তিতুনি এবং তিতুনি (ষষ্ঠ পর্ব)

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

আসল তিতুনি চুপচাপ গালে হাত দিয়ে জানালার কাছে বসে আছে। পর্দার ফাঁক দিয়ে সে বাইরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। বাইরে অনেক রকম কাজকর্ম চলছে। নানা ধরনের গাড়ি আসছে-যাচ্ছে, গাড়ির ভেতরে কী আছে কে জানে। কেউ যেন সন্দেহ না করে সে জন্য গাড়িগুলো ঠিক তাদের বাসার সামনে রাখছে না, দূরে নিয়ে রাখছে। একসঙ্গে বেশি মানুষ আসে না, একজন-দুজন আসে। তিতুনি বুঝতে পারছে তাদের বাসাটাকে চারদিক থেকে নানা যন্ত্রপাতি দিয়ে ঘিরে ফেলছে। বিদেশি মানুষ দুটোও একবার-দুবার বাসার সামনে থেকে ঘুরে গেছে। যারা তাদের বাসার চারপাশে কাজ করছে তারা কথাবার্তা বলে না, যদি বলতে হয় চাপা স্বরে বলে, তাই ঠিক শুনতে পাচ্ছে না। সে যে বাসার ভেতরে আছে সেটা যেন বাইরের মানুষেরা বুঝতে না পারে সে জন্য তিতুনি খুবই সাবধানে আছে। চলাফেরা করছে খুবই কম, যদিও বা একটু এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে হয়, নিচু হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে যাচ্ছে।

একটু পরে অন্ধকার হয়ে যাবে তখন সে আর আলো জ্বালাতে পারবে না, অন্ধকারে থাকতে হবে। অন্ধকারে কেমন করে কী করবে বুঝতে পারছে না। আগে ভেবেছিল ফ্রিজ থেকে কিছু খাবার বের করে গরম করে খেয়ে ফেলবে। এখন সেটাও করতে পারছে না। সারা দিন শুধু রুটি আর কলা খেয়ে কাটিয়ে দিতে হচ্ছে। দুপুরবেলা খুব সাবধানে তিতুনি দুইটা ডিম সিদ্ধ করে নিয়েছে। রাত্রে একটা ডিম খেয়ে নেবে, ডিমের মাঝে প্রোটিন থাকে, পেটের মাঝে অনেকক্ষণ থাকবে।

ফ্রিজে একটু দুধও আছে। খুব বেশি নেই, তাই একটু বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে খাচ্ছে, যেন শেষ না হয়ে যায়। এমনিতে সে একেবারেই দুধ খেতে চায় না, কেমন জানি গন্ধ গন্ধ লাগে, এখন ভিন্ন কথা! বিপদে পড়লে বাঘে নাকি ঘাস খায়, সে তিতুনি কেন একটু দুধ খেতে পারবে না?

আজ সকালে তার খুব দুশ্চিন্তা ছিল রাত্রিবেলা সে একা একা কেমন করে থাকবে? ভূতের ভয়ে সে নিশ্চয়ই হার্টফেল করে মরেই যাবে। এখন অবশ্যি ভিন্ন কথা—আজ রাতে আর যেটা নিয়েই ভয় থাকুক ভূতের ভয় হবে না। তাদের বাসা ঘিরে এত মানুষ, এত যন্ত্রপাতি, ভূত নিয়ে ভয় পাবার সুযোগ কোথায়? সময় কোথায়?

কিন্তু তার বুকের ভেতর একটা দুশ্চিন্তা খচখচ করছে। এলিয়েন মেয়েটাকে যদি সত্যি ধরে ফেলে তখন কী হবে? মেয়েটাকে কি জোর করে আটকে রাখবে? পুলিশ যে রকম করে রিমান্ডে নেয় এই এলিয়েন মেয়েটাকেও কি রিমান্ডে নেবে? অত্যাচার করবে? কেটেকুটে ফেলবে? মেয়েটা যে দেখতে হুবহু তার মতো সেটা নিয়ে কি কোনো সমস্যা হবে?

তিতুনি ভেবে ভেবে কোনো কূলকিনারা পায় না। এলিয়েন মেয়েটার সাথে একটু কথা বলতে পারলে হতো কিন্তু সে তো ঢাকায় বসে আছে। সেখানে কী যন্ত্রণা পাকাচ্ছে কে জানে! বড় ফুপুর মতো সুইট মানুষ দুনিয়াতে আর একজনও আছে কি না সন্দেহ কিন্তু তার ছেলেমেয়েগুলো কেমন যেন! টোটনের সঙ্গে খাতির কিন্তু তাকে দেখতে পারে না। এলিয়েন তিতুনির সাথে কোনো কিছু নিয়ে বড় ফুপুর ছেলেমেয়ের লেগে যাবে না তো?

ঢাকায় বড় ফুপুর ফ্ল্যাটটা বড় রাস্তার ওপরে, ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখা যায় রাস্তা দিয়ে বাস গাড়ি টেম্পো যাচ্ছে এবং আসছে। অন্য তিতুনি প্রায় পুরো সময়টাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাস গাড়ি টেম্পো আর মানুষ দেখল। রাস্তার দুপাশে ফুটপাত বেশির ভাগই নানা ধরনের হকারেরা দখল করে রেখেছে, যেটুকু ফাঁকা আছে সেখান দিয়ে পিলপিল করে মানুষ যাচ্ছে। প্রত্যেক মানুষেরই নিজের একটা জীবন আছে এবং সবাই নিজের মতো কিছু একটা ভাবতে ভাবতে যাচ্ছে আসছে, সেটা অন্য তিতুনি খুবই মনোযোগ দিয়ে দেখল। সন্ধেবেলা যখন একটা একটা করে বাতি জ্বলে উঠল, নিওন আলো দিয়ে রাস্তার দুই পাশ আলো ঝলমল করতে লাগল সেটাও অন্য তিতুনি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল। তাকে এ রকম গভীর মনোযোগ দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে একসময় মিলু জিজ্ঞেস করল, ‘তিতুনি আপু, তুমি কী দেখ?’

অন্য তিতুনি বলল, ‘মানুষ দেখি’।

‘তুমি আগে মানুষ দেখ নাই?’

অন্য তিতুনি ফিক করে হেসে ফেলল, বলল, ‘দেখব না কেন, দেখেছি। কিন্তু এই ওপর থেকে পিলপিল করে হাজার হাজার মানুষ হেঁটে যাচ্ছে দেখতে খুব ভালো লাগে।’

মিলু কিছুক্ষণ এই খুব ভালো লাগার দৃশ্যটা দেখার চেষ্টা করল কিন্তু কিছুক্ষণেই তার ধৈর্য ফুরিয়ে গেল। মানুষদের দেখার কী আছে কে জানে?

সন্ধেবেলা আম্মু বড় ফুপুকে নিয়ে একটু কেনাকাটা করতে বের হলেন। আম্মু যখনই ঢাকা আসেন তখনই একটু কেনাকাটা করে নিয়ে যান। অন্য তিতুনিকে শুধু জিজ্ঞেস করার জন্য বললেন, ‘তিতুনি, যাবি আমাদের সাথে?’

অন্য-তিতুনি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেল। আম্মু বেশ অবাক হলেন, কারণ তিতুনি কখনোই ঢাকা শহরে ভিড় ঠেলে দোকানপাটে যেতে চায় না। মিলু ঠিক তার উল্টো। সে সব সময়ই বাইরে যেতে চায়, তাই সেও তাদের সাথে রওনা হলো। বড় ফুপু আর আম্মুর সাথে অন্য তিতুনি আর মিলু বের হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে নাদুর ঘরে নাদু দিলু আর টোটন মিলে একটা মিটিং শুরু করে দেয়। মিটিং না বলে এটাকে অবশ্যি ষড়যন্ত্র বলাই ভালো, কারণ মিটিংয়ের বিষয়বস্তু হচ্ছে কেমন করে তিতুনিকে একটা সত্যিকারের শিক্ষা দেওয়া যায়, যেন সে সারা জীবনের জন্য সাইজ হয়ে যায়। নাদু বলল, ‘টোটন তোমার বোন মানুষটা খুবই ডেঞ্জারাস।’

টোটন মাথা নাড়ল, বলল, ‘আমি জানি।’

‘আমি তার প্লেটে এক খাবলা লবণ দিয়েছি, সে নিশ্চয়ই হাত দিয়ে সেটা ধরে তোমার প্লেটে দিয়ে দিয়েছে।’ টোটন মাথা নাড়ল। নাদু বলল, ‘তা না হলে এরপর থেকে শুধু আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে কেন?’

দিলু মাথা নাড়ল, সায় দিয়ে বলল, ‘হাসে কেন?’

নাদু বলল, ‘আমাকে বলে বোকা।’

দিলু বলল, ‘আমাকে বলে নাদুসনুদুস মোটাসোটা গোলগাল ফুটবল।’

টোটন বলল, ‘তোমাদের সাথে মাত্র এক দিন থেকেছে, এর মাঝে তিতুনি কত কী বলে ফেলেছে। আমার সাথে সারাক্ষণ থাকে, চিন্তা করে দেখ আমার কী অবস্থা।’

নাদু বলল, ‘কাজেই তাকে ঠিকভাবে সাইজ করা দরকার।’

দিলু বলল, ‘চুলের মাঝে চিউয়িংগাম লাগিয়ে দিই!’

নাদু মাথা নাড়ল, বলল, ‘না। এই সব করলে আম্মু বকুনি দেবে। আম্মু আব্বু যেন সন্দেহ না করে।’

‘তাহলে কী করব?’

‘এমন একটা কাজ করব যেটা দিয়ে সারা জীবন তিতুনিকে লজ্জা দেওয়া যায়।’

টোটনের চোখ চকচক করে উঠল, ‘কী কাজ?’

‘আগেরবার এটা করেছিলাম মিতুলের ওপর। এখন তাকে আর কেউ মিতুলি ডাকে না। সবাই ডাকে হিসুনি।’

‘হিসুনি?’

‘হ্যাঁ’ নাদুর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ‘মিতুল হচ্ছে আমার চাচাতো বোন। মাত্র ছয়-সাত বছর বয়স কিন্তু হেব্বি যন্ত্রণা। সারাক্ষণ কথা বলে, এক সেকেন্ড মুখ বন্ধ করে না। ধমক দিলে শোনে না উল্টা ধমক দেয়। তখন ঠিক করলাম তারে সাইজ করতে হবে। কী করলাম জানো?’

টোটন আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী?’

নাদু হাসি হাসি মুখে বলল, ‘জন্মের মতো সাইজ করে দিলাম। কী দিয়ে করলাম জান?’

‘কী দিয়ে?’

‘এক গ্লাস পানি।’

টোটন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এক গ্লাস পানি?’

‘হ্যাঁ। মিতুল যখন ঘুমিয়েছে বিছানায়, তার নিচে এক গ্লাস পানি ঢেলে দিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে সে বেকুব হয়ে গেল—ভাবল সে বিছানায় হিসু করে দিয়েছে।’

নাদুর বুদ্ধি দেখে টোটন চমত্কৃত হয়ে গেল। নাদু দুলে দুলে হাসতে হাসতে বলল, ‘মিতুল সকালে ঘুম থেকে উঠে লজ্জায় টমেটোর মতো লাল হয়ে গেল। কারও সামনে মুখ দেখাতে পারে না। আমরা কী ছাড়ি নাকি? টিটকারি করতে করতে মিতুলের বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দিলাম। তাকে নিয়ে একটা কবিতা বানালাম,

মিতুল মিতুল হিসুনি

এমন কাম আর করবানি?

তারপর তার পিছে পিছে এই কবিতা বলতে লাগলাম। মিতুল কেন্দে কেটে একাকার। তার নামই হয়ে গেল হিসুনি। হিস্যু থেকে হিসুনি। সেই যে আমাদের বাসা থেকে গিয়েছে আর কোনো দিন আসে নাই।’

টোটন আনন্দে হাততালি দিয়ে বলল, ‘তোমার কী বুদ্ধি। ফ্যান্টাস্টিক!’ তারপর বলল, ‘আমরা তিতুনির ওপরেও এটা করতে পারি না?’

নাদু বলল, ‘একশ বার!’

উত্তেজনায় টোটনের চোখ চকচক করতে থাকে, ‘তিতুনির বেলা কাজটা আরও সোজা হবে। গাধাটা যখন ঘুমায় মড়ার মতো ঘুমায়। কিছু টের পাবে না।’

নাদু গম্ভীর হয়ে বলল, ‘একেবারে ঠান্ডা পানি না নিয়ে পানিটা একটু গরম করে নিতে হবে, শরীরের সমান টেম্পারেচার, তাহলে পানি ঢালার সময়ে টের পাবে না।’

টোটন নাদুর কথায় একেবার মুগ্ধ হয়ে গেল, আবার বলল, ‘তোমার কী বুদ্ধি, নাদু!’

দিলু মাথা নাড়ল, বলল, ‘হ্যাঁ। ভাইয়ার মাথায় অনেক বুদ্ধি।’

‘বুদ্ধির তোমরা কী দেখেছ। আরও দেখবে।

দিলু বলল, ‘আমরা তিতুনিকে নিয়ে কবিতা বানাব না?’

নাদু বলল, ‘কবিতা তো বানাতেই হবে। কবিতা ছাড়া কি আর এই প্রজেক্ট শেষ হয় নাকি।’

টোটন চকচকে চোখে বলল, ‘তিতুনিকে নিয়ে কবিতা বানানো আরও সোজা হবে—আমরা বলতে পারি

‘তিতুনি রে তিতুনি
তুই হলি হিসুনি—’
নাদু বলল, ‘কিংবা,
হিস্যু হিস্যু হিসুনি
তিতা তিতা তিতুনি!’

দিলু আনন্দে হাততালি দিয়ে দাঁত বের করে হাসতে লাগল। অনেক দিন এ রকম মজা হয়নি।

আম্মু আর বড় ফুপু মিলু আর অন্য তিতুনিকে নিয়ে ফিরে এলেন ঘণ্টা দুয়েক পরে। মিলু একটা নতুন পুতুল কিনে এনেছে। সেটা নিয়ে তার উত্তেজনার শেষ নেই। ফুপাও প্রায় একই সময় অফিস থেকে ফিরলেন। ফুপা ব্যাংকে চাকরি করেন। এই সময়ে তাঁর কাজের চাপ অনেক বেড়ে যায়, ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। বড় ফুপুর তুলনায় ফুপা একটু গম্ভীর। ছেলেমেয়েরা মনে হয় তাঁকে একটু ভয়ই পায়। টোটনের খুব ইচ্ছা ছিল মোড়ের ফাস্টফুডের দোকান থেকে ফ্রায়েড চিকেন কিনে খাবে কিন্তু বড় ফুপু এত কিছু রান্না করেছেন যে সাহস করে সেটা আর বলতে পারল না। খাবার টেবিলে আব্বু আর ফুপা পলিটিকস নিয়ে আলোচনা করতে থাকলেন, আম্মু আর বড় ফুপু পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে আলোচনা করতে থাকলেন, নাদু দিলু আর টোটন কম্পিউটার গেম নিয়ে আলোচনা করতে করতে চোখের কোনা দিয়ে তিতুনিকে লক্ষ করতে লাগল। আজ রাতে এক গ্লাস পানি দিয়ে কী ম্যাজিক করে ফেলা হবে সেটা চিন্তা করেই তাদের মন আনন্দে ভরে যাচ্ছিল। মিলু তার ক্লাসের পাজি ছেলেদের নানা রকম কাজকর্মের বর্ণনা তিতুনিকে শুনিয়ে যাচ্ছিল। তিতুনি খুব মনোযোগ দিয়ে সেগুলো শোনার ভান করছিল, যদিও আসলে তার আলাদা করে কিছুই শোনার দরকার নেই, কার মনের ভেতর কী আছে সেগুলো সে খুব ভালো করে জানে।

খাওয়ার পর তিতুনিকে মিলুর সঙ্গে তার নতুন কিনে আনা পুতুলটা নিয়ে খেলতে হলো। নাদু, দিলু আর টোটন নানা রকম ভয়ংকর কম্পিউটার গেম খেলে সময় কাটিয়ে দিল। রাত একটু গভীর হওয়ার পর বড় ফুপু আর আম্মু সবাইকে ঘুমাতে পাঠিয়ে দিলেন। মিলুর ঘরে তার বিছানায় মিলুর সঙ্গে তিতুনি। নাদুর ঘরে মেঝেতে তোষক পেতে আড়াআড়িভাবে নাদু, দিলু আর টোটনের শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ঠিক ঘুমানোর আগে হঠাৎ নাদু আবিষ্কার করে তার খুবই পানি তৃষ্ণা পেয়েছে। পরপর দুই গ্লাস পানি খাবার পরও তৃষ্ণা যায় না, তিন নম্বর গ্লাস খাবার পর তার তৃষ্ণা মিটল। নাদুকে এভাবে পানি খেতে দেখে টোটনের তৃষ্ণা পেয়ে গেল আর টোটনকে পানি খেতে দেখে কেমন করে জানি দিলুরও তৃষ্ণা পেয়ে গেল। তিনজন যখন শুতে এসেছে তখন তিনজনেরই পানি খেয়ে একটু আইঢাই অবস্থা। বিছানায় শুয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে তারা ঘুমিয়ে গেল।

ঘুমানোর ঠিক আগে তিন গ্লাস পানি খাওয়ার কারণে গভীর রাতে তলপেটে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করে নাদুর ঘুম ভেঙে যায়। অন্ধকার ঘরে তার পাশে দিলু এবং দিলুর পাশে টোটন মড়ার মতো ঘুমাচ্ছে। নাদু মশারি তুলে বের হয়ে এল। আচ্ছা অন্ধকারে বাথরুমে গিয়ে নাদু বাথরুমের বাতিটা জ্বালিয়ে কমোডের দিকে এগিয়ে গেল। হিসু করায় মনে হয় একধরনের আনন্দ আছে, বিশেষ করে যখন অনেক বেশি হিসুর দরকার পড়ে তখন মনে হয় আনন্দটাও অনেক বেশি। তলপেটের চাপ কমে আসার সাথে সাথে নাদুর একধরনের আরাম হতে থাকে, সে মনে হয় চোখ বন্ধ করে আরামের একধরনের শব্দও করে ফেলল। তখন হঠাৎ তার বিচিত্র একটা অনুভূতি হলো, তার মনে হলো তার শরীরের নিচে একধরনের কুসুম কুসুম গরমের প্রবাহ হচ্ছে এবং ঠিক তখন দ্বিতীয়বার নাদুর ঘুম ভেঙে গেল। নাদুর এক মুহূর্ত সময় লাগল বুঝতে যে এবার সত্যি সত্যি ঘুম ভেঙেছে, এর আগেরটা ছিল ঘুম ভাঙার স্বপ্ন। নাদুর সারা শরীর দিয়ে আতঙ্কের একটা হিম শীতল প্রবাহ বয়ে যায়, সে চৌদ্দ বছরের একটা দামড়া ছেলে বিছানায় হিসু করে দিয়েছে। প্রচণ্ড আতঙ্কে সে পাথরের মতো জমে গেল, এটা কীভাবে সম্ভব? এখন কী হবে? সে তার পাশে তাকাল, দিলু ঘুমাচ্ছে। ঘুমাতে ঘুমাতে ছটফট করে কিছু একটা বলল তারপর হঠাৎ উঠে বসে পড়ল। দিলু এদিক-সেদিক তাকায়। তারপর নাদুকে ধাক্কা দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘ভাইয়া।’

নাদু জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’

‘আমি—আমি—’ বলে ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে কাঁদতে শুরু করে।

‘আমি কী?’

দিলু বলল, ‘আমি বিছানায় হিসু করে দিয়েছি।’

‘তুইও?’ নাদু দিলুর কথা শুনে বিরক্ত না হয়ে কেমন যেন খুশি হয়ে উঠল।

দিলু কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তোমার জন্য।’

‘আমার জন্য?’

‘হ্যাঁ। আমি স্বপ্ন দেখলাম। তুমি আমাকে ধরে বাথরুমে নিয়ে বললে, কর হিসু কর, আর আমি হিসু করে দিয়েছি।’

নাদু বলল, ‘কাঁদিস না। আমারও বিছানায় হিসু হয়ে গেছে।’

দিলু মুহূর্তে কাঁদা বন্ধ করে বলল, ‘তোমারও?’

নাদু বলল, ‘হ্যাঁ। আমারও।’

গভীর রাতে দুই ভাইয়ের কথা শুনে টোটনের ঘুম ভেঙে গেছে। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আমারও।’

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

তখন তিনজন বিছানায় বসে অন্ধকারে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে থাকে এটা কী হলো? সকালে তারা বাসার সবার সামনে মুখ দেখাবে কেমন করে? যেদিন তারা তিনজন মিলে ঠিক করেছে তিতুনিকে একটা শিক্ষা দেবে, সেদিন উল্টো তাদের তিনজনের একটা উল্টো শিক্ষা হয়ে গেল? এর থেকে বড় হৃদয়বিদারক ঘটনা আর কী হতে পারে? এ রকম কাকতালীয় ঘটনা কি আগে কখনো ঘটেছে? ভবিষ্যতে কখনো ঘটবে? তিতুনি যখন সকাল বেলা এটা আবিষ্কার করবে তখন আত্মহত্যা করা ছাড়া তাদের আর কি কোনো গতি আছে?

ভোরবেলা ব্যাপারটা নিয়ে বাসায় ছোটখাটো একটা উত্তেজনা হলো, তিনজন শুনল মিলু ছুটে গিয়ে তিতুনিকে খবরটা দিচ্ছে।

‘তিতুনি আপু, কী হয়েছে জান?’

‘কী হয়েছে?’

‘ভাইয়া, ছোট ভাইয়া আর টোটন ভাইয়া একসাথে বিছানায় পিশাব করে দিয়েছে! গন্ধে ঘরে যাওয়া যায় না।’

তিনজনই এই সময়ে তিতুনির গলা থেকে একটা আনন্দধ্বনি শোনার অপেক্ষা করছিল কিন্তু সেটা শুনল না, উল্টো শুনল তিতুনি বলছে, ‘শ-স-স-স! মিলু এটা নিয়ে কোনো কথা বল না। ইচ্ছে করে তো করেনি—হঠাৎ হয়ে গেছে, তারা তো বড় হয়ে গেছে, কিছু একটা নিশ্চয়ই কারণ আছে। হয়তো ঘুমানোর আগে বেশি পানি খেয়েছিল। তাদের কোনো দোষ নেই।’

‘দোষ নেই?’

‘না, ভান করো তুমি কিছু জান না। আমিও কিছু জানি না। মানুষকে কখনো লজ্জা দিতে হয় না।’

খুবই অনিচ্ছার সাথে মিলু বলল, ‘ঠিক আছে।’

তিনজন ঘরে বসে একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকায়। একজন যদি আরেকজনকে লজ্জাই না দেবে তাহলে কী দেবে? কী বলে তিতুনি?

ঢাকা থেকে বাসায় ফিরে আসার পুরো সময়টা টোটন কোনো কথা বলল না। আব্বু এবার আর মাইক্রোবাস ভাড়া করার সাহস পেলেন না, সবাইকে নিয়ে বাসে চলে এসেছেন। বাস থেকে নেমে রিকশা করে বাসার কাছাকাছি এসে একেবারে হকচকিয়ে গেলেন। বাসার রাস্তার কাছাকাছি পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে, কাউকে যেতে দিচ্ছে না। অস্ত্র হাতে একজন পুলিশ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘এই রাস্তায় যেতে পারবেন না। অন্য রাস্তায় যান।’

আব্বু বললেন, ‘অন্য রাস্তায় যাব মানে? আমার বাসা এই রাস্তায়, আমি অন্য রাস্তায় গিয়ে কী করব? কী হয়েছে এই রাস্তায়?’

‘আমি জানি না।’

‘কে জানে?’

পুলিশটি এবার অস্ত্র ঝাঁকিয়ে বলল, ‘আমি সেটাও জানি না।’

‘আমরা তাহলে কী করব? নিজের বাসায় যেতে পারব না?’

‘সেটা আমি জানি না। আমার ওপর অর্ডার কাউকে যেতে দেওয়া যাবে না।’

আম্মু এবার রিকশা থেকে নেমে এসে কড়া গলায় বললেন, ‘কে আপনাকে অর্ডার দিয়েছে তাকে ডেকে আনেন। আমরা কথা বলব।’

আম্মুর তেজি গলায় পুলিশ এতই থতমত খেয়ে গেল যে মাথা চুলকে বলল, ‘আপনারা দাঁড়ান স্যারকে ডেকে আনি।’

কিছুক্ষণের মাঝেই একজন সুদর্শন পুলিশ অফিসার এসে ভুরু কুঁচকে আব্বুকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোনো সমস্যা?’

আব্বু মাথা নাড়লেন, ‘জি, সমস্যা। আমি আমার বাসায় যেতে পারছি না।’

‘আপনার বাসা কোথায়?’

‘এই রাস্তায়, এখান থেকে চারটা বাসার পর।’

পুলিশ অফিসার কেমন যেন ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল। বলল, ‘দোতলা বাসাটা? সামনে নারকেলগাছ?’

‘জি।’

পুলিশ অফিসার বলল, ‘ও মাই গড!’

আম্মু ভয় পাওয়া গলায় বললেন ‘কী হয়েছে?’

পুলিশ অফিসার বলল, ‘আমরা কেউ জানি না কী হয়েছে ওই বাসায়। টপ সিক্রেট। আমাদের ওপর দায়িত্ব প্রটেকশন দেওয়া। আপনাদের জন্য কোর টিম অপেক্ষা করছে।’

‘কোথায়?’

‘আপনাদের বাসার সামনে একটা ট্রেইলারে কন্ট্রোল সেন্টার তৈরি হয়েছে। সেখানে চলেন আমাদের সাথে।’

আম্মু বললেন, ‘আমাদের জিনিসপত্র?’

‘আমরা দেখব।’ তারপর যে পুলিশটা তাদের আটকানোর চেষ্টা করেছিল তাকে বলল, ‘এই মালপত্রগুলো দেখে রাখো। খবরদার যেন কিছু না হয়।’

‘হবে না স্যার।’

ঠিক তারা যখন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করবে তখন অন্য তিতুনি আব্বুর হাত ধরে বলল, ‘আব্বু।’

‘কী হলো?’

‘রিকশা ভাড়া!’

‘ও। তাই তো।’ তাড়াহুড়াতে রিকশা ভাড়ার কথা ভুলেই যাচ্ছিলেন। বড় একটা নোট দিয়ে ভাংতির জন্য আর অপেক্ষা করলেন না, পুলিশ অফিসারের সাথে হাঁটতে শুরু করলেন।

বাসার সামনে যাওয়ার আগে আরও কয়েকটা ব্যারিকেড পার হতে হলো। সবার শেষে দুজন মানুষ দাঁড়িয়েছিল, তারা পুলিশ অফিসারটিকে থামাল। পুলিশ অফিসার বলল, ‘এই বাসাটিতে এই ফ্যামিলি থাকে।’

একজন মানুষ বলল, ‘ঠিক আছে, আমি দেখছি।’ তারপর চারজনকে নিয়ে তারা ট্রেইলারের ভেতরে ঢুকে গেল।

আব্বু আম্মু বা অন্য কেউ এর আগে কখনো এ রকম ট্রেইলারে ঢোকেননি। ভেতরে ঢুকে অবাক হয়ে গেলেন। দেখতে একটা বাসার মতো কিন্তু এই বাসার প্রত্যেকটা স্কয়ার ইঞ্চি যন্ত্রপাতি দিয়ে ঠাসা। যন্ত্রপাতির নিজস্ব একটা শব্দ থাকে, সেই শব্দের জন্য একটা বিচিত্র চাপা শব্দ। ভেতরে বসার বিশেষ জায়গা নেই। এর মাঝে দুজন বিদেশিসহ কয়েকজন বসে ছিল, আব্বু-আম্মুকে বসানোর জন্য দুজন উঠে জায়গা করে দিল।

আব্বু আম্মু কিংবা টোটন কিছুই বুঝতে পারছিল না। শুধু অন্য তিতুনি পুরোটা জানে, তাকে ধরার জন্য এই আয়োজন এবং সে নিজেই এখন তাদের সামনে বসে আছে।

আব্বু বললেন, ‘এখানে কী হচ্ছে আমাদের একটু বলবেন?’

জিনস এবং টি-শার্ট পরা মানুষটি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তখন টিশটাশ মেয়েটা বলল, ‘দাঁড়াও। এখানে দুজন বাচ্চা আছে তাদের সামনে কথা বলা কি ঠিক হবে?’

জিনস-টি-শার্ট পরা ছেলেটা বলল, ‘আমার মনে হয় পুরো ফ্যামিলির সামনেই কথা বলা উচিত। ফ্যামিলির বড় মানুষদের থেকে হয়তো ছোটরাই আমাদের বেশি ইনপুট দিতে পারবে।’

টিশটাশ মেয়েটা তখন বিদেশি দুজনের সাথে কথা বলল, তারা আবার নিজেরা নিজেরা গুজগুজ করে কিছুক্ষণ কথা বলল, তারপর মাথা নেড়ে সায় দিল। তখন জিনস আর টি-শার্ট পরা ছেলেটা কথা বলতে শুরু করল। গলা পরিষ্কার করে বলল, ‘আমি শামীম। ডক্টর শামীম। মহাকাশবিজ্ঞানে আমার পিএইচডি আছে। আমি আইএসএএলে কাজ করি। আইএসএএল হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল সার্চ ফর এলিয়েন লাইফ। আমাদের টিম লোকাল সাপোর্ট নিয়ে এখন আপনাদের বাসাটাকে ঘিরে রেখেছে। মডার্ন টেকনোলজির সর্বোচ্চ ইলেকট্রনিকস সার্ভালেন্স দিয়ে এই মুহূর্তে আপনাদের বাসাটা ট্র্যাক করা হচ্ছে।’

আব্বু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন?’

‘আমরা সন্দেহ করছি আপনাদের বাসায় এই মুহূর্তে একটা এলিয়েন লাইফ ফর্ম ঘুরে বেড়াচ্ছে।’

আব্বু আম্মু এবং টোটন একসাথে চিৎকার করে উঠল এবং চিৎকার করতেই থাকল। শুধু অন্য তিতুনি চুপচাপ বসে থেকে সবার মুখভঙ্গি একধরনের কৌতূহল নিয়ে দেখতে থাকল।

জিনস-টি-শার্ট পরা শামীম তিতুনির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘খুকি—’

‘আমার নাম তিতুনি।’

‘তিতুনি, তুমি বুঝতে পেরেছ আমরা কী বলেছি? আমরা বলেছি যে তোমাদের বাসায়—’

অন্য তিতুনি বলল, ‘আপনারা কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি। আপনারা বলেছেন আমাদের বাসায় একটা এলিয়েন আছে।’

টিশটাশ মেয়েটা বলল, ‘খবরটা শুনে তুমি একটুও অবাক হলে না তাই ভেবেছিলাম তুমি বুঝতে পারোনি।’

অন্য তিতুনি বলল, ‘আমি অবাক হই নাই, কারণ আমি এটা আগে থেকে জানি। এই এলিয়েন তিন দিন থেকে আমার সাথে থাকে।’

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

ঘরের ভেতরে একটা বোমা ফেললেও কেউ এত অবাক হতো না। একসাথে সবাই চিৎকার করে উঠল। বিদেশি দুজন তিতুনির কথা বুঝতে পারেনি বলে তাদের কথাটা অনুবাদ করে দিতে হলো, তখন তারা দুজন সবার চাইতে জোরে চিৎকার করে উঠল। সবাই তিতুনিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে যায়। সবাই একসাথে কথা বলতে থাকে, সবাই কিছু না কিছু প্রশ্ন করে। বিদেশি দুজনও গলার ভেতর থেকে ঘরঘর ধরনের একটা শব্দ করে অন্য তিতুনিকে কী যেন জিজ্ঞেস করল। অন্য তিতুনি কারও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আম্মুর দিকে তাকাল, আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই কি বলছিস এসব?’

অন্য তিতুনি বলল, ‘সত্যি আম্মু। খোদার কসম।’

আবার সবাই প্রশ্ন করতে থাকে। অন্য তিতুনি কারও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আবার আম্মুর দিকে তাকাল, আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত বড় একটা ব্যাপার আমাদের কিছু বললি না?’

অন্য তিতুনি মাথা চুলকে বলল, ‘আমি ভাবছিলাম তোমাদের বলব, কিন্তু তোমরা ব্যাপারটা কীভাবে নাও। কী মনে করো বুঝতে পারিনি।’

‘কী মনে করি মানে? মনে করার কী আছে?’

অন্য তিতুনি বলল, ‘আসলে হয়েছে কি জান? এই এলিয়েনটা বাসার পেছনে ল্যান্ড করেছে। মনে আছে সেদিন ভূমিকম্পের মতো হলো? আমি তখন এটাকে ল্যান্ড করতে দেখেছি। আমাদের বাসার পেছনের জঙ্গলে ল্যান্ড করেছে, আমি ভেবেছিলাম উল্কা। গিয়ে দেখি মাটিতে একটা গর্ত, আমি যখন গর্তটার দিকে তাকিয়েছিলাম তখন গর্তের ভেতর থেকে এলিয়েনটা বের হয়ে এল।’

সবাই একটা আর্তচিৎকার করে উঠল। টোটন জিজ্ঞেস করল, ‘তুই ভয় পাসনি?’

অন্য তিতুনি বলল, ‘নাহ্।’

‘কেন ভয় পাসনি।’

‘আমি ভয় পাইনি কারণ এলিয়েনটা দেখতে আমার মতো।’

সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠল, ‘তোমার মতো?’

‘হ্যাঁ। হুবহু আমার মতো। দেখতে আমার মতো, কথাবার্তা, ভাবভঙ্গি সবকিছু আমার মতো। প্রথমে আমি একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম কিন্তু আস্তে আস্তে তার সাথে একটু খাতির হলো। তখন তার জন্য একটু মায়া হলো, আমি আমার ঘরে লুকিয়ে রেখেছি।’

টোটন তখন চিৎকার করে বলল, ‘মনে আছে আব্বু, আম্মু? আমি তিতুনির ঘরে আরেকটা তিতুনি দেখেছিলাম? মনে আছে? তার মানে আমি এলিয়েনটাকে দেখেছিলাম!’

অন্য তিতুনি মাথা নাড়ল, বলল, ‘হ্যাঁ। যখন তোমরা সবাই ভেতরে খুঁজতে গেছ তখন এলিয়েনটা সিলিং ফ্যানের পাখাটার ওপর বসেছিল, সে জন্য কেউ খুঁজে পায়নি।’

বিদেশি দুজন যেহেতু অন্য তিতুনির কথা বুঝতে পারছিল না তাই তাকে সব কথা অনুবাদ করে শোনানো হাচ্ছিল, তারা টিশটাশ মেয়েটিকে দিয়ে অনেক রকম প্রশ্ন করে যাচ্ছিল কিন্তু অন্য তিতুনি কথাবার্তা বলছিল আম্মু আব্বু আর টোটনের সাথে।

আম্মু বললেন, ‘তার মানে মাঝরাতে যে ফ্রিজ খুলে খাচ্ছিল সেটি এলিয়েন?’

অন্য তিতুনি মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ, আম্মু। ঠিক আমার মতো হয়েছে বলে তার আমার মতো খিদে পায়!’

আম্মু বললেন, ‘ওমা! সে তো একেবারে তোর মতো। আসলে তোর মতো না, আসলে তুই।’

‘হ্যাঁ, মা! আরেকজন আমি।’

‘তুই আমাকে একবার বললি না? বেচারি কোথা থেকে এসে একা একা এই পৃথিবীতে কত না জানি মন খারাপ করেছে! পৃথিবীর মানুষ নিয়ে একটা ভুল ধারণা নিয়ে যাবে না? যে এখানে কারও ভেতরে কোনো মায়া নেই?’

বিদেশি দুজন এবং তার সাথে সাথে তাদের টিমের সবাই এতক্ষণে একেবারে অধৈর্য হয়ে উঠেছিল, এবার রীতিমতো জোর করে তারা অন্য তিতুনির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল। জিনস-টি-শার্ট পরা শামীম বেশ গলা উঁচিয়ে বলল, ‘তিতুনি, তুমি আগে আমাদের কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দাও।’

অন্য তিতুনি ঘুরে এবার তার দিকে তাকাল, বলল, ‘কী প্রশ্ন?’

শামীম কঠিন মুখে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি ঠিক ঠিক বলছ যে এলিয়েনটা দেখতে একেবারে হুবহু তোমার মতো?’

অন্য তিতুনির একটু হাসি পেয়ে গেল, বলল, ‘আমি এইমাত্র আমার আম্মুকে সেটা বলেছি, আপনি শুনেননি?’

শামীম একটু থতমত খেয়ে বলল, ‘হ্যাঁ শুনেছি। কিন্তু বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই নিশ্চিত হতে চাচ্ছি।’

টিশটাশ মেয়েটা বলল, ‘আমি ডক্টর নাহার। আমি ইন্টেলিজেন্ট লাইফ ফর্মের বিহেভিয়ার নিয়ে কাজ করি। আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।’

অন্য তিতুনি বলল, ‘বলেন।’

‘তুমি দাবি করছ এলিয়েন লাইফ ফর্মটা দেখতে হুবহু তোমার মতো। সেটার ব্যবহার, কথাবার্তা, অর্থাৎ বুদ্ধিমত্তাও কি তোমার মতো?’

‘হ্যাঁ, আমার মতো।’

শামীম বলল, ‘এটা খুবই ইম্পরট্যান্ট। এলিয়েন সায়েন্সের অনেক বড় একটা থিসিস হচ্ছে যদি তারা পৃথিবীতে এসে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায় তাহলে তারা মানুষের ফর্ম নেবে। তোমার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে সেটা কনফার্ম হবে।’

চাঁচাছোলা মাথার বিদেশিটা কী একটা বলল, টিশটাশ নাহার সেটা তিতুনিকে জিজ্ঞেস করল, বলল, ‘এলিয়েন এক্সপেডিশানের ডিরেক্টর প্রফেসর রিক গার্নার জানতে চাইছেন এই এলিয়েনের কি কোনো বাড়তি ক্ষমতা আছে?’

অন্য তিতুনি বলল, ‘মনে হয় আছে।’

‘কী রকম ক্ষমতা?’

‘আমার সঙ্গে যখন থাকে তখন তো আর ক্ষমতা দেখাতে হয় না। কিন্তু মনে করেন হঠাৎ করে আম্মু ঘরে ঢুকে গেলে সে এত তাড়াতাড়ি সরে যায় যে আম্মু দেখতে পান না। কিংবা মনে করেন রাতে যখন বাসায় আসে তখন দোতলার জানালা দিয়ে শিক বাঁকা করে ঢুকে যায়।’

ন্যাড়া মাথা গার্নার আবার কিছু একটা বলল, ড. নাহার আবার অন্য তিতুনিকে বলল, ‘এটা তো শারীরিক ক্ষমতা। মানসিক ক্ষমতা কী আছে?’

অন্য তিতুনি বলল, ‘নিশ্চয়ই আছে। সে আমার মতো কথা বলে, চিন্তা করে। মানসিক ক্ষমতা না থাকলে কেমন করে সেটা সম্ভব?’

ন্যাড়া মাথা বিদেশি তখন পাকা চুল বিদেশির সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গুজগুজ ফুসফুস করে কথা বলল। তারপর নাহার আর শামীমের সঙ্গে কথা বলল। নাহার আর শামীম যখন অন্য তিতুনির সঙ্গে কথা বলতে এল অন্য তিতুনি তখন হাত-পা নেড়ে আব্বু আম্মু আর টোটনের সঙ্গে এলিয়েনের কাজকর্মের একই বর্ণনা দিচ্ছিল। শামীম আর নাহার গল্পটা শেষ করার সময় দিল, তারপর বলল, ‘তিতুনি আমরা কি তোমার সঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারি?’

অন্য তিতুনি বলল, ‘জি বলেন।’

নাহার বলল, ‘আমরা, পৃথিবীর মানুষেরা এখন একটা যুগান্তকারী মুহূর্তের সামনে আছি। এই প্রথমবার পৃথিবীর মানুষ একটা এলিয়েনের সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ পেয়েছে। একটা এলিয়েনের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করা উচিত সেগুলো নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, অনেক আলোচনা হয়েছে কিন্তু কেউ সেটা সঠিকভাবে জানে না। কিন্তু আমরা অসম্ভব সৌভাগ্যবান যে তোমার সাথে একজন এলিয়েনের যোগাযোগ হয়েছে এবং তুমি যদি আমাদের সাহায্য করো তাহলে পৃথিবীর মানুষেরা প্রথমবার একটা এলিয়েনের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে। এখন তিতুনি, তুমি কি আমাদের সাহায্যটুকু করবে?’

‘কী রকম সাহায্য?’

এবার শামীম বলল, ‘মনে করো এলিয়েনটাকে রাজি করিয়ে তুমি কি তাকে এই ট্রেইলারে নিয়ে আসতে পারবে?’

অন্য তিতুনি একটু সন্দেহের চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এলিয়েনকে আনার পর আপনারা কী করবেন? তাকে কি ধরে ফেলবেন? কাটাকুটি করবেন?’

দুজন একসাথে চিৎকার করে বলল, ‘না না। মোটেও কাটাকুটি করব না। কাটাকুটি কেন করব? আমরা একটু কথা বলব। কয়েকটা টেস্ট করব। কিছু স্যাম্পল নেব, কিছু ছবি তুলব, স্ক্যানিং করব। এ রকম রুটিন কাজকর্ম।’

অন্য তিতুনি পরিষ্কার শুনতে পেল মনে মনে তারা বলছে, কোনোমতে এই ট্রেইলারে আনতে পারলেই এলিয়েনটাকে আটকে ফেলা যাবে। একবার আটকে ফেললে তাকে কাটাকুটি করতে সমস্যা কী? মুখে বলছে অন্য কথা!

অন্য তিতুনি আবার জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা কথা দিচ্ছেন তার কোনো ক্ষতি করবেন না?’

সবগুলো মিথ্যুক মানুষ জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, ‘অবশ্যই কথা দিচ্ছি।’

‘দুজন বিদেশি মানুষও কথা দিচ্ছেন? জিজ্ঞেস করে দেখেন।’

টিশটাশ ড. নাহার বলল, ‘জিজ্ঞেস করতে হবে না, আমি জানি তাঁরাও কথা দিচ্ছেন।’

অন্য তিতুনি সবার মনের কথা জানে, তাই সে জোর করল, ‘না। আপনারা জিজ্ঞেস করে দেখেন। আমি তাঁদের নিজেদের মুখে শুনতে চাই। এই এলিয়েন বহু দূর গ্যালাক্সি থেকে এসেছে, আমি তাকে একটুও বিপদের মুখে ফেলব না।’

নাহার আর শামীম বিরক্ত মুখে তখন ন্যাড়া মাথা এবং পাকা চুলের দুই বিদেশির সাথে কথা বলল, তারা জোরে জোরে মাথা নেড়ে তাদের কথায় সায় দিল। নাহার বলল, ‘প্রফেসর রিক গার্নার আর প্রফেসর বব ক্লাইড কথা দিয়েছেন।’

অন্য তিতুনি তখন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ঠিক আছে আমি তাহলে এলিয়েনকে ডেকে আনি।’

নাহার বলল, ‘যাও। আমরা তোমার জন্য এই ট্রেইলারে অপেক্ষা করছি।’

অন্য তিতুনি ট্রেইলার থেকে বের হয়ে চারদিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমাদের বাসার চারপাশে এত যন্ত্রপাতি লাগিয়েছে, এগুলো এলিয়েনের কোনো ক্ষতি করবে না তো?’

‘না, কোনো ক্ষতি করবে না। এগুলো লাগিয়েছি শুধু মনিটর করার জন্য।’

অন্য তিতুনির সাথে সাথে আব্বু আম্মু আর টোটনও ট্রেইলারের বাইরে এসে দাঁড়ালেন। আম্মু খুশি খুশি গলায় বললেন, ‘যা, মেয়েটাকে ডেকে আন, আমরা দেখি।’

অন্য তিতুনি বলল, ‘আম্মু তুমি অনেকবার দেখেছ, শুধু বুঝতে পারোনি।’

‘এবার আমি বুঝেশুনে দেখতে চাই!’

অন্য তিতুনি বলল, ‘ঠিক আছে।’ তারপর আব্বুর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আব্বু বাসার চাবিটা দাও।’

আব্বু পকেট থেকে বের করে চাবিটা এগিয়ে দিলেন। তিতুনি সেই চাবিটা নিয়ে বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করে।

চলবে...

আরও পড়ুন