পাঁচ
‘সে-ও একটা টি...’ বলতে গেল সারা।
তার মুখ চেপে ধরল জারা। ফিসফিস করে বলল, ‘নড়বে না। কোনো কথা বলবে না।’
জারা দৌড়ে গেল জনসনদের বাড়ির এক পাশে, যে পাশটায় ড্রাইভওয়েটা রয়েছে। সেখান থেকে দৌড়ে চলে গেল সাইডওয়াকে। রুবি আর লালচুলো মেয়েটাও গাড়িতে উঠে বসেছে। ড্রাইভওয়েতে পিছিয়ে এনে গাড়ি ঘোরালেন মি. জনসন। সাইডওয়ে ধরে গাড়িটার পাশে হাঁটতে লাগল জারা।
‘দারুণ!’ ফিসফিসিয়ে লরা বলল। ‘এমন ভাব দেখাচ্ছে, যেন রাস্তায় হাঁটছে, আর গাড়িতে দেখে ফেলেছে রুবিদের।’
‘রুবি!’ জারা ডাকল। হাত নাড়াল। ‘থামো!’
ব্রেক চাপলেন মি. জনসন। গাড়ির জানালার কাছে দৌড়ে গেল জারা।
‘হাই,’ রুবিকে বলল জারা। ‘তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল। গতকাল ক্যান্ডির দোকানে যখন বাতি চলে গিয়েছিল, সে সময় আমার নীল নোটবুকটা হারিয়ে ফেলেছি। ওটার ভেতরে তিনটি মুভি পাস ছিল। তুমি তো ওখানেই ছিলে। কোনোভাবে তোমার চোখে কি পড়েছে ওটা?’
মাথা নাড়ল রুবি। ‘নাহ্। স্কুল ক্যান্ডিতে খোঁজ নিয়েছিলে। হয়তো ওখানেই এখনো পড়ে আছে।’
‘হ্যাঁ, ওখানে খুঁজে এসেছি,’ জারা বলল। চট করে তাকাল একবার গাড়িতে রাখা ব্যাকপ্যাকটার দিকে। কোনো একটা তথ্য দরকার তার। ‘পাইনি।’
‘মেয়েরা,’ মি. জনসন বললেন, ‘আমি দুঃখিত, তোমাদের কথায় বাদ সাধতে হচ্ছে। আমাদের যেতে হচ্ছে। এখনই না গেলে স্টেট পার্কে ঘোরার আর সময় পাব না।’
চলতে শুরু করল গাড়িটা। রাস্তায় উঠলে জানালা দিয়ে হাত বের করে জারার উদ্দেশে নাড়ল রুবি। মোড়ের কাছে গিয়ে ওটা যখন মোড় নিল, লরা আর সারাকে বেরিয়ে আসতে ইশারা করল জারা।
‘ও কী বলল?’ সারা জানতে চাইল।
‘তেমন কিছু নয়,’ জারা জবাব দিল। ‘শুধু বলল, স্কুল ক্যান্ডিতে গিয়ে খোঁজা দরকার, হয়তো ওখানেই পড়ে আছে নোটবুকটা।’
‘রুবেলা জনসন!’ অনেকটা খেদের সঙ্গেই বলল লরা। ‘আমি সব সময় ওকে ভালো মেয়ে ভাবতাম। কিন্তু এখন দেখছি গোলমাল আছে। সে-ই তোমার নোটবুকটা নিয়েছে। নইলে তার কাজিনের জন্য মুভি পাস জোগাড় করল কীভাবে?’
মাথা ঝাঁকাল জারা। ‘আমিও তা-ই ভাবছি। কিন্তু আপাতত আর জিজ্ঞেস করা যাবে না—সারা দিনের জন্য বেড়াতে চলে গেছে।’
গুঙিয়ে উঠল সারা। ‘তার মানে সে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমাদের আর কিছুই করার থাকল না। আর কালকেই রোববার, মুভি দেখার তারিখ।’
‘অন্য সন্দেহভাজনদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া দরকার,’ জারা বলল। ‘কোনখান থেকে যে কী বেরিয়ে পড়বে, আগে থেকে বোঝা যায় না।’ ঘড়ি দেখল সে। ‘ওরে বাবা, অনেক বেজে গেছে তো! বাড়ি যাওয়া দরকার। লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে।’
‘আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে,’ সারা বলল। ‘লাঞ্চের পর আমার সঙ্গে চলো। মা আমাকে নিয়ে একটা পুতুল-মেলায় নিয়ে যাওয়ার কথা। জানতে পারলাম, নিনা বার্ডও ওই মেলায় যাচ্ছে। ওখানে তার সঙ্গে কথা বলতে পারব।’
‘বেশ।’ জারা বলল। ‘কিন্তু আমি একা, নাকি লরাও যেতে পারবে?’
মাথা নাড়ল লরা। ‘কিন্তু আমি যেতে পারব না। আমাকে ডেন্টিস্টের কাছে যেতে হবে। ভাবতেও ভয় লাগছে!’
কী করবে ঠিক করার পর সাইকেলে চাপল মেয়েরা। বাড়ি ফেরার পথে ভাবতে ভাবতে চলল জারা। এমন একটা জঘন্য কাজ কীভাবে করতে পারল রুবি, অবশ্য যদি করে থাকে। আর নোটবুকটা ফেরত পাওয়ার উপায় কী?’
জারার অতি প্রিয় বাঙালি খাবার রান্না করে রেখেছেন মিসেস কোরি। ভাত, ডাল, ঝাল করে বানানো আলুর ভর্তা, ডিমভাজি। সঙ্গে বড় বড় করে কাটা টমেটো আর শসা। দীর্ঘদিন একটা বাঙালি পরিবারের সঙ্গে থাকতে থাকতে বাঙালি রান্না শিখে ফেলেছেন। খেতে খেতে সারার সঙ্গে পুতুল-মেলায় যাওয়ার কথা জানাল জারা। কোরি বললেন, ভালোই হবে।
লাঞ্চের ঘণ্টাখানেক পর সারাদের গাড়িতে সারার পাশে উঠে বসল জারা। সারার মা মিসেস লেভিন গাড়ি চালিয়ে মলে এলেন। মেয়েদের সঙ্গে ভেতরে ঢুকলেন। মেইন কোর্টের অর্ধেকজুড়ে রঙিন ডিসপ্লেতে নানা রকম খেলনা সাজানো রয়েছে। তাকের সারির মাঝখানে লোক চলাচলের পথ। সেগুলো লোকে ভর্তি।
‘এই জায়গাটাতেই থাকো তোমরা।’ মিসেস লেভিন বললেন। ‘ঘুরে ঘুরে পুতুল দেখো।’
‘আরে, অনেক স্টার কুয়েস্ট টয় আছে!’ সারা বলল। ‘আমার পছন্দ ওই কেমা অ্যান্ড্রয়েড পুতুলগুলো।’
‘আসলেই, সত্যিই সুন্দর।’ জারা বলল। ‘দেখো একটা আরএফএফ রোবট ডগও আছে, ব্যাটারিতে চলে।’
এই খেলনাগুলোর পাশে রাখা স্টাফ করা জানোয়ারগুলোর দিকে নজর দিল মেয়েরা। তারপর পুতুলের ডিসপ্লের সামনে দাঁড়াল। ওয়াটারকালার সেট দেখে সেটার দিকে এগোল জারা।
‘এ রকম একটা জায়গায় এসেছ নোটবুক খুঁজতে?’ বলে উঠল একটা পরিচিত কণ্ঠ।
ঘুরে তাকাল জারা। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে নিনা বার্ড।
‘আমার নোটবুক হারিয়েছে, তুমি কী করে জানলে?’ প্রশ্ন করল জারা।
‘পিটার জোনসের কাছে শুনলাম।’ নিনা জানাল। ‘এখানে এসেছিলাম আমার পত্রিকার জন্য পুতুল-মেলা নিয়ে প্রতিবেদন লেখার রসদ জোগাড়ের জন্য। কিন্তু আরেকটা মজার খবর পেয়ে গেলাম। এখন লিখতেই পারি—একজন গোয়েন্দা কীভাবে তার নোটবুক হারিয়েছে—সঙ্গে তিনটা টিকিট।’
ঝটকা দিয়ে একটা লাল মলাটওয়ালা নোটবুক খুলল নিনা। ‘স্টার কুয়েস্ট ২ প্রিভিউ নিয়ে কী মনে হচ্ছে তোমাদের—আমি জারা, সারা, লরা—তিনজনকেই জিজ্ঞেস করছি।’
‘টিকিটগুলো একেবারে হারিয়ে ফেলেছি, আমি এখনো তা মনে করি না।’ জারা জবাব দিল।
হাসল নিনা। তার মুখ দেখে মনে হলো জারার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘টিকিট হারানোয় লরা আর সারা তোমার ওপর প্রচণ্ড খেপে যায়নি?’
‘সত্যি কথাটা শুনলে তোমার ভালো লাগবে না—ওরা একটুও রাগেনি; বরং আমাকে সহানুভূতি জানিয়েছে।’
এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল নিনা, যেন এবারও জারার কথা বিশ্বাস করেনি। তার লাল নোটবুকে খসখস করে কিছু লিখল। তারপর বলল, ‘আমার একটা শেষ প্রশ্ন। পিটার কি তোমার নোটবুকটা খুঁজে বের করেছে? যদি করে থাকে, স্বীকার করছ, সে-ই সেরা গোয়েন্দা?’
‘এ মুহূর্তে আমি একটা কথা স্বীকার করছি—মানে জোর দিয়ে বলতে চাচ্ছি—ওই নোটবুক আমি খুঁজে বের করবই।’ জারা বলল। ‘সেই সঙ্গে টিকিটগুলো।’
‘দোয়া করি, তুমি খুঁজে পাও।’ নিনা বলল। ‘কারণ, সবাই ফ্রি পাস নিয়ে সিনেমার প্রিভিউ দেখতে যাচ্ছে, এমনকি রুবেলা জনসনের কাজিনও।’
‘কাজিনের জন্য টিকিটটা জোগাড় করল কোত্থেকে?’ জারা জিজ্ঞেস করল। ‘তোমার কাছে কোনো খবর আছে?’
‘প্রশ্নটার জবাব তো তোমার জানার কথা। কারণ, তুমিই নিজেকে গোয়েন্দা বলে দাবি করো।’ কুটিল হাসি হেসে বলল নিনা। ‘একেবারে সেরা গোয়েন্দা। চলি। দেখা হবে।’
ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল নিনা।
সে এমন কিছু জানে, যেটা আমি জানি না, জারা ভাবল। নিনা আর পিটার, দুজনে মিলেই কি করেছে কাজটা? এই সময় দেখল, তাড়াহুড়ো করে সারা আসছে তার দিকে।
‘এই যে, তুমি এখানে।’ সারা বলল।
‘এইমাত্র নিনার সঙ্গে কথা বললাম।’ জারা বলল। ‘সে জানে, রুবি তার কাজিনের জন্য একটা পাস জোগাড় করেছে। কিন্তু কীভাবে পেল, সেটা আমাকে বলেনি।’
‘তুমি ভাবছ পিটার আর নিনা প্ল্যান করে কাজটা করেছে?’ সারা জিজ্ঞেস করল। ‘তুমি কি ভাবছ...ষ...কী যেন বলে বাংলায়?’
‘ষড়যন্ত্র।’ জারা বলল।
‘হ্যাঁ, তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে?’
*
শেষ বিকেলে গাড়িতে করে জারাকে বাড়ি পৌঁছে দিলেন মিসেস লেভিন। সোজা নিজের ঘরে চলে এল জারা। বিছানায় বসে অঙ্কের খাতাটা খুলল।
রুবি, নিনা আর পিটার—ভাবল সে—তিনজন সন্দেহভাজন। সত্যিই কি তা-ই? নাকি একজন চোর, আর দুজন তার সহকারী। রুবি হয়তো নোটবুকটা নেয়নি। হয়তো পিটার আর নিনা নিয়েছে প্রমাণ করার জন্য যে আমি ‘সেরা গোয়েন্দা’ নই। নোটবুকটা নিয়ে থাকলে এদের যে কারও পক্ষেই রুবির কাজিনকে একটা ফ্রি পাস দেওয়া সম্ভব।
আমি সত্যিই একটা গ্যাঁড়াকলে পড়েছি, ভাবল জারা। রুবির কাজিন টিকিটটা কোথায় পেয়েছে জানা গেলেই অনেক প্রশ্নের জবাব সহজ হয়ে যাবে।
খাতার সাদা পাতায় বড় করে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন আঁকল জারা। এরপর আমাকে কী করতে হবে, আমি জানি, ভাবল সে। রুবিকে বলতে পারি, আমি শুনেছি, তার কাজিন একটা ফ্রি পাস পেয়েছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে পারি টিকিটটা কোথায় পেয়েছে। ...
লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল জারা। দৌড়ে নিচে নামল। রুবিকে ফোন করল।
জবাব দিলেন একজন মহিলা। ‘হ্যালো?’
‘আমি রুবির সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।’ জারা বলল।
‘সরি।’ মহিলা জবাব দিলেন। ‘ও এখনো ফেরেনি। ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে।’
জোরে নিশ্বাস ফেলল জারা। ‘ঠিক আছে, আমি কাল সকালে ফোন করব আবার। থ্যাংকস। বাই।’
এরপর লরা আর সারাকে ফোন করল জারা। তার সন্দেহ এবং পরিকল্পনার কথা জানাল। এটাও বলল কাল সকালে আবার রুবিকে ফোন করব।
‘আমরা সবাই মিলে একসঙ্গেই তো তার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারি?’ লরা বলল। ‘কাল সকাল ১০টায় ওর বাড়িতে চলে যাব।’
‘বেশ।’ জারা বলল, ‘তা-ই করব। সারাকে ফোন করে জানিয়ে দাও।’
ডিনারের সময় সেদিন যা যা ঘটেছে বাবাকে সব কথা খুলে বলল জারা।
‘আমার মনে হয় ঠিক পথেই এগোচ্ছ তুমি।’ বাবা বললেন। ‘রুবির সঙ্গে কথা বলো। কিন্তু আমার বেবি শার্লককে এত বিমর্ষ লাগছে কেন?’
‘আমার ভয় লাগছে বাবা, টিকিটগুলো হয়তো আমি খুঁজে পাব না।’ জারা বলল। ‘তার কারণ, সময় তো হাতে বেশি নেই।’
অন্যদিন ডিনারের ভিডিও গেম খেলে, আজ খেলতে ইচ্ছা করল না। তার বদলে বই পড়ে কাটাল। শোয়ার সময় হলে যাবতীয় কাজ সেরে, দাঁত মেজে, কাপড় বদলে শুয়ে পড়ল। চাদরটা টেনে দিল গলা পর্যন্ত। আশা করতে থাকল, সকালটা যেন খুব শিগগির চলে আসে। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়ল জানে না।
যখন আবার চোখ মেলল, দেখে জানালা দিয়ে ঢুকছে সকালের নরম রোদ। আগের রাতে যেমন তাড়াহুড়ো করেছিল, এখনো তা করল। জিনস পরে, একটা লাল সোয়েটার গায়ে দিয়ে, রান্নাঘরে এসে যখন ঢুকল, তখনো মিসেস কোরি আসেননি। নিজেই খাবার নিয়ে নাশতা সেরে বেরোনোর জন্য তৈরি হলো। ৯টা ৪৫ মিনিটে রুবিদের বাড়ির সাইডওয়াকে এসে দাঁড়াল।
রুবির মা-বাবা এখন কাজে বেরিয়ে গেলে সুবিধা হয়, সারা আর লরা আসার অপেক্ষা করতে করতে ভাবল সে।
অপেক্ষা করতে পারছে না, অস্থির হয়ে গিয়ে শেষে সাইকেল নিয়ে ঢুকে পড়ল রুবিদের আঙিনায়। দরজার ঘণ্টা বাজাল। খুলে দিলেন মি. জনসন।
‘রুবির সঙ্গে কথা বলতে পারি?’ জিজ্ঞেস করল সে।
‘নিশ্চয়ই।’ মি. জনসন বললেন। ‘এসো এসো। রুবির ঘর দোতলায়। তুমি বোসো। আমি ওকে ডেকে নিয়ে আসছি।’
একটা বারান্দা দিয়ে হলঘরে ঢুকল জারা। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলেন মি. জনসন। চারপাশে তাকাল জারা। বাড়িটা বড়ই শান্ত।
হালের মার্বেল পাথরে তৈরি একটা টেবিলের ওপর হাত রেখে বসল জারা। একটা কাচের ফুলদানি রাখা টেবিলটার ঠিক মাঝখানে। লক্ষ করল, একটা কার্ডের কোনা বেরিয়ে আছে ফুলদানির নিচ থেকে। গোলাপি বর্ডার দেওয়া। স্টার কুয়েস্ট ২-এর পাস না তো?
উঠে এসে, সাবধানে, আস্তে করে ফুলদানিটা উঁচু করল সে। দুটো টিকিট আছে মনে হলো। টিকিটগুলো নিতে হাত বাড়াল।
‘এই, কী করছ তুমি? এ জিনিসগুলো তোমার নয়!’ তীক্ষ চিৎকার শোনা গেল। ‘চোর কোথাকার!’
ছয়
ঝট করে টিকিটগুলোর কাছ থেকে হাত সরিয়ে, চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল জারা। রুবির কাজিন জুলি দাঁড়িয়ে আছে রান্নাঘরের দরজায়। মি. জনসন আর রুবি সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে এল।
‘কী ব্যাপার?’ মি. জনসন জিজ্ঞেস করলেন।
জারার দিকে অভিযোগের আঙুল তুলল জুলি। ‘আমাদের সিনেমার টিকিট চুরি করছে সে।’
‘আমি চুরি করছিলাম না,’ জারা বলল। ‘আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম।’ রুবির দিকে তাকাল সে। ‘রুবি, আমি শুনেছি তুমি একটা বাড়তি টিকিট জোগাড় করেছ। আমি জানতে চাই কোথায় পেলে ওটা—কারণ, আমার, সারার, লরার তিনটি টিকিট রহস্যজনকভাবে খোয়া গেছে। ক্লাস টিচার মিস ক্লারা ডেনিম স্পষ্টই বলে দিয়েছেন, প্রত্যেককে একটা করে টিকিট দেওয়া হবে, বাড়তি কোনো টিকিট নেই।’
‘কনা জেসন সিনেমা দেখতে যেতে পারবে না।’ রুবি বলল। ‘তার নানি অসুস্থ, ডেট্রয়েটে থাকে। সেখানে, হাসপাতালে দেখা করতে গেছে কনা আর তার মা। কাল সকালে নিনাকে বলেছে কনা, নিনা ফোন করেছে আমাকে। সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে কনার টিকিটটা তার কাছ থেকে নিয়ে এসেছি আমি আর জুলি।’
মাথা ঝাঁকাল জুলি। বিব্রত দেখাচ্ছে তাকে। জারাকে বলল, ‘তোমাকে চোর বলেছি, সে জন্য দুঃখিত। আমি বুঝিনি, তুমি কী করছ।’
‘না না, ঠিক আছে।’ জারা বলল।
‘তোমার টিকিটগুলো হারিয়ে গেছে, এ জন্য আমারও খারাপ লাগছে।’ রুবি বলল। ‘আমি সিনেমা দেখতে না গেলে আমার টিকিটটা তোমাকে দিয়ে দিতাম। সত্যি বলছি।’
‘তা যে দিতে, সেটা আমিও জাানি।’ জোর দিয়ে বললেন মি. জনসন।
‘থ্যাংকস, রুবি।’ জারা বলল। বেরোনোর জন্য দরজা খুলল। ‘পরে দেখা হবে—হয়তো আগামীকালই।’
সাইকেলটা ঠেলে মোড়ের কাছে নিয়ে এল জারা। ভাবল, রুবি যে চোর নয়, তাতে আমি খুশি। কিন্তু আমার নোটবুকটা গেল কোথায়? টিকিটগুলো কে নিল?
ইতিমধ্যে সারা আর লরাও এসে হাজির হলো। রুবি বাড়তি টিকিট কোথায় পেয়েছে, দুজনকে জানাল জারা।
‘হুঁ, রুবি তাহলে নিনার সঙ্গে মিশে ষড়যন্ত্র করেনি।’ লরা বলল। ‘তাহলে এখন কী করব আমরা?’
‘হাল ছাড়ব না, আর যা-ই হোক।’ জারা বলল। ‘এখন পিটারকে জেরা করে দেখা যাক।’
পিটারের কথায় মুখ বাঁকাল সারা।
জারা বলল, ‘গোয়েন্দাগিরি যদি করেই থাকে, নিশ্চয় নোটবুকটার ব্যাপারে সে কিছু জানে। হয়তো ওটা খুঁজে বের করার একটা সুযোগ পেয়ে যাব। ওকে ফোন করা যাক।’
হাতের ঘড়িটা দেখল সারা। ‘আমি থাকতে পারব না। আমার নানি আমাকে মলে নিয়ে যাবে। কেমা অ্যান্ড্রয়েড ডলটা দেখাব তাকে। তোমরা তো জানোই, নানি আমাকে কত কিছু কিনে দেয়।’
‘আমি মাকে বলে এসেছি উঠানের ঝরাপাতা সাফ করতে তাকে আমি সাহায্য করব।’ লরা বলল। ‘কাজেই আমাকে যেতে হবে। তবে বেশিক্ষণ লাগবে না।’
‘আমি একাই তাহলে পিটারের সঙ্গে কথা বলব।’ জারা বলল। ‘তারপর কী হলো, তোমাদের ফোনে জানাব।’
বাড়ি চলে এল জারা। মাত্র আর ছয় ঘণ্টা সময় আছে হাতে, যা করার এর মধ্যে করতে হবে। নইলে সিনেমা দেখা আর হবে না ওদের। হয়তো পিটার কোনো সূত্র দিতে পারে, ভাবল জারা। হয়তো আমাদের সঙ্গে মিশে কাজ করবে। চারটি মাথা একসঙ্গে খাটালে হয়তো তিনটি মাথার চেয়ে ভালো হবে। যদিও পিটারকে বিশ্বাস করা যায় না।
বাড়ি ফিরেই পিটারদের বাড়িতে ফোন করল জারা। ওর মা ফোন ধরলেন।
‘পিটার আছে, আন্টি?’ জারা জিজ্ঞেস করল। ‘আমি তার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ি। আমার নাম জোহরা আজিজ।’
‘পিটার তো নেই, কী একটা লিগ খেলা খেলতে পার্কে চলে গেছে।’ মিসেস জোনস জানালেন। ‘বাড়ি এলে কি তোমার কথা বলব কিছু তাকে?’
‘না, থ্যাংকস।’ জারা জবাব দিল। ‘বাই।’
বাবার স্টাডিতে তাঁকে পাওয়া গেল। জিজ্ঞেস করল, ‘সাইকেল নিয়ে পার্কে যাব। তোমার কোনো আপত্তি আছে, বাবা?’
ঘড়ির দিকে তাকালেন মি. আজিজ। ‘যাও, তবে লাঞ্চের আগে ফিরে এসো। আর চালানোর সময় খুব সাবধান, বিশেষ করে মোড়ের ট্রাফিক লাইটগুলোর দিকে নজর রেখো।’
‘রাখব, রাখব। আর লাঞ্চের আগে ফিরেও আসব।’ জারা বলল। ‘এমনভাবে বলছ, যেন আমি এসব জানি না।’
হেসে উঠলেন বাবা। হাত নেড়ে মেয়েকে গুডবাই জানালেন।
দ্রুত সাইকেল চালিয়ে পার্কে চলে এল জারা। বেড়ার বাইরে জড়ো হয়েছে বেশ কিছু দর্শক। বেসবল খেলা হচ্ছে পার্কের ভেতরে। চিৎকার করে যার যার পক্ষকে সমর্থন জানাচ্ছে। ব্যাট করছে পিটারের দল।
‘স্কোর কত?’ একটা টিনএজ মেয়েকে জিজ্ঞেস করল জারা।
‘এ পর্যন্ত টাই হয়েছে। খেলাও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।’ মেয়েটা জবাব দিল। ‘তবে এখন যারা ব্যাট করছে, তারা যদি বাড়তি কিছু করতে পারে, তো জিতে যাবে।’
পিটাররা যেখানে রয়েছে, সাইকেলটা ঠেলে নিয়ে সেখানে চলে এল জারা। পিটারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু জোনাথন রেইড ব্যাট করতে প্রস্তুত।
একটা গাছের গায়ে সাইকেলটা ঠেস দিয়ে রাখল জারা। তারপর পিটারের পেছনে গিয়ে তার কাঁধে আলতো চাপড় দিল। ‘তোমার সঙ্গে কথা আছে, পিটার। এক মিনিট সময় হবে? খুব জরুরি। আমার হারানো নোটবুক সম্পর্কে।’
‘কিন্তু আমি তো এখন খেলায় ব্যস্ত।’ পিটার জবাব দিল। ‘খেলা আর গোয়েন্দাগিরি, একই সঙ্গে তো দুটো করতে পারব না। আমি সেরা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, তবে আমি সুপারম্যান নই।’ তারপর জোনাথনের উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল। ‘একটা রান করে ফেলো!’
পিচার বল করল। ব্যাট ঘুরিয়ে বাড়ি মারল জোনাথন এবং বলে লাগাতে পারল না। একটা স্ট্রাইক মিস।
সামান্য একটু সময় পাওয়া গেল। ‘তোমার যদি কোনো সূত্র থাকে তাড়াতাড়ি বলে ফেলো।’ পিটারকে বলল জারা। ‘প্লিজ! সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে!’
‘তাই? কিন্তু আমি তো আমার “সেরা গোয়েন্দা”র পদ হারাতে রাজি নই।’ পিটার জবাব দিল।
বল করল আবার পিচার। আবার বাড়ি মারল জোনাথন। মিস করল। দুটো স্ট্রাইক চলে গেল।
‘খুব জরুরি না হলে তোমার কাছে আসতাম না, পিটার।’ জারা বলল। ‘আমি চাই না, আমার জন্য আমার বন্ধুরা সিনেমাটা দেখতে না পারুক।’
জারার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল সে। গম্ভীর হয়ে গেছে মুখ। ফিসফিস করে বলল, ‘একটা কথা কি জানো?’
‘কী?’ জারা জিজ্ঞেস করল।
হেসে উঠল পিটার। ‘আমার কাছে কোনো সূত্র নেই।’
মুখ বাঁকাল জারা। ‘পিটার, এটা ইয়ার্কির সময় নয়। তুমি দেখেছ...’ কথা শেষ হলো না জারার।
আবার খেলায় মনোযোগ দিল পিটার। বল করল পিচার। গায়ের জোরে বাড়ি মারল জোনাথন। থ্যাপাত! জোরে বাড়ি লাগল বলে। শর্ট স্টপ পার হয়ে চলে গেল বল। বলের পেছনে দৌড়াতে লাগল একজন আউটফিল্ডার। বলটা ধরতে পারছে না।
‘বাউন্ডারির বাইরে চলে যাক! বাইরে চলে যাক!’
আরও অনেকের সঙ্গে জারাও চিৎকার করে উঠল। দৌড়াতে দৌড়াতে সেকেন্ড বেজে চলে গেল জোনাথন, তৃতীয় বেজ ঘুরল, তারপর চলে এল আগের জায়গায়, হোম প্লেটে, যেখান থেকে ব্যাট করেছিল।
‘জিতে গেছি! জিতে গেছি!’ চেঁচাতে লাগল পিটার। ‘ইয়া-হু!’ সে আর দলের বাকি সবাই জোনাথনের দিকে দৌড়ে গেল।
তাকিয়ে দেখছে জারা, দলের সদস্য আর ভক্তরা সবাই উল্লাস করছে, হাততালি দিচ্ছে। কয়েক মিনিট পর দর্শকদের ভিড় কমে গেল। জারা দেখল, পিটার, জোনাথন আর তার বাবা মি. রেইড একটা পার্ক করে রাখা গাড়ির দিকে এগোচ্ছেন। গাড়িতে উঠলেন তিনজনে। স্টার্ট নিল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল রাস্তার দিকে।
গেল, ভাবছে জারা, আর কোনো আশা নেই!
হঠাৎ গাড়িটা থেমে গেল। পিছিয়ে এল আবার মোড়ের কাছে। গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে, লাফাতে লাফাতে বেসবল ফিল্ডে ছুটে এল জোনাথন।
‘কী হয়েছে, জোনাথন?’ কোচ জিজ্ঞেস করলেন। ‘আরেকটা গেম খেলবে নাকি?’
‘নাহ্,’ জোনাথন জবাব দিল। ‘পিটার আর আমি আমাদের জিম ব্যাগটা নিতে ভুলে গেছি।’
তাড়াহুড়ো করে জারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার কাছাকাছি একটা জায়গায় ছুটে এল জোনাথন। কয়েকজন খেলোয়াড় আর ওদের পরিবারের লোকেরা ওখানে জটলা করছে। ক্যানভাসের ব্যাগ দুটো তোলার জন্য উবু হলো জোনাথন। হাতল চেপে ধরল।
‘এই, জোনাথন,’ কোচ বললেন, ‘এই জ্যাকেটটা, এতে পিটারের নাম লেখা আছে।’ সবুজ-সাদা রঙের একটা উইন্ডব্রেকার বাড়িয়ে দিলেন তিনি।
‘হ্যাঁ, এটা ওরও।’ জোনাথন জবাব দিল। জ্যাকেটটা ভরে রাখার জন্য একটা ব্যাগের জিপার টান দিয়ে পুরো খুলে ফেলল সে। ফাঁক হয়ে গেল ব্যাগটা। জ্যাকেটটা ওটার ভেতরে ভরার আগেই একটা জিনিস চোখে পড়ল জারার, ব্যাগে ভরা কাপড়ের স্তূপের ওপর শুয়ে আছে।
আয়তাকার, নীল রঙের, চকচকে।
নিশ্বাস ভারী হয়ে গেল জারার। ‘ওই তো, আমার নোটবুক!’