তিতুনি এবং তিতুনি (শেষ পর্ব)

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

তিতুনি ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। দুপুরের দিকে তাদের বাসার সামনে একটা ট্রেইলার এনে রাখা হয়েছে, তিতুনি আগে কখনো ট্রেইলার দেখেনি, এটা আসলে চাকা লাগানো একটা বাসা। এই ট্রেইলারের ওপরে, নিচে, ডানে, বামে—সব দিক দিয়ে নানা রকম যন্ত্রপাতি বের হয়ে আছে। ট্রেইলারের দরজা দিয়ে লোকজন ভেতরে ঢুকছে এবং বের হচ্ছে। একসময় সে দেখল তার আব্বু-আম্মু, টোটন আর এলিয়েন তিতুনি সেখানে ঢুকল। সে খুবই উত্তেজিত হয়ে কী হয় দেখার জন্য তাকিয়ে রইল। যে এলিয়েন তিতুনিকে ধরার জন্য এত আয়োজন, সেই এলিয়েন তিতুনি নিজেই এই ট্রেইলারে ঢুকেছে। তিতুনি অনেকক্ষণ প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে জানালার পাশে ঘাপটি মেরে ট্রেইলারের দিকে তাকিয়ে রইল। অনেকক্ষণ পর তিতুনি দেখল এলিয়েন তিতুনি বেশ হেলতে-দুলতে ট্রেইলার থেকে বের হয়ে এল। তার মানে এই মহা ধুরন্ধর এলিয়েন তিতুনি সবাইকে বোকা বানিয়ে রেখেছে। এত দুঃখের মাঝেও তিতুনির একটু হাসি পেয়ে গেল।

তিতুনি দেখল এলিয়েন তিতুনি বাসার চাবিটা আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে বাসার দিকে আসছে, তার মতলবটা কী কে জানে? বাসার সিঁড়ি দিয়ে উঠে সে তালাটা খুলল, তারপর গলা উঁচু করে ডাকল, ‘তিতুনি’!

তিতুনি এক মুহূর্ত ইতস্তত করে উত্তর দিল, ‘কী হয়েছে?’

‘তুমি বের হয়ে এসো।’

‘কেন?’

‘সবাই তোমার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে।’

‘কেন?’

‘এরা আগে কখনো এলিয়েন দেখে নাই। এলিয়েন দেখতে চায়।’

তিতুনি প্রায় বলেই ফেলছিল, ‘এলিয়েন কি আমি, না তুমি?’

কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলল না, এই ধুরন্ধর মেয়েটার নিশ্চয়ই কোনো চালাকি আছে। বলল, ‘ঠিক আছে আসছি। জামাটা বদলে আসি।’

এলিয়েন তিতুনি বলল, ‘না না, জামা বদলাতে হবে না। যেভাবে আছ সেভাবে বের হয়ে আসো। সবাই অপেক্ষা করছে। আব্বু, আম্মু আর টোটনও তোমাকে দেখতে চায়।’

মেয়েটার কথা শুনে তিতুনির পিত্তি জ্বলে যাওয়ার অবস্থা—তার নিজের আব্বু, আম্মু আর ভাই নাকি তাকে দেখতে চায়। একবার নিরিবিলি পেয়ে নিক, তখন এই মেয়েটাকে সে বোঝাবে মজা!

যদিও এলিয়েন তিতুনি বলেছে, যেভাবে আছে সেভাবেই যেন বের হয়ে আসে কিন্তু তিতুনি তারপরও চুলটা আঁচড়ে নিল, তার লাকি টি-শার্টটা পরে নিল (এই টি-শার্ট পরে থাকলে সাধারণত তার বিপদ-আপদ কম হয়)। বাসা থেকে বের হয়ে দেখল এলিয়েন তিতুনি সিঁড়ির ওপর বসে তার জন্য অপেক্ষা করছে। সে ইচ্ছে করলেই বাসার ভেতরে ঢুকতে পারত, কিন্তু ঢোকেনি, এর পেছনে কোনো কারণ আছে কি না কে জানে।

তিতুনি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই এলিয়েন তিতুনি হাসি হাসি মুখে বলল, ‘দেখছ, তোমাকে দেখার জন্য সবাই কীভাবে অপেক্ষা করছে?’

‘আমাকে দেখার জন্য?’

‘হ্যাঁ।’ এলিয়েন তিতুনি হাত দিয়ে দেখাল, ‘কত যন্ত্রপাতি তোমার দিকে তাক করে রেখেছে দেখেছ?’

তিতুনি মাথা নাড়ল, এই মেয়েটা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে সে যেন কোনো বেফাঁস কথা না বলে, এই যন্ত্রপাতি দিয়ে শুনে ফেলবে। তিতুনি তাই কোনো কথা বলল না, মুখ শক্ত করে এলিয়েন তিতুনির দিকে তাকিয়ে রইল।

এলিয়েন তিতুনি বলল, ‘চলো যাই।’

‘চলো।’

তারা হেঁটে হেঁটে ট্রেইলারের দিকে যেতে থাকে।

ট্রেইলারের দরজার কাছে আম্মু প্রায় ছুটে এসে তিতুনিকে ধরলেন, চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘মা, তুই কোন দূর গ্রহ থেকে এসেছিস এখানে, আমার বাসায়; একবার আমাকে সেই কথাটা বলবি না?’ তিতুনির বুদ্ধি শুনে তুই সারাক্ষণ ঘরের ভেতর লুকিয়ে থাকলি? কী খেয়েছিস, কোথায় ঘুমিয়েছিস কিছু জানি না মা—’

তিতুনির ইচ্ছে হলো বলে, ‘আম্মু, আমি মোটেও দূর গ্রহ থেকে আসিনি, আমি তোমার সত্যিকারের মেয়ে তিতুনি! যে ফাজিল মেয়েটাকে তুমি তোমার নিজের মেয়ে ভাবছ, সে হচ্ছে ধুরন্ধর এলিয়েন, সবাইকে ঘোল খাওয়াচ্ছে—’ কিন্তু সত্যি সত্যি তো আর এই কথাগুলো বলা সম্ভব না, তাই মুখের মাঝে একটা এলিয়েন এলিয়েন ভাব ধরে রেখে দাঁড়িয়ে রইল।

আব্বু গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘মা, তোমার কোনো কষ্ট হয়নি তো?’ আব্বু সারাজীবন তিতুনিকে তুই করে বলে এসেছেন, এখন তুমি করে বলছেন! কপাল আর কাকে বলে। টোটন কোনো কথা না বলে চোখ বড় বড় করে তিতুনির দিকে তাকিয়ে রইল।

নাহার তখন তাদের তাড়া দিল, বলল, ‘সবাই ট্রেইলারের ভেতরে চলে আসেন।’

আম্মু তিতুনির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কথা বলতে থাকলেন, বললেন, ‘কী আশ্চর্য মা, তুই কেমন করে হুবহু আমার মেয়ের মতো হয়ে গেলি? এক বিন্দু পার্থক্য নাই, ঘাড়ে তিলটা পর্যন্ত আছে!’

তিতুনি মনে মনে একটা নিশ্বাস ফেলল, সারা জীবন এই তিলটা ছিল, সেটি এখন কোথায় যাবে? আম্মুকে এই মুহূর্তে সেটা বোঝাবে কেমন করে?

ট্রেইলারের ভেতর ঢোকার সাথে অনেক ধরনের যন্ত্রপাতি চালু হয়ে গেল, বিচিত্র শব্দ করতে শুরু করল। শামীম তিতুনিকে ট্রেইলারের এক কোনায় যন্ত্রপাতি দিয়ে বোঝাই একটা চেয়ার দেখিয়ে সেখানে বসতে বলল। তিতুনি মাথা ঘুরিয়ে এলিয়েন তিতুনির দিকে তাকাল, এলিয়েন তিতুনি সাথে সাথে বলল, ‘যাও। বসো চেয়ারটাতে। আমি সবার সাথে কথা বলে রেখেছি, কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করবে না।’

তিতুনি চেয়ারটাতে বসল, দেখে বোঝা যায় না কিন্তু চেয়ারটাতে বসতে খুব আরাম। আশপাশে চারিদিকে নানা রকম যন্ত্রপাতি। শামীম ওপর থেকে টেনে একটা হেলমেট নিচে নামিয়ে এনে তার মাথার মাঝে পরিয়ে দিল, সাথে বাইরের নানা ধরনের শব্দ কমে গিয়ে শুধু শোঁ শোঁ একটা শব্দ শুনতে পায়। চেয়ারের হাতলে তিতুনির দুটো হাত রাখা ছিল, দুটো যন্ত্র এসে হাত দুটোকে হাতলের সাথে আটকে ফেলল। তিতুনি টের পেল তার পা দুটোকেও একই কায়দায় আটকে দেওয়া হয়েছে। বুকের ওপর দুই পাশ থেকে দুটো চতুষ্কোণ যন্ত্র এসে আড়াআড়িভাবে তাকে আটকে ফেলেছে। তিতুনির বুকটা ধুকপুক করতে থাকে, এখান থেকে সে ছুটে বের হতে পারবে তো? সে নিজে বের হতে না পারলেও এলিয়েন মেয়েটা নিশ্চয়ই তাকে বের করে নেবে।

তিতুনি টের পেল তার শরীরের সবকিছু পরীক্ষা করতে শুরু করেছে, হেডফোনে নানা ধরনের শব্দ শোনা যাচ্ছে, চোখের সামনে নানা রঙের আলো খেলা করছে, শরীরের নানা জায়গায় আলাদা আলাদাভাবে কম্পন টের পাচ্ছে। মানুষগুলো নিশ্চয়ই কিছুক্ষণের মাঝে বুঝে যাবে সে মোটেই এলিয়েন নয়, একজন খুবই ফালতু মানুষ, তখন তারা কী করবে?

তিতুনি দেখল বিদেশি মানুষ দুজন অন্যদের সাথে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে, তখন তারা আব্বু-আম্মু আর অন্যদের কাছে এসে দাঁড়াল। নাহার বলল, ‘আমরা এখন এই এলিয়েন মেয়েটির ওপর কিছু টেস্ট করব—এই সময়টাতে আপনাদের এই ট্রেইলারে থাকা ঠিক হবে না।’ আব্বু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন?’ এলিয়েন তিতুনি জিজ্ঞেস করল, ‘টর্চার করবেন নাকি?’ নাহার জোরে জোরে মাথা নাড়ল, ‘না না! টর্চার করব কেন? টেস্টগুলো করার সময় এলিয়েনের মনোযোগ এক জায়গায় থাকতে হবে। ট্রেইলারে পরিবারের সবাই থাকলে, সেটা সম্ভব হচ্ছে না।’ আম্মু জানতে চাইল, ‘কতক্ষণ টেস্ট করবেন?’ ‘আমরা তো চাইব ঘণ্টার পর ঘণ্টা! কিন্তু সেটা ঠিক হবে না। শুরুতে আধা ঘণ্টার একটা সেশন নেব।’ ‘আমরা বাসায় অপেক্ষা করি?’ শামীম বলল, ‘না, আপনারা বাসায় যেতে পারবেন না। আপনাদের বাসা কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছে।’ টোটন ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী করে রাখা হয়েছে?’ ‘কোয়ারেন্টাইন। কেউ যেতে-আসতে পারবে না। বাসা সিল করে দেওয়া হয়েছে।’ আব্বু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আমার সাথে কথা না বলে আমার বাসা সিল করে দেওয়া হয়েছে মানে?’ শামীম মুখ শক্ত করে বলল, ‘এখানে যে টিম এসেছে, তারা কত পাওয়ারফুল আপনারা বুঝতে পারছেন না। ড. গার্নার আর ড. ক্লাইডকে প্রোটেকশন দেওয়ার জন্য ইউএস মেরিনকে এয়ারলিফট করা হচ্ছে।’ আব্বু বললেন, ‘আমার সেটা জানার প্রয়োজন নেই। আমার বাসাকে সিল করে দেওয়ার আগে আমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন আছে। যখন আমি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।’ নাহার মুখ সুচালো করে বলল, ‘ড. গার্নার আর ড. ক্লাইডের ডিসিশন—’ এলিয়েন তিতুনি বলল, ‘ড. গার্নার আর ড. ক্লাইডের খেতা পুড়ি। তাই না আব্বু?’ আব্বু এলিয়েন তিতুনিকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘তুই কেন বড়দের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছিস?’ আম্মু আব্বুকে বললেন, ‘এরা যখন চাইছে না আমরা এখানে থাকি, তাই চলো আমরা বাইরে যাই।’

আব্বু বললেন, ‘বাইরে কোথায় যাব? জার্নি করে এসেছি, হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হওয়ার ব্যাপার আছে। বাচ্চারা কিছু খায়নি—’ নাহার বলল, ‘পাশে আরেকটা ট্রেইলার আছে, সেখানে বাথরুম আছে। স্ন্যাক আছে, চা-কফি আছে, রেস্ট নেওয়ার ব্যবস্থা আছে, দরকার হলে শুতেও পারবেন। আপনাদের সেখানেই রেস্ট নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’ জটিল যন্ত্রপাতিবোঝাই একটা চেয়ারে তিতুনিকে রীতিমতো বেঁধে আটকে রাখা হয়েছে, সেখান থেকে তিতুনি করুণ চোখে আব্বু-আম্মু আর টোটনের দিকে তাকাল। এলিয়েন তিতুনি তার দিকে তাকিয়ে ছিল, তার মুখে একটা ফিচেল হাসি, তিতুনির মনে হলো এই হইচইয়ের মাঝেই সে সূক্ষ্মভাবে একবার চোখ টিপে দিয়েছে—সেটাই ভরসা। দরকার হলে এই ধুরন্ধর মেয়েটা নিশ্চয়ই তাকে উদ্ধার করবে। ট্রেইলার থেকে বের হয়ে যখন আব্বু, আম্মু, টোটন আর এলিয়েন তিতুনি পাশের ট্রেইলারের দিকে যাচ্ছে, তখন টোটন গলা নামিয়ে এলিয়েন তিতুনিকে বলল, ‘তিতুনি—’ ‘বল ভাইয়া।’ ‘আমি কি তোর সাথে একটু নিরিবিলি কথা বলতে পারি?’ ‘আমার সাথে?’ এলিয়েন তিতুনি একটু অবাক হয়ে টোটনের দিকে তাকাল। ‘হ্যাঁ। আয়, আমাদের বাসার সিঁড়িতে গিয়ে বসি।’ ‘চল।’ তখন দুজন হেঁটে হেঁটে গিয়ে তাদের সিঁড়িতে গিয়ে বসল। টোটন কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল, তার আঙুলগুলো পরীক্ষা করে বলল, ‘এই যে পৃথিবীতে একটা এলিয়েন চলে এসেছে, এইটা অনেক বড় একটা ঘটনা—চিন্তার বাইরের ঘটনা। তুই ছাড়া দুনিয়ার আর কেউ সেটা জানত না। তুই নিশ্চয়ই খুব ভালো করে সবকিছু করেছিস, সে জন্য এলিয়েনের সাথে তোর এত খাতির হয়েছে। এত বন্ধুত্ব হয়েছে।’

টোটন কয়েক সেকেন্ড থেমে আবার শুরু করল, ‘তুই একটা জিনিস লক্ষ করেছিস? গতকাল যে আমরা ঢাকায় গিয়েছি, এই ট্রিপে অনেক কিছু ঘটেছে—কোনোটাই ঠিক স্বাভাবিক না? পাগল ড্রাইভারের কারণে আমরা আরেকটু হলে মরেই যেতাম, মাইক্রোবাসটা রেললাইনে আটকে গিয়েছিল, একেবারে শেষ মুহূর্তে কী রকম হঠাৎ করে যেন ছুটে এল, মনে আছে?’

অন্য তিতুনি মাথা নাড়ল। টোটন বলল, ‘আমার স্পষ্ট মনে হচ্ছিল কেউ যেন ধাক্কা দিয়ে মাইক্রোবাসটা সরিয়ে দিয়েছে। যা-ই হোক, তারপর ধর ড্রাইভারের ব্যাপারটা। হঠাৎ করে সে ড্রাইভিং ভুলে গেল। এটা কি কখনো সম্ভব যে একজন মানুষের অন্য সবকিছু মনে আছে কিন্তু শুধু ড্রাইভিংটা ভুলে গেছে? দেখে কি মনে হয় না যে কেউ একজন তার মাথার ভেতরে ঢুকে শুধু ড্রাইভিংয়ের অংশটা মুছে দিয়েছে?’

অন্য তিতুনি মাথা নেড়ে স্বীকার করে নিল।

টোটন বলতে থাকল, ‘তারপর ধর সিএনজি স্টেশনে সেই মানুষটার কথা। ডিম বিক্রি করা মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার পর তাকে আচ্ছামতো একটা শাস্তি দিল কে? অনেকগুলো কাক। এটা কি সম্ভব? সম্ভব না। কিছুতেই সম্ভব না। কিন্তু আমি নিজের চোখে দেখেছি, আমাকে বিশ্বাস করতেই হবে। বুঝেছিস?’

অন্য তিতুনি মাথা নাড়ল, বলল, ‘বুঝেছি।’

টোটন কয়েক সেকেন্ড অন্য তিতুনির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এরপর ধরা যাক বড় ফুপুর বাসার ঘটনা। পৃথিবীতে কেউ কখনো শুনেছে একটা কম্পিউটার গেম যখন খেলা হচ্ছে তখন খেলার মাঝখানে সেটা পাল্টে গিয়ে অন্য রকমভাবে খেলতে শুরু করেছে? সব গ্রাফিকস পর্যন্ত বদলে গেছে? এটা কি কখনো সম্ভব? সম্ভব না, কিন্তু বড় ফুপুর বাসায় এটা ঘটেছে। আমাদের চোখের সামনে সেটা ঘটেছে। নিজের চোখে দেখলে বিশ্বাস না করে উপায় কী?’

টোটন এক সেকেন্ড থামল তারপর কেমন যেন অপরাধীর মতো ভান করে বলল, ‘এর পরের ব্যাপারটা আমাদের করা উচিত হয়নি। তোকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমরা প্ল্যান করে ডাইনিং টেবিলে তোর প্লেটে এক খাবলা লবণ দিয়ে দিলাম আর সেই লবণ সব হাজির হলো আমার প্লেটে! শুধু যে হাজির হলো তা-ই না—এক শ গুণ বেশি তিতা হয়ে হাজির হলো। কীভাবে হলো এটা?’

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

অন্য তিতুনি কোনো কথা না বলে টোটনের দিকে তাকিয়ে রইল। টোটন চোখ সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আবার কথা শুরু করল, বলল, ‘এর পরের ঘটনাটা খুবই লজ্জার। চিন্তা করলেই লজ্জায় আমার শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে! সেই কাজটা করার চেষ্টা করা আমাদের একেবারেই ঠিক হয়নি। আমি, নাদু আর দিলু মিলে ঠিক করলাম রাতে তুই যখন ঘুমিয়ে থাকবি, তখন আমরা তোর বিছানায় এক গ্লাস পানি ঢেলে দেব যেন তুই বিছানা ভিজিয়ে দিয়েছিস। আসলে হলো কী? ঘুমানোর আগে আমাদের তিনজনের পানির তৃষ্ণা পেয়ে গেল, সে কী পানির তৃষ্ণা! এক গ্লাস না, দুই গ্লাস না, তিন-তিন গ্লাস পানি খেয়ে তখন শান্তি। তারপর কী হলো? একজন বা দুইজন বা তিন-তিনজন রীতিমতো বড় মানুষ একই সাথে বিছানায় পেশাব করে দিলাম! এটা কি বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা? এটা কি কখনো হতে পারে?’

অন্য তিতুনি মাথা নাড়ল, স্বীকার করে নিল যে এটা হতে পারে না। টোটন তখন ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘তুই দেখেছিস, এইবার কতগুলো এই রকম অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে?’

অন্য তিতুনি মাথা নাড়ল, বলল, ‘দেখেছি’। তারপর টোটনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখান থেকে তুমি কী বলতে চাইছ ভাইয়া।’

‘আমি বলতে চাইছি—’ টোটন মাথা চুলকে বলল, ‘আমি জানি কথাটা খুবই হাস্যকর শোনাবে, তবুও বলি। আমি বলতে চাইছি আসল তিতুনিকে বাসায় রেখে, এলিয়েন তিতুনি আমাদের সাথে ঢাকা গিয়েছিল।’

অন্য তিতুনির মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে, ‘মানে—’

‘মানে তুই হচ্ছিস এলিয়েন। আর ট্রেইলারের ভেতর আসল তিতুনি এখন ভুজুং ভাজুং করে সবাইকে বোকা বানাচ্ছে।’

অন্য তিতুনি কিছুক্ষণ টোটনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাইয়া, তুমি ঠিকই ধরেছ। আমি আসলে এলিয়েন!’

টোটন কেমন যেন শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল, বলল, আসলেই তুই—মানে তুমি—মানে আপনি—’

অন্য তিতুনি হি হি করে হেসে বলল, ‘ভাইয়া, আমাকে তোমার আপনি করে বলতে হবে না। আমি আসলে একেবারে হানড্র্রেড পার্সেন্ট তিতুনির কপি, বলতে পারো আগে একটা তিতুনি ছিল, এখন দুইটা।’

টোটন কেমন যেন বস্ফািরিত চোখে অন্য তিতুনির দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, ‘তার মানে আসলে আমি বিছানায় পিশাবই করি নাই—তুমি—মানে তুই আমাকে পিশাব করিয়েছিস?’

‘হ্যাঁ। আমি করিয়েছি।’

টোটন চোখ দুটো বড় বড় করে বলল, ‘তার মানে অন্য একটা গ্যালাক্সি থেকে আসা একটা এলিয়েনের বড় কোনো কাজ নেই? তার কাজ হচ্ছে—’

অন্য তিতুনি হি হি করে হেসে বলল, ‘ভাইয়া, তুমি একটা জিনিস ভুলে যাচ্ছ। এখানে আসার পর এলিয়েনটা আর এলিয়েন নাই, সে তিতুনি হয়ে গেছে। তিতুনির মতো দেখতে একটা প্রাণী না, পুরোপুরি তিতুনি। এখানে তিতুনির যে কাজ সেটা হয়ে গেছে এলিয়েনের কাজ! আসল তিতুনি অনেক কিছু পারে না, আমি পারি। এই হচ্ছে পার্থক্য।’ কথা বলতে বলতে হঠাৎ এলিয়েন তিতুনি থেমে গেল, হাত তুলে বলল, ‘এক সেকেন্ড।’

‘কী হয়েছে?’

‘ট্রেইলারের ভেতরে ওই ফাজিল মানুষগুলো তিতুনিকে একটা বাজে ইনজেকশন দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমি ইনজেকশনটাকে নিউট্রালাইজ করে দিই।’

টোটন ভয়ে ভয়ে বলল, ‘কী ইনজেকশন?’

‘ওরা বলছে, ট্রুথ সিরাম। এটা দিলে মনের জোর ভেঙে যাবে, যেটাই বলবে তিতুনিকে, সেটাই করতে হবে। ফাজলেমি পেয়েছে?’

এক সেকেন্ড পরে এলিয়েন তিতুনি টোটনের দিকে তাকাল, তারপর বলল, ‘হ্যাঁ। নিউট্রাল করে দিয়েছি। এখন বরং উল্টো কাজ হবে, তিতুনির ভেতরে কোনো ভয়-ডর থাকবে না।’

টোটন কেমন যেন হাঁ করে এলিয়েন তিতুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, ‘কী আশ্চর্য! আমি একটা এলিয়েনের পাশে বসে আছি! এলিয়েন!’

এলিয়েন তিতুনি বলল, ‘এখন তুমি কী করবে? আমাকে ধরিয়ে দেবে?’

টোটন গলা উঁচিয়ে বলল, ‘ধরিয়ে দেব? ধরিয়ে দেব কেন? এইটা সত্যি, এত দিন আমি তিতুনিকে কোনো পাত্তা দেই নাই, উঠতে-বসতে জ্বালিয়েছি। আর আমার এই বোকাসোকা বোনটা একটা এলিয়েনের সাথে খাতির করে সারা পৃথিবীর সবাইকে বোকা বানাচ্ছে, আর আমি তাকে ধরিয়ে দেব? তুই আমাকে তাই ভাবলি?’

এলিয়েন তিতুনি তখন কোনো কথা না বলে তার ডান হাতটা ওপরে তুলল, টোটন তখন সেখানে একটা হাই ফাইভ দিল! প্রথমবার ভাইবোনে বন্ধুত্ব হয়ে গেল, যদিও অরিজিনাল না, তবুও তো ভাইবোন।

টোটন কিছুক্ষণ একা একা বসে বসে হাসল, তারপর বলল, ‘তুই এখন কী করবি?’

এলিয়েন তিতুনি বলল, ‘চলে যাব।’

টোটন কেমন যেন চমকে উঠল, বলল, ‘চলে যাবি?’

‘হ্যাঁ।’

‘কেন? চলে যাবি কেন?’

‘সব জানাজানি হয়ে গেছে, এখন আর থাকা যাবে না। এটা আমাদের নিয়ম, কোথাও গেলে সেখানে জানাজানি হতে পারবে না।’

‘কিন্তু—’ টোটন প্রায় হাহাকার করে বলল, ‘কোন গ্যালাক্সি থেকে এসে পৃথিবীর কিছুই দেখলি না, জানলি না, আমার সাথে ঝগড়াঝাটি করে সময় কাটিয়ে দিলি—’

এলিয়েন তিতুনি বলল, ‘কে বলেছে কিছু দেখি নাই? এই পৃথিবীর সবচেয়ে দরকারি জিনিসগুলো জেনে গেছি।’

‘কী দরকারি জিনিস?’

‘এই যে মানুষ কীভাবে চিন্তা করে। একজন আরেকজনের সাথে ঝগড়া করে, আসলে ভেতরে ভেতরে ভালোবাসে! কোনো কারণ ছাড়া হি হি করে হাসে। কী অদ্ভুত!’

‘কিন্তু পৃথিবীর কত রকম যন্ত্রপাতি, কত আবিষ্কার—’

এলিয়েন তিতুনি বলল, ‘দূর! এইগুলা কোনো আবিষ্কার নাকি? সব খেলনা। সেই খেলনা নিয়ে কী অহংকার! ট্রেইলারের ভেতরে ছাগলগুলো ভাবছে তিতুনিকে আটকে ফেলে তার কাছ থেকে সবকিছু বের করে ফেলবে। এই কাঁচকলা।’ বলে তিতুনি তার হাত দিয়ে কাঁচকলা বানিয়ে দেখাল।

টোটন বলল, ‘তুই চলে যাবি?’

‘হ্যাঁ।’

‘কখন?’

‘এই তো কয়েক মিনিটের ভেতরে।’

টোটন চিৎকার করে উঠল, ‘কয়েক মিনিটের ভেতর?’

‘হ্যাঁ। আমি আমার স্পেসশিপে যোগাযোগ করেছি। তারা ব্যবস্থা করছে।’

টোটন কেমন যেন অবাক হয়ে এলিয়েন তিতুনির দিকে তাকিয়ে রইল, প্রায় কান্না কান্না গলায় ফিসফিস করে বলল, ‘তুই চলে যাবি?’

‘হ্যাঁ ভাইয়া। তিতুনি থাকবে—শুধু আমি চলে যাব। আমি তো আরেকটা তিতুনি ছাড়া কিছু না, সেই তিতুনি তো আছেই!’

শামীম তিতুনিকে বলল, ‘আমরা তোমার লাইফ ফর্মে সব রকম টেস্ট করেছি। তুমি যদিও এলিয়েন কিন্তু স্বীকার করতেই হবে তুমি মানুষের নিখুঁত রেপ্লিকা। আমরা এখনো কোনো বিচ্যুতি পাইনি। কাজেই আমরা একজন মানুষের সাথে যেভাবে যোগাযোগ করার কথা, তোমার সাথে সেভাবে যোগাযোগ করছি।’

তিতুনি কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। এবার নাহার বলল, ‘একজন এলিয়েন হয়ে তুমি যে হুবহু মানুষের একটা ফর্ম নিয়েছ, সেটা একদিক দিয়ে আমাদের জন্য ভালো, অন্যদিক দিয়ে আমাদের জন্য অনেক বড় সমস্যা।’

মাথাভরা পাকা চুল বিদেশিটা ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা বলল, নাহার মাথা নাড়ল, তারপর তিতুনির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এলিয়েন হয়ে তুমি শুধু যে মানুষের ফর্ম নিয়েছ তা নয়, তুমি বারো বছরের একটা বাচ্চা মেয়ের ফর্ম নিয়েছ, শুধু যে শারীরিক ফর্ম তা নয়, তোমার মানসিক ফর্ম বারো বছরের, বুদ্ধিমত্তা বারো বছরের। তোমার সাথে যোগাযোগ করতে হলে বারো বছরের বাচ্চার সাথে যেভাবে কথা বলার কথা, সেভাবে কথা বলতে হয়। এখন পর্যন্ত তোমার ভেতরে এলিয়েনসুলভ ক্ষমতার কোনো চিহ্ন আমরা পাইনি।’

তিতুনি মনে মনে বলল, ‘কেমন করে পাবে! আমি যদি এলিয়েন হতাম তাহলে না পেতে!’ মুখে কোনো কথা না বলে মাছের মতো চোখে সবার দিকে তাকিয়ে রইল।

পাকা চুলের মানুষটা নাহারকে আবার কিছু একটা বলল, নাহার সেটা শুনে তিতুনিকে সেটা বোঝাতে থাকে, প্রফেসর বব ক্লাইড বলছেন তাঁর ধারণা ছিল একজন এলিয়েন যখন মানুষের ফর্ম নেয় তখন বাইরের ফর্মটা নেয়। ভেতরের ফর্মটা ঠিক থাকে। তোমার বেলা সেটা পাওয়া যাচ্ছে না; তুমি ইউনিভার্সাল ল্যাঙ্গুয়েজ বোঝো না, সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বোঝো না ইংরেজি কিংবা ফ্রেঞ্চও বোঝো না। তোমার সাথে শুধু বাংলায় কথা বলতে হয়।’

শামীম বলল, ‘আমরা বাংলাতেই বলব, কোনো সমস্যা নেই।’

এবার ন্যাড়া মাথা মানুষটা কিছু একটা বলল, শামীম সেটা তিতুনিকে অনুবাদ করে শোনাল, ‘কিন্তু তুমি যেহেতু এলিয়েন কাজেই এলিয়েনের নীল নকশা তোমার ভেতরে আছে। কোথাও না কোথাও কোড করা আছে। আমাদের সেটা দরকার।’

নাহার বলল, ‘আমরা তোমার শরীরের বাইরে থেকে স্যাম্পল নিয়েছি, এবারে ভেতর থেকে স্যাম্পল নেব। হার্ট কিডনি লিভার লাংস এবং ব্রেন টিস্যু।’

তিতুনি আঁতকে উঠল, বলে কী এরা? এখন তাকে কেটেকুটে ফেলবে? সে চোখ বড় বড় করে মানুষগুলোর দিকে তাকাল।

বিদেশিগুলো হড়বড় করে আরও কিছুক্ষণ কথা বলল, তারপর নাহার আর শামীম সেগুলো অনুবাদ করে শোনাতে লাগল। তারা বলল, ‘তোমার মস্তিষ্কের টিস্যু স্যাম্পল নেওয়ার জন্য তোমার খুলিতে ড্রিল করতে হবে, সত্যিকারের মানুষের বেলাতে কখনোই এ রকম একটা কিছু চেষ্টা করা হতো না—কিন্তু তুমি যেহেতু সত্যিকার মানুষ নও, তুমি যেহেতু একটা এলিয়েন, তোমার বেলায় এটা চেষ্টা করতে আইনগত কোনো বাধা নেই।’

‘তুমি যেহেতু বারো বছরের একটা শিশুর ফর্ম নিয়েছ, তোমাকে অচেতন করেই আমাদের এই প্রক্রিয়াটা করা উচিত, কিন্তু আমরা তোমাকে অচেতন করব না দুটি কারণে। বিষয়টিতে যদি তুমি বাধা দিতে চাও তাহলে তোমাকে কোনো একধরনের এলিয়েন শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। আমরা সেটি দেখতে চাই, আমরা সেটি রেকর্ড করতে চাই।

‘এ ছাড়াও দ্বিতীয় কারণটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কখনো ভাবিনি তোমাকে আমরা আটকে ফেলতে পারব। কিন্তু আমরা খুবই অবাক হয়ে লক্ষ করেছি আমরা আমাদের যন্ত্রপাতি দিয়ে তোমাকে আটকে ফেলতে পেরেছি। আমাদের আরও কিছু যন্ত্রপাতি আছে, আমরা তোমার ওপর সেগুলো ব্যবহার করতে চাই। আশা করছি বিজ্ঞানের গবেষণায় আমরা তোমার সহায়তা পাব।’

কথা শেষ করে শামীম তার মাথায় লাগানো হেলমেটটার দিকে এগিয়ে গেল। তিতুনি হঠাৎ একধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। সে ধরেই নিয়েছিল বিপদের সময় এলিয়েন তিতুনি তাকে সাহায্য করবে। কিন্তু এরা তার মাথায় ড্রিল করতে চলে আসছে, এখনো এলিয়েন তিতুনির দেখা নেই, ব্যাপারটা কী? তিতুনি তখন গরম হয়ে বলল, ‘তুমি খালি আমার মাথায় ড্রিল করার চেষ্টা করে দেখ, আমি যদি তোমাদের ঠ্যাং ভেঙে না দেই—!’

তিতুনির কথাটা শেষ হওয়ার আগেই খটাশ করে একটা শব্দ হলো আর ডক্টর শামীম ধরাম করে নিচে পড়ে গেল, নিজের পা ধরে তপন সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে। নাহার আর তার সাথে অন্যরাও তার কাছে ছুটে এল, নাহার জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে? কী হয়েছে?’

‘পা, আমার পা!’

‘কী হয়েছে তোমার পায়ের?’

‘মনে হয় ভেঙে গেছে—‘মনে হয় এলিয়েনটা আমার পা ভেঙে দিয়েছে!’

তিতুনি অবাক হয়ে বলল, ‘আমি মোটেও তোমার পা ভাঙিনি—শুধু বলেছি ভেঙে দেব।’

শামীম তখন সাবধানে তার পা নাড়াল, তারপর ভাঙা গলায় বলল, ‘না ভাঙে নাই। কিন্তু আমার মনে হলো ভেঙে গেছে—মটাশ করে শব্দ হলো।’

বিদেশি দুইজন তখন শামীমের হাত ধরে তাকে দাঁড় করাল। নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে শামীম ভয়ে ভয়ে তিতুনির দিকে তাকাল। বিদেশি দুইজন তখন গলা নামিয়ে নিজেদের ভেতর কিছুক্ষণ কথা বলল, তারপর চোখের কোনা দিয়ে তিতুনিকে দেখল। তারপর নাহারকে বলল, ‘তুমি একটা সিরিঞ্জে করে দশ মিলিগ্রাম রিটাটিল নিয়ে এসো, আমি দেখতে চাই এই এলিয়েনটাকে অচেতন করা যায় কি না।’

নাহার ইতস্তত করে বলল, ‘কাজটা কি ঠিক হবে?’

বিদেশিগুলো বলল, ‘অবশ্যই ঠিক হবে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাঝে কোনো শর্টকাট নাই।’

তিতুনি বিদেশির কথাগুলো বুঝতে পারেনি কিন্তু তাদের ভাবভঙ্গি দেখে অনুমান করল তাকে নিয়ে তারা কিছু একটা আপত্তিকর কাজ করতে যাচ্ছে। সে চোখ পাকিয়ে বলল, ‘তোমরা কী করতে চাইছ?’

টিশটাশ ডক্টর নাহারকে এখন খুব টিশটাশ দেখাচ্ছে না, সে একটু ভয়ে ভয়ে বলল, ‘রিক গার্নার আর বব ক্লাইড তোমাকে অচেতন করার জন্য তোমার শরীরে রিটাটিল পুশ করার কথা চিন্তা করছেন।’

তিতুনি বলল, ‘তুমি এই বুড়া আর টাক্কুকে বলো কাজটা ভালো হবে না।’

‘কেন? কেন ভালো হবে না?’

‘আমি তাহলে তোমাদের সব যন্ত্রপাতি ভেঙে গুঁড়া করে দেব।’

তিতুনির কথা শেষ হওয়ার আগেই ঠাশ ঠাশ শব্দ করে কয়েকটা মনিটর ফেটে গেল। দেয়ালে লাগানো কয়েকটা যন্ত্র রীতিমতো বিস্ফোরণ করে সত্যি সত্যি গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল। ট্রেইলারের ভেতরে কালো ধোঁয়া আর পোড়া গন্ধে ভরে যায়।

ড. নাহার বুকে হাত দিয়ে বলল, ‘হায় খোদা!’ বিদেশি দুইজন একজন আরেকজনের হাত ধরে বলল, ‘ও মাই গড!’

মানুষগুলোকে দেখে তিতুনির হাসি পেয়ে যায়, কিন্তু সে হাসল না। মুখ শক্ত করে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। এলিয়েন তিতুনি তাকে ছেড়ে যায়নি—ট্রেইলারের বাইরে থেকেও ভেতরে কী হচ্ছে সেটা লক্ষ করছে! সে যেটাই বলছে সেটাই করে ফেলছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে তাকে নিয়ে কোনো দুই নম্বরি কাজ করা চলবে না।

সবাই যখন ভয়ে ভয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে তখন ট্রেইলারের এক কোনা থেকে একজন ইংরেজিতে বলল, ‘খুব আজব একটা জিনিস হচ্ছে।’

ন্যাড়া মাথা রিক গার্নার শুকনো গলায় জানতে চাইল, ‘কী হচ্ছে?’—

‘যন্ত্রপাতিগুলো উল্টাপাল্টা কাজ করছে।’

‘কী রকম উল্টাপাল্টা?’

‘মনে হচ্ছে কমিউনিকেশনস মডিউলে কোনো কন্ট্রোল নাই। পুরো ট্রেইলারের সব যন্ত্রপাতি থেকে পাওয়ার নিয়ে যাচ্ছে।’

‘পাওয়ার নিয়ে কী করছে?’

‘অ্যান্টেনা দিয়ে একটা সিগনাল পাঠাচ্ছে।’

‘কী রকম সিগন্যাল?’

‘মনে হচ্ছে কোনো এক ধরনের সংখ্যার সিকোয়েন্স।’

ট্রেইলারের সব যন্ত্রপাতি থেকে পাওয়ার নিয়ে নেওয়ার কারণে যন্ত্রপাতিগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। ট্রেইলারের আলোও আস্তে আস্তে কমে কেমন জানি নিবুনিবু হয়ে আসে।

কে যেন জিজ্ঞেস করল, ‘কী হচ্ছে এখানে?’

মাথা ন্যাড়া বিদেশিটা বলল, ‘মনে হয় এলিয়েনটা আমাদের অ্যান্টেনা দিয়ে তার মাদারশিপের সাথে যোগাযোগ করছে।’

যদিও বিদেশিদের উচ্চারণ আর কথা বুঝতে তিতুনির সমস্যা হচ্ছিল কিন্তু এই কথাটা সে বুঝতে পারল এবং বুঝে সে চমকে উঠল। এলিয়েন তিতুনি তার মাদারশিপের সাথে যোগাযোগ করছে, তাহলে কি সে এখন চলে যাবে? আগেই বলেছিল পৃথিবীতে সে যে এসেছে সেটা সে জানাজানি করতে চায় না, এখন সেটা জানাজানি হয়ে গেছে এখন নিশ্চয়ই আর থাকবে না। নিশ্চয়ই চলে যাবে। কখন চলে যাবে? কীভাবে চলে যাবে? সে চলে যাওয়ার পর তার কী হবে?

ঠিক তখন মনে হলো ট্রেইলারের বাইরে একটা বজ্রপাত হয়েছে, প্রচণ্ড শব্দে চারিদিক কেঁপে উঠল, বিজলির নীল আলোতে চারপাশ ঝলসে ওঠে। কোনো মেঘ নেই বৃষ্টি নেই কিন্তু তার মাঝে পরিষ্কার বজ্রপাত। বজ্রপাত হলে নীলাভ আলো একবার ঝলসে ওঠার পর শেষ হয়ে যায়, কিন্তু এবার শেষ হলো না। নীল আলো ঝলসাতে লাগল আর বিচিত্র এক ধরনের শব্দ শোনা যেতে লাগল। ট্রেইলারের জানালা দিয়ে ভেতরে সেই আলো খেলা করতে থাকে।

ট্রেইলারের দরজা খুলে সবাই বাইরে তাকায় এবং তিতুনি শুনতে পেল পাকা চুলের বিদেশিটা চিৎকার করে বলল, ‘ও মাই গুডনেস!’

কী দেখে বিদেশিটা চিৎকার করেছে তিতুনি দেখতে পাচ্ছিল না, তাকে যন্ত্রপাতিবোঝাই চেয়ারটাতে বেঁধে রেখেছে বলে সে নড়তেও পারছিল না। ট্রেইলারের দরজা দিয়ে বাইরের দৃশ্যটি দেখে সবাই আবার ভেতরে এসে তিতুনিকে ঘিরে দাঁড়াল। শামীম হিস হিস করে বলল, ‘তুমি এলিয়েন না! তুমি মানুষ। তুমি আমাদের ধোঁকা দিয়েছ!’

ওরা হঠাৎ করে সেটা কেমন করে বুঝতে পারল তিতুনি এখনো জানে না, কিন্তু বিষয়টা যখন জেনেই গিয়েছে তখন সেটা আর গোপন রাখার কোনো অর্থ হয় না। তিতুনি মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ। আমি মানুষ। অন্যজন এলিয়েন।’

‘তুমি আমাদের সে কথাটা কেন বলো নাই?’

‘কেন বলব? তোমরা এত বড় বড় বৈজ্ঞানিক তোমরা কেন নিজেরা সেটা বের করতে পারো না?’

নাহার প্রায় হিংস্র গলায় বলল, ‘তুমি মানুষ হয়ে মানুষের পক্ষে থাকলে না? তুমি মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এলিয়েনের পক্ষে গেলে?’

তিতুনি রেগে গিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ। গিয়েছি, আরও একশবার যাব।’

‘কেন?’

‘কারণ, সে তোমার কাছে এলিয়েন। আমার কাছে মানুষ। খালি মানুষ না, সে পুরোপুরি আমি। আমি আমার পক্ষে থাকব নাকি তোমার পক্ষে থাকব?’

নাহার কী বলবে বুঝতে পারছিল না, তিতুনি বলল, ‘এখন তো জেনে গেছ কে মানুষ কে এলিয়েন। সমস্যাটা কী?’

‘দেরি হয়ে গেছে।’

তিতুনি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, ‘সে কি চলে গেছে?’

‘না এখনো যায়নি। কিন্তু সে একটা শক্তিবলয়ের মাঝে ঢুকে গেছে, তাকে আর আমরা ছুঁতে পারব না।’

তিতুনি তার মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘আমাকে ছেড়ে দাও। আমি ওকে দেখব—কথা বলব।’

নাহার বিদেশি দুটোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখন এই মেয়েটাকে শুধু শুধু আটকে রেখে কী হবে? একে ছেড়ে দিই।’

ন্যাড়া মাথা বিদেশিটার মুখটা দেখতে দেখতে কেমন জানি নিষ্ঠুর হয়ে যায়। সে মাথা নাড়ল, বলল, ‘না। এখন এই মেয়েটা হচ্ছে আমাদের শেষ অস্ত্র। এই মেয়েটাকে ব্যবহার করে আমাদের শেষ চেষ্টা করতে হবে।’

‘কীভাবে শেষ চেষ্টা করবে?’

‘অ্যাটমিক ব্লাস্টার!’

নাহার আর শামীম একসঙ্গে ভয় পাওয়া গলায় চিৎকার করে উঠল, ‘অ্যাটমিক ব্লাস্টার?’

‘হ্যাঁ। এখন আর মেপে মেপে স্যাম্পল নেওয়ার সময় নেই। অ্যাটমিক ব্লাস্টার দিয়ে এলিয়েনটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিব, তখন তার ছিন্নভিন্ন অংশটা হবে আমাদের স্যাম্পল!’

শামীম আর নাহার এমনভাবে ন্যাড়া মাথা বিদেশিটার দিকে তাকিয়ে রইল যে দেখে মনে হলো তারা তার কথা বুঝতে পারছে না। শামীম খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, কিন্তু এলিয়েনটা শক্তিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেছে, সেখানে যে পরিমাণ এনার্জি তোমার অ্যাটমিক ব্লাস্টারের স্প্লিন্টার ঢুকবে না।’

বিদেশিটা হিংস্র মুখে বলল, ‘তাকে শক্তিবলয়ের বাইরে আনতে হবে।’

‘কীভাবে বাইরে আনবে?’

বিদেশিটা তিতুনিকে দেখিয়ে বলল, ‘এই নির্বোধ মেয়েটাকে দিয়ে।’

নাহার ইতস্তত করে বলল, ‘কীভাবে?’

ন্যাড়া মাথা রিক গার্নার বলল, ‘সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও।’ তারপর অন্যদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘অ্যাটমিক ব্লাস্টার বের করে পজিশন নাও। এলিয়েনটাকে লেজার লক করো। আর এই নির্বোধ মেয়েটাকে খুলে দাও।’ কথা শেষ করে সে তার জ্যাকেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে একটা ছোট কালো রিভলবার বের করে আনল। সেটা তিতুনির মাথার দিকে তাক করে বলল, ‘নির্বোধ মেয়ে, আমি আজকে তোমাকে জন্মের মতো শিক্ষা দিব। তোমার চৌদ্দগুষ্টি সেটা মনে রাখবে।’

তিতুনিদের বাসার সামনে খোলা জায়গাটাতে এলিয়েন তিতুনি দাঁড়িয়ে আছে, তাকে ঘিরে একটা নীল আলো। সেই আলোটা মাটি থেকে শুরু করে একেবারে আকাশের দিকে উঠে গেছে। নীল আলো থেকে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝলক বের হয়ে আসছে, একটা ভোঁতা শব্দ মাঝে মাঝে বাড়ছে মাঝে মাঝে কমছে। আলোটা যেখানে মাটিতে এসে নেমেছে, সেই জায়গাটি আগুনের মতো গনগনে গরম, একধরনের পোড়া গন্ধে বাতাসটা ভারি হয়ে আছে। নীল আলোটি তীব্র নয়, কেউ বলে দেয়নি কিন্তু সবাই বুঝতে পারছে এই নীল আলোর মাঝে অচিন্ত্যনীয় এক ধরনের শক্তি আটকা পড়ে আছে, সেই শক্তিটুকু এই এলিয়েন মেয়েটিকে রক্ষা করছে, পৃথিবীর কারও সাধ্যি নেই এখন তাকে স্পর্শ করে।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

আব্বু আর আম্মু হতচকিতের মতো এলিয়েন তিতুনির দিকে তাকিয়েছিলেন, টোটন বুঝিয়ে দেওয়ার পরও বুঝতে পারছিলেন না কেমন করে তাঁদের মেয়ে হঠাৎ এলিয়েন হয়ে গেল! তাহলে তাঁদের আসল মেয়ে এখন কোথায়? কেন সে ট্রেইলারের ভেতর থেকে বের হয়ে আসছে না? আম্মু একবার ট্রেইলারের দরজা দিয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করলেন, তারপর এলিয়েন তিতুনির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তিতুনি মা, তুই চলে যাচ্ছিস কেন? থেকে যা।’

টোটনও চিৎকার করে বলল, ‘হ্যাঁ। তিতুনি তুই থেকে যা। এই জীবনে তোকে আর কোনো দিন জ্বালাব না। খোদার কসম!’

আম্মু বললেন, ‘তুই তো পুরোপুরি তিতুনি। আমার যদি একটা তিতুনি থাকতে পারে তাহলে দুটি তিতুনি কেন থাকতে পারবে না?’

এলিয়েন তিতুনি নীল আলোর শক্তিবলয়ের ভেতর থেকে বলল, ‘আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানে আমার ফিরে যেতে হবে, সেখানে সবাই আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। তা ছাড়া—’

এলিয়েন তিতুনি একটু থামল, তারপর বলল, ‘তা ছাড়া পৃথিবীর মানুষ ভালো যন্ত্র খুব বেশি তৈরি করতে পারেনি কিন্তু অনেকগুলি খুব খারাপ খারাপ যন্ত্র তৈরি করেছে। ওই দেখো একটা খারাপ যন্ত্র বের করে আনছে আমাকে গুলি করার জন্য।’

সবাই মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, অবাক হয়ে দেখল, মেশিনগানের মতো একটা যন্ত্র টেনে নামিয়ে আনছে ট্রেইলারের ভেতর থেকে।

আম্মু আব্বু চিৎকার করে উঠলেন, বললেন, ‘সর্বনাশ!’

এলিয়েন তিতুনি বলল, ‘না, আম্মু আব্বু, কোনো ভয় নেই। এই শক্তিবলয়ের ভেতরে আমাকে কিছু করতে পারবে না।’ কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে সে দেখল ট্রেইলারের দরজা দিয়ে মাথা ন্যাড়া রিক গার্নার তিতুনির চুলের মুঠি ধরে তাকে টেনে বের করে আনছে, তার অন্য হাতে কুচকুচে কালো ছোট একটা রিভলবার। রিভলবারটি সে তিতুনির মাথায় ধরে রেখেছে। ট্রেইলারের দরজায় দাঁড়িয়ে সে হিংস্র গলায় চিৎকার করে ইংরেজিতে বলল, ‘সরে যাও সবাই, খবরদার। খুন করে ফেলব।’

আম্মু একটা আর্তচিৎকার করে ছুটে যেতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু কোথা থেকে সামরিক পোশাক পরা একজন মানুষ এসে প্রথমে আম্মুকে তারপর আব্বুকে ধরে ফেলল।

পাকা চুলের মানুষটা অ্যাটমিক ব্লাস্টারটা সেটার তিনটা পায়ের ওপর দাঁড়া করিয়ে সেটা চালু করে দিয়েছে। ভেতর থেকে একটা চাপা গুঞ্জনের সাথে সাথে লাল রঙের লেজারের আলো এলিয়েন তিতুনিকে আলোকিত করে ফেলে। পাকা চুলের বব ক্লাইড চিৎকার করে বলল, ‘লক ইন কমপ্লিট। গেট রেডি।’

ন্যাড়া মাথার মানুষটা তিতুনির চুলের মুঠি ধরে ট্রেইলারের সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নিচে নেমে আসে।

তিতুনির চোখেমুখে একটা অবর্ণনীয় আতঙ্ক। চুলের মুঠি ধরে একটা ঝাঁকুনি দিতেই তার মুখে একটা যন্ত্রণার ছাপ পড়ল। ন্যাড়া মাথা রিক গার্নার হুংকার দিয়ে বলল, ‘ইউ ব্লাডি এলিয়েন! দ্যাখ, তোর মানুষ বন্ধুর কী অবস্থা! তোর সাথে দেখা হয়েছিল বলে সে এখন তোর সামনে খুন হয়ে যাবে।’

আম্মু চিলের মতো একটা চিৎকার করলেন, তাঁকে ধরে রাখা মানুষটা সাথে সাথে খপ করে আম্মুর মুখ চেপে ধরল।

ন্যাড়া মাথা রিক গার্নার রিভলবারটা ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘আমি এই নির্বোধ মেয়েকে খুন করে ফেলব, নর্দমার কীট পারলে তুই তাকে রক্ষা কর!’

নীল আলোর ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা এলিয়েন তিতুনি স্থির দৃষ্টিতে রিক গার্নারের দিকে তাকিয়ে রইল। তিতুনিকে বাঁচানোর জন্য এই শক্তিবলয় থেকে বের হলেই অ্যাটমিক ব্লাস্টার দিয়ে তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে। পৃথিবীর মানুষ কত যত্ন করে কত নিখুঁতভাবে ধ্বংস করার জন্য যন্ত্র তৈরি করেছে!

রিক গার্নার চিৎকার করে বলল, ‘নরকের কীট! আমি তিন পর্যন্ত গুনব, তারপর গুলি করে এই নির্বোধ মেয়ের খুলি উড়িয়ে দেব!’ একমুহূর্ত অপেক্ষা করে সে চিৎকার করে গুনল, ‘ওয়ান-টু-থ্রি-’ তারপর ট্রিগার টেনে তিতুনির মাথায় গুলি করে দিল।

তিতুনির সামনে সবকিছু অদৃশ্য হয়ে যায়, চারপাশে অনেক মানুষ, তাদের চিৎকার, তার চুলের মুঠি ধরে রাখা রিক গার্নার মাথার মাঝে রিভলবারের কালো নল, একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আম্মু, আব্বু টোটন, তাদের আতঙ্কিত দৃষ্টি। বাসার সামনে আকাশ থেকে নেমে আসা নীল আলোর একটা টানেল, সেই টানেলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এলিয়েন মেয়েটি, বাতাসে তার চুল উড়ছে, তার চোখ দুটো স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষের চিৎকার, কোলাহল, যন্ত্রের ভোঁতা শব্দ, পোড়া গন্ধ, সবকিছু হঠাৎ থেমে গেল। কোথাও এতটুকু শব্দ নেই।

তিতুনি খুব ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাল চারপাশে পুরোপুরি নৈঃশব্দ্যে ঢেকে যাওয়া একটা পৃথিবী, তার মাঝে সবকিছু একটা ছবির মতো স্থির হয়ে আছে, আর তার মাঝে ঢেউয়ের মতো ভেসে ভেসে আসছে এলিয়েন মেয়েটি। মনে হচ্ছে যোজন যোজন সময় পরে এলিয়েন মেয়েটি তার কাছে এসে হাত বাড়িয়ে তাকে স্পর্শ করল। তার খুব কাছে এসে তার কপালে কপাল ছুঁইয়ে তার চোখের দিকে তাকাল। তিতুনি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কি মরে গেছি?’

‘না।’ এলিয়েন মেয়েটি মাথা নাড়ল, ‘না তিতুনি, তুমি মরে যাওনি!’

‘তাহলে আমার চারপাশে এ রকম কেন? কোনো শব্দ নেই কেন? সবাই ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছে কেন?’

‘তোমাকে বাঁচানোর জন্য আমি সময়কে স্থির করে দিয়েছি।’

‘সত্যি?’

‘হ্যাঁ সত্যি।’ এলিয়েন মেয়েটি তার চুল ধরে থাকা ড. মর্গানের হাতটা সরিয়ে তাকে মুক্ত করে। রিভলবারের নল থেকে তার মাথাটা সরিয়ে আনে।

বলল, ‘এই দেখ, রিভলবার থেকে বুলেট বের হয়ে তোমার মাথায় আঘাত করতে যাচ্ছিল, মাঝপথে থেমে গেছে!’

তিতুনি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, কী অবাক লাগছে দেখতে!

এলিয়েন সাবধানে শূন্যে ঝুলে থাকা বুলেটটা ধরে তিতুনির হাতে দেয়, বলে, ‘নাও! দেখো। এখনো গরম হয়ে আছে। আরেকটু হলে এটা তোমার মাথায় ঢুকে যেত!’

তিতুনি এলিয়েন মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘থ্যাংকু, আমাকে বাঁচানোর জন্যে।’

এলিয়েন মেয়েটি হাসল, বলল, ‘যখন আমি থাকব না, তখন নিজেকে দেখেশুনে রেখো।’

‘রাখব।’

তিতুনি অবাক হয়ে চারিদিকে তাকাল, চারপাশে সবাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আম্মুর মুখে অবর্ণনীয় আতঙ্ক, আব্বু ভয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন, টোটনের চোখেমুখে অবিশ্বাস। সবাই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে।

রিক গার্নারের মুখে হিংস্র একটা ভঙ্গি, চোখগুলো লাল, মুখের ফাঁক দিয়ে জিব বের হয়ে আছে। বব ক্লাইডের মুখ কুঁচকে আছে, অ্যাটমিক ব্লাস্টারটা দুই হাতে ধরে রেখেছে। এদিকে সেদিকে অনেক মানুষ, সবাই বিচিত্র ভঙ্গিতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এলিয়েন মেয়েটি চারিদিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমার এখন যেতে হবে তিতুনি।’

তিতুনির চোখে হঠাৎ পানি এসে গেল, বলল, ‘তুমি চলে গেলে আমার খুব কষ্ট হবে!’

এলিয়েন বলল, ‘হবে না। যাওয়ার আগে আমি তোমার স্মৃতি মুছে দিয়ে যাব। সবার স্মৃতি মুছে দিয়ে যাব।’

তিতুনি বলল, ‘না, প্লিজ না! আমার স্মৃতি মুছে দিয়ো না। আমি তোমাকে মনে রাখতে চাই।’

এলিয়েন মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, ‘না, তিতুনি এটা হয় না। আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানে কখনো কোনো দিন এই নিয়ম ভাঙা হয়নি, তুমি আমাকে এই অনুরোধ কোরো না। আমাকে সবার সব স্মৃতি মুছে দিতে হবে!’

তিতুনি প্রায় হাহাকারের মতো শব্দ করে বলল, ‘প্লিজ! প্লিজ—তুমি আমার স্মৃতি মুছে দিয়ো না। আমি তোমাকে মনে রাখতে চাই।’

এলিয়েন মেয়েটি তিতুনির হাত ধরে বলল, ‘আমাকে বিদায় দাও তিতুনি। আমি যাই।’

তিতুনি চোখ মুছে বলল, ‘বিদায়। তুমি যেখানেই থাকো ভালো থেকো।’

এলিয়েন মেয়েটি তিতুনির হাত ছেড়ে দিয়ে নীল আলোটার দিকে এগিয়ে যায়। কাছাকাছি পৌঁছে সে একবার ঘুরে তাকাল, হাত নাড়ল। তিতুনি অবাক হয়ে দেখল, এলিয়েন মেয়েটির চোখের নিচে চিকচিক করছে পানি!

এলিয়েন মেয়েটি তারপর নীল আলোর বলয়ের ভেতরে ঢুকে গেল। সেখানে দাঁড়িয়ে দুই হাত ধীরে ধীরে দুই পাশে ছড়িয়ে দেয়—তার শরীরটা তখন ঘুরতে থাকে। ঘুরতে ঘুরতে শরীরটা হঠাৎ ওপরে উঠতে থাকে, দেখতে দেখতে সেটি নীল আলোর টানেলের ভেতর দিয়ে আকাশের দিকে ছুটে যেতে থাকে। দেখতে দেখতে সেটি অদৃশ্য হয়ে যায়। তিতুনি আকাশের দিকে তাকিয়েই থাকে—তাকিয়েই থাকে।

হঠাৎ করে তিতুনি শুনতে পেল টোটন তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই এ রকম হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?’

তিতুনি মাথা নামিয়ে আনে। একটু আগে মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো নড়তে শুরু করেছে। আম্মু আর আব্বু তার দিকে এগিয়ে এসেছেন, আম্মু চারিদিকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো দেখিয়ে আব্বুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে এত মানুষ কেন?’

তোদের কারও কিছু মনে নেই।

আব্বু বললেন, ‘বুঝতে পারছি না। দেখি কাউকে জিজ্ঞেস করে।’

তিতুনি দেখল আব্বু শামীমের কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে কী হয়েছে? এত মানুষ কেন? এত যন্ত্রপাতি কেন?’

শামীম মাথা চুলকে বলল, ‘ঠিক বলতে পারছি না। আমরা এলিয়েন লাইফ ফর্ম খুঁজি, হয়তো এখানে সে রকম সিগন্যাল ছিল। দেখি, আমি আমাদের টিম লিডারকে জিজ্ঞেস করি।’

তিতুনি দেখল শামীম রিক গার্নারের কাছে গিয়ে তাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করল। রিক গার্নার শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ শামীমের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর হঠাৎ মুখ বিকৃত করে একটা হিংস্র পশুর মতো শব্দ করল।

শামীম লাফ দিয়ে পেছনে সরে গিয়ে ভয় পাওয়া গলায় বলল, ‘নাহার! প্রফেসর গার্নারের কী হয়েছে? এ রকম করছে কেন?’

নাহার বলল, ‘বুঝতে পারছি না। প্রফেসর ক্লাইডও খুব বিচিত্র ব্যবহার করছেন। কথা না বলে কেমন জানি শব্দ করছেন।’

তিতুনি দেখল আব্বু তাদের কাছ থেকে সরে আসছেন, সবাই মিলে রিক গার্নার আর বব ক্লাইডকে ধরে ট্রেইলারের ভেতর নিয়ে যাচ্ছে। মানুষ দুটো হিংস্র পশুর মতো শব্দ করে যাচ্ছে।

এলিয়েন মেয়েটি যাওয়ার সময় রিক গার্নার আর বব ক্লাইডের সব স্মৃতি শুধু মুছে দেয়নি, তাদের মস্তিষ্কটি তাদের উপযুক্ত করে সাজিয়ে দিয়েছে, হিংস্র পশুর মতো! তাদের যে রকম হওয়ার কথা।

তিতুনি চারিদিকে তাকায়, কারও মাথায় এলিয়েনের কোনো স্মৃতি নেই, শুধু তার মাথায় আছে। এলিয়েন মেয়েটি তার অনুরোধ রেখেছে। অন্য সবার স্মৃতি মুছে দিলেও তার স্মৃতিটি মোছেনি। তিতুনিকে সে তার স্মৃতিটি উপহার দিয়ে গেছে।

আম্মু একটু অবাক হয়ে তিতুনির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন, তারপর বললেন, ‘আচ্ছা তিতুনি, তুই কি কিছু জানিস এখানে কী হচ্ছে?’

তিতুনি আম্মুর দিকে তাকাল, আম্মু বললেন, ‘তোকে দেখে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তুই কিছু একটা জানিস!’

তিতুনি মাথা নাড়ল, বলল, ‘না আম্মু। আমি কিছু জানি না।’ তারপর চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল, ‘খোদা, আমি আম্মুর সঙ্গে মিছে কথা বলেছি। তুমি আমাকে মাফ করে দিয়ো।’

অন্ধকার রাতে যখন আকাশে লক্ষ লক্ষ তারা ওঠে, তখন তিতুনি তাদের ছাদে একটা মাদুর পেতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

আব্বু জিজ্ঞেস করেন, ‘তুই কী দেখিস তিতুনি?’

তিতুনি বলে, ‘আকাশের তারা দেখি!’

আম্মু বললেন, ‘তারার মাঝে আবার দেখার কী আছে?’

তিতুনি বলে, ‘এই আকাশের বহুদূরে একটার পর একটা গ্যালাক্সি আছে। সেই গ্যালাক্সিতে হয়তো কোথাও কোনো প্রাণী থাকে, তারা হয়তো সেখানে থেকে আমাদের কথা ভাবছে—এটা চিন্তা করতে আমার খুব ভালো লাগে!’

টোটন হি হি করে হেসে বলে, ‘আমাদের তিতুনি ফিলোসফার হয়ে গেছে আম্মু! দেখেছ?’

তিতুনি কিছু বলে না, সে আকাশের নক্ষত্রের দিকে তাকিয়েই থাকে। না, সে ফিলোসফার হয়নি। সে কী হয়েছে, সে নিজেও জানে না।

(শেষ)