স্টার কোয়েস্ট ২ (শেষ পর্ব)

অলংকরণ: তুলি

সাত

বরফের মতো জমে গেছে যেন জারা। মনে হতে লাগল, যেন প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে তার ভেতরের সমস্ত বাতাস বের করে নেওয়া হয়েছে। টান মেরে ব্যাগ দুটো তুলে নিয়ে দৌড় দিল জোনাথন। পিটারের ব্যাগের জিপার খোলাই রইল।

‘জোনাথন!’ চিৎকার করে ডাকল জারা।

ঠিক একই সময়ে কোচও জোনাথনের নাম ধরে ডাকলেন। তার ভারী কণ্ঠ জারার কণ্ঠকে ছাপিয়ে গেল। মুখ ফেরাল জোনাথন।

‘ভালো খেলেছ!’ কোচ বললেন।

হাসল জোনাথন, তবে দৌড় থামাল না। নিজের সাইকেলটার দিকে দৌড় দিল জারা। প্রাণপণে প্যাডেল করে যখন সাইকেল নিয়ে ও পার্কের কিনারে বেরোল, মি. রেইডের গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছে।

ট্রাফিক লাইটের কাছে আমি ওদের ধরব, ভাবল জারা।

ফুটপাতের কিনার ঘেঁষে ছুটে চলল সে। মেইন রোডে উঠে গাড়ির গতি বেড়ে গেছে। মোড়ের ট্রাফিক লাইটের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে হলুদ আলো জ্বলে উঠেছে। গতি কমাতে বাধ্য হলো গাড়িটা। যতটা জোরে সম্ভব প্যাডেল ঘোরাতে লাগল জারা। গাড়িটা চৌরাস্তা ক্রস করে চলে গেল। জারা মোড়ের কাছে পৌঁছাতেই লাল আলো জ্বলে উঠল।

‘ধ্যাত্তরি!’ রাগে চেঁচিয়ে উঠে ব্রেক কষল সে। চোখের সামনে গাড়িটাকে ছুটে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখল।

পিটার আমাকে মিথ্যা বলল কেন? অবাক হয়ে ভাবছে জারা। নাটকীয়ভাবে শেষ মুহূর্তে নোটবুকটা দেওয়ার জন্য? নিজেকে হিরো বানানোর জন্য? জোনাথন রেইডের সঙ্গে কোথাও যাচ্ছে এখন? নাকি বাড়ি যাচ্ছে? যদি ওর জিম ব্যাগটা কোনোভাবে হারিয়ে ফেলে, তখন? কিংবা তার খোলা ব্যাগ থেকে আমার নোটবুকটা বেরিয়ে পড়ে যায়।

লাল আলো বদলে সবুজ আলো জ্বলল। সাইকেল ঠেলে নিয়ে চৌরাস্তা পার করল জারা।

বাড়ি ফিরেই পিটারকে ফোন করব, ভাবছে সে। তাকে বলব তার ব্যাগে রাখা আমার নোটবুকটা দেখে ফেলেছি। অতএব, পানি আরও ঘোলা না করে সসম্মানে নোটবুকটা ফেরত দিক।

ঘড়ি দেখল জারা। দুপুর হয়ে গেছে।

তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এল সে। সোজা এসে রান্নাঘরে ঢুকল ফোন করার জন্য। এবারও ফোন ধরলেন পিটারের মা।

‘আন্টি, পিটারের সঙ্গে কথা বলতে পারি?’ জিজ্ঞেস করল জারা। ‘আমি জোহরা আজিজ বলছি। আগেও একবার ফোন করেছিলাম।’

‘হ্যাঁ, মনে আছে,’ মিসেস জোনস বললেন। ‘জোনাথন রেইডের সঙ্গে লাঞ্চ করতে গেছে পিটার। দেড়টার আগে ফিরবে না। ওই সময় ফোন করতে অসুবিধা আছে?’

‘কোথায় লাঞ্চ করবে, জানেন?’ জারা জিজ্ঞেস করল। ‘ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

‘মি. রেইড ওদের একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাবেন,’ মিসেস জোনস জবাব দিলেন। ‘তবে কোন রেস্টুরেন্ট, সেটা আমি জানি না। ও ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে ফোন করতে বলব।’

মিসেস জোনসকে গুডবাই জানিয়ে, লাইন কেটে দিয়ে, লরাকে ফোন করল জারা।

‘মস্ত খবর,’ বলল সে। ‘আমার নোটবুকটা পিটারের জিম ব্যাগে দেখলাম।’

‘তুমি বলতে চাইছ, জিনিসটা তার কাছেই ছিল?’ লরার প্রশ্ন। ‘টিকিটগুলো বের করে নিয়েছ?’

‘এখনো নোটবুকটাই বের করতে পারিনি,’ জারা জবাব দিল। কী ঘটেছে, খুলে বলল সে। ‘সোয়া একটায় পিটারদের বাড়ির সামনে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে?’

‘নিশ্চয়,’ লরা জানাল। ‘তবে ঘটনাটা অবাক করছে আমাকে—পিটার জোনসের জিম ব্যাগে তোমার নোটবুক!’

ফোন ছেড়ে দিয়ে বাবাকে লাঞ্চ টেবিল গোছাতে সাহায্য করতে এল জারা। ভাত আর গরুর মাংস রেঁধেছেন তিনি। সঙ্গে মচমচে করে পনির ভাজা আর হাতে বানানো টমেটোর স্যুপ। কাঁচা টমেটো, শসা, পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ কেটে সালাদ বানিয়েছেন। খাবারগুলো ভীষণ লোভনীয় মনে হলো জারার। পেটে খিদে, টের পেল জারা। সাইকেল চালাতে অনেক পরিশ্রম করেছে।

‘তারপর, বাইসাইকেল গোয়েন্দা,’ হেসে বললেন মি. আজিজ, ‘সারাটা সকাল তো ব্যস্ত থাকলে। লাভ কিছু হলো?’

‘কেসটা সমাধানের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছি আমি,’ জারা জানাল। ‘তবে বিষয়টা আমার কাছে অদ্ভুত লাগছে।’ পিটারের জিম ব্যাগে নোটবুক দেখার কথাটা বাবাকে জানাল সে।

ভ্রুকুটি করলেন মি. আজিজ। ‘তোমার নোটবুকটা পেয়েও ফেরত না দিয়ে সে খুব খারাপ কাজ করেছে। ফেরত আনতে যাচ্ছ কখন?’

‘লাঞ্চের পর জোনসদের বাড়িতে যাব,’ জারা বলল। ‘ওখানে লরা আরা সারাকেও আমার সঙ্গে দেখা করতে বলেছি।’

খাওয়া শেষ করে বাবা আর মেয়ে মিলে টেবিল সাফ করল। তারপর আবার সাইকেল নিয়ে বেরোল জারা। জোনসদের বাড়িতে এসে বাড়ির বারান্দার সিঁড়িতে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। কয়েক মিনিট পর সারা আর লরাও এসে তার সঙ্গে যোগ দিল। ওরা বসল এক ধাপ নিচের সিঁড়িতে।

‘অবিশ্বাস্য,’ লরা বলল। ‘পিটার বলল তোমার নোটবুকের ব্যাপারে কিছুই জানে না। অথচ তার জিম ব্যাগে দেখা গেল ওটা। এ রকম মিথ্যা কথা একজন কীভাবে বলতে পারে?’

‘হয়তো সে “একজন” নয়,’ জারা জবাব দিল। ‘হয়তো একটা দুষ্ট অ্যান্ড্রয়েড—প্রথম স্টার কোয়েস্ট ছবিটার থার্টিকের মতো।’

জোরে নিশ্বাস ফেলল সারা। ‘তোমার কি মনে হয় টিকিটগুলোতে পিটারের ব্যাগের গন্ধ লেগে থাকবে?’

এমন বোকার মতো প্রশ্নে হো হো করে হেসে উঠল জারা-সারা। ওদের মুখে তখনো হাসি লেগে রয়েছে, যখন মি. রেইডের গাড়িটা এসে থামল।

জিম ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গাড়ি থেকে নামল পিটার। জোনাথন আর তার বাবাকে উদ্দেশ করে হাত নেড়ে গুডবাই জানাল। তারপর এগোল বাড়ির দিকে। চোখে পড়ল সিঁড়িতে বসে থাকা তিন কন্যার দিকে। তিনজনেই তাকিয়ে আছে তার দিকে।

‘বাহ্, তোমরাও আমার ভক্ত হয়ে গেলে দেখছি!’ চওড়া হাসি হেসে বলল পিটার। ‘কী, অটোগ্রাফ লাগবে? কয় ঘণ্টা ধরে বসে আছ?’

‘এক দিনেরও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করে আছি, তুমি আমার নোটবুকটা ফেরত দেওয়ার জন্য,’ রাগত স্বরে জারা বলল।

‘আমি ইতিমধ্যেই যা বলার বলে দিয়েছি,’ পিটার বলল। ‘আমার কাছে কোনো সূত্র নেই। জিরো। নো সূত্র, নো নোটবুক, নো নাথিং!’

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সারা। ‘মিথ্যা কথা!’

‘না!’ পিটার বলল।

‘তোমার জিম ব্যাগে আমার নোটবুকটা রয়েছে,’ জারা বলল। ‘পার্কে ব্যাগ খুলে জোনাথন যখন জ্যাকেট ঢোকাল, তখনই দেখেছি।’

অবাক মনে হলো পিটারকে। তারপর লাল হয়ে গেল। ‘ও, ওটা,’ বিড়বিড় করল সে। ব্যাগ খুলে চকচকে একটা নীল রঙের কভারওয়ালা নোটবুক বের করল।

‘এটা আমার নোটবুক!’ চেঁচিয়ে উঠল জারা।

‘না, আমার,’ পিটার জবাব দিল। ‘দেখো? একেবারে নতুন।’ পাতাগুলো খুলে দেখাল সে। ‘সব সাদা।’

‘কোথায় পেলে?’ লরা জিজ্ঞেস করল।

‘স্কুল বেল থেকে কিনেছি, আজ সকালে,’ পিটার জবাব দিল। ‘ক্যান্ডির কাছে সব ধরনের নোটবুক আছে। গাদা গাদা।’

নোটবুকটার দিকে নীরবে তাকিয়ে রইল তিন কন্যা। তারপর জারা জিজ্ঞেস করল, ‘একটা নীল নোটবুক কিনতে গেলে কেন তুমি?’

আবার লাল হয়ে গেল পিটারের গাল। ‘আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি। আমার মনে হলো, নীল নোটবুক যার কাছে থাকবে, সে ভালো গোয়েন্দা হবে।’ জারাকে বলল, ‘তোমার মতো!’

‘সরি,’ জারা বলল। ‘আমি এ কেসটাতে বারবার ভুল করছি। এ নিয়ে দু-দুবার আমার সন্দেহ ভুল প্রমাণিত হলো।’

সাইকেলে চাপল তিন কন্যা। সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠল পিটার। ভেতরে চলে যাওয়ার আগে বলল, ‘এ কেসটার সমাধান কেউ করতে পারছে না।’ তারপর হাসল, ‘তবে পারছি না বলেই যে পারব না, তা নয়।’ ইঙ্গিতে নিজেকে বোঝাল সে।

পিটার চলে গেলে জারাকে জিজ্ঞেস করল লরা, ‘এখন কী করব?’

‘দুটো বাজে,’ জারা বলল। ‘কেসটা সমাধানের আর কোনো বুদ্ধি বের করতে পারছি না আমি। সত্যিই খুব খারাপ লাগছে। আমার কারণে তোমরাও সিনেমাটা দেখতে পারবে না।’

‘আমার মা-বাবা বলেছে, আমাকে আরেকটা সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবে,’ সারা বলল। ‘বুঝতে পারছি না যাব কি না।’

জারা আর সারা দুজনেই মাথা নাড়ল। অন্য কোনো সিনেমা দেখার আগ্রহ ওদের নেই। ওরা শুধু স্টার কোয়েস্ট ২-ই দেখতে চায়।

পরস্পরকে গুডবাই জানাল তিন কন্যা। তিনজনের কারও মুখেই হাসি নেই।

বাড়ি ফিরে বাবাকে সব জানাল জারা।

মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে গলা জড়িয়ে ধরলেন বাবা। ‘মুভি প্রিভিউটা দেখতে পারবে না, আমারও খুব খারাপ লাগছে। তবে যেদিন ছবিটা খোলাবাজারে আসবে, সেদিনই প্রথম শো দেখাতে তোমাদের তিনজনকে নিয়ে যাব আমি। কথা দিলাম।’

‘ধন্যবাদ, বাবা,’ জারা বলল।

‘এখন তোমার মুখে হাসি দেখার জন্য কী করতে পারি?’ মি. আজিজ বললেন। ‘চকলেট সস মেশানো স্ট্রবেরি আইসক্রিম? ডোমিনোর বারোটা গেম? নাকি গান গাইব?’

‘না না না, গান গেয়ো না!’ তাড়াতাড়ি বাধা দিল জারা। বাবার হেঁড়ে গলার খবর তার জানা আছে। হাসার চেষ্টা করল সে। ‘আমি জানি, আমি এখন কী করব। প্রথম স্টার কোয়েস্ট ছবিটাই ভিডিওতে দেখব।’

‘ভালো বুদ্ধি,’ সায় দিলেন মি. আজিজ। ‘আরও একবার একসঙ্গে তুলনাহীন একটা ছবি দেখার আনন্দ পাব আমরা।’

জারা আর তার বাবা মিলে বড় এক বাটি পপকর্ন বানালেন। তারপর বসার ঘরে ঢুকলেন বড় টিভি স্ক্রিনে ভিডিও দেখার জন্য।

পর্দায় বড় বড় অক্ষরে দেখা দিল: Star Quest। স্টার কোয়েস্ট ২ শুরু হওয়ার প্রায় ঘণ্টা দুই আগে। টিভির স্ক্রিনে মনোযোগ রাখার চেষ্টা করেও পারল না জারা।

স্টার-ফাইটার পাইলট জাইল রোবট কুকুর আরএফএফকে রিপ্রোগ্রামিং করছে।

‘আমি চাই প্রতিদিন সকালে আমার কম্পিউটার স্ক্রিনের ওপরে রাখা খবরের কাগজটা এনে দাও,’ জাইল বলল, ‘একটা বুদ্ধিমান কুকুরের মতো। আমার ডেস্কে বসে থেকে সবকিছু পড়ে ফেলার দরকার নেই তোমার।’

হেসে উঠল জারা। ধীরে ধীরে সিনেমায় মনোনিবেশ করে নোটবুকের কথা ভুলে যেতে লাগল। মিনিটের পর মিনিট কেটে যাচ্ছে।

‘এবার আসছে একটা মজার দৃশ্য,’ বাবাকে বলল জারা।

জাইলের স্টার ফাইটার শিপ একটা স্পেস স্টেশনের দিকে এগোচ্ছে। ফ্লিট কমান্ডারের একটা মেসেজে শিপের কমিউনিকেশন সিস্টেমে ঢুকে পড়েছে। মেসেজে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ‘সমস্ত স্টার ফাইটারদের বলছি। বিশ মিনিট অপেক্ষা করে তারপর ঢুকবে ডকিং বে-তে।’

‘এ তো একটা মহা ট্রাফিক জ্যাম,’ জাইল তার কো-পাইলট কেমাকে বলল। ‘চৌদ্দটা শিপ জমা হয়ে গেছে ঝুড়িতে জমানো পিঠার মতো। আবারও বলছি, পিঠা হয়ে গেলে যেভাবে ঝুড়ির মধ্যে ছুড়ে দেওয়া হয়, সেভাবে। আর ওই পিঠার মাঝখানে আমি হলাম গিয়ে মাখনের একটা দলা।’

অ্যানড্রয়েডের উজ্জ্বল নীল চোখ নিয়ে জাইলের দিকে তাকিয়ে রইল। ‘কী পিঠা?’

হাসতে আরম্ভ করল জারা, তারপর ঝটকা দিয়ে সোজা হয়ে বসল। ‘আরে...’ বলে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। রিমোট টিপে বন্ধ করে দিল ভিডিওটা।’

‘বাবা!’ চেঁচিয়ে উঠল সে। ‘আমাকে গাড়িতে করে ক্যান্ডির দোকানে নিয়ে চলো! এখনই!’

অলংকরণ: তুলি

আট

অবাক হলেন মি. আজিজ। ‘কী?’

ঘড়ি দেখল জারা। ‘চারটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। ঠিক চারটায় বন্ধ হয়ে যায় স্কুল ক্যান্ডি। বাবা, প্লিজ, তাড়াতাড়ি করো! আমার মনে হয় আমি রহস্যটার সমাধান করে ফেলেছি! গাড়িতে যেতে যেতে বলব তোমাকে। প্লিজ!’

একটা মুহূর্ত স্থিরদৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন মি. আজিজ। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘চলো।’

রান্নাঘরে দৌড়ে ঢুকল জারা। বলল, ‘কোরি আন্টি, সারা আর লরাকে একটা ফোন করে দেবে, প্লিজ? ওদের বলবে, টিকিটগুলো আমি পেয়ে গেছি। রিচমন্ডভিল সিনেমা হলের সামনে যেন চারটা পঁচিশে হাজির থাকে। খুব খুউব জরুরি কাজে যাচ্ছি আমি। পরে সব বলব।’

ঘর থেকে বেরিয়ে গাড়ির দিকে দৌড় দিল জারা। ততক্ষণে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফেলেছেন মি. আজিজ। লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠে বসল জারা। গাড়ি নিয়ে রাস্তায় উঠে এলেন মি. আজিজ। দ্রুত তার অনুমানের কথা বাবাকে জানাল জারা। ড্যাশবোর্ডের ঘড়ির দিকে তাকাল।

তীব্র গতিতে ছুটছে যেন ঘড়ির কাঁটাটা। চারটা বাজতে এক। চারটা। চারটা বেজে এক। চারটা বেজে দুই।

রাস্তার শেষ মোড়টা পেরোল ওদের গাড়ি।

‘বন্ধ হয়ে গেছে!’ চেঁচিয়ে উঠল জারা। দোকানের দরজায় ঝোলানো ‘ক্লোজড’ সাইনবোর্ডটার দিকে তাকিয়ে ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেল তার মন।

রাস্তার দিকে নজর গেল। দোকানটা যে ব্লকে রয়েছে, সেটার শেষ মাথায় একজন লোক গাড়িতে উঠছে। চেঁচিয়ে উঠল আবার জারা, ‘ওই যে ক্যান্ডি হুয়াম! ওকে থামাতে হবে!’

গাড়ির গ্যাস প্যাডেল চেপে ধরলেন মি. আজিজ। তীব্র গতিতে ছুটে গেল গাড়িটা। এই সময় রাস্তায় উঠল ক্যান্ডির গাড়ি। জোরে জোরে হর্ন বাজালেন মি. আজিজ। ক্যান্ডি থামল না। হর্ন বাজিয়েই চললেন মি. আজিজ। তারপর ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালাতে-নিভতে শুরু করলেন। পরের মোড়টায় গিয়ে গাড়ি থামালেন ক্যান্ডি।

‘গাড়িতে বোসো।’ ইমার্জেন্সি ব্রেকটা সেট করে দিলেন মি. আজিজ। লাফ দিয়ে নেমে লাফাতে লাফাতে ছুটলেন ক্যান্ডির গাড়ির দিকে।

গাড়িতে বসে দুজনকে কথা বলতে দেখল জারা। ঘড়িতে দেখল চারটা বেজে পাঁচ। তাড়াহুড়ো করে নিজের গাড়ির দিকে এগোলেন মি. আজিজ। ক্যান্ডিকে গাড়ি চালাতে দেখল জারা।

‘কী হলো?’ জারা জিজ্ঞেস করল। গাড়ি চালাতে শুরু করেছেন ততক্ষণে মি. আজিজ।

‘এই ব্লকটা ঘুরে আসতে হবে আমাদের,’ মেয়েকে জানালেন তিনি। ‘ক্যান্ডি বলেছে, দোকান খুলবে।’

চারটা বেজে নয়। ক্যান্ডির দোকানের সামনে গাড়ি থামল। এক লাফে নেমে গেল জারা। দরজার তালা খুলল ক্যান্ডি। সুইচ টিপে দোকানের ভেতরের আলো জ্বালল।

কাগজ আর নোটবুক রয়েছে যে তাকগুলোতে, সেগুলোর দিকে দৌড়ে গেল জারা। লাল, নীল, বেগুনি, সবুজ, কমলা রঙের নোটবুকের উঁচু স্তূপের মধ্যে খুঁজতে লাগল একটা উজ্জ্বল রঙের নীল নোটবুক, যেটার কভারে পকেট রয়েছে একটা।

‘এই যে! আমারটা!’ চেঁচিয়ে উঠল সে। হাতে একটা নীল নোটবুক। ‘সেদিন বাতি নিভে গেলে আমার জিপারখোলা ব্যাকপ্যাকের ভেতর থেকে নোটবুকটা পড়ে গিয়েছিল। তারপর ডিসপ্লে র্যাকটা পড়ে যায়। পড়ে বাতি এলে ওটা আবার তুলে সোজা করে, মেঝেতে পড়ে যাওয়া নতুন নোটবুকগুলো তাকে তুলে রাখা হয়। আর ভুলে, তার মধ্যে আমার নোটবুকটাও রেখে দেওয়া হয়। নোটবুকের গাদার মাঝখানে আরেকটা নোটবুক। পিঠার মধ্যে মাখন!’

অবাক দেখাল ক্যান্ডিকে। ‘মাখনের সঙ্গে নোটবুকের কী সম্পর্ক আমি বুঝিনি। তবে তোমার নোটবুকটা খুঁজে পাওয়ায় আমি খুশি। এই নোটবুকের ভেতরেই কি তোমার টিকিটগুলো আছে?’

নোটবুকটা ঝাড়া দিল জারা। তিনটি টিকিট বেরিয়ে তার ছড়ানো হাতের তালুতে পড়ল। মলিন, নোংরা হয়ে গেছে। তবে চাপে থেকে সমান হয়ে গেছে। আর শুকনো।

‘অনেক, অনেক, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, ক্যান্ডি, দোকানটা খোলার জন্য,’ জারা বলল। ‘কাল বিকেলে স্কুল ছুটির পর সব আপনাকে খুলে বলব।’

‘তাহলে ওই কথাই রইল,’ জবাব দিল ক্যান্ডি। রসিকতা করে বলল, ‘তোমার নোটবুকটা আমার দোকানে জমা রাখার জন্য তোমাকে এক পয়সাও ভাড়া দিতে হবে না।’

দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল জারা। গাড়িতে উঠল। ঠিক ৪টা ২৫ মিনিটে গাড়িটা পৌঁছাল সিনেমা হলের সামনে।

‘থ্যাংকস, বাবা!’ জারা বলল।

‘অত্যন্ত ভালো গোয়েন্দা তুমি, জারা,’ উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন বাবা। মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন।

গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল জারা। হলের প্রবেশমুখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সারা আর লরা। সোডা আর পপকর্ন কিনে সিনেমা দেখার জন্য তৈরি।

‘হুর্্র্রের!’ আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল লরা।

‘জারা, তুমি একটা জিনিয়াস!’ সারা বলল।

হলে ঢোকার বারান্দা ধরে এগোল তিন কন্যা। প্রচণ্ড ভিড়। এর মধ্য দিয়েই পথ করে এগোতে হলো। হলে ঢুকে চারপাশে তাকিয়ে বসার জন্য সিট খুঁজল।

উল্লসিত একটা চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল হলজুড়ে।

দুই ভাগে ভাগ করা সিটের সারির মাঝখান দিয়ে এগোল তিনজনে। সবাই চিৎকার করে স্বাগত জানাল তিন কন্যাকে।

‘জারা, তোমাদের সিট আমি রেখে দিয়েছি,’ রুবি বলল।

‘তুমি যে শেষ পর্যন্ত নোটবুকটা খুঁজে বের করতে পারলে, তার জন্য আমি অনেক খুশি,’ বলল রুবির কাজিন জুলি।

সবার পরে ঢুকেছে তিন কন্যা। তারপরও সিট রেডি পেয়ে খুশি। বসল তিনজনে। তাদের পেছনে বসেছে পিটার আর জোনাথন। আর তাদেরও পেছনে বসেছে নিনা।

‘তো, কীভাবে রহস্যটার সমাধান করলে?’ নিনা জিজ্ঞেস করল। ‘না, কাউকে বলবে না, গোয়েন্দার সিক্রেট?’

‘একটা কথা তোমাকে এখন বলতে পারি,’ জারা বলল, ‘ক্যান্ডির দোকানে গাদা করে রাখা হয়েছে নোটবুক—এই কথাটা থেকেই সূত্র পেয়েছি আমি।’

‘বুঝলাম না,’ পিটার বলল।

‘পরে বুঝিয়ে বলব আমি,’ জারা বলল।

সামনে ঝুঁকে এল নিনা। ‘তোমার একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাই। সিনেমা শেষ হওয়ার পর নিলে কেমন হয়?’

জারা জবাব দেওয়ার আগেই হলের আলো কমতে শুরু করল। সিনেমা শুরু হতে যাচ্ছে। সিটে হেলান দিল সে। তার কাঁধে চাপড় দিল কেউ। ফিরে তাকিয়ে দেখল, পিটার। ওর নতুন কেনা নোটবুকটা জারার দিকে বাড়িয়ে দিল।

‘তুমি এটা নিয়ে যাও,’ পিটার বলল। ‘এটা কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, আমি জানি না। তুমি গোয়েন্দা, তুমিই রাখো।’

‘শুধুই গোয়েন্দা?’ হেসে প্রশ্ন করল জারা।

‘না, ভালো গোয়েন্দা,’ পিটার বলল।

‘শুধু ভালো গোয়েন্দা?’ আবার হাসল জারা।

‘না, অনেক ভালো গোয়েন্দা,’ পিটার বলল।

‘অনেক ভালো গোয়েন্দা। আর কিছু না?’

‘হয়েছে, বাবা, হয়েছে!’ দুই হাত তুলে মেনে নেওয়ার ভঙ্গি করল পিটার, ‘তুমি আসলে, সেরা গোয়েন্দা!’ পরে যোগ করল, ‘অন্তত এখনকার মতো!’

নোটবুকে তার তদন্তের সারমর্ম লিখে রাখার তর সইছে না জারার। স্টার কোয়েস্ট ২ সিনেমার থিম মিউজিক শুরু হলে, তার নিজের নীল নোটবুকটা খুলে, স্বল্প আলোতেই লিখতে শুরু করল:

আমার প্রিয় এই নোটবুকটায় আবার লিখতে পারা অনেক আনন্দের। নোটবুকটা আমি খুঁজে বের করেছি। সঙ্গে আমার ও আমার বন্ধুদের ফ্রি টিকিটগুলো। পিটারও একটা জিনিস জানতে পেরেছে। একটা নোটবুক কিনে ফেললেই ভালো গোয়েন্দা হওয়া যায় না, যেমন হওয়া যায় না বেসবল ব্যাট কিনলে ভালো খেলোয়াড়। এসব হওয়ার জন্য যেমন মেধা থাকতে হবে, তেমনি করতে হবে নিয়মিত চর্চা। আমি আশা করি, রহস্য সমাধান নিয়ে আরও অনেক চর্চা করতে পারব। এতই বেশি, যে সেসবের ফলাফল লিখতে লিখতে এই নোটবুকটা ভরে যাবে, তখন আরেকটা নতুন নোটবুক কিনতে হবে! যা-ই হোক, স্টার কোয়েস্ট ২-এর কেস এখানেই শেষ।

(শেষ)