ম হলো, খবরের কাগজে ছাপা প্রত্যেকের চেহারা আমি মুখস্থ করে রাখি। কখন কোন দুর্ঘটনায় কাউকে শনাক্ত করার জন্য ডাক পড়ে আমার, কে জানে।’

রোমহর্ষক চিন্তাটা কল্পনা করে ঢোঁক গিলল ছেলেরা। কিশোর জিজ্ঞেস করল বৃদ্ধকে, রেড ডোবার নামে কোনো রেলকর্মীর কথা মনে আছে কি না তার।

‘ডোবার নামে একজনের কথা অবশ্য মনে পড়ছে, কিন্তু আমি যখন চিনতাম, তখন ওর নাম রেড ছিল না। তবু বোধ হয় ওরা একই লোক ছিল। মানে, যে লোকটার জেল হলো বলে লিখেছে পত্রিকায়, তার কথাই তো বলছ তোমরা, নাকি?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই লোকই!’

‘জেল থেকে বেরিয়েছে সে?’ প্রশ্ন করল ডেভ ওয়ারেন।

‘লোকটা মারা গেছে,’ জবাব দিল রবিন। ‘রাশেদ আঙ্কেল একটা কেসে কাজ করছেন, যাঁর সঙ্গে রেড ডোবারের সম্পর্ক আছে। তাই ওর ব্যাপারে খানিকটা খোঁজখবর করছি আমরা।’

‘তাহলে তোমাদের যেটা করতে হবে,’ বলল ফ্লাগম্যান, ‘রকি বিচ হয়ে সোজা কোস্টলাইন রেলরোডে চলে যাও। ওখানেই কাজ করত ডোবার। চেরিভিল স্টেশনের আশপাশেই থাকত সে। এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয় জায়গাটা।’ ইশারায় উত্তর দিকটা দেখিয়ে দিল সে।

‘অসংখ্য ধন্যবাদ,’ বলল কিশোর। ‘অনেক উপকার করলেন আপনি।’

উনিশ

মোটরসাইকেল নিয়ে চেরিভিল রওনা হলো দুই গোয়েন্দা। ছোট্ট শহরটাতে এসে একজন পুলিশকে জিজ্ঞেস করতেই, রেলস্টেশনটা দেখিয়ে দিল সে। শহর থেকে আধা মাইল দূরে জায়গাটা। নতুন হাইওয়ে থেকে খানিকটা ভেতরে, নিচু জমিতে দাঁড়িয়ে স্টেশনটা। একটা বাঁকা রাস্তা ধরে যেতে হয় ওখানে। রেললাইনের সমান্তরাল কয়েক শ ফুট এগিয়েছে রাস্তাটা।

ছোট একটা চৌকো ঘর নিয়ে স্টেশন, কত কাল চুনকাম করা হয়নি কে জানে। আশপাশের কাঠের ঘরগুলোর অবস্থাও সঙিন, ভগ্নপ্রায় দশা। স্টেশনের একধারে, মোটামুটি সত্তর গজের ভেতরে, পুরোনো একটা কাঠের পানির ট্যাংক এক দিকে কাত হয়ে আছে বিপজ্জনকভাবে। প্রায় একই দূরত্বে অন্য পাশটাতে খাড়া হয়ে আছে লাল রঙের আরেকটা পানির ট্যাংক। আগেরটার চেয়ে ভালো অবস্থা এটার।

এক পাশে মোটরসাইকেল রেখে স্টেশনের ভেতরে ঢুকল দুই গোয়েন্দা। ক্যাপ মাথায়, ফুলহাতা শার্ট পরা এক লোক ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে টিকিট উইন্ডোর পেছনে।

‘আপনিই কি স্টেশনমাস্টার?’ ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করে কিশোর।

সামনে এগিয়ে এল লোকটা। ‘আমার নাম বিকন। আমিই স্টেশনমাস্টার, আমিই টিকিট বিক্রেতা। আমিই মুটে, আর্দালি, পিয়ন, ঝাড়ুদার, এমনকি রাইস থ্রোয়ারও। যে নামেই ডাকো, আমিই তোমাদের লোক।’

প্রাণখুলে হাসল ছেলেরা। রবিন বলল, ‘আমরা যা জানতে চাই, তা যদি কেউ বলতে পারে এখানে, সে আপনিই পারবেন। আমি শিওর। তার আগে বলুন, রাইস থ্রোয়ার মানে কী?’

হো হো করে হেসে উঠল স্টেশনমাস্টার। ‘সচরাচর না হলেও মাঝেমধ্যে আমার এখানে নতুন বর-কনে ট্রেন ধরতে আসে। আমিও তখন দৌড়ে গিয়ে কিছু চাল নিয়ে, আর সবার সঙ্গে মিলে ওদের ওপর ছিটাতে থাকি। এতে যদি ওরা সুখী হয়, তাহলে আমিও তার অংশ হয়ে গেলাম, এই আরকি।’

আবারও হেসে উঠল ছেলেরা। অবশেষে কিশোর জানতে চাইল রেড ডোবার নামে কাউকে চেনে কি না সে।

‘নিশ্চয়ই চিনতাম,’ জবাব দিল বিকন। ‘মজার এক লোক ছিল। এই পাগলের মতো খাটছে তো পরক্ষণেই আবার আলসেমি শুরু করল। একটা জিনিস ছিল ওর, কারও খবরদারি একেবারেই পছন্দ করত না।’

‘ও যে সম্প্রতি মারা গেছে, তা কি জানেন?’ কিশোর জিজ্ঞেস করল।

‘না, তা তো শুনিনি,’ বলল স্টেশনমাস্টার। ‘দুঃখই লাগছে। আমি যত দূর চিনতাম, খুব একটা খারাপ লোক ছিল না সে। বোধ হয় বাজে বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়েছিল।’

‘আচ্ছা, ওর কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা দিতে পারেন আমাদের?’ প্রশ্ন করল কিশোর।

ক্যাপের ওপর দিয়ে মাথা চুলকালো বিকন। অবশেষে বলল, ‘সবচেয়ে যেটা মনে আছে, বানরের মতো স্বভাবের ছিল ডোবার। প্রচণ্ড ছটফটে। মই বেয়ে ফ্রেইট-কারে উঠছে, নামছে—এই করত খালি।’

তখনই একটা ট্রেন আসার হুইসেল শোনা গেল। ব্যস্ত হয়ে বলল স্টেশনমাস্টার, ‘আর থাকতে পারছি না, ছেলেরা। অন্য আরেক সময়, যখন আমার ব্যস্ততা একটু কম থাকে, তখন এসো। ট্রেনটার কাছে যেতে হবে আমাকে।’

স্টেশন থেকে সরে এল ওরা। কিশোর প্রস্তাব করল, ‘এসো, লাঞ্চ সেরে ফেলি। তারপর আবার আসা যাবে।’

রেললাইনের ধারে ছোট একটা গাছের জটলা দেখতে পেল ওরা। মস্ত একটা গাছের গায়ে মোটরসাইকেল হেলান দিয়ে রাখল।

‘খিদেয় মরে যাচ্ছি,’ গাছের নিচে বসে পড়ল সে। লাঞ্চবক্স খুলল।

‘ওরে বাবা, কী জিনিস দিয়েছেন আন্টি!’ ঝলসানো গরুর মাংস ভরা পুরু স্যান্ডউইচে কামড় দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল রবিন।

‘ডোবার লোকটা যদি শুধু রেল কোম্পানিতেই লেগে থাকত,’ একটা সেদ্ধ ডিম চিবাতে চিবাতে বলল কিশোর, ‘তাতে সবারই উপকার হতো।’

‘সত্যিই, মরার আগে অনেক ঝামেলা বাধিয়ে গেছে সে,’ বলল রবিন।

‘তখন থেকে খালি একটার পর একটা সমস্যাই তৈরি করেছে। বিশেষ করে পিটারসনদের।’

চিন্তামগ্ন দৃষ্টিতে রেললাইনের দিকে তাকিয়ে আছে ছেলেরা। ঝলমলে রোদে, পাশাপাশি দুটি লাইন চলে গেছে বহুদূর। ওরা যেখানে বসে আছে, তার থেকে মাত্র কয়েক শ ফুট দূরে পানির ট্যাংক দুটি চোখে পড়ছে ওদের। জরাজীর্ণ, ভগ্নপ্রায় কাঠের ট্যাংক। পাশ দিয়ে উঠে যাওয়া মইয়ের কিছু কিছু ধাপ খসে গেছে। পেটমোটা ধাতব ট্যাংকটা বসে আছে স্টিলের পায়ার ওপর।

স্যান্ডউইচে এক কামড় দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে চিবাতে লাগল কিশোর। ওয়াটার টাওয়ার দুটি দেখে একটা ধারণা উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছে ওর মাথায়। কিন্তু তা এতটাই অযৌক্তিক, চিন্তা করতেও হাস্যকর লাগছে ওর। রবিনকে বলবে কি না, ইতস্তত করছে সে।

তখন খেয়াল করল, রবিন নিজেও লাইন বরাবর ট্যাংক দুটির দিকে অপলকে তাকিয়ে আছে। অন্যমনস্কভাবে একটা বিস্কুট তুলে নিয়ে কামড় দিতে গিয়ে মিস করল রবিন। এখনো দৃষ্টি আগের জায়গায়ই নিবদ্ধ।

অবশেষে কিশোরের দিকে ঘুরে তাকাল রবিন। পরস্পরের মনের কথা পড়তে পারছে ওরা। একই কথা ভাবছে দুজন।

‘দুটি ওয়াটার টাওয়ার,’ উত্তেজিত গলা কিশোরের।

‘আর একটা পুরোনো, একটা নতুন,’ বিড়বিড় করল রবিন।

‘আর ডোবার বলেছিল’

‘মালগুলো পুরোনো টাওয়ারে লুকিয়েছিল সে।’

‘এবং রেললাইনে কাজ করত সে।’

‘নয় কেন?’ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল রবিন। ‘পুরোনো টাওয়ার দিয়ে ওটাকেই বোঝাতে সমস্যা কোথায় ওর? আশপাশেই তো কাজ করত সে।’

‘সবচেয়ে বড় কথা, ও তো আর বলেনি যে বিলি ম্যানশনের পুরোনো টাওয়ার! শধু বলেছিল, “পুরোনো টাওয়ার!”’

‘কিশোর, বোধ হয় সাংঘাতিক একটা সূত্র আবিষ্কার করে ফেলেছি আমরা!’ উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে রবিন। ‘আগে যেখানে ঘোরাফেরা করত, ডাকাতির পর সেখানে ফিরে আসাটা খুবই স্বাভাবিক ডোবারের পক্ষে!’

‘ঠিক!’ সায় দিল কিশোর।

‘মুসার জেলোপিটা গায়েব হয়ে যেতে দেখে ভাবল, পেছনে পুলিশ লেগে গেছে। কাজেই লুটের মালগুলো এমন কোনো জায়গায় লুকিয়ে ফেলতে চাইল, যেখানটা ওর পরিচিত। যেখানে রাখলে কেউ সন্দেহ করবে না। পুরোনো টাওয়ার! কোনো সন্দেহ নেই, এটাই!’

লাঞ্চ, মোটরসাইকেল—সব গোল্লায় যাক! রাস্তার ধারে একটা বাঁধ, তার ওপাশেই ওদের লক্ষ্য। উল্লাসে বিকট হাঁক ছেড়ে, বাঁধ টপকে নামতে শুরু করল কিশোর আর রবিন।

একধারে গজিয়ে ওঠা ঘাস আর আগাছা থেকে রেললাইনকে আলাদা করার জন্য বেড়া দিয়ে রাখা হয়েছে। ওটার কাছে এসেই হোঁচট খেয়ে থেমে গেল ওরা। কে যেন ওপরের হাইওয়ে থেকে গাড়ির হর্ন টিপছে। মুখ তুলে তাকাতেই ড্রাইভারকে চিনে ফেলল ওরা।

ফ্রেড!

‘এই সেরেছে!’ ককিয়ে উঠল রবিন।

‘এই ব্যাটা আবার কোত্থেকে এসে জুটল!’ বিরক্তিতে মুখ কোঁচকাল কিশোর।

‘জলদি খসাতে হবে ওকে,’ ঠোঁট কামড়াল রবিন।

পেছনে ঘুরে, আবার বাঁধ বেয়ে উঠতে শুরু করল ওরা। ততক্ষণে গাড়ি থেকে বেরিয়ে, নিচের দিকে হাঁটা ধরেছে ডগলাস ফ্রেড।

‘তো, শেষতক পেলাম তোমাদের,’ বলল সে।

‘তার মানে, আমাদের খুঁজছিলেন আপনি?’ অবাক হয়ে গেল কিশোর।

দাঁত বের করে হাসল তথাকথিত ডিটেকটিভ। যেন মস্ত কোনো কাজ করে ফেলেছে এমন ভঙ্গি করে জানাল, বহুক্ষণ ধরে ওদের ট্রেইল অনুসরণ করেছে সে। মোটরসাইকেলে চেপে বাড়ি থেকে বেরোতে দেখেছিল ওদের। একটুর জন্য রকি বিচ স্টেশনে নাগাল পায়নি। তবে স্টেশনমাস্টারের কাছ থেকে ওদের পরবর্তী গন্তব্য সম্পর্ক জেনে নেয়। তখনই ফ্লাগম্যান ডেভ ওয়ারেনের সঙ্গে কথা বলতে ছোটে হবু গোয়েন্দা।

‘ওর মুখেই শুনলাম, তোমাদের এখানে পাওয়া যেতে পারে,’ বেশ একটা আত্মতৃপ্তির সুর ফ্রেডের গলায়।

‘বুঝলাম। কিন্তু আমাদের খুঁজছেন কেন, সেটা তো বলবেন?’ কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল রবিন।

‘একটা প্রস্তাব দিতে চাই তোমাদের,’ দরাজ গলায় বলল ফ্রেড। ‘ডোবার আর ওর চোরাই মালের ব্যাপারে দারুণ একখান সূত্র আবিষ্কার করেছি আমি। কিন্তু খোঁজাখুঁজিতে কারও সাহায্য লাগবে আমার। তা, তোমরা কী বলো? আমি আমার গোপন কথাটা বললে, তোমরা কি আমাকে সাহায্য করবে?’

ঘটনার এই আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে গেল ছেলেরা। লোকটা কি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানে? নাকি হঠাৎ করেই এতটা চালাক হয়ে গেল যে ফাঁকি দিয়ে ওদের মুখ থেকে আসল কথাটা বের করে নিতে চায়? সে যা–ই হোক, একটা ব্যাপারে ওদের কোনো সংশয় নেই। পুরোনো ওয়াটার টাওয়ারে খোঁজা শেষ না করে কিছুই করতে চায় না ওরা ডগলাস ফ্রেডের সঙ্গে।

‘সুযোগটা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ,’ হাসল কিশোর। ‘রবিন আর আমি মনে করি, আমরা নিজেরাই যথেষ্ট। এরপরও আপনি যে আমাদের কথা মনে করেছেন, তার জন্য খুশি হলাম।’

‘তার মানে আমার সঙ্গে কাজ করছ তোমরা?’ প্রত্যাশার আলো জ্বলে উঠল ফ্রেডের চোখে।

‘আমি হ্যাঁ-ও বলিনি, না-ও বলিনি,’ বলল কিশোর। ফ্রেডের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা রবিনের দিকে তাকাতেই প্রবল বেগে মাথা নাড়ল সে। ‘একটা কথা কি, ফ্রেড,’ বলে চলল কিশোর, ‘আমি আর রবিন আগে রকি বিচে ফিরি। আপনার ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করি, তারপর নাহয় জানাই। এখানে আমরা এসেছি একটু আরাম করে পিকনিক করতে।’

মুখ কালো হয়ে গেল ফ্রেডের। কিন্তু এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র সে নয়। ‘গাড়ির ভেতর থেকে দেখলাম, বাঁধের নিচে পাগলের মতো দৌড়াচ্ছ তোমরা। এর নাম আরাম করা?’

‘ও আচ্ছা। আসলে কি, বেশিক্ষণ মাটিতে বসে খাওয়াদাওয়া করলে হাতে-পায়ে খিল ধরে যায়,’ বলল রবিন। ‘তা ছাড়া স্কুলের বেসবল খেলার জন্য সব সময় প্র্যাকটিসের ভেতর থাকতে হয়।’

ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল ফ্রেড। ওরা ইয়ার্কি মারছে কি না বোঝার চেষ্টা করছে। শেষ অবধি বলল, ‘ঠিক আছে বাপু। তো, সপ্তাহের শুরুতে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে, কথা দিতে পারি, বিশাল একটা চমক রয়েছে তোমাদের জন্য। ৫০ হাজার ডলারের পুরস্কারটা যে তোমাদের একার পক্ষে জেতা সম্ভব না, সে তো বুঝতেই পেরেছ। কাজেই আমরা প্রত্যেকে ভাগ করে নিতে তো অসুবিধা নেই। আমি তো স্বীকারই করলাম, রহস্যটার সমাধান করতে তোমাদের সাহায্য দরকার আমার।’

ঘুরে, বাঁধের ওপরে থাকা গাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল সে। হাত নেড়ে তাকে বিদায় জানাল ছেলেরা। চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। আরও খানিকক্ষণ দেখে শিওর হয়ে নিল, লোকটা আর ফেরত আসবে কি না। এরপর দৌড়ে রেললাইনের কাছে ফিরে এল ওরা। বেড়া টপকাল। পড়িমরি করে ছুটল পুরোনো ওয়াটার টাওয়ারের দিকে।

‘আহ, এখনই যদি রহস্যটার সমাধান করে ফেলতে পারি!’ ব্যগ্র গলায় বলল কিশোর।

‘বেঁচে যাবেন মি. পিটারসন—’

‘আমরাই পুরস্কারটা জিতে যাব—’

‘সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের গর্বে বুকটা ফুলে উঠবে রাশেদ আঙ্কেলের।’

রেললাইনের পাশেই নিতান্ত অবহেলায়, নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে পুরোনো ওয়াটার ট্যাংকটা। দূর থেকে যতটা লাগছিল, কাছ থেকে তার চেয়েও বেহাল লাগল ওটার। মইয়ের অনেকগুলো ধাপ নেই। সেদিকে তাকিয়ে ভাবছে ছেলেরা, আদৌ ওটা বেয়ে ওপরে ওঠা যাবে কি না, কে জানে।

‘ডোবার যদি উঠতে পারে, আমরাও পারব,’ তলায় এসে বলল কিশোর। দৌড়ে আসাতে হাঁপাচ্ছে। ‘এসো!’

পচা কাঠের পাদানি বেয়ে উঠতে শুরু করল সে। মাত্র চারটে ধাপ উঠেছে, ঠিক তখনই কড়াৎ করে শব্দ হলো!

‘সাবধান!’ নিচ থেকে চেঁচিয়ে উঠল রবিন।

দেহের ভারে কিশোরের পায়ের তলার ধাপটা ভেঙে যেতে শুরু করেছে। ওপরের ধাপটা ধরে ঝুলে পড়ল সে। সাবধানে উঠে পড়ল ওটায়। আগেরটার চেয়ে শক্ত এটা।

‘এই!’ হাঁক দিল রবিন। ‘দেখো, সব কটি পাদানি ভেঙে ফেলো না যেন! আমিও কিন্তু আসছি!’

মই বেয়ে উঠে চলল কিশোর। নিচ থেকে উঠতে শুরু করল রবিনও।

যেসব জায়গার পাদানি ভাঙা, সেখানে এসে গায়ের জোরে ঠেলে ওপরে উঠতে হচ্ছে ওদের। অবশেষে মাথায় পৌঁছাল কিশোর। রবিনের নিচে আসার জন্য একটু অপেক্ষা করল সে।

‘একটা ট্র্যাপডোর দেখতে পাচ্ছি ওপরে, ট্যাংকের ভেতরে ঢোকার,’ জোরে জোরে বলল কিশোর।

চলবে...

আরও পড়ুন