টুনটুনি ও ছোটাচ্চু (দ্বিতীয় পর্ব)

ছোটাচ্চু তার ঘরে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে তার হলুদ বইটা পড়ছে, তার চারপাশে কাগজপত্র ছড়ানো। পড়তে পড়তে মাঝে মাঝেই ছোট একটা নোটবইয়ে কিছু একটা লিখছে। এ রকম সময়ে টুনি এসে ঘরে ঢুকল।

এই বাসার অসংখ্য বাচ্চার সবার পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু মনে হয় টুনির কথা আলাদা করে বলে রাখা ভালো। টুনির বয়স এগারো, ছোটখাটো সাইজ, তাই দেখে মনে হয় বয়স বুঝি আরও কম। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে তার মুখের দিকে তাকালে সবাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়, সেখানে এমন এক ধরনের গাম্ভীর্য যে মনে হয় সে বুঝি বয়স্ক একজন মানুষ। এই বাসার বাচ্চাকাচ্চাদের লেখাপড়ায় বেশি আগ্রহ নেই, তাই তাদের কারও চোখে চশমা নেই, টুনি ছাড়া। তার চশমাটিও মোটেও বাচ্চাদের চশমা নয়, চশমার দোকান থেকে বেছে বেছে বুড়ো মানুষের গোল গোল মেটাল ফ্রেমের চশমা কিনেছে, সেই চশমায় তাকে আরও বয়স্ক দেখায়। সে কথা বলে কম, যখন বলে তখন অল্প দুই-চারটা শব্দ দিয়ে সবকিছু বলে ফেলে। যখন কথা বলে না তখন ঠোঁট দুটি চেপে রাখে, যেন মুখের ভেতর থেকে তার অজান্তে কিছু বের না হয়ে যায়। তার চুলগুলো অনেকটা পুতুলের চুলের মতো, মাথার দুই পাশে দুটি ঝুঁটি এবং সেগুলো লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা।

ছোটাচ্চুর ঘরে ঢুকে টুনি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। তাকে কিছু জিজ্ঞেস না করা পর্যন্ত সে কোনো কথা বলে না। ছোটাচ্চু তার হলুদ বইয়ে এত বেশি ডুবে ছিল যে প্রথমে টুনিকে লক্ষই করেনি। যখন লক্ষ করল তখন মুখ তুলে বলল, ‘টুনটুনি!’

ছোটাচ্চু মাঝে মাঝেই টুনিকে টুনটুনি ডাকে কিন্তু টুনির নাম যেহেতু টুনটুনি না তাই তাকে টুনটুনি ডাকা হলে সে সাধারণত উত্তর দেয় না। এবারও সে উত্তর দিল না। তার গোল গোল চশমার ভেতর দিয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে রইল। ছোটাচ্চু তখন একটু থতমত খেয়ে বলল, ‘কিছু বলবি?’

টুনি মাথা নাড়ল, সে কিছু বলতে চায়। কিন্তু কিছু না বলে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ছোটাচ্চু বলল, ‘কী বলবি? বল।’

টুনি কম কথার মানুষ, তাই সে কম কথায় বলল, ‘আমিও ডিটেকটিভ হব।’

ছোটাচ্চু একটু হকচকিয়ে গেল, বলল, ‘কী হবি?’

টুনি উত্তর দিল না, সে কী বলেছে ছোটাচ্চু ভালো করে শুনেছে, তাই আরও একবার একই কথা বলার কোনো অর্থ নেই। সে কখনো বাড়তি কথা বলে না।

ছোটাচ্চু তখন বলল, ‘তুই ডিটেকটিভ হবি? ডিটেকটিভ হওয়া এত সোজা!’

টুনি বলল, ‘তুমি যদি হতে পারো এটা নিশ্চয় সোজা।’

ছোটাচ্চু কেমন জানি চিড়বিড় করে জ্বলে উঠল, ‘কী বললি, কী বললি তুই?’

টুনি কোনো কথা বলল না, তার হিসাবে ছোটাচ্চুর এই কথাটার উত্তর দেওয়ার দরকার নেই। ছোটাচ্চু তখন গলা উঁচিয়ে বলল, ‘তোরা ভেবেছিস কী? আমি একটা খেলা খেলছি? ডিটেকটিভ ডিটেকটিভ খেলা?’

টুনি ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়ল, বুঝিয়ে দিল সে এটাকে খেলা ভাবছে না।

ছোটাচ্চু আরও গলা উঁচিয়ে বলল, ‘তাহলে? তাহলে তুই ডিটেকটিভ হবি, এই কথাটার মানে কী?’

টুনি বলল, ‘সব ডিটেকটিভের একটা অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকে। আমি তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হব।’

ছোটাচ্চুর মুখটা কেমন জানি অল্প হাঁ হয়ে গেল, সেই হাঁ অবস্থায় বলল, ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট?’

টুনি মাথা নাড়ল। ছোটাচ্চু তখন ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘মনে কর আমি তোকে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট বানালাম। তারপর মনে কর একটা ক্লায়েন্ট আমাকে একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিতে এল, এসে দেখল আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হচ্ছে আট বছরের একটা বাচ্চা—’

টুনি গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমার বয়স মোটেও আট বছর না।’

‘কত? তোর বয়স কত? নয়? বড়জোর দশ?’

‘আমার বয়স এগারো বছর তিন মাস।’

‘ঠিক আছে। তোর বয়স এগারো বছর তিন মাস। আট বছর আর এগারো বছর তিন মাসের মাঝে কোনো পার্থক্য আছে? নেই। যদি আমার কোনো ক্লায়েন্ট এসে দেখে আমার অ্যাসিস্ট্যান্টের বয়স এগারো বছর তিন মাস তাহলে আমাকে সিরিয়াসলি নেবে? নেবে সিরিয়াসলি?’

টুনি কোনো কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ছোটাচ্চু তখন ফোঁস করে আরেকটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘শোন টুনি। তোদের নিয়ে আমি অনেক কিছু করি। নাটক করি, ছাগল রং করি। ভূতের ভয় দেখাই। সেগুলো হচ্ছে মজা। সেগুলো হচ্ছে খেলা। কিন্তু এটা খেলা না। আমার ডিটেকটিভ এজেন্সি মোটেও খেলা না। এটা সিরিয়াস বিজনেস। এটা বাচ্চাকাচ্চার বিষয় না। এটা হচ্ছে বড়দের ব্যাপার। বুঝেছিস?’

টুনি মাথা নেড়ে জানাল সে বুঝেছে। ছোটাচ্চু তখন হাসি হাসি মুখ করে বলল, ‘গুড।’

টুনি বলল, ‘আমি তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট।’

ছোটাচ্চু এবার রীতিমতো চমকে উঠে বলল, ‘কী বললি? তুই আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট? এতক্ষণ ধরে আমি তাহলে কী বললাম?’

টুনি গলায় এখন আরও জোর দিয়ে বলল, ‘তোমার একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট দরকার। আমি তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট।’

ছোটাচ্চু রেগে উঠে বলল, ‘তোকে কে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট বানিয়েছে? আমি বানিয়েছি?’

টুনি খুব শান্ত গলায় বলল, ‘ছোটাচ্চু। তোমার ডিটেকটিভ এজেন্সি ঠিক করে চালানোর জন্য ভালো একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট দরকার। আমি হচ্ছি সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট। তোমাকে এখন কোনো বেতন দিতে হবে না। আমি ফ্রি তোমাকে সব কাজ করে দেব।’

ছোটাচ্চু আরও রেগে উঠল, ‘আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিস? রং-তামাশা করছিস?’

টুনি বলল, ‘তুমি শুধু শুধু রাগ করছ ছোটাচ্চু। সত্যিকারের ডিটেকটিভরা কখনো রাগ হয় না। তুমি এখনো আসল ডিটেকটিভ হও নাই। সেই জন্য তোমার একজন ভালো অ্যাসিস্ট্যান্ট দরকার। আমি হচ্ছি সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট।’

ছোটাচ্চু কী একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু টুনি সেটা শুনতে দাঁড়াল না, হেঁটে হেঁটে চলে গেল।

পরের কয়েকটা দিন ছোটাচ্চুর জন্য মোটেও ভালো গেল না। তার এক নম্বর কারণ, এই বাসার যার সঙ্গেই তার দেখা হলো সে-ই তাকে একই প্রশ্ন করতে লাগল। প্রথমে দাদি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই! তুই নাকি একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছিস আর টুনি নাকি তোর অ্যাসিস্ট্যান্ট?’

ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, ‘আমি একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছি কিন্তু টুনি মোটেও আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট না।’

‘তাহলে সবাই যে বলছে তুই নাকি টুনিকে অ্যাসিস্ট্যান্ট বানিয়েছিস। বাচ্চা একটা মানুষ—’

‘আমি টুনিকে অ্যাসিস্ট্যান্ট বানাই নাই। যে বলেছে সে ভুল বলেছে।’

দাদি উল দিয়ে সোয়েটার বুনতে বুনতে বললেন, ‘সেটাই ভালো। বাচ্চাকাচ্চাকে নিয়ে টানাটানি কেন? আর ডিটেকটিভ এজেন্সি জিনিসটা কী? কী করবি সেখানে? এটা কি কোনো ধরনের খেলা?’

ছোটাচ্চুর মুখ আরও শক্ত হয়ে গেল। বলল, ‘এটা মোটেও খেলা না। এটা সিরিয়াস বিজনেস। মানুষজন প্রবলেম নিয়ে আসবে, আমি সেই প্রবলেম সলভ করে দেব।’

দাদি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘জানি না বাপু। তুই তোর নিজের প্রবলেমই সলভ করতে পারিস না, মানুষের প্রবলেম সলভ করবি কেমন করে?’

ছোটাচ্চু ফোঁস করে বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘তুমি খালি দেখো। আগেই এত নেগেটিভ হয়ে যেয়ো না।’

বড় মামার সঙ্গে যখন দেখা হলো তখন বড় মামা বলল, ‘তুই নাকি প্রাইভেট ডিটেকটিভ আর টুনি নাকি তোর অ্যাসিস্ট্যান্ট?’

ছোটাচ্চু গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ হওয়ার চেষ্টা করছি। সেই জন্য একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছি। রেজিস্ট্রেশনের জন্য অ্যাপ্লাই করেছি।’

‘টুনিকে নিলে তোর রেজিস্ট্রেশন হবে?’

‘আমি টুনিকে নেই নাই।’

বড় মামা একটু অবাক হয়ে বলল, ‘তাহলে সবাই যে বলছে—’

‘কে বলছে?’

‘তোর ভাবি বলল। মেকু বলল। রানি বলল। সুমি বলল।’

মেকু রানি সুমি এরা এই বাসার বিভিন্ন চরিত্র, এদের সবার নাম মনে রাখা সোজা নয়, দরকারও নেই। ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, ‘সবাই তোমাকে ভুল বলেছে। আমি মোটেও টুনিকে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট বানাই নাই।’

বড় মামা একটু অবাক হয়ে বলল, ‘ও।’

ঠিক তখন ভাবি ঘরে এসে ঢুকল, ছোটাচ্চুকে দেখে বলল, ‘এই যে তোমাকে খুঁজছিলাম। তুমি নাকি—’

ভাবি কথা শেষ করার আগেই ছোটাচ্চু বলল, ‘না।’

ভাবি অবাক হয়ে বলল, ‘কী না?’

‘তুমি যেটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছ।’

‘আমি কী জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছি?’

‘টুনি আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট কি না।’

ভাবি আরও অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি কেমন করে বুঝলে আমি এটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছি?’

ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, ‘আমি একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলছি। কে কী বলবে আমার অনুমান করতে হয়।’

‘তাই বলে টুনির মতো ছোট একটা বাচ্চাকে তোমার সঙ্গে নেবে?’

ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, ‘আমি মোটেও টুনিকে নিচ্ছি না।’

‘তাহলে সবাই যে বলছে—’

ছোটাচ্চু হিংস্র গলায় বলল, ‘কে বলছে?’

‘ওই তো রনি, পিকু, টুশি, শায়লা—’

রনি, পিকু, টুশি, শায়লা—এরা এই বাসার মানুষজন। এদের নামও মনে রাখা সম্ভব না। দরকারও নেই।

ছোটাচ্চু মুখ আরও শক্ত করে বলল, ‘সবাই মিলে পেয়েছে কী? আমি সবগুলোকে খুন করে ফেলব।’

ভাবি হেসে বলল, ‘তুমি ডিটেকটিভ মানুষ, নিজেই যদি খুন করে ফেলো, তাহলে কেমন করে হবে? অন্যরা খুন করবে, তুমি সেটা বের করবে। বইয়ে তো সে রকমই লেখে।’ কথা শেষ করে ভাবি টেনে টেনে আরও কিছুক্ষণ হাসল।

ছোটাচ্চু বলল, ‘এটা মোটেও ঠাট্টার বিষয় না।’

কিছুক্ষণের মাঝে অনেকগুলো বাচ্চা ছোটাচ্চুকে ঘিরে ফেলল, তারা সবাই একসঙ্গে কথা বলতে লাগল। কথাগুলো ছিল এ রকম—যদিও সবাই একসঙ্গে কথা বলার কারণে কেউ কিছু শুনতে পারছিল না, বুঝতেও পারছিল না।

একজন বলল, ‘তুমি বলেছিলে এটা ছোটদের জন্য না, তাহলে টুনিকে কেন নিলে? আমাকে কেন নিলে না?’

আরেকজন বলল, ‘টুনি কি ছোট না? টুনি আমার থেকে ছোট।’

অন্যরা বলল, ‘টুনি তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট? কেন? কেন? কেন?’

‘তোমার সঙ্গে আমরা কোনো দিন খেলব না। তুমি টুনিকে নিলে আর আমরা এত করে বললাম আমাদের নিলে না।’

‘অন্যায়। অন্যায়। ঘোরতর অন্যায়।’

‘মানি না। মানি না।’

‘ধ্বংস হোক। ধ্বংস হোক।’

‘জ্বালো জ্বালো। আগুন জ্বালো।’

ছোটাচ্চু যদিও কারও কথাই স্পষ্ট করে শুনতে পাচ্ছিল না, তবু বুঝে গেল সবাই কী নিয়ে কথা বলছে। সে চিৎকার করে বলল, ‘চোপ। সবাই চোপ। এক্কেবারে চোপ।’

একজন মিনমিন করে বলল, ‘চোপ বলে কোনো শব্দ নাই। শব্দটা আছে চুপ।’

আরেকজন বলল, ‘চুপ থেকে পাওয়ারফুল হচ্ছে চোপ। তাই না ছোটাচ্চু?’

ছোটাচ্চু তাদের কারও কথার উত্তর না দিয়ে বলল, ‘আমি তোদের সবাইকে খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই। আমার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি মোটেও পোলাপানের খেলা না। এটা বড় মানুষদের দিয়ে তৈরি বড় মানুষের সমস্যা সমাধানের একটা সিরিয়াস এজেন্সি। এখানে কোনো বাচ্চাকে নেওয়া হয় নাই। টুনিকেও নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’

একজন বলল, ‘তাহলে টুনি যে বলল সে তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট?’

‘সে মোটেও আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট না। ডাক টুনিকে।’

টুনিকে ডাকতে হলো না, ঠিক তখন দেখা গেল টুনি তার স্টিলের তৈরি গোল গোল চশমা চোখে হেঁটে হেঁটে আসছে। মুখে একেবারে ঘন মেঘ কিংবা কংক্রিটের দেয়ালের মতো গাম্ভীর্য। ছোটাচ্চু হুংকার দিল, ‘টু-নি।’

টুনি দাঁড়িয়ে গিয়ে চশমার ফাঁক দিয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, কোনো কথা বলল না, বলা প্রয়োজন মনে করল না। ছোটাচ্চু আরও জোরে হুংকার দিয়ে বলল, ‘তুই নাকি সবাইকে বলে বেড়াচ্ছিস যে তুই আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট?’

টুনি না-সূচকভাবে মাথা নাড়ল। ছোটাচ্চু তখন তার গলা আরও এক ধাপ ওপরে তুলে বলল, ‘সবাই বলছে তুই এটা বলেছিস—’

টুনি প্রথমবার মুখ খুলল, বলল, ‘আমি সবাইকে বলেছি, তুমি তোমার বুদ্ধি দিয়ে কখনো তোমার ডিটেকটিভ এজেন্সি চালাতে পারবে না। এটা চালাতে হলে আমাকে তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট বানাতে হবে।’

ছোটাচ্চু চিৎকার করে বলল, ‘কী বললি? কী বললি তুই?’

টুনি কোনো উত্তর না দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে গেল। ছোটাচ্চু আরও জোরে চিৎকার করে বলল, ‘দেখলি, টুনির সাহসটা দেখলি তোরা? সে নিজেকে ভেবেছে কী? মাদাম কুরি নাকি হাইপেশিয়া?’

বাচ্চাকাচ্চারা মাদাম কুরিকে চেনে না, হাইপেশিয়া কি মানুষ না একটা রোগের নাম, সেটাও ধরতে পারল না। শুধু অনুমান করল ছোটাচ্চু খুব রেগেছে। তবে ছোটাচ্চুর রাগ নিয়ে বাচ্চাকাচ্চারা বেশি মাথা ঘামায় না। তাই তারা এবারও এটা নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করল না।

তবে মজার ব্যাপার হলো, এক সপ্তাহের মাঝে সবাই আবিষ্কার করল টুনির কথা একেবারে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি! ঘটনাটা হলো এভাবে: জোবেদা খানম তাঁর ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়ে যে তিনতলা কিংবা চারতলা (যেটা আসলে সাড়ে তিনতলাও হতে পারে) বাসায় থাকেন তার কাছাকাছি একটা একতলা বাসা আছে। একতলা বাসা বলে কেউ যেন সেটাকে তাচ্ছিল্য না করে, সেই বাসা দেখলে যে কেউ ট্যারা হয়ে যাবে। তবে বাসাটা উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা বলে কেউ বাসাটা দেখতে পায় না। তাই কেউ এখনো ট্যারা হয়ে যায়নি। বাসাটা অনেক জায়গাজুড়ে, মনে হয় তিন-চারটা ফুটবল মাঠের সমান। বাসার সামনে-পেছনে অনেক জায়গা, সেটাও মনে হয় পাঁচ-ছয়টা ফুটবল মাঠের সমান। বাসার ভেতরে নানা রকম গাছ। যেকোনো সময় সেখানে তিন-চারটা দামি দামি গাড়ি থাকে। বাসার সামনে ফুলের বাগানে নানা রকম ফুল ফুটে থাকে, কিন্তু সেগুলো কেউ দেখতে পায় না। তার কারণ কেউ ভেতরে ঢুকতে পারে না। বাসার সামনে যে বিশাল গেট সেখানে পাহাড়ের মতো একজন দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকে। গেট দিয়ে ভেতরে উঁকি দিলেই সেই দারোয়ান হুংকার দিয়ে বলে, ‘খ-ব-র-দা-র!’

সেই বাসার মালিকের নাম হাজি গুলজার খান, স্থানীয় লোকজন বলে গুলজার খান একসময় অনেক বড় গুন্ডা ছিল, চুরি-ডাকাতি-খুন করে বিশাল সম্পত্তি তৈরি করেছে, তারপর হজ করে এসে এখন ভালো মানুষ হয়ে গেছে। তার স্ত্রী কতজন, ছেলেমেয়ে কতজন সেটা কেউ ভালো করে জানে না, তবে সবাই একদিন খবর পেল হাজি গুলজার খানের মেয়ের বিয়ে। সেই বিয়ের আয়োজন দেখে সবার তাক লেগে গেল। বিয়ে উপলক্ষে কত কী যে হলো তার কোনো হিসাব নেই। আর এই বিয়ের কারণে এই এলাকার মানুষজন প্রথমবার হাজি গুলজার খানের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারল। মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে একেক দিন একেক আয়োজন, কোনো দিন কনসার্ট, কোনো দিন সার্কাস, কোনো দিন যাত্রাগান আবার কোনো দিন মেলা। এলাকার লোকজন সুযোগ পেয়ে সবাই ভিড় করে সেগুলো দেখতে গেল। জোবেদা খানমের নাতি-নাতনিরাও তখন প্রথমবার হাজি গুলজার খানের বাড়ির ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেল। সেখানে সারা দিন মেলা হয়, রাতের বেলা কোনো দিন কনসার্ট, কোনো দিন সার্কাস, কোনো দিন থিয়েটার, কোনো দিন যাত্রা। জোবেদা খানমের নাতি-নাতনিরা তাদের বাসার চার দেয়ালের মাঝখানে যা খুশি করতে পারে, কিন্তু বাড়ির বাইরে গেলে তাদের কঠিন নিয়ম মানতে হয়। সন্ধ্যাবেলার মাঝে তাদের সবার বাসায় ফিরে আসতে হয়। মাগরিবের আজানের পর কেউ বাইরে থাকতে পারে না। তাই তারা হাজি গুলজার খানের বাড়িতে শুধু মেলাটাই দেখতে পেল, কনসার্ট, সার্কাস, থিয়েটার বা যাত্রা দেখার সুযোগ পেল না।

অলংকরণ: সাদাত

মেলাটা অবশ্য বাচ্চাকাচ্চারা বেশ পছন্দ করল। নানা রকম জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে, তার মাঝে এক কোনায় মৃত্যুকূপ। সেখানে একজন খাড়া দেয়ালে মোটরসাইকেল চালায়। এ ছাড়া আছে নাগরদোলা, সেটাতে ওঠার সময় ঠিক আছে, নামার সময় পেটের মাঝে কেমন জানি চাপ লাগে, সবাই তখন একে অন্যের ওপর বমি করে দিল। নাগরদোলায় চড়ার থেকে বেশি আনন্দ হলো সেটা নিয়ে। এ ছাড়া ছিল সাপের খেলা। বেদেনিরা মোটা মোটা সাপ ধরে এনেছে, সুর করে গান গেয়ে সেই সাপ নিয়ে খেলা দেখায়। বাচ্চাকাচ্চাদের ধারণা ছিল, সাপ বুঝি ভেজা ভেজা তেলতেলে কিন্তু বেদেনিদের বললেই তারা গলায় সাপ ঝুলিয়ে দেয়, তখন তারা আবিষ্কার করল সাপের শরীর আসলে শুকনো খসখসে।

সাপের খেলার চেয়েও মজার খেলা হলো বানরের খেলা। শুকনো টিংটিংয়ে একটা মহাচালবাজ বানর নানা রকম খেলা দেখিয়ে গেল। বিয়ে করতে যাওয়া, শ্বশুরকে সালাম করা, শাশুড়িকে ভেংচি কাটা, বউয়ের সঙ্গে তামাশা করা, পাবলিকের পকেট কাটা, পুলিশের হাতে ধরা পড়ে হাজত খাটা, জেলখানায় বাথরুম পরিষ্কার করা সবার শেষে জেল থেকে বের হয়ে বড় মাস্তান হয়ে যাওয়া! এই পর্যায়ে টিংটিংয়ে শুকনো বানরটা তার ওস্তাদের কাছ থেকে একটা মুঠোফোন নিয়ে সেটা দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করল, ছবি তুলল—দেখে সবাই হেসে গড়াগড়ি খেলো। শুধু টুনি হাসল না, বলল, ‘এইটা স্মার্টফোন। স্মার্টফোন দিয়ে কেউ এইভাবে ছবি তোলে না। কেউ এইভাবে ফোন করে না।’

তাদের একজন বলল, ‘টুনি! এইটা মানুষ না। এইটা বানর।’

টুনি বলল, ‘বানর হয়েছে তো কী হয়েছে? ঠিকভাবে ব্যবহার করা শিখবে না? ফোনটা কত দামি দেখেছ?’

কেউ সেটা দেখেনি, দেখার দরকারও মনে করেনি। সবাই জানে টুনির সবকিছু নিয়ে সব সময়ই বাড়াবাড়ি।

হাজি গুলজার খানের মেয়ের বিয়ে নিয়ে নানা রকম আয়োজন, মনে হয় সারা দেশ থেকে লোকজন এসেছে, সেটা নিয়েও একটা ঝামেলা হলো। ঝামেলাটা অবশ্য বড় মানুষের সঙ্গে বড় মানুষের, ছোটদের সেটা জানার কথা না, বোঝার কথা না। কিন্তু তবু তারা না দেখার এবং না বোঝার ভান করে অনেক কিছু বুঝে গেল। হাজি গুলজার খানের বাড়িতে গ্রাম থেকে বিয়ে উপলক্ষে কাজ করার জন্য অনেক মানুষ আনা হয়েছে, তাদের মাঝে পুরুষ আছে, মহিলা আছে, কম বয়সী কিছু মেয়েও আছে। এই রকম একজন কম বয়সী মেয়ে হঠাৎ করে হাজি গুলজার খানের বাসা থেকে বের হয়ে সোজা জোবেদা খানমের কাছে এসে তার পা ধরে শুরু করল হাউমাউ করে কান্না। নানি বললেন, ‘কী হয়েছে মেয়ে? তুমি কাঁদো কেন?’

মেয়েটা বলল, ‘আপনি আমাকে বাঁচান।’

নানি বললেন, ‘তোমার কী হয়েছে না জানলে আমি কেমন করে বাঁচাব?’

মেয়েটা তখন চোখ মুছে আশপাশে তাকাল, বাচ্চারা তখন গভীর মনোযোগ দিয়ে পুরো বিষয়টা দেখছে। মেয়েটার মুখ দেখে বোঝা গেল সে বাচ্চাকাচ্চাদের সামনে কিছু বলতে চাইছে না। নানি তখন বাচ্চাদের বললেন, ‘এই তোরা এখান থেকে যা।’

অলংকরণ: সাদাত

ত্যাঁদড় টাইপের ছেলেটা বলল, ‘কেন? আমরা থাকলে কী হবে?’

নানি বললেন, ‘তোরা থাকলে আমি তোদের ঠ্যাঙ ভেঙে দেব।’

নানির কথা শুনে মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতেই ফিক করে হেসে দিল, তখন সবাই বুঝতে পারল মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দর এবং বেশ হাসিখুশি।

নানি ঘর থেকে বের করে দেওয়ার পর ঘরের ভেতরে কী নিয়ে কথা হলো বাচ্চারা কিছু জানতে পারল না কিন্তু দেখা গেল মেয়েটা যখন ঘর থেকে বের হয়েছে, তখন তার মুখে ঝলমলে হাসি। সে কোমরের মাঝে শাড়ি পেঁচিয়ে তখন তখনই রান্নাঘরে ঢুকে বাসন ধুতে শুরু করল। বাচ্চারা বুঝতে পারল, এই বাসায় মেয়েটার চাকরি হয়েছে, মেয়েটার কিছু একটা বিপদ ছিল, নানির কাছে চাকরি পেয়ে মেয়েটার সেই বিপদ কেটে গেছে। মেয়েটার নাম ঝুমু, বাচ্চারা তাকে ঝুমু খালা বলে ডাকতে লাগল এবং কিছুক্ষণের মাঝেই টের পেল ঝুমু খালা নামের মেয়েটা খুব মজার।

ঠিক কী জন্য মেয়েটা হাজি গুলজার খানের বাসা থেকে পালিয়ে নানির কাছে এসেছে, বিষয়টা জানার জন্য বাচ্চাদের সবারই খুব কৌতূহল।

আশপাশে যখন কেউ নেই তখন ত্যাঁদড় টাইপের ছেলেটা ঝুমু খালার কাছ থেকে সেটা বের করার চেষ্টা করল, তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল ‘আচ্ছা ঝুমু খালা, তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি?’

ঝুমু খালা রান্নাঘরে একটা ডেকচি সাংঘাতিকভাবে ডলাডলি করছিল, ডলাডলি না থামিয়েই বলল, ‘করো।’

‘গুলজার খানের বাড়িতে তোমার কী সমস্যা হয়েছিল?’

ঝুমু খালা ডেকচিটা পানিতে ধুতে ধুতে বলল, ‘শুনতে চাও?’

ত্যাঁদড় টাইপের ছেলেটা মাথা নাড়ল, বলল, ‘হ্যাঁ।’

‘ভয় পাবা না তো?’

‘না। ভয় পাব কেন?’

‘শোনো তাহলে।’ বলে ঝুমু খালা হাজি গুলজার খানের বাসাটার একটা ভয়ংকর বর্ণনা দিল। বাসাটা বাইরে থেকে চকচকে মনে হলেও ভেতরে অন্ধকার গুহার মতো। সেখানে ছোট-বড়-মাঝারি ভূত এবং ভূতের বাচ্চারা ঘোরাঘুরি করে। রাতের বেলা সেই ভূতের একটা বাচ্চা ঝুমু খালার পায়ের বুড়ো আঙুলে কামড়ে ধরেছিল। ঝুমু খালা রুটি বেলার বেলুনি দিয়ে পিটিয়ে সেটাকে আধমরা করে ফেলেছিল। (গল্পের এই অংশে ঝুমু খালা ত্যাঁদড় টাইপের ছেলেটাকে তার পায়ের বুড়ো আঙুলটা দেখাল, সত্যি সত্যি সেখানে ছাল উঠে আছে।) ভূতটা আধমরা হওয়ার পর ঝুমু খালা সেটাকে একটা জেলির খালি বোতলে ভরে আটকে রেখেছে। সেটাকে উদ্ধার করার জন্য প্রতি রাতে ছোট-বড়-মাঝারি ভূত এবং ভূতের বাচ্চারা এসে হামলা করে। ভূতের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে ঝুমু খালা সেই বাড়ি ছেড়ে নানির কাছে চলে এসেছে।

ত্যাঁদড় টাইপের ছেলেটা হাঁ করে ঝুমু খালার দিকে তাকিয়ে রইল, একজন মানুষ যে এ রকম আজগুবি একটা গল্প এ রকম বিশ্বাসযোগ্য করে বলতে পারে, সে নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করত না। আমতা আমতা করে বলল, ‘ভূতের বাচ্চাটা এখনো জেলির বোতলে আছে?’

ঝুমু খালা মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ। আছে।’

‘আমাকে দেখাবা?’

‘দিনের বেলা তো দেখানো যায় না। রাতে দেখতে হয়।’

‘রাতে দেখাবা?’

ঝুমু খালা তখন চিন্তিত মুখ করে বলল, ‘দেখি! তোমরা ছোট পোলাপান। ভয় পেয়ে প্যান্টে পিশাব করে দিলে ঝামেলা।’

ত্যাঁদড় টাইপের ছেলেটা মুখ কালো করে ফিরে এল, সে যথেষ্ট বড় হয়েছে, এই বয়সে সে প্যান্টে পেশাব করে দেবে সে জন্য তাকে ভূতের বাচ্চা দেখানো যাবে না, বিষয়টা তার পক্ষে হজম করা খুব কঠিন।

দেখা গেল ঝুমু খালা যে শুধু বানিয়ে বানিয়ে ভয়ংকর আজগুবি গল্প বিশ্বাসযোগ্যভাবে বলতে পারে তা না, এলাচি-দারুচিনি দিয়ে পায়েসের মতো একধরনের চা বানাতে পারে, খুব অল্প তেল দিয়ে অসাধারণ পরোটা বানাতে পারে, লাল মরিচ দিয়ে ঝাল করে চ্যাপা শুঁটকির ভর্তা বানাতে পারে। তার সবচেয়ে বড় প্রতিভা হচ্ছে স্বপ্নের অর্থ বলে দেওয়া—হাতি স্বপ্ন দেখলে কী হয়, জাহাজ স্বপ্ন দেখলে কী হয়, এমনকি তেঁতুলগাছে বাদুড় বসে আছে স্বপ্ন দেখলে কী হয়, সেটাও বলে দিতে পারে। ছোট বাচ্চাকাচ্চারা তাকে খুব পছন্দ করল, বড়রা আগে বাচ্চাদের দিয়ে যে কাজগুলো করাতে পারেনি, ঝুমু খালা প্রথম চব্বিশ ঘণ্টার মাঝেই সেটা করিয়ে ফেলল। নানি জোবেদা খানমও তাকে খুব পছন্দ করলেন, কারণ তার কাজ শেষ করে ঝুমু খালা নানির পায়ের কাছে বসে তার পায়ে ঝাঁজালো সরিষার তেল মাখিয়ে মালিশ করতে করতে টেলিভিশনে সিরিয়াল দেখতে লাগল এবং সিরিয়ালের বিভিন্ন চরিত্রের সমালোচনা করতে লাগল। বেশির ভাগই নানির সঙ্গে মিলে গেল বলে নানি খুব খুশি।

ঝুমু খালা নানির কাছে মাত্র এক সপ্তাহ থাকার অনুমতি চেয়েছিল। এর মাঝে বাড়ি থেকে লোক এসে তাকে নিয়ে যাবে। সবাই মিলে ঝুমু খালাকে হয়তো পাকাপাকিভাবে রেখেই দিত কিন্তু এক দিন পরেই তাকে বিদায় করে দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে হলো, তার কারণ ঝুমু খালা যেদিন এসেছে, সেদিনই বড় মামার মানিব্যাগ, মেজো চাচির এক জোড়া কানের দুল আর ছোট খালার একটা মুঠোফোন চুরি হয়ে গেল। এই বাসায় বাইরের কোনো মানুষ আসে না, কাজেই কোনো কিছু চুরি হলে বাসার ভেতরের কাউকেই চুরি করতে হবে। মানুষটা ঝুমু খালা ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে না—শুধু সে-ই এই বাসার নতুন মানুষ।

চুরির খবরটা শোনার পর বাসার সবার খুব মন খারাপ হলো। এ রকম কমবয়সী হাসিখুশি একজন মেয়ে দেখে বোঝাই যায় না তার এ রকম একটা অভ্যাস রয়েছে, সেটা মেনে নেওয়া কঠিন।

যখন ঝুমু খালা আশপাশে নেই তখন বড় মামা বলল, ‘এত চমৎকার মসলা চা বানায় অথচ চুরির অভ্যাসটা ছাড়তে পারল না।’

মেজো চাচির এক জোড়া কানের দুল গিয়েছে, তাই তার খুব মেজাজ খারাপ। মেজো চাচি বলল, ‘একে তো বিদায় করেই দিতে হবে। কিন্তু বিদায় করার আগে আমার কানের দুল জোড়া উদ্ধার করে দেবে না?’

মেজো চাচা মাথা চুলকে বলল, ‘কেমন করে?’

‘জিনিসপত্র সার্চ করলেই বের হয়ে যাবে।’

বড় মামা বলল, ‘শুধু সন্দেহের বশে একজনের জিনিসপত্র সার্চ করা যায় না। এতে মানুষকে অসম্মান করা হয়।’

‘অসম্মান?’ মেজো চাচি বলল, ‘যে চুরি করতে পারে তাকে সম্মান করতে হবে?’

বড় মামা দার্শনিকের মতো একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘সবাইকে সব সময় সম্মান করতে হয়। তা ছাড়া আমরা তো নিশ্চিতভাবে জানি না ঝুমুই চুরি করেছে।’

‘আর কে করবে? জানালার ওই পাশে খাড়া দেয়াল, বাইরে থেকে কেউ নিতে পারবে না। নিতে হলে ভেতরের কাউকে নিতে হবে। ভেতরে ঝুমু ছাড়া আর কে আছে?’

বড় মামা মাথা নাড়ল, বলল, ‘তবু তো আমরা নিশ্চিত না। যদি হাতেনাতে ধরা যেত তাহলে একটা কথা ছিল।’

তখন সবাই একসঙ্গে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, সবার একসঙ্গে মনে পড়ল যে ছোটাচ্চুর একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি আছে। মেজো চাচি ছোটাচ্চুকে বলল, ‘তোমার না এত বড় ডিটেকটিভ এজেন্সি। এই চোরকে হাতেনাতে ধরে দাও।’

ছোটাচ্চু মাথা চুলকে বলল, ‘অ্যাঁ, অ্যাঁ, অ্যাঁ—’

ছোট খালার মুঠোফোনটা গিয়েছে, সে একটু খুশিই হয়েছে, নতুন আরেকটা স্মার্টফোন কিনতে পারবে, কিন্তু চুরি হওয়া মুঠোফোনে সবার টেলিফোন নম্বর ছিল, সেটাই হয়েছে সমস্যা। তাই ছোট খালা বলল, ‘হ্যাঁ। আমার মুঠোফোনটা উদ্ধার করে দাও। তোমাকে একটা পুরস্কার দেব।’

ছোট চাচা আবার মাথা চুলকে বলল, ‘ইয়ে মানে হয়েছে কী—’ কিন্তু কী হয়েছে সেটা আর বলল না।

ছোট খালা তখন জানতে চাইল, ‘কী হয়েছে?’

‘মানে—’ ছোট চাচা ইতস্তত করে বলল, ‘হাতেনাতে ধরতে হলে ক্রাইমটা যখন ঘটে তখন থাকতে হয়। কিন্তু ক্রাইমটা তো ঘটে গেছে এখন তো আর হাতেনাতে ধরার সুযোগ নেই।’

মেজো চাচি ঠোঁট উল্টে বলল, ‘তাহলে তুমি কিসের ডিটেকটিভ হলে?’

ছোটাচ্চু মাথা চুলকে বলল, ‘ডিটেকটিভের কাজ হচ্ছে অপরাধীকে ধরা। এই কেসে সেটা তো ধরাই হয়ে গেছে। কাজেই আমার তো কোনো কাজ নেই।’

মেজো চাচি বলল, ‘কোথায় অপরাধীকে ধরা হয়েছে? আমি একটু আগে দেখেছি ঝুমু হি হি করে হাসতে হাসতে আনন্দে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ওকে ঠিক করে ধরতে হবে। দরকার হলে পুলিশে দিতে হবে।’

ছোটাচ্চু মুখটা সুচালো করে খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, ‘একটা কাজ করা যায়।’

‘কী কাজ?’

‘অপরাধীকে আরেকবার ক্রাইম করার সুযোগ করে দেওয়া যাক। এবার যখন ক্রাইম করবে, তখন হাতেনাতে ধরা হবে।’

বড় মামা এতক্ষণ কোনো কথা না বলে চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল, এবার বলল, ‘এটা অনৈতিক কাজ। একজন মানুষকে অপরাধ করতে প্ররোচনা দেওয়া অপরাধ করার মতোই অন্যায়—’

বড় মামি বলল, ‘রাখো তোমার নীতিকথা! আমাদের সোনা গয়না মোবাইল মানিব্যাগ হাওয়া হয়ে যাচ্ছে আর তোমার বড় বড় কথা।’

অলংকরণ: সাদাত

এই বাসায় যখনই বড়রা কথা বলে তখন সব সময়ই আশপাশে বেশ কিছু বাচ্চাকাচ্চা থাকে। এখানেও তারা আছে আর গভীর মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনছে। মনোযোগ দিয়ে শুনছে টুনি। এখানে যে বাচ্চাকাচ্চা আছে তারা সবাই ঝুমু খালার ভক্ত, কেউ চিন্তাই করতে পারে না যে ঝুমু খালার মতো মানুষ এ রকম কাজ করতে পারে। হঠাৎ করে ছোটাচ্চুর খেয়াল হলো বেশ কিছু বাচ্চাকাচ্চা তার কথা শুনছে, সঙ্গে সঙ্গে খুব ব্যস্ত হয়ে ছোটাচ্চু সবাইকে ঘর থেকে বের করে দিল, বলল, ‘যা ভাগ। ভাগ এখান থেকে।’

একজন আপত্তি করে বলল, ‘কেন? ভাগতে হবে কেন?’

ছোটাচ্চু হুংকার দিয়ে বলল, ‘আবার মুখে মুখে তর্ক করে? বের হ বলছি।’

কাজেই বাচ্চাকাচ্চাদের বের হয়ে আসতে হলো, তারা খুব মনমরা হয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, তখন একজন বলল, ‘ঝুমু খালাকে সাবধান করে দিতে হবে।’

টুনি বলল, ‘কোনো দরকার নাই।’

সবাই একসঙ্গে টুনির দিকে তাকাল, বলল, ‘কেন?’

‘ঝুমু খালা মোটেও এইগুলি চুরি করে নাই।’

‘তাহলে কে করেছে?’

টুনি উত্তরটা জানে না, তাই চুপ করে রইল। ত্যাঁদড় টাইপ জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কেমন করে জানিস ঝুমু খালা চুরি করে নাই।’

‘ঝুমু খালার অনেক বুদ্ধি। বুদ্ধিমান মানুষ বোকার মতো চুরি করে না।’

‘তাহলে কে চুরি করেছে?’

‘চুরি করেছে বাইরের কেউ।’

‘বাইরের কেউ বাসার ভেতরে কেমন করে ঢুকেছে?’

টুনি কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে হাঁটতে থাকে। বাইরের কেউ বাসার ভেতরে কেমন করে ঢুকেছে সে জানে না। হয়তো ঢোকেনি। বাসার ভেতরে না ঢুকেই কীভাবে বাসার ভেতরের জিনিস চুরি করে নেওয়া যায় টুনি সেটা এখনো চিন্তা করে বের করতে পারল না। সে অবশ্য চিন্তা করা থামাল না, চিন্তা করতে লাগল। টুনি জানে ছোটাচ্চু এটা বের করতে পারবে না, তাকেই এটা বের করতে হবে।

ছোটাচ্চু চোরকে হাতেনাতে ধরার জন্য খুব গোপনে একটা ব্যবস্থা নিল। তার মোটা কলমের মতো ভিডিও ক্যামেরাটা নানির ঘরের জানালার সঙ্গে বেঁধে দিল। বাঁধল অনেক উঁচুতে যেন ঘরের ভেতরে কেউ থাকলে সেটা সহজে চোখে না পড়ে। নানির বিছানার কাছে টেবিলে বেশ কিছু লোভনীয় জিনিস ছড়িয়ে রাখা হলো। লোভনীয় জিনিসগুলো হলো কিছু টাকা, একটা মুঠোফোন এবং একটা গলার হার। হারটা দেখে সোনার মনে হলেও এটা আসলে ইমিটেশন, চোরের পক্ষে সেটা জানার কোনো উপায় নেই। ছোটাচ্চু তার ডিটেকটিভ এজেন্সির পুরো কাজটা করল খুব গোপনে, যেন কেউ সেটা টের না পায়। কিন্তু বাচ্চারা সবাই সেটা জেনে গেল কিন্তু সবাই ভান করল তারা জানে না। বাসার বড় মানুষদের শান্ত রাখার জন্য তাদের সবারই মাঝে মাঝে এ রকম কিছু করতে হয়। বড় মানুষদের নানা কাজকর্ম দেখেও না দেখার ভান করতে হয়।

ছোটাচ্চু মোটামুটি নিঃসন্দেহ ছিল পরদিন ভোরের মধ্যে চোরের সব কাজকর্ম ভিডিও ক্যামেরায় ধরা পড়ে যাবে। এভাবে হাতেনাতে ধরা পড়ার পর চোরকে শায়েস্তা করার কাজটা হবে পানির মতো সোজা।

ছোটাচ্চু কখনোই ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে পারে না কিন্তু পরদিন সে অ্যালার্ম ছাড়াই ঘুম থেকে উঠে পড়ল। ঘুম থেকে উঠেই সে নানির ঘরে ছুটে এল, বিছানার কাছে টেবিলে টাকা, মুঠোফোন কিংবা ইমিটেশন সোনার হার কেউ স্পর্শ করেনি। ঘরের মাঝখানে টুনি দাঁড়িয়ে ছিল, সে আঙুল দিয়ে জানালার ওপরে দেখিয়ে বলল, ‘নিয়ে গেছে।’

‘কী নিয়ে গেছে?’

‘তোমার ভিডিও ক্যামেরা।’

ছোটাচ্চু চমকে উঠল, জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কে নিয়েছে?’

‘মনে হয় চোর।’

ছোটাচ্চু প্রায় হাহাকার করে বলল, ‘আ-আ-আমার এত দামি ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে গেছে?’

টুনি কোনো কথা বলল না, সে অপ্রয়োজনীয় কথা বলে না। ছোটাচ্চু তখন আরও জোরে হাহাকার করে বলল, ‘কেমন করে নিল?’

টুনি এবার উত্তর দিল, বলল, ‘তুমি চেয়ারের ওপর একটা মোড়া রেখে তার ওপর দাঁড়িয়ে তোমার ভিডিও ক্যামেরা ফিট করেছিলে।’

‘তু-তুই কেমন করে জানিস?’

‘সবাই জানে। তোমরা মনে করো কেউ জানে না। এই বাসার বড় মানুষেরা একটু হাবা টাইপের।’

‘হা-হাবা টাইপের?’

টুনি এই প্রশ্নের উত্তর দিল না, বলল, ‘তুমি অনেক উঁচুতে ভিডিও ক্যামেরাটা লাগিয়েছ, সেটা খুলে নিতে হলে চোরটাকে অন্তত আট ফুট লম্বা হতে হবে। এই বাসায় আট ফুট লম্বা কোনো মানুষ নাই, কোনো মানুষ ঢুকে নাই।’

‘তাহলে?’

টুনি বলল, ‘তুমি ডিটেকটিভ, তুমি বের করো।’

এ রকম সময় নানি ঘরে ঢুকলেন, তার ঘরে এত কিছু হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেটা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হলো না। নানি এদিক-সেদিক কিছু একটা খুঁজতে লাগলেন। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, ‘কী খুঁজছ, মা।’

‘আমার পানের বাটা।’

নানিকে একজন খুব ছোট প্রায় সিগারেটের বাক্সের সাইজের একটা পানের বাটা এনে দিয়েছিল। নানি বাইরে কোথাও গেলে সেটাতে পান-সুপারি ভরে ব্যাগে করে নিয়ে যান। মনে হলো নানি সেটা খুঁজে পাচ্ছেন না।

ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় রেখেছিলে?’

নানি বললেন, ‘এই তো। এইখানে, জানালার কাছে।’

খুঁজে দেখা গেল জানালার কাছে কিছু নেই। টুনি গম্ভীর গলায় বলল, ‘চোর টাকা, মোবাইল কিংবা সোনার হার নেয় নাই কিন্তু নানির পানের বাটা নিয়ে গেছে।’

ছোটাচ্চু কোনো উত্তর না দিয়ে কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার দামি ভিডিও ক্যামেরাটার দুঃখ সে এখনো ভুলতে পারছে না। টুনি কিছুক্ষণ ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ছোটাচ্চু।’

‘কী হলো?’

‘কী হচ্ছে তুমি বুঝতে পারছ?’

‘না। কী হচ্ছে?’

টুনি হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, ‘কী হচ্ছে দেখতে পাচ্ছ না? জানালার কাছে কিছু থাকলেই সেটা চুরি হচ্ছে। নানির পানের বাটা, তোমার ভিডিও ক্যামেরা, মেজো চাচির কানের দুল, ছোট খালার মোবাইল টেলিফোন, বড় মামার মানিব্যাগ, এর প্রত্যেকটা ছিল জানালার কাছে। তার অর্থ জানালার বাইরে থেকে কেউ এগুলো নিচ্ছে।’

অলংকরণ: সাদাত

ছোটাচ্চু মুখ খিঁচিয়ে বলল, ‘গাধার মতো কথা বলিস না। জানালার ওই পাশে দাঁড়ানোর জায়গা আছে? খাড়া দেয়াল!’

টুনি মাথায় টোকা দিয়ে বলল, ‘ব্রেনটাকে ব্যবহার করো। থিংক। থিংক। থিংক। ডিটেকটিভদের চিন্তা করতে হয়। তোমার সমস্যা হলো তুমি চিন্তা করো না।’

ছোটাচ্চু আরও রেগে গিয়ে বলল, ‘বড় বড় কথা বলিস না। ভাগ এখান থেকে।’

কাজেই টুনি সরে পড়ল।

দিনটা ছুটির দিন ছিল, তাই বাচ্চারা ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা করেই বাসা থেকে বের হয়ে গেল হাজি গুলজার খানের বাসায় মেলা দেখতে। আজকের মেলা খুবই জমেছে। রনপা লাগিয়ে দশ ফুট উঁচু একজন মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার হাতে লজেন্স, ছোট বাচ্চারা গেলেই ওপর থেকে তাদের লজেন্স ছুড়ে দিচ্ছে। ছোট ছোট কিছু কুকুরের খেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কুকুরগুলো একটা ছোট ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে ড্রামটাকে গড়িয়ে গড়িয়ে নিচ্ছে, ভারী মজা দেখতে। মাঠের এক কোনায় পর্দা দিয়ে ঢেকে একটা জায়গায় নর রাক্ষসের আসর করা হয়েছে। প্রতি ঘণ্টায় একবার করে নর রাক্ষস এসে জ্যান্ত হাঁস-মুরগি-ছাগল খেয়ে ফেলে, তখন তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না। এখানে ছোট বাচ্চাদের ঢোকা নিষেধ, তাই তারা বাইরে ঘোরাঘুরি করছে। সাপের খেলার সঙ্গে এখন একটা বেজি আনা হয়েছে। বেজি আর সাপ একে অন্যের সঙ্গে মারামারি করে—রীতিমতো ভয়ংকর দৃশ্য। বানরের খেলা তো আছেই।

বাচ্চারা ঘুরে ঘুরে সব খেলা দেখছে, টুনি ছাড়া। সে সেই সকাল থেকে বানরওয়ালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে ধৈর্য ধরে বানরের খেলা দেখে যাচ্ছে—বারবার একই খেলা। টুনি অপেক্ষা করে থাকে খেলার শেষটা দেখার জন্য। তখন বানরটা সন্ত্রাসী গডফাদার হয়ে মুঠোফোন দিয়ে ফোন করে। টুনি তখন তীক্ষ দৃষ্টিতে মুঠোফোনটা লক্ষ করে। বানরওয়ালা তার ঝোলার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একেকবার একেকটা ফোন বের করে দেয়। এই বানরওয়ালার কাছে অনেকগুলো মুঠোফোন। টুনি বানরওয়ালার ঝোলাটা লক্ষ করল, লাল রঙের একটা ঝোলা। এক টুকরা লাল সালুর চারকোনা বেঁধে একটা ঝোলা তৈরি করা হয়েছে। এই ঝোলার ভেতরে মনে হয় অনেক কিছু আছে।

‘টুনি, দশ টাকা ধার দিবি?’ গলার স্বর শুনে টুনি ঘুরে তাকাল, ত্যাঁদড় টাইপ তার কাছে টাকা ধার চাইতে এসেছে। তার চোখে-মুখে উত্তেজনা। অনেকগুলো বাচ্চাকাচ্চা বলে এখন পর্যন্ত টুনি ছাড়া অন্য কারও নাম বলা হয়নি, এখন মনে হয় ত্যাঁদড় টাইপের নামটা বলা যায়। তার নাম হচ্ছে শান্ত, যদিও নামকরণটি একেবারেই ঠিক হয়নি। ‘দুর্দান্ত’ হলে ঠিক হতো, অন্ততপক্ষে ‘অশান্ত’ হওয়া উচিত ছিল। শান্ত টুনির থেকে দুই বছরের বড় কিন্তু তার বাড়ন্ত শরীর দেখে আরও বড় মনে হয়।

শান্ত টুনির কাছে মুখ এনে বলল, ‘দিবি? কালকেই ফেরত দিয়ে দেব।’

শান্তকে টাকা ধার দিয়ে এখন পর্যন্ত কেউ কোনো টাকা ফেরত পায়নি কিন্তু টুনি শান্তকে সেটা মনে করিয়ে দিল না। বলল, ‘কী জন্য?’

‘নর রাক্ষসের খেলা দেখব। বাচ্চাকাচ্চাদের ঢোকা নিষেধ। গেটে যে মানুষটা আছে তার সঙ্গে কথা বলেছি। দশ টাকা ঘুষ দিলে আমাকে ঢুকতে দেবে।’

শান্তকে কেউ কখনো টাকা ধার দেয় না, দেওয়া উচিত না কিন্তু টুনি তার পকেট থেকে দুইটা দশ টাকার নোট বের করে বলল, ‘আমি তোমাকে দশ টাকা না, পুরো বিশ টাকা দেব। ধারও না, একেবারে দিয়ে দেব। এই টাকা তোমার ফেরত দিতে হবে না। কিন্তু তোমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে।’

শান্তর চোখ চকচক করে উঠল, ‘কী কাজ?’

‘সেটা তোমাকে একটু পরে বলব। ঠিক আছে?’

শান্ত মাথা নাড়ল, ‘ঠিক আছে।’ কী কাজ তার জানার প্রয়োজন নেই। দশ টাকার জন্য সে যেকোনো কাজ করতে রাজি আছে। এর অর্ধেক টাকা বাজি ধরে সে একবার একজনের জুতার তলা চেটে দিয়েছিল।

টুনি শান্তকে দশ টাকার একটা নোট দিল, বলল, ‘দশ টাকা অ্যাডভান্স। কাজ শেষ হলে বাকি দশ টাকা।’

‘কী করতে হবে বলো।’

‘একটু পরে বলব, তুমি এখন নর রাক্ষসের খেলা দেখে এসো।’

শান্ত দশ টাকার নোটটা হাতে নিয়ে নর রাক্ষসের খেলা দেখতে ছুটে গেল, টুনি রওনা দিল বাসার দিকে। কী করবে সেটা ঠিক করে ফেলেছে। এখন সবকিছু ভালয় ভালয় শেষ হলে হয়।

বাসার সিঁড়িতে ঝুমু খালার সঙ্গে দেখা হলো। সে সিঁড়িতে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। মুখ দেখে মনে হলো একটু আগে হয়তো কেঁদেছে। টুনি জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে ঝুমু খালা?’

ঝুমু খালা মাথা নেড়ে বোঝাল কিছু হয়নি। এর আগে যখনই তাকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়েছে, সে প্রতিবারই বিদঘুটে কিছু একটা উত্তর দিয়েছে। কী নাশতা তৈরি হয়েছে জিজ্ঞেস করার পর আজ সকালেই ঝুমু খালা বলেছে, ‘পরোটার সঙ্গে বাঘের মাংস। বাঘের মাংস সেদ্ধ হতে চায় না বলে অনেকক্ষণ জ্বাল দিতে হচ্ছে, আঁশটে গন্ধ দূর করার জন্য অনেক বেশি গরম মসলা দিতে হয়েছে।’ সেই ঝুমু খালা মুখে কোনো কথা না বলে শুধু মাথা নেড়ে উত্তর দিচ্ছে, বিষয়টা যথেষ্ট অস্বাভাবিক। টুনি সাধারণত দ্বিতীয়বার কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে না কিন্তু আজকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে? বলো।’

ঝুমু খালা একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি নাকি চোর। আমি নাকি মোবাইল ফোন, কানের দুল এসব চুরি করেছি। খোদা আমারে গরিব বানাইছে কিন্তু চোর তো বানায় নাই।’ বলে ঝুমু খালা চোখে আঁচল দিয়ে কাঁদতে লাগল।

টুনি সিঁড়িতে ঝুমু খালার পাশে বসে বলল, ‘তুমি চুরি করো নাই।’ ঝুমু খালা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি জানি। কিন্তু তোমরা পোলাপান মানুষ, তোমরা বললে কে বিশ্বাস করবে।’

‘করবে। আমি যখন আসল চোরকে ধরব তখন সবাই বিশ্বাস করবে।’

ঝুমু খালা ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠে সোজা হয়ে বসল। টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি আসল চোর কে সেইটা জানো?’

‘এখনো পুরোপুরি জানি না। কিন্তু অনুমান করতে পারি।’

‘কে?’ ঝুমু খালা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘কোন বান্দীর পোলা? আমি যদি হারামজাদার মুণ্ডু ছিঁড়ে না আনি তাহলে আমি বাপের বেটি না—’

টুনি ঝুমু খালার কথা শুনে একটু হেসে ফেলল। বলল, ‘আস্তে ঝুমু খালা, আস্তে। আগেই এত ব্যস্ত হয়ো না, মুণ্ডু ছিঁড়তে হবে নাকি লেজ ছিঁড়তে হবে, এখনো আমরা জানি না।’

‘লেজ?’ ঝুমু চোখ কপালে তুলে বলল, ‘লেজ?’

‘একটু পরেই সেটা জানতে পারব। তুমি খালি আমাকে একটা কাজ করে দাও।’

‘কী কাজ?’

‘লাল কাপড়ের একটা ঝোলা তৈরি করে দাও।’

ঝুমু খালা অবাক হয়ে বলল, ‘লাল কাপড়ের ঝোলা?’

‘হ্যাঁ। পারবে?’

ঝুমু খালা খানিকক্ষণ কিছু একটা চিন্তা করে বলল, ‘ছোট ভাবির একটা লাল পেটিকোট ধুতে দিয়েছে। সেটা দিয়ে বানানো যায়—’

টুনি ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘প্লিজ প্লিজ বানিয়ে দাও। এক্ষুনি। একেবারে সত্যি ঝোলা হতে হবে না, ঝোলার মতো হলেই হবে। আমি নষ্ট করব না, আবার ফিরিয়ে দেব।’

‘ঠিক তো?’

‘ঠিক।’

‘মোবাইল, মানিব্যাগ, কানের দুলের চোর হয়ে আছি। পেটিকোট চোর হতে চাই না।’

ঝুমু খালা ময়লা কাপড়ের স্তূপ থেকে একটা লাল পেটিকোট বের করে সেটাকে বেশ কায়দা করে ভাঁজ করে এদিকে-সেদিকে কয়েকটা সেফটিপিন লাগিয়ে দিয়ে একটা ঝোলার মতো করে দিল। রান্নাঘর থেকে কয়েকটা আলু, বসার ঘর থেকে দু-একটা বই, বাথরুম থেকে কয়েকটা শ্যাম্পুর খালি বোতল ভরে টুনি ঝোলাটাকে মোটামুটি ভরে নিল।

ঝুমু খালা জিজ্ঞেস করল, ‘ঠিক হয়েছে?’

টুনি মাথা নাড়ল।

ঝুমু খালা জিজ্ঞেস করল, ‘এখন কী করবে?’

‘চোর ধরতে যাব।’

‘কোনো বিপদ হবে না তো?’

‘এখনো জানি না।’

‘সাবধান।’

টুনি বাসা থেকে বের হওয়ার আগে ছোটাচ্চুর ঘরে গেল। ছোটাচ্চু বিছানায় আধশোয়া হয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে তার হলুদ বইটা পড়ছে। টুনিকে দেখে মুখ শক্ত করে বলল, ‘কী খবর টুনটুনি? এই লাল ঝোলা নিয়ে কী করিস?’

টুনি প্রশ্নটা না শোনার ভান করে বলল, ‘আমি যদি তোমার ভিডিও ক্যামেরা, মেজো চাচির কানের দুল, বড় মামার মানিব্যাগ, ছোট খালার মোবাইল ফোন, নানির পানের বাটার চোরকে ধরে দিই তাহলে তুমি কি আমাকে তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট বানাবে?’

ছোট চাচা চোখ বড় বড় করে বলল, ‘কী বললি? কী বললি তুই?’

‘আমি কী বলেছি তুমি শুনেছ।’

‘তুই জানিস, চোর কে?’

‘এখনো জানি না। পনেরো মিনিটের মধ্যে জানব।’

‘প-পনেরো মিনিট? কীভাবে?’

‘যদি দেখতে চাও তাহলে ঠিক পনেরো মিনিট পরে তুমি হাজি গুলজার খানের মাঠে মেলাতে বানরের খেলা দেখতে এসো।’

ছোটাচ্চুর মুখটা কেমন যেন হাঁ হয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, ‘গু-গু-গুলজার খানের মাঠে? বা-বা-বানরের খেলা?’

‘হ্যাঁ। ঠিক পনেরো মিনিট পরে। আগে আসলেও হবে না, পরে আসলেও হবে না।’

ছোটাচ্চু ততক্ষণে বিছানা থেকে নেমে এসেছে। হলুদ বইটা টেবিলে রেখে টুনির দিকে এগিয়ে এল। টুনি অপেক্ষা করল না। দরজা বন্ধ করে তার লাল ঝোলা নিয়ে ছুটতে লাগল। বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তা পার হয়ে এক দৌড়ে হাজি গুলজার খানের মাঠে।

ত্যাঁদড় টাইপ শান্তকে খুঁজে পেতে কোনো সমস্যা হলো না। সে রনপা দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষটিকে জ্বালাতন করছিল, টুনিকে দেখে এগিয়ে এল, বলল, ‘দে আমার বাকি দশ টাকা।’

‘দেব। আগে আমার কাজটা করে দাও।’

‘কী কাজ?’ তখন তার হঠাৎ করে টুনির কাঁধে ঝোলানো লাল ঝোলাটা চোখে পড়ল।। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এই ক্যাটক্যাটে লাল ঝোলা কই পেলি? ভেতরে কী?’

‘একটু পরেই তুমি দেখবে। আগে আমার কাজটা করে দাও।’

‘কী কাজ?’

‘ওই যে বানরওয়ালা খেলা দেখাচ্ছে, আমি সেখানে গিয়ে বানরওয়ালার ঠিক পেছনে দাঁড়াব। তুমি দাঁড়াবে সামনে। বানর খেলা দেখাতে দেখাতে যখন তোমার কাছে আসবে, তখন তুমি বানরের গলার দড়িটা ধরে একটা টান দিয়ে বানরওয়ালার হাত থেকে ছুটিয়ে আনবে।’

‘ছুটিয়ে আনব?’

‘হ্যাঁ, কোনো সমস্যা হবে না। আমি দেখেছি দড়িটা সে পায়ের নিচে চাপা দিয়ে রাখে, টান দিলেই ছুটে আসবে।’

‘কিন্তু কিন্তু—’

টুনি শান্ত গলায় বলল, ‘আমার কথা এখনো শেষ হয় নাই।’

শান্ত মুখ শক্ত করে বলল, ‘শেষ করো তাহলে।’

‘বানরের দড়িটা ছুটিয়ে নেওয়ার পর বানরটাকে কোলে নিয়ে ছুটে পালাবে।’

শান্ত চোখ কপালে তুলে বলল, ‘ছুটে পালাব?’

‘হ্যাঁ।’

‘বানর কোলে নিয়ে?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমি প্রকাশ্য দিনের বেলায় হাজার হাজার মানুষের সামনে একটা বানরকে চুরি করে নিয়ে যাব? তারপর পাবলিক যখন পিটিয়ে আমাকে তক্তা বানাবে—’

টুনি বলল, ‘মোটেও তক্তা বানাবে না। পাবলিক কিছু বুঝতেই পারবে না কী হচ্ছে, শুধু বানরওয়ালা তোমার পিছু পিছু ছুটে আসবে। তখন তুমি বানরওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করবে।’

‘ঝগড়া? আমি বানর চুরি করব আর আমিই আবার ঝগড়া করব?’

‘কেন? সমস্যা আছে? তুমি ঝগড়া করতে পারো না? তোমার চাইতে ভালো ঝগড়া আর কে করতে পারে?’

শান্ত এটাকে প্রশংসা হিসেবে ধরে নিয়ে বলল, ‘কী নিয়ে ঝগড়া করব?’

‘যা খুশি। ইচ্ছে হলে তুমি বলতে পারো যে বানরের খেলা দেখানো অমানবিক, এটা নিরীহ পশুর প্রতি অত্যাচার। তুমি পশু ক্লেশ নিবারণ সমিতির মেম্বার। তুমি বানরটাকে বনে ছেড়ে দেবে। এসব।’

শান্ত কিছুক্ষণ চিন্তা করল, তারপর বলল, ‘ঠিক আছে। কিন্তু দশ টাকায় হবে না।’

‘কত লাগবে?’

‘এক শ।’

‘বিশ।’

‘উহু। পঞ্চাশ টাকার এক পয়সা কম না।’

কিছুক্ষণ দরদাম করে ত্রিশ টাকায় রফা হলো। টুনি দশ টাকা অ্যাডভান্স দিল, কাজ শেষ হলে বাকি টাকা দেওয়া হবে। টুনি শান্তকে সাহস দিয়ে বলল, ‘তোমার কাজ খুব সহজ, বানরওয়ালাকে ব্যস্ত রাখা। তুমি চোখের কোনা দিয়ে আমাকে লক্ষ করবে। যখন দেখবে আমি সরে গেছি তখন তোমার কাজ শেষ। তখন বানরওয়ালাকে বানর ফেরত দিতে পারো। ইচ্ছা করলে তোমার কাছে রেখে দিতে পারো।’

‘তুই কী করবি?’

টুনি তার ঝোলাটা দেখিয়ে বলল, ‘আমি আমার ঝোলাটার সঙ্গে বানরওয়ালার ঝোলাটা বদলে নেব।’

শান্ত আবার চোখ কপালে তুলে বলল, ‘কেন?’

‘একটু পরেই দেখবে।’

‘কোনো ঝামেলা হবে না তো?’

টুনি কোনো উত্তর দিল না, শুধু তার ঠোঁটের কোনায় বিচিত্র একটা হাসি ফুটে উঠল।

একটু পরেই দেখা গেল টুনি ভিড় ঠেলে একেবারে বানরওয়ালার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। লাল ঝোলাটা সে হাতে ধরে রেখেছে। বানরওয়ালার পাশে তার লাল ঝোলা, দুটো দেখতে হুবহু এক রকম নয় কিন্তু সেটা বোঝার জন্য খুব ভালো করে লক্ষ করতে হবে।

শান্ত ভিড় ঠেলে একটু সামনে এগিয়ে গেল। তার চোখে-মুখে উত্তেজনা। বানরটা খেলা দেখাচ্ছে, প্রথমে ঘুরে ঘুরে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া দেখাল, তারপর শ্বশুরকে সালাম করা দেখাল। যখন শাশুড়িকে ভেংচি কাটা দেখাচ্ছে তখন শান্ত হঠাৎ করে তড়াক করে লাফ দিয়ে বানরের দড়িটা হেঁচকা টান দিয়ে ছুটিয়ে আনল, তারপর কেউ কিছু বোঝার আগে দড়ি ধরে বানরকে নিয়ে দে দৌড়। লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, শুধু বানরওয়ালা ‘এই, এই ছ্যামড়া কী করো? কী করো? আমার বান্দর, আমার বান্দর’ বলে শান্তর পেছনে পেছনে দৌড়াতে থাকে। সবাই যখন অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে, টুনি তখন তার ঝোলাটা বানরওয়ালার ঝোলার পাশে ফেলে দিয়ে পরমুহূর্তে তুলে নিল। খুব ভালো করে লক্ষ না করলে কেউ বুঝতে পারবে না নিজের ঝোলাটা ফেলে সে বানরওয়ালার ঝোলাটা তুলে নিয়েছে। টুনি একটুও তাড়াহুড়া করল না, বানরওয়ালার ঝোলা নিয়ে খুব শান্তভাবে হেঁটে সরে গেল।

একটু দূরেই তখন শান্ত আর বানরওয়ালার মাঝে তুমুল ঝগড়া লেগে গেছে। শান্ত বলছে, ‘আপনি জানেন বানরের খেলা দেখানো বেআইনি? বনের পশু থাকবে বনে, আর আপনি দড়ি বেঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন?’

অলংকরণ: সাদাত

বানরওয়ালা তেড়িয়া হয়ে বলল, ‘বেআইনি হলে সেটা আমার সমস্যা। তুমি আমার বান্দর নিয়ে কোথায় যাও?’

‘আপনাকে পুলিশে দেওয়া হবে। আমি পশু ক্লেশ নিবারণ সমিতির সেক্রেটারি। আমার কমিটি আপনাকে পুলিশে দেবে। হাইকোর্টে মামলা করবে।’

বানরওয়ালা চোখ কপালে তুলে বলল, ‘কী আলতু ফালতু কথা বলো। আমি গরিব মানুষ, বান্দরের খেলা দেখাই, আর তুমি আমার বিরুদ্ধে মামলা করবে?’

শান্ত হাত-পা নেড়ে বলল, ‘আপনি বানরকে খেতে দেন? এই বানর এত শুকনো কেন? বানরের স্বাস্থ্য এত খারাপ কেন? কোনো দিন মেডিকেল চেকআপ করিয়েছেন? বানরকে শাস্তি দেন। অত্যাচার করেন।’

টুনি বানরওয়ালার ঝোলাটার ভেতরে উঁকি দিল। ওপরে একটা ময়লা গামছা। সেটা সরানোমাত্র ভেতরে সে নানির পানের বাটা দেখতে পেল। তার পাশে ছোটাচ্চুর ভিডিও ক্যামেরা। বেশ কয়েকটা মোবাইল, অনেকগুলো মানিব্যাগ, মনে হলো একটা ল্যাপটপও আছে। টুনির মুখে হাসি ফুটে ওঠে, তার সন্দেহ পুরোপুরি ঠিক। সে রহস্যময় চোরকে ধরে ফেলেছে।

শান্ত ঝগড়া করে বেশি সুবিধা করতে পারেনি। দেখা গেল বানরওয়ালা তার বানর নিয়ে ফিরে আসছে। হাজি গুলজার খানের বাড়ির দারোয়ানকেও দেখা গেল, মেলায় গোলমাল করার জন্য সে শান্তকে মেলা থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। টুনি ঠিক এই রকম সময় ছোটাচ্চুকে দেখতে পেল, লম্বা পা ফেলে তার দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে আসতেই টুনি বানরওয়ালার লাল ঝোলাটা তার হাতে ধরিয়ে দিল, বলল, ‘নাও। এইখানে সব চোরাই মালপত্র আছে। আমাদের বাসারগুলো আছে, অন্য বাসারগুলোও আছে।’

ছোটাচ্চু মুখ হাঁ করে বলল, ‘চো-চোরাই মাল। কে চুরি করেছে?’

‘বানরওয়ালা। বানরকে ট্রেনিং দিয়ে রেখেছে, তার বানর বাড়ি বাড়ি গিয়ে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে যা পায় তুলে নিয়ে আসে।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘বা-বা-বা’ নিশ্চয়ই বানর বলতে যাচ্ছিল কিন্তু কথা শেষ করতে পারল না।

বানরওয়ালা তখন নিজের জায়গায় গিয়ে বসে তার ঝোলার দিকে তাকিয়েছে, হঠাৎ করে তার কিছু একটা সন্দেহ হলো, সে ঝোলাটার ভেতরে উঁকি দেয়, সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সে এদিক-সেদিক তাকায় এবং হঠাৎ দূরে ছোটাচ্চু আর টুনিকে দেখতে পেল। ছোটাচ্চুর হাতে তার লাল ঝোলা। দেখে সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেল সে ধরা পড়ে গেছে। ছোটাচ্চুর হাত থেকে নিজের ঝোলা উদ্ধার করার কোনো চেষ্টা না করে হঠাৎ সে তার বানরকে নিয়ে ছুটতে শুরু করে। ট্রেনিং পাওয়া বানর, এক লাফ দিয়ে তার ঘাড়ে উঠে বসল, আর বানরওয়ালা তার বানর ঘাড়ে নিয়ে হাজি গুলজার খানের বাড়ির গেটের দিকে প্রাণপণে ছুটতে থাকে।

এতক্ষণে ছোটাচ্চু নিজেকে সামলে নিয়েছে। চিৎকার করে বলল, ‘ধরো। ধরো বানরওয়ালাকে। এই ব্যাটা চোর। মহাচোর।’

ছোটাচ্চুর কথা শেষ না হতেই লোকজন বানরওয়ালাকে ধাওয়া করল, টুনি দেখল সবার আগে শান্ত। কী হয়েছে, কেন বানরওয়ালাকে ধরতে হবে, সে কিছুই জানে না, কিন্তু মহা-উৎসাহে সে পেছন থেকে ল্যাং মেরে বানরওয়ালাকে ফেলে দিল। তার বানর মনে হয় আগেও এ রকম অবস্থায় পড়েছে, সেটা কয়েকটা লাফ দিয়ে বড় একটা মান্দারগাছের মগডালে উঠে কৌতূহল নিয়ে নিচের দিকে তাকাল। অনুমান করার চেষ্টা করছে, এখন কী হবে।

চোর ধরা পড়লেই পাবলিক আচ্ছা মতন পিটুনি দেয়। এখানে তা-ই শুরু হয়ে গেল। ছোটাচ্চু তখন অনেক কষ্ট করে বানরওয়ালাকে পাবলিকের পিটুনি থেকে রক্ষা করল, ততক্ষণে বাসার দারোয়ান এমনকি দুজন পুলিশও চলে এসেছে। সবাই জানতে চাইছে; কী হয়েছে, ব্যাপারটা বুঝতে চাইছে।

ছোটাচ্চু বলল, ‘এই বানরওয়ালা মহাচোর। বানরের খেলা দেখানো তার সাইড বিজনেস। আসলে রাতের বেলা বানরকে ছেড়ে দেয় চুরি করার জন্য। বানরকে চুরি করা শিখিয়েছে।’

একজন পুলিশ জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কেমন করে জানেন?’

ছোটাচ্চু তার ঝোলাটা দেখাল, বলল, ‘এই ঝোলাবোঝাই চোরাই মাল। আমাদের বাসা থেকে চুরি করা সব জিনিস এখানে আছে। অন্যের বাসার জিনিসও আছে।’

পাবলিক তখন আবার খেপে উঠল, বলল, ‘ধর শালা বানরওয়ালাকে। মার শালাকে।’

আবার কয়েকটা কিল-ঘুষি পড়ল কিন্তু পুলিশ সবাইকে থামিয়ে দিল। ঝোলাটার ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল, ‘কী আশ্চর্য!’ তারপর ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কেমন করে এই ব্যাটাকে ধরলেন?’

ছোটাচ্চু উত্তর দেওয়ার আগেই টুনি বলল, ‘খুবই সোজা। ইনি হচ্ছেন দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির প্রধান ডিটেকটিভ। ইনি যেকোনো কেস সলভ করতে পারেন। চুরি, ডাকাতি, খুন যেকোনো কিছু উনার হাতের ময়লা!’

পুলিশটা অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকাল, ‘সত্যি? তার মানে ইনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ?’

‘হ্যাঁ। আর আমি হচ্ছি উনার অ্যাসিস্ট্যান্ট।’

ছোটাচ্চু একবার শুকনো মুখে ঢোঁক গিলল, কিন্তু প্রতিবাদ করল না।

এভাবে টুনি দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির প্রধান ডিটেকটিভের অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে গেল।

চলবে...

আরও পড়ুন