তিতুনি এবং তিতুনি (পঞ্চম পর্ব)

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

বাসা থেকে যখন মাইক্রোবাসটা রওনা দিল তখন সবারই মনে একধরনের ফুরফুরে আনন্দের ভাব। সবচেয়ে বেশি আনন্দ টোটনের মনে। সে একটানা কথা বলে যাচ্ছে কিন্তু সে যেহেতু তিতুনিকে মানুষ বলেই বিবেচনা করে না তাই তার কথাবার্তা সব আব্বু-আম্মুর সাথে। কথার বিষয়বস্তু অবশ্যি কম্পিউটার গেম আর ফ্রায়েড চিকেনের বাইরে যাচ্ছিল না।

মাইক্রোবাসটা রওনা দিতেই টোটন বলল, ‘আব্বু, আমাকে একটা কম্পিউটার কিনে দেবে?’

‘কী করবি কম্পিউটার দিয়ে?’

টোটন প্রশ্নটা শুনে অবাক হলো, বলল, ‘কী করব মানে? গেম খেলব। কী ফাটাফাটি গেম আছে তুমি জানো আব্বু?’

আব্বু মাথা নেড়ে জানালেন যে জানেন না। টোটন বলল, ‘একটা গেম আছে খুবই মজার। তুমি গাড়ি চালাবে আর পাবলিককে চাপা দিবে। যত বেশি চাপা দিবে তত পয়েন্ট।’

আম্মু বললেন, ‘এটা আবার কী রকম গেম?’

টোটন দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘যখন একজনকে চাপা দিবে তখন ফটাস্ করে মাথাটা ফেটে যায়, না হলে ভ্যাড়াৎ করে ভুঁড়ি ফেঁসে যায়—’

আম্মু আবার বললেন, ‘ছিঃ!’

টোটন তবু থামল না, ‘মাথায় মগজ নাড়িভুঁড়ি রক্ত সব ছিটকে ছিটকে যাবে—যা মজার গেম তোমরা চিন্তাও করতে পারবে না। খুবই রিয়েলিস্টিক।’

আব্বু বললেন, থাক, ‘অনেক হয়েছে রিয়েলিস্টিক গেম।’

টোটন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমার যদি একটা কম্পিউটার গেম থাকতো তাহলে দিন-রাত আমি কম্পিউটার গেম খেলতাম। চব্বিশ ঘণ্টায় মধ্যে বাইশ ঘণ্টা!’

অন্য তিতুনি বেশি কথা বলছিল না, এবার একটু চেষ্টা করল, জিজ্ঞেস করল, ‘বাকি দুই ঘণ্টা?’

টোটন মুখ শক্ত করে বলল, ‘বাকি দুই ঘণ্টা খেতাম। ফ্রায়েড চিকেন।’

অন্য তিতুনি বলল, ‘কিন্তু কম্পিউটার তৈরি হয়েছে প্রোগ্রামিং করার জন্যে—’

টোটন বলল, ‘আমি প্রোগ্রামিংয়ের খেতা পুড়ি।’

অন্য তিতুনি বলল, ‘ও!’ তারপর থেমে গেল।

টোটন আবার কথা শুরু করল, বলল, ‘আম্মু, ফুপুর বাসার কাছেই একটা ফ্রায়েড চিকেনের দোকান আছে। যা মজা, তুমি চিন্তা করতে পারবে না। বেসন দিয়ে মাখিয়ে ডুবাতেলে ভাজে। তেল চপচপ ফ্রায়েড চিকেন। ইয়াম ইয়াম।’

কথা শেষ করে টোটন মুখে লোল টেনে নিল। আব্বু বললেন, ‘ফ্রায়েড চিকেন একটা খাওয়ার জিনিস হলো?’

টোটন মহা-উৎসাহে বলল, ‘বার্গারও পাওয়া যায়, আর পিৎজা।’

টোটন খাওয়ার আলোচনাটা আরও খানিকক্ষণ চালিয়ে যেতে চাইছিল কিন্তু তখন রাস্তার মোড়ে ছোট একটা ভিড় চলে এল এবং ড্রাইভার এমনভাবে হর্ন দিতে লাগল যে কারও আর কোনো কথা শোনার উপায় থাকল না।

আব্বু একটু বিরক্ত হয়ে ড্রাইভারকে বললেন, ‘এত জোরে হর্ন দেওয়ার কোনো দরকার আছে? দেখছেন না সামনে ভিড়।’

ড্রাইভার হর্ন থামানোর কোনো লক্ষণ দেখাল না, বলল, ‘এই মানুষগুলা এমনি এমনি সরবি মনে করেন? এরা সরবি না। হর্ন দিলেও সরবি না। দুই-একটারে চাপা দিলে যদি সরে।’

অন্য তিতুনি বলল, ‘ভাইয়ার কম্পিউটার গেমের মতো।’

টোটন না শোনার ভান করে সামনে তাকিয়ে রইল। শেষ পর্যন্ত ভিড়টা পার হয়ে মাইক্রোবাসটা বড় রাস্তায় উঠে পড়ল এবং তখন হঠাৎ করে সবাই বুঝতে পারল এই ড্রাইভার একেবারে পাগলের মতো গাড়ি চালায়। আব্বু কয়েক মিনিট সহ্য করার চেষ্টা করলেন, তারপর বললেন, ‘ড্রাইভার সাহেব! করছেন কী? আস্তে গাড়ি চালান—অ্যাকসিডেন্ট হবে তো।’

ড্রাইভার গাড়ির স্পিড কমানোর কোনো নিশানা দেখাল না, গুলির মতো ছুটিয়ে নিতে নিতে বলল, ‘আমি মতিন ড্রাইভার, সতেরো বছর থেকে গাড়ি চালাই, কুনোদিন অ্যাসকিডেন্ট হয় নাইক্কা।’

আব্বু ‘অ্যাসকিডেন্ট’ শব্দটাকে শুদ্ধ করার কোনো চেষ্টা করলেন না, বললেন, ‘আগে কখনো অ্যাসকিডেন্ট হয় নাই মানে না যে এখন হতে পারে না। আস্তে চালান।’

মতিন ড্রাইভার বলল, ‘আমি আস্তেই চালাবার লাগছি বস। আপনার বাচ্চাকাচ্চা নিয়া উঠছেন তাই পুরা স্পিড এখনো দেই নাইক্কা।’

কথা বলতে বলতে সে বিপজ্জনকভাবে একটা ট্রাককে ওভারটেক করে সামনের দিক থেকে ছুটে আসা একটা বাসের মুখোমুখি হয়ে গেল, একেবারে কপাল জোরে মুখোমুখি অ্যাকসিডেন্ট থেকে বের হয়ে রাস্তা থেকে ছিটকে বের হতে হতে আবার রাস্তায় চলে এল। মতিন ড্রাইভার হা হা করে হেসে বলল, ‘দেখলেন, বস? হইচে অ্যাসকিডেন্ট? হইচে?’

আব্বু নিঃশ্বাস আটকে রেখে বললেন, ‘না হয় নাই। কিন্তু হতে পারত।’

‘হবে নাইক্কা। কুনোদিন হয় নাই।’

মতিন ড্রাইভার বিকট স্বরে হর্ন বাজাতে বাজাতে রাস্তা দিয়ে প্রায় উড়ে যেতে লাগল। বাস-ট্রাক ওভারটেক করে যখন খুশি রাস্তার অন্য পাশে যেতে থাকল এবং উল্টো দিক থেকে আসা গাড়িগুলোকে রীতিমতো ভয় দেখিয়ে রাস্তা থেকে নেমে পাশে সরে যেতে বাধ্য করতে লাগল। একটা ট্যাক্সিকে এভাবে রাস্তা থেকে নামিয়ে আনন্দে হা হা করে হাসতে হাসতে বলল, ‘বুঝলেন বস? আমারে গাড়ি চালান শিখাইছে আমার ওস্তাদ। ওস্তাদের নাম ছিল বুলবান্দ খান।’ মতিন ড্রাইভার এই সময় স্টিয়ারিং থেকে হাত ছেড়ে কপাল ছুঁইয়ে তার ওস্তাদকে সালাম জানিয়ে আবার শুরু করল, ‘ওস্তাদ ছিলেন কামেল মানুষ। বারো চাক্কার ট্রাক চালাইতেন, কুনো ঘুম ছাড়া একবার বাহাত্তুর ঘণ্টার ট্রিপ দিছিলেন।’

বিপজ্জনকভাবে আরেকটা মাইক্রোবাসকে ওভারটেক করে সামনে থেকে আসা আরেকটা ট্রাকের পাশ দিয়ে বের হয়ে ড্রাইভার আবার শুরু করল, ‘সেই ওস্তাদ বলত, বুঝলি মতিন গাড়ি চালানোর জন্যে লাগে দুইটা জিনিস। একটা হচ্ছে সাহস। কুনো ভয় পাবি না, সামনে দিয়ে দৈত্যের মতন ট্রাক আসতাছে? গাড়ি নিয়া সামনে দাঁড়াবি, সেই ট্রাক তোরে সাইড দিতে বাধ্য!’

আব্বু চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘আপনার ওস্তাদ আপনাকে তাই শিখিয়েছে?’

‘জে। একেবারে এক শ ভাগ খাঁটি কথা। অন্য ড্রাইভার ভয় পায় আমি পাই না। বুকের মাঝে ভয়ডর থাকলে এই লাইনে আসা ঠিক না। ওস্তাদের জবান খাঁটি জবান।’ বলে মতিন ড্রাইভার আবার কপালে হাত দিয়ে ওস্তাদকে সালাম জানাল।

টোটন খুবই মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভারের কথা শুনছিল, এবারে জিজ্ঞেস করল, ‘আরেকটা কী?’

‘দুই নম্বর জিনিস হচ্ছে—’ হঠাৎ করে মতিন ড্রাইভার থেমে গিয়ে রিয়ারভিউ মিররে পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘নাহ্ সেইটা এখন বলা যাবে না।’

‘কেন বলা যাবে না?’

‘তুমরা পুলাপান মানুষ, তুমাদের সামনে বলা ঠিক নাইক্কা।’

‘কেন বলা ঠিক না? বলেন।’ টোটনের শোনার খুবই আগ্রহ।

মতিন ড্রাইভার খুবই অনিচ্ছার ভঙ্গি করে বলল, ‘আরেকটা হচ্ছে বোতল।’

‘বোতল?’ টোটন অবাক হয়ে বলল, ‘কিসের বোতল?’

আব্বু টোটনকে একটা ধমক দিলেন, বললেন, ‘তুই চুপ করবি এখন?’

ড্রাইভার অনেকটা নিজের মনে বলল, ‘ট্রিপ দেওয়ার আগে আধা বোতল, ট্রিপের শেষে আধা বোতল, ব্যাস কুনো ঝুট ঝামেলা নাই।’

আব্বু খুবই বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আপনি কথা না বলে এখন ঠিক করে গাড়ি চালান।’

ড্রাইভার বলল, ‘জি বস। গাড়ি চালাই।’ বলে গ্যাসের প্যাডালে চাপ দিয়ে মাইক্রোবাসের স্পিড আরও বাড়িয়ে ফেলল। গাড়ির সবাই একেবারে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে।

যেকোনো সময় যা কিছু ঘটে যেতে পারত কিন্তু কিছু ঘটল না। ঘণ্টা খানেক পর যখন ঢাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে তখন হঠাৎ দেখা গেল সামনে গাড়িগুলো লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। আব্বু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার? জ্যাম নাকি?’

মতিন ড্রাইভার বলল, ‘জে না। ক্রসিং।’

‘রেলক্রসিং?’

‘জে বস’ বলে সামনের গাড়িগুলোর পিছনে থেমে না গিয়ে সে পাশের ফাঁকা লেন দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। আব্বু ভয় পেয়ে বললেন, ‘কী হলো? কই যান?’

‘ক্রসিং পার হই।’

‘ক্রসিং পার হন মানে?’

‘এই ট্রেন কখন আসবে কুনো ঠিক আছে? ঠিক নাইক্কা! উল্টা লেনে সামনে গিয়া রেললাইন ক্রস কইরা সামনে আবার ঠিক লেনে উইঠা যামু। আপনি খালি দেখেন।’

আব্বু বললেন, ‘সামনে রেলগেট ফেলে রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে না?’

‘পুরাটা করে নাই। মাইক্রো যাওয়ার ফাঁক আছে।’

‘ফাঁক আছে বলেই উল্টা রাস্তায় আপনি রেললাইন ক্রস করবেন?’ আব্বু রীতিমতো চিৎকার করে বললেন, ‘থামান। গাড়ি থামান।’

ড্রাইভার আব্বুকে সান্ত্বনা আর সাহস দেয়, ‘বস, এত ঘাবড়ান কিসের লাইগ্যা। কুনো ভয় নাই। আর এইখানে গাড়ি থামানোর উপায় আছে?’ বলে সে মাইক্রোবাসটা একেবারে রেলগেটের কাছে এসে উল্টো লেন থেকে বাঁকা হয়ে রেললাইনের ওপর উঠে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে দূর থেকে ট্রেনের প্রচণ্ড হুইসেলের শব্দ শোনা যায়, প্রচণ্ড গতিতে দৈত্যের মতো একটা ট্রেন আসছে। ট্রেনের হুইসেল শুনে এইবার মতিন ড্রাইভার পর্যন্ত ঘাবড়ে যায়। ট্রেন লাইনটা সোজাসুজি পার না হয়ে কোনাকুনি পার হওয়ার চেষ্টা করছে বলেই কি না কে জানে মাইক্রোবাসটা শেষ মুহূর্তে রেললাইনের ওপর আটকে গেল। ট্রেনের ইঞ্জিন বিকট শব্দে হুইসেল দিয়ে এগিয়ে আসছে, ভয়ে আতঙ্কে গাড়ির ভেতরে সবাই চিৎকার করে উঠল। মতিন ড্রাইভার পাগলের মতো শেষবার চেষ্টা করল, গ্যাস প্যাডেলে প্রাণপণে চাপ দিয়ে গাড়িটা কোনোমতে ছুটিয়ে নিয়ে এল এবং একটা ঝটকা দিয়ে সেটা লাইন থেকে সরে যেতেই দৈত্যের মতো বিশাল ট্রেনটা বাতাসের ঝাপটা দিয়ে গাড়িটার একেবারে গা ঘেঁষে বের হয়ে গেল।

মতিন ড্রাইভার কোনোমতে গাড়িটাকে রাস্তার ওপর তুলে এবারে ঠিক লেনে ছুটে যেতে থাকে। আব্বু একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিলেন, কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘ড্রাইভার সাহেব, গাড়ি থামান।’

‘কী বললেন বস? গাড়ি থামামু?’

‘হ্যাঁ, গাড়ি থামান।’

ট্রেন ক্রসিংয়ের জন্য সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর পাশ দিয়ে ছুটে যেতে যেতে বলল, ‘কী জন্যে বস?’

আব্বু গর্জন করে বললেন, ‘বলছি গাড়ি থামান।’

মতিন ড্রাইভার বলল, ‘কিছু তো হয় নাইক্কা।’

‘কিছু হয়েছে কি হয় নাই আমি সেটা নিয়ে কথা বলছি না। গাড়ি থামান।’

আম্মুও এতক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছেন, কাঁপা গলায় বললেন, ‘গাড়ি থামান।’

টোটনও যোগ দিল, বলল, ‘থামান, গাড়ি থামান।’

শুধু অন্য তিতুনি কিছু বলল না। মতিন ড্রাইভার নার্ভাসভাবে একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, ‘বস, গাড়ি তো এখন থামান যাবে নাইক্কা। দিরং হয়ি যাবে। আপনাদের নামানোর পর আরেকটা বড় ট্রিপ আছে কক্সবাজার। ওই ট্রিপ তো মিস করা যাবে না। কাস্টমার খুব ত্যাড়া।’

আব্বু হুংকার দিয়ে বললেন, ‘আমি কিছু শুনতে চাই না। গাড়ি থামান, আমরা নেমে যাব।’

সামনের দিক থেকে আসা আরেকটা ট্রাককে খুবই বিপজ্জনকভাবে পাশ কাটিয়ে গিয়ে মতিন ড্রাইভার মুখ শক্ত করে বলল, ‘রাগ করেন ক্যান বস। আমি বলছি গাড়ি থামান যাবি না।’

মতিন ড্রাইভার কথা শেষ করার আগেই গাড়ির ইঞ্জিন একটা বিদঘুটে শব্দ করল, গাড়িটা একটা ঝাঁকুনি দিল, তারপর কেমন যেন কাশির মতো শব্দ করতে করতে রাস্তার পাশে থেমে গেল। কেন হঠাৎ করে গাড়ির ইঞ্জিনটা বন্ধ হয়ে গেল সেটা অন্য তিতুনি ছাড়া আর কেউ জানল না। একটু আগে ট্রেন লাইনে আটকে যাওয়া মাইক্রোবাসটা কেমন করে শেষ মুহূর্তে ছুটে এসেছে সেটাও কেউ জানে না। পুরো রাস্তার বিপজ্জনক ওভারটেকগুলোতে প্রত্যেকবার কেমন করে নিরাপদে পার হয়ে এসেছে, সেটাও অন্য তিতুনি ছাড়া আর কেউ জানে না।

গাড়িটা থেমে যাওয়াতে মতিন ড্রাইভার খুবই অবাক হলো, দাঁতে দাঁত ঘষে একটা গালি দিয়ে বলল, ‘আরে! একি মুসিবত। মাত্র সার্ভিসিং করছি, ধোলাইখাল থেকে রিকন্ডিশন ইঞ্জিল ফিট করছি, এখন রাস্তার মাঝে গাড়ি বন হইল, ব্যাপারটা কী?’

ব্যাপারটা কী সেটা নিয়ে আব্বু-আম্মু কিংবা টোটনের কোনো আগ্রহ নেই। অন্য তিতুনি যেহেতু এটা ঘটিয়েছে তারও কোনো আগ্রহ নাই। আব্বু গাড়ির দরজা খুলে সবাইকে নিয়ে নেমে পড়লেন। মেঘ স্বরে ড্রাইভারকে ডেকে বললেন, ‘ড্রাইভার সাহেব। গাড়ি থেকে নামেন। আপনার সাথে কথা আছে।’

মতিন ড্রাইভার গাড়ি থেকে নামার কোনো আগ্রহ দেখাল না। তার সিটে বসে কিছুক্ষণ খুটখাট করে আবার গাড়ি স্টার্ট করার চেষ্টা করল আর সত্যি সত্যি হঠাৎ ইঞ্জিনটা স্টার্ট নিয়ে নেয়। ড্রাইভার গাড়ির ভেতরে বসে আনন্দের মতো শব্দ করে বলল, ‘উঠেন গাড়িতে! গাড়ি স্টার্ট নিছে।’

আব্বু বললেন, ‘রাখেন আপনার গাড়ি। আগে নিচে নেমে আসেন।’

মতিন ড্রাইভার গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ না করেই দরজা খুলে খুবই অনিচ্ছার সাথে তার ড্রাইভারের সিট থেকে নিচে নেমে এল। মুখে একটা বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে রেখে সে কাছে এসে রুক্ষ গলায় বলল, ‘কী হইছে বস? আপনার সমিস্যা কী?’

‘আমার কোনোই সমস্যা নেই। আমরা আপনার গাড়িতে যাব না। আমাদের ব্যাগগুলো নামিয়ে দেন।’

আব্বুর কথা শুনে সে খুবই অবাক হয়েছে, এই রকম ভান করল, তারপর কী একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। হঠাৎ করে মনে হলো তার মাথাটা ঘুরে উঠেছে, হাত বাড়িয়ে মাইক্রোবাসটাকে ধরে সে তাল সামলানোর চেষ্টা করে। তার চোখগুলো ঘুরতে থাকে, দেখে মনে হয় সে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে।

আব্বু ভয় পেয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে? আরে কী হয়েছে আপনার?’

ড্রাইভার কোনো কথা বলল না, তারপর হঠাৎ কেমন জানি জেগে উঠে পিটপিট করে সবার দিকে তাকাল। আব্বু বললেন, ‘ঠিক আছেন আপনি?’

‘জে বস ঠিক আছি।’ মতিন ড্রাইভার হাত দিয়ে তার কপালটা মুছে বলল, ‘হঠাৎ মাথাটা কেমন জানি ঘুরে উঠল। জে বস আপনি কী যেন বলছিলেন?’

‘আমি বলেছি যে আমরা আপনার গাড়ি করে যাব না। আমাদের ব্যাগগুলো নামিয়ে দেন?’

ড্রাইভার কেমন জানি শূন্য দৃষ্টিতে আব্বুর দিকে তাকিয়ে রইল, মনে হলো আব্বুর কথা সে কিছুই শুনছে না। আব্বু বললেন, ‘কী হয়েছে আপনার?’

‘ভুলে গেছি।’

‘কী ভুলে গেছেন?’

‘গাড়ি চালানো।’

আব্বু অবাক হয়ে বললেন, ‘গাড়ি চালানো ভুলে গেছেন মানে?’

মতিন ড্রাইভার আব্বুর কথার উত্তর না দিয়ে হেঁটে হেঁটে ড্রাইভারের দরজার কাছে দাঁড়াল, কেমন যেন ভয়ে ভয়ে ভিতরে তাকাল। আব্বু এবং সাথে অন্য সবাই তার পিছু পিছু এগিয়ে গেল। ড্রাইভার আব্বুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে কেমুন করে?’

আব্বু কয়েক মুহূর্ত মতিন ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কেন চাবি দিয়ে?’

‘চাবি কই?’ বলে সে ওপরে-নিচে তাকাতে লাগল।

আব্বু বললেন, ‘ওই যে স্টিয়ারিং-এর নিচে।’

‘ইস্টিয়ারিং? ইস্টিয়ারিং কী?’

আব্বু অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনি সত্যিই স্টিয়ারিং হুইল কী সেইটা ভুলে গেছেন?’

‘জে বস। সব ভুলে গেছি।’ বলে সে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল, জিজ্ঞেস করল, ‘কোনটা স্টিয়ারিং?’

আব্বু স্টিয়ারিং হুইলটা দেখালেন। মতিন ড্রাইভার খুব সাবধানে আঙুল দিয়ে সেটা একবার ছুঁয়ে দেখল। তারপর তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নিল, বলল, ‘কী আচানক!’

আম্মু বললেন, ‘আপনার এখন কোথাও বসে মাথায় একটু ঠান্ডা পানি ঢালা দরকার। মনে হয় আপনার মাথা গরম হয়ে গেছে।’

মতিন ড্রাইভার বলল, ‘না ম্যাডাম, আমার মাথা গরম হয় নাইক্কা, আমি সব ভুলে গেছি।’

‘আর কী কী ভুলেছেন? স্ট্রোক হলে মানুষ সবকিছু ভুলে যায়।’

‘আর কিছু ভুলি নাইক্কা। সব মনে আছে।’

‘আপনার নাম? ঠিকানা? টেলিফোন নম্বর?’

‘মনে আছে। সব মনে আছে।’

‘শুধু গাড়ি চালানো ভুলে গেছেন? এটা কেমন করে হতে পারে?’

মতিন ড্রাইভার একবার মাথা চুলকাল, একবার পেট চুলকাল, তারপর অনেকক্ষণ ধরে বগল চুলকাল তারপর বলল, ‘কিছু মনে নাইক্কা। কিছু নাইক্কা।’

সে মাইক্রোবাসটা ঘুরে ঘুরে দেখে, ড্রাইভারের দরজা খুলে কেমন যেন হাঁ করে গাড়ির ড্যাশবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে। খুব সাবধানে একবার গিয়ারটা ছুঁয়ে দেখে, নিচে গ্যাস প্যাডেল আর ব্রেকের দিকে তাকায় তারপর আবার প্রথমে মাথা, তারপর পেট এবং শেষে বগল চুলকাতে থাকে।

আব্বু বললেন, ‘ইঞ্জিনটা বন্ধ করে রাখেন, শুধু শুধু গ্যাস খরচ হচ্ছে।’

‘আমি তো পারমু না। বললাম না ভুলে গেছি।’

আব্বু গাড়ির চাবিটা দেখিয়ে বললেন, ‘ওইটা ঘোরান। ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাবে।’

মতিন ড্রাইভার খুব সাবধানে চাবি ঘুরিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করল, তারপর চাবিটা বের করে কেমন জানি অবাক হয়ে গাড়ির চাবিটার দিকে তাকিয়ে রইল।

আব্বু বললেন, ‘ড্রাইভার সাহেব, আপনাকে একটা কথা বলি।’

‘জে বস। বলেন।’

‘এইটা মনে হয় ভালোই হয়েছে যে আপনি গাড়ি চালানো ভুলে গেছেন। এটা কেমন করে সম্ভব আমি জানি না, কিন্তু যেহেতু দেখছি এটা ঘটেছে, মেনে নেন। আপনার জন্যে ভালো, প্যাসেঞ্জারদের জন্যে ভালো। আপনি যেভাবে গাড়ি চালান সেটা খুবই ডেঞ্জারাস। আপনি নিজে মারা যাবেন, প্যাসেঞ্জারদের মারবেন। বুঝেছেন?’

‘জে বস। বুঝেছি।’

‘আপনি অন্য কিছু করেন।’

‘অন্য কিছু?’

আব্বু বললেন, ‘হ্যাঁ। ব্যবসাপাতি। কন্ট্রাক্টরি। আপনার স্বাস্থ্য ভালো আছে, সিকিউরিটির চাকরি নিতে পারেন। বুঝেছেন?’

মতিন ড্রাইভার মাথা নাড়ল, বলল, ‘বুঝেছি। কিন্তু—’

‘কিন্তু কী?’

‘আমার ওস্তাদ বুলবান্দ খান দিলে খুবই দাগা পাবে। আমি তার এক নম্বুর ছাত্র ছিলাম।’

ওস্তাদ বুলবান্দ খানের এক নম্বর ছাত্র মতিন ড্রাইভার মুখটা ভোঁতা করে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চুল, পেট আর বগল শেষ করে এবার তার কান চুলকাতে লাগল।

গাড়ি থেকে সবার ব্যাগ নামিয়ে একটু হেঁটে সামনে একটা গ্যাস স্টেশন পাওয়া গেল। আব্বু অন্যদের দাঁড় করিয়ে একটা ট্যাক্সি ক্যাব খুঁজতে গেলেন। ঢাকা শহরের খুব কাছাকাছি চলে এসেছেন, এখন খুব সমস্যা হওয়ার কথা না।

এক পাশে দাঁড়িয়ে লাইন বেঁধে গাড়িগুলোকে সিএনজি নেওয়া দেখতে দেখতে টোটন আবার তার কথা শুরু করল। যেহেতু তিতুনিকে সে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে না, তাই আম্মুকে বলল, ‘আম্মু, মাইক্রোবাসের ড্রাইভারটা কিন্তু খুবই এক্সপার্ট ড্রাইভার।’

আম্মু ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘এক্সপার্ট?’

‘হ্যাঁ। রেলক্রসিংয়ে মাইক্রোটাকে কেমন করে ছুটিয়ে এনেছে দেখোনি?’

‘ওইখানে গিয়ে আটকাল কেন সেটা দেখবি না?’

টোটন সেটাকে বেশি গুরুত্ব দিল না, বলল, ‘একেবারে কম্পিউটার গেমের মতো গাড়ি চালায়। হুশহাশ করে ওভারটেক করে।’

অন্য তিতুনি বলল, ‘খালি একটা পার্থক্য? কম্পিউটার গেমে অনেকগুলো লাইফ থাকে। এইখানে লাইফ খালি একটা।’

এক শ ভাগ সত্যি কথাটার কোনো ঠিক উত্তর দিতে পারল না বলে টোটন খুবই বিরক্ত হয়ে অন্য পাশে সরে গিয়ে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। গ্যাস নেওয়ার সময় প্যাসেঞ্জারদের গাড়ি থেকে নামতে হয়, তারাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কাছাকাছি খুব ফিটফাট একজন মানুষ, তার ধবধবে সাদা শার্ট, কুচকুচে কালো প্যান্ট, চোখে চশমা, মুখে সিগারেট। মানুষটার মাথায় চুল খুব বেশি নেই কিন্তু যেটুকু আছে তার জন্য নিশ্চয়ই অনেক মায়া, তাই পকেট থেকে সবুজ রঙের একটা চিরুনি বের করে একবার চুলগুলো আঁচড়ে নিল।

গ্যাস স্টেশনে বেশ কয়েকজন ভিখারি ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করছে। ছোট ছোট কয়েকটা ছেলেমেয়ে সিদ্ধ ডিম পপকর্ন আর আচার বিক্রি করার চেষ্টা করছে। একটা ছোট মেয়ে তার সিদ্ধ ডিমের ঝুড়ি নিয়ে ফিটফাট মানুষটার কাছে গিয়ে সেগুলো বিক্রি করার চেষ্টা করল। কী কারণ জানা নেই মানুষটা খুবই বিরক্ত হয়ে একেবারে খেঁকিয়ে উঠল, মেয়েটা তারপরেও হাল ছাড়ল না, আবার করুণ মুখ করে কিছু একটা বলল। ফিটফাট মানুষটা একেবারে রেগে উঠে মেয়েটাকে একটা ধাক্কা মেরে বসে, এর জন্য মেয়েটা প্রস্তুত ছিল না, তাই একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। ঝুড়ি থেকে বের হয়ে ডিমগুলো ছিটকে পড়ে, গড়িয়ে যেতে থাকে। কিছু একেবারে থেঁতলে গেল।

দৃশ্যটা দেখে টোটন মনে হয় একটু আমোদ পেল, তাই ভালো করে দেখার জন্য কাছে এগিয়ে গেল। তিতুনিও টোটনের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। যেন কিছুই হয়নি এ রকম মুখের ভাব করে ছোট মেয়েটা গড়িয়ে যাওয়া ডিমগুলো তুলতে থাকে। থেঁতলে যাওয়া ডিমটা বিক্রি করতে পারবে কি না, সেটা নিয়ে তার ভেতরে একটু দুর্ভাবনা হয় কিন্তু সেটা নিয়ে সে বেশি মাথা ঘামাল না। তার এই ছোট জীবনে সে প্রতিদিন এর থেকে অনেক বড় বড় বিপদ পার করে। তবে সে নিশ্চয়ই খুবই অবাক হতো যদি জানতে পারত ঝুড়ির ভেতরে থেঁতলানো ডিমটা রাখতেই সেটা ম্যাজিকের মতো ঠিক হয়ে যাচ্ছে।

অন্য তিতুনি নিচু গলায় টোটনকে বলল, ‘কাজটা ঠিক হলো না।’

‘কোন কাজটা?’

‘এই যে মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। এখন মানুষটার ঝামেলা হবে।’

টোটন ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কী ঝামেলা?’

অন্য তিতুনি গ্যাস স্টেশনের ছাউনির ওপর বসে থাকা কয়েকটা কাককে দেখিয়ে বলল, ‘ওই কাকগুলো দেখেছ?’

‘কী হয়েছে কাকের?’

‘এরা পুরো ব্যাপারটা দেখে খুব রেগে গেছে মনে হয়।’

কথাটা শুনে টোটন এমনভাবে তাকাল যেন অন্য তিতুনির মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে। সে মুখে একটা বিদ্রূপের হাসি এনে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই সত্যি সত্যিই একটা কাক ছাউনি থেকে উড়ে এসে ঠিক ফিটফাট মানুষটার মাথায় বাথরুম করে দিল। ছোট একটা কাকের পেটে এত বিপুল পরিমাণ বাথরুম থাকতে পারে কে জানত, কারণ দেখা গেল কাকের বাথরুম তার মাথা থেকে চোখ-গাল বেয়ে ধবধবে সাদা শার্ট পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে।

হকচকিত মানুষটা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে একবার নিজের দিকে, তারপর মাথা উঁচু করে কাকটার দিকে তাকাল। আর ঠিক তখন অন্য কাকগুলো কা কা করে উড়ে এসে মানুষটার মাথা ঘাড় মুখে ঠোকরাতে শুরু করে। মানুষটা দুই হাতে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে, কিন্তু কাক খুবই ভয়ংকর পাখি, দল বেঁধে থাকলে তাদের ঠেকানো সোজা কথা নয়। মানুষটা নিজেকে বাঁচানোর জন্য দৌড়ে তার গাড়িটাতে ওঠার চেষ্টা করে কিন্তু তার আগেই সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।

কাকগুলো যে রকম হঠাৎ করে এসেছিল ঠিক হঠাৎ করে উড়ে আবার তাদের ছাউনির ওপর ফিরে গেল। সেখানে বসে খুবই নিরাসক্তভাবে কাকগুলো ফিটফাট মানুষটাকে দেখতে থাকে।

কাকদের এই ঝটিকা আক্রমণ দেখে বেশ কিছু মানুষ ছুটে আসে। মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা মানুষটাকে টেনে দাঁড় করায়। চশমাটা ভেঙে গেছে, নাকটা মনে হয় থেঁতলে গেছে। মাথায় মুখে ঘাড়ে কাকের ধারালো ঠোঁটের আঘাতের চিহ্ন। বেশির ভাগ মানুষ শুধু কাকের ঝটিকা আক্রমণটুকু দেখেছে, মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার আগের অংশটুকু দেখেনি, তাই তাদের সমবেদনাটা এই মানুষটার জন্য, তারা তাকে ঠিকঠাক করার চেষ্টা করতে থাকে।

ছোট মেয়েটা তার সবগুলো সিদ্ধ ডিম ঝুড়িতে ভরে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ঝুড়িটা দুই হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে মানুষটাকে দেখল, তার চোখে-মুখে একধরনের ভয়ের ছাপ নেমে আসে। কাকদের এই ঝটিকা আক্রমণের জন্য তাকেই দায়ী করে তার ওপর আরও বড় কোনো শাস্তি নেমে আসবে কি না কে জানে। সে দ্রুত সরে যেতে যেতে একবার টোটন আর অন্য তিতুনির দিকে তাকাল। অন্য তিতুনির চোখের দিকে তাকিয়ে সে কী দেখল কে জানে, বিড়বিড় করে নিচু গলায় তাকে বলল, ‘আল্লাহর মাইর চিন্তার বাইর।’

তারপর সে ছুটে পালিয়ে যেতে থাকে। ঠিক তখন আব্বু একটা ক্যাব নিয়ে হাজির হলেন। বললেন, ‘চলো, সবাই ঝটপট উঠে পড়ো।’

দরজা খুলেই বড় ফুপু আনন্দে চিৎকার করে বললেন, ‘দেখে যা, কারা এসেছে!’

তারপর টোটন আর ‘তিতুনি’কে জাপটে ধরে আদর করলেন, নাকে-মুখে চুমো খেলেন। যদিও বড় ফুপুর জানার কোনো উপায় নাই যে তিতুনি ভেবে যাকে ল্যাটা প্যাটা করে চুমু খেলেন সেটা বহুদূর গ্যালাক্সি থেকে আসা একটা এলিয়েন এবং তার চুমু খাওয়াটা ছিল পৃথিবীর মানুষ দ্বারা একটা এলিয়েনকে প্রথমবার ল্যাটা প্যাটা করে চুমু খাওয়া।

বড় ফুপুর আনন্দের চিৎকার শুনে তার ছেলেমেয়েরা নিজেদের ঘর থেকে বের হয়ে এল। সবাই নাদুসনুদুস ফরসা এবং গোলগাল, তাদের কেউই টোটন কিংবা তিতুনিকে দেখে এমন কিছু আনন্দের ভাব করল না। মুখে হালকা একটা তাচ্ছিল্যের বাঁকা হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আব্বু আর আম্মু তাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন, বললেন, ‘কী খবর তোমাদের নাদু দিলু মিলু?’

নাদু দিলু মিলু আব্বুর কথা শুনল কি না বোঝা গেল না, কারণ তারা যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। বড় ফুপুর ছেলেমেয়েদের মাঝে নাদু বড়,  বয়সে টোটনের সমান কিন্তু চোখে চশমা আর মোটাসোটা বলে তাকে আরও অনেক বড় দেখায়। তার নাকের নিচে হালকা গোঁফ দেখা দিতে শুরু করেছে, গলার স্বর পরিবর্তন হচ্ছে বলে সেটাতে কন্ট্রোল নেই, তাই আজকাল বেশি কথা বলে না। দিলু দ্বিতীয় ছেলে, একেবারে তিতুনির বয়সী, চোখে চশমা, নাদুর মতোই মোটাসোটা কিন্তু সাইজে তিতুনি থেকে ছোট বলে আরও বেশি মোটা দেখায়। তিতুনি মেয়ে বলে তাকে পাত্তা না দেওয়াটা টোটন আর নাদুর কাছে শিখেছে, কাজেই সেও তিতুনিকে পাত্তা দেয় না। সবচেয়ে ছোটজনের নাম মিলু, বয়স নয়, সে তিতুনিকে বেশ পছন্দই করে কিন্তু বড় দুই ভাই এবং টোটন যেহেতু সব সময় তিতুনিকে হাসি তামাশা ঠাট্টা টিটকারি করে তাই সে ধরে নিয়েছে এটাই নিয়ম। বড় দুই ভাইয়ের কারণে সে বেশি কম্পিউটার খেলার সুযোগ পায় না বলে চোখে এখনো চশমা ওঠেনি। বড় ফুপু টোটন আর অন্য তিতুনিকে ধরে ভেতরে আনলেন, আব্বু আর আম্মু পেছনে পেছনে ভেতরে ঢুকলেন। বড় ফুপু বললেন, ‘ওমা! দেখ, টোটন কত বড় হয়ে গেছে। তিতুনিও দেখি লম্বা হয়েছে।’

আব্বু বললেন, ‘আপা, তোমার ওদের সাথে তিন মাস পর দেখা হয়েছে—তুমি এমন ভাব করছ যে কয়েক বছর পরে দেখছ।’

ফুপু বললেন, ‘চিন্তা কর—পুরো তিন মাস পরে দেখছি। আর এক-দুই দিনের জন্য দেখা আর না দেখার মাঝে কোনো পার্থক্য আছে নাকি?’

আম্মু বললেন, ‘আপা আপনারাও তো মাঝে মাঝে আসতে পারেন, গ্রামে আমরা কেমন থাকি না হয় একবার দেখে আসলেন!’

বড় ফুপু বললেন, ‘অনেক হয়েছে। এখন আমাদের নিয়ে আর টিটকারি কোরো না—এই ঢাকা শহরে মানুষ কীভাবে থাকে মাঝে মাঝে এসে দেখে যেয়ো।’

টোটন বলল, ‘না বড় ফুপু ঢাকা শহরই ভালো। গ্রামে কোনো লাইফ নাই।’

বড় ফুপু বললেন, ‘থাক, আমাকে আর লাইফ শেখাতে হবে না। এখন যা হাত-মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নে। একটু পরেই খেতে দেব।’

টোটন বলল, ‘বেশি করে খেতে দিবে তো বড় ফুপু? আমাদের তিতুনি আজকাল রাক্ষসের মতো খায়।’

তিতুনি রাক্ষসের মতো খায়, কথাটা টোটন বেশ নাটকীয়ভাবে বলল আর সেটা শুনে নাদু দিলু হি হি করে হেসে উঠল আর বড় দুই ভাইকে হি হি করে হাসতে দেখে মিলুও হাসার চেষ্টা করল। নাদু আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘সত্যি?’

টোটন বলল, ‘সত্যি না তো মিথ্যা নাকি? আমার কথা বিশ্বাস না করলে আম্মুকে জিজ্ঞেস করে দেখ। একদিন রাত দুইটার সময় আম্মু ঘুম থেকে উঠে দেখে তিতুনি ফ্রিজ খুলে যা পাচ্ছে তাই গপ গপ করে খাচ্ছে! তাই না আম্মু?’

আম্মু একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘খিদে পেয়েছে তো খেয়েছে। তাতে তোর সমস্যা কী? যা এখন বিরক্ত করিস না।’

টোটন বলল, ‘নাদু, চলো তোমার রুমে যাই। তোমার নতুন গেমগুলি দেখি।’

মিলু বলল, ‘ভাইয়া যা একটা গেম—’ নাদু তখন চোখ পাকিয়ে মিলুর দিকে তাকাল আর মিলু সাথে সাথে কথা বন্ধ করে ফেলল।

নাদুর ঘরে টেবিলে কম্পিউটার মনিটরে একটা অর্ধসমাপ্ত কম্পিউটার গেমের দৃশ্য আটকে আছে। খুবই স্বাস্থ্যবান একজন মানুষ একটা আধা-জন্তু আধা-মানুষকে ধারালো তরবারি দিয়ে গেঁথে ফেলছে। স্ক্রিনটা দেখে টোটনের চোখ বড় বড় হয়ে উঠল। মুখে লোল টানার মতো শব্দ করে বলল, ‘নূতন গেম?’

নাদু একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, ‘এইটা আর কী গেম! নতুন যে গেমটা এনেছি সেইটা খেললে তোমার কাপড় নষ্ট হয়ে যাবে।’

‘সত্যি?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু এইটা খুবই সিক্রেট। এই গেমটা আমেরিকা, জার্মানি আর ফ্রান্সে ব্যান্ড। কেউ খেললে তার এক হাজার ডলার জরিমানা।’

টোটনের চোখ বড় বড় হয়ে উঠল, ‘সত্যি?’

‘এক শ ভাগ সত্যি। অনেক কষ্ট করে জোগাড় করেছি।’

টোটন মুখে লোল টেনে বলল, ‘দেখি, দেখি।’

নাদু মুখ গম্ভীর করে বলল, ‘আগে দরজা বন্ধ করতে হবে। মিলু দরজা বন্ধ কর।’

মিলু দরজা বন্ধ করতে গিয়ে থেমে গেল। তাদের ঘরে টোটনের সঙ্গে তিতুনিও ঢুকেছে। তিতুনিকে কেউ তাদের খেলায় চায় না। সবাই তিতুনির দিকে তাকিয়ে রইল। নাদু বলল, ‘তিতুনি বলে দেবে।’

অন্য তিতুনি মাথা নাড়ল, বলল, ‘বলব না।’

‘খোদার কসম?’

‘খোদার কসম।’

টোটন মুখ শক্ত করে বলল, ‘বলে দেখুক না, আমি বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দিব না?’

নাদু তার কম্পিউটারের ভেতর থেকে গেমটা খুুঁজে বের করে লোড করতে থাকে। দিলু তিতুনির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তিতুনি, তুমি সত্যি এখন রাত দুইটার সময় উঠে রাক্ষসের মতো খাও।’

অন্য তিতুনি মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ। খাই।’

কথাটা এত সহজে স্বীকার করে নেবে দিলু মোটেও আশা করেনি, একটু থতমত খেয়ে বলল, ‘কেন?’

‘বেশি বেশি খেয়ে আমি তোমাদের মতো নাদুসনুদুস মোটাসোটা গোলগাল ফুটবলের মতো হতে চাই।’

সবাই চোখ পাকিয়ে তিতুনির দিকে তাকাল, শুধু মিলু হি হি করে হাসতে শুরু করল, বলল, ‘নাদুসনুদুস মোটাসোটা গোলগাল ফুটবল নাদুসনুদুস মোটাসোটা গোলগাল ফুটবল—’

দিলু মুখ খিঁচিয়ে মিলুর দিকে তাকিয়ে একটা ধমক দিয়ে বলল, ‘চুপ কর স্টুপিড।’ তারপর বড় ভাইয়ের কাছে নালিশ দিয়ে বলল, ‘দেখেছ ভাইয়া তিতুনি কী বলে?’

টোটন বলল, ‘তিতুনিটা সব সময় এই রকম বেয়াদপের মতো কথা বলে। একবার বাসায় নিয়ে যাই তো তারপর আচ্ছা মতন সাইজ করব।’

দিলু নাক ফুলিয়ে বলল, ‘করবে তো সাইজ?’

‘করব।’

অন্য তিতুনি বলল, ‘কে কাকে সাইজ করবে দেখা যাবে।’

টোটন হুংকার দিয়ে বলল, ‘চুপ কর তিতুনি।’

নাদু বলল, ‘ছেড়ে দাও ওই সব। তোমার আব্বু-আম্মু তোমার বোনের নাম রেখেছে তিতুনি। তিতুনি মানে তিতা। তিতুনির কথা তো তিতা হবেই! যদি মিষ্টি কথা বলত তাহলে কি আর তিতুনি নাম রাখে? তাহলে নাম রাখত মিষ্টুনি।’

যুক্তিটা সবারই খুব পছন্দ হলো। তখন অন্য তিতুনি ছাড়া সবাই হি হি করে দুলে দুলে হাসতে লাগল। ঠিক তখন কম্পিউটারের স্ক্রিনে একটা ভয়ংকর কম্পিউটার গেমের ছবি ভেসে ওঠে, তার সঙ্গে বিদঘুটে মিউজিক। স্ক্রিনটা মুছে গিয়ে নতুন আরেকটা ছবি ভেসে আসে। নিচে অনেকগুলো মানুষের মুখ, ওপরে অনেকগুলো অস্ত্র। নাদু বলল, ‘এই যে নিচে এরা হচ্ছে ভিকটিম। তুমি আগে এদের একজনকে বেছে নিবে।’ নাদু মাউস নাড়িয়ে একজন মেয়েকে বেছে নিল। সাথে সাথে স্ক্রিনে সেই মেয়েটাকে দেখা গেল। সে ভীত চোখে মাথা ঘুরিয়ে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে, খুবই জীবন্ত একটা দৃশ্য। নাদু হাসি হাসি মুখে বলল, ‘তারপর ওপরের অস্ত্রগুলো থেকে টর্চারের একটা অস্ত্র বেছে নিবে। অনেক রকম অস্ত্র আছে, হকিস্টিক, চাবুক, নানচাকু, ছোরা, চাপাতি, চায়নিজ কুড়াল। তুমি যেটা ইচ্ছা সেটা বেছে নেবে।’ নাদু চাবুক বেছে নিতেই মেয়েটার সামনে একটা চাবুক ঝুলতে থাকে। মেয়েটার চোখে-মুখে ভয়টা হঠাৎ করে বেড়ে যায়। সে দুই হাত তার সামনে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। নাদু বলল, ‘তারপর তুমি মারবে।’ নাদু মাউস ক্লিক করতেই শপাং করে চাবুকটা মেয়েটার ওপর আছড়ে পড়ল আর মেয়েটা যন্ত্রণার মতো চিৎকার করে ছটফট করতে থাকে। নাদুর চোখে-মুখে একটা হিংস্র ভাব চলে আসে, সে শপাং শপাং করে স্ক্রিনের মেয়েটাকে চাবুক দিয়ে মারতে থাকে। মেয়েটা চিৎকার করতে থাকে, দেখতে দেখতে চাবুকের আঘাতে তার শরীরের কাপড় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

নাদু টোটনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখেছ কী রিয়েলিস্টিক?’

অন্য তিতুনি দাঁতের ফাঁক দিয়ে বলল, ‘ছি ছি ছি! এই গেম মানুষ খেলে?’

মিলু একটু আশা নিয়ে তিতুনির মুখের দিকে তাকাল। সেও এই গেমটাকে মোটেও পছন্দ করে না, তার দেখতে ভয় লাগে, কান্না চলে আসে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না, তিতুনির কথা শুনে প্রথমবার একটু সাহস পেল। বিড়বিড় করে বলল, ‘আমারও এটা ভালো লাগে না।’

নাদু ধমক দিয়ে বলল, ‘ভালো না লাগলে নাই। এখানে দাঁড়িয়ে ভ্যাঁদর ভ্যাঁদর করবি না।’

অন্য তিতুনি মুখ শক্ত করে বলল, ‘কেউ যদি এই গেম খেলে তাহলে তাকে পুলিশ না হয় র‌্যাবের হাতে ধরিয়ে দেওয়া উচিত। তার মাথার চিকিৎসা করানো দরকার।’

সাহস পেয়ে মিলুও জোরে জোরে মাথা নাড়ল। টোটন মুখ খিঁচিয়ে বলল, ‘খবরদার বড় বড় কথা বলবি না। ভাগ এখান থেকে।’ তারপর নাদুকে বলল, ‘আমাকে দাও, প্লিজ, আমি একটু টর্চার করি।’

নাদু মুখে অহংকারের একটা ভাব এনে বলল, ‘পরের লেবেলটা আরও ভালো, সেখানে অ্যাসিড ছোড়া যায়।’

নাদু সরে টোটনকে বসার জায়গা করে দিল। টোটন মাউসটা হাতে নিয়ে শপাং শপাং করে মেয়েটাকে চাবুক দিয়ে মারতে লাগল আর ঠিক তখন খুবই বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটে গেল। হঠাৎ চাবুকটা একটা ফুলের মালায় পাল্টে গেল। আর সেটা দিয়ে মারার চেষ্টা করতেই ফুলগুলো ঝুরঝুর করে মেয়েটার চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ভীত আতঙ্কিত মেয়েটার মুখ হঠাৎ হাসি হাসি হয়ে যায় আর তার চারপাশে যখন ফুলগুলো ঝরে পড়তে থাকে তখন মেয়েটা আনন্দে খিলখিল করে হাসতে থাকে। সেটা দেখে মিলুও হাততালি দিয়ে আনন্দে খিলখিল করে হেসে উঠল।

নাদু অবাক হয়ে বলল, ‘এটা কী হলো?’ টোটনের কাছ থেকে মাউসটা নিয়ে সে চেষ্টা করল, প্রত্যেকবারই চাবুকের বদলে একটা ফুলের মালা মেয়েটার দিকে ছুটে যাচ্ছে, সেখান থেকে ফুল ঝরে পড়ছে। শুধু তাই না, সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি একটা বাজনা হতে থাকে আর মেয়েটা আনন্দে খিলখিল করে হাসতে থাকে।

নাদু প্রায় খেপে যায়, হিসহিস করে বলল, ‘বাগ, নিশ্চয়ই একটা বাগ। কিন্তু আমি কালকেই খেলেছি, কোনো সমস্যা হয়নি।’

টোটন বলল, ‘অন্য একটা অস্ত্র নাও। চাপাতি না হলে চায়নিজ কুড়াল।’

নাদু চায়নিজ কুড়াল বেছে নিল, সত্যি সত্যি এবার কুড়াল সামনে দুলতে থাকে। কিন্তু কুড়ালটা দিয়ে আঘাত করতেই সেটা হঠাৎ করে একটা আইসক্রিম হয়ে গেল। মেয়েটা হাত বাড়িয়ে আইসক্রিমটা নিয়ে চেটে চেটে খেতে শুরু করে। শুধু যে খেতে থাকল তাই না, খুব পরিতৃপ্তির মতো শব্দ করতে লাগল।

নাদু প্রায় হুংকার দিয়ে বলল, ‘কী হচ্ছে এটা?’

সে আবার আঘাত করার চেষ্টা করতেই আরেকটা আইসক্রিম বের হয়ে আসে। মেয়েটা দ্বিগুণ উৎসাহে সেটাও আরেক হাতে নিয়ে নেয় আর মহানন্দে খেতে থাকে।

মিলু আনন্দে হাততালি দিয়ে বলল, ‘আমি খেলব। আমি খেলব।’

নাদু গর্জন করে বলল, ‘চুপ কর পাজি মেয়ে। আমার এত সুন্দর গেমটার বারোটা বেজে গেছে আর সে খেলবে।’

নাদু অস্ত্র হিসেবে ধারালো চাপাতি বেছে নিল, সেটা প্রথমে ঠিকই একটা চাপাতি থাকলেও সেটা দিয়ে কোপ দেওয়ামাত্র সেটা এক স্লাইস চকলেট কেক হয়ে গেল। মেয়েটা হাত বাড়িয়ে কেকটা নিয়ে খেতে থাকে। শুধু যে খেতে থাকে তাই নয়, হাত-পা দুলিয়ে নাচতে থাকে এবং মনে হলো একসময় নাদুর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে দিল।

অন্য তিতুনি হাসি হাসি মুখে বলল, ‘এইবার গেমটা ঠিক আছে। খুবই সুইট গেম।’

মিলু লাফাতে লাফাতে বলল, ‘আমি খেলব। আমি খেলব!’

নাদু ধমক দিয়ে বলল, ‘চুপ কর।’

টোটন বলল, ‘এটা কেমন করে হচ্ছে?’

শুধু অন্য তিতুনিই জানে এটা কেমন করে হচ্ছে, কিন্তু সে কাউকে বুঝতে দিল না, বলল, ‘ভাইরাস। কম্পিউটার ভাইরাস। তাই না নাদু ভাইয়া?’

নাদু মেঘস্বরে বলল, ‘যেটা জানো না, সেটা নিয়ে কথা বোলো না। কম্পিউটার ভাইরাস একটা প্রোগ্রামকে অন্য কিছু করে দিতে পারে না। এটা খালি নষ্ট করে দিতে পারে, না হলে বন্ধ করে দিতে পারে।’

অন্য তিতুনি বলল, ‘তাহলে কম্পিউটার ব্যাকটেরিয়া।’

নাদু বলল, ‘কম্পিউটার ব্যাকটেরিয়া বলে কিছু নাই। বোকার মতো কথা বোলো না।’

অন্য তিতুনি ফিক করে হেসে ফেলল, বলল, ‘বোকাদের সঙ্গে বোকাদের মতো কথা না বললে কেমন করে হবে?’

ঠিক তখন ঘরের দরজায় বড় ফুপু ধাক্কা দিলেন, বললেন, ‘কী হলো? দরজা বন্ধ করে তোরা কী করছিস, বের হয়ে আয়, টেবিলে খাবার দিয়েছি।’

তিতুনি দরজা খুলে বের হয়ে এল, তার হাত ধরে মিলুও বের হয়ে গেল। ঘরের ভেতর টোটন, নাদু আর দিলু। নাদু বলল, ‘টোটন তোমার এই বোনটা খুবই জ্বালাতন করে।’

টোটন বলল, ‘একবার বাসায় নিয়ে নিই তখন টাইট করে ছেড়ে দেব।’

‘বাসাতে নিয়ে না, এইখানেই একবার টাইট করা দরকার। কী সাহস, আমাকে বোকা বলে। আমাদের ক্লাসে সবচেয়ে বেশি বুদ্ধি আমার। গত সপ্তাহেই আমি ফারজানাকে মার খাইয়েছি।’

টোটন জিজ্ঞেস করল, ‘ফারজানা কে?’

‘আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে। হেভি নেকু। আমি নেকু মেয়েদের দুই চোখে দেখতে পারি না।’

টোটন বলল, ‘আমি মেয়েদেরকেই দেখতে পারি না।’

দিলু এক টিমে থাকার জন্য বলল, ‘আমিও।’

নাদু বলল, ‘আজকে খাবার টেবিলে একবার টাইট দেই।’

‘কীভাবে?’

নাদু কয়েক সেকেন্ড মুখ সুচালো করে চিন্তা করল, তারপর বলল, ‘খাবার সময় তিতুনির প্লেটে এক খাবলা লবণ ঢেলে দিই। নাম যেহেতু তিতুনি, একটু তিতা খাবার খেয়ে দেখুক।’

দিলু মাথা নাড়ল, বলল, ‘খেয়ে দেখুক।’

টোটন জিজ্ঞেস করল, ‘কীভাবে লবণ দেবে?’

‘আমার ওপর ছেড়ে দাও, আমি এটার এক্সপার্ট, এর আগেরবার একটা বিয়ের দাওয়াতে করেছিলাম।’

‘কার প্লেটে করেছিলে?’

‘চিনি না, আমার পাশে বসেছিল, বেকুব টাইপের একটা ছেলে।’

‘কীভাবে করো?’

‘খুব সোজা। প্লেটের ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে কিছু একটা নেওয়ার ভান করি, তখন অন্য হাতে তলা দিয়ে লবণটা ঢেলে দিই। এই যে এইভাবে—’ নাদু করে দেখাল এবং পদ্ধতিটা দেখে টোটন মুগ্ধ হলো। নাদুর কাছে তার অনেক কিছু শেখার আছে। নাদু বলল, ‘শুধু একটা জিনিস দরকার, ঠিক পাশে বসা দরকার।’

খাবার টেবিলে কায়দা করে নাদু ‘তিতুনি’র পাশে বসে গেল। অন্য পাশে টোটন, দুই পাশে দুই জন বসেছে। প্লেটে লবণ ঢেলে দেওয়া আজকে কঠিন হওয়ার কথা না।

বড় ফুপু সবার প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছেন, কথা বলতে বলতে সবাই খাচ্ছে। বড় ফুপু খুব ভালো রাঁধতে পারেন, আজকে সবাই আছে বলে অনেক কিছু রেঁধেছেন। আম্মু খেতে খেতে বড় ফুপুকে বললেন, ‘আপা আপনার হাতে জাদু আছে, তা না হলে এত মজার খাবার রাঁধেন কেমন করে।’

বড় ফুপু বললেন, ‘জাদু না ছাই। তাড়াহুড়ো করে কী রেঁধেছি কী হয়েছে কিছুই জানি না।’

আম্মু বললেন, ‘খুব ভালো হয়েছে আপা। অসাধারণ।’

আব্বু বললেন, ‘আসলে আপার কোনো ক্রেডিট নাই। এটা আমাদের বংশের ধারা। আমাদের দাদা নাকি পীর ছিলেন। দোয়া করে দিয়েছিলেন এই বংশের সব মেয়ের হাতে জাদু থাকবে, যেটাই রান্না করবে সেটাই হবে অসাধারণ।’

যখন বড়দের এ রকম কথা চলছে ঠিক তখন নাদু অন্য তিতুনির প্লেটের ওপর বাম হাত দিয়ে আচারের বোতলটা নেওয়ার ভান করতে করতে ডান হাতে ঢেলে নেওয়া এক খাবলা লবণ তিতুনির প্লেটে ঢেলে দিল। নিখুঁত কাজ। নিজের কাজ দেখে নাদু নিজেই মুগ্ধ হয়ে যায়।

তিতুনি প্লেট থেকে তার খাবার নিয়ে মুখে দিল। নাদু দিলু আর টোটন চোখের কোনা দিয়ে তিতুনির দিকে তাকিয়ে আছে, এক মুহূর্তের জন্য অন্য তিতুনির ভুরু একটু কুঁচকে উঠে তারপর আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়, সে তৃপ্তি করে খেতে থাকে। লবণের জন্য খেতে তার কোনো সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হলো না।

একটু অবাক হয়ে টোটন তার খাবার মুখে দিয়েই চমকে উঠল, তার খাবারের মাঝে একগাদা লবণ। যেটুকু মুখে দিয়েছে সেটা বের করতেও পারছে না আবার খেতেও পারছে না, নাদু তিতুনির প্লেটে এক খাবলা লবণ দিতে গিয়ে তার প্লেটে দিয়ে দিয়েছে? কী সর্বনাশ! কেমন করে এটা ঘটল? এখন সে কী করবে? টোটন খাবার মুখে নিয়ে বসে থাকে। লবণের তেতো স্বাদ মুখ থেকে ধীরে ধীরে গলার দিকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে ওয়াক করে বমি করে দেবে।

অন্য তিতুনি তৃপ্তি করে খেতে খেতে টোটনের দিকে তাকাল। বলল, ‘ভাইয়া, তুমি খাচ্ছ না কেন?’

টোটন মুখে খাবার নিয়ে কোনোমতে বলল, ‘খাচ্ছি তো। খাচ্ছি।’ তারপর মুখে যেটা ঢুকিয়েছিল সেটা কোনোমতে কোঁৎ করে গিলে নিল, তার মনে হলো পুরোটা উগরে দেবে।

নাদু একটু অবাক হয়ে একবার তিতুনির দিকে তাকাল। ইতস্তত করে বলল, ‘তিতুনি, খাবার ঠিক আছে?’

অন্য তিতুনি বলল, ‘একেবারে ফার্স্ট ক্লাস। আজকেও আমি রাক্ষসের মতো খাব। এক দিনে মোটা হয়ে যাব।’

টোটন একধরনের আতঙ্ক নিয়ে তার প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে, খাবার মুখে দিচ্ছে না। আম্মু বলল, ‘কী হলো টোটন? খাচ্ছিস না কেন?’

‘কে বলেছে খাচ্ছি না। খাচ্ছি তো?’ বলে সে হাত দিয়ে খাবার নাড়াচাড়া করতে থাকে।

বড় ফুপু বললেন, ‘খাবার মজা লাগছে না?’

টোটন বলল, ‘লাগছে। লাগছে। অনেক মজা।’ তারপর ভয়ে ভয়ে মুখে একটু খাবার নিয়ে মুখ বিকৃত করে বসে থাকে।

নাদু টোটনকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’

টোটন বলল, ‘আমাকে বড় ফুপু বেশি দিয়ে দিয়েছে। তুমি আমার কাছ থেকে একটু নাও।’ বলে নাদু কিছু বলার আগেই নিজের প্লেট থেকে প্রায় পুরোটাই নাদুর প্লেটে ঢেলে দিল। নাদু কিছুক্ষণ অবাক হয়ে একবার টোটনের দিকে আরেকবার নিজের প্লেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর সাবধানে একটু মুখে দিয়ে মুখ বিকৃত করে ফেলল। অন্য তিতুনি যখন খুব তৃপ্তি করে খাওয়া শেষ করল তখন টোটন আর নাদু দুজনই একধরনের আতঙ্ক নিয়ে তাদের প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনের কেউই ধরতে পারল না যে খাবারে যেটুকু তেতো ভাব এসেছে সেটা সাধারণ লবণের তেতো না, সেটা অন্য রকম ভয়ংকর তেতো।

খাওয়া শেষে নাদুর ঘরে টোটনের সঙ্গে নাদুর একটা বড় ধরনের ঝগড়া হয়ে গেল। টোটন বলল, ‘তোমার লবণ দেওয়ার কথা ছিল তিতুনির প্লেটে, আমার প্লেটে কেন দিয়েছ?’

নাদু খানিকক্ষণ মাথা চুলকে বলল, ‘বুঝতে পারলাম না—আমি তো ভেবেছিলাম আমি তিতুনির প্লেটেই দিয়েছি।’

‘না, তুমি দেও নাই। তুমি দিয়েছ আমার প্লেটে—’

নাদু গরম হয়ে বলল, ‘ঠিক আছে আমি নাহয় ভুল করে তোমার প্লেটে দিলাম, তুমি কেন সেটা আমার প্লেটে ঢেলেছ? আমার খাওয়া কেন নষ্ট করেছ?’

‘তুমি আমার খাওয়া নষ্ট করতে পারো আর আমি তোমার খাওয়া নষ্ট করতে পারব না।’

ঝগড়া আরও ডালপালা ছড়িয়ে আরও অগ্রসর হতে পারত কিন্তু ঠিক তখন অন্য তিতুনি আর মিলু ঘরে ঢুকল বলে দুজনে থেমে গেল। টোটন এবং নাদু এই দুজনের কারোরই জানার কোনো উপায় ছিল না তাদের কোনো কিছুই এই তিতুনির কাছে গোপন নেই। সে মানুষের মস্তিষ্কের ভেতর ঢুকে নিউরনের সিনাপ্স কানেকশন ওলটপালট করে দিতে পারে। তার কাছে একটা প্লেটের লবণ অন্য প্লেটে পাঠানো কোনো ব্যাপারই না। সেই লবণকে এক শ গুণ বেশি তেতো করে দেওয়াও তার কাছে পানির মতো সহজ।

চলবে...

আরও পড়ুন