পৃথিবীর শেষ মানুষটা
অফিসটা এমন কিছু আহামরি টাইপ না। খুবই সাধারণ অফিস, হলুদ রঙের একটা দোতলা বিল্ডিং। গেটে কোনো দারোয়ানও নেই, সাইনবোর্ড নেই। রহমান সাহেব তাঁর ছেলে সাব্বিরকে নিয়ে সোজা ঢুকে গেলেন। ঢুকে দেখেন, ডান দিকে একটা লোক বসে কান চুলকাচ্ছে কলম দিয়ে।
‘আসেন আসেন।’ লোকটা ডাকল। এগিয়ে গেলেন রহমান সাহেব।
‘কারে চান?’
‘কারদার সাহেব।’
‘স্যার পাশের রুমে বসেন। স্যার একটু বাইরে গেছেন, এখনই চলে আসবেন। আপনারা পাশের রুমে গিয়ে বসেন।’
তা–ই বসলেন তিনি। একটু পরই কারদার সাহেব চলে এলেন। সাদা শার্টের সাথে তার গলার লাল চিকন টাইটা বেশ মানিয়েছে।
‘হাই, বলুন কী করতে পারি। আপনিই তো বোধ হয় সকালে ফোন করেছিলেন!’
‘জি জি, আমি আবদুর রহমান। এ আমার ছেলে সাব্বির।’
‘হাই, সাব্বির।’ সাব্বির অবশ্য মুখ নিচু করে বসে রইল। কারদার সাহেবের দিকে তাকালই না।
‘বলুন এবার, আপনার জন্য কী করতে পারি?’
‘মানে আমার এই ছেলেটা...প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে থাকে...মানে এর থেকে মুক্তির পথ কী? ডাক্তার, সাইকোলজিস্ট, সাইকিয়াটিস্ট সব দেখিয়েছি, কোনো কাজ হচ্ছে না।’
‘হুম...’ কারদার সাহেব লম্বা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ‘এটা এই জেনারেশনের কমন প্রবলেম। তা আপনি এখন কী করতে চাইছেন?’
‘আপনাদের এখানে নাকি কী একটা প্রসেস আছে।’
‘হ্যাঁ, তা আছে। ডেটা ট্রান্সফার প্রসেস। ডিটিপি। এই প্রসেসে আমরা আপনার ছেলেকে অন্য এক জগতে পাঠিয়ে দেব। সেখানে গেলে তার ড্রিপেশন–টিপ্রেশন কিচ্ছু থাকবে না। সে তার পছন্দের এক জগতে চলে যাবে।’
‘ভার্চ্যুয়াল জগৎ নাকি?’
‘ওই রকমই একটা ব্যাপার।’
রহমান সাহেব খেয়াল করলেন, সাব্বির এবার মুখ তুলে তাকিয়েছে কারদারের দিকে।
‘ছেলেকে কীভাবে পাঠাবেন?’
‘ওই যে বললাম ডিটিপি...একধরনের ট্রান্সফরমেশন বলতে পারেন।’
‘বুঝলাম না।’
‘ধরুন, সাব্বিরের ওজন...সাব্বির, তোমার ওজন কত?’
‘৬৮ কিলোগ্রাম।’
‘আচ্ছা আমরা হিসাবের সুবিধার জন্য ধরলাম, সাব্বিরের ওজন ৭০ কিলোগ্রাম। তার মানে তার শরীরে আছে ৭ বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন পরমাণু? বিশ্বাস হয়? অর্থাৎ ৭–এর পর ২৭টা শূন্য!’
‘আচ্ছা।’
‘আমরা যেটা করব, ওর শরীরের এই ৭ বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন পরমাণু বিচ্ছিন্ন করে ডেটায় কনভার্ট করে ট্রান্সফার করে দেব অন্য একটা জগতে। স্বপ্নের জগৎ বলতে পারেন। সেই জগতে কী নেই! এভরিথিং পসিবলের এক অনন্য জগৎ। মানুষ যা চায়, তার সবকিছু আছে সেখানে এবং চাইলেই পাওয়া যাওয়ার এক অভূতপূর্ব জগৎ...সেই জগতে গিয়ে ওর বিচ্ছিন্ন অ্যাটমগুলো রিঅ্যারেঞ্জ হয়ে নতুন এক সাব্বিরকে তৈরি করবে...ব্যস...
‘আমি যাব।’ উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ে সাব্বির। ‘আমি ডিটিপির কথা শুনেছি। আমার অনেক বন্ধু চলে গেছে সেই জগতে।’
‘ওই দেখুন, আপনার ছেলে ঠিকই বুঝে গেছে। সত্যি কথা বলতে কি, প্রতিদিন শত শত হাজার হাজার মানুষ চলে যাচ্ছে। পৃথিবীর অর্ধেক মানুষই চলে গেছে ওই জগতে।’
‘এটাকে কী জগৎ বলে?’
‘অন্য বিশ্বে ওরা কিছু সুন্দর নাম তৈরি করেছে। যেমন জেমিনি, ফ্রিজবি, অরোরা...কিন্তু আমরা এখনো কোনো নামের মধ্যে যাচ্ছি না। কারণ, (এই পর্যায়ে গলা নামিয়ে ফেললেন কারদার সাহেব) সরকার কিন্তু এখনো এই প্রক্রিয়ার কঠিন বিরুদ্ধে। আমরা গোপনেই কাজটা করছি। আপাতত নামধামের প্রশ্নই ওঠে না।’
‘আচ্ছা, খরচ কেমন?’
‘কোনো খরচ নাই...ফ্রি।’
‘ফ্রি?’
‘হ্যাঁ, ফ্রি।’
‘তাহলে আপনাদের লাভ কী?’
‘শোনেন ভাই, এটা সুপার ইন্টেলিজেন্ট এআইএর একটা প্রজেক্ট। তারা চালাচ্ছে। পৃথিবীটাকে মানুষশূন্য করে দিচ্ছে...হা হা হা!’ কারদার সাহেব হাসলেন বটে, কিন্তু আবদুর রহমান সাহেবের মনে হলো, হাসিটায় প্রাণ নেই।
‘আচ্ছা, ধরেন ওকে পাঠালাম। ও আবার ফিরবে কীভাবে?’
‘ফিরবে মানে? ফিরবে কেন? এটা ওয়ান–ওয়ে জার্নি। ফেরার কোনো পথ নেই। আরে ভাই, সবাই তো ফ্যামিলি ধরেই যাচ্ছে। আপনিও চলে যান ছেলের সঙ্গে। আপনার স্ত্রীকেও নিয়ে যান।’
‘তাই?’ হতভম্ব হয়ে রহমান সাহেব ছেলের দিকে তাকান। ছেলের চোখমুখ বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। সে মনে হচ্ছে, কল্পনায় ওই জগতে চলেই গেছে।
‘যদি সত্যিই ওকে এখনই পাঠাতে চান, তাহলে সোজা দোতলায় ডান দিকের একটা রুমে যাবেন। ওটাকে আমরা মেশিন ঘর বলি। ওখানে একটাই চেয়ার আছে। চেয়ারে বসবে আপনার ছেলে...ব্যস বাকিটা সুপার ইন্টেলিজেন্ট এআইএর কাজ। খুব সম্ভব ২ মিনিট ২৯ সেকেন্ড সময় নেবে।’
‘তারপর?’
‘তারপর আপনার ফোনে একটা লিংক আসবে...ওই লিংকে ঢুকলেই আপনার ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ হবে। সেই স্বপ্নের জগতে সে কী করছে না করছে, সব দেখতে পারবেন, জানতে পারবেন।’
‘আচ্ছা, আমি একটু বাসায় স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে নিই। তারপর...’
‘শোনেন ভাই, আমি বলি, পুরো পরিবার চলে যান। এই পৃথিবীতে আর ভালো কিছু হবে না, মানুষ বুঝে গেছে। পরিবেশদূষণ তো আছেই, আরও কী সব ভয়ংকর খেলা শুরু হয়ে গেছে...’ আবারও গলা নামিয়ে ফেলেন কারদার ‘ জীববৈচিত্র্য পুরাই ধ্বংস। এখনো সময় আছে, চলে যান।’
২
মাসখানেকের মধ্যেই রহমান সাহেব ছেলে আর স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিয়েছেন ডিজিটাল জগতে। জগৎটার একটা অদ্ভুত নাম আছে, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। এই তো সেদিন ওদের লিংকে ঢুকে ছেলের সঙ্গে কথা হলো।
‘কী রে, কেমন আছিস?’
‘খুব ভালো।’
‘তোর মা কই?’
‘মা পাশের ঘরে কী যেন করছে।’
‘খাওয়াদাওয়া?’
‘ওহ বাবা, কতবার বলেছি, এখানে খাওয়াদাওয়া লাগে না। তারপরও খুব ইচ্ছা হলে কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। কত রকম মজার খাবার যে আছে, কী আর বলব। তুমি চলে আসো জলদি।’
‘দেখি।’
‘এই যে, মা এসেছে। কথা বলো।’
‘কী গো, কেমন কাটছে ওই জগতে?’
‘খুব ভালো, তুমি চলে আসো। না এলে কিন্তু তোমার মতো একটা কপি তৈরি করে ফেলা যায় এখানে! হা হা হা!’
‘বলো কী?’
‘ওই যে, আমার বান্ধবী শিরিনকে মনে আছে? ও চলে এসেছে, কিন্তু ওর জামাই আসবে না। কিছুতেই আসবে না। পরে ও শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে ওর জামাইয়ের একটা কপি তৈরি করে নিয়েছে। এখন দিব্যি আছে দুজন। তোমার–আমার পরিচিত অনেকেই কিন্তু এসেছে এখানে।’
‘আচ্ছা, দেখি চলে আসব। একটু গুছিয়ে নিই এদিকটা।’
‘মানে? কী গোছাবে?’
‘বাসার জিনিসপত্র, ব্যাংকের টাকাপয়সা।’
‘তুমি কি একটা গাধা নাকি? এসব দিয়ে আর কী হবে? ওসব সব ফেলে আসো। এখানে সব আছে এবং সব ফ্রি। যা চাও, সব ফ্রি। আমি একটা বিএমডব্লিউ নিয়েছি, এখন চালানো শিখছি।’
‘কীভাবে নিয়েছ?’
‘এখানে ইচ্ছেমতো যেকোনো কিছু নেওয়া যায়। চলে আসো, দেখবে। আচ্ছা, রাখলাম, আমার গাড়ির ট্রেইনার চলে এসেছে।’
‘আচ্ছা।’
ফোন ছেড়ে দিয়ে গুম হয়ে বসে থাকেন রহমান সাহেব। ঠিক তখনই দরজায় নক। নক নক।
‘কে?’
‘আমি ডিটিপির কারদার।’
দরজা খুলে অবাক হয়ে গেলেন রহমান সাহেব। সেই ডিটিপির কারদার দাঁড়িয়ে আছেন। সেই স্মার্ট লোক; ধূসর প্যান্ট সাদা শার্টের সাথে চিকন লাল টাই। বাইরের বাতাসে টাইটা পতাকার মতো এদিক–ওদিক পতপত করে উড়ছে আর তার গালে বাড়ি খাচ্ছে।
‘আসেন আসেন, ভেতরে চলে আসেন।’
‘আছেন কেমন?’
‘জি, ভালো।’
‘আপনার স্ত্রী–পুত্র?’
‘ওরাও ভালো আছে...বেশ ভালো আছে।’
‘শোনেন রহমান সাহেব, একটা ঘটনা ঘটেছে। সুপার ইন্টেলিজেন্ট এআই আজ সকালে আমাকে জানিয়েছে, পৃথিবীতে এই মুহূর্তে আর কোনো মানুষ নাই। কোনো ফিজিক্যাল মানুষ নাই। সব ভার্চ্যুয়াল জগতে ঢুকে গেছে। শুধু আছি আমি আর আপনি। ব্যাপারটা বিশ্বাস হয়?’
‘বলেন কী?’
‘হ্যাঁ, ভাই। এখন আপনাকে জরুরি ভিত্তিতে পাঠিয়ে দিতে বলেছে। পৃথিবীতে শুধু থাকব আমি...দ্য লাস্ট ম্যান অন আর্থ।’
‘আপনাকে নিয়ে ওরা কী করবে?’
‘সেটা তো ভাই বুঝতে পারছি না। তবে আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে।’
‘কী সন্দেহ?’
‘চলুন, যেতে যেতে বলছি।’
‘কোথায় যাব?’
‘কী আশ্চর্য! আমাদের অফিসে। আপনাকে পাঠাতে হবে না? ১২টার মধ্যে পাঠাতে বলেছে।’
কারদার সাহেব একটা উড়ন্ত বাইভারবাল নিয়ে এসেছেন। সেটাতে চড়ে বসলেন রহমান সাহেব। এই প্রথম তিনি কোনো বাইভারবালে বসলেন। সাঁই সাঁই করে বাতাসের মধ্য দিয়ে উড়ে যাচ্ছে জিনিসটা।
‘আমি ঠিক করেছি, আপনাকে আপনার স্ত্রী–সন্তানের কাছে পাঠাব। কিন্তু আপনার একটা ফিজিক্যাল কপি আমি এখানে রেখে দেব।’
‘কেন?’
‘আমার একটা হেল্পিং হ্যান্ড দরকার। ওরা ঠিক কী করতে যাচ্ছে, সেটা আমাকে বুঝতে হবে। অবশ্য আপনি যদি রাজি থাকেন।’
‘আমি রাজি, আমিও এই পৃথিবীর শেষটা দেখতে চাই।’
‘দ্যাটস রাইট!’
৩
না, শেষ পর্যন্ত রহমান সাহেবের একটা ফিজিক্যাল কপি রাখা সম্ভব হয় নাই। সুপার ইন্টেলিজেন্ট এআই ব্যাপারটা শেষ মুহূর্তে ধরে ফেলে। এদের কাজকর্ম এত নিখুঁত যে এর বাইরে একবিন্দু যাওয়ার উপায় নেই। কী হবে এখন তার? ভাবতে ভাবতে কফি বানাচ্ছিলেন কারদার সাহেব। ঠিক তখনই দরজায় নক হলো—ঠক ঠক ঠক।
এই পৃথিবীতে এই মুহূর্তে একজন মাত্র মানুষ অবশিষ্ট আছে, সেটা কারদার সাহেব। পুরো নাম কারদার হাসান। তার হঠাৎ তরুণ বয়সে পড়া একটা গল্প মনে পড়ল। এক লাইনের একটা ইংরেজি গল্প, লেখক ফ্রেডরিখ ব্রাউন। গল্পটা এ রকম—‘দ্য লাস্ট ম্যান অন আর্থ স্যাট অ্যালোন ইন আ রুম। দেয়ার ওয়াজ আ নক অন দ্য ডোর’—ঠক ঠক ঠক।
কফির মগটা নামিয়ে রেখে কারদার হাসান এগিয়ে গেলেন দরজার কাছে। হ্যাঁ, ফ্রেডরিখ ব্রাউনের গল্পের তিনিই সেই লাস্ট ম্যান অন আর্থ। দরজাটা খুললেন আস্তে করে। সবুজ রঙের একজন কেউ দাঁড়িয়ে আছে দরজার প্রশস্ত চৌকাঠে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সে এই পৃথিবীর কেউ নয়। পেছনে তার মতোই আরও কয়েকজন দাঁড়িয়ে...আরও পেছনে দিগন্তের কাছাকাছি বেশ কিছু ছোট–বড় অদ্ভুতদর্শন মহাকাশযানকে নিঃশব্দে নামতে দেখা যাচ্ছে! কারদার সাহেবের চোখ জ্বালা করে উঠল...মানুষের কান্না কি বুঝতে পারে এরা? কে জানে!
