টুনটুনি ও ছোটাচ্চু (সপ্তম পর্ব)

টুনি ছোটাচ্চুর ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, ভেতর থেকে ছোটাচ্চুর উত্তেজিত গলার স্বর শুনে সে দাঁড়িয়ে গেল। ছোটাচ্চু বলছে, ‘না না না, এটা কিছুতেই সম্ভব না।’

সাধারণ কথাবার্তা না শুনলে ক্ষতি নেই কিন্তু কেউ যখন উত্তেজিত গলায় কথা বলে তখন সেটা শুনতে হয়। আর কথাটা যদি ছোটাচ্চু বলে তাহলে কথাটা অবশ্যই ভালো করে শোনা দরকার। টুনি তাই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। শুনল ছোটাচ্চু বলছে, ‘দেখেন, আমাদের আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি তৈরি হয়েছে মানুষের সমস্যা মেটানোর জন্য। এটা মোটেও ভূতের সমস্যার জন্য তৈরি হয়নি। আমরা ভৌতিক সমস্যা মেটাতে পারব না।’

বোঝাই যাচ্ছে ছোটাচ্চু টেলিফোনে কথা বলছে, অন্য পাশ থেকে কী বলছে টুনি সেটা শুনতে পেল না, যেটাই বলুক সেটা শুনে ছোটাচ্চু মোটেও নরম হলো না, আরও গরম হয়ে বলল, ‘আপনার মোটেও ডিটেকটিভ এজেন্সির সাহায্যের দরকার নেই। আপনার দরকার পীর-ফকির, না হলে সাধু-সন্ন্যাসী। তাদের কারও কাছ থেকে একটা হাই পাওয়ার তাবিজ নিয়ে নিন। দেখবেন সব সমস্যা মিটে যাবে।’

ছোটাচ্চু চুপচাপ কিছু একটা শুনল, শুনে আরেকটু গরম হয়ে বলল, ‘আমি আপনার কোনো কথা শুনতে চাই না। আমি এক কথার মানুষ। আমি আপনাকে স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, আমাদের এজেন্সি কখনো ভূতপ্রেত জিন পরি নিয়ে কাজ করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। লাখ টাকা দিলেও না। আপনি শুধু শুধু আমার সময় নষ্ট করছেন।’

টুনি বুঝতে পারল কথা শেষ করে ছোটাচ্চু টেলিফোনের লাইনটা কেটে দিল। টুনি কিছুক্ষণ দরজার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর কিছু জানে না শোনে না এ রকম ভান করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। ছোটাচ্চু টুনিকে দেখে নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা শব্দ করে বলল, ‘যত সব পাগল-ছাগল।’

টুনি জিজ্ঞেস করল, ‘কে পাগল-ছাগল?’

ছোটাচ্চু হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, ‘এই তো!’ তার মানে ছোটাচ্চু টুনিকে ভূত পার্টির কথা বলতে চাইছে না, টুনি তাই ভান করল সে কিছুই জানে না। একটু এদিক-সেদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নতুন কোনো কেস এসেছে ছোটাচ্চু?’

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, ‘নাহ্।’

টুনি শেষবার চেষ্টা করল, ‘কেউ কখনো ফোন-টোন করে না?’

ছোটাচ্চু ভুরু কুঁচকে টুনির দিকে তাকাল, তারপর বলল, ‘করে, আবার করে না।’

এই কথাটার অর্থ যা কিছু হতে পারে। টুনি বুঝতে পারল ছোটাচ্চু ভূত পার্টির কথা নিজে থেকে বলবে না। অন্য কোনো লাইনে চেষ্টা করতে হবে। টুনি কিছুক্ষণ চিন্তা করল, তারপর বুঝতে পারল ফারিহা আপুর লাইন ছাড়া গতি নেই। তাই তখন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘ছোটাচ্চু, তোমার মোবাইল ফোনটা একটু দেবে?’

ছোটাচ্চু চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন?’

মোবাইল ফোন দিয়ে কেউ কান চুলকায় না, কিংবা চুল আঁচড়ায় না, মোবাইল ফোন দিয়ে মানুষ টেলিফোন করে, কাজেই ছোটাচ্চুর এই প্রশ্নের কোনো অর্থ নেই, এর উত্তর দেওয়ারও দরকার নেই। কিন্তু গরজটা যেহেতু টুনির তাই সে ধৈর্য ধরে উত্তর দিল, ‘একটা জরুরি ফোন করতে হবে।’

ছোটাচ্চু মুখের মাঝে একটা বিরক্তির ভান করে ফোনটা টুনির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘নে। বেশিক্ষণ লাগাবি না কিন্তু, আমার কিছু জরুরি ফোন আসবে।’

টুনি মাথা নেড়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বের হয়ে গেল। ছোটাচ্চু যেন শুনতে না পায় সে রকম দূরে গিয়ে ফোনটা টেপাটেপি শুরু করে ফারিহার নাম্বারটা বের করে ডায়াল করল। ডায়ালটোন একটা দেশাত্মবোধক গান, বেশ সুন্দর, গানটা যখন উপভোগ করতে শুরু করেছে তখন ফারিহাপুর গলার স্বর শুনতে পেল। খানিকটা ধমকের সুরে বলল, ‘কী সাহেব? আমাকে কী মনে করে?’

অলংকরণ: সাদাত

টুনি বলল, ‘ফারিহাপু, আমি টুনি।’

‘ও টুনি, আমি ভাবলাম শাহরিয়ার—তা কী খবর?’

‘ফারিহাপু, তোমাকে একটা কাজে ফোন করেছি।’

‘কী কাজ?’

‘কাজটা একটু গোপনীয়। আমি যে তোমাকে ফোন করছি ছোটাচ্চু সেটা জানে না।’

ফারিহা শব্দ করে হাসল, বলল, ‘জানার দরকার নেই। কী কাজ বলো।’

টুনি বলল, ‘ছোটাচ্চুর একটা কেস এসেছে। ছোটাচ্চু কেসটা নিতে চাচ্ছে না।’

‘কী বললে? শাহরিয়ারের কেস এসেছে, সে কেস নিতে চাচ্ছে না?’

‘না। ফারিহাপু, তুমি কি ছোটাচ্চুকে কেসটা নিতে রাজি করাতে পারবে?’

‘কিন্তু আগে শুনি কেন রাজি হতে চাচ্ছে না। সে তো দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা কেসের জন্য বসে থাকে। এখন পেয়েও নিচ্ছে না, ব্যাপার কী?’

টুনি বলল, ‘আমি ঠিক জানি না, ছোটাচ্চুর কথা শুনে মনে হলো কেসটা ভূতের। আর ছোটাচ্চু ভূতকে খুব ভয় পায়।’

‘শাহরিয়ার ভূতকে ভয় পায়?’

‘হ্যাঁ, ভূত আর মাকড়সা।’

ফারিহা বলল, ‘মাকড়সাকে ভয় পাওয়া নাহয় বুঝতে পারলাম, কিন্তু ভূতকে ভয় পায় মানে কী? সে কোনখানে ভূত দেখেছে?’

টুনি ফারিহার কথা শুনে আরও উৎসাহ পেল, বলল, ‘আমিও তো তা-ই বলি? যেটা কেউ কখনো দেখেনি সেটাতে ভয় পাওয়ার কী আছে। দেখা পেলে আরও ভালো, ধরে নিয়ে আসা যাবে।’

ফারিহা থতমত খেয়ে বলল, ‘ধরে নিয়ে আসা যাবে?’

‘হ্যাঁ, বড় হলে খাঁচায় ভরে, মাঝারি সাইজ হলে বোতলে ভরে আর ছোট হলে শিশিতে ভরে—’

ফারিহা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, একটা ভূতকে যে বোতল কিংবা শিশিতে ভরে আনা যায় সেটা সে কখনো চিন্তা করেনি। টুনি বলল, ‘ফারিহাপু, তুমি প্লিজ ছোটাচ্চুকে কেসটা নিতে একটু রাজি করাবে? প্লিজ প্লিজ? আমার খুব ভূত দেখার শখ।’

ফারিহা বলল, ‘কিন্তু আমি তো ভূতের ক্লায়েন্ট সম্পর্কে কিছুই জনি না। শাহরিয়ারকে কী বলব? কীভাবে বলব?’

টুনি বলল, ‘সেটা আমি জানি না। কিন্তু আমি যে তোমাকে বলেছি সেটা কিছুতেই বলতে পারবে না। সেটা বললে ছোটাচ্চু আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে।’

ফারিহা কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল, ‘যদি এই ভূতের ক্লায়েন্ট কারা সেটা যদি জানতে পারতাম তাহলে চেষ্টা করে দেখা যেত।’

টুনি বলল, ‘এক সেকেন্ড! ছোটাচ্চুর এই ফোনে তার টেলিফোন নম্বর আছে। এইমাত্র ফোন করেছিল।’

‘বের করে বলো দেখি।’

টুনি ভূতের পার্টির টেলিফোন নম্বরটা বের করে ফারিহাকে বলে দিল।

ছোটাচ্চুকে ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে টুনি তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার চেষ্টা করছিল, ছোটাচ্চু তাকে থামাল। জিজ্ঞেস করল, ‘এতক্ষণ কার সঙ্গে গুজগুজ ফুসফুস করছিলি?’

টুনি বলল, ‘এই তো।’

‘এই তো মানে?’

টুনি কোনো উত্তর না দিয়ে উদাস মুখে দাঁড়িয়ে রইল, একটু আগে ছোটাচ্চু নিজেও বলেছে, ‘এই তো!’ তখন টুনি জানতে চায়নি ‘এই তো’ মানে কী? এখন ছোটাচ্চু কেন জানতে চাইছে? ডিটেকটিভ হওয়ার পর মনে হয় ছোটাচ্চুর কৌতূহল বেড়েছে। মোবাইল টিপে দেখে নিল টুনি কাকে ফোন করেছে, ফারিহার নাম দেখে চোখ কপালে তুলে বলল, ‘তুই ফারিহাকে ফোন করেছিস?’

টুনি মাথা নাড়ল।

‘কেন?’

‘এই তো।’

ছোটাচ্চু রেগে গেল, বলল, ‘এই তো এই তো করবি না, মাথা ভেঙে দেব। কেন ফোন করেছিলি?’

‘একটা শব্দের ইংরেজি জানার জন্য।’

ছোটাচ্চু মুখ হাঁ করে বলল, ‘শব্দের ইংরেজি?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমাকে জিজ্ঞেস করলি না কেন?’

‘তুমি বাংলাই ভালো করে জানো না, ইংরেজি কতটুকু জানবে?’

ছোটাচ্চু থমথমে গলায় বলল, ‘আমি বাংলা জানি না?’

‘নাহ্। মনে নাই, হেসেছে না বলে তুমি বলো হাসি করেছে। আমরা বলি অমুক গেছে, তমুক যাবে আর তুমি বল অমুক গেছে তমুক গাবে।’

‘আমি কখন একটা বলি?’

টুনি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ঘাড় ঝাঁকাল, দাদুর কাছে সবাই শুনেছে ছোটাচ্চু ছেলেবেলায় এভাবে কথা বলত, সেই বিষয়টাকে এভাবে বেশিদূর টানাটানি করা বুদ্ধির কাজ হবে না। সে আবার ঘর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করল, ছোটাচ্চু হুংকার দিয়ে তাকে থামাল, ‘তুই কোন শব্দের ইংরেজি জানার জন্য আমাকে জিজ্ঞেস না করে ফারিহাকে ফোন করেছিস?’

টুনি শুকনো মুখে ঢোঁক গিলে বলল, ‘শব্দটা হচ্ছে—শব্দটা হচ্ছে—ইয়ে’ হঠাৎ করে টুনির ঠিক শব্দটা মনে পড়ে গেল। সে বলল, ‘শব্দটা হচ্ছে অভিমান।’

‘অভিমান?’ ছোটাচ্চু ভুরু কুঁচকে বলল, ‘অভিমানের ইংরেজি হচ্ছে ইয়ে মানে—’ ছোটাচ্চু মাথা চুলকাতে থাকে, টুনি সেই ফাঁকে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

বিকেলবেলা ফারিহা এসে হাজির আর তাকে দেখে ছোটাচ্চুর মুখ এক শ ওয়াট বাতির মতো জ্বলে উঠল। সবগুলো দাঁত বের করে বিশাল একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘আরে ফারিহা, তুমি?’

‘হ্যাঁ। আমি কি তোমাদের বাসায় আসতে পারি না?’

‘অবশ্যই আসতে পারো।’

‘বিশেষ করে যখন তোমার জন্য বিশাল একটা কাজ করে ফেলেছি তখন তো আসতেই পারি।’

ছোটাচ্চুর মুখ আনন্দে দুই শ ওয়াট বাতির মতো জ্বলে উঠল, বলল, ‘আমার জন্য কী কাজ করেছ?’

ফারিহা চোখ বড় বড় করে বলল, ‘তোমার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির জন্য একটা বিশাল ক্লায়েন্ট জোগাড় করেছি।’

‘সত্যি?’ ছোটাচ্চুর মুখ এবার তিন শ ওয়াট বাতির মতো জ্বলতে লাগল।

‘হ্যাঁ। এক ভদ্রলোকের গাজীপুরের দিকে একটা বাগানবাড়ি আছে। সেই বাড়িতে রাতে কেউ থাকতে পারে না। ভূতের নাকি উপদ্রব।’ ফারিহা শরীর দুলিয়ে হি হি করে হাসতে লাগল।

ছোটাচ্চুর তিন শ ওয়াট মুখটা দেখতে দেখতে চল্লিশ ওয়াটে নেমে এল। ফারিহা সেটা না দেখার ভান করে বলল, ‘তোমাকে সেই বাগানবাড়িতে এক রাত থেকে রহস্য উদ্ঘাটন করে দিতে হবে। বলে দিতে হবে ওটা আসলেই ভূত নাকি অন্য কিছু।’

ছোটাচ্চুর মুখটা চল্লিশ ওয়াট থেকে আরও নিচে নেমে পঁচিশ ওয়াটের বাতির মতো টিমটিম করে জ্বলতে জ্বলতে একসময় পুরোপুরি ফিউজ হয়ে গেল। ছোটাচ্চুর মুখটা দেখে ফারিহার রীতিমতো মায়া হচ্ছিল কিন্তু সে না দেখার ভান করল। বলল, ‘আমি তোমার পক্ষে সব কথা পাকা করে ফেলেছি।’

ছোটাচ্চু তার অন্ধকার মুখ নিয়ে বলল, ‘পা-পা-পাকা করে ফেলেছ?’

‘হ্যাঁ। পরশু দিন একটা এসি মাইক্রোবাসে তোমার টিমকে নিয়ে যাবে। পরের দিন আবার নিয়ে আসবে। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ওই পার্টির।’

ছোটাচ্চুর মুখটা আরও অন্ধকার হয়ে গেল। ফারিহা বলল, ‘আমি কোনো কাঁচা কাজ করি না। বলেছি অর্ধেক অ্যাডভান্স করতে হবে। এক কথায় রাজি। চেক লিখে মেইল করে দিয়েছে। কালকে পেয়ে যাবে।’

বেশ কিছুক্ষণ থেকে ছোটাচ্চু কথা বলার চেষ্টা করছিল। ফারিহা সুযোগ দিচ্ছিল না, এবার একটু চেষ্টা করে বলল, ‘ওই লোক তোমার খোঁজ পেল কেমন করে?’

ফারিহা কথাটাকে খুব গুরুত্ব দিল না, হাত দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, ‘মনে হয় জানে তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। সেই জন্য আমাকে মিসড কল দিয়েছে।’

‘মিসড কল? এত বড় একটা ক্লায়েন্ট মিসড কল দেয়?’

‘আরে মিসড কল হচ্ছে একটা কালচার। বড়-ছোটর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।’

ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ মুখটা অন্ধকার করে বসে থাকল। তারপর ফোঁস করে একটা বিশাল নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘ওই পার্টি আগে আমাকে ফোন করেছিল।’

‘সত্যি?’ ফারিহা অবাক হওয়ার একটা অসাধারণ অভিনয় করল।

‘হ্যাঁ’ ছোটাচ্চু বলল, ‘আমি তাকে পরিষ্কার না করে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম...’

‘কী বলেছিলে?’

‘বলেছিলাম লাখ টাকা দিলেও এই ভূতের কেস নেব না।’ ফারিহা মধুর ভঙ্গি করে হাসল, বলল, ‘তুমি তোমার কথা রেখেছ। পার্টি লাখ টাকা দেবে না—অনেক কম দেবে।’

ছোটাচ্চু কেমন যেন ঘোলা চোখে ফারিহার দিকে তাকিয়ে রইল।

সন্ধ্যাবেলা টুনি ছোটাচ্চুকে দেখতে তার ঘরে গেল। ছোটাচ্চু তার বিছানায় পা ভাঁজ করে বসে আছে, মুখ দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র খবর পেয়েছে যে তার যাবজ্জীবন জেল হয়ে গেছে। টুনিকে দেখে চিঁ চিঁ করে বলল, ‘টুনি।’

টুনি বলল, ‘কী হয়েছে ছোটাচ্চু?’

‘খুবই খারাপ খবর।’

খারাপ খবর শুনলে চোখে-মুখে যে রকম ভাব করার কথা টুনি সে রকম ভাব করে বলল, ‘কী খারাপ খবর?’

‘ফারিহা আমাকে খুব বিপদে ফেলে দিয়েছে।’

‘ফারিহাপু? বিপদে? তোমাকে?’

‘হ্যাঁ। একটা কেস নিয়ে নিয়েছে আমাকে জিজ্ঞেস না করে। আমি না করে দিয়েছিলাম।’

অলংকরণ: সাদাত

টুনি জিজ্ঞেস করল, ‘কী কেস ছোটাচ্চু?’

‘একটা ভূতের বাড়ি চেক করে দেখতে হবে সত্যি না মিথ্যা।’

‘নিশ্চয়ই মিথ্যা ছোটাচ্চু। সত্যি সত্যি তো আর ভূত নেই।’

‘যদি থাকে?’

‘ভূত থাকলে নিশ্চয়ই ভূতের ওষুধও আছে।’

ছোটাচ্চু জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, ‘আমিও তাই বলছিলাম। ভূতের তাবিজ-কবজ নিশ্চয়ই আছে। আছে না?’

টুনি কী আর করবে, মাথা নাড়ল। ছোটাচ্চু বলল, ‘আমি তাই ভাবছিলাম খামোখা রিস্ক নিয়ে লাভ কী? একটা পীর-ফকিরকে খুঁজে বের করে একটা তাবিজ নিয়ে ফেলি, কী বলিস?’

টুনি মাথা নাড়ল। ছোটাচ্চু চিঁ চিঁ করে বলল, ‘মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ভূত তাড়ানোর দোয়া-দরুদ জানে কি না।’

‘দাদু কী বলেছে?’

‘মা বলেছে, আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে ফুঁ দিলে ভূত ধারে-কাছে আসতে পারে না।’

‘তাহলে আয়াতুল কুরসিটা মুখস্থ করে ফেলো।’

ছোটাচ্চু মুখ শুকনো করে বলল, ‘চেষ্টা করে দেখেছি, মুখস্থ হতে চায় না।’

‘তোমার ফোনে রেকর্ড করা যায় না? ফোনে রেকর্ড করে নাও, যখন দরকার পড়বে চালিয়ে দেবে।’

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, ‘আইডিয়াটা খারাপ না।’

এর আগে ছোটাচ্চু যতবার তার ডিটেকটিভ কাজকর্ম করেছে ততবার বাচ্চাকাচ্চাদের এক শ হাত দূরে রেখেছে। কাউকে ধারে-কাছে আসতে দেয়নি। এই প্রথমবার দেখা গেল ছোটাচ্চু সবাইকে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুব ব্যস্ত। যেই যেতে চাইছে, তাকেই ছোটাচ্চু নিয়ে যেতে রাজি হয়ে যাচ্ছে। এতজন বাচ্চাকাচ্চাকে ছোটাচ্চু কেমন করে নিয়ে যাবে টুনি বুঝতে পারল না, সবাইকে নিতে হলে একটা মাইক্রোবাসে হবে না, একটা ডাবল ডেকার বাস লাগবে। বাচ্চাকাচ্চাদের আব্বু-আম্মুরা নিজেদের বাসায় বাচ্চাকাচ্চাদের ভালো-মন্দ নিয়ে মাথা ঘামায় না কিন্তু এবার ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। অন্য কারও বাসায় সবাই রাত কাটাবে। কোথায় ঘুমাবে, কী খাবে এসব নিয়ে তারা দুশ্চিন্তা করতে লাগল। এই বাসায় তাদের কেউ দেখে রাখে না, তার দরকারও হয় না কিন্তু সেই ভূতের বাড়িতে একজন বড় মানুষ দেখে না রাখলে বাচ্চাকাচ্চাগুলো কী পাগলামো করে ফেলবে সেটা নিয়ে আব্বু-আম্মুরা চিন্তায় পড়ে গেল।

ঝুমু খালা তার সমাধান করে দিল। সবাই মিলে ভূতের বাড়ি যাচ্ছে শুনে সে একটা ঝাঁটা হাতে নিয়ে বলল সে সঙ্গে যাবে আর এই ঝাঁটা দিয়ে পিটিয়ে ভূতের গুষ্টিকে নির্বংশ করে দেবে। সঙ্গে ঝুমু খালা থাকবে শুনে বাচ্চাকাচ্চাদের আম্মু-আব্বুরা নিশ্চিন্ত হয়ে গেল। তার মতো কাজের মানুষ আর কেউ নেই।

ঝুমু খালার এই বাসায় সপ্তাহ খানেক থেকে তার নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু দাদির সঙ্গে তার একধরনের বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়ার জন্য সে আর ফিরে যায়নি। সন্ধ্যার পর দাদির পায়ের কাছে বসে সে রসুন দেওয়া গরম সরিষার তেল দাদির পায়ে ডলে ডলে লাগাতে লাগাতে বাংলা সিরিয়াল দেখে এবং দুজনে মিলে সিরিয়ালের যত চরিত্র আছে তাদের সমালোচনা করে। দাদি এবং ঝুমু খালার কথা শুনে মনে হতে পারে টেলিভিশনে বাংলা সিরিয়ালের চরিত্রগুলো সত্যিকারের মানুষ। রসুন দেওয়া সরিষার তেল মাখানোর কারণে দাদির শরীর থেকে সব সময় কেমন যেন একধরনের কাবাবের গন্ধ বের হয়, দাদির সেটা নিয়ে মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।

ঝুমু খালার ঝাঁটা দেখে একজন বাচ্চা জিজ্ঞেস করল, ‘ঝুমু খালা, তুমি কেমন করে ঝাড়ু দিয়ে পেটাবে। ভূতকে তো দেখা যায় না।’

ঝুমু খালা বলল, ‘খালি চোখে দেখা যায় না। কলকের ভেতর দিয়ে তাকালে সব ভূত দেখা যায়।’

বাচ্চাদের বেশির ভাগই কলকে চেনে না, তাই ঝুমু খালাকে হুঁকো এবং কলকে ব্যাখ্যা করতে হলো। হুঁকো খাওয়ার বদলে মানুষজন সিগারেট খেয়ে যে পৃথিবীর কত বড় সর্বনাশ করে ফেলেছে ঝুমু খালা সেটা খুব জোর দিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে দিল।

একজন জিজ্ঞেস করল, ‘ঝুমু খালা, তুমি কখনো কলকের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে ভূত দেখেছ?’

‘দেখিনি আবার! এক শবার এক শ রকম ভূত দেখেছি।’ আরেকজন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘দেখতে কী রকম?’

ঝুমু খালা হাত-পা নেড়ে বলল, ‘বেশির ভাগ ভূতের সাইজ হয় ছোট। তাদের ঘাড় নেই, ধড়ের ওপর এই এত বড় মাথা। চোখগুলো লাল, নাক নেই সেইখানে দুইটা গর্ত। মুখে মুলার মতন দাঁত, লম্বা জিব। হাতগুলান হাঁটুর সমান লম্বা। দেখলে মনে হয় শরীর থেকে চামড়া তুলে নিয়েছে, সেই খানে আবার বিশ্রী গন্ধ। মড়া পোড়ালে যে রকম গন্ধ বের হয় সেই রকম।’

ঝুমু খালার বর্ণনা শুনে বেশির ভাগ বাচ্চার ভূত দেখার শখ মিটে গেল।

ভূতের বাড়ি যাওয়ার জন্য অনেকেই রেডি হয়ে থাকলেও যখন যাওয়ার সময় হলো তখন তাদের সংখ্যা কমতে শুরু করল। যারা বেশি ছোট তাদের আম্মুরা ভেটো দিয়ে দিল। দেখা গেল অনেকেরই পরের দিন পরীক্ষা। সবচেয়ে উৎসাহী একজনের হঠাৎকরে এক শ তিন ডিগ্রি জ্বর উঠে গেল। একজনের পরের দিন তার প্রাণের বন্ধুর জন্মদিন, সেই জন্মদিনে না গেলে প্রাণের বন্ধুর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে, তাই তার ভূতের বাড়ি যাওয়ার আশা ছেড়ে দিতে হলো। তার দেখাদেখি অন্য কয়েকজনও ঠিক করল তারাও যাবে না। ভূতের বাড়িতে টেলিভিশন নাও থাকতে পারে আশঙ্কা করে টেলিভিশনের পোকা দুজন পিছিয়ে গেল। তাদের দেখাদেখি অন্য দুইজন। কয়েকজন কোনো কারণ না দেখিয়ে পিছিয়ে গেল, তারা মুখে কিছু না বললেও অনুমান করা গেল ঝুমু খালার ভূতের বর্ণনা শুনে তারা যাওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে!

অলংকরণ: সাদাত

কাজেই পরের দিন যখন একটা মাইক্রোবাস সবাইকে ভূতের বাড়ি নিয়ে যেতে হাজির হয়েছে, তখন মানুষজন খুবই কম। ছোটাচ্চু, শান্ত, টুনি, টুম্পা তাদের সঙ্গে ঝুমু খালা। ছোটাচ্চুর গলায় একটা বড় তাবিজ, সেটা ছোটাচ্চু লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু কালো সুতার কারণে বেশ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। ঝুমু খালা তার প্রিয় ঝাঁটাটা নিয়ে রওনা দিতে চেয়েছিল কিন্তু তাকে বোঝানো গিয়েছে ভূতের বাড়িতে গিয়েও একটা ঝাঁটা পাওয়া যাবে। শান্ত একটা ক্রিকেট ব্যাট নিয়েছে—মোটেও ক্রিকেট খেলার জন্যে নয়—অস্ত্র হিসেবে। ক্রিকেট ব্যাটকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায় কি না, সেটা নিয়ে এখনো কোনো প্রশ্ন করা হয়নি। টুনির ব্যাগে ঘুমের কাপড়, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, সাবান, তোয়ালে, নোটবই ছাড়াও আরও কিছু মালমসলা আছে, যেটা এখনো কেউ জানে না। সে আগের দিন বাজারে ঘোরাঘুরি করে সংগ্রহ করেছে। টুম্পা একটা মোটা গল্পের বই নিয়েছে, টুনির ওপরে তার অনেক বিশ্বাস—টুনি বলেছে, গল্পের বই ছাড়া আর কিছুই নেওয়ার দরকার নেই।

মাইক্রোবাসে ওঠার সময় শান্ত সবার আগে লাফিয়ে সামনের সবচেয়ে ভালো সিটটাতে বসে গেল। তার পাশে বসল ছোটাচ্চু, পেছনের সিটে টুনি আর টুম্পা। ঝুমু খালা ড্রাইভারের পাশের সিটে। মাইক্রোবাসটা ছাড়ার সময় ড্রাইভার খুব সন্দেহের চোখে ঝুমু খালাকে একনজর দেখে নিল, ঝুমু খালা তার চাইতেও বেশি সন্দেহের চোখে ড্রাইভারকে কয়েক নজর দেখে নিল।

মাইক্রোবাসটা ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোঝা গেল ড্রাইভার খুব বেশি কথা বলে। একজন যখন কথা বলে তখন অন্যদের সেই কথাটা শোনার কথা, প্রথম কিছুক্ষণ তাই সবাই ড্রাইভারের কথা শোনার চেষ্টা করল—কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই হাল ছেড়ে দিল। তার কারণ, ড্রাইভার গাড়ি ড্রাইভিং নিয়ে তার আলোচনাটা শুরু করল এভাবে, ‘যখন ট্রেনে মানুষ কাটা পড়ে তখন কি ট্রেনের ড্রাইভারের নামে মামলা হয়? হয় না। তাহলে যখন মানুষ গাড়ির নিচে চাপা পড়ে, তখন গাড়ির ড্রাইভারের নামে মামলা কেন হয়? কী যুক্তি? কোনো যুক্তি নাই। গাড়ির ড্রাইভারের নামে মামলা দেওয়া ঠিক না। একজন ড্রাইভার যখন গাড়ি চালায়, তখন সে কয় দিক দেখবে? রাস্তার মাঝে কি খালি গাড়ি? না। রিকশা, টেম্পো, পাবলিক, গরু, ছাগল কী নাই? আমি আজ পনেরো বছর থেকে গাড়ি চালাই, আমি কি দেখেছি জানেন? গরু-ছাগলের বুদ্ধি পাবলিক থেকে বেশি। কোনো দিন শুনেছেন গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে গরু মরেছে? ছাগল মরেছে? শুনেন নাই। তার কারণ, গরু-ছাগলের বুদ্ধি পাবলিক থেকে বেশি, তারা গাড়ির নিচে চাপা খায় না। পাবলিক রেগুলার চাপা খায়। দোষ হয় ড্রাইভারের। পৃথিবীতে কোনো ইনসাফ নাই। কোনো বিচার নাই। দেশের সব ড্রাইভার মিলে আন্দোলন করা দরকার, প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করা দরকার, গাড়ির ড্রাইভারদের ট্রেনের ড্রাইভারের সমান মর্যাদা দিতে হবে। গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট হলে গাড়ির ড্রাইভারদের কোনো দায়দায়িত্ব নাই। তাদের নামে মামলা করা যাবে না। পাবলিক পিটা দিতে পারবে না—’

মিনিট দশেক সবাই ড্রাইভারের বকবকানি সহ্য করল তারপর ঝুমু খালা ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ড্রাইভার সাহেব।’

‘বলেন।’

‘আমার ব্যাগে একটা গামছা আছে।’

ড্রাইভার অবাক হয়ে বলল, ‘গামছা?’

‘হ্যাঁ। যদি আপনি আর একটা কথা বলেন এই গামছা দিয়ে আপনার মুখটা বেনধে দিব। বুঝেছেন?’

ড্রাইভার অবাক হয়ে ঝুমু খালার দিকে তাকাল, তারপর বলল, ‘আপনে কথাবার্তা পছন্দ করেন না?’

‘করি। কিন্তু—’

‘মানুষ ছাড়া আর কোনো পশুপাখি জন্তু-জানোয়ারের জবান আছে? নাই। এখন মানুষ যদি জবান ব্যবহার না করে, কথা না বলে তাহলে মানুষে আর জানোয়ারে কোনো পার্থক্য আছে? নাই।’

ঝুমু খালা বলল, ‘আপনি বিয়া করছেন? বউ আছে?’

ড্রাইভার থতমত খেয়ে বলল, ‘আছে। বউ আছে। বিয়া করেছি।’

‘কয় নম্বর বউ?’

ড্রাইভার ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কয় নম্বর বউ মানে?’

‘মানে আপনার এক নম্বর বউ নাকি দুই নম্বর বউ নাকি তিন নম্বর?’

ড্রাইভার মুখ শক্ত করে বলল, ‘আপনি কেন এটা জিজ্ঞাসা করছেন?’

ঝুমু খালা বলল, ‘আপনি এত বেশি কথা বলেন, আপনার কোনো বউ ছয় মাসের বেশি লাস্টিং করার কথা না। বড়জোর এক বছর।’

ড্রাইভার কোনো কথা বলল না। ঝুমু খালা বলল, ‘কী হলো, কথা বলেন না কেন? কত নম্বর বউ?’

ড্রাইভার এবারেও কোনো কথা বলল না, শুধু নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা শব্দ করল। ঝুমু খালা ছেড়ে দেওয়ার পাত্র না, মাথাটা ড্রাইভারের দিকে ঝুঁকিয়ে বলল, ‘শরমের কী আছে? বলে ফেলেন!’

ড্রাইভার বলল, ‘আপনার মুখ খুব খারাপ। বড় বাজে কথা বলেন।’

ঝুমু খালা শব্দ করে হাসল, বলল, ‘সত্যি কথা বললে মুখ খারাপ হয়? ঠিক আছে, আপনার কিছু বলতে হবে না। যা বোঝার আমরা সেটা বুঝে নিয়েছি। তয় ড্রাইভার সাহেব, আপনারে একটু উপদেশ দেই, যদি বউরে লাস্টিং করাতে চান, কথা কম বলবেন।’

ড্রাইভার সেই যে মুখ বন্ধ করল আর কথা বলল না। পেছনে বসে ছোটাচ্চু থেকে শুরু করে টুম্পা পর্যন্ত সবাই ঝুমু খালার ধারালো জিবটাকে মনে মনে স্যালুট দিল।

শহরের ভিড়, ট্রাফিক জ্যাম পার হয়ে যখন মাইক্রোবাসটা একটু ফাঁকা রাস্তায় উঠে গেল তখন সবাই ড্রাইভারের দ্বিতীয় এবং আসল গুণটার খবর পেল। তারা আবিষ্কার করল, ড্রাইভার গুলির মতো মাইক্রোবাসটাকে রাস্তা দিয়ে প্রায় উড়িয়ে নিতে শুরু করেছে। এ রকম বিপজ্জনকভাবে যে গাড়ি চালানো যায়, তারা নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারে না।

বিপরীত দিক থেকে একটা ভয়ংকর ট্রাক ছুটে আসছিল, মাইক্রোবাসের ড্রাইভার তার মাঝে রাস্তা দিয়ে যাওয়া একটা বাসকে ওভারটেক করে সেই ভয়ংকর ট্রাকের একেবারে গায়ে ঘষা দিয়ে বের হয়ে গেল। ছোটাচ্চু প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘সর্বনাশ!’

ড্রাইভার ছোটাচ্চুর চিৎকার শুনল বলে মনে হলো না, দৈত্যের মতো ছুটে আসা আরেকটা ট্রাকের দিকে মুখোমুখি ছুটে যেতে যেতে একেবারে শেষ মুহূর্তে কোনোভাবে পাশ কাটিয়ে গেল। ট্রাক ড্রাইভার পর্যন্ত চমকে উঠে বিকট সুরে হর্ন বাজাতে থাকল। ছোটাচ্চু আবার চিৎকার করে বলল, ‘ড্রাইভার সাহেব! সাবধান!’

ড্রাইভার ‘সাহেব’ কোনো কথা বলল না। ছোটাচ্চুর কথা শুনেছে সে রকম ভাব দেখাল না। ঠিক যেভাবে মাইক্রোবাস চালাচ্ছিল, সেভাবে চালিয়ে যেতে থাকল। মনে হলো হঠাৎ করে স্পিড আরও বাড়িয়ে দিল। ছোটাচ্চু গলা উঁচিয়ে বলল, ‘ড্রাইভার সাহেব!’

ড্রাইভার মাথা ঘুরিয়ে বলল, ‘কী হইছে?’

‘এইভাবে ড্রাইভ করছেন কেন? একটু সাবধানে চালান।’

ড্রাইভার আবার সামনে তাকিয়ে বলল, ‘কেন?’

‘যেকোনো সময়ে অ্যাকসিডেন্ট হবে!’

‘অ্যাকসিডেন্ট কি হয়েছে?’

‘হয় নাই কিন্তু তার মানে না যে হতে পারে না। আপনি আস্তে চালান, সাবধানে চালান।’

ড্রাইভার মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘কোনো ভয় নাই। অ্যাকসিডেন্ট হবে না। নিশ্চিত থাকেন।’

‘আপনি যেভাবে চালাচ্ছেন যেকোনো সময়ে অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে।’

ড্রাইভার মাথা নাড়ল, বলল, ‘আমি যেভাবেই চালাই কোনো দিন অ্যাকসিডেন্ট হবে না।’

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, ‘কেন?’

‘এই গাড়ির ওপরে দোয়া আছে।’

‘দোয়া?’

‘জে।’

‘সেটা কী রকম?’

ড্রাইভার মুখ গম্ভীর করে বলল, ‘চাক্কা পীরের নাম শুনেছেন?’

‘চাক্কা পীর?’

‘জে। চাক্কা পীর। চাক্কার ওপরে চলে যত জিনিস তার সবকিছুর জন্য এই পীরের তাবিজ আছে। একেবারে জিন্দা তাবিজ। কোনো গাড়িতে যদি এই তাবিজ থাকে, সেই গাড়ির কোনো দিন অ্যাকসিডেন্ট হয় না।’

‘আপনার গাড়িতে এই তাবিজ আছে?’

‘জে।’

‘কোথায়?’

ড্রাইভার হাত দিয়ে দেখাল, রিয়ার ভিউ মিরর থেকে বড়সড় একটা তাবিজ ঝুলছে। ‘মনে করেন আমি যদি এখন আমার এই গাড়ি সামনের ট্রাকের সাথে অ্যাকসিডেন্ট করার চেষ্টা করি এই গাড়ির কিছু হবে না—ওই ট্রাক রাস্তা থেকে নিচে পড়ে যাবে।’

ছোটাচ্চু নিজে গলায় এত বড় একটা তাবিজ নিয়ে রওনা দিয়েছে এখন তাবিজের ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ করে কেমন করে? তাই খালি দুর্বল গলায় বলল, ‘ট্রাকের সাথে লাগানোর চেষ্টা করবেন না, প্লিজ!’

ড্রাইভার বলল, ‘কী বলেন, স্যার! ওই ট্রাকের ড্রাইভার-হেলপারের জীবনের দাম আছে না?’

একটা বাসকে অসম্ভব বিপজ্জনকভাবে ওভারটেক করে সামনের দিক থেকে আসা আরেকটা বাসের একেবারে গা ঘেঁষে পাশ কাটিয়ে মাইক্রোবাসটা রাস্তার মাঝখানে একটা গর্তের ওপর দিয়ে প্রায় লাফিয়ে পার হয়ে গেল। মাইক্রোবাসের ভেতরে সবাই একবার ডান দিকে, আরেকবার বাম দিকে গড়িয়ে পড়তে লাগল। ছোটাচ্চু দুর্বলভাবে বলল, ‘আস্তে ড্রাইভার সাহেব! একটু আস্তে!’

ড্রাইভার বলল, ‘ভয় পাবেন না, স্যার। আমার গাড়িতে চাক্কা পীরের তাবিজ! আমেরিকা থেকে গাড়ির কোম্পানির মালিক নিজে আসছিল চাক্কা পীর বাবার সাথে দেখা করতে।’

‘কেন?’

‘এই তাবিজ নিতে। গাড়ির কোম্পানি গাড়ি তৈরি করার সময় গাড়ির ভিতরে পাকাপাকিভাবে তাবিজ লাগিয়ে দিবে। গাড়ি আর অ্যাকসিডেন্ট হবে না। চাক্কা পীর বাবা রাজি হয় নাই।’

‘কেন রাজি হয় নাই?’

‘চাক্কা পীর বাবা খালি নিজের দেশের খেদমত করতে চায়।’

‘ও।’

ড্রাইভার বলল, ‘এই দেশের সরকার থেকে মন্ত্রী চাক্কা পীর বাবার কাছে আসছিল।’

‘কেন?’

‘চাক্কা পীর বাবার দোয়া নিতে। চাক্কা পীর বাবা মন্ত্রীরে কী বলেছেন জানেন?’

‘কী বলেছেন?’

‘ড্রাইভিং লাইসেন্সের সাথে সাথে সবাইরে একটা তাবিজ দিতে। তাহলে এই দেশে আর অ্যাকসিডেন্ট হবে না।’

‘মন্ত্রী রাজি হয়েছে?’

‘জে, রাজি হয়েছে। মনে হয় পার্লামেন্টে এইটা নিয়ে আলোচনা হবে, আইন পাস হবে।’

‘ও।’

এ রকম সময়ে টুম্পা বলল, ‘ছোটাচ্চু, বমি করব।’

টুম্পা কম কথার মানুষ, তাই তার কথাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে নেওয়া হয়। বিশেষ করে যখন সে বমি করতে চায় এবং সত্যি সত্যি বমি করলে সেটা ছোটাচ্চুর ঘাড়ে করা হবে। ড্রাইভারের অ্যাকসিডেন্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার তাবিজ আছে কিন্তু বমি থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো তাবিজ নেই, তাই ছোটাচ্চু যখন বলল, ‘ড্রাইভার সাহেব, গাড়ি থামান। একজন বমি করবে।’ তখন ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে তার গাড়ি থামাল।

যে বমি করবে তার গাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি নামার কথা কিন্তু টুম্পাকে খুব তাড়াহুড়া করতে দেখা গেল না, সে খুব ধীরেসুস্থে নামল। নেমেই বমি করার কোনো লক্ষণ দেখাল না, এদিক-সেদিক তাকাতে লাগল। ঝুমু খালাও দরজা খুলে নেমে টুম্পার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হলো, বমি করবে না?’

‘করব।’

‘কর।’

টুম্পা বলল, ‘এই জায়গাটা ময়লা, আমি এইখানে বমি করব না।’ বলে সে বমি করার জন্যে পরিষ্কার জায়গার খোঁজে সামনের দিকে হাঁটতে লাগল।

বিষয়টা সবার কাছে খানিকটা বিচিত্র মনে হলেও আসলে এটা মোটেও বিচিত্র না, কারণ, বমি করার এই নাটকটা এমনি এমনি হয়নি। ড্রাইভার যখন তার চাক্কা পীরের তাবিজের ওপর ভরসা করে মাইক্রোবাসটাকে রীতিমতো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তখন টুনি টুম্পাকে ফিস ফিস করে বলল, ‘টুম্পা, তোকে একটা কাজ করতে হবে।’

‘কী কাজ?’

‘বমি করতে হবে।’

‘কিন্তু আমার বমি পায় নাই।’

টুম্পা কেউ যেন শুনতে না পায় সেভাবে ফিস ফিস করে বলল, ‘তোর আসলে বমি করতে হবে না। তুই খালি ভান করবি। আগে বলবি তোর বমি করতে হবে তারপর গাড়ি থেকে নামবি। নেমে সময় নিবি। যখন আমি ডাকব তখন গাড়িতে ঢুকবি। এর আগে ঢুকবি না।’

অন্য যে কেউ হলে জিজ্ঞেস করত, ‘কেন?’ টুম্পা জিজ্ঞেস করল না। টুনির ওপরে তার অনেক বিশ্বাস। কেন এই নাটকটা করতে হবে একটু পরে নিশ্চয়ই বোঝা যাবে। তাই যখন টুনি টুম্পাকে সিগন্যাল দিল, টুম্পা বলল, ‘ছোটাচ্চু, বমি করব।’

টুম্পা বমি করার জন্যে সুন্দর জায়গা খুঁজে হাঁটতে থাকে আর ঝুমু খালা তাকে বমি করানোর জন্যে পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকে। ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, ‘কই যায়?’

টুনি বলল, ‘বমি করার জন্যে একটা ভালো জায়গা খুঁজছে।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘বমি করার জন্যে কারও ভালো জায়গা লাগে?’

‘টুম্পার লাগে। টুম্পা খুবই খুঁতখুঁতে।’

তখন প্রথমে ছোটাচ্চু তারপর শান্ত তারপর গাড়ির ড্রাইভার মাইক্রোবাস থেকে নেমে গেল।

টুনি ঠিক এই সময়টার জন্যে অপেক্ষা করছিল। কেউ যেন না দেখে সেভাবে একটু সামনে ঝুঁকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে রিয়ার ভিউ মিররে ঝোলানো চাক্কা পীরের তাবিজটা খুলে নিল, তারপর মুঠিতে ধরে মাইক্রোবাস থেকে নেমে গেল।

টুম্পা তখনো হাঁটছে, টুনি চিৎকার করে বলল, টুম্পা বমি করলে করে ফেল তাড়াতাড়ি।’

টুম্পা তখন বসে মাথা ঝুঁকিয়ে কয়েক বার ‘ওয়াক ওয়াক’ শব্দ করল। বমি করার খুব ভালো অভিনয় বলা যাবে না, কিন্তু কেউ শব্দ করে কখনো বমি করার অভিনয় করে না, তাই কেউ সন্দেহ করল না।

কিছুক্ষণ পর টুম্পা ঝুমু খালার হাত ধরে ফিরে এল। চেহারার মাঝে একটা বিধ্বস্ত ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে রেখেছে। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, ‘বমি হয়েছে?’

ঝুমু খালা উত্তর দিল, ‘বেশি হয় নাই।’

ছোটাচ্চু বলল, না হলেই ভালো।

টুনি বলল, ‘খোলা বাতাসে হাঁটাহাঁটি করলে বমি বমি ভাব কমে যায়।’

শান্ত বলল, ‘লুতুপুতু মানুষকে নিয়ে জার্নি করা ঠিক না।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘থাক, থাক। ছোট মানুষ।’ তারপর টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলল, এখন যেতে পারবি?’

টুম্পা মাথা নেড়ে জানাল যে সে যেতে পারবে। তখন একজন একজন করে সবাই আবার মাইক্রোবাসে উঠে পড়ল। ড্রাইভার তার সিটে বসে আবার গাড়ি স্টার্ট করে। দেখতে দেখতে মাইক্রোবাসের স্পিড বাড়তে থাকে, সামনে যা কিছু আছে সবকিছু ওভারটেক করে ফেলে, উল্টো দিক থেকে যা কিছু আছে তার গা ঘেঁষে যেতে থাকে, মাঝে মাঝেই হেডলাইট জ্বালিয়ে-নিভিয়ে বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়িগুলোকে চোখ রাঙানি দিয়ে সামনে থেকে সরে যেতে বাধ্য করতে থাকে। ছোটাচ্চু কয়েকবার বলল, ‘আস্তে ড্রাইভার সাহেব, আস্তে।’

ড্রাইভার তার কথা শুনল না।

একটা বড় বাসকে ওভারটেক করে ড্রাইভার যখন গুলির মতো সামনে চলে গেল, ঝুমু খালা সিট ধরে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘ড্রাইভার সাহেব।’

‘কী হলো?’

‘আপনার আসলে অ্যারোপ্লেনের পাইলট হবার কথা ছিল। কপালের দোষে হয়েছেন গাড়ির ড্রাইভার।’

ড্রাইভার কোনো কথা না বলে বিষদৃষ্টিতে একবার ঝুমু খালার দিকে তাকাল। ঝুমু খালা বলল, ‘আপনার মনে হয় কেউ এখনো বলে নাই, আপনার গাড়ির কিন্তু দুই দিকে পাঙ্খা নাই। যত জোরেই চালান এইটা কিন্তু আকাশে উড়বে না।’

ড্রাইভার মুখ খিঁচিয়ে বলল, ‘আপনার মুখ খুব খারাপ।’

ঝুমু খালা বলল, ‘গরিবের পরিবার। জন্মের সময় বাপে মধু কিনে আনতে পারে নাই। বাড়িতে কাঁচা মরিচ ছিল, মুখে সেইটাই দিছিল। তাই আমার মুখ এত খারাপ। মুখে মিষ্টি কথা আসে না।’

‘মিষ্টি কথা না আসলে চুপ করে থাকেন। ঝাল কথা বলতে হবে কেন?’

‘তার কারণ, গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট হলে আপনি একলা মরবেন না, তার সঙ্গে আমরা সবাই মরব। আপনি মরতে চান মরেন, বাড়িতে গিয়ে গলায় দড়ি দেন। কিন্তু আমাদের সবাইরে আপনি মারতে পারবেন না।’

ড্রাইভার গলা উঁচিয়ে বলল, ‘আপনারে কতবার বলব আমার গাড়িতে চাক্কা পীরের তাবিজ আ—’ কথা বলার সময় চোখের কোনা দিয়ে তাবিজটা একনজর দেখতে গিয়ে সে আবিষ্কার করল রিয়ার ভিউ মিররে ঝোলানো তাবিজটা নেই, তাই সে কথা শেষ না করে মাঝখানে থেমে গেল। হেঁচকি তোলার মতো শব্দ করে বলল, ‘তা-তা-তাবিজ, আমার তাবিজ!’

সবাই তখন দেখল যেখানে একটা তাবিজ ঝুলছিল সেখানে কিছু নেই। কীভাবে সেটা ঘটেছে সেটা শুধু টুম্পা বুঝতে পারল। সে টুনির দিকে তাকাল, টুনি চোখ টিপে মুচকি হাসল।

ঝুমু খালা চিৎকার করে বলল, ‘আপনার তাবিজ কই গেল?’

ড্রাইভার খুব তাড়াতাড়ি গাড়িকে থামিয়ে এনে রাস্তার পাশে দাঁড়া করিয়ে আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে থাকে। হাহাকারের মতো শব্দ করে বলল, ‘আমার তাবিজ! আমার চাক্কা পীরের তাবিজ!’

ঝুমু খালা বলল, ‘আপনি বলছিলেন আপনার তাবিজ জিন্দা। সেই জন্যে মনে হয় উড়ে উড়ে চলে গেছে।’

সবাই ভাবল ঝুমু খালার টিটকারি শুনে ড্রাইভার বুঝি রেগে উঠবে। ড্রাইভার রাগল না, চোখেমুখে গভীর একটা দুঃখের ভাব ফুটিয়ে বলল, ‘আপনি আমার সঙ্গে মশকরা করছেন। কিন্তু এই তাবিজ আসলেই জিন্দা। বিনা অজুতে এই তাবিজ ছুঁতে হয় না। এই তাবিজের অপমান করলে তাবিজ গায়েব হয়ে যায়। আপনারা সবাই এই তাবিজের বেইজ্জতি করেছেন, তাবিজ গোস্সা করে গায়েব হয়ে গেছে।’

ঝুমু খালা বলল, ‘আমরা কখন আপনার তাবিজের বেইজ্জতি করলাম?’

‘একটু পরে পরে বলেছেন অ্যাকসিডেন্ট হবে অ্যাকসিডেন্ট হবে, সেইটা তাবিজের বেইজ্জতি হলো না?’

ছোটাচ্চু একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ঠিক আছে ড্রাইভার সাহেব। এখন রওনা দেন।’

শান্ত বলল, ‘এখন আপনার জিন্দা তাবিজ নাই, তাই আস্তে আস্তে চালাবেন।’

ড্রাইভার ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘নিশানা খুব খারাপ। চাক্কা পীরের তাবিজ নাই, ভালো-মন্দ কিছু একটা না হয়ে যায়।’

ঝুমু খালা বলল, ‘হবে না। আপনি ড্রাইভার ভালো, এতক্ষণ গাড়ি উড়ায়ে নিচ্ছিলেন, এখন রাস্তার উপর দিয়ে নিবেন।’

ড্রাইভার মুখটা কালো করে তার সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট করল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চালিয়ে নিয়ে গেল খুবই সাবধানে, কোনো বিপজ্জনক ওভারটেক করল না, বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা কোনো গাড়িকে হেডলাইট জ্বালিয়ে-নিভিয়ে চোখ রাঙানি দিল না। একেবারে গা ঘেঁষে পার হলো না, হর্ন বাজিয়ে কারও কান ঝালাপালা করল না। এক কথায় বলা যায় সবাই খুবই শান্তিতে পুরো রাস্তা পার করল।

বেশি সাবধানে গাড়ি চালানোর কারণে পৌঁছাতে দেরি হয়ে গেল, যখন শেষ পর্যন্ত কাঁচা রাস্তা দিয়ে ঝাঁকুনি খেতে খেতে মাইক্রোবাসটি ভূতের বাড়ি পৌঁছেছে, তখন বিকেল হয়ে গেছে।

এই বাগানবাড়িটি আগে কেউ দেখেনি, সবাই এটাকে ভূতের বাড়ি বলে এসেছে। বাগানবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হলো এটা বুঝি আসলেই একটা ভূতের বাড়ি। পুরোনো একটা দোতলা বাসা, চারপাশে বড় বড় গাছ দিয়ে ঢাকা। বড় বড় গাছের কারণে দিনের বেলাতেই আবছা অন্ধকার। সামনে বড় বারান্দা, ভারী কাঠের পুরোনো আমলের দরজা-জানালা। পুরোনো দেয়াল থেকে জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়েছে। দালান বেয়ে বেয়ে কিছু কিছু লতানো গাছ উঠে গেছে। দালানটির ঝকঝকে তকতকে ভাবটি নেই কিন্তু সে জন্যে এটাকে খারাপ লাগছে না, বরং এর মাঝে অন্য একধরনের সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে।

গাড়ির শব্দ শুনে পেছন থেকে একজন মাঝবয়সী মানুষ হাজির হলো। মনে হয় এই বাগানবাড়ির কেয়ারটেকার। ছোটাচ্চুকে একটা সালাম দিয়ে বলল, ‘আমার স্যার ফোন করে আমাকে বলেছেন আপনারা দুপুরে আসবেন।’

‘হ্যাঁ। আসতে একটু দেরি হয়ে গেল।’

‘স্যার বলেছিলেন আপনারা নাকি ডিটেকটিভ। এখন তো দেখি সবাই পোলাপান।’

‘আমি এসেছি ডিটেকটিভের কাজে। আর অন্যেরা আসছে বেড়াতে।’ মানুষটা মাথা নেড়ে বলল, ‘ভালো। ভালো। খুব ভালো। এই জায়গাটা বেড়ানোর জন্যে খুব ভালো।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘কিন্তু শুনেছি এই বাড়িটাতে নাকি ভূতের উপদ্রব আছে?’

মানুষটা দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘এই যুগে কেউ ভূত বিশ্বাস করে? ওগুলো বাজে কথা। এই সুন্দর জায়গাটার একটা বদনাম দেবার জন্যে লোকজন এই কথা ছড়ায়।’

‘এর আগে কারা এসেছিল, রাতে নাকি তারা ভূতের ভয় পেয়েছে?’

মানুষটা মুখ গম্ভীর করে বলল, ‘সেটা আমি জানি না, আমাকে কিছু বলে নাই। কোনো পার্টি মনে হয় বাড়ি কিনতে এসেছিল, কম দামে কিনতে চায় তাই এই কথা ছড়িয়েছে। ভেবেছে ভূতের কথা বললে বাড়ি সস্তায় দিবে।’

বাড়িটাতে আসলে ভূতের কোনো উৎপাত নেই শুনে ছোটাচ্চু খুব খুশি হয়ে উঠল। বলল, ‘যদি ভূতের কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে আমাকে খামোখা কেন টেনে আনল?’

‘এসেছেন যখন দুই-একদিন থেকে বেড়িয়ে যান। ভালো লাগবে।’

‘সেইটা অবশ্যি ঠিকই বলেছেন। এ রকম সুন্দর জায়গায় দুই-একদিন থাকলে আসলেই খুব ভালো লাগবে। কিন্তু সেই কপাল তো নেই। সবাই ব্যস্ত, আজকের রাতটা শুধু থাকতে পারব, কালকেই চলে যেতে হবে।’

‘ঠিক আছে, এক দিনই না হয় থাকলেন। আপনাদের ব্যাগগুলো দেন, ভেতরে নিয়ে যাই।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘আমাদের এমন কিছু ব্যাগ-স্যুটকেস নেই, নিজেরাই নিতে পারব।’

তার পরও কেয়ারটেকার মানুষটা টুম্পা আর টুনির ব্যাগ দুটো দুই হাতে করে ভেতরে নিয়ে গেল।

বাইরে যে রকম গা ছমছাম ভাব আছে, ভেতরে সে রকম নেই। মাঝখানে একটা ড্রয়িংরুমের মতো, সেখানে সুন্দর সোফা। এক পাশে একটা লাইব্রেরির মতো, আলমারির ভেতরে অনেক বই, পুরোনো আমলের বাঁধাই, মোটা মোটা বইয়ের গায়ে সোনালি রং দিয়ে বইয়ের নাম লেখা, বেশির ভাগই ইংরেজি। অন্য পাশে ডাইনিং রুম। বড় ডাইনিং টেবিল ঘিরে পুরোনো আমলের কাঠের চেয়ার।

ঘরের মাঝখান দিয়ে চওড়া সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে। দোতলায় দুই পাশে দুটি বেডরুম, প্রত্যেকটা বেডরুমে দুটি করে পরিপাটি বিছানা। বেডরুমের সঙ্গে লাগানো বাথরুম। বাথরুমে পরিষ্কার টাওয়েল, নতুন সাবান। দুই বেডরুমের মাঝখানে একটা লিভিং রুম। সেখানে বসার জন্য সোফা, কফি টেবিল। কফি টেবিলের ওপর কিছু পুরানো ম্যাগাজিন। লিভিংরুমের একপাশে একটা বেসিন। ট্যাপ খোলার পর ঘড়ঘড় একটু শব্দ করে পানি বের হয়ে এল। ঘরের অন্য কোনায় একটা পুরোনো টেলিভিশন।

শান্ত প্রথমেই ডান দিকের বেডরুমের জানালার কাছে সবচেয়ে ভালো বিছানাটা দখল করে নিল। অন্যটাতে ছোটাচ্চু। বাম দিকের বেডরুমের একটাতে ঝুমু খালা, অন্যটাতে টুনি আর টুম্পা। সবাই হাত-মুখ ধুয়ে নিচে নেমে আসে, ডাইনিং টেবিলে চা-নাশতা দেওয়া হয়েছে। ড্রাইভার তাড়াতাড়ি করে কিছু খেয়ে মাইক্রোবাস নিয়ে ফিরে চলে গেল। পরের দিন সকালবেলা তাদের নিয়ে যেতে আসবে। তাবিজ হারানোর পর থেকে তার মুখের দিকে তাকানো যায় না।

ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে খেতে কেয়ারটেকারের সঙ্গে কথাবার্তা হলো। তার নাম রমজান আলী। এই বাগানবাড়ির পেছনেই একটা ছোট দোচালায় সে তার বউকে নিয়ে থাকে। তাদের বাচ্চাকাচ্চা নেই, ছোট শালা তাদের সঙ্গে থাকে। ছোট শালা কলেজে পড়ে, বিএ পরীক্ষা দেবে। ডাইনিং টেবিলে যে নাশতা দেওয়া হয়েছে সেগুলো তার বউ তৈরি করেছে। বউ ভালো রান্না করতে পারে। এই বাগানবাড়িতে যখন কেউ আসে তখন তার বউ রান্না করে। স্বামী-স্ত্রী এই দুজনে মিলে বাগানবাড়িটা দেখেশুনে রাখে—কেউ বেড়াতে না এলে তাদের আলাদা কাজ নেই কিন্তু এই বড় বাড়িটা দেখেশুনে রাখাই অনেক কাজ।

রমজান আলী ডাইনিং টেবিল থেকে কাপ, পিরিচ, বাটি, প্লেট তুলে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল, ‘রাত্রে কী খাবেন?’

শান্ত বলল, ‘পিৎজা। আপনার বউ পিৎজা বানাতে পারে?’

রমজান আলী থতমত খেয়ে বলল, ‘জে না। এটার তো নামও শুনে নাই।’

শান্ত হতাশ হয়ে বলল, ‘তাহলে আর লাভ কী হলো?’

রমজান আলী বলল, ‘এখানে ভালো মাছ পাওয়া যায়—’

শান্ত বলল, ‘নো মাছ। বাসায় আম্মু জোর করে মাছ খাওয়ায়। এখানে মাছ খাব না।’

‘তাহলে মুরগির মাংস?’

শান্ত বলল, ‘দেশি মুরগি? অরিজিনাল বাংলাদেশি পাসপোর্ট?’

খাওয়ার মেন্যু নিয়ে আলোচনা যখন আরও জটিল হয়ে উঠল তখন টুনি উঠে পড়ল। তার দেখাদেখি টুম্পা। খাওয়া নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই, যত আলোচনাই হোক শেষ পর্যন্ত খেতে হবে ভাত, সবজি, ডাল সঙ্গে মাছ না হয় মাংস! এর মাঝে এত আলোচনার কী আছে?

টুনিকে উঠতে দেখে ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, ‘কই যাস?’

টুনি বলল, ‘যাই একটু ঘুরে দেখি।’ দিনের আলো থাকতে থাকতে সে পুবের এলাকাটা দেখতে চায় সেটা আর বলল না।

ছোটাচ্চু বলল, ‘অপরিচিত জায়গা, বেশিদূর যাবি না।’

টুনি মাথা নাড়ল, সে শুধু শুধু বেশি দূর কেন যাবে? এটি হচ্ছে বড় মানুষদের অর্থহীন অপ্রয়োজনীয় উপদেশ।

বাগানবাড়ি থেকে বের হয়ে টুনি পুরো বাড়িটা একবার ভালো করে দেখে। টুনি জিজ্ঞেস করল, ‘কী দেখো টুনি আপু?’

‘এই বাড়িটাতে ইলেকট্রিসিটি আছে। যে বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি থাকে, সেখানে ভূত কীভাবে আসবে? ভূতকে আসতে হয় অন্ধকারে। কোনো দিন শুনেছিস দিনের বেলা ভূত এসেছে? শুনেছিস যখন অনেক আলো তখন ভূত এসেছে?’

টুম্পা মাথা নাড়ল, সে আসলে কখনোই ভূত নিয়ে কিছু শোনেনি। আলোতে এসেছে শোনেনি, অন্ধকারে এসেছে সেটাও শোনেনি।

টুনি বলল, ‘তার মানে হচ্ছে এই বাসায় ভূত আসতে হলে প্রথমে ইলেকট্রিসিটিটা বন্ধ করতে হবে। তার মানে বুঝেছিস?’

টুম্পা মাথা নাড়ল, সে বোঝেনি।

‘তার মানে আমাদের মেইন সুইচটা খুঁজে বের করতে হবে। ভূতকে প্রথমে মেইন সুইচ অফ করতে হবে। আয় এটা খুঁজে বের করি।’

টুনি টুম্পাকে নিয়ে বাড়িটার চারপাশে ঘুরে ঘুরে পেছন দিকে একটা ছোট ঘর খুঁজে বের করল, এর ভেতরে মিটার এবং তার পাশে কয়েকটা সার্কিট ব্রেকার। টুনি কিছুক্ষণ সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে টুম্পাকে বলল, ‘তুই বাইরে পাহারা দে। যদি দেখিস কেউ আসছে তাহলে শব্দ করে কাশবি।’

অন্য যে কেউ হলে জিজ্ঞেস করত টুনি ভেতরে কী করবে, টুম্পা জিজ্ঞেস করল না। সময় হলেই সে নিজের চোখে দেখবে। টুনি আপুর ওপরে তার অনেক বিশ্বাস।

টুম্পাকে কাশতে হলো না, টুনি কিছুক্ষণের মাঝেই বের হয়ে এল। পুরো বাড়িটা চক্কর দিতে দিতে তারা বাড়ির পেছনে হাজির হলো। দুই পাশের দুটি গাছের ডালের সঙ্গে একটা দড়ি বেঁধে সেখানে কাপড় শুকাতে দিয়েছে। একটি শাড়ি, একটি লুঙ্গি, দুটি টি-শার্ট, একটি ব্লাউজ। টুনি বলল, ‘এই কাপড়গুলো দেখেই বুঝতে পারবি এই বাড়িতে কয়জন কী রকম মানুষ থাকে।’

‘কীভাবে?’

শাড়ি-ব্লাউজ দেখে বোঝা যাচ্ছে একজন মহিলা আছে। শাড়িটা রঙিন, তার মানে কম বয়সী মহিলা। আমাদের কেয়ারটেকার রমজান আলীর বউ। লুঙ্গিটা নিশ্চয়ই রমজান আলীর। টি-শার্ট দেখেই বোঝা যাচ্ছে স্কুল-কলেজের ছেলে আছে। এটা হচ্ছে রমজান আলীর শালা। কোনো ছোট ছেলেমেয়ের জামাকাপড় নাই, তার মানে কোনো বাচ্চাকাচ্চা নাই।’

অলংকরণ: সাদাত

টুম্পা চমৎকৃত হলো, বলল, ‘টুনি আপু, তুমি জিনিয়াস।’

‘এইটা জিনিয়াস না। যদি ভূতকে ধরতে পারি তাহলে বলিস জিনিয়াস।’

‘ভূতকে ধরে কী করবে?’

‘সেটা নির্ভর করে ভূতের সাইজের ওপর। ছোটখাটো হলে বোতলে ভরে নিয়ে যাব।’

টুম্পা কথা বলে কম, হাসে আরও কম। এবারে টুনির কথা শুনে সে হি হি করে হেসে উঠল।

আরেকটু হাঁটতেই টুনি আর টুম্পা কেয়ারটেকার রমজান আলীর বাড়িটা দেখতে পেল। তকতকে একটা বাসা, বাসার সামনে সবজির বাগান। তারা আরেকটু এগিয়ে যায়, একটা জানালা দিয়ে একটা বউ বাইরে তাকিয়েছিল, টুনি আর টুম্পাকে দেখে সরে গেল।

টুনি বলল, ‘আয় যাই। এই বউটা লাজুক, আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায় না।’

দুজনে আবার বাগানবাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখে। টুম্পার চোখে এটা পুরোনো একটা বাড়ি ছাড়া আর কিছু না। কিন্তু টুনির চোখে মনে হয় আরও অনেক কিছু ধরা পড়েছে, সে মাঝে মাঝেই কিছু একটা দেখে সবকিছু বুঝে ফেলার মতো মাথা নাড়তে থাকে। কী দেখে মাথা নাড়ছে টুম্পা জানার চেষ্টা করে না—তাকে জানানোর মতো কিছু হলে টুনি নিজেই তাকে জানিয়ে দেবে।

সন্ধ্যা হওয়ার পর শান্ত বলল, ‘শুধু শুধু এখানে এসে সময় নষ্ট। এখানে কিছুই করার নাই।’

ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কী করতে চাচ্ছিস?’

‘সেটা জানি না। তুমি বলেছিলে এখানে ভূত আছে। এখন রমজান চাচা বলছে ভূত নাই। ভূত যদি না তাকে তাহলে এসে লাভ কী?’

টুনি বলল, ‘ভূত তো আর রমজান চাচার পোষা ভূত না।’

‘মানে?’

‘রমজান চাচা না বললেই ভূত থাকবে না কে বলেছে? থাকতেও তো পারে।’

শান্ত ভুরু কুঁচকে বলল, ‘তোর কী মনে হয়? ভূত আছে?’

টুনি উত্তর দেওয়ার আগেই ঝুমু খালা বলল, ‘আছে।’

‘আছে?’ শান্ত চমকে উঠে বলল, ‘তুমি কেমন করে জানো?’

‘বাতাসটা টের পাও না?’

‘বাতাস? ভূতের বাতাস আছে নাকি?’

‘হ্যাঁ।’

‘সেটা কী রকম?’

‘ঠান্ডা ঠান্ডা। দেখবা হঠাৎ একটু ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগবে। তখন বুঝবা তেনারা আছে আশেপাশে।’

‘তুমি টের পাচ্ছ?’

ঝুমু খালা বলল, ‘বাড়িটাতে ঢুকেই আমার মনে হয়েছে, এইখানে কিছু একটা আছে।’

শান্ত হঠাৎ করে শান্ত হয়ে গেল। অল্পতেই চমকে উঠতে লাগল। যেখানে সবাই বসে আছে সেখান থেকে নড়ল না।

রাতের খাওয়াটা খুব ভালো হলো। রমজান আলী ভুল বলেনি, তার বউ খুব ভালো রান্না করে। টুনি ভেবেছিল নানা রকম আলোচনার পর তাদের সেই পুরোনো ভাত-মাছ-ডালই খেতে হবে। কিন্তু দেখা গেল খাবার মেন্যু খুবই চমকপ্রদ: পরোটা এবং শিক কাবাব। পাশাপাশি সবজি এবং ঘন ডাল, তার সঙ্গে দই এবং মিষ্টি। পরোটাগুলো খুবই ভালো, মোটেও তাদের বাসার তৈরি পরোটার মতো না। খাওয়া শেষে চা এবং কফি। চা মোটেও সাধারণ চা নয়, মসলা দেওয়া একধরনের পায়েসের মতো চা। খেয়ে টুম্পা পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে গেল। ঝুমু খালা খাওয়া শেষে রমজান আলীকে বলল, ‘আপনার বউয়ের রান্নার হাত খুব ভালো। এইসব বড়লোকি রান্না সবাই জানে না। কোথায় শিখেছে?’

কেয়ারটেকার রমজান আলী বলল, ‘এই তো!’

‘বউয়ের সাথে ভালো ব্যবহার করবেন। আপনার বউ চলে গেলে এইখানে আপনার চাকরিও নট হয়ে যাবে!’

রমজান আলী কিছু বলল না।

খাওয়ার পর সবাই আবিষ্কার করল, কারও কিছু করার নেই। শুধু বুদ্ধিমান টুম্পার কাছে মোটা একটা গল্পের বই। সে মশারির ভেতর ঢুকে সেটা মন দিয়ে পড়ছে। অন্যরা ঘরের ভেতরে এদিক-সেদিকে একটু হাঁটাহাঁটি করল, টেলিভিশনটা চালু করার চেষ্টা করল। খুবই আবছাভাবে বিটিভির চাষবাস-সংক্রান্ত একটা অনুষ্ঠান মাঝে মাঝে শোনা গেল, কিন্তু সেটা দেখে সময় কাটানো সম্ভব না। শান্ত কিছুক্ষণ গজগজ করল, তারপর বিছানায় শুয়ে পড়ল।

রমজান আলী সবার ঘরে পানির বোতল আর গ্লাস দিয়ে চলে যাওয়ার সময় ছোটাচ্চুকে বলে গেল, ‘এখানে লোডশেডিং হয় দিনের বেলা। রাত্রে কারেন্ট যায় না।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘গুড।’

রমজান আলী বলল, ‘যদি কারেন্ট চলে যায় আর মোমবাতি লাগে সে জন্যে মাঝখানের ঘরে টেলিভিশনের ওপরে রেখে গেলাম। মোমবাতি আর দিয়াশলাই।’

ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, ‘মাঝখানের ঘরে কেন?’

রমজান আলী মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ‘কয় দিন আগে একজন মোমবাতি দিয়ে মশারিতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল, সে জন্যে।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘ঠিক আছে। আমরা এখন ঘুমিয়ে যাব। রাত্রে ভূত যদি উৎপাত না করে ঘুম থেকে ওঠার কোনো প্ল্যান নাই।’

মশারির ভেতর থেকে শান্ত বলল, ‘আমি আমার ব্যাট নিয়ে শুয়েছি। ভূত আসলে এমনি এমনি ছেড়ে দিব না।’

রমজান আলী বলল, ‘আপনাদের চিন্তার কোনো কারণ নাই। ভূত বলে কিছু নাই। যদি থাকে সেইটা হচ্ছে মানুষের মনে।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘আমার মন নিয়ে কোনো সমস্যা নাই।’

রমজান আলী বলল, ‘আমি গেলাম, আপনারা ভিতর থেকে দরজায় ছিটকানি দিয়ে দেন।’

ঝুমু খালা নিচে নেমে দরজায় ছিটকিনি দিয়ে প্রত্যেকটা দরজা-জানালা পরীক্ষা করল। দরজাগুলো বন্ধ। জানালায় শক্ত লোহার শিক, ফাঁক দিয়ে ভূত চলে আসতে পারলেও চোর-ডাকাত আসতে পারবে না।

যখন সবার মনে হলো নিশুতি রাত হয়েছে, তখন সবাই বিছানায় শুয়ে ঘুমাতে গেল। ছোটাচ্চু অবাক হয়ে দেখল, ঘড়িতে মাত্র রাত দশটা বাজে। সারা দিন জার্নি করে এসেছে বলেই হোক, রাতের ভালো খাবারের জন্যেই হোক কিংবা ভূতের ভয়েই হোক, সবাই বেশ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেল।

কতক্ষণ পর কেউ জানে না সবার আগে ঘুম থেকে জেগে উঠল টুম্পা, ‘ধুম’ করে শব্দে মনে হলো বাড়িটা কেঁপে উঠেছে। টুম্পা লাফ দিয়ে উঠে বসে টুনিকে ধাক্কা দিল, ‘টুনি আপু!’

টুনি জেগে উঠে বলল, ‘কী হয়েছে?’

কী হয়েছে সেটা আর টুম্পাকে বলে দিতে হলো না। কারণ, ঠিক তখন আবার ‘ধুম’ করে ঠিকই একটা শব্দ হলো।

শব্দের কারণটাও এবারে অনুমান করা হলো। বাড়িটার টিনের ছাদ, সেই ছাদে কেউ ঢিল মারছে। তৃতীয় ঢিলটা পড়ার পর অন্য সবাই ঘুম থেকে জেগে উঠল। ঝুমু খালা মশারি থেকে বের হয়ে কোমরে শাড়ির আঁচলটা বেঁধে বলল, ‘কোন বান্দীর পুলা ঢেলা মারে?’

টুম্পা ভয়ে ভয়ে বলল, ‘ভূত?’

ঝুমু খালা বলল, ‘ভূতে কোনো দিন ঢেলা মারে না। ঢেলা মারে মানুষ।’

তখন চতুর্থ ঢিলটা এসে পড়ল, এটার সাইজ নিশ্চয়ই অনেক বড়, কারণ মনে হলো পুরো বাড়িটা কেঁপে উঠল। সেই বিকট শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ছোটাচ্চু আর শান্তও সমান জোরে চিৎকার করে উঠল। তারপর দুপদাপ শব্দ করে ছুটে টুনিদের ঘরে এল। শান্ত তার হাতে ব্যাটটা ধরে রেখেছে আর ছোটাচ্চু দুই হাত দিয়ে তার তাবিজটা ধরে রেখেছে।

ছোটাচ্চু ঘরে ঢুকে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘কোনো ভয় নাই। কোনো ভয় নাই।’

ঝুমু খালা বলল, ‘হ্যাঁ, কেউ ভয় পাবা না। এইটা ভূতের কাম না, এইটা হচ্ছে মানুষের কাম। বদমানুষের কাম। ঢেলা মারতে মারতে যখন হাতে বেদনা হবে, তখন ঢেলা মারা বন্ধ করে বাড়িতে যাবে।’

ঝুমু খালার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুটি বড় বড় ঢিল ছাদে এসে পড়ল আর হঠাৎ করে ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। শান্ত চিৎকার করে বলল, ‘কারেন্ট চলে গেছে।’

ছোটাচ্চু কাঁপা গলায় বলল, ‘জানি।’

শান্ত বলল, ‘অন্ধকার চারিদিক।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘হ্যাঁ। দেখেছি।’

শান্ত ভয় পাওয়া গলায় বলল, ‘এখন কী করব?’

‘লিভিংরুমে টেলিভিশনের ওপরে মোমবাতি আছে।’

ঝুমু খালা বলল, ‘সবাই চল। মাঝখানের ঘরে সবাই একসঙ্গে থাকি।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘হ্যাঁ। হ্যাঁ। সবাই একসাথে।’

সবাই হাতড়াতে হাতড়াতে এগোতে থাকে। এর মাঝে টুনি অন্ধকারের মাঝেই তার ব্যাগটা নিয়ে নেয়। এর মাঝে তার দরকারি জিনিসপত্র আছে।

মাঝখানের ঘরে গিয়ে সত্যি সত্যি টেলিভিশনের ওপরে দুটি মোমবাতি পাওয়া গেল। মোমবাতির পাশে একটি ম্যাচও রাখা আছে। ছোটাচ্চু মোমবাতি দুটো জ্বালিয়ে ঘরের মাঝখানে বসিয়ে দিল। অন্ধকারে একধরনের আতঙ্ক হচ্ছিল। মোমবাতির আবছা আলোতে সেই আতঙ্ক না কমে কেমন যেন আরও বেড়ে গেল। দেয়ালে তাদের বড় বড় ছায়া পড়েছে, সেই ছায়াগুলো যখন হঠাৎ হঠাৎ করে নড়তে থাকে তখন নিজেরাই নিজের ছায়া দেখে চমকে চমকে ওঠে।

সবাই ঘরের মেঝেতে গোল হয়ে বসেছে। ছোটাচ্চু ডান হাত দিয়ে তার তাবিজটা ধরে রেখেছে। ঝুমু খালা যদিও বলছে এটা ভূতের কাজ নয়, কোনো পাজি মানুষ ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে, তার পরও ছোটাচ্চু কোনো ঝুঁকি নিল না, শক্ত করে তাবিজটা ধরে রাখল।

এভাবে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর হঠাৎ তারা শুনল একটা গাছের ডাল হঠাৎ করে নড়তে শুরু করেছে। খোলা জানালা দিয়ে আবছা আবছা দেখা যায় আশপাশে সব গাছ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, শুধু একটা গাছের একটা ডাল ভীষণভাবে দুলছে। ঝুমু খালা বলল, ‘মনে হয় বান্দর।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘বানর? বানর কোথা থেকে এসেছে?’

শান্ত বলল, ‘বানর না, এটা নিশ্চয়ই ভূত।’

গাছের ডালটা যেভাবে হঠাৎ করে নড়তে শুরু করেছিল, ঠিক সেভাবে হঠাৎ করে থেমে গেল। যখন সবাই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার চেষ্টা করছে তখন হঠাৎ করে অন্য পাশের আরেকটা গাছের একটা ডাল দুলতে থাকে। একটু বাতাস নেই, একটা গাছের পাতাও নড়ছে না, তার মাঝে শুধু একটা গাছের একটা ডাল এভাবে নড়ছে, দেখে সবার বুক কেঁপে ওঠে। ঝুমু খালা পর্যন্ত নার্ভাস হয়ে গেল, কাঁপা গলায় বলল, ‘ইয়া মাবুদ! মনে হয় তেনারাই আসছেন!’

শান্ত বলল, ‘তেনারা কারা?’

ঝুমু খালা বলল, ‘রাত্রি বেলা তেনাদের নাম নেওয়া ঠিক না।’

‘তাহলে কী করব?’

‘আয়াতুল কুরসি পড়।’

‘আমার তো মুখস্থ নাই।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘আমার মোবাইলে রেকর্ড করা আছে।’

ঝুমু খালা বলল, ‘দেরি কইরেন না। চালান। তাড়াতাড়ি চালান।’

ছোটাচ্চু অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে তার মোবাইল ফোন বের করে সেখানে রেকর্ড করে রাখা আয়াতুল কুরসিটা চালানোর চেষ্টা করল। কোথায় রেকর্ড করেছে মনে নেই, এখন ভয় আর উত্তেজনায় সেটা খুঁজে পাচ্ছে না, কিছু একটা টিপতেই বিকট সুরে হেভি মেটাল গান শুরু হয়ে গেল।

ঝুমু খালা বলল, ‘মনে হয় এই গান শুনলেও তেনারা কাছে আসবে না। কিন্তু আয়াতুল কুরসি নাই?’

‘আছে আছে। খুঁজে পাচ্ছি না।’ ছোটাচ্চু যখন তার মোবাইলে রেকর্ড করে রাখা আয়াতুল কুরসি খুঁজছে তখন হঠাৎ করে গাছের ঝাঁকুনিটা থেমে গেল। চারদিকে একটা সুনসান নীরবতা, সেটা মনে হয় আরও বেশি ভয়ের। সবাই যখন নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে, তখন হঠাৎ দপ দপ করে কয়েকবার জ্বলে উঠে একটা মোমবাতি নিভে গেল। ছোটাচ্চু চিৎকার করে বলল, ‘কী হলো? মোমবাতি নিভে গেল কেন?’

ঝুমু খালা বলল, ‘নিশানা ভালো না। দোয়া দরুদ পড়েন।’

ঠিক তখন দ্বিতীয় মোমবাতিটাও দপ দপ করে কয়েকবার জ্বলে উঠে তারপর মোমবাতির শিখাটা কমতে কমতে হঠাৎ করে পুরোপুরি নিভে যায়। পুরো ঘরটা অন্ধকার, শুধু খোলা জানালা দিয়ে বাইরের একটু আলো ঘরের ভেতর এসে মনে হয় ঘরের ভেতরের অন্ধকারটা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ঝুমু খালা বলল, ‘সাবধান। তেনারা কিন্তু ঘরের মাঝে ঢুকে গেছে।’

ছোটাচ্চু ভাঙা গলায় বলল, ‘কোন দিক দিয়ে ঢুকল?’

ছোটাচ্চুর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যেই মনে হয় হঠাৎ করে জানালার একটা কপাট দড়াম করে নিজে নিজে বন্ধ হয়ে গেল। সবাই তখন একসঙ্গে চিৎকার করে ওঠে। আর সঙ্গে সঙ্গে জানালার অন্য কপাটটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। সবাই তখন ভয়ে আবার চিৎকার করে ওঠে।

তাদের ভয় দেখানোর জন্যেই মনে হয় জানালাটা আবার বন্ধ হয়ে আবার খুলে গেল। টুনি তখন হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। ছোটাচ্চু আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, বলল, ‘কী হয়েছে টুনি? তুই উঠছিস কেন?’

‘জানালাটা একটু দেখে আসি।’

ছোটাচ্চু চিৎকার করে বলল, ‘তোর সাহস বেশি হয়েছে? চুপ করে বসে থাক।’

ঝুমু খালা বলল, ‘হ্যাঁ, টুনি। চুপচাপ বসে থাক। তুমি বুঝতে পারছ না তেনারা এখন এই ঘরে আছেন? একটা গন্ধ পাচ্ছ না?’

সত্যি সত্যি ঘরের ভেতরে কোথা থেকে জানি একটা পোড়া মাংসের গন্ধ হাজির হয়েছে। তার সঙ্গে ধূপের মতো একটা গন্ধ। ঝুমু খালা ফিস ফিস করে বলল, ‘মড়া পোড়ার গন্ধ। শ্মশানে এ রকম গন্ধ হয়। ইয়া মাবুদ! এখন কী হবে?’

ছোটাচ্চু তখন ভাঙা গলায় বলল, ‘আমার মনে হয় ভালো করে রিকোয়েস্ট করলে চলে যাবে।’

শান্ত জিজ্ঞেস করল, ‘কাকে রিকোয়েস্ট করলে?’

‘যিনি ঘরে এসেছেন।’

শান্ত বলল, ‘তাহলে রিকোয়েস্ট করো। দেরি করছ কেন?’

ছোটাচ্চু কেশে একটু গলা পরিষ্কার করে বলল, ‘হে বিদেহী আত্মা। আমরা না বুঝে আপনাদের আবাসস্থলে চলে এসেছি। আপনাদের শান্তিপূর্ণ জীবনে আমরা বিরক্তির সৃষ্টি করছি। সে জন্যে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত এবং লজ্জিত। আমরা আপনাদের কথা দিচ্ছি ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে আপনাদের এই আশ্রয়স্থল ছেড়ে চলে যাব। আপনারা আমাদের ক্ষমা করুন। আমাদের মার্জনা করুন। আমরা আর কখনোই আপনাদের জীবনে অনুপ্রবেশ করব না। আপনারা অনুগ্রহ করে আমাদের আর ভয়ভীতি দেখাবেন না। আমাদের প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করবেন না। আমাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করবেন না। প্লিজ।’

ছোটাচ্চু নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্যে একটু থামল ঠিক তখন সবাই একটা কান্নার শব্দ শুনতে পেল। ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে, সেই কান্নার শব্দ বাইরে থেকে আসছে না, এই ঘরের ভেতর থেকে আসছে। মনে হচ্ছে ঘরের এক কোনায় একটি কম বয়সী মেয়ে বসে আকুল হয়ে কাঁদছে।

ঘরের সবাই পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। কান্নার শব্দটা একটু থেমে যায় তারপর আবার শুরু হয়ে যায়। ইনিয়ে বিনিয়ে করুণ একটা কান্না, সেটি শুনলে বুকের মাঝে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে থাকে। ছোটাচ্চু কাঁপা কাঁপা গলায় আবার তার করুণ আবেদন শুরু করল, ‘হে বিদেহিনী। হে মহাত্মন। হে অশরীরী আত্মা। আপনার কান্নার সুর আমাদের হৃদয়কে বিদীর্ণ করে দিচ্ছে। আমাদের বুককে ভেঙে দিচ্ছে। যখন আপনি বেঁচে ছিলেন তখন হয়তো আপনার একটি দুঃখময় বেদনাময় জীবন ছিল, হয়তো পৃথিবীর নির্মম মানুষের কেউ আপনার জীবনকে ছিনিয়ে নিয়েছে। আপনি হয়তো আমাদেরকে সেটি জানাতে চান। হে অশরীরী, হে বিদেহিনী...’

ছোটাচ্চু যখন করুণ স্বরে ভূতের কাছে তার আবেদন করে যাচ্ছে তখন টুনি টুম্পাকে ফিস ফিস করে বলল, ‘টুম্পা, তোর ভয় লাগছে?’

টুম্পা ফিস ফিস করে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ।’

‘কতটুকু?’

‘অনেক।’

‘ভয় পাবি না। ভয়ের কিছু নাই।’

‘কেন?’

‘আমি এখন এই ভূতটাকে ধরব।’

‘ধরবে?’ টুম্পা অবাক হয়ে বলল, ‘কীভাবে ধরবে?’

‘প্রথমে খুঁজে বের করতে হবে কোথা থেকে কান্নার শব্দ আসছে। আয় আমার সাথে।’

‘আমার ভয় করছে টুনি আপু।’

‘ভয়ের কিছু নাই। আয়।’

টুনি আর টুম্পা যখন কান্নার শব্দ কোথা থেকে আসছে দেখার জন্যে পা টিপে টিপে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন ছোটাচ্চুর সঙ্গে সঙ্গে শান্তও ভূতের কাছে আবেদন করতে শুরু করেছে। সে অবশ্যি ছোটাচ্চুর মতো এত সুন্দর ভাষায় বলতে পারে না, তার কথাগুলো অনেক চাঁছাছোলা, কিন্তু ভূতের মনকে নরম করার জন্যে মনে হয় যথেষ্ট।

ঘরের কোনায় একটা বেসিন, টুনির মনে হলো এই বেসিনের কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকে শব্দটা আসছে। বেসিনে কান পাততেই পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। বেসিন থেকে পানি যাবার যে পাইপটা রয়েছে, কান্নার শব্দটা সেখান থেকে আসছে। শুধু যে কান্নার শব্দ তা নয়, একটু আগে যে মাংস পোড়া গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল সেটাও এখান থেকে আসছে। অর্থাৎ এই পাইপটা নিচে যেখানে গিয়েছে সেখানে কেউ একটু আগে মাংস পুড়িয়েছে, সঙ্গে ধূপের গন্ধের জন্যে একটু ধূপও দিয়েছে। এখন ভয় দেখানোর জন্যে মুখ লাগিয়ে কান্নার শব্দ করছে। মানুষটি কে হতে পারে সেটাও মোটামুটি অনুমান করা যায়, নিশ্চয়ই রমজান আলীর লাজুক বউ। এমনিতে লাজুক কিন্তু রাতের বেলা ভয় দেখানোর সময় তার লাজুক ভাবটা কেটে যায়।

টুনি টুম্পাকে ফিস ফিস করে বলল, ‘নিচে থেকে এই পাইপে মুখ লাগিয়ে কেউ একজন কান্নার শব্দ করছে।’

‘সত্যি?’

‘হ্যাঁ। সত্যি। শুনতে পাচ্ছিস না?’

‘শুনতে পাচ্ছি।’

‘টুনি বলল, ‘এখন তাকে ধরব।’

‘কীভাবে ধরবে টুনি আপু?’

‘এক্ষুনি দেখবি।’

টুনি তখন অন্ধকারের মাঝেই হাতড়ে হাতড়ে একটা বোতল বের করল। টুম্পার হাতে দিয়ে বলল, ‘নে, এটা ধর।’

টুম্পা সাধারণত টুনিকে কিছু জিজ্ঞেস করে না, কিন্তু এবারে জিজ্ঞেস না করে পারল না, ‘এর ভেতরে কী টুনি আপু?’

‘রং। হাজার পাওয়ার রং। যদি কারও গায়ে লাগে সেটা পুরো এক সপ্তাহ থাকে।’

‘সত্যি?’

‘হ্যাঁ। টকটকে লাল।’

‘কী করবে এটা দিয়ে?’

‘এই পাইপ দিয়ে ঢালব, একটু একটু করে ঢাললে হবে না, একসাথে ঢালতে হবে। নিচে যেন হুড় হুড় করে একসাথে বের হয়। যে কান্নার শব্দ করছে তার মুখে যেন লাল রং লেগে যায়।’

‘কীভাবে একসঙ্গে ঢালবে?’

টুনি একটু চিন্তা করে বলল, ‘একটা মগ থাকলে হতো।’

‘বাথরুমে মগ আছে।’

টুনি বলল, ‘তুই দাঁড়া, আমি নিয়ে আসি।’

টুম্পা বলল, ‘না টুনি আপু। তুমি থাকো, আমি নিয়ে আসি।’

‘ভয় পাবি না তো?’

অন্ধকারে টুম্পা ফিক করে হাসল, বলল, ‘না টুনি আপু। এখন আর ভয় লাগছে না।’

ছোটাচ্চু আর শান্ত যখন করুণ গলায় তাদের ক্ষমা করার জন্যে প্রার্থনা করছে তখন টুম্পা অন্ধকারে পা টিপে টিপে বাথরুমে গিয়ে মগটা নিয়ে এল। টুনি তখন সেই মগে হাজার পাওয়ারের সেই পাকা রংটা ঢেলে নিল। তারপর বেসিনের কাছে দাঁড়াল। যখন কান্নার শব্দটা খুব ভালোভাবে আসছে, তখন টুনি হঠাৎ করে পুরো মগভর্তি রংটা ঢেলে দিল।

যতক্ষণ রংটা পাইপের ভেতর দিয়ে নিচে যাচ্ছিল ততক্ষণ কান্নার শব্দটা বন্ধ থাকল, কিন্তু নিচে হুড় হুড় করে বের হওয়ার পর আবার শব্দ শোনা গেল। তবে এবারে সম্পূর্ণ ভিন্ন শব্দ। কোনো একজন নারী কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠল, ‘হায় খোদা! এইটা কী? এইটা কী হলো? কী বের হয় এখান থেকে? আমার মুখে কী লাগল?’

টুনি তখন তার ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে ছয় ব্যাটারির একটা বিশাল টর্চলাইট বের করে সেটা জ্বালিয়ে দিতেই ছোটাচ্চু আর শান্তর করুণ আবেদন থেমে গেল। ঝুমু খালা বলল, ‘টর্চলাইট!’

টুনি বলল, ‘হ্যাঁ।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘তোর কাছে এত পাওয়ারফুল একটা টর্চলাইট আছে আর তুই আমাদের বলছিস না কেন? আমরা অন্ধকারে বসে আছি।’

‘ছোটাচ্চু, যদি ভূত ধরতে চাও তাহলে আমার সঙ্গে চল।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘কী বলছিস তুই পাগলের মতো?’

‘ছোটাচ্চু, তুমি নিচে গেলেই দেখবে। আমি যাচ্ছি তোমরা চাইলে আস।’

টুম্পা কম কথা বলে, উত্তেজনায় সে পর্যন্ত কথা বলে ফেলল, ‘হ্যাঁ, ছোটাচ্চু। ভূতের মুখে রং লাগানো হয়েছে, এখন খালি ধরতে হবে!’

‘তোরা কী বলছিস আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’

‘তোমাকে পরে বোঝাব। আমাদের হাতে সময় নাই। আমরা গেলাম। ঝুমু খালা, তুমি যাবে?’

ঝুমু খালার সাহস ফিরে এল, বলল, ‘এক শ বার যাব। ভূতের বাবা ভূত, বান্দীর বাচ্চা বান্দীকে যদি আমি কিলিয়ে ভর্তা না বানাই।’

টুনি বলল, ‘তুমি শান্ত ভাইয়ার ব্যাটটা নিয়ে নাও। হাতে একটা অস্ত্র থাকা ভালো।’

যখন ছোটাচ্চু আর শান্ত দেখল সত্যি সত্যি অন্য সবাই ভূত ধরতে যাচ্ছে তখন তারাও পিছু পিছু নেমে এল। দরজা খুলে বের হয়ে বিশাল টর্চলাইটটা নিয়ে সবার আগে টুনি তার পেছনে টুম্পা তারপর ঝুমু খালা আর সবার পেছনে শান্ত আর ছোটাচ্চু প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে রমজান আলীর বাসার দিকে ছুটতে থাকে।

বাসাটা অন্ধকার, দেখে মনে হয় সবাই ঘুমিয়ে আছে। টুনি জানে সবাই এখন এখানেই আছে এবং খুব ভালোভাবেই জেগে আছে। টুনি দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘রমজান চাচা, দরজা খুলেন তাড়াতাড়ি।’

ভেতরে কোনো শব্দ নেই। টুনি তখন আরও জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিল, বলল, ‘দরজা খুলেন।’

এবারেও কেউ দরজা খুলল না। ঝুমু খালা তখন হুংকার দিয়ে বলল, ‘দরজা খুলেন, তা না হলে কিন্তু খবর আছে।’

টুনি বলল, ‘পুলিশে খবর দিলে কিন্তু আপনার বিপদ আছে!’

ঝুমু খালা বলল, ‘বিপদ মানে মহাবিপদ। বাঘে ছুঁলে হয় আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা।’

এবারে মনে হলো ভেতরে একটু খুটখাট শব্দ একটু ফিসফাস কথাবার্তা শোনা গেল। টুনি বলল, শোনেন, ‘আমরা সবকিছু জানি। মেইন সুইচে আমি হাজার পাওয়ার রঙের গুঁড়া লাগিয়ে এসেছি, আপনারা যখন সেটা অফ করেছেন তখন হাতে রং লেগেছে, যতই ধোয়ার চেষ্টা করেন সেই রং আর উঠবে না!’

ঝুমু খালা বলল, ‘হুঁ হুঁ! মজাটা টের পাবে তখন।’

শান্ত তার ব্যাটটা দিয়ে মাটিতে দুই-চারবার ঘা দিল।

টুনি বলল, ‘দরজাটা খুলেন। আমরা আপনাদের কিছু বলব না, শুধু একনজর দেখতে চাই। ওপর থেকে আমি বেসিনে লাল রং ঢেলে দিয়েছি, আপনাদের যিনি পাইপে মুখ লাগিয়ে কাঁদছিলেন তার মুখে লাল রং লেগে গেছে। আমরা জানি। যতই সাবান দিয়ে ধোয়ার চেষ্টা করেন এই রং আর উঠবে না।’

ঝুমু খালা বলল, ‘উঠবে না। সোডা দিয়ে সিদ্ধ করলেও উঠবে না।’

টুনি বলতেই থাকল, ‘কাপড় শুকানোর দড়ি টেনে কীভাবে গাছের ডাল নাড়িয়েছেন সেটাও আমরা জানি। জানালার কপাটে দড়ি লাগিয়ে কীভাবে নিচে থেকে এটা খুলেছেন আর বন্ধ করেছেন সেইটাও আমরা জানি। কাজ শেষ করে আপনারা দড়িটা টেনে সরাতে পারেন নাই, তার কারণ দড়িটা আমি ওপরে পেঁচিয়ে রেখেছি।’

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে টুনির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ঝুমু খালা দরজায় লাথি দিয়ে বলল, ‘এখন দরজা খুলেন। এই দড়ি আপনাদের কোমরে বেঁধে থানায় নিয়ে যাব। পাইছেনটা কী?’

টুনি বলল, ‘শুধু শুধু ঘরের ভেতরে থেকে লাভ নাই, বের হয়ে আসেন। মনে করবেন না আমরা কিছু বুঝি না। আমরা সব বুঝি। মোমবাতিটা এখনো পরীক্ষা করি নাই, কিন্তু পরীক্ষা না করেই বলতে পারি মোমবাতির সুতাটা কেটে ছোট করে রেখেছেন যেন একটু জ্বলে পরেই নিভে যায়!’

ঝুমু খালা হুংকার দিল, ‘আপনারা কী আমাদের বেকুব ভাবছেন? আপনাদের বুদ্ধি যদি থাকে মাথার ভেতরে আমাদের বুদ্ধি তখন থাকে রগে রগে।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘আমরা দশ পর্যন্ত গুনব, এর মাঝে দরজা না খুললে পুলিশে ফোন করে দিব।’

ঝুমু খালা বলল, ‘শুধু পুলিশ না, মিলিটারি, বিজিবি সবাইরে ফোন করে দিব। আপনাদের ধরে নিয়ে সাথে সাথে ক্রসফায়ার!’

ছোটাচ্চু বলল, ‘আমি গুনতে শুরু করলাম, এক।’

কয়েক সেকেন্ড পর টুনি বলল, ‘দুই।’

ঝুমু খালা হুংকার দিল, ‘তিন।’

টুম্পা আস্তে আস্তে বলল, ‘চার।’

শান্ত গর্জন করল, ‘পাঁচ।’

‘ছয়’ বলার আগেই খুট করে দরজা খুলে গেল। সবার সামনে ফুটফুটে একটা বউ, সারা মুখে লাল রং। দুই হাত দিয়ে মুখটা ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু ঢাকতে পারছে না। তার পেছনে রমজান আলী, হাতটা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু দেখা যাচ্ছে ডান হাতের আঙুলগুলো টকটকে লাল। তাদের পেছনে বিশ-বাইশ বছরের একটা ছেলে, গায়ে কালো টি-শার্ট, শুধু তার শরীরের কোথাও কোনো রং নেই। তিনজন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল আর ছোটাচ্চু কোমরে হাত দিয়ে হুংকার দিয়ে বলল, ‘আপনাদের এত বড় সাহস। আমাদের ভূতের ভয় দেখান—আপনাদের আমি পুলিশে দেব।’

টুনি ছোটাচ্চুর শার্টটা টেনে বলল, ‘ছোটাচ্চু, মনে আছে, নানির রাজাকার টাইপ ভাইটা যখন আমাদের বাসায় এসেছিল তখন তুমি আমাদেরকে নিয়ে তাকে ভূতের ভয় দেখিয়েছিলে?’

‘হ্যাঁ।’

‘সেই বুড়া রাজাকার ভয়ে কাপড়ে বাথরুম করে দিয়েছিল, মনে আছে?’

‘হ্যাঁ, মনে আছে।’

‘তখন তোমাকে তো আমরা পুলিশে দেই নাই। দিয়েছিলাম?’

‘কিন্তু...’

‘তাই এদেরকেও তুমি পুলিশে দিতে পারবে না।’

টুম্পা এবং শান্ত টুনির কথার সাথে সাথে জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, ‘পারবে না। কিছুতেই পারবে না।’

‘তাহলে কোনো শাস্তি হবে না?’

টুনি বলল, ‘শুধু অপরাধ করলে শাস্তি হয়। মজা করলে শাস্তি হয় না।’

টুম্পা আর শান্ত মাথা নাড়ল, ‘হয় না। মজা করলে শাস্তি হয় না।’

টুনি বলল, ‘আর তুমি যদি মনে কর একটা শাস্তি দিতেই হবে তাহলে একটা শাস্তি দেওয়া যায়।’

ছোটাচ্চু গম্ভীর গলায় বলল, ‘কী শাস্তি?’

‘যা খিদে পেয়েছে। রমজান চাচি যদি কোনো একটা নাশতা বানিয়ে খাওয়ায়—সাথে পায়েসের মতো ওই মসলা চা!’

শান্ত জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, ‘গুড আইডিয়া। আমারও খুব খিদে লেগেছে। ভয় পেলে মনে হয় বেশি খিদে লাগে।’

‘এই শাস্তি?’

টুনি টুম্পা আর শান্ত বলল, ‘হ্যাঁ।’

ফুটফুটে বউটা এই প্রথম মুখ ফুটে কথা বলল, ‘লুচি ভেজে দেই? সাথে বেগুন ভাজি আর ডিম ভুনা? রসমালাই আছে একটু, দিব?’

কেউ কিছু বলার আগে শান্ত হাতে কিল দিয়ে বলল, ‘ফ্যান্টাস্টিক আইডিয়া।’

ঝুমু খালা বউটিকে বলল, ‘আমি যখনই লুচি ভাজি কেমন জানি কড়কড়া হয়ে যায়, নরম হয় না। তুমি আমাকে শিখাবা কেমন করে নরম লুচি ভাজতে হয়?’

বউটি ফিক করে একটু হেসে বলল, ‘আসেন।’

ছোটাচ্চু টুনি টুম্পা আর শান্ত যখন বাগানবাড়িতে ফিরে যাচ্ছে তখন ছোটাচ্চু বিড় বিড় করে বলল, ‘সবকিছু বুঝলাম। একটা জিনিস শুধু বুঝতে পারলাম না।’

টুনি জিজ্ঞেস করল, ‘কী বুঝতে পারলে না?’

‘কেন এরা সবাইকে ভূতের ভয় দেখায়?’

মিনিট ত্রিশেক পর যখন লুচি, বেগুনভাজা ডিম ভুনা রসমালাই আর পায়েসের মতো মসলা চা সবাই মিলে খাচ্ছে তখন একটু একটু করে সবাইকে ভূতের ভয় দেখানোর কারণটা জানা গেল। রমজান আলী আর তার বউয়ের এই বাগানবাড়ি ছাড়া থাকার কোনো জায়গা নেই। খবর পেয়েছে, মালিক এটা বিক্রি করার চিন্তা করছে, তাই তারা ভেবেছে যদি এই বাগানবাড়িটাকে ভূতের বাড়ি হিসেবে দাঁড় করানো যায়, তাহলে হয়তো আর কেউ কিনতে রাজি হবে না। সে জন্যে যখনই কেউ আসে তারা একবার ভূতের ভয় দেখিয়ে দেয়।

* * *

ফিরে গিয়ে ছোটাচ্চু তার ক্লায়েন্টকে রিপোর্ট দিল যে এই বাগানবাড়িতে কোনো ভূত নেই, তবে বাড়িটা এমন একটা পরিবেশে আছে যে এটাকে ভূতের বাড়ি হিসেবে পরিচয় দিয়ে উৎসাহী দর্শকদের ভূত দেখার অভিজ্ঞতার জন্যে ভাড়া দেওয়া যেতে পারে! কেউ যেন নিরাশ না হয় খুব সহজেই সেই ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। আইডিয়াটা বাড়ির মালিকের বেশ পছন্দ হয়েছে, কীভাবে করা যায় সেটা নিয়ে ছোটাচ্চুর সঙ্গে আলোচনা করেছে, ছোটাচ্চুর ধারণা রমজান আলী, তার বউ আর শালার একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা করে দেওয়া যাবে।

ভূতের বাড়ি দেখতে যাওয়া নিয়ে আর কারও কোনো লাভ হয়েছে কি না কেউ জানে না, শুধু টুনির বিশাল লাভ হয়েছে। ছোটাচ্চু যখন কোনো কিছু নিয়ে গড়িমসি করে, তখন টুনি বলে, ‘ছোটাচ্চু দেব সবাইকে বলে? তুমি কীভাবে তোমার তাবিজটা ধরে বলেছিলে হে বিদেহী আত্মা, হে অশরীরী...’

ছোটাচ্চু তখন লাফ দিয়ে এসে টুনির মুখ চেপে ধরে বলে, ‘বলিস না বলিস না প্লিজ! তোর কসম লাগে। তুই কী চাস বল!’

টুনির দিনকাল এখন ভালোই যাচ্ছে।

চলবে...

আরও পড়ুন