সকালবেলা।
আমরা ছেলেপুলের দল বাড়ির বাইরে খুলিতে এসে জড়ো হয়েছি। রিটন ভাইয়ের নির্দেশ। আমি, বিটু, টিটু পড়ি ক্লাস ওয়ানে। রিটন ভাই পড়েন ক্লাস ফোরে। মিতাপুও এল।
রিটন ভাই বললেন, মিতা, তুই যা।
মিতাপু বলল, কই যাব?
রিটন ভাই বললেন, তুই বাড়ির ভেতরে যা।
মিতাপু বলল, কেন?
রিটন ভাই বললেন, আমরা ছেলেরা একটা প্ল্যান করব। তুই যা না!
মিতাপু বলল, না। তোমরা প্ল্যান করো। আমিও শুনব।
রিটন ভাই বললেন, প্ল্যানটা হলো, আমরা যুদ্ধ করতে যাব। আব্বাকে থানায় আটকে রেখেছে। আমরা থানায় অপারেশন চালাব। আব্বাকে উদ্ধার করে আনব।
মিতাপু বলল, আমিও যাব অপারেশনে।
রিটন ভাই বললেন, না না। তুই অপারেশনে যাবি না।
মিতাপু বলল, কেন যাব না? স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শুনেছি, মেয়েরাও যুদ্ধ করছে। আমিও করব।
রিটন ভাই বললেন, আচ্ছা। তুইও যুদ্ধ করবি।
রিটন ভাই বললেন, আচ্ছা, সবাই শোনো। আমরা ছোট। তাই বলে আমরা পারব না, এমন কিছু নাই। আমরা থানা অ্যাটাক করব।
বিটু বলল, আমাদের তো কোনো অস্ত্র নেই।
টিটু বলল, হ্যাঁ। আমাদের তো কোনো অস্ত্র নেই। তাহলে কীভাবে যুদ্ধ করব?
রিটন ভাই বললেন, যুদ্ধ করব বুদ্ধি দিয়ে।
মিতাপু বলল, কী বুদ্ধি?
রিটন ভাই বললেন, সেটাই তো এখন বের করতে হবে। কী বুদ্ধি করা যায়! তোরা সবাই মাথায় আঙুল দিয়ে টোকা দিতে থাক। দ্যাখ কী বুদ্ধি বের করা যায়!
মিতাপু বলল, মাথায় টোকা দিলেই বুদ্ধি বের হবে?
রিটন ভাই বললেন, তোর মাথা থেকে হবে না। বললাম না তোকে তুই বাড়ির ভেতরে যা। বাকিরা আমার কথা শোনো। আমি কমান্ডার। আমরা এখন যুদ্ধে আছি। যুদ্ধের ১ নম্বর নিয়ম হলো, কমান্ডার যা বলবে, তা-ই শুনতে হবে। অর্ডার ইজ অর্ডার।
আমি মাথায় ডান হাতের তর্জনী দিয়ে টোকা দিতে লাগলাম। কোনো বুদ্ধিই বের হচ্ছে না। আসলে আমার মাথায় তো কোনো বুদ্ধি নেই। বের হবে কোত্থেকে?
রিটন ভাই বললেন, আমাদের প্রথমে রেকি করতে হবে। আমরা যে জায়গাটা আক্রমণ করব, সেটা ভালোভাবে দেখতে হবে। চল, আমরা থানায় যাই। গিয়ে দেখে আসি, জায়গাটা কেমন। পুলিশ কোথায় পাহারা দেয়। তাদের রাইফেল কয়টা?
টিটু বলল, আমার মাথা থেকেও এই বুদ্ধিটাই বের হচ্ছিল।
বিটু বলল, আমার মাথা থেকেও একই বুদ্ধি বের হচ্ছিল।
আমরা থানা রেকি করতে যাব। থানা এখান থেকে অনেক দূর। রিটন ভাই সাইকেল চালাতে জানেন। তবে রডের নিচ দিয়ে। দুই পা প্যাডেলে রেখে তিনি সাইকেল চালান। তাঁর রডে একজন বসতে পারবে। পেছনের ক্যারিয়ারেও একজন বসতে পারবে। সমস্যা হলো, সাইকেল পাওয়া যাবে কোথায়? আব্বা সাইকেল চালিয়ে পুলিশের সঙ্গে গেছেন।
শফিক মামার সাইকেলটা নিতে হবে। মামাকে বললে মামা দেবে না। ওই যে উঠানে সাইকেলটা রাখা। চুপি চুপি নিয়ে আসতে হবে।
রিটন ভাই বাড়ির ভেতরে গিয়ে সাইকেল নিয়ে চলে এলেন।
টিটু আর বিটু সেই সাইকেলের সামনে আর পেছনে বসল। রিটন ভাই রডের নিচ দিয়ে ঠ্যাং ঢুকিয়ে সাইকেল চালাতে চালাতে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
আমি আর মিতাপু তাদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার বুক কাঁপতে লাগল।
সারা দুপুর তাদের খবর নেই।
আম্মা বললেন, এই মিঠুন, রিটন কই?
আমি বললাম, জানি না।
মিতাপু বলল, রেকি করতে গেছে।
রেকি করতে গেছে মানে?
আব্বাকে থানায় কোথায় রেখেছে, সেটা দেখতে গেছে।
আম্মা কাঁদতে লাগলেন, ও আল্লাহ বলে কী। ওর তো সাহস কম না। একা একা থানায় চলে গেল?
মিতাপু বলল, একা একা যায় নাই। বিটু আর টিটুকে সঙ্গে নিয়ে গেছে।
আম্মা পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে লাগলেন। ও শফিক ভাইজান, শুনছেন, এ কী কথা, রিটন নাকি থানার দিকে গেছে।
সারা দুপুর কেটে গেল। আমরা সবাই দুপুরে খাওয়ার কথা ভুলে গেলাম। রিটন ভাই কই গেল দুটো বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে?
দুপুর গড়িয়ে পড়ার পর আম-জাম ঘেরা রাস্তার ওই দূরে দেখা গেল সাইকেল। সাইকেলের সামনে টিটু বা বিটু, আরও পরে দেখা গেল রিটন ভাইকে, শেষে দেখা গেল টিটু বা বিটুকে।
রিটন ভাই এসে বলল, খারাপ খবর আছে। খুব খারাপ খবর। আব্বাকে থানা থেকে মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে গেছে।
আম্মা রিটন ভাইয়ের গালে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। বললেন, তোদের বাপ গেছে, এখন তোকেও মরতে যেতে হবে? তা–ও আবার সঙ্গে দুইটা বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে যেতে হবে?
মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। আম্মা কাঁদছেন। তিনি আলফাজ মাতুব্বরের বাড়ি গেলেন। তিনি বললেন, না না, আমার কিছু করার নেই। আপনাদের বাড়িতে মুক্তি আসে।
আম্মা ঠিক করলেন, মুক্তাগাছা বন্দরে যাবেন। তমিজ মিয়ার কাছে যাবেন। তিনি পাকিস্তানি মিলিটারির বড় দালাল। তাকে ধরলে যদি আব্বাকে ছাড়িয়ে আনা যায়।
আম্মার সঙ্গে আমিও গেলাম। একটা নৌকায় চড়ে বিল পেরিয়ে আমরা যাচ্ছি বন্দরের দিকে। বিলে কত যে শাপলা ফুটে আছে। দেখা যাচ্ছে শালুকের লতা। সেসবের মধ্য দিয়ে আমাদের নৌকা চলছে। একজন মধ্যবয়সী মাঝি লগি ঠেলছেন। তাঁর গালে দাড়ি, কপালে নামাজের দাগ। মাথায় টুপি।
তিনি বললেন, ‘পাকিস্তানিরা খুব অত্যাচার করিচ্ছে। ক্যাম্পত অনেক মেয়েছেলে ধরা নিয়া গেছে। অত্যাচার করে। আল্লাহ এই অত্যাচার সহ্য করবি ক্যাংকা করা।’
আমাদের একটা ব্রিজের নিচ দিয়ে যেতে হবে। মাথার ওপরে ব্রিজ। সেই রাস্তা দিয়ে পাকিস্তানি আর্মি চলাচল করে।
দূর থেকে দেখা গেল, একদল মিলিটারি রাস্তা দিয়ে আসছে। এখন কী হবে?
আম্মা দোয়া পড়তে লাগলেন। লা-ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন।
মাঝি বললেন, ‘আমি নৌকা ঠিক ব্রিজের নিচে রেখে দেব। আপনারা কোনো শব্দ করবেন না। মাথার ওপর দিয়ে ওরা লাইন ধরে চলে যাবে। নিচে কী আছে, দেখতে পাবে না।’
আমার নিশ্বাস ভয়ে বন্ধ হয়ে আসছে। আমরা ব্রিজের নিচে নৌকায় বসে আছি। ওপর দিয়ে সৈন্যরা যাচ্ছে। আধঘণ্টা পর দেখা গেল দূরে চলে গেছে তারা। তখন মাঝি আবার নৌকার লগি ঠেলতে লাগলেন।
আমরা মুক্তাগাছা বন্দরে গিয়ে দেখি বন্দরে লোকজন খুব কম। বাজারের দোকানপাট সব পোড়া। চাল নেই। পোড়া খুঁটি।
সেসব পেরিয়ে আমরা গেলাম তমিজ দালালের বাড়ি।
টিনের বড় ঘর। বাড়ির সামনে আরও লোকজন বসে আছে। কান্নাকাটি করছে। কারও ছেলেকে মিলিটারি ধরে নিয়ে গেছে। কারও বা মেয়েকে।
তারা সবাই তমিজ দালালের সাহায্য চায়।
আমাদের দেখে তমিজ মিয়া বললেন, ভাবি, আপনে আসছেন ক্যা?
আম্মা বললেন, ‘আপনাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট স্যারকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছল। এখন নাকি মিলিটারি ক্যাম্পে নিছে।’
‘ক্যা, ওনাকে ধরছে ক্যা?’
আম্মা বললেন, ‘আমারও তো সেইটাই প্রশ্ন। ওদের আব্বা পরহেজগার মানুষ। সব সময় নামাজ–রোজা নিয়ে আছে। তাকে যে কেন ধরল। কে শত্রুতা করল?’
‘একটা অপরাধ অবশ্য উনি করছেন। উনি চাকরিতে জয়েন করেন নাই। পিটিআইতে ঠিকমতো আসবে না?’
‘ওনার শরীর খারাপ। ব্লাডপ্রেশার বেশি। তাই উনি মেডিকেল লিভ নিছেন।’ আম্মা বললেন।
‘আচ্ছা আমি দেখব। কী যেন নাম?’
‘মো. আহসানুল হক।’
‘আচ্ছা। আমি দেখব।’
আমরা ফিরে এলাম নৌকাযোগে। আম্মা অজু করে জায়নামাজে বসলেন।
রাতের বেলা আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ কিসের যেন শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। দরজায় নক। ঠক ঠক। ঠক ঠক।
কে? আম্মা ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন।
ভাবি, আমি কায়সার। স্যারের ছাত্র কায়সার।
আম্মা কাপড় ঠিক করতে করতে উঠলেন। হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দিলেন চাবি ঘুরিয়ে।
দরজা খুললেন।
কায়সার ঢুকলেন। তার গায়ে একটা চাদর। চাদরের নিচে একটা স্টেনগান।
আমরা তখন খুব ছোট ছিলাম। কিন্তু কোনটা রাইফেল কোনটা স্টেনগান আমাদের ধারণা হয়ে গিয়েছিল।
কায়সার বললেন, স্যারকে তো মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। মিলিটারি ক্যাম্পটা পিটিআইয়ের পাশের কলেজে। মাঝখানে মাত্র একটা প্রাচীর।
রিটন ভাইয়ের ঘুম ভেঙে গেছে।
রিটন ভাই চোখ রগড়াতে রগড়াতে বললেন, সেই প্রাচীরের নিচে মাটির গর্ত। প্রাচীরের তল দিয়ে যাওয়া যায়।
মোট ২৫ জন মিলিটারি আছে। আমরা ঠিক করেছি, ক্যাম্পে হামলা চালাব। কমান্ডো হামলা। স্যারকে উদ্ধার করে নিয়ে আসব।
আম্মা বললেন, ওরা কলেজের বিল্ডিংয়ের ভেতরে থাকবে। নিশ্চয়ই ভালোভাবে চারদিকে পাহারা বসিয়ে রেখেছে। অনেক অস্ত্রও নিশ্চয়ই তাক করে রেখেছে। ওখানে হামলা করলে তোমরা সুবিধা করতে পারবে না।
কায়সার ভাই বললেন, ঠিক বলেছেন। আমাদের জানতে হবে মিলিটারি কখন, কোথায় অপারেশন করতে বের হবে। সেইটা জানলে বাকি কাজ সহজ হয়ে যাবে।
আচ্ছা।
এই জন্য আমার আপনার ছেলেমেয়েদের হেল্প লাগবে?
হেল্প লাগবে? কী রকম?
ওরা স্কুলের বই–খাতা নিয়ে কলেজের ভেতর দিয়ে পিটিআই স্কুলে যাবে। মিলিটারিরা ওদের কিছু বলবে না। এত ছোট বাচ্চাকে ওরা কিছু বলে না। ওদের সঙ্গে বরং এদের বন্ধুত্ব হয়ে যেতে পারে। এটাই আমরা চাই।
পরের দিন আমরা স্কুলে যাব বলে রওনা হলাম। আমি, মিতুপা, রিটন ভাই, টিটু, আর বিটু। নৌকা নিয়ে চলেছি। বাজারের ব্যাগের মধ্যে বই। বই নিয়ে স্কুলে যাচ্ছি দেখলে মুক্তিযোদ্ধারা রাগ করবেন। আবার স্কুলে না গেলে মিলিটারিরা রাগ করে। স্কুলে গেলে মিলিটারিরা খুশি হয়।
আমাদের নৌকা ঘাটে নামিয়ে দিল।
এবার আমরা পাঁচজন, ক্লাস ওয়ানের তিনজন, থ্রির একজন, ফোরের একজন, হাতে বই নিয়ে মুক্তাগাছা বন্দরের রাস্তায় হাঁটতে লাগলাম।
তারপর আমরা গেলাম কলেজের সামনে। এই কলেজের ভেতরেই মিলিটারি ক্যাম্প।
কলেজের গেটে বালুর বস্তা। তার আড়ালে মিলিটারির লোক মাথায় হেলমেট পরে অস্ত্র তাক করে রেখেছে।
আমরা গেটে গিয়ে বললাম, আমরা স্কুলে যাব। এই মাঠের ভেতর দিয়ে কি আমরা যেতে পারি?
মিলিটারি গার্ডরা মজা পেয়ে গেল। বলল, কিউ?
রিটন ভাই উর্দু প্র্যাকটিস করতেন। তিনি উর্দুতে বলতে লাগলেন, এই পথ দিয়ে গেলে আমাদের স্কুল কাছে হবে। এক মাইল কম হাঁটতে হবে।
মিলিটারির কয়েকজন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল অস্ত্র হাতে। তারা ডাকতে লাগল, বাচ্চালোগ ইধার আও।
গার্ডরা বলল, যাও।
আমরা পাঁচজন কলেজের ভেতরে গিয়ে প্রথম টানা লম্বা টিনে ছাওয়া ভবনের বারান্দায় উঠলাম।
তোমারা নাম কিয়া হ্যায়?
আমরা সবার নাম বললাম।
একজন মিলিটারি আমাকে কোলে তুলে নিল।
একজন মিলিটারি তার রাইফেলটা তুলে দিল রিটন ভাইয়ের কাঁধে। বলল, লেফট রাইট করো।
রিটন ভাই লেফট রাইট করতে লাগলেন।
একজন মিলিটারি কতগুলো লজেন্স আনল। আমাদের সবার হাতে লজেন্স দিল। টিটু আর বিটুকে নিয়ে তাদের আমোদের অন্ত নেই। টিটু কৌন হ্যায়? তো বিটু কৌন হ্যায়? এ তো ভেল্কি হ্যায়! তারা হো হো করে হাসতে লাগল!
সেখানে আমরা দেখলাম, মাহতাব মালিকে। পিটিআইয়ের মালি ছিলেন। তিনি খাকি প্যান্ট পরে আছেন।
আমাদের দেখে চলে এলেন কাছে। বললেন, এই রিটন, মিঠুন, মিতু তোমরা এখানে কী করো?
রিটন ভাই বললেন, ‘আপনি কী করেন?’
মাহতাব বললেন, ‘কমো বারে সব কমো। পরে কমো। তিনি চোখ টিপলেন।’
তারপর মুখে বললেন, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ। হামি পাকিস্তানের সেবা করিচ্ছি।’
মাহতাব চাচার বউকেও দেখা গেল। তিনি থালাবাসন মাজছেন টিউবওয়েলের পাড়ে।
রিটন ভাই বললেন, ‘আমাদের স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন স্কুলে যাব।’
ওদের ক্যাপ্টেনও এসে গিয়েছিল। সে বলল, আচ্ছা যাও। কালকে আবার এসো।
মাহতাব চাচা বললেন, ‘তোমরা চলো। তোমাদের আগায় দিয়া আসি।
তিনি আমাদের সঙ্গে দেয়ালের ভাঙা অংশে গেলেন।’
এই পথটা এখন জঙ্গলে ছেয়ে গেছে। কেউ আর এই পথে চলাচল করে না।
খানিক দূরে গিয়ে মাহতাব চাচা বললেন, ‘স্যারক তো এই পশ্চিমের ঘরত আটাকায়া থুছে। হামি কছি, স্যার ভালো মানুষ। স্যারক ক্যান আনিছো?’
রিটন ভাই বললেন, ‘আপনি কেন রাজাকার হইছেন?’
মাহতাব চাচা বললেন, ‘কোয়ো না বাপু কাকো। হামি মুক্তিবাহিনীর হয়া খবর জোগাড় করি।’
রিটন ভাই বললেন, তাহলে বলেন, ওরা কবে খাল দিয়ে নৌকা নিয়ে অপারেশনে যাবে?’
মাহতাব মিয়া বললেন, ‘আচ্ছা, কালকা আসো। কালকা কমো।’
আমরা স্কুলে গেলাম। ক্লাসে কেউ আসে না। যদিও দু–চারজন শিক্ষক আসেন। পিয়নও দরজা খোলে। ঘণ্টা বাজানো হয়।
পরের দিন আবার আমরা এলাম স্কুলের বই–খাতা নিয়ে। ঢুকলাম কলেজের গেট দিয়ে। মিলিটারিরা আমাদের নিয়ে নানা রকমের রঙ্গ–তামাসা করে। আমাদের বলল, ব্যাঙ লাফ দাও। আমরা বসে দুই হাত পায়ের পেছনে নিয়ে লাফাতে লাগলাম। তারা খুব মজা পেল।
পরে মাহতাব চাচা ফিস ফিস করে বলল, কাল ভোরে ওরা খাল দিয়ে হিন্দুপাড়ায় যাবে। দুই নৌকায় কুড়ি জন যাবে। ক্যাম্পে তখন মাত্র পাঁচজন থাকবে।
ওরা বের হবে সকাল আটটায়।
আমরা ফিরে গেলাম বাড়িতে।
গভীর রাতে কায়সার আঙ্কেল এলেন। আমরা তাঁকে জানালাম পাকিস্তানিদের পরিকল্পনার কথা। কুড়িজন আর্মি যাবে হিন্দুপাড়া অভিযানে। আগামীকাল সকাল আটটায়। দুইটা নৌকা নিয়ে যাবে।
পাঁচজন থাকবে ক্যাম্পে। তাদের মধ্যে দুজন বাবুর্চি, দুজন সেন্ট্রি, তারা পাহারা দেবে। একজন চিকিৎসক।
কায়সার আঙ্কেল বললেন, রিটন।
জি।
রিটন, মন দিয়া শোনো। এই শিশিতে অজ্ঞান করার গ্যাস আছে। এটা কারও নাকে ধরলেই সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। তুমি সেটা নিয়ে কাল স্কুলে যাওয়ার পথে আর্মি ক্যাম্পে যাবে। দুই গার্ডের নাকে সুবিধামতো ধরবে। শোঁকার সঙ্গে সঙ্গে ওরা অজ্ঞান হয়ে যাবে। তারপর তোমার আব্বাকে যে ঘরে রেখেছে, সেই ঘরের দরজা খুলবে। যদি তালা লাগানো থাকে, তাহলে তালা ভাঙতে হবে। বড় একটা হাতুড়ি নাও তোমাদের ব্যাগে। আর দুটো গ্রেনেড দিচ্ছি বিপদে পড়লে গ্রেনেড ছুড়বে।
রিটন ভাই গ্রেনেড হাতে নিলেন। বললেন, এই চাবিটা দাঁত দিয়ে টেনে খুলতে হবে। আমি জানি।
হ্যাঁ। তারপর দূরে ছুড়ে মারবে। মারার সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়বে। পারবে না?
পারব।
মিতাপু বলল, কাল আমি যাব না।
কায়সার আঙ্কেল বললেন, সেই ভালো।
সারা রাত ঘুম হলো না। আমরা তিনজনই ছটফট করছি।
আমরা যাচ্ছি নৌকা করে। আমাদের ব্যাগে বই। দুটো গ্রেনেড। অজ্ঞান করার গ্যাস ভরা শিশি। আমার পিপাসা পাচ্ছে। চারদিকে এত পানি, কিন্তু খাবার মতো পানি নেই।
আমরা কলেজের গেটে পৌঁছালাম সকাল নয়টায়। ততক্ষণে মিলিটারিরা নৌকা নিয়ে বেরিয়ে গেছে।
আমরা গেটে যেতেই সেন্ট্রি দুজন খুশি হয়ে উঠল। বলল, আজকে তো কেউ নেই। সবাই কাজে গেছে।
আমরা বললাম, আমাদের চকলেট কই। তোমরা দুজনই দাও।
তারা পোস্ট ছেড়ে এসে আমাদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করতে লাগল। একজন কোলে নিল টিটুকে। আরেকজন বিটুকে। কী মুশকিল। রিটন ভাই শিশি ধরবেন কী করে।
আমি বললাম, আমি তোমাদের জন্য ছবি এঁকে এনেছি। দেখো।
ওরা দুজন টিটু, বিটুকে রেখে আমার কাছে এল। আমি খাতা বের করে আমার আঁকা ছবি বের করতে লাগলাম।
এই সময় রিটন ভাই তাঁর গ্যাসের শিশি বের করলেন। সেন্ট্রি দুজনের নাকে ধরলেন। দুজনই ধপাস করে পড়ে গেল।
মাহতাব চাচা ছুটে এলেন।
দেখলেন সেন্ট্রি দুজন পড়ে আছে।
তিনি তাদের অস্ত্র দুটো নিজের হাতে তুলে নিলেন।
বললেন, ‘চলো। স্যারকে বার করা লাগবি। আমরা দৌড়ে গেলাম পশ্চিম দিকের ঘরে। বাইরে থেকে বড় তালা ঝুলছে। রিটন ভাই ব্যাগ থেকে হাতুড়ি বের করলেন।
মাহতাব চাচা জোরে তালার মধ্যে হাতুড়ি চালাতে লাগলেন।
রিটন ভাই বললেন, কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরি তো পাশের ঘরেই। এটার তালা নেই। এটাতে ঢুকি আগে চলো।’
কেমিস্ট্রি ল্যাবে গিয়ে দেখা গেল, একটা বোতলে লেখা নাইট্রিক অ্যাসিড। রিটন ভাই বললেন, মাহতাব চাচা, এটা নেন। এটা দিলে লোহা গলে যাবে। সাবধান হাতে–পায়ে পড়লে পুড়ে যাবে।
আমরা অ্যাসিডের বোতল নিয়ে আব্বার রুমের সামনে আনলাম। মাহতাব চাচা সাবধানে বোতল খুলে তালার কড়ায় ঢাললেন। কড়া গলে গেল। তিনি সাবধানে তালা খুলে ফেললেন।
দরজা খুলল। ভেতরে আব্বা আর একজন অপরিচিত লোক।
মাহতাব চাচা বললেন, ‘স্যার, পালান। ছেলেদের সঙ্গে দৌড় ধরেন। আমিও আসতিছি। আমার বউকেও নিয়া আসতিছি।’
আমরা দৌড়ে গেট পেরিয়ে গেলাম। তারপর চলে গেলাম বিলে। আব্বা, আমি, টিটু, বিটু, রিটন ভাই।’
অপরিচিত লোকটাকে রিটন ভাই বললেন, ‘চাচা, জোর ছোটেন।’
রিটন ভাই বললেন, ‘গ্রেনেড দুটো কোনো কাজে লাগল না।’
একটু পরে দেখি, মাহতাব চাচা আর তার বউ এসেছেন। হাতে দুটি অস্ত্র।
তিনি চিৎকার করছেন, ‘আমাকে সাথে লন। আমি মুক্তিবাহিনীতে যামো।’
আবার নৌকা ঘোরানো হলো।
মাহতাব চাচা, তাঁর বউও আমাদের নৌকায় উঠে পড়লেন।
নৌকা চলছে। মাঝি লগি ঠেলছেন।
মাহতাব বললেন, ‘মেয়েছেলে আটকায়া থুছিল অনেকগুলা। তাদের দরজা খুলা দিয়া বললাম, পালাও। অরা বোকার মতো তাকায়া আছে। কই পালাবি কুটি যাবি বুঝিচ্ছে না।‘
আকাশে সাদা মেঘ। নীল আকাশে সাদা মেঘের ছায়া পড়েছে বিলের পানিতে। আমি একটা শাপলার ফুল টেনে ছিঁড়লাম। এটা দিয়ে পাইপ বানানো যাবে।
আব্বা আমাকে টেনে বুকে নিলেন। তিনি কোনো কথা বলতে পারছেন না।
আকাশে একঝাঁক বক। একটা পানকৌড়ি ঝুপ করে ডুবে একটা মাছ তুলে নিয়ে আবার উড়ে গেল আকাশে।
গোলাগুলির শব্দ আসছে।
কায়সার আঙ্কেলরা পাকিস্তানি নৌকায় হামলা করা শুরু করে দিয়েছেন।
আমাদের মাঝি নৌকার বেগ আরও বাড়িয়ে দিলেন।
আমরা বাড়িতে এলাম। আম্মা আব্বাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।
মাহতাব চাচাকে নিয়ে হলো মুশকিল। তাঁকে কোথায় লুকিয়ে রাখা হবে? বাড়ির পেছনেই দালালের বাড়ি।
আমরা অপেক্ষা করছি কায়সার আঙ্কেলের জন্য।
সন্ধ্যার দিকে শোনা গেল, পাকিস্তানি বাহিনীর একটা প্লাটুন পুরো ধ্বংস হয়ে গেছে। পুরো ক্যাম্প মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নিয়ে সব অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নিয়েছেন।
আমরা রাতে অপেক্ষা করতে লাগলাম কায়সার আঙ্কেলের জন্য।
তিনি এলে মাহতাব চাচাকে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হবে।
কায়সার আঙ্কেল আর আসেননি। দিশেহারা হয়ে তাঁকে খুঁজতে ছুটে গেলেন মাহতাব চাচা।
আমরা পরের দিন ভোরবেলা তিনটি গরুর গাড়ি করে মুক্তাগাছা ছেড়ে নানাবাড়ির দিকে রওনা দিই। মাহতাব চাচা রাতের অন্ধকারে বর্ডারের দিকে রওনা দেন।
নানাবাড়িতে আমাদের দিনগুলো কাটে একঘেয়েমিতে। রাতে বিবিসি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আর আকাশবাণী শুনি।
একদিন হঠাৎ আকাশে উড়োজাহাজ দেখা যায়। একটা উড়োজাহাজকে ধাওয়া করতে থাকে আরেকটা উড়োজাহাজ।
বোমা ফেলে। আমরা মাটিতে গর্ত খুঁড়ি। এটাকে বলে ট্রেঞ্চ। আমাদের ট্রেঞ্চটা ছিল ভি প্যাটার্নের। প্লেনের শব্দ শোনামাত্র আমরা গর্তে গিয়ে ঢুকতাম।
তারপর আমাদের গ্রামের নদীর ওই পাড়ে দেখা গেল সারি সারি ট্যাংক। ভারতের ট্যাংক। তার সামনে সাইকেলে মুক্তিবাহিনী। তারা যাচ্ছে আগে আগে। ট্যাংকগুলো ব্যাঙের মতো সাঁতরে নদী পার হয়ে আমাদের নানাবাড়ির পাশের ধানখেত দিয়ে যেতে থাকে। ধানখেত শেষে যখন উঁচু কাঁচা রাস্তা পড়ে, ট্যাংকগুলো তাতে উঠে আবার ধানখেতেই নেমে যায়। সব বাড়ি থেকে নারী–পুরুষ কলাগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে তাঁদের হাত নেড়ে অভ্যর্থনা জানান।
ভারতীয় সেনাদের অনেকেই ছিল শিখ। তাদের মাথায় ছিল পাগড়ি।
তারা বলছিল, আশিস করো মা, আশিস করো।
আমাদের আম্মা, খালা, নানিরা তাদের জন্য দোয়া করতে থাকেন। কেউবা নফল নামাজ পড়েন। কেউবা রোজা রাখেন।
ধানখেত থেকে বড় রাস্তায় উঠে আবার ধানখেতে নামতে গিয়ে ট্যাংক আছাড় খায়। কতগুলো সৈন্য ট্যাংক থেকে ধুপ ধুপ করে পড়ে যায়। তারা আবার ট্যাংকে উঠে পড়ে।
এই গ্রামের নাম কাজলা। এটা গাইবান্ধার নাকাইহাটের কাছে, কাটাখালি নদীর ধারে। মোট ২৯টি ট্যাংক আমাদের নানাবাড়ির পাশ দিয়ে যায়। অনেক পরে, আমি জেনেছি যে হামিদুল হোসেন তারেক বীর বিক্রম আমাদের নানাবাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া মিত্রবাহিনীর এই ট্যাংক দলকে গাইড করে নিয়ে গিয়েছিলেন।
একদিন বিকেলে সবাই জয় বাংলা রব তুলে পুরো গ্রাম মাথায় তোলে।
ব্যাপার কী?
পাকিস্তানি বাহিনী স্যারেন্ডার করেছে। বাংলাদেশ এখন শত্রুমুক্ত।
আমরা আবার গরুর গাড়ি করে নানাবাড়ি থেকে দাদাবাড়ি চলে আসি।
সেখানে রোজ সন্ধ্যার পরে হারিকেন টর্চ হাতে নিয়ে আমরা ছোটরা এবং বড়রা মিলে মিছিল বের করি: জেলের তালা ভাঙব। শেখ মুজিবকে আনব।
একদিন দুপুরবেলা। খুব শীত পড়েছে।
দুপুরের রোদও সেই শীত তাড়াতে পারছে না। আমি দাদাবাড়ির উঠানে একটা মাদুর পেতে বসে আছি। আমার তখন খুব ঝোঁক ছিল ছবি আঁকার। আমি বঙ্গবন্ধু আর ইন্দিরা গান্ধীর ছবিওয়ালা একটা ক্যালেন্ডারের পাতা পেয়েছি। সেটা দেখে বঙ্গবন্ধু আর ইন্দিরা গান্ধীকে আঁকার চেষ্টা করছি। হঠাৎ কাঠের দেয়ালঘেরা দাদার ঘর থেকে একটা রেডিও হাতে লাফিয়ে বেরোতে লাগলেন রিটন ভাই। চিৎকার করে বলছেন, বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিয়েছে...
আমরা সবাই রিটন ভাইকে ঘিরে ধরে নাচতে থাকি...রেডিওতে গান হচ্ছে, শোনো একটি মুজিবরের কণ্ঠ থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি...
আমরা মুক্তাগাছায় ফিরে আসি।
আব্বা বলেন, রিটন, মিঠুন চলো, কায়সারের কবর জিয়ারত করতে হবে।
মিতাপু বলে, আমিও যাব।
আমরা পিটিআইয়ের মাঠের এক কোণে শহীদ কায়সার আলমের কবরের পাশে দাঁড়াই। তাঁর কারণে আব্বা মুক্ত হয়েছিলেন। আমরা তাঁর জন্য দোয়া করি। আমি বলি, হে আল্লাহ, কায়সার আঙ্কেলকে তুমি বেহেশত দিয়ো।
মিতাপু ফুলের মালা গেঁথে এনেছেন।
মাহতাব চাচার ফুলের বাগানের ফুল।
মাহতাব চাচাও আর ফিরে আসেননি। কে জানে, তিনি কোথায় হারিয়ে গেছেন।
আর আসে না নাগেশ্বর। আর আসে না রাজা। পুরো পরিবারটার কোনো খোঁজ নেই।
পাশের কলেজের ইঁদারা থেকে অসংখ্য মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়েছে।
ট্রেন চলে। আমি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ট্রেনের আসা–যাওয়া দেখি। আমাদের অটোপ্রমোশন দেওয়া হয়েছে। আমি ক্লাস টুতে ভর্তি হয়েছি।
এর মধ্যে আব্বার বদলির নির্দেশ আসে। আব্বা রংপুর পিটিআইতে বদলি হয়ে গেছেন।
আমরা একদিন ট্রেনে চড়ে রংপুরের দিকে রওনা হই। রাতের ট্রেন। ট্রেনে কোনো বাতি ছিল না।
ট্রেনের দুলুনিতে আমি আম্মার কোলের পাশে ঘুমিয়ে পড়ি।
দেখি, রাজা আমাকে ডাকছে। ভাইয়া, চলো খেলতে যাই।
একটু পর মাহতাব চাচা আসেন। বলেন, আজ অনেক জবা ফুল ফুটেছে।
আমি বলি, আমাকে দেন। আমি কায়সার আঙ্কেলের কবরে জবা ফুল দেব।
ভোরের আলো ফুটলে আমি দেখতে পাই, আমরা রংপুর স্টেশনে এসে গেছি।