টুনটুনি ও ছোটাচ্চু (অষ্টম পর্ব)

ছোটাচ্চু বসার ঘরে ঢুকে ডান হাতটা ওপরে তুলে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘প্রজেক্ট ডাইনি বুড়ি’।

বাচ্চারা মেঝেতে বসে রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা খেলছিল, তারা খেলা নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল যে ছোটাচ্চুর কথা শুনতে পেল না। খেলাটার আসল নাম ছিল চোর-পুলিশ, বাসার সবচেয়ে ছোট বাচ্চা গুটটু চোর-পুলিশ ছাড়া আর কিছু খেলতে পারে না, তাই সে সব সময় চোর-পুলিশ লেখা কয়েকটা কাগজ নিয়ে সবার পেছনে পেছনে এটা খেলার জন্য ঘুরে বেড়াত, কেউ খেলতে রাজি হতো না। তখন টুনি তাকে বুদ্ধি দিয়ে বলল, ‘তোর এই খেলা কেউ খেলবে না, স্মার্টফোনে কত হাইফাই খেলা আছে দেখেছিস? তুই এই চোর-পুলিশ খেলাটাকে বদলে ফেল। চোর আর ডাকাতের বদলে নাম দে রাজাকার আর আলবদর। পুলিশ আর দারোগার বদলে মুক্তিযোদ্ধা আর সেক্টর কমান্ডার। তাহলে দেখবি সবাই খেলবে।’

টুনির বুদ্ধি শুনে গুটটু খেলার চরিত্রগুলোর নাম পাল্টে দিল, তখন সত্যি সত্যি সবাই এটা খেলতে লাগল। প্রথমে চারজন খেলত, খেলোয়াড়ের সংখ্যা বাড়তে থাকলে মুক্তিযোদ্ধাও বাড়াতে হলো, ছেলে মুক্তিযোদ্ধা, মেয়ে মুক্তিযোদ্ধা, শিশু মুক্তিযোদ্ধা, কিশোর মুক্তিযোদ্ধা তৈরি হলো। খেলোয়াড় আরও বেড়ে যাওয়ার পর রাজাকার-আলবদরের সঙ্গে সঙ্গে আলশামস, শান্তিবাহিনী, পাকিস্তানি মিলিটারি এই চরিত্রগুলো তৈরি করতে হলো। খেলার মাঝে সেক্টর কমান্ডার যখন মুক্তিযোদ্ধাদের রাজাকার, আলবদর, শান্তিবাহিনী কিংবা পাকিস্তানি মিলিটারিকে ধরে আনতে বলে, তখন তারা শুধু ধরে আনে না, ধরার পর রীতিমতো ধোলাই দিয়ে ছেড়ে দেয়! কাউকে ধোলাই দিলে সেটা এমনি এমনি কেউ সহ্য করত না, কিন্তু রাজাকার হিসেবে ধোলাই খেয়ে তারা গলা ফাটিয়ে আর্তনাদ করে কিন্তু কিছু মনে করে না। কাজেই অত্যন্ত নিরীহ চোর-পুলিশ খেলাটা এখন প্রচণ্ড নাটকীয় এবং ভয়ংকর উত্তেজনার একটা খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাচ্চারা যখন এই খেলাটি খেলে তখন তাদের ধারেকাছে কেউ শান্তিতে থাকতে পারে না। তাই বাচ্চারা কেউ যে ছোটাচ্চুর ঘোষণাটা শুনতে পায়নি তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ছোটাচ্চু তখন গলা আরও উঁচিয়ে বলল, ‘প্রজেক্ট ডাইনি বুড়ি’।

এবার বাচ্চারা মাথা ঘুরিয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল। শান্ত এবার রাজাকার হিসেবে ধরা পড়ে বেদম মার খাচ্ছিল, সবাই আপাতত মার থামিয়ে ছোটাচ্চুর কথা শোনার চেষ্টা করল। একজন জিজ্ঞেস করল, ‘প্রজেক্ট কী বুড়ি’?

ছোটাচ্চু মুখ গম্ভীর করে বলল, ‘ডাইনি বুড়ি’। আরেকজন জিজ্ঞেস করল, ‘ডাইনি বুড়ি? সত্যি?’

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল। বলল, ‘হ্যাঁ’।

‘নাকের মাঝে আঁচিল আছে? ঝাড়ুর মাঝে বসে আকাশে উড়তে পারে।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘ওইগুলো আমেরিকান ডাইনি বুড়ি। আমাদের বাংলাদেশের ডাইনি বুড়ি আকাশে ওড়ে না।’

তখন আরেকজন জিজ্ঞেস করল, ‘বাংলাদেশের ডাইনি বুড়িরা কী করে?’

‘ছেলেমেয়েদের যন্ত্রণা দেয়। তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে দেয়।’

তখন একজন এদিক-সেদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আমার আম্মুও তো আমাকে যন্ত্রণা দেয়, তাহলে আম্মু কি ডাইনি বুড়ি?’

ছোটাচ্চু বলল, ‘আরে ধুর! এই যন্ত্রণা সেই যন্ত্রণা না।’

‘তাহলে কী রকম যন্ত্রণা?’

‘মনে কর কোনো একটা বুড়ি নিজের ছেলেমেয়েকে ভালোবাসে না। আদর করে না, দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু অন্যদের জন্য দরদে বুক ভাসিয়ে দেয়।’

বাচ্চাদের আশাভঙ্গ হলো। তারা ভাবছিল ছোটাচ্চু আরও ভয়ংকর কিছু বলবে, রাত্রিবেলা মানুষের ঘাড়ে কামড় দিয়ে রক্ত চুষে খায়, এ রকম কিছু। ছেলেমেয়েকে ভালোবাসে না, আদর করে না, এটা আবার কী রকম ডাইনি বুড়ি!

বাচ্চারা আবার তাদের রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা খেলায় ফিরে গেল। এই রকম ডাইনি বুড়িতে তাদের খুব বেশি উৎসাহ নেই। ছোটাচ্চুর অবশ্য অনেক উৎসাহ, বাচ্চাদের ডেকে বলল, ‘আমার এই প্রজেক্টের জন্য অ্যাডভান্স টাকা দিয়েছে সেটা জানিস?’

সবাই প্রায় একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল, ‘কত টাকা?’

ছোটাচ্চু মনে হলো এই প্রশ্নটা শুনে একটু বিরক্ত হলো, মুখ ভোঁতা করে বলল, কত টাকা সেটা ইম্পরট্যান্ট না। ইম্পরট্যান্ট হচ্ছে পার্টি এখন আমার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিকে অ্যাডভান্স টাকা দেয়। সেটা হচ্ছে ইম্পরট্যান্ট।’

শান্ত রাজি হলো না, মাথা নেড়ে বলল, ‘উঁহু। কত টাকা দিয়েছে, সেইটা ইম্পরট্যান্ট।’

ছোটাচ্চু আরাও বিরক্ত হয়ে বলল, ‘সেটা মোটেও ইম্পরট্যান্ট না।’

শান্ত বলল, ‘বুঝেছি। তোমাকে আসলে খুবই কম টাকা দিয়েছে, সেই জন্য বলতে চাইছ না।’

ছোটাচ্চু ধমক দিয়ে বলল, ‘সব সময় শুধু টাকা টাকা করবি না।’

শান্ত বলল, ‘ঠিক আছে। এখন থেকে ডলারে কথা বলব। তোমাকে কত ডলার দিয়েছে ছোটাচ্চু?’

ছোটাচ্চু একটা বাজখাঁই ধমক দিতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই টুনি জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার প্রজেক্টটা কী ছোটাচ্চু?’

সবচেয়ে শান্তশিষ্ট মেয়েটি বলল, ‘ডাইনি বুড়িকে মার্ডার করতে হবে মনে হয়! কেমন করে মার্ডার করবে ছোটাচ্চু?’

আরেকজন উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘রিভলবার দিয়ে গুলি করবে, তাই না ছোটাচ্চু?’

আরেকজন আরও বেশি উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘না না না। ডাইনি বুড়িদের গুলি করলে কিছু হয় না। তাদের গলা টিপে মারতে হয়। তুমি গলা টিপে মারবে, তাই না ছোটাচ্চু?’

একজন সাবধান করে দিল, ‘তুমি কিন্তু খুব সাবধান থেকো। ডাইনি বুড়ি ইচ্ছা করলেই মন্ত্র দিয়ে তোমাকে ভেড়া বানিয়ে দেবে।’

আরেকজন সেটা ব্যাখ্যা করল, ‘তারপর কচ করে তোমার মাথাটা কামড় দিয়ে খেয়ে ফেলবে। তোমার কোনো মাথাই থাকবে না।’

শান্ত বলল, ‘তুমি নিজে নিজে ডাইনি বুড়িকে মার্ডার করতে যেয়ো না। পুলিশ-র্যাব তোমাকে ধরে ফেলবে। একটা হিটম্যান ভাড়া করো। দুই হাজার টাকা দিলে যে কাউকে মার্ডার করে দেবে।’

ছোটাচ্চু বাচ্চাদের কথা শুনে খুবই বিরক্ত হলো। বলল, ‘তোরা এমন ভায়োলেন্ট হলি কেমন করে? ছোট ছোট বাচ্চা কত সুইট হয়, কত সুন্দর করে কথা বলে, আর তোরা শুধু মার্ডার নিয়ে কথা বলিস। খুন-জখম নিয়ে কথা বলিস। তোদের সমস্যাটা কী?’

একজন বলল, ‘আমরা খুন-জখম নিয়ে কথা বলি তোমার জন্য। তুমি খুন-জখম-মার্ডার করো সেই জন্য আমরা খুন-জখম-মার্ডার নিয়ে কথা বলি।’

ছোটাচ্চু চোখ কপালে তুলে বলল, ‘আমি কোনো দিন খুন-জখম-মার্ডার করেছি?’

‘আমরা বইয়ে পড়েছি। সিনেমায় দেখেছি। ডিটেকটিভরা সব সময় খুন-জখম-মার্ডার করে। তুমিও করবে। তাই না রে?’

সব বাচ্চা মাথা নাড়ল, বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ ছোটাচ্চুও খুন-জখম-মার্ডার করবে।’

ছোটাচ্চু গলা উঁচিয়ে বলল, ‘কোনো দিন আমি খুন-জখম-মার্ডার করব না। গল্প বইয়ের ডিটেকটিভ আর বাস্তবের ডিটেকটিভ এক না। বাস্তবের ডিটেকটিভের কাজ হচ্ছে বুদ্ধির কাজ। মগজের কাজ।’

ছোট একজন বলল, ‘কিন্তু তোমার তো মগজও কম। বুদ্ধিও কম।’

ছোটাচ্চু চোখ লাল করে বলল, ‘কে বলেছে?’

‘সবাই বলে।’

ছোটাচ্চু রেগে কী একটা বলতে যাচ্ছিল। টুনি থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ছোটাচ্চু, তুমি এখনো বলো নাই ডাইনি বুড়ি নিয়ে তোমার কাজটা কী?’

ছোটাচ্চু গজগজ করে বলল, ‘আমি তো বলতে যাচ্ছিলাম, তোদের যন্ত্রণায় কি কথা বলা যায়?’

‘ঠিক আছে। এখন বলো।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘আমি যে ডাইনি বুড়ির কথা বলছি, তার ছয় ছেলেমেয়ে। দুজন থাকে আমেরিকা, একজন থাকে দুবাই বাকি তিনজন দেশে থাকে। এখন ছুটিতে সবাই দেশে এসেছে। এসে পড়েছে মহা মুশকিলে।’

একজন জিজ্ঞেস করল, ‘কী মুশকিল?’

‘ডাইনি বুড়ির হাজব্যান্ড যখন বেঁচে ছিল তখন নাকি ডাইনি বুড়ি ভালোই ছিল। ছেলেমেয়েদের আদর করত। এখন ছেলেমেয়েদের দুই চোখে দেখতে পারে না। দেখা হলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়।’

টুনি জিজ্ঞেস করল, ‘কেন?’

‘সেটাই তো কেউ জানে না। ছেলেমেয়ের ধারণা, তার মায়ের একটু মাথা খারাপের মতো হয়েছে।’

‘কেন? কী করে?’

‘যেমন মনে কর তার যা কিছু আছে, সেগুলো এখানে-সেখানে ফেলে দেয়। নষ্ট করে ফেলে!’

‘আর কী করে?’

‘তার হাজব্যান্ড এই ডাইনি বুড়ির নামে জমি লিখে দিয়েছিল। ডাইনি বুড়ি এখন এই জমিটা নাকি নষ্ট করবে।’

শান্ত ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘জমি কীভাবে নষ্ট করে?’

ছোট একজন বলল, ‘ফ্রিজের বাইরে গোশত রাখলে গোশত নষ্ট হয়ে যায় না? মনে হয় সেই রকম, তাই না ছোটাচ্চু?’

ছোটাচ্চু বলল, ‘ধুর বোকা। জমি কি কেউ ফ্রিজে রাখে নাকি? জমি নষ্ট করা মানে হচ্ছে জমিটা পাগল-ছাগলকে দান করে দেওয়া। অপদার্থ মানুষদের দিয়ে দেওয়া। ক্রিমিনালদের দিয়ে দেওয়া।’

বাচ্চারা কেউ কিছু বুঝতে পারল না কিন্তু তারা সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। জমি কাউকে দিয়ে দিলে দেবে, না দিলে দেবে না। এটা নিশ্চয়ই ভেজাল ডাইনি বুড়ি। সত্যিকারের ডাইনি বুড়ি নিশ্চয়ই জমি নষ্ট করে না। তারা ছোট বাচ্চাদের ধরে ধরে কচমচ করে খায়! সেই রকম ডাইনি বুড়ি হলে একটা কথা ছিল। একটা ভেজাল ডাইনি বুড়ি যে তার জমি ছেলেমেয়েদের না দিয়ে আলতু-ফালতু মানুষদের দিয়ে দিচ্ছে তাকে নিয়ে কারও কোনো কৌতূহল নেই। বাচ্চারা আবার তাদের রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা খেলায় ফিরে গেল।

রাত্রিবেলা টুনি ছোটাচ্চুর ঘরে গিয়ে হাজির হলো। ছোটাচ্চু তার বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে, কোলে একটা খাতা এবং হাতে একটা বলপয়েন্ট কলম, কলমটা গভীর মনোযোগ দিয়ে চিবোচ্ছে। টুনি ডাকল, ‘ছোটাচ্চু’।

ছোটাচ্চু বলল, ‘উঁ।’

টুনি বলল, ‘ছোটাচ্চু, আমি তোমার ডাইনি বুড়ির কেসের একটা জিনিস বুঝতে পারছি না।’

‘কী জিনিস?’

‘তোমাকে কী করতে হবে?’

‘আমাকে ডাইনি বুড়ির কাছ থেকে জমির দলিলটা উদ্ধার করে দিতে হবে।’

টুনি বলল, ‘ও।’ যদিও সে কিছুই বুঝতে পারল না।

ছোটাচ্চু বলল, ‘ডাইনি বুড়ি জমির দলিলটা তার ঘরে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। পুরো ঘরটা আঁতিপাঁতি করে সবাই মিলে খুঁজেছে, কিন্তু কেউ খুঁজে পায়নি। আমাকে সেটা খুঁজে বের করে দিতে হবে।’

টুনি আবার বলল, ‘ও।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘দলিলটা খুঁজে পেলে জমিটা উদ্ধার করা যাবে। তা না হলে ডাইনি বুড়ি যাকে জমিটা দিয়েছে, সে যদি মামলা করে দেয় তাহলে সমস্যা হয়ে যাবে। এখনো তো নামজারি হয় নাই, তাই একটা সুযোগ আছে। জমি যখন বিক্রি হয় তখন প্রথমে জমি রেজিস্ট্রি করতে হয়। তারপর...।’ ছোটাচ্চু তখন কেমন করে জমি বিক্রি করতে হয় তার নিয়মকানুনগুলো টুনিকে খুব উৎসাহ নিয়ে বোঝাতে লাগল, টুনি কিছুই বুঝতে পারল না। ছোটাচ্চু অনেকক্ষণ কথা বলে শেষ পর্যন্ত কেমন জানি ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল। টুনি আবার জমি বিক্রি নিয়ে নতুন আরেকটা বক্তৃতা না শুরু করে দেয় সেই ভয়ে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হয়ে যেতে চেষ্টা করল। দরজার কাছাকাছি গিয়ে থেমে গিয়ে আবার ফিরে এসে টুনি ছোটাচ্চুকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা ছোটাচ্চু, তুমি কি ডাইনি বুড়িকে দেখেছ?’

ছোটাচ্চু বলল, ‘না, এখনো দেখি নাই।’

‘তাহলে তুমি কেমন করে জানো বুড়িটা ডাইনি বুড়ি?’

ছোটাচ্চু সোজা হয়ে বলল, ‘আমি কি শুধু শুধু একটা বুড়িকে ডাইনি বুড়ি বলব? তার ছেলেমেয়েরা বলেছে বলেই তো আমি বলি।’

টুনি তার বড় বড় চশমার ফাঁক দিয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, ছেলেমেয়েরা তার নিজের মাকে ডাইনি বুড়ি ডাকে?’

‘হ্যাঁ।’

টুনি কিছুক্ষণ চোখ বড় বড় করে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আচ্ছা ছোটাচ্চু, এমন কি হতে পারে যে মা-টা ঠিকই আছে, ছেলেমেয়েগুলো ডাইনি বুড়া আর ডাইনি বুড়ি?’

ছোটাচ্চু ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ডাইনি বুড়া আর ডাইনি বুড়ি?’

‘হ্যাঁ, মেয়েরা যদি ডাইনি বুড়ি হতে পারে তাহলে ছেলেরা কেন ডাইনি বুড়া হতে পারবে না?’

ছোটাচ্চু কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। তারপর বলল, ‘ডাইনি বুড়া? তুই বলছিস মেয়েরা যদি ডাইনি বুড়ি হয় তাহলে ছেলেরা হবে ডাইনি বুড়া?’

‘হ্যাঁ।’

ছোটাচ্চু মাথা চুলকাতে লাগল। তারপর নিজেও একটা বিশাল নিঃশ্বাস ফেলল। টুনি তখন ছোটাচ্চুকে আরও ভালো করে মাথা চুলকানোর সুযোগ করে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল। পরদিন ছোটাচ্চু যখন তার ঘর থেকে বের হচ্ছে ঠিক তখন টুনি সেখানে হাজির হলো। সেও বের হওয়ার জন্য সেজেগুজে ফিটফাট হয়ে এসেছে।

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, ‘তুই কোথায় যাচ্ছিস?’

‘তোমার সঙ্গে।’

ছোটাচ্চু আরও অবাক হয়ে বলল, ‘আমার সঙ্গে?’

‘হ্যাঁ। ডাইনি বুড়ি দেখতে।’

‘ডা-ডাইনি বুড়ি দেখতে?’

‘হ্যাঁ। তুমি এখন ডাইনি বুড়ির বাড়িতে যাচ্ছ না?’

ছোটাচ্চু আমতা-আমতা করে বলল, ‘হ্যাঁ, কিন্তু তুই কেমন করে জানিস?’

ছোটাচ্চুর টেলিফোনের কথাবার্তা একটু মনোযোগ দিয়ে শুনলেই এগুলো জানা যায়। তবে টুনি সেটা বলল না। মুখ গম্ভীর করে বলল, ‘তুমি ডিটেকটিভ। আমি তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট, মনে নাই? আমি সব জানি।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘কিন্তু আমি এখন যাচ্ছি ফ্যামিলির সবার সঙ্গে কথা বলতে, তুই বাচ্চা মানুষ গিয়ে কী করবি?’

‘আমি কিছু করব না। শুধু ডাইনি বুড়িকে একনজর দেখব। আমি জীবনে ডাইনি বুড়ি দেখি নাই।’

‘কিন্তু—’

অলংকরণ: সাদাত

‘ছোটাচ্চু, তোমার কোনো কাজে আমি কোনো দিন ঝামেলা করেছি? করি নাই। বরং উল্টোটা হয়েছে—আমি তোমার কেস সলভ করে দিয়েছি।’

‘কিন্তু—’

‘আমি তোমাদের কোনো ঝামেলা করব না। তুমি ফ্যামিলির সঙ্গে কথা বলবে, আমি তখন ডাইনি বুড়িকে একটু দেখে আসব। যদি ডাইনি বুড়ি কথা বলতে রাজি হয়, তাহলে তার কথা শুনতে পারি। তার ঘরটা একটু দেখে আসতে পারি, তোমার কাজে লাগবে। মনে নাই—’

ছোটাচ্চু বলল, ‘কিন্তু—’

টুনি বলল, ‘কোনো কিন্তু নাই ছোটাচ্চু! মনে নাই, ভূতের বাড়িতে তুমি গলায় তাবিজ লাগিয়ে বিদেহী আত্মার কাছে কত কী বলেছিলে? আমাকে তুমি বলেছ, সেই কথাটা যেন আমি কাউকে না বলি। আমি তোমার কথা শুনেছি। কাউকে বলি নাই। আর তুমি আমার এই ছোট একটা কথা শুনতে পারবে না?’

ছোটাচ্চুর মুখটা এবার একটু আমসি মেরে গেল। এই মেয়েটি বাকি জীবন এই ঘটনাটা দিয়ে তাকে ব্ল্যাকমেইল করবে। যদি কোনো দিন ফারিয়াকে বলে দেয় তাহলে বেইজ্জতির চূড়ান্ত হবে। ছোটাচ্চু ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে মিনমিন করে বলল, ‘ঠিক আছে, চল।’

টুনি ছোটাচ্চুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুমি এত সুইট ছোটাচ্চু, এই জন্যই তো আমরা তোমাকে এত পছন্দ করি।’

ডাইনি বুড়ির বাসায় ডাইনি বুড়ির ছেলেমেয়েরা ছোটাচ্চুর সঙ্গে টুনিকে দেখে যেন অবাক এবং মনে হলো একটু বিরক্ত হলো। ছোটাচ্চু অবশ্য খুব কায়দা করে ব্যাপারটা সামলে নিল। তাদের বোঝাল, এ রকম কেসে সে ইচ্ছে করে টুনিকে নিয়ে যায়, বয়স্ক মানুষেরা বড় মানুষের কাছে মুখ খোলে না কিন্তু ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে একেবারে খোলামেলা কথা বলে ফেলে। টুনিকে পাঠানো হচ্ছে ডাইনি বুড়ির ভেতরের খবর বের করার জন্য। ডাইনি বুড়ির ছেলেমেয়েরা ছোটাচ্চুর কথা বিশ্বাস করে টুনিকে ডাইনি বুড়ির ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে ছোটাচ্চুর সঙ্গে কথা বলার জন্য বাইরের ঘরে বসল। ডাইনি বুড়ির ছয় ছেলেমেয়ে তাকে ঘিরে সোফায় বসে পড়ে। বড় ছেলের মাথায় টাক কিন্তু তাকে দেখে মনে হয় সেটা সে জানে না। একটু পরে পরে হাত দিয়ে সে তার মাথার অদৃশ্য চুলে হাত বোলায়। সে-ই কথা শুরু করল। অনেক দিন থেকে সে আমেরিকায় আছে, তাই বাংলা কথা তার মুখে আসতেই চায় না। ইংরেজিটা খাঁটি আমেরিকান উচ্চারণ, বাংলাটাও ইংরেজির মতো শোনায়। সে ছোটাচ্চুকে বলল, ‘আপনি বুঝেছেন, আপনাকে কি করতে হবে?’

‘করতে হবে’ শব্দ দুটো অবশ্য শোনা গেল ‘কড়তে হবে’। তবে ছোটাচ্চু সে জন্য কিছু মনে করল না। একজন মানুষকে সারা জীবন দেশের বাইরে থাকতে হলে এ রকম কিছু একটা হতেই পারে। ছোটাচ্চু বলল, ‘হ্যাঁ। বুঝতে পেরেছি আমাকে কী করতে হবে। একটা জমির দলিল আপনার মা তার ঘরে লুকিয়ে রেখেছেন, সেটা খুঁজে বের করতে হবে।’

বড় ভাই মাথা নাড়ল। বলল, ‘ইয়েস।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘এটা কিসের দলিল, কেন আপনার মা সেটা আপনাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চান, কেন আপনারা তার পরও সেটা খুঁজে বের করতে চান, সেটা কি আমাকে একটু বলবেন?’

বড় ভাই বলার চেষ্টা করল। ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে কিছু একটা বলতে শুরু করল তখন বড় বোন তাকে ঝটকা মেরে থামিয়ে দিল। বড় বোন মোটাসোটা এবং নাদুসনুদুস, দেখে মনে হয় নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে। সব সময়ই কেমন জানি হাঁসফাঁস করছে। হাঁসফাঁস করতে করতে বলল, ‘আমার মা এই রকম করছেন তার একটাই কারণ! তার কারণ, আমার মা আসলে একটা ডাইনি বুড়ি! সবার মা থাকে, তারা তাদের বাচ্চাদের কত আদর করে আর আমার মা আমাদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়—’ বড় বোন কথা শেষ না করে হেঁচকির মতো শব্দ করে কাঁদতে শুরু করল।

ছোটাচ্চু খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। ছোট বাচ্চারা কাঁদলে তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে সান্ত্বনা দেওয়া যায়। কিন্তু বড় মানুষ বিশেষ করে মোটাসোটা নাদুসনুদুস মানুষ হেঁচকি তোলার মতো শব্দ করে কাঁদতে শুরু করলে তাকে কীভাবে সান্ত্বনা দেওয়া যায় ছোটাচ্চু বুঝতে পারল না। কাঠির মতো শুকনো ছোট একজন বোন তাকে সান্ত্বনা দিল। বলল, ‘তুমি খামাখা কাঁদছ কেন বড় আপু? বুড়ির কাছে তোমার চোখের পানির কোনো দাম আছে?’

বড় বোন তখন হেঁচকি তোলা থামিয়ে কান্না বন্ধ করল। বড় ভাই তখন ছোটাচ্চুকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কীভাবে কাজ শুরু করবেন?’ (বড় ভাই অবশ্য ‘শুরু করবেন’ বলল না, বলল ‘শুড়ু কড়বেন’।)

ছোটাচ্চু বলল, ‘আপনারা নিজেরা যেহেতু অনেক খুঁজেও দলিলটা পান নাই, কাজেই ধরে নিচ্ছি আপনার মা সেটা বেশ ভালোভাবেই লুকিয়ে রেখেছেন। কাজেই সাধারণভাবে খুুঁজে এটা পাওয়া যাবে না। তার পরেও আমি সাধারণভাবে একবার খুঁজে দেখতে চাই। কিন্তু ঘরে আপনার মা থাকলে সেটা সম্ভব হবে না।’

নাদুসনুদুস বড় বোন হাঁসফাঁস করতে করতে বলল, ‘সেটা কোনো সমস্যা না। বুড়ি বই পড়তে খুব পছন্দ করে, তাকে বইয়ের দোকানে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেই সে বই কিনতে চলে যায়।’

ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, ‘ঘরে তালা দিয়ে যান?’

কাঠির মতো শুকনো লিকলিকে বোন বলল, ‘তাতে সমস্যা নাই। আমরা তালা-চাবিওয়ালা ডেকে তালার চাবি বানিয়ে রেখেছি। বুড়ি বাইরে গেলেই ঘরে ঢুকি।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘গুড। যদি এমনি খুঁজে পেয়ে যাই তাহলে ভালো। যদি পাওয়া না যায় তাহলে একদিন একটা ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন তৈরি করতে হবে।’

বড় ভাই তার মাথার অদৃশ্য চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন?’

হ্যাঁ। ঘরে ইলেকট্রিক শর্টসার্কিট দিয়ে আগুন লেগে গেছে এ রকম একটা সিচুয়েশন। আপনার মা তখন ঘর থেকে তাড়াতাড়ি বের হতে চেষ্টা করবেন—মূল্যবান কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করবেন। ঘরে ভিডিও ক্যামেরা থাকবে, সেটা দিয়ে মনিটর করা হবে, ঠিক কী নিচ্ছেন, সেখান থেকে বোঝা যাবে।

বড় ভাই মাথা নাড়ল, বলল, ‘গুড আইডিয়া।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘সেটাও যদি কাজ না করে তাহলে আমরা প্ল্যান সি-তে যেতে পারি।’

শুকনো কাঠি বোন জিজ্ঞেস করল, ‘প্ল্যান সি?’

‘হ্যাঁ। স্বাভাবিক খোঁজাখুঁজি হচ্ছে প্ল্যান এ, ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন হচ্ছে প্ল্যান বি আর প্ল্যান সি হবে ঘর রিনোভেশন।

‘ঘর রিনোভেশন?’

‘হ্যাঁ। আপনার মায়ের ঘরে ওপর থেকে পানি ঢালতে হবে, বোঝাতে হবে ছাদে ফাটল হয়ে পানি ঢুকছে, পুরো ঘর ভেঙেচুরে ঠিক করতে হবে। তখন গোপন ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে আপনার মাকে মনিটর করতে হবে। গোপন দলিল যেন হাতছাড়া না হয়ে যায়, সে জন্য আপনার মা সেটা খুঁজে বের করবেন।’

হাঁসফাঁস করতে করতে বড় বোন বলল, ‘বাসাটা এমনিতেই পুরোনো হয়ে গেছে, ঠিক করতে হবে। আর বুড়ি একলা মানুষ। তার এত বড় রুমের দরকার কী? কোনার ছোট ঘরে ট্রান্সফার করে দিলেই তো বের হয়ে যাবে।’

বড় ভাইবোন সেটা নিয়ে আলোচনা শুরু করে দেয়। অন্য ভাইবোনগুলো সারাক্ষণ চুপ করে ছিল। এবারও চুপ করে মাছের মতো তাকিয়ে থাকে।

ছোটাচ্চু বলল, ‘যদি প্ল্যান সি কাজ না করে তাহলে রয়েছে প্ল্যান ডি। আমি অবশ্য এটা করতে চাই না। কারণ, এটা করতে হলে আমার ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।’

বড় ভাই জিজ্ঞেস করল, ‘প্ল্যানটা কী, শুনি।’

ছোটাচ্চু তখন বেশ আজগুবি প্ল্যান-ডিটা ব্যাখ্যা করতে থাকে।

এদিকে টুনি ডাইনি বুড়ির ঘর খুঁজে বের করে দরজা একটু ফাঁক করে বলল, ‘দাদু, আসতে পারি?’

ঘরের ভেতর আবছা অন্ধকার। বিছানায় বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে একজন বেশ বয়সী মহিলা বই পড়ছিলেন। মাথা তুলে চশমার ফাঁক দিয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কে?’

টুনি ঘরে ঢুকে বলল, ‘আপনি আমাকে চিনবেন না’। বয়সী মহিলা কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি আমার কাছে? কী মনে করে?’

টুনি ইতস্তত করে বলল, ‘আমি আপনাকে সাবধান করতে এসেছি।’

মহিলা এবার কৌতূহলী চোখে টুনির দিকে তাকালেন, বইটা বন্ধ করে বিছানায় রেখে টুনিকে ভালো করে লক্ষ করে একটু হেসে দিলেন। টুনি লক্ষ করল মহিলার সাদা চুল, মুখে বয়সের চিহ্ন, চেহারাটা একটু কঠিন কিন্তু হাসামাত্রই সব কাঠিন্য দূর হয়ে সেখানে কেমন যেন কৌতুকের একটা ভাব চলে এল। মহিলা বললেন, ‘তুমি আমাকে সাবধান করতে এসেছ?’

‘জি।’

‘কী নিয়ে সাবধান করতে এসেছ?’

টুনি কাছে গিয়ে বিছানার একটা কোনায় বসে বলল, ‘আমার ছোট চাচাকে নিয়ে।’

‘তোমার ছোট চাচা? তোমার ছোট চাচা কী করেছেন?’

‘আমার ছোট চাচা একজন ডিটেকটিভ—’

বয়স্ক মহিলা চোখ বড় বড় করে চশমার ফাঁক দিয়ে টুনির দিকে তাকালেন, ‘সত্যি সত্যি ডিটেকটিভ আছে নাকি? আমি ভেবেছিলাম এগুলো শুধু গল্পে থাকে।’

‘সত্যি সত্যি আছে। ছোট চাচার এজেন্সিটার নাম দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি। কয়েকটা কেস সলভ করেছে।’

‘বেশ। তোমার ছোট চাচাকে নিয়ে আমাকে সাবধান করতে এসেছ কেন?’

‘আপনার ছেলেমেয়েরা আমার ছোট চাচাকে একটা কাজ করতে দিয়েছে। আপনার ঘর থেকে একটা দলিল খুঁজে বের করতে দিয়েছে।’

হঠাৎ করে বয়স্ক ভদ্রমহিলার চোখমুখে আবার সেই কাঠিন্য ফিরে এল। কেমন যেন কঠিন চোখে টুনির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর শীতল গলায় বললেন, ‘তুমি কেন আমাকে এটা বলতে এসেছ?’

টুনি মাথা নিচু করে বলল, ‘আমার ছোট চাচা মানুষটা খারাপ না। কিন্তু একটু সহজ-সরল। আপনার ছেলেমেয়েরা তাকে বুঝিয়েছে—’ টুনি কথা শেষ না করে থেমে গেল।

‘কী বুঝিয়েছে?’

‘বুঝিয়েছে যে আপনি-আপনি—’ টুনি আবার কথা না বলে থেমে যায়। এ রকম একজন বয়স্ক মহিলার সামনে ডাইনি বুড়ি কথাটা সে বলতে পারল না।

বয়স্ক ভদ্রমহিলা নিজেই বললেন, ‘ডাইনি বুড়ি?’

টুনি মাথাটা নিচু করে অস্পষ্ট করে বলল, ‘হ্যাঁ’।

‘আর কী বুঝিয়েছে?’

‘বুঝিয়েছে, আপনি আপনার ছেলেমেয়েকে আদর করেন না। আপনার সব সম্পত্তি আপনি নিজের ছেলেমেয়েদের না দিয়ে নষ্ট করে ফেলছেন, আজেবাজে লোকদের দিয়ে দিচ্ছেন।’

ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আর বলতে হবে না। আমি বুঝতে পারছি।’

‘আমার ছোট চাচা আপনার ছেলেমেয়েদের কথা বিশ্বাস করে দলিলটা খুঁজে বের করতে রাজি হয়েছে। কাজটা যে ঠিক না, সেটা বুঝতে পারছে না।’

ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে রইলেন, একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তুমি ছোট মানুষ। এই বড়দের ব্যাপারে কেন জড়িয়ে গেলে?’

টুনি লাজুক মুখে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘আমি আমার ছোট চাচার অ্যাসিস্ট্যান্ট।’

‘অ্যাসিস্ট্যান্ট?’

‘হ্যাঁ। ছোট চাচা যত কেস সলভ করেছে, সবগুলোতে আমি ছিলাম।’

‘তুমি ছিলে?’

‘হ্যাঁ’ টুনি বলল, ‘আমি সব সময়ই চাই ছোটাচ্চু—’ টুনি একটু থেমে ব্যাখ্যা করল, ‘ছোট চাচাকে আমরা ছোটাচ্চু ডাকি। আমি চাই ছোটাচ্চু কেস সলভ করুক। শুধু এইবার আমি চাই ছোটাচ্চু যেন কেসটা সলভ করতে না পারে। কিছুতেই যেন আপনার দলিলটা বের করতে না পারে।’

‘কেন?’

টুনি মাথা চুলকাল। বলল, ‘ঠিক জানি না। কিন্তু মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক না।’

ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি ছোট মেয়ে কিন্তু তোমার কথাবার্তা কাজকর্ম বড়দের মতো।’

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, ‘আমার ক্লাসের মেয়েরা আমাকে খালাম্মা ডাকে।’

ভদ্রমহিলা হেসে ফেললেন। বললেন, ‘না। তুমি এখনো খালাম্মা হও নাই।’

‘কেউ কেউ নানুও ডাকে।’

‘সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না।’ ভদ্রমহিলা বললেন, ‘তুমি আমাকে সাবধান করতে এসেছ—ঠিক কীভাবে আমাকে সাবধান থাকতে হবে?’

টুনি বলল, ‘আমার ছোটাচ্চু ঠিক কীভাবে দলিলটা খুঁজবে, সেটা বলতে এসেছি।’

‘কীভাবে খুঁজবে?’

‘প্রথমে আপনি যখন এই ঘরে থাকবেন না তখন এই ঘরে খুব ভালো করে খুঁজবে।’

ভদ্রমহিলা হাসলেন, বললেন, ‘জন্মেও পাবে না।’

‘তারপর ঘরে একদিন আগুন লাগানোর মতো একটা ব্যবস্থা করবে। আপনাকে বলবে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হয়ে যেতে। একটা ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে আপনাকে লক্ষ করবে। আপনি জরুরি কাগজপত্র নিয়ে বের হবেন, সেখান থেকে বের করবে।’

ভদ্রমহিলা টুনির দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কেমন করে জানো?’

‘ছোটাচ্চুর একটা হলুদ বই আছে। সেই বইয়ে লেখা আছে কোন কাজের জন্য কী করতে হয়। যদি ঘরে আগুন লাগিয়ে বের করতে না পারে তাহলে আপনার পুরো ঘর ভেঙেচুরে ঠিক করবে। দেখবে আপনি কী করেন। তা-ও যদি না পারে তাহলে ডাক্তারি ওষুধ দিয়ে চেষ্টা করবে। আমিও ছোটাচ্চুর বইটা পড়েছি।’

ভদ্রমহিলা কোনো কথা না বলে টুনির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর আবার ফিক করে হেসে ফেললেন, বললেন, ‘তোমার মতো অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকলে তোমার ছোটাচ্চু কোনো দিন ডিটেকটিভগিরি করতে পারবে না।’

টুনি কোনো কথা বলল না। ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নাম কী মেয়ে?’

‘কঠিন একটা নাম আছে, এমনিতে সবাই টুনি ডাকে।’

‘টুনিই ভালো।’

‘দাদু, আমি তাহলে যাই?’

‘যাবে? যাও। আমাকে সাবধান করে দিয়েছ সে জন্য তোমাকে তো আমার কিছু একটা দেওয়া দরকার। একটা চকলেটের প্যাকেট কিংবা অন্য কিছু।’

‘না না, কিছু লাগবে না দাদু।’

ভদ্রমহিলা বিছানার ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা বইগুলো থেকে একটা বই তুলে নিয়ে টুনির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই বইটা নাও। বই পড়তে ভালো লাগে তো? আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো বই পড়ে না। শুধু টেলিভিশন দেখে।’

‘আমি বই পড়ি।’

‘চমৎকার। এই বইটা তোমার ভালো লাগবে কি না জানি না—কবিতার বই।’

টুনি বইটা হাতে নিল। ময়লা একটা কাগজ দিয়ে বইটার মলাট দিয়ে রেখেছেন। একটা বইয়ের প্রচ্ছদই সবচেয়ে সুন্দর, সেটাই যদি ময়লা কাগজ দিয়ে ঢেকে রাখা হয় তাহলে লাভ কী? টুনি মলাটটা খুলে বইয়ের প্রচ্ছদটা দেখবে নাকি চিন্তা করছিল। মনে হলো ভদ্রমহিলা সেটা বুঝে ফেললেন। বললেন, মলাটটা খুলে বইটার প্রচ্ছদটা দেখতে পারো। কিন্তু এখানে না। বাসায় গিয়ে।’

টুনি অবাক হয়ে বলল, ‘বাসায় গিয়ে?’

‘হ্যাঁ।’ ভদ্রমহিলা ফিক করে হাসলেন। বললেন, ‘আমি দলিলটা দিয়ে বইয়ের মলাটটা দিয়ে রেখেছি। এখন বুঝেছ, কেন কেউ কোনো দিন দলিলটা খুঁজে পায় নাই?’

টুনির চোখ বড় বড় হয়ে উঠল। বলল, ‘এই মলাটটা সেই দলিল?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমার কাছে দিচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ। তোমার থেকে বিশ্বাসী মানুষ মনে হয় পাব না।’

‘আমি এটা এখন কী করব?’

‘রেখে দাও তোমার কাছে। একটা ফটোকপি আমার ছেলেমেয়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়ো। তাহলে বুঝবে আসলটা পাচার হয়ে গেছে।’

‘তারা মনে হয় খুব রেগে যাবে।’

‘রাগুক। আমার ছেলেমেয়েগুলো মানুষ হয় নাই। বড় ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, অফিসার হয়েছে। ইউনিভার্সিটির মাস্টার হয়েছে কিন্তু মানুষ হয় নাই।’

টুনি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ভদ্রমহিলা বললেন, ‘তাদের বাবা এই জমিটা একটা স্কুলকে দান করতে চেয়েছিল। আমি সেই জন্য স্কুলকে দান করেছি। ছেলেমেয়ের সহ্য হলো না। শুধু হিসাব করে আর লাফঝাঁপ দেয়। কারও টাকার কোনো অভাব নাই কিন্তু এই জমিটা ছাড়বে না। জাল দলিল করবে সেই জন্য অরিজিনালটা নষ্ট করতে চায়।’

অলংকরণ: সাদাত

টুনি এবারও কিছু বলল না।

ভদ্রমহিলা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘এবার দেখি কী করে।’

টুনি ভদ্রমহিলার কাছে গিয়ে বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। দেখবেন স্কুলকে জমিটা লিখে দিতে পারবেন।’

‘ছেলেমেয়েগুলোকে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার।’

টুনি কোনো কথা বলল না, কিন্তু কীভাবে তাদের শিক্ষা দেওয়া যায় তার কয়েকটা পরিকল্পনা মাথায় খেলা করতে লাগল। টুনি তার কোনোটাই ভদ্রমহিলাকে বলল না। বলার দরকারও নেই। বইটা বুকে চেপে ধরে রেখে বলল, ‘আমি যাই?’

‘যেতে নেই। বলো আসি।’

‘আমি আসি তাহলে?’

‘এসো টুনি।’

টুনি ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

ঠিক দুই দিন পর টুনি ছোটাচ্চুর ঘরে গিয়ে দেখে ছোটাচ্চু তার বিছানায় পা তুলে বসে আছে, মুখটা খুবই বিমর্ষ। ছোটাচ্চু বিয়ে করেনি, ছেলেমেয়ে নাই, যদি থাকত তাহলে যে কেউ দেখে বলত নিশ্চয়ই তার ছেলে কিংবা মেয়ে মার্ডার হয়ে গেছে কিংবা কাউকে মার্ডার করে ফেলেছে। ছোটাচ্চু টুনিকে দেখে একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। টুনি জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে ছোটাচ্চু?’

ছোটাচ্চু কথা না বলে আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। টুনি তখন আরেকবার জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে ছোটাচ্চু?’

ছোটাচ্চু বলল, ‘আর বলিস না। সবকিছু আউলা-ঝাউলা হয়ে গেছে।’

‘কী আউলা-ঝাউলা হয়ে গেছে?’

‘তোর মিসেস জাহানের কেসটার কথা মনে আছে?’

টুনি অবাক হয়ে বলল, ‘মিসেস জাহান? সেটা আবার কে?’

‘মনে নাই, যাকে প্রথম প্রথম আমি ডাইনি বুড়ি বলেছিলাম? ভদ্রমহিলা খুবই সুইট, খুবই সম্মানী মহিলা। তাকে ডাইনি বুড়ি ডাকাটা খুবই বেকুবির কাজ হয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই মনে হচ্ছে তোর কথাই ঠিক।’

‘আমার কোন কথাই ঠিক?’

‘ওই ভদ্রমহিলা মোটেই ডাইনি বুড়ি না। ডাইনি বুড়া আর ডাইনি বুড়ি হচ্ছে তার ছেলেমেয়েগুলো। আমার এই কেসটা নেওয়াই ঠিক হয় নাই।’

টুনি তার চশমার ওপর দিয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, ‘কেন ঠিক হয় নাই?’

‘ছেলেমেয়েগুলো দুই নম্বরি। আসল দলিলটা বের করতে চাচ্ছে কেন, জানিস?’

টুনি সবকিছুই জানে কিন্তু তার পরেও ভান করল কিছু জানে না। সরল মুখ করে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন?’

‘একটা জাল দলিল বের করবে। সেই জন্য। ছেলেমেয়ে সবগুলো ক্রিমিনাল। আমেরিকা থেকে যেটা এসেছে, সেটা রীতিমতো মাফিয়া।’

টুনি মুখ গম্ভীর করে বলল, ‘তুমি তাহলে ওদের জন্য কাজ করছ কেন? ছেড়ে দাও।’

‘ছাড়তেই তো চাই, কিন্তু ছাড়তে পারছি না।’

‘কেন ছাড়তে পারছ না?’

ছোটাচ্চু আবার বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, মনে নাই। আমি ওদের কাছ থেকে অ্যাডভান্স নিয়েছিলাম।’

‘অ্যাডভান্স ফিরিয়ে দাও।’

ছোটাচ্চু মুখ কাঁচুমাঁচু করে বলল, ‘কেমন করে ফিরিয়ে দেব? খরচ করে ফেলেছি যে! ফারিয়ার জন্মদিন ছিল—আমাকে আমার জন্মদিনে কত কিছু গিফট দেয়, আমি ভাবলাম আমিও এবার একটা ভালো বার্থডে গিফট দিয়ে অবাক করে দেব।’

‘দিয়েছ গিফট?’

‘হ্যাঁ। কী যে খুশি হলো ফারিয়া। এখন ফারিয়াকে বলতে হবে গিফটটা যেন ফেরত দেয়। দোকানে গিফটটা ফেরত নেবে কি না জানি না। রিকোয়েস্ট করলে একটু ডেমারেজ দিয়ে মনে হয় নিতেও পারে। এখন মুশকিল হচ্ছে ফারিয়াকে বলি কেমন করে!’

টুনি মাথা নাড়ল। বলল, ‘না ছোটাচ্চু। এটা তুমি করতেই পারবে না। তুমি যদি এটা করো তাহলে আমরা সবাই মিলে তোমাকে বাসা থেকে বের করে দেব।’

ছোটাচ্চু মুখ কাঁচুমাঁচু করে বলল, ‘ঠিকই বলেছিস। আমার মতো অপদার্থ একজন মানুষকে ঘর থেকে বেরই করে দেওয়া দরকার।’

টুনি মুখ গম্ভীর করে বলল, ‘ছোটাচ্চু, তুমি দলিলটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলে?’

‘করেছিলাম।’

‘পেয়েছ?’

‘না।’

‘কীভাবে খুঁজেছ?’

‘প্রথমে মিসেস জাহানকে বইয়ের দোকানে পাঠানো হলো। ওই মাফিয়া বাহিনীর কাছে মিসেস জাহানের ঘরের তালার চাবি আছে। সেই চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। ঘরভর্তি বই, প্রতিটা বইয়ের একটা একটা পৃষ্ঠা করে খুঁজেছি। তোষকের নিচে, ড্রয়ারে, আলমারিতে কোথাও বাকি রাখি নাই।’

টুনির খুবই ইচ্ছে করল একবার জিজ্ঞেস করে মলাট দেওয়া বইয়ের মলাট খুলে দেখেছে কিনা—কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর জিজ্ঞেস করল না। সরল মুখে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তারপর?’

‘এভাবে খুঁজে না পেয়ে আমি আসল ডিটেকটিভগিরি শুরু করলাম।’

টুনি সবই জানে, তার পরও মুখ গম্ভীর করে জিজ্ঞেস করল, ‘কী করলে তখন?’

‘ঘরের ভেতরে আমার কলমের মতো দেখতে ভিডিও ক্যামেরাটা রেখে ঘরে আগুন দিয়ে দিলাম।’

ঘরের ভেতর আগুন দেওয়ার খবর শুনলে যে রকম অবাক হওয়ার কথা, সে রকম অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বলল, ‘আগুন!’

‘সত্যিকারের আগুন না, ভুয়া আগুন। কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি করা যায়, কোনো আগুন বের হয় না, খালি ধোঁয়া বের হয়। সেই ভুয়া আগুন দিয়ে মিসেস জাহানকে ভয় দেখানো হলো। মিসেস জাহান তাড়াতাড়ি তাঁর বিছানার নিচ থেকে একটা খাম নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন।’

টুনি চোখ বড় বড় করে বলল, ‘তারপর?’

‘আমি তখন শিওর হয়ে গেলাম যে এই খামের ভেতর দলিলটা আছে। তখন অনেক কায়দা করে সেই খামটা উদ্ধার করা হলো। খামের ভেতর কী ছিল জানিস?’

টুনি জিজ্ঞেস করল, ‘কী?’

ছোটাচ্চু আবার একটা বিশাল নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘একটা সাদা কাগজ। কাগজে একটা কবিতা লেখা।’

‘কবিতা?’

‘হ্যাঁ। ছোটাচ্চু অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘কবিতাটা শুনতে চাস?’

‘বলো।’

ছোটাচ্চু তখন কবিতাটা আবৃত্তি করল:

‘আজকালকার পোলাপান

বাপরে কয় তামুক আন।

মা হইল ডাইনি বুড়ি

টাকাপয়সা সোনার চান।

টুনি চোখ বড় বড় করে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে রইল। ছোটাচ্চু বলল, ‘আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন এই কবিতটা অন্যভাবে শুনেছিলাম। মিসেস জাহান একটু বদলে ফেলেছেন। তার মানে বুঝেছিস?’

টুনি জানতে চাইল, ‘কী?’

‘তার মানে মিসেস জাহান সবকিছু জানেন। তাঁর ছেলেমেয়েরা যে দুই নম্বরি, সেটা জানেন। তারা যে মাফিয়া, সেইটা জানেন। তাঁকে যে তারা ডাইনি বুড়ি ডাকে, সেইটাও জানেন। এখন কী মনে হচ্ছে জানিস? আমরা যে আগুনের ভয় দেখিয়ে তাঁকে ঘর থেকে বের করব, সেইটাও জানেন—আমাদের টিটকারি করার জন্য ওই কবিতাটা লিখে রেখেছেন। কী রকম বেইজ্জতি হলাম দেখেছিস?’

টুনি মাথা নেড়ে স্বীকার করল যে ছোটাচ্চু যথেষ্ট বেইজ্জতি হয়েছে।

‘এখন এই মাফিয়া পার্টি আমার ঘাড়ে সিন্দাবাদের বুড়ার মতো চেপে বসেছে, আমি দলিল বের না করলে আমাকে ছাড়বে না। কী বিপদে যে পড়েছি!’

‘দলিল বের করে দাও।’

‘দলিল বের করে দেব?’ ছোটাচ্চু অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই ভেবেছিস বের করতে পারব? আর যদি পারিও সেটা মাফিয়া পার্টিকে দেব?’

টুনি মাথা নাড়ল। বলল, ‘উঁহু, আমি সেইটা বলি নাই। আমি বলেছি দুই নম্বরি মানুষকে একটা দুই নম্বরি দলিল দাও, তাহলেই তো সব ঝামেলা মিটে যায়।’

ছোটাচ্চু খানিকক্ষণ হাঁ করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, ‘দুই নম্বরি দলিল? আমি দুই নম্বরি দলিল কোথায় পাব?’

টুনি চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ল। বলল, সেটা অবশ্য ঠিকই বলেছ! দুই নম্বরি দলিল তো আর কিনতে পাওয়া যায় না।’

‘দলিল দেখতে কেমন হয়, সেইটাও আমি জানি না।’ ছোটাচ্চু হতাশভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।

টুনি তখন ছোটাচ্চুর ঘর থেকে বের হয়ে শান্তকে খোঁজ করে বের করল। সে তার পড়ার টেবিলে বসে পড়ছে, যেটা খুবই বিচিত্র একটা দৃশ্য! শান্তকে কেউ কখনো পড়ার টেবিলে দেখে না। টুনি বলল, ‘ও, শান্ত ভাইয়া! তুমি লেখাপড়া করছ? তাহলে আমি পরে আসি।’

শান্ত বলল, ‘পরে আসতে হবে না। যা বলতে চাস এখনই বলে ফেল।’

টুনি বলল, ‘উঁহু। তুমি এখন পড়ালেখা করো।’

শান্ত গলা নামিয়ে বলল, ‘আমি পড়ালেখা করছি কে বলেছে? পড়ালেখার ভান করে একটা ফাটাফাটি উপন্যাস পড়ছি।’ শান্ত তার পাঠ্যবইয়ের নিচ থেকে একটা রগরগে বই বের করে দেখিয়ে দাঁত বের করে হাসল।’

টুনি বলল, ‘ঠিক আছে তাহলে।’ সে শান্তর সামনে একটা চেয়ারে বসে বলল, ‘আমার একটা কাজ করে দিতে পারবে?’

শান্তর চোখ চকচক করে উঠল, বলল, ‘কত দিবি?’

টুনি বলল, ‘আমি কোনো টাকাপয়সা দিতে পারব না। তোমাকে ফ্রি করে দিতে হবে।’

‘ফ্রি! আমি?’ শান্ত হা হা করে হাসতে লাগল।

‘হাসছ কেন? মানুষ কখনো অন্যের জন্য কাজ করে দেয় না? তুমি যদি করতে না চাও আমি আর কারও কাছে যেতে পারি। আমি তোমার কাছে এসেছিলাম তার কারণ কাজটা অ-স-ম্ভ-ব গোপনীয়।’

এবার শান্তর চোখমুখে একটু কৌতূহল ফুটে উঠল। জিজ্ঞেস করল, ‘কী কাজ?’

‘কাউকে বলবে না তো?’

‘বলব না।’

‘আমাকে ছুঁয়ে বলো।’

‘তোকে ছুঁয়ে বললে কী হবে?’

‘কাউকে বললে আমি মরে যাব।’

‘তুই মরে গেলে আমার সমস্যা কী?’

‘আমি মরে গেলে তোমার অনেক সমস্যা। আমি ভূত হয়ে এসে তোমার ঘাড় মটকে দেব। তুমি যে ভূতকে ভয় পাও, সেইটা আমি বাগানবাড়িতে দেখেছি। মনে আছে—’

শান্ত সেটা মনে করতে চায় না তাই কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘ঠিক ঠিক আছে। কী করতে হবে তাড়াতাড়ি বল।’

টুনি এদিক-সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, ‘মনে আছে, ছোটাচ্চু একটা ডাইনি বুড়ির কাছ থেকে জমির দলিল বের করতে চেয়েছিল?’

‘হ্যাঁ। মনে হয় শুনেছিলাম।’

‘আসলে সেই ভদ্রমহিলা মোটেও ডাইনি বুড়ি না। ভদ্রমহিলা খুবই সুইট। তার ছেলেমেয়েগুলো হচ্ছে ডাইনি বুড়া আর ডাইনি বুড়ি।’

‘তুই কীভাবে জানিস?’

‘আমি কথা বলেছি। আমার কাছে এখন সেই দলিলটা আছে। পৃথিবীর কেউ জানে না—আমি আর তুমি ছাড়া।’

শান্ত টুনির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আজকাল অবশ্য টুনির কাজকর্ম দেখে সে খুব বেশি অবাক হয় না। টুনি বলল, ‘তোমাকে এই দলিলটা স্ক্যান করে ইন্টারনেটে আপলোড করে দিতে হবে।’

শান্ত মাথা নেড়ে বলল, ‘এইটা তো সোজা কাজ। তোকে করে দেব। এখন টাকাপয়সা না দিলি, পরে বিল করে দেব।’

টুনি বলল, ‘কাজ শেষ হয় নাই। আরও একটা কাজ বাকি আছে।’

‘সেটা কী?’

‘দলিলটার একটা প্রিন্ট দিতে হবে। রঙিন, যেন দেখে মনে হয় অরিজিনাল।’

‘প্রমি আপুর কাছে স্ক্যানার আছে, স্ক্যান করে দিতে পারব। কিন্তু রঙিন প্রিন্ট কীভাবে করব?’

‘সেই জন্যই তো তোমার কাছে এসেছি।’

‘তার মানে আমাকে বাইরে প্রিন্টারের দোকানে যেতে হবে?’

‘দরকার হলে যাবে। আমি তোমার জন্য এত কিছু করি আর তুমি এই ছোট কাজটা করে দিতে পারবে না?’

‘তুই আমার জন্য কী করিস?’

‘বাগানবাড়িতে ভূতের ভয় পেয়ে তুমি আর ছোটাচ্চু ভূতের কাছে কত কান্নাকাটি করেছিলে মনে আছে? আমি কাউকে বলেছি?’

শান্ত আবার নরম হয়ে গেল। গজগজ করতে করতে বলল, ‘ঠিক আছে। ঠিক আছে। দে দলিলটা।’

‘আরও একটু কাজ করে দিতে হবে।’

‘কী কাজ?’

‘দলিলটার রঙিন প্রিন্টের মাঝখানে দুই লাইন কথা ঢুকিয়ে দিতে হবে। ভালো করে লক্ষ না করলে যেন কেউ ধরতে না পারে।’

‘কী কথা?’

‘একটা কবিতা।’

‘কবিতা?’

‘হ্যাঁ। কবিতাটা হচ্ছে’, টুনি কবিতাটা বলল:

‘আজকালকার পোলাপান

বাপরে কয় তামুক আন

মা হইল ডাইনি বুড়ি

টাকাপয়সা সোনার চান!’

শান্ত হা হা করে হেসে বলল, ‘এইটা আবার কী রকম কবিতা?’

টুনি বলল, ‘এখনো শেষ হয় নাই, শেষ দুই লাইন এই রকম:

গ্যান্দা ফুল হলুদ রঙের জবা ফুল লাল

এইটা হলো ফটোকপি সেফ জায়গায় অরিজিনাল।’ শান্ত কবিতা শুনে দুলে দুলে হাসল। তারপর বলল, ‘তোর ডিটেকটিভ না হয়ে কবি হওয়া উচিত ছিল।’

‘সেটা না হয় হব। এখন আমার কাজ করে দাও।’

‘ঠিক আছে দে। কখন দরকার?’

‘কালকের ভেতর। যদি সবকিছু ঠিক করে কাজ করো, আমি তোমাকে একটু কমিশন জোগাড় করে দিতেও পারি।’

শান্তর চোখ-মুখে এবার একটু উৎসাহ ফুটে উঠল। বলল, ‘ঠিক আছে।’

দুপুরবেলার ভেতর শান্ত এসে টুনিকে তার কাগজপত্র বুঝিয়ে দিল। তার মুখে রাজ্যজয়ের হাসি। টুনিকে বলল, ‘কী হয়েছে জানিস?’

টুনি বলল, ‘কী হয়েছে?’

‘আমি ভাবলাম তোর কাজ আউল-ফাউল জায়গায় না করে অরিজিনাল জায়গায় করি। কম্পিউটার স্ক্যান ফটোকপি প্রিন্টিংয়ের জায়গায়। দুই নম্বরি কাজ করার মাঝে তারা এক নম্বর। তোর দলিলের প্রিন্ট একেবারে অরিজিনালের মতো করে দিল। ভেতরে তোর কবিতাটা না থাকলে কেউ বুঝতেই পারত না কোনটা অরিজিনাল, কোনটা প্রিন্ট।’

‘থ্যাংকস শান্ত ভাইয়া।’

‘আমাকে তোর থ্যাংকস দিতে হবে না। তোকে থ্যাংকস।’ টুনি অবাক হয়ে বলল, ‘আমাকে থ্যাংকস কেন?’

‘তোর জন্যই তো এই ইন্টারেস্টিং স্ক্যানিং প্রিন্টিংয়ের দোকানটা খুঁজে পেলাম। আমার আর কোনো চিন্তা নাই।’

‘কেন তোমার চিন্তা নাই?’

‘এই দোকানে সবকিছু পাওয়া যায়। এসএসসির মার্কশিট, এইচএসসির সার্টিফিকেট, ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি, এমবিবিএস সার্টিফিকেট, মাস্টার্স, পিএইচডি—সবকিছু। আমি আমার জন্য একটা পিএইচডি সার্টিফিকেট কিনে এনেছি। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির।’

‘সত্যি?’

‘হ্যাঁ। এই দেখ।’ শান্ত টুনিকে তার হার্ভার্ডের সার্টিফিকেট দেখাল। কম্পিউটার সায়েন্সে পিএইচডি সার্টিফিকেট। সেখানে বড় বড় করে শান্তর নাম লেখা। শান্ত তার পিএইচডি সার্টিফিকেট সরিয়ে আরেকটা সার্টিফিকেট বের করল। বলল, ‘সস্তায় পেয়ে আরও একটা সার্টিফিকেট কিনে এনেছি।’

টুনি জিজ্ঞেস করল, ‘কিসের সার্টিফিকেট?’

‘ডেথ সার্টিফিকেট!’

টুনি চোখ কপালে তুলে বলল, ‘কার?’

‘আমার। এই দেখ।’ টুনি অবাক হয়ে দেখল, সত্যি সত্যি শান্তর নামে ডেথ সার্টিফিকেট। পরিষ্কার করে লেখা সে ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ করে মারা গেছে।

টুনি জিজ্ঞেস করল, ‘এইটা দিয়ে কী করবে?’

‘কত কাজে লাগবে! স্কুলের পরীক্ষার সময় ব্যবহার করতে পারি। আম্মুকে ভয় দেখাতে পারি! বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরার কাজে ব্যবহার করতে পারি!’

শান্ত তার পিএইচডি আর ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে খুব খোশমেজাজে অন্যদের দেখানোর জন্য চলে গেল। টুনি গেল তার নিজের ঘরে। মিসেস জাহান তাকে যে কবিতার বইটা দিয়েছিলেন, সেইটার ওপরে দলিলের এই রঙিন প্রিন্টটা দিয়ে মলাট ছিল। তার পরে ভেতরে একটা পৃষ্ঠায় পেনসিল দিয়ে লিখল:

প্রিয় দাদু,

এই প্রিন্টটা কোনোভাবে আমার ছোটাচ্চুকে

উদ্ধার করতে দেবেন!

টুনি

তারপর বইটা নিয়ে ছোটাচ্চুর ঘরে গেল। ছোটাচ্চু তখন কাপড়-জামা পরে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। টুনি জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাও?’

‘আর কোথায়! মাফিয়া পার্টি ডেকে পাঠিয়েছে।’

‘মিসেস জাহানের সঙ্গে একটু দেখা করতে পারবে?’

‘কেন?’

‘আমাকে একটা বই পড়তে দিয়েছিলেন। বইটা পড়া শেষ হয়েছে, তুমি উনাকে ফেরত দিতে পারবে?’

‘পারব। দে।’ টুনি বইটা ছোটাচ্চুর হাতে দিয়ে বলল, ‘তার সঙ্গে এইটা।’

‘এইটা কী?’

‘একটা রবার।’

‘রবার দিয়ে কী হবে?’

টুনি বলল, ‘রবার দিয়ে পেনসিলের লেখা মোছে।

ছোটাচ্চু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘সেটা আমি জানি! মিসেস জাহানকে কেন দিতে হবে?’

‘মিসেস জাহানের যদি কোনো পেনসিলের লেখা মুছতে হয়, সে জন্য।’

‘মিসেস জাহানের কেন পেনসিলের লেখা মুছতে হবে?’

টুনি বলল, ‘সেটা তোমার জানার দরকার নাই, ছোটাচ্চু!’

ছোটাচ্চু বিরক্ত হয়ে রবারটা নিয়ে পকেটে ঢোকাল। তারপর আরও বিরক্ত হয়ে বের হয়ে গেল। টুনি পেছন থেকে বলল, ‘মিসেস জাহানকে বই আর রবারটা দিতে ভুলো না যেন।’

ছোটাচ্চু আরও বেশি বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ভুলব না।’

মিসেস জাহান তাঁর বিছানায় বসে বই পড়ছিলেন। ছোটাচ্চু ভেতরে ঢুকে বলল, ‘চাচি, টুনি আপনাকে এই বইটা দিয়েছে। তার নাকি পড়া শেষ হয়ে গেছে।’

অলংকরণ: সাদাত

‘তাই নাকি?’ মিসেস জাহান বইটা হাতে নিলেন। ওপরের মলাটটা দেখলেন এবং কিছু একটা অনুমান করলেন।

ছোটাচ্চু তখন পকেট থেকে রবারটা বের করে মিসেস জাহানের হাতে দিয়ে বলল, ‘আপনাকে এই রবারটাও দিতে বলেছে।’

‘বলেছে নাকি? বলে থাকলে দাও। নিশ্চয়ই আমার কাজে লাগবে।’ মিসেস জাহান রবারটা হাতে নিয়ে বললেন, ‘বাবা, এই বাসায় তোমার কাজ কি শেষ হয়েছে?’

ছোটাচ্চু মুখ কালো করে বলল, ‘উঁহু, শেষ হয় নাই।’

ভদ্রমহিলা ছোটাচ্চুকে ডেকে বললেন, ‘তোমাকে একটা কথা বলি, বাবা?’

‘জি, বলেন।’

‘আমার ছেলেমেয়েগুলো মানুষ হয়নি। ওদের বুদ্ধি শুনে কাজ করতে আসাটা বুদ্ধিমানের কাজ হয় নাই। তোমাকে ভোগাবে।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘জি। আমি বুঝতে পারছি।’ তারপর বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে মিসেস জাহান মলাটটা খুললেন। ভেতর থেকে দলিলের প্রিন্টটা বের করলেন। পেনসিলে টুনির লেখাটা পড়লেন। নিজের মতো করে একটু হাসলেন। দলিলের ভেতরের কবিতাটা চোখে পড়ল, সেটা পড়ে খিলখিল করে হাসতে লাগলেন। তারপর রবারটা দিয়ে টুনির লেখাটা মুছে দলিলের প্রিন্ট কপিটা ভাঁজ করে একটা খামে ঢোকালেন, তারপর গুটি গুটি পায়ে বাইরের ঘরে এলেন। সেখানে ছোটাচ্চুকে ঘিরে ছয় ভাইবোন বসে আছে। উত্তপ্ত একধরনের আলোচনা চলছে। মাকে দেখে ছেলেমেয়েরা চুপ করে গেল। মিসেস জাহান ছোটাচ্চুকে বললেন, ‘বাবা, তুমি যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে একটু দেখা করে যাবে?’

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল। মিসেস জাহান গুটি গুটি পায়ে হেঁটে আবার নিজের ঘরে ফিরে গেলেন।

কিছুক্ষণের মাঝে ছোটাচ্চু মিসেস জাহানের কাছে হাজির হলো। মিসেস জাহান বললেন, ‘তুমি একা এসেছ তো?’

‘জি। আমি একা।’

‘এই যে রবারটা, তুমি টুনিকে ফিরিয়ে দিয়ো। দিয়ে বলো, রবারটার কাজ শেষ হয়েছে।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘শুধু এইটুকু বলার জন্য আমাকে ডেকেছেন?’

মিসেস জাহান মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘না। আরও একটু কথা ছিল।’

‘জি, বলেন।’

‘আমার ঘরে তুমি কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছ, তাই না?’

ছোটাচ্চু লজ্জা পেয়ে গেল। ইতস্তত করে বলল, ‘না, মানে ইয়ে—আসলে—হয়েছে কী—’

মিসেস জাহান বললেন, ‘তোমার অপ্রস্তুত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তুমি যেটা খুঁজছ সেটা খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত আমার ছেলেমেয়ে তোমাকে ছাড়বে না।’

ছোটাচ্চু আরও অপ্রস্তুত হয়ে গেল। এবার কোনো কথাই বলতে পারল না, শুধু কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। মিসেস জাহান ছোটাচ্চুর দিকে দলিলের প্রিন্ট কপি ভরা খামটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই যে নাও। এইটা আমার ছেলেমেয়েদের দিয়ে তাদের শান্ত করা যায় কি না দেখো।’

ছোটাচ্চু খামটা নিল, খুলে দলিলের প্রিন্ট কপিটা বের করে দেখে চমকে উঠল। বলল, ‘আ-আ-আপনি আমাকে এটা দিয়ে দিচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ। আমার ছেলেমেয়ের জন্য।’

‘থ্যাংকু চাচি, অনেক থ্যাংকু।’

‘আমাকে থ্যাংকু দিতে হবে না, তোমার ভাতিজিকে থ্যাংকু দিয়ো।’

‘ভাতিজিকে? তার মানে টুনিকে? কেন?’

‘আমাকে একটা রবার ব্যবহার করতে দেওয়ার জন্য!’ বলে মিসেস জাহান ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন, একজন বয়স্ক মহিলা যে চোখ টিপতে পারেন সেটা ছোটাচ্চু আগে কখনো দেখেনি। দেখে খুবই অবাক হলো!

ছোটাচ্চু বাসায় এল খুবই ফুরফুরে মেজাজে। তার পকেটে চেক এবং মুখে হাসি। মাফিয়া বাহিনী দলিলের প্রিন্ট কপি পেয়েই খুশি। তারা বুঝতে পারেনি এটা অরিজিনালটা না। দলিলের ভেতরে পুরোটা পড়েনি তাই টুনটুনির কবিতার দুই লাইনও তাদের চোখে পড়েনি।

টুনটুনির কবিতা চোখে পড়ল দুই দিন পর, জমি রেজিস্ট্রি করার অফিসে। যে লোক অনেক টাকা খেয়ে জাল দলিল বের করবে বলে কথা দিয়েছিল, সে এই প্রিন্ট কপি হাতে নিয়েই খেঁকিয়ে উঠল, ‘আপনি আমারে দেবেন অরিজিনাল আমি আপনারে দেব জাল জিনিস। আপনারা তো দেখি উল্টা কাজ করলেন—আমার জন্য নিয়ে আসছেন জাল কপি—।’

টাক মাথায় অদৃশ্য চুল টেনে ছেঁড়ার ভঙ্গি করে বড় ছেলে চিৎকার করে বলল, ‘বুড়ি অরিজিনাল গায়েব করে দিয়েছে? বাসার মাঝে জাল কপি লুকিয়ে রেখেছে? কত বড় ধুরন্ধর।’

জমি রেজিস্ট্রি করার অফিসের লোক এইবার আরও জোরে খেঁকিয়ে উঠল। বলল, কাগজ পড়ে দেখবেন না। এইটা তো জাল দলিলও না—এইটা হচ্ছে তামাশা!’

‘তামাশা?’

‘হঠাৎ এই দেখেন কী লেখা—’ মানুষটা তখন পুরো কবিতাটা পড়ে শোনাল। কবিতার শেষ অংশ হচ্ছে:

গ্যান্দা ফুল হলুদ রঙের জবা ফুল লাল

এইটা হলো ফটোকপি সেফ জায়গায় অরিজিনাল।

এই দুই লাইন পড়ে লোকটা টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, ‘এইখানে তো স্পষ্ট লেখা আছে এইটা ফটোকপি। চোখ দিয়ে দেখেন না? আপনাদের মাথার মাঝে কি গোবর?’

মোটাসোটা মহিলা হাঁসফাঁস করে বলল, ‘আমরা তাহলে কী করতে পারি?’

‘আপনাদের আর কিছু করার নাই। এই বুড়ি অরিজিনাল পাচার করে দিয়েছে। যাদেরকে জমিটা দিয়েছে, তাদের হাতে অরিজিনাল। মামলা করলেই আপনারা জেলে!’

‘জেলে?’

‘হ্যাঁ। আর এই বুড়ি ডেঞ্জারাস। ঘরে বসে সে যদি আপনাদের মতো আধা ডজন মানুষকে ঘোল খাওয়ায়, তার সঙ্গে ঝামেলা করবেন না!’

‘ঝামেলা করব না?’

‘না।’ লোকটা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘এই বুড়ি আপনাদের কী হয়?’

বড় ছেলে টাক মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘আমাদের মা।’

লোকটা প্রথমে চোখ বড় বড় করে তাকাল, তারপর চিৎকার করে বলল, ‘আপনাদের মা? নিজের মাকে বুড়ি বলে ডাকেন? আপনারা কী রকম মানুষ? দোজখেও তো আপনাদের জায়গা হবে না। আমি টাকাপয়সার জন্য জালিয়াতি করি সেইটা এক কথা কিন্তু তাই বলে নিজের মায়েরে তো অপমান করি না। আপনারা বিদায় হন—আর কোনো দিন আমার কাছে আসবেন না। এলে পুলিশে দিয়ে দেব।’

মাফিয়া বাহিনী মুখ কালো করে চলে এল। তিন দিনের ভেতর আমেরিকার দুজন আমেরিকা চলে গেল। দুবাইয়ের ছেলেটি দুবাই চলে গেল এক সপ্তাহ পর।

দিন দশেক পর একটা কফি হাউসে একজন বয়স্ক মহিলা আর একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখা গেল। দুজন মাথা খুব কাছাকাছি রেখে ফিসফিস করে ষড়যন্ত্রীদের মতো কথা বলছে। মাঝে মাঝেই দুজন হি হি করে হাসছে।

বয়স্ক মহিলাটা মিসেস জাহান, বাচ্চা মেয়েটা টুনি।

চলবে...

আরও পড়ুন