সকালবেলা মিতাপু ডাকতে লাগল, মিঠুন, ওঠ। ওঠ।
আমরা আম্মার ফুপুর বাড়িতে একটা বড় ঘরে সবাই মিলে থাকি। আব্বা, আম্মা, রিটন ভাই, মিতাপু আর আমি। একটা বিশাল বিছানায় পাঁচজন বেশ এঁটে যায়।
আমি ঘুমিয়েই ছিলাম। আম্মা তখনো জায়নামাজে। আব্বা বোধ হয় মর্নিং ওয়াক করতে বের হয়েছেন। রিটন ভাই আর আমি শুয়ে আছি। মিতাপু ডাকছে, মিঠুন, মিঠুন...ওঠ।
কী? আমি চোখ রগড়াতে রগড়াতে বললাম। বেড়ার ঘর। ওপরে ঢেউটিন। বেড়ার ফুটো দিয়ে গোল গোল করে ভোরের আলো ঢুকছে। জানালা দিয়েও আলো আসছে।
আয়। একটা জিনিস দেখবি?
রিটন ভাই ঘুম থেকে উঠে পড়লেন। কী রে মিতা?
ভাইয়া। একটা জিনিস!
কী জিনিস?
বিলে ভাসছে...আমি বলতে পারব না। তোমরা আসো...
আমি বিছানা ছাড়লাম। আমার স্যান্ডেল চকির নিচে। মাটিতে নেমে স্যান্ডেল জোড়া খুঁজে বের করলাম। স্যান্ডেলের ফিতা গতকাল ছিঁড়ে গিয়েছিল। ল্যাম্পোর আগুনে ফিতা আর ফিতার গোল মাথাটা ধরে গলিয়ে নিয়ে আবার জোড়া লাগিয়েছি।
রিটন ভাই আর আমি চললাম মিতাপুর পিছে পিছে। আঙিনায় পানি জমে আছে। রাতে বোধ হয় বৃষ্টি হয়েছে। এখন অবশ্য আকাশ পরিষ্কার। সূর্য এখনো ওঠেনি। তবে সাদা আলোয় আঙিনা আকাশ সজনে গাছ—সব পবিত্র বলে মনে হচ্ছে। ভেজা বাতাসে আমগাছের পাতা কাঁপছে। পাখির কলকাকলি ছাপিয়ে ডেকে উঠল একটা মোরগ! কুক্কুরু কু।
উঠানের চারদিকে বেড়া। বেড়ার একপাশে একটা ড্রাম কাটা লোহা দিয়ে বানানো গেট। সেটা দিয়ে বেরিয়ে আমরা এলাম বাড়ির বাইরের খুলিতে। কিছুটা পরিষ্কার জায়গা। এখানে নিশ্চয়ই ধান শুকানো হয়। মিতাপুর পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে আমরা গেলাম বিলের ধারে। ঢোলকলমির ঝাড় পেরিয়ে বিলের ঠিক কাছাকাছি আসতেই চমকে উঠতে হলো।
পানিতে ভাসছে একটা ছোট্ট বাচ্চার লাশ।
লাশটা উপুড় হয়ে আছে। পরনে হাফপ্যান্ট। খালি গা। ছেলে, না মেয়ে—বোঝা যাচ্ছে না।
তার শরীরটা আমার চেয়েও ছোট।
তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। পানিতে লাল মিশে আছে।
কীভাবে বিলের পানিতে লাশ এল? কোথা থেকে ভেসে এল?
একটা কুকুর আসছে এদিকে। ঘেউ ঘেউ করতে করতে। রিটন ভাই কুকুরটাকে মারার জন্য একটা ঢিল খুঁজতে লাগল।
আমার বুক কাঁপছে। আমি খুব ভয় পেয়ে গেছি। আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে বিলের ধার থেকে নানির বাড়ির খুলিতে চলে এলাম। তখনই দেখা আব্বার সঙ্গে। আব্বা আর শফিক মামা মর্নিং ওয়াক করে ফিরছেন। আমাদের দেখে আব্বা বললেন, এই তোমাদের কী হয়েছে? হাঁপাচ্ছ কেন?
মিতাপু বলল, আব্বা, বিলের পানিতে একটা লাশ। ছোট্ট বাচ্চার লাশ।
শফিক মামা বললেন, ও আল্লাহ রে, গঞ্জত মিলিটারি মানুষ মারা সাফ করিছে। সেই লাশ বিলের মাঝখানে স্রোত ধরা এটি আসা গেছে। কী গজব পড়ল রে আল্লাহ। চলেন তো দুলাভাই দেখি...
আব্বা আর শফিক মামা বিলের ওই দিকটাতে যেতে লাগলেন। রিটন ভাই পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগল।
লোকজন জড়ো হলো।
লাশটা তোলা হলো।
আমরা দূর থেকে দেখে আঁতকে উঠলাম। এ যে রাজা। নাগেশ্বর কাকার ছেলে।
মিলিটারি কি নাগেশ্বর কাকাদের পাড়ায় ঢুকে সবাইকে গুলি করে মেরেছে?
আমার বুকে চেপে বসেছে কষ্ট। আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমি বিলের আরেক পাশে টলটলে পানির পাশে দাঁড়িয়ে বিলের পানিতে পড়া আকাশের ছায়া দেখতে দেখতে কাঁদতে লাগলাম।
একটু পরে আমার পাশে এসে কাঁদতে লাগল মিতাপু।
আরেকটু পরে এল রিটন ভাই। সে–ও কাঁদতে লাগল।
আমরা তিনজনে কাঁদছি। প্রথমে আস্তে আস্তে, তারপর হাউমাউ করে কান্না শুরু হলো।
রিটন ভাই কাঁদতে কাঁদতে বলল, এতটুকুন একটা ছেলেকেও গুলি করে মারল?
মিতাপু বলল, নাগেশ্বর কাকা, কাকি, রাজা, মায়া, সবাইকে মেরেছে?
রিটন ভাই বলল, ওদের ঘরবাড়ি সব পুড়িয়ে দিয়েছে। সবাই নিশ্চয়ই মারা গেছে। ব্রাশফায়ার করেছিল তো?
মিতাপু বলল, ব্রাশফায়ার মানে কী?
রিটন ভাই কান্না থামিয়ে বলল, একসাথে ২৪টা গুলি বের হয়। মেশিনগানের গুলি।
রিটন ভাই সবকিছু জানেন।
মিতাপু বলল, রাজার লাশটাকে কী করবে? কবর দিবে?
রিটন ভাই বলল, কবর কী করে দেবে? ওরা তো মুসলমান না?
মিতাপু বলল, তাহলে কি পোড়াবে?
রিটন ভাই বলল, পোড়ানোর জন্য শ্মশানে নিয়ে যাবে। এখান দিকে তিন মাইল দূরে মড়া ঘাঁটিতে লাশ পোড়ায়।
আমি এই সব কথার কিছুটা বুঝলাম, কিছুটা বুঝলাম না।
আমার রাজা রানি আর মায়ার মায়াভরা চোখ, ঝাঁকড়া চুল মনে পড়ছে।
কেন মিলিটারিরা মানুষ মারে?
ওরা কি মানুষ নয়?
মানুষ কেন মানুষকে মারে?
বিটু আর টিটুরাও এই গ্রামে চলে এসেছে। ওদের আব্বা-আম্মাও আর সোনাতলা বন্দরে থাকা নিরাপদ মনে করেননি। আমাদের সারা দিন কাটে ঘুরে ফিরে। বৃষ্টি এলে আমরা খানকাঘরে বসে ষোলো ঘুঁটি খেলি।
মাটিতে দাগ কেটে ষোলো ঘুঁটির ছক বানাই। মাঝেমধ্যে খেলি বাঘবন্দী।
মিতাপু খেলে কিতকিত, না হলে এক্কাদোক্কা।
সেটাও মাটিতে দাগ কেটে।
বিকেল হলে আমরা খেলি গাদন গাদন। এটা অনেকটা দাঁড়িয়াবান্ধার মতো খেলা।
আর খেলি যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। আমরা ছেলেপুলেরা দুই ভাগে ভাগ হই। একদল হয় মুক্তিযোদ্ধা। আরেক দল সাজে পাকিস্তানি মিলিটারি। একদল হয় বিশ্ব। তারা যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করে।
খেলার নিয়ম হলো সবাই লুকিয়ে থাকবে। তারপর একজন একজন করে বের হবে। দেখামাত্র যে আগে হাতের লাঠিটাকে বন্দুক বানিয়ে মুখে গুলির শব্দ করতে পারবে, সে বেঁচে গেল। আর যে গুলি করতে দেরি করবে, সে মারা যাবে। তখন সে খেলা থেকে বাদ। মড়া।
এইভাবে যে দলের সব খেলোয়াড় আগে মারা যাবে, সেই দল হেরে যাবে।
সমস্যা হলো, মুখে আগে গুলি করলেও প্রতিপক্ষ মানতে চায় না যে সে মারা গেছে।
তখন বিশ্বকে রেফারির ভূমিকা পালন করতে হয়।
আবার তুমি একজনকে মেরেছ, সাথে সাথে আরেকজন এসে তোমাকে মারতে পারে।
লুকোচুরি খেলারই ১৯৭১ সালের রূপ। তিলো এক্সপ্রেস খেলার মতনই।
আমাদের সঙ্গে খেলে বিটু আর টিটু।
ওদেরকে খেলায় নেবার সমস্যা হলো, এদের কে মুক্তিবাহিনি কে মিলিটারি—বোঝা যাবে কী করে? সে জন্য দুইজনকেই একদলে রাখতে হয়। তার মধ্যে একজন মারা গেলে সে একটু পর এসে বলে আমি মরি নাই, বিটু মরেছিল। কে যে বিটু আর কে যে টিটু।
শেষে রিটন ভাই বুদ্ধি বের করে। বিটুর পিঠে (খালি গা) পুঁইশাকের বিচি দিয়ে লিখে দেয় বি। টিটুর পিঠে লিখে দেয় টি। এরপর এরা আর পরিচয় অস্বীকার করতে পারবে না।
আমাদের ছোটবেলায় পুঁইশাকের বিচিতে খুব সুন্দর রং হতো। কিছুটা বেগুনি কিছুটা গোলাপি ধরনের ছিল রংটা।
সারা দিন এইভাবেই কাটে। স্কুল নেই। পড়াশোনা নেই। পরীক্ষা নেই।
রাত হলে হাতমুখ ধুয়ে হারিকেনের আলোয় মাটিতে পিঁড়ি পেতে বসে ভাত খাই। আমার টিনের থালাটা রঙিন। তাতে একটা লাল রঙের ফলের ছবি। কী ফল, তা জানি না।
রাতের বেলা ঝিঁঝি ডাকে। পুরা বিলের ওপরে জোনাকি মিটিমিটি করে। শেয়াল ডাকে। কুকুর ডাকে। মাঝেমধ্যে গুলির শব্দ হয়।
আর আমরা রেডিও শুনি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। তাতে খবর হয়—মুক্তিবাহিনী কোথায় কোথায় অপারেশন চালিয়েছে, কতগুলান পাকিস্তানি মিলিটারি মারা গেছে।
চরমপত্র নামের একটা অনুষ্ঠান সবার খুব প্রিয়। মুক্তিবাহিনির বিচ্ছুগুলা কী করল, সেটা বলে খুব রস করে করে।
রিটন ভাই বলেন, এই ভাষাটা ঢাকার ভাষা। খাইছে রে ভাই খাইছে...
গান হয়। পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্তলাল রক্তলাল...
আমার তখন ভারি কান্না পায়। রাজার রক্ত বিলের পানিতে মিশে গিয়েছিল। আমি দেখেছিলাম।
আর রেডিওতে হয় বজ্রকণ্ঠ। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজে। তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।
আব্বা রেডিওর নব ঘোরান। বিবিসির খবর শোনেন। আর শোনেন আকাশবাণী কলকাতা। খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়...
খবর শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়ি, জানি না। ভোরবেলা ঘুম ভাঙে।
তবে মাঝেমধ্যে রাতের বেলা ঘুম ভাঙলে সর্বনাশ। তখন কী করব? একা একা বাইরে যাওয়ার সাহস হয় না। পেটে পেশাব থাকলেও চুপ করে থাকতে হয়। অসহ্য হয়ে গেলে কাতর কণ্ঠে ডাকি, আম্মা আম্মা।
আম্মার ঘুম খুব পাতলা। এক ডাকেই উঠে পড়েন। কী বাবা?
আম্মা, পেশাব করব?
কতবার বললাম, ঘুমোনোর আগে আরেকবার করে আসো...কথা শুনবা না। ওঠো...
আম্মা বিছানা ছেড়ে মাটিতে রাখা হারিকেনের আলো নব ঘুরিয়ে বাড়িয়ে দেন। আমি বিছানা ছাড়ি।
বাইরে পায়খানা পেশাবখানা অনেক দূর।
এই উঠানের একপাশে টিউবওয়েলের পাড়। তার ড্রেনটা চলে গেছে পেছনের একটা পগাড়ে। সেই ড্রেনের ওপরে দুই পা দুইটা পাকা পাড়ে দিয়ে বসে পড়ি।
আকাশে চাঁদ। মেঘের ফাঁকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। কী আশ্চর্য, সবাই ঘুমালেও চাঁদটা এত রাতে জেগে আছে!
একটা বিড়াল কোথাও কাঁদছে। বিড়ালের কান্না এত ভয়াবহ হয়। ভয় পেয়ে দৌড়ে ঘরে আসি। বিছানায় শুয়ে পড়ি। ভয়ানক গরম। গা ঘেমে গেলে ঠান্ডা লাগে। ফের ঘুমিয়ে পড়ি।
বাড়িতে একজন মুক্তিযোদ্ধা এসেছেন।
আব্বার ছাত্র। তার নাম কায়সার।
আম্মা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা!
এখন কী খেতে দিই! বাবা, তুমি একটু বসো। আমি ভাত চুলায় দিই।
না, ভাবি। আমার সময় নাই। আমাকে এক্ষুণি আবার ছুটতে হবে।
আম্মা বললেন, আচ্ছা তুমি বসো ভাই। আমি তোমাকে অন্তত একটু গুড় আর ছাতু খেতে দিই।
ছাতু ভেজানো হচ্ছে।
আমরা তিন ভাইবোন ঘরের দুয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছি। মুক্তিযোদ্ধা দেখছি! মুক্তিযোদ্ধা দেখতে সাধারণ মানুষেরই মতো। লোকটা শুকনো। মনে হয় খাবার খেতে পায় না ঠিকমতো। মুখে একটু একটু দাড়ি। চুলও একটু লম্বাই।
তার কাঁধে একটা ঝোলা। লোকটার গায়ে শার্ট। পরনে একটা প্যান্ট।
তিনি আমাদের বললেন, এই তোমরা ভেতরে আসো।
আমাকে চিনতে পারছ না? আমি ৩০৩ নম্বর রুমে থাকতাম। মিঠুন, তুমি কেমন আছ?
আরে মুক্তিযোদ্ধা আমার নাম মনে রেখেছেন! আমি খুশিতে ডগমগ।
রিটন ভাই বলল, স্যার, (পিটিআইয়ের সব ছাত্রকে আমরা স্যার বলতাম) আপনার ব্যাগে কি অস্ত্র আছে?
কায়সার স্যার বললেন, গ্রেনেড আছে। দেখবা?
রিটন ভাই বললেন, হ্যাঁ দেখব। আপনারা তো গ্রেনেডকে আনারস বলেন, তাই না?
কায়সার স্যার হাসলেন। হ্যাঁ।
ঝোলা থেকে একটা গ্রেনেড বের করা হলো। কালো রং। একটা আমের সমান।
কায়সার স্যার বললেন, হাতে নিবা?
রিটন ভাই বলল, না, যদি হাত থেকে পড়ে যায়।
কায়সার স্যার বললেন, হাত থেকে পড়লে ব্লাস্ট করবে না। চাবি খুললে করবে।
রিটন ভাই বললেন, চাবি খুলে এক থেকে দশ গোনার মধ্যেই ছুড়ে মারতে হবে। না মারলে হাতেই ফুটে যাবে।
কায়সার স্যার বললেন, যুদ্ধের মধ্যে এখন সবাই সব জানে।
আব্বা কায়সার স্যারকে একটা চাবি দিলেন।
আম্মা ছাতু নিয়ে এলেন বাটিতে করে।
এই সময় বাড়ির বাইরে থেকে রব উঠল, মিলিটারি আসছে মিলিটারি...
এক লহমায় গ্রেনেডটা হাতে নিয়ে কায়সার স্যার ঘর থেকে বেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
আম্মা বললেন, দেখো তো, ছেলেটা ছাতুটুকুনও খেয়ে যেতে পারল না।
আব্বা বললেন, মিলিটারি এসেছে নাকি?
আমাদের গা কাঁপছে ভয়ে উত্তেজনায়।
আম্মা বাইরে বের হলেন।
একটু পর এসে বললেন, না, মিলিটারি আসে নাই। আমাদের পেছনের বাড়িতে দালাল আছে। তারা চিৎকার করেছে, যাতে কায়সার ছাতুটা না খেতে পারে।
পরে রিটন ভাই বলল, মিঠুন, বল তো কায়সার স্যার কেন এসেছিল?
জানি না তো।
আব্বার কাছ থেকে চাবি নিতে। পিটিআইয়ের ল্যাবরেটরিতেও কেমিক্যাল আছে। সেগুলো দিয়ে বোমা বানানো যাবে। ওরা চাবি দিয়ে দরজা খুলে চুপচুপ করে কেমিক্যাল নিয়ে পালাবে।
আমি বললাম, পিটিআইয়ে না মিলিটারি ক্যাম্প করেছে?
না, পিটিআইয়ে করে নাই। পাশের হাইস্কুলে করেছে।
থানা থেকে পুলিশ এল এই বাড়িতে। বাইরের গেটে দাঁড়িয়ে বলল, আহসানুল হক স্যার কি আছেন?
আহসানুল হক আব্বার নাম। আম্মা এগিয়ে গেলেন, না। নাই। কেন?
কোথায় গেছেন?
উনি তো আমাদের গ্রামের বাড়ি গেছেন।
গ্রামের বাড়ি কেন যাবেন? ওনার অফিস আছে না?
ওনার শরীর ভালো না। মেডিকেল লিভে আছেন।
আমরা বাড়ি সার্চ করব।
এরই মধ্যে আব্বাকে মামিরা রান্নাঘরে লুকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু পুলিশ এসে এই ঘর ওই ঘর করে রান্নাঘরেও ঢুকে পড়ল।
আব্বাকে দেখে বলল, সালাম স্যার। ভয় পাওয়ার কিছু নাই। আমরা পুলিশ। আপনাকে একটু থানায় যেতে হবে।
ক্যান কী হয়েছে?
সেটা থানাতে গেলেই জানতে পারবেন।
আব্বা বললেন, আচ্ছা, পায়জামা পাঞ্জাবি পরে আসি।
আব্বা পাঞ্জাবি পায়জামা পরছেন। আম্মা কাঁদছেন। আমরাও কাঁদছি। আব্বা বললেন, কান্নাকাটি কোরো না। আল্লাহ ভরসা। আমি তো কোনো অন্যায় করি নাই। আমার কিছু হবে না।
পুলিশ সাইকেল নিয়ে এসেছে। আব্বাও সাইকেল নিলেন।
সাইকেলে চড়া আব্বা পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
আম্মা মাটিতে আছড়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করলেন।
তারপর গেলেন পেছনের বাড়ির আলফাজ মাতুব্বরের কাছে। তিনি পাকিস্তানি মিলিটারির দালাল।
ভাইসাহেব, পুলিশ তো আপনার ভাইকে ডেকে নিয়ে গেল থানায়।
আলফাজ মাতুব্বর বললেন, বাঙালি পুলিশ নিছে তো। চিন্তার কিছু নাই। আস্যা যাবি।
ভাইজান, আপনে একটু খোঁজ খবর নেন। আপনার ভাইয়ের য্যান ক্ষতি না হয়।
না না, ক্ষতি হবি ক্যান। তবে শুনতে পালাম আপনাদের ঘরত মুক্তি আসা–যাওয়া করে।
কী যে বলেন ভাইজান। আমাদের ঘরে মুক্তি আসবে কোথা থেকে। আমরা ছাপোষা মানুষ। আমরা কারও সাতেও নাই পাঁচেও নাই। আপনি আমার ধর্মভাই। আপনি আপনার ভাইকে ছাড়ায়া আনেন। আম্মা কাতরস্বরে বলতে লাগলেন।
আমরা তিন ভাইবোন আম্মার পাশে। আমরাও কাঁদতে লাগলাম।
আলতাফ মাতুব্বর বলতে লাগলেন, শোনা যায়, মুক্তিকে নাকি হক সাহেব সাহায্য করিছে। শোনা কথা আর কী! আমরা তো ঠিকঠাক জানি না।
আম্মা বললেন, আমরা ছাপোষা মানুষ। আমরা কেমন করে মুক্তিদের সাহায্য করব?
আমি তো জানি না। পুলিশ নিয়ে গেছে স্যারক। পুলিশ কথা বার করা না ফেলে!
ভাইজান, আপনি একটু দেখেন। আপনি থানায় যান।
দেখি। ভাবা চিন্তা সিদ্ধান্ত নেই। বোঝেনই তো দেশের পরিস্থিতি...
আব্বাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। রাত নেমে আসছে। আম্মা কী করবেন কোথায় যাবেন বুঝছেন না। শফিক মামা বললেন, ওই আলফাজই রিপোর্ট করছে। হারামজাদা তো আর্মির দালাল। ও ছাড়া এটা আর কারও কাজ না।
আমাদের ঘুম আসছে না। মিতাপু কাঁদছেন...আব্বা আব্বা...
আব্বাকে কোথায় রেখেছে এই রাতে? আব্বা আসছেন না কেন? তাঁকে মারধর করবে? আমাদের নরমশরম আব্বাকে?
আমিও কাঁদছি।
রিটন ভাই বলল, এখনো নাকি থানাতেই রেখেছে। মিলিটারি নেয়নি। এই বেশি।
কে বলল? মিতাপু জিজ্ঞেস করল।
শফিক মামা থানায় গেছলেন। উনি বললেন।
আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমার কিছু ভালো লাগছে না।
আম্মা নামাজ পড়ছেন। মোনাজাত করছেন।
নামাজ শেষ করে আম্মা বললেন, একটা ছাগল কুরবানি দেব মানত করেছি। তোদের আব্বাকে যদি ছেড়ে দেয়, একটা ছাগল কুরবানি দিব। মহাস্থানগড়ে গিয়ে দরগা শরিফের সামনে কুরবানি দিয়ে মানুষের মধ্যে শিরনি বিতরণ করব।
আমরা সবাই দোয়া পড়তে লাগলাম। হে আল্লাহ, আমাদের আব্বাকে যেন ছেড়ে দেয়।