অদ্রির অভিযান (শেষ পর্ব)

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

কমান্ডার ট্র্যাপিজিনের সঙ্গে থাকা নয়জন ট্র্যাপিজিন সেনা বিকট শব্দে ভয়ংকর অস্ত্রগুলো অদ্রিদের দিকে তাক করল। তিন বন্ধুর আত্মা কেঁপে উঠল। এসব অস্ত্রের আঘাতে শেষ হয়ে যাবে তাদের সমস্ত স্মৃতি, স্বপ্ন এবং একমাত্র জীবন। অদ্রির মনে পড়ল মায়ের মুখখানা, অদ্রিকের হৃদয়ে ভেসে উঠল তার বাবার চেহারা এবং তালুতের মনে পড়ল এক প্রিয়জনকে, যাকে ইমপ্রেস করার জন্য সে সব সময় সাহসিকতার চেষ্টা করে।

লুলুলু বুকে হাত দিল; যেন বেচারার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে! হঠাৎ সে পা তুলে সজোরে লাথি দিল মেঝেতে। মুহূর্তেই যা ঘটল, তা দেখে চমকে উঠল তিনজন। সামনে থাকা দলটির পায়ের তলা থেকে সরে গেল মেঝে! পুরো দল পড়ে গেল নিচের গভীর খাদে; স্রোতস্বিনী পাহাড়ি নদীর পাথরে মাথা আছড়ে মরল ট্র্যাপিজিন সেনাদল। এত ওপর থেকে তাদের চিৎকার তেমন শোনা গেল না।

অদ্রিদের দিকে তাকিয়ে লুলুলু বলল, ‘কখনো অন্যায় করিনি। আজ বেঁচে থাকার জন্য করতে হলো। বাগানবাড়ির এই নিরাপত্তাব্যবস্থা যখন ডিজাইন করেছিলাম, তখন ভাবিনি যে এটা কখনো এভাবে কাজে লাগবে। আমি পা দিয়ে মেঝের এই পুশ বাটনকে জোরে চাপ দিয়েছি; এটাতে চাপ দিলে সামনের অংশের মেঝে খুলে যায়।’

তালুত আনন্দে বলে উঠল, ‘মরে যাইনি, এই তো জরুরি খবর!’

লুলুলু বলল, ‘আমাদের খোঁজে আরেকটি দল শিগগিরই চলে আসবে এখানে। সেবার হয়তো আর বাঁচার সুযোগ পাব না। আসলে এই গ্রহে থাকা তোমাদের জন্য নিরাপদ হবে না। এসো আরেকবার বসি, চিন্তা করে বের করি কী করা যায়।’

সবাই আবার টেবিলে বসল এবং নকশার দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকল। অদ্রিক বলল, ‘তুমি বললে এই চার লোকেশনে সার্ভার সেটগুলো রাখা আছে; কিন্তু বাকি দুটি লোকেশনে কী আছে?’

‘ওই দুই লোকেশনে পাওয়ার সাপ্লাই ইউনিট রাখা। জিওগ্রাফিক্যাল রিডানডেন্সি নিশ্চিত করার জন্য সেগুলো দুই লোকেশনে রাখা হয়েছে। পাওয়ার সাপ্লাই ইউনিটের নির্মাণ প্রচণ্ড ব্যয়সাধ্য বলে দুটির ব্যবস্থা—একটি মেইন এবং অন্যটি স্ট্যান্ডবাই। মূলত, ট্র্যাপিস্ট নক্ষত্রের দুটি গ্রহের ঘূর্ণনকে কাজে লাগিয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়, তা সরাসরি সরবরাহ করা হচ্ছে ওই দুই পাওয়ার সাপ্লাই ইউনিটে।’

অদ্রিক বলল, ‘তাহলে তো সমাধান পেয়ে গেছি। পৃথিবীও বাঁচবে আর আমরাও পৃথিবীতে ফিরতে পারব।’

লুলুলু যেন বিষয়টি ধরতে পেরেছে, এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। তালুত অস্থিরভাবে জিজ্ঞাসা করল, ‘সমাধানটা কী?’

অদ্রিক বলল, ‘আমরা এই দুই পাওয়ার সাপ্লাই ইউনিট ধ্বংস করলেই কাজ হয়ে যাবে। এর ফলে সমস্ত সার্ভার শাটডাউন হয়ে যাবে এবং একই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাবে ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটির সব রকম প্রক্রিয়া।’

অদ্রি জিজ্ঞাসা করল, ‘তাহলে আমরা পৃথিবীতে ফিরব কীভাবে?’

অদ্রিক উত্তর দিল, ‘প্রথমে আমরা তিনজন একটি পাওয়ার সাপ্লাই স্থাপনা বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংস করব। তখনো পুরো সিস্টেম চলবে অন্য পাওয়ার সাপ্লাই ইউনিট দিয়ে। তাই আমরা চলে যেতে পারব পৃথিবীতে। আর আমরা চলে যাওয়ার পরপরই লুলুলু ধ্বংস করে দেবে সর্বশেষ পাওয়ার সাপ্লাই স্থাপনা। থেমে যাবে ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটির সমস্ত কার্যক্রম।’

অদ্রি প্রথমবারের মতো অবাক চোখে তাকাল অদ্রিকের দিকে। বিস্ময় বালিকাকে এভাবে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা থতমত খেয়ে গেল অদ্রিক। বলল, ‘আমি কি ভুল কিছু বললাম?’

লুলুলু বলল, ‘না, তুমি একদম ঠিক বলেছ। তবে একটা সমস্যা হতে পারে।’

অদ্রিক জিজ্ঞাসা করল, ‘কী সমস্যা?’

‘ট্র্যাপিজিনরা আরেকটা পাওয়ার সাপ্লাই ইউনিট তৈরি করে চার সার্ভার লোকেশন আবার চালু করতে পারে। কিন্তু সেটা অবশ্য সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রায় ৩০ বছর, অর্থাৎ পৃথিবীর হিসাবে প্রায় ৪৫ বছর।’

অদ্রি বলল, ‘এটা অনেক সময়। প্রায় চার যুগ বা প্রায় দুই প্রজন্ম বলা যেতে পারে; যেহেতু পৃথিবীর হিসাবে ১২ বছরে এক যুগ আর ২৫ বছরে এক প্রজন্ম ধরা হয়। দুই প্রজন্ম পরে দেখা যাবে, মানুষই এই গ্রহে এসে হাজির হয়েছে!’

লুলুলু বলল, ‘হতে পারে। তা ছাড়া এই পাওয়ার সাপ্লাই ইউনিট দুটির সঙ্গে যেহেতু অন্য গ্রহ থেকে আসা বিদ্যুৎ সরবরাহের সংযোগ আছে, সেহেতু পাওয়ার সাপ্লাই ইউনিট ধ্বংস করলে সেসব স্থাপনাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ট্র্যাপিস্ট গ্রহগুলোয় বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে। যেমন কর্ম, তেমন ফল। ট্র্যাপিজিনদের উপযুক্ত শিক্ষা হবে।’

লুলুলু নকশা দেখিয়ে অদ্রিদের বুঝিয়ে দিল কীভাবে কাজ করতে হবে। একটি যন্ত্রে কিছু ইনপুট দিয়ে সে দুটি জিরোস্পেস গেট তৈরি করবে। এক জিরোস্পেস গেটের ডেসটিনেশন একটি পাওয়ার সাপ্লাই স্থাপনার ভেতরে মাঝামাঝি কোনো স্থানে; আরেকটি জিরোস্পেস গেটের গন্তব্য পৃথিবীর কোনো স্পেসশিপে। অদ্রিরা প্রথম জিরোস্পেস গেট দিয়ে চলে যাবে পাওয়ার সাপ্লাই স্থাপনার মাঝে। সেখানে নিফ্রাইট বোমার সেফটি পিন খুলে সেটি রেখে চলে আসবে। ১০ সেকেন্ডের মধ্যে বিস্ফোরিত হবে ভয়ংকর সেই বোমা; উড়িয়ে দেবে সুবিশাল পাওয়ার সাপ্লাই ইউনিট তথা স্থাপনা। এদিকে অদ্রিরা ফিরেই অন্য জিরোস্পেস গেট দিয়ে চলে যাবে পৃথিবীতে। এর মধ্যে লুলুলু তার যন্ত্রে ইনপুট দিয়ে সৃষ্টি করবে আরেকটি জিরোস্পেস গেট। সেই গেটের ডেসটিনেশন দ্বিতীয় পাওয়ার সাপ্লাই স্থাপনার মাঝবরাবর। এই স্থাপনাগুলোর অবস্থান অত্যন্ত গোপন হলেও নকশা থাকায় লুলুলুর স্থানঙ্কগুলো জানা। অদ্রিরা পৃথিবীতে পৌঁছানোর পর সেটি নিশ্চিত হয়ে লুলুলু সর্বশেষ জিরোস্পেস গেট দিয়ে দ্বিতীয় পাওয়ার সাপ্লাই স্থাপনার মাঝবরাবর চলে যাবে। নিফ্রাইট বোমার সেফটি পিন খুলে সেটি রেখে ফিরে আসবে নিজের বাড়িতে। ১০ সেকেন্ডের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে সর্বশেষ পাওয়ার সাপ্লাই ইউনিট। বন্ধ হয়ে যাবে ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটির প্রোগ্রাম চলা সমস্ত সার্ভার।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, নিফ্রাইট বোমা নিয়ে অদ্রিরা প্রস্তুত হলো। লুলুলু সৃষ্টি করল দুটি জিরোস্পেস গেট—একটির গন্তব্য পাওয়ার সাপ্লাই সেন্টারে এবং আরেকটির গন্তব্যস্থল পৃথিবী গ্রহের কোনো মহাকাশযান! অদ্রিরা পাওয়ার সাপ্লাই সেন্টারে যাওয়ার জন্য জিরোস্পেস গেটের মধ্যে ঢুকে পড়ল। সাড়ে তিন সেকেন্ডেই পৌঁছে গেল গন্তব্যে। কিন্তু সেখানে পৌঁছতেই ভয়াবহ এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো। অদ্রিদের সামনে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে এক ট্র্যাপিজিন সেনা। ভিনগ্রহী সেনা টহল দিচ্ছিল এবং জিরোস্পেস গেট আবির্ভূত হতে দেখে সেদিকে অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে গেছে!

সশস্ত্র এলিয়েন ট্র্যাপিটো ভাষায় কী সব বলতে থাকল। সেসব কথায় পাত্তা না দিয়ে তালুত নিফ্রাইট বোমার সেফটি পিন খুলে তা ছুড়ে দিল দূরে। অন্যদিকে, প্রাণভয়ে অদ্রিক দুই হাত ওপরে তুলতেই তার দিকে গুলি চালাল এলিয়েন। তালুত টান দিয়ে অদ্রিককে নিয়ে ঢুকে পড়ল জিরোস্পেস গেটের মধ্যে। অদ্রিও ঝাঁপ দিল। এলিয়েন অদ্রির দিকে একটি গুলি ছুড়ল কিন্তু অদ্রি একবার ডানে, আরেকবার বাঁয়ে লাফ দিয়ে জিরোস্পেস গেটের ভেতর ঝাঁপ দেওয়ায় সেটি লাগল না।

জিরোস্পেস গেট দিয়ে অদ্রিরা লুলুলুর বাসস্থানে পৌঁছানোমাত্র সেটি সে বন্ধ করে দিল। এর মধ্যেই অদ্রিকের অবস্থার অবনতি ঘটেছে—ঠিকমতো দম নিতে পারছে না; কিছু একটা বলতে চাচ্ছে, কিন্তু তার গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। অদ্রির চোখে পানি চলে এল। লুলুলু বলল, ‘এসব অস্ত্রের গুলি আসলে এমন উপাদানে তৈরি যে শরীরের ভেতরে ঢুকে আর বের হয় না; বরং ভেতরে বিষক্রিয়া তৈরি করে। এই গ্রহের হাসপাতালে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে ওকে নিতে পারলে বাঁচানো যেত। কিন্তু সেই সময়টুকু আমাদের হাতে নেই।’

তালুত বলল, ‘গুলিটা শরীর থেকে কি বের করা সম্ভব?’

লুলুলু বলল, ‘শরীর থেকে গুলি বের করলেও লাভ নেই। ইতিমধ্যে বিষক্রিয়া ওর শরীরের অনেকখানি কবজা করেছে। দেখো, ওর শরীর নীল হয়ে যাচ্ছে।’

অদ্রি ও তালুত দেখল, অদ্রিকের শরীর ফ্যাকাশে নীল রং ধারণ করছে। লুলুলু বলল, ‘তোমাদের আর একমুহূর্ত দেরি করা ঠিক হবে না। ওই জিরোস্পেস গেট দিয়ে চলে যাও। আমি খবর পেয়েছি, অন্য একটি দল এই বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা এখানে এসে যাবে।’

অদ্রিরা ঠিকমতো বিদায় নেওয়ার অবস্থায় নেই। কোনো কথা না বাড়িয়ে তারা ঢুকে পড়ল পৃথিবীগামী জিরোস্পেস গেটের মধ্যে। লুলুলু হিসাব করে দেখেছে, পৃথিবীতে পৌঁছতে অদ্রিদের দেড় মিনিট সময় লাগবে। দেড় মিনিট শেষ হতেই লুলুলু সর্বশেষ পাওয়ার সাপ্লাই স্থাপনায় পৌঁছানোর জন্য আরেকটি জিরোস্পেস গেট সৃষ্টি করে তাতে ঢুকে পড়ল। সেখানে পৌঁছাতেই লুলুলুর ওপর গুলি চালাল টহলরত ট্র্যাপিজিন সেনা। এ অবস্থার জন্য প্রস্তুত ছিল লুলুলু। তাই নিফ্রাইট বোমার সেফটি পিন আগেই খুলে রেখেছিল। নিজেকে গুলির হাত থেকে বাঁচিয়ে নিফ্রাইট বোমা ছুড়ে মারল টহলরত এলিয়েনের মুখ বরাবর এবং পরক্ষণেই ঢুকে পড়ল জিরোস্পেস গেটে।

বাগানবাড়িতে ফিরতেই লুলুলু আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। তার বাসার দিকে ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ আকাশযান নিয়ে ছুটে আসছে বিশাল সৈন্যবহর। তার জন্য অপেক্ষা করছে ভয়াবহ মৃত্যু! তার মৃত্যু হলেও পাওয়ার সাপ্লাই ইউনিট দুটিকে বাঁচাতে পারবে না বদমাশ ট্র্যাপিজিনরা। কারণ, নিফ্রাইট বোমার বিস্ফোরণে দুটি সেন্টারে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। যন্ত্রপাতি এবং অন্য সরঞ্জামাদি পুড়ে নিঃশেষ হতে আর বড়জোর কয়েক মিনিট লাগবে। তারপরই ইতিহাস হয়ে যাবে বদমাশ ট্র্যাপিজিনদের কয়েক দশকের ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি প্রজেক্ট। নিঃশেষ হয়ে যাবে পৃথিবী গ্রহে এলিয়েনদের আগ্রাসন।

লুলুলুর বাড়ি লক্ষ্য করে দূর থেকেই গোলাগুলি ছোড়া শুরু করল আকাশপথে আসতে থাকা সেনাবাহিনী। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে লুলুলু তাকাল মহামূল্যবান ধাতুর গুঁড়া এবং লেজার মেল্টিং প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি এক নিখুঁত অবয়বের দিকে, যা মূলত অকালে প্রাণ হারানো তার প্রিয়তমা স্ত্রীর অবয়ব। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত লুলুলুর চোখে পড়ল পৃথিবী গ্রহে যাওয়ার জিরোস্পেস গেট! আর কোনো চিন্তা না করেই সেটির ভেতর ঝাঁপ দিল লুলুলু।

পৃথিবীর একটি স্পেসশিপের ভেতর অদ্রিরা এসে পৌঁছেছে কিন্তু অদ্রিকের কোনো সাড়া নেই। অদ্রিক আর বেঁচে নেই, এটি তালুত ও অদ্রি বিশ্বাসই করতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর অদ্রিদের কাছে এসে পৌঁছাল লুলুলু এবং সে আসার পরপরই মিলিয়ে গেল জিরোস্পেস গেট। অদ্রি ও তালুত কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই শুরু হলো আরেক ঘটনা। সুবিশাল স্পেসশিপের স্ট্রাকচার যেন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আকারে খুলে শূন্যে মিলিয়ে যেতে থাকল।

যেসব মানুষ বেঁচে আছেন, তাঁরা চালু থাকা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় অপরিমেয় বিস্ময় নিয়ে দেখলেন, ১০টি স্পেসশিপ একই সঙ্গে শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে! ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার মতো বস্তুতে বিভাজিত হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে স্পেসশিপগুলো। ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে তৈরি স্পেসশিপগুলো ট্র্যাপিজিনরা হয়তো পৃথিবীর নিকটবর্তী আকাশে সুবিশাল জিরোস্পেস গেট নির্মাণের মাধ্যমে পাঠিয়েছিল; কিন্তু সেগুলোর বিদায় সেভাবে হলো না।

বান্দরবানের বগা লেকের পানিতে টুপ করে কেউ পড়ল। পড়েই অদ্ভুত ভাষায় চিৎকার করতে করতে লেকের পানিতে ডুবে গেল। পৃথিবীবাসী টেলিভিশন পর্দায় দেখতে পেল, স্পেসশিপের ভেতরে থাকা এক এলিয়েনের পানিতে ডুবে মর্মান্তিক মৃত্যু। একই ঘটনা ঘটল অন্যান্য স্পেসশিপের ক্ষেত্রেও। বিভিন্ন দ্বীপ, রিফ, উপদ্বীপের ঝুলন্ত স্পেসশিপ মিলিয়ে যাওয়ার সময় সেগুলো থেকে নিচে পড়ল দায়িত্বরত এলিয়েনরা। মানুষ তাদের আক্রমণ করল না; কারণ প্রতিকূল পরিবেশে তাদের পক্ষে বেশি দিন বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।

যুক্তরাজ্যের নটিংহামে স্থানীয় সময় সকাল পৌনে আটটায় ঘটল ভিন্ন রকম একটি ঘটনা। উলাটন পার্কের স্পেসশিপটি মিলিয়ে যাওয়ার সময় পার্কের মাঠে ঝুপ করে পড়ল পাঁচজন। তাদের আশপাশ থেকে ঘিরে ফেললেন ব্রিটিশ সেনাসদস্যরা। তাদের মধ্যে দুজন এলিয়েন এবং তিনজন মানুষ! টেলিভিশনের পর্দায় পৃথিবীবাসী বান্দরবানের স্পেসশিপে যে তিন কিশোরকে ঢুকতে দেখেছিল, তাদের আবার টেলিভিশনের মাধ্যমে দেখতে পেল নটিংহামের উলাটন পার্কে! তবে এক কিশোরকে মৃত মনে হচ্ছে; সঙ্গে দুজন সবুজ ত্বকের এলিয়েন। নটিংহামের তাপমাত্রা কম হওয়ায় অদ্রি ও তালুত ঠান্ডায় কাঁপতে থাকল, কিন্তু অদ্রিকের নিথর শরীর এখন এসবের ঊর্ধ্বে।

কিছুক্ষণের মধ্যে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা হলো অদ্রিদের। পৃথিবীর মানুষের উদ্দেশে অদ্রি বলল, ‘আজকে পৃথিবীর জন্য আনন্দের দিন। কারণ, এলিয়েনদের আমরা পরাজিত করতে পেরেছি। ভিনগ্রহে আমরা যে মিশন সম্পন্ন করেছি, সেটির সহযোগী ছিলেন একজন ভিনগ্রহী। তাকে আমার পাশেই দেখতে পাচ্ছেন।’ এটুকু বলে লুলুলুকে আঙুল দিয়ে দেখাল অদ্রি।

দীর্ঘ একটি শ্বাস নিয়ে অদ্রি আবার বলতে শুরু করল, ‘একটি সংবাদ আমি দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানাতে চাই। যার বুদ্ধিমত্তায় আমরা পৃথিবীকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছি এবং মিশন শেষে আমাদের গ্রহে ফিরে আসতে পেরেছি, সেই মানুষ আমার প্রিয় বন্ধু অদ্রিক আর আমাদের মধ্যে নেই। আশা করি, পৃথিবীর জন্য তার এই জীবনদান মানুষ সব সময় মনে রাখবে।’ এ কথা বলার পর অদ্রির গলা ধরে এল এবং চোখ ছলছল করে উঠল। বিস্ময় বালিকা আর কথা বলতে পারল না।

*

পৃথিবী আবার সচল হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। মাত্র ছয় মাসে সব আগের মতো চলতে শুরু করেছে। সবাই হারানো প্রিয়জনদের স্মৃতি বুকে নিয়ে জীবনপথে এগিয়ে চলেছে। শোককে শক্তিতে পরিণত করে পৃথিবীবাসী আরও দুর্বার গতিতে এগোচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে গবেষণা শুরু হয়েছে জোরতালে। কয়েক যুগ পরে এলিয়েন আক্রমণ করলে হয়তো তারা পালাতে বাধ্য হবে।

পৃথিবী গ্রহের বিভিন্ন গবেষণাগারে খুশি মনে সময় দিচ্ছে লুলুলু এবং বেঁচে যাওয়া আরেক এলিয়েন। তারা বিভিন্ন দেশে যায়, সেখানকার নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে এবং মানুষের কল্যাণে গবেষণার কাজ করে। দুই ভিনগ্রহী নাসার বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সীমাহীন মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করে, কখনোবা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সংস্থার অত্যাধুনিক অস্ত্র নির্মাণ প্রকল্পে সহযোগিতা করে, আবার কখনো আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সংস্থার প্রতিনিধি হয়ে মানবজাতিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে কাজ করে।

পুরোদমে চালু হয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অদ্রিদের ক্লাস ও ক্লাস টেস্ট চলছে সমানতালে। বিস্ময় বালিকার মাথার ভেতরে গাছপালার কথামালা আজও তরঙ্গায়িত হয়। থেমে নেই অদ্রির মেডিটেশন ক্লাস; বাদল ভাইয়ার কমেডি চলমান। গোয়েন্দা মেহেরাজ আঙ্কেলের সঙ্গেও অদ্রির মাঝেমধ্যে কথা হয়। আবারও সচল হয়ে ওঠা জীবনের পথে ছুটে চলা অদ্রিকে শুধু একটি শূন্যতা কখনো কখনো গ্রাস করে—তাকে আর অনুসরণ করে না তার ফরেস্ট হোমো স্যাপিয়েন্স, প্রিয় বন্ধু অদ্রিক।

(শেষ)