রকিব হাসানের ‘ক্যাম্পাসে ভূত’ (শেষ পর্ব)

অলংকরণ: ধ্রুব এষ

তাড়াতাড়ি গাড়িতে চড়ে কলেজের দিকে ছুটল ওরা। পথে গেট থেকে গার্ডকে তুলে নিল কিশোর। সায়েন্স বিল্ডিংয়ের সামনে গাড়ি থামিয়ে, লাফিয়ে নেমে ছুটল।

সিঁড়ি বেয়ে ওরা দৌড়ে দোতলায় ওঠার সময় প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ কানে এল। ল্যাবরেটরিতে ঢুকে কোরি অ্যালেঙ্গারকে অচেতন হয়ে পড়ে থাকতে দেখল। তাঁর মুখে কালো দাগ লেগে রয়েছে। এ ছাড়া তিনি অক্ষতই আছেন মনে হচ্ছে। সাধারণ পোশাকের ওপর ধূসর রঙের একটা আলখেল্লা পরা। ছিঁড়ে গেছে আলখেল্লাটা।

ঘরে শুধু একটা বানসন বার্নার জ্বলছে। জানালা দিয়ে দেখা মৃদু আলোর উৎস এই বার্নারটাই, বুঝতে পারল কিশোর। ওঅর্ক বেঞ্চে কিছু ভাঙাচোরা যন্ত্রপাতি দেখা গেল, যেগুলোর সাহাঘ্যে রাসায়নিক পরীক্ষা করা হয়। বিস্ফোরণেই ওগুলো ভেঙেছে, বোঝা গেল। ছাতেও বিস্ফোরণের আঘাতের চিহ্ন দেখা গেল। পুরো আঘাতটা ওখানেই গিয়ে লেগেছে। ভাগ্যিস, কোরির গায়ে লাগেনি। তাঁর গায়ে শুধু আঁচ লেগেছে।

সুইচ টিপে মাথার ওপরের ফ্লুরোসেন্ট বাতিটা জ্বেলে দিল গার্ড। উদ্বিগ্ন হয়ে কোরির দিকে তাকাল তিন বন্ধু। আকর্ষণীয় চেহারার একজন মহিলা। বিস্ফোরণের ধাক্কা কাটিয়ে ধীরে ধীরে হুঁশ ফিরে আসছে। তিনজনে মিলে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে তাঁকে ল্যাবরেটরির একটা হাতাওয়ালা চেয়ারে বসিয়ে দিল।

‘তোমরা এখানে কেন এসেছ?’ বিড়বিড় করে প্রশ্ন করলেন কোরি।

‘বলছি, আগে আপনি ঠিক হোন,’ কিশোর বলল। ‘এখন কি একটু ভালো বোধ করছেন, প্রফেসর ওয়াইল্ডার?’

‘হ্যাঁ, করছি, থ্যাংক ইউ।’

কিশোরের কথা শুনে হাঁ করে তাকিয়ে আছে মুসা, রবিন  ও গার্ড।

‘কী-কী-কী বলতে চাও তুমি?’ তোতলাতে লাগল গার্ড। ‘প্রফেসর ওয়াইল্ডার? তিনি তো কবেই মারা গেছেন!’

‘সাময়িকভাবে ভূত হয়ে গিয়েছিলেন, কিংবা বলা যেতে পারে সবাই তাঁকে ভূত ভাবতে আরম্ভ  করেছিল,’ হাসিমুখে বলল কিশোর। ‘তবে মারা যাননি।’

কী ঘটেছিল বুঝিয়ে বলল কিশোর। সেই ঝড়ের রাতে উত্তেজিত অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে সত্যিই অ্যাক্সিডেন্ট করেছিলেন লরা। ওপর থেকে খাঁড়িতে পড়ে গিয়েছিল তাঁর গাড়ি। নিশ্চয় পড়ার পর দরজা খুলে গিয়েছিল। তাঁর দেহটা গাড়ি থেকে বেরিয়ে নদী দিয়ে ভেসে গিয়েছিল উপসাগরের দিকে।

‘প্রচণ্ড ঝড়ে কয়েকটা বোট আর জাহাজ ডুবে গিয়েছিল সেই রাতে,’ কিশোর বলল। ‘ওগুলোরই একটা সি কুইন। ভাগ্যক্রমে ওই জাহাজটার একটা লাইফবোট পেয়ে যান লরা। ওটা ধরে ভাসতে থাকেন। সাগর থেকে তাঁকে উদ্ধার করেন ডাক্তার অ্যাডাম ফ্রিম্যান।’

কোরি ওরফে লরা মনোযোগ দিয়ে কিশোরের কথা শুনছেন। চাঁদি চেপে ধরে মাথা ঝাঁকালেন। ‘হ্যাঁ, সব এখন মনে পড়ছে আমার। ভেসে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম আমি। হাতের কাছে কাঠকুটো যা-ই পাচ্ছিলাম, আঁকড়ে ধরছিলাম। এভাবেই পেয়ে গেলাম একটা লাইফবোট। নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কোনোমতে নিজেকে টেনে  তুলেছিলাম বোটটায়।’

আবার বলতে লাগল কিশোর, ‘আমার বিশ্বাস, অ্যাক্সিডেন্টে মাথায় বাড়ি খেয়েছিলেন আপনি। মুখও কেটে গিয়ে বিশ্রী ক্ষত তৈরি হয়েছিল। একে বৈজ্ঞানিক সম্মেলনের ভয়ানক হতাশা, প্রচণ্ড অপমান, আর অ্যাক্সিডেন্টের আঘাতের কারণে স্মৃতিভ্রংশ হয়েছিল আপনার। তাই ডাক্তার ফ্রিম্যান আপনাকে উদ্ধার করার পর নিজের আসল পরিচয় জানাতে পারেননি। উদ্ধার করার পর ডাক্তার আপনাকে সেবাযত্ন করে শুধু সারিয়েই তোলেননি, প্লাস্টিক সার্জারি করে মুখের বিকৃতিগুলোও স্বাভাবিক করে দিয়েছিলেন। ছেলেবেলার অ্যাক্সিডেন্টের আর কোনো চিহ্নই থাকেনি আপনার মুখে। সুন্দরী নারীতে পরিণত হন আপনি। চেহারার পরিবর্তন হলেও মনের পরিবর্তন ঘটেনি আপনার, স্মৃতি ফিরে পাননি।’

বলতে লাগল কিশোর, কোরি অ্যালেঙ্গার তাঁর বিস্মৃত মনেরই একটা অতিকল্পনা। নিজেকে তিনি একজন ওই রকম মহিলা ভাবতে ভালোবাসতেন—সুন্দরী, ধনী, সারা পৃথিবী ভ্রমণকারী।

‘বিজ্ঞানী হলেও একটা রোমান্টিক মন ছিল আপনার,’ কিশোর বলল। ‘কবিতা লেখার পাশাপাশি লরার নামে চিঠিগুলোও আপনিই লিখেছেন। লরার নাম আর রিচমন্ড কলেজের ঠিকানাটা কোনোভাবে রয়ে গিয়েছিল আপনার স্মৃতিতে। তাই কোরি হওয়ার পর কল্পিত বান্ধবীর কাছে চিঠি লিখতেন। ছোটবেলায় টেক্সাসে থাকতেন। কোরি হয়ে গিয়ে কথার সেই পুরোনো টান ফিরে এসেছিল আপনার।’

কিশোরের কথায় সমর্থন জানালেন লরা। জানালেন, স্মৃতি হারানোর পর প্রায়ই একটা অদ্ভুত যন্ত্রণাবোধ চাপ সৃষ্টি করত তাঁর মগজে, সাময়িকভাবে ইমোশনাল ব্ল্যাকআউট ঘটত। আর সেটার তাড়নায় মাঝেমধ্যেই রিচমন্ড কলেজে ফিরে আসতেন তিনি, নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো, ঘোরের মধ্যে, সেসব পোশাক পরে, যেগুলো পরে অ্যাক্সিডেন্ট করেছিলেন, যা পরে তিনি পড়াতেন এখানে। অবচেতনভাবেই কাজগুলো করতেন তিনি। ল্যাবরেটরির চাবি পোশাকের পকেটেই রয়ে গিয়েছিল তাঁর। তাই তালা খুলতে কোনো অসুবিধা হতো না।

‘তারপর ঘোর কেটে গেলে নিজেকে দেখতে পেতাম এখানে,’ লরা বললেন। ‘আবার আমি কোরি অ্যালেঙ্গার হয়ে যেতাম তখন, কিংবা নিজেকে কোরি অ্যালেঙ্গার ভাবতাম। বুঝতে পারতাম না, কী করে এখানে এসেছি আমি।’

‘আমার ধারণা, অবচেতন মনের গভীরে, প্রফেসর ওয়াইল্ডারের ওপর একটা বিতৃষ্ণা ছিল আপনার, কখনোই আর প্রফেসর হতে চাইতেন না,’ কিশোর বলল। ‘কারণ, ওই জীবনে আপনি ভীষণ অসুখী ছিলেন।’ একটু থেমে যোগ করল, ‘তবে আমার মনে হয়, সামনে এখন আপনার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। আপনার আবিষ্কারকে স্বীকৃতি দিয়েছে ড্রাগ কোম্পানি, রয়্যালটি দিতে চাইছে, ধনী আর বিখ্যাত বিজ্ঞানী হয়ে যাবেন আপনি এখন। তা ছাড়া একটু আগের ওই বিস্ফোরণটার প্রতিও আপনার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। বিস্ফোরণের কারণে আবার মাথায় আঘাত পেয়েছেন আপনি, আর তার ফলে আপনার পুরো স্মৃতিশক্তি ফিরে এসেছে আবার।’

হাসল কিশোর। ‘এবং তার ফলে এখন প্রফেসর জনসন আর সুন্দরী টিনা হার্বার্টের আর কোনো আশা রইল না। আপনার টাকার মালিক আর হতে পারবে না ওরা।’

‘কিশোর, একটা কথা,’ মুসা বলল, ‘প্রফেসর ওয়াইল্ডারই যদি ভূত হয়ে থাকেন—কিংবা বলা যায়, প্রফেসর ওয়াইল্ডারকে সবাই ভূত ভেবে থাকে, তো বনের মধ্যে তুমি যে ভূতটাকে দেখেছ, আমরা যেটাকে বনের কিনারে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি, ও কে?’

‘অবশ্যই টিনা হার্বার্ট,’ জবাব দিল কিশোর। ‘প্রফেসর লরা ওয়াইল্ডার মারা গেছেন, শুধু মারাই যাননি, মরে ভূত হয়ে গেছেন, তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে টিনা, এটা প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই ওই ভূত-ভূত নাটকের অবতারণা। লোভী প্রফেসর জনসনের সঙ্গে যুক্তি করেই এই নাটক করেছিল টিনা। ধূসর আলখেল্লা আর ডাইনির মুখোশ পরে বনের মধ্যে ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াত ও। আমিও গত রাতে ওকেই দেখেছি বনের মধ্যে। আসলে আমাকে দেখানোর জন্যই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। টিনার ভূত সাজার আলখেল্লা আর মুখোশটাও পাওয়া গেছে হোটেলের ঘরে।’

‘যা-ই হোক, প্রফেসর ওয়াইল্ডার,’ রবিন জানতে চাইল, ‘কোন ক্যাটালিস্ট ব্যবহার করে ওই রাসায়নিক পদার্থ বানিয়েছিলেন আপনি, সেটা মনে আছে তো? নাকি ভুলে গেছেন?’

হাসলেন প্রফেসর। ‘না, ভুলিনি। কখনোই ভুলিনি। ব্রোমেইট। আজ রাতেও আবার সেই পরীক্ষাটা চালাতে গিয়েছিলাম। এতই ভালো কাজ করেছে, আরেকটু হলে বিস্ফোরণের চোটে নিজেকেই উড়িয়ে দিয়েছিলাম। আসলে, ভুল করে ব্রোমেইটের সঙ্গে অন্য কিছু মিশিয়ে ফেলেছি আমি।’

রাসায়নিক রাখার বোতলের একটা ভাঙা টুকরোর দিকে আঙুল তুলল কিশোর। ওঅর্ক বেঞ্চের ওপর পড়ে আছে। লেবেলটা এখনো লেগে রয়েছে কাচের গায়ে। তাতে লেখা ‘পটাশিয়াম ব্রোমেইট’।

‘হুঁ,’ মাথা ঝাঁকাল রবিন, ‘এ কারণেই বিস্ফোরণটা ঘটেছে।’

কিশোরও মাথা ঝাঁকাল। ‘আরও একটা ধাঁধার জবাব পেয়ে গেছি এখন। প্রফেসর ওয়াইল্ডার নাকি বিড়বিড় করে দুটো শব্দ বলেছিলেন, ব্রহ্মা ক্যাটল, যেটার মানে বুঝতে পারেননি ডাক্তার ফ্রিম্যান। প্রফেসর ওয়াইল্ডার আসলে বলতে চেয়েছিলেন ‘ব্রোমেইট ক্যাটালিস্ট”, উচ্চারণের কারণে যেটাকে ডাক্তার ফ্রিম্যানের মনে হয়েছে “ব্রহ্মা ক্যাটল”। হা হা হা!’

মুসা আর রবিনও হাসল।

আচমকা লাফ দিয়ে উঠে এসে কিশোরের হাত দুটো চেপে ধরে জোরে জোরে ঝাঁকিয়ে দিতে লাগলেন প্রফেসর ওয়াইল্ডার। ‘কিশোর, তুমি একটা জিনিয়াস!’ চেঁচিয়ে বললেন তিনি, ‘তোমার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে গেলাম, আমাকে আবার আমার আসল পরিচিতিতে ফিরিয়ে দিলে, এ ঋণ কীভাবে শোধ করব আমি?’

(শেষ)