টুনটুনি ও ছোটাচ্চু (প্রথম পর্ব)

বাসাটা তিনতলা। কিংবা কে জানে, চারতলাও হতে পারে। আবার তিন কিংবা চারতলা না হয়ে সাড়ে তিনতলাও হতে পারে। এই বাসায় যারা থাকে, তাদের জন্য অসম্ভব কিছু না। এই বাসায় কারা থাকে, সেটা বলে দিতে পারলে মনে হয় ভালো হতো, কিন্তু সেটা সম্ভব হবে না। তা ছাড়া বলে লাভ কী, সবার নাম, বয়স, কে কী করে—এত সব কি আর মনে রাখা সম্ভব? শুধু একটা জিনিস বলে দেওয়া যায়, এই বাসায় সবাই এক পরিবারের মানুষ। সংখ্যাটা শুধু আন্দাজ করা যেতে পারে, ৩০-৪০ জন হবে, কিংবা কে জানে, বেশিও হতে পারে। বাসাভর্তি বাচ্চা কিলবিল করছে। এতগুলো বাচ্চার হিসাব রাখা কঠিন, তাদের বাবা-মায়েরাই হিসাব রাখতে পারে না।

তাদের বাবা-মায়েরা যে হিসাব রাখতে পারে না, তার অবশ্য একটা কারণ আছে। কারণ, তারা কে কখন কোথায় থাকে, তার ঠিক নেই। হয়তো বাসায় খেতে বসেছে, ডাইনিং টেবিলে খাবারটা কারও পছন্দ হলো না, সঙ্গে সঙ্গে নাক কুঁচকে থালাটা বগলে নিয়ে ওপরে কিংবা নিচের তলায় কিংবা পাশের ফ্ল্যাটে চলে যাবে। হয়তো স্কুলে যাওয়ার সময় হয়েছে, স্কুলের পোশাক খুঁজে পাচ্ছে না তারা, অন্যজনের ফ্ল্যাটে গিয়ে অন্য কারও পোশাক পরে ফেলবে। কাছাকাছি বয়স, সমস্যা হয় না। বড়জোর একটু ঢলঢলে কিংবা একটু টাইট হয়, সেটা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। রাতে ঘুমানোর সময় মায়েরা যদি দেখে বাচ্চা বিছানায় নেই, তাহলেও তারা দুশ্চিন্তা করে না। আবার যদি দেখে দুই-চারটা বাচ্চা বেশি, তাহলেও অবাক হয় না।

এই পরিবারে বাচ্চাকাচ্চা ছাড়া মাঝবয়সী মানুষও আছেন, আবার বুড়ো মানুষও আছেন। বুড়ো মানুষ মাত্র একজন, তাঁর নাম জোবেদা খানম। জোবেদা খানমকে অবশ্য তাঁর নাম দিয়ে ডাকার কেউ নেই, তাই জোবেদা খানমও তাঁর নামটা প্রায় ভুলেই গেছেন। বাচ্চাকাচ্চারা তাঁকে নানি, না হয় দাদি ডাকে। কেউ যেন মনে না করে, যাদের নানি ডাকার কথা, তারা নানি ডাকে, আর যাদের দাদি ডাকার কথা, তারা দাদি ডাকে! যখন যার ইচ্ছে, তখন তারা সেটা ডাকে। কেউ সেটা নিয়ে মাথা ঘামায় না। নানি কিংবা দাদি না ডেকে যদি খালা কিংবা আপু ডাকত, তাহলেও কেউ মনে হয় মাথা ঘামাত না।

জোবেদা খানমের বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে, সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে থাকেন। সব পরিবারের মেয়েদের বিয়ে হলে তারা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, এখানে কেউ যায়নি। ওপরতলা কিংবা নিচতলায় থেকে গেছে। সবারই বিয়ে হয়ে গেছে, বাচ্চাকাচ্চা আছে, শুধু একজন ছাড়া। সে ঘোষণা দিয়েছে যে সে বিয়ে করবে না। সেই ঘোষণা শোনার পর সবারই ধারণা হয়েছে, তার নিশ্চয়ই বিয়ে করার শখ হয়েছে। যাদের বিয়ে করার শখ হয়, তারা এ রকম ঘোষণা দেয়। একদিন সে বাসায় এসে বলল, ‘গুড নিউজ।’

সে প্রায় প্রতিদিনই বাসায় এসে এ রকম কিছু বলে, তাই কেউ গুরুত্ব দিল না। দাদি চেয়ারে বসে সোয়েটার বুনতে থাকলেন, বাচ্চাকাচ্চারা ফোর টোয়েন্টি খেলতে থাকল, বড় ভাই পত্রিকা পড়তে থাকল, ভাবি টেবিলে খাবার রাখতে থাকল।

তখন সে আবার গলা উঁচিয়ে বলল, ‘গুড নিউজ। পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। আমি পাস করেছি।’

বড় ভাই পত্রিকা থেকে চোখ না তুলে বলল, ‘কী পরীক্ষা?’

ছেলেটা বলল, ‘মাস্টার্স।’

বড় ভাই পত্রিকা থেকে চোখ সরিয়ে অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল, বলল, ‘মাস্টার্স? আমি ভেবেছিলাম তুই ইন্টারমিডিয়েট পড়িস।’

ছোট ভাই রাগ হয়ে বলল, ‘ভাইয়া, তুমি কোনো কিছু খোঁজ রাখো না। আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, সেইটা তুমি জানো না?’

‘জানতাম মনে হয়, ভুলে গেছি।’

ভাবি ডাইনিং টেবিলে শব্দ করে একটা প্লেট রেখে বলল, ‘সব সময় এক কথা, ভুলে গেছি। জিজ্ঞেস করে দেখো তার কয়টা ছেলেমেয়ে, সেটা মনে আছে কি না। সেটাও মনে হয় ভুলে গেছে।’

বড় ভাই তখন আবার পত্রিকায় মুখ ঢেকে ফেলল, একবার এটা নিয়ে আলোচনা শুরু হলে সব সময় সে বিপদে পড়ে যায়।

মেঝেতে বসে যে বাচ্চাকাচ্চা ফোর টোয়েন্টি খেলছিল, তাদের একজন জিজ্ঞেস করল, ‘ছোটাচ্চু, তুমি কি গোল্ডেন ফাইভ পেয়েছ?’

অলংকরণ: সাদাত

এই বাসায় চাচাদের মধ্যে সে ছোট, তাই তাকে ছোট চাচা ডাকা হয়। যাদের সে ছোট মামা, তারাও তাকে ছোট চাচা ডাকে। ছোট চাচা শব্দটা ছোট হতে হতে ছোটাচ্চু হয়েছে, আরও ছোট হবে কি না, কেউ জানে না।

ছোটাচ্চু বলল, ‘ইউনিভার্সিটিতে গোল্ডেন ফাইভ হয় না।’

‘তাহলে কী হয়?’

বাচ্চাদের মধ্যে যে একটু ত্যাঁদড় টাইপের সে বলল, ‘প্লাস্টিক ফাইভ!’

সব বাচ্চা তখন হি হি করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে বলতে লাগল, ‘প্লাস্টিক ফাইভ, প্লাস্টিক ফাইভ!’

ছোটাচ্চু চোখ পাকিয়ে বলল, ‘ফাজলামি করবি না। দেব একটা থাবড়া।’

ছোটাচ্চু কখনো থাবড়া দেয় না, মেজাজ গরম করে না, তাই তাকে কেউ ভয় পায় না। সত্যি কথা বলতে কি, ছোটাচ্চুকে বাচ্চারা তাদের নিজেদের বয়সী মনে করে, তাই তাদের সব রকম ফুর্তিফার্তা, হাসি-তামাশা সবকিছু ছোটাচ্চুকে নিয়ে। বাচ্চাকাচ্চাদের মধ্যে যে একটু বড়, সে বলল, ‘তোমার গ্রেড কত, ছোটাচ্চু?’

ছোটাচ্চুর চেহারাটা প্রথমে একটু কঠিন হলো, তারপর কেমন যেন দার্শনিকের মতো হলো, তারপর বলল, ‘ইউনিভার্সিটির ডিগ্রিটা হচ্ছে বড় কথা। গ্রেড দিয়ে কী হবে? পাস করেছি, সেইটা হচ্ছে ইম্পরট্যান্ট।’

ত্যাঁদড় টাইপের বাচ্চাটা বলল, ‘তার মানে তোমার গ্রেড কুফা?’

ছোটাচ্চু আবার চোখ পাকিয়ে বলল, ‘মোটেও কুফা না।’

‘তাহলে কত, বলো।’

‘টু পয়েন্ট থ্রি সিক্স।’

বাচ্চাটা চোখ কপালে তুলে বলল, ‘মাত্র টু?’

‘টু পয়েন্ট থ্রি সিক্স।’

‘একই কথা। তার মানে তুমি প্রায় ফেল করে গিয়েছিলে। অল্পের জন্য বেঁচে গেছ।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘মনে নেই, পরীক্ষার আগে আমার ডেঙ্গু হলো?’

দাদি অবাক হয়ে বলল, ‘তোর ডেঙ্গু হয়েছিল নাকি? কখন?’

‘ওই যে জ্বর হলো। নিশ্চয়ই ডেঙ্গু হবে।’

বাচ্চাদের ভেতর ত্যাঁদড়জন জিজ্ঞেস করল, ‘প্লাটিলেট কাউন্ট কত ছিল?’

‘ব্লাড টেস্ট করাইনি।’

‘তাহলে বুঝলে কেমন করে ডেঙ্গু?’

‘ডেঙ্গু ছাড়া আর কী হবে?’

ত্যাঁদড়জন বলল, ‘আসলে তোমার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে তো, সেই জন্য তুমি বানিয়ে বানিয়ে ডেঙ্গুর কথা বলছ।’

সব বাচ্চাকাচ্চা জোরে জোরে মাথা নাড়ল, একজন বলল, ‘ছোটাচ্চু, তুমি তো লেখাপড়া করো নাই, সেই জন্য রেজাল্ট খারাপ হয়েছে।’ তারা লেখাপড়া করে না, সে জন্য সব সময় বকুনি শুনতে হয়। এখন ছোটাচ্চুকে লেখাপড়া না করার জন্য ধরা যাচ্ছে, এ রকম সুযোগ খুব বেশি আসে না। তাই তারা সবাই সুযোগটার সদ্ব্যবহার শুরু করল, বলা শুরু করল:

‘প্রতিদিন নিয়ম করে পড়তে হয়। সকালে আর রাতে।’

‘নো টিভি। টিভি দেখলে ব্রেন নষ্ট হয়ে যায়।’

‘পড়ার সময় মনোযোগ দিয়ে পড়তে হয়। উল্টাপাল্টা চিন্তা করলে হবে না।’

‘বই মুখস্থ করে ফেলবে।’

‘সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে, তুমি তো ১০টার আগে ওঠো না।’

‘আউল ফাউল বই পড়ে লাভ নেই। পাঠ্যবই ঝাড়া মুখস্থ, দাঁড়ি-কমাসহ।’

ছোটাচ্চু তখন সবাইকে একটা ধমক দিল, ‘চুপ করবি তোরা? বেশি মাতবর হয়েছিস?’

ত্যাঁদড় টাইপ বলল, ‘তোমরা বললে দোষ নাই, আর আমরা বললে দোষ।’

‘লাই দিতে দিতে মাথায় উঠে গেছিস।’

একজনের জানার ইচ্ছে হচ্ছিল লাই জিনিসটা কী, সেটা কেমন করে দেওয়া হয়, সেটা কি হাত দিয়ে ধরা যায়, পকেটে রাখা যায়, কিন্তু ছোটাচ্চুর মেজাজ দেখে সাহস করল না।

দাদি বললেন, ‘পাস করেছিস, এখন চাকরিবাকরি করবি?’

ত্যাঁদড় টাইপ বলল, ‘টু পয়েন্ট থ্রি সিক্স দিয়ে কোনো চাকরি হবে না।’

ছোটাচ্চু চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকাল, তারপর দার্শনিকের মতো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি চাকরি করতে চাই না। চাকরি মানেই আরেকজনের গোলামি। স্বাধীনভাবে কাজ করব।’

বড় ভাই পত্রিকা সরিয়ে মুখ বের করে বলল, ‘আমরা যে চাকরি করি, সেটা কি গোলামি?’

ছোটাচ্চু বলল, ‘তোমার কথা আলাদা। তুমি বস। তোমার আন্ডারে যারা কাজ করে, তাদের কথা বলছি।’

‘সব সময় নিচ থেকে শুরু করে ওপরে উঠতে হয়।’

ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, ‘নেভার। আমি ওপর থেকে শুরু করব।’

‘ওপর থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে নিচে যাবি?’

ছোটাচ্চু নার্ভাসভাবে হাসার চেষ্টা করল, বলল, ‘না, ওপর থেকে শুরু করে ওপরেই থেকে যাব। একটা ফার্ম দেব।’

বাচ্চাদের একজন জিজ্ঞেস করল, ‘কিসের ফার্ম? মুরগির?’

অন্য একজন বলল, ‘হ্যাঁ। সব সময় মুরগির ফার্ম হয়। মুরগি আর মোরগ। তার সঙ্গে বেবি মোরগ।’

অলংকরণ: সাদাত

আরেকজন শুদ্ধ করে দিল, ‘তার সঙ্গে ডিম। তাই না ছোটাচ্চু?’

ছোটাচ্চু বলল, ‘নেভার। আমি কেন মুরগির ফার্ম দেব?’

‘তাহলে কিসের ফার্ম?’

‘কোনো একধরনের সার্ভিস ফার্ম, যেখানে ইনভেস্টমেন্ট লাগে না।’

বাচ্চাদের একজন জিজ্ঞেস করল, ‘ইনভেস্টমেন্ট মানে কী?’

ত্যাঁদড় টাইপ বুঝিয়ে দিল, ‘টাকাপয়সা। ছোটাচ্চু কোনো টাকাপয়সা খরচ না করে টাকাপয়সা কামাই করবে। তাই না ছোটাচ্চু?’

‘ছোটলোকের মতো শুধু টাকাপয়সা টাকাপয়সা করবি না। সার্ভিস ফার্ম খুব ইম্পরট্যান্ট কনসেপ্ট। সারা পৃথিবী এখন সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি দিয়ে চলছে। কত রকম সার্ভিস আছে দুনিয়াতে, আমাকে একটা খুঁজে বের করতে হবে।’

‘সেটা কী সার্ভিস?’

‘এখনো ঠিক করি নাই। বিষয়টা নিয়ে আগে গবেষণা করতে হবে।’ ছোটাচ্চু তখন মনে হয় গবেষণা করতে বের হয়ে গেল। বড় ভাই পত্রিকাটা ভাঁজ করে পাশে রেখে দাদির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার এই ছেলের কপালে দুঃখ আছে।’

দাদি কিছু বললেন না, উল দিয়ে সোয়েটার বুনতে লাগলেন।

বড় ভাই বলল, ‘এ রকম লাফাঙ্গা আর নিষ্কর্মা মানুষ আমি জন্মে দেখি নাই। বাবাও কাজের মানুষ ছিল, তুমিও কাজের মানুষ, তোমাদের ছেলে এই রকম নিষ্কর্মা হলো কেমন করে?’

বাচ্চারা তখন একসঙ্গে আপত্তি করল, ‘না, বড় মামা। ছোটাচ্চু মোটেও নিষ্কর্মা না।’ যদিও বড় ভাই অনেকের বড় চাচা, আবার অনেকের বড় মামা। তার পরও সবাই তাকে বড় মামা বলে। নিজের ছেলেমেয়েরাও ভুলে মাঝেমধ্যে তাকে বড় মামা ডেকে ফেলে। একজন বলল, ‘মনে নাই, আমরা যখন নাটক করেছিলাম, তখন ছোটাচ্চু স্টেজ বানিয়ে দিয়েছিল।’

‘আর ওই ছাগলের বাচ্চাটাকে যখন গোলাপি রং করেছিলাম, তখন রং এনে দিয়েছিল।’

‘আর ওই রাজাকার টাইপ মানুষটাকে ভূতের ভয় দেখিয়েছিল।’

‘আর আমরা যে সিনেমা বানালাম, সেইখানে ছোটাচ্চু ভিলেনের অ্যাকটিং করল।’

‘আর ভাইয়ার স্কুল থেকে যখন গার্ডিয়ানকে ডেকে পাঠাল...’

সে বাক্যটা শেষ করতে পারল না, এর আগেই তাকে অন্যরা থামিয়ে দিল। স্কুলে অপকর্ম করার জন্য যখন গার্ডিয়ানকে ডেকে পাঠায়, তখন মাঝেমধ্যেই ছোটাচ্চু গার্ডিয়ান সেজে তাদের উদ্ধার করে, যেটা অনেকেই জানে না এবং জানার কথা না।

বড় মামা একটা বই টেনে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে বলল, ‘তোমাদের ছোটাচ্চুর কাজকর্ম ওই পর্যন্তই। ছাগলকে গোলাপি রং করা, শরীরে কালি মেখে ভূতের ভয় দেখানো। যদি এই রকম সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি থাকে, তাহলে কোনো চিন্তা নেই।’

দাদি বলল, ‘আহা। ছোট মানুষ, থাকুক না ছোট মানুষের মতো।’

‘আমার তাতে আপত্তি নেই। তার কাজকর্ম দেখে তো আমি তাই ভেবেছিলাম ইন্টারমিডিয়েট পড়ে। আসলে মাস্টার্স পাস করে ফেলেছে, এখন তো রীতিমতো বড় মানুষ।’

বাচ্চারা জোরে জোরে মাথা নাড়ল, তারা কেউ চায় না তাদের ছোটাচ্চু বড় মানুষ হয়ে যাক।

পরের কয়েক দিন ছোটাচ্চুকে গভীর মনোযোগ দিয়ে বইপত্র, ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করতে দেখা গেল। শুধু তা-ই না, একটা ছোট নোটবইয়ে তাকে কী সব লিখতে দেখা গেল। বাচ্চারা কখনো তাদের ছোটাচ্চুকে এ রকম গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে দেখেনি, তাই তারা অবাক হয়ে গেল। যখন ছোটাচ্চু আশপাশে নেই, তখন তারা সেই নোটবই খুলে দেখার চেষ্টা করল সেখানে কী লেখা, কিন্তু তারা কিছু বুঝতে পারল না ইনভেস্টিগেশন, ক্রাইম সিন, মোটিভ, ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন—এই রকম কঠিন কঠিন শব্দ লেখা, যেগুলো পড়ে তারা কিছু মাথামুণ্ডু বুঝতে পারল না।

সপ্তাহ খানেক পর ছোটাচ্চু প্রথম বাচ্চাদের সামনে তার পরিকল্পনাটা খুলে বলল, সবাইকে ডেকে নিয়ে বসিয়ে সে গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমি কী করব ঠিক করেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত ঠিক করে শুরু না করছি, ততক্ষণ পর্যন্ত এইটা সিক্রেট। ঠিক আছে?’

সবাই মাথা নাড়ল, যদিও মনে মনে কে কাকে কীভাবে এটা বলবে, সেটা চিন্তা করতে লাগল।

ছোটাচ্চু তার মুখটা আরও গম্ভীর করে বলল, ‘আমি যেটা খুলব সেটা হচ্ছে একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি। নাম দেওয়া হবে দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি।’

বাচ্চারা সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল। শুধু ছোটাচ্চুই এ রকম অসাধারণ আইডিয়া নিয়ে আসতে পারে। সবাই হাত তুলে চিৎকার করতে থাকল, ‘আমি আমি আমি...’

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, ‘আমি কী?’

‘আমিও হব।’

‘তুই কী হবি?’

‘ডিটেকটিভ।’

ছোটাচ্চুর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল, বলল, ‘তোরা কি ভেবেছিস এটা একটা খেলা? তোরা সব সেই খেলা খেলবি?’

সবাই চুপ করে রইল। তারা ধরেই নিয়েছিল এটা ছাগল রং করার মতো একটা মজার ব্যাপার, ঠিক খেলা না হলেও খেলার মতোই আনন্দের।

অলংকরণ: সাদাত

ছোটাচ্চু মুখ আরও গম্ভীর করে বলল, ‘এটা মোটেও ঠাট্টা-তামাশা না, এটা খুবই সিরিয়াস। এটা বড়দের বিষয়, প্রফেশনালদের বিষয়। এটা নিয়ে লেখাপড়া করতে হয়, গবেষণা করতে হয়।’ ছোটাচ্চু হলুদ রঙের একটা বই দেখিয়ে বলল, ‘এই যে একটা বই, এখানে অনেক কিছু লেখা আছে। কীভাবে ডিটেকটিভের কাজ করতে হয়, সবকিছু বলে দেওয়া আছে। এমনকি যদি মঙ্গল গ্রহ থেকে কোনো প্রাণী চলে আসে, তাহলে কী করতে হবে, সেটাও লেখা আছে।’

‘সত্যি?’

‘হ্যাঁ।’

‘কী করতে হবে?’

ছোটাচ্চু বলল, ‘সেইটা জেনে কী করবি?’

‘যদি কখনো দেখা হয়ে যায়।’

‘দেখা হলে আমার কাছে নিয়ে আসবি।’

‘কিন্তু।’

ছোটাচ্চু থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এখন চুপ কর দেখি। যেটা বলছি সেটা শোন।’

সবাই তখন আবার চুপ করল। ছোটাচ্চু বলল, ‘আমি তোদের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করছি, কারণ বড়দের সঙ্গে আলোচনা করে কোনো লাভ নেই। তারা কিছু বোঝে না। তোরা বুঝবি।’

বাচ্চাকাচ্চারা সবাই মাথা নাড়ল। ছোটাচ্চু বলল, ‘আমি এর মধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছি। এই যে এইগুলো কিনে এনেছি।’ ছোটাচ্চু তার ব্যাকপ্যাক খুলে প্রথমে একটা বড় ম্যাগনিফাইং গ্লাস, একটা বাইনোকুলার আর একটা মোটা কলম বের করে আনল।

একজন জিজ্ঞেস করল, ‘মোটা কলম দিয়ে কী করবে?’

ছোটাচ্চুর মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল, ‘দেখে মনে হচ্ছে কলম। আসলে এটা ভিডিও ক্যামেরা। বুকপকেটে রেখে কথা বলবি, তখন সবকিছু ভিডিও হয়ে যাবে!’

বাচ্চাদের মুখে বিস্ময়ের ছাপ পড়ল। ছোটাচ্চু বলল, ‘আরও জিনিস অর্ডার দিয়েছি, সেগুলো এলেই দেখবি।’

ত্যাঁদড় ধরনের বাচ্চাটা জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার অফিস কোনটা হবে? তোমার রুম? তাহলে তুমি ঘুমাবে কোথায়?’

‘শুরুতে হবে ভার্চুয়াল অফিস।’

‘ভার্চুয়াল অফিস? সেটা আবার কী?’

‘তার মানে সব কাজকর্ম, যোগাযোগ হবে ইন্টারনেটে। একটা ওয়েবসাইট থাকবে, সেখানে সবাই যোগাযোগ করবে। যদি দেখি কোনোটা ভালো, তাহলে ক্লায়েন্টের সঙ্গে নিউট্রাল গ্রাউন্ডে...’

‘তুমি রিভলবার কিনবে না? না হলে পিস্তল। সব সময় ডিটেকটিভদের পিস্তল, না হলে রিভলবার থাকে।’ ছোটাচ্চুকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে একজন জিজ্ঞেস করল, সে সবচেয়ে নিরীহ ধরনের ছোট একটা মেয়ে।

ছোটাচ্চু থতমত খেয়ে বলল, ‘রিভলবার?’

‘হ্যাঁ। আমি সিনেমায় দেখেছি ডিটেকটিভরা গুলি করে মগজ বের করে দেয়। তুমি কি মগজ বের করবে?’

ছোটাচ্চু হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, ‘তোদের আমি বিষয়টা বোঝাতেই পারলাম না। এটা মোটেও নাটক-সিনেমা না। এটা গল্প-উপন্যাস না। এটা সত্যিকারের সার্ভিস। বাংলাদেশে এখনো নেই, আমি শুরু করতে যাচ্ছি। সিনেমাতে ডিটেকটিভদের রিভলবার-পিস্তল থাকে। আমার সেগুলো লাগবে না। আমার দরকার খালি বুদ্ধি।’

অলংকরণ: সাদাত

ত্যাঁদড় মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার বুদ্ধি আছে?’

‘যেকোনো মানুষ থেকে বেশি। খালি বুদ্ধি না, আমার আছে তীক্ষ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, বিশ্লেষণী মস্তিষ্ক এবং নিরলস পরিশ্রম করার আগ্রহ।’

কথাগুলোর অর্থ কী, বাচ্চাদের বেশির ভাগই বুঝতে পারল না, তারা মাথাও ঘামাল না। একজন জিজ্ঞেস করল, ‘আমাদের নেবে না?’

‘আঠারো বছরের কম কাউকে নেওয়া যাবে না।’

হাসিখুশি ধরনের একজন বলল, ‘আমি আর টুম্পা দুইজন মিলে আঠারো।’

‘দুইজন মিলে আঠারো হলে হবে না। একজনকে আঠারো হতে হবে।’

যখন তারা বুঝতে পারল ছোটাচ্চু তাদের নেবে না, তখন তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে শুরু করল। তারা যখন উঠে চলে যেতে শুরু করল, ছোটাচ্চু তখন মনে করিয়ে দিল, ‘মনে থাকবে তো? এটা এখনো সিক্রেট। কাউকে বলা যাবে না।’

সবাই মাথা নাড়ল এবং একটু পরেই অন্যদের ফিসফিস করে বলতে শুরু করল। দাদি শুনে মুখ টিপে হাসলেন। বড় মামা হতাশভাবে মাথা নাড়ল।

চলবে...

আরও পড়ুন