দুই
তরুণ ঘুরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ল।
‘হাই, তোমরা নিশ্চয়ই কিশোর, মুসা আর রবিন। আমি রয় হাডসন। আমি টনি আর ওর বন্ধু জনের সঙ্গে কাজ করি। ওরা এখনই এসে পড়বে।’
রয় গাড়ির হুড খুলতেই আরও ধোঁয়া গলগল করে বেরিয়ে এল। সামনের সিট থেকে এক জগ পানি নিল ও, রেডিয়েটরের ক্যাপ খুলল। তারপর হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠে মুখে আঙুল পুরল।
‘এত দিনে আমার শিক্ষা হওয়া উচিত ছিল,’ বলে মাথা নাড়ল। পকেট থেকে একটা ব্যান্ড-এইড বের করল। তারপর মোড়ক খুলে সবুজ ব্যান্ড–এইডটা আঙুলে পেঁচিয়ে লাগাল।
ঠিক এমন সময় লম্বা একটা ফ্ল্যাটবেড ট্রাক রয়ের গাড়ির পাশে এসে থেমে দাঁড়াল। বাদামি একটা ত্রিপলে ঢাকা ট্রাকের বেড; বিশাল, ফোলা কোনো কিছুকে ঢেকে রেখেছে। গোটা জিনিসটা দড়ি দিয়ে বাঁধা।
চালকের আসন থেকে নেমে এল লম্বা, পাতলা এক লোক। পরনে জিনস, শর্ট-স্লিভ শার্ট আর কাউবয় হ্যাট।
‘হাউডি,’ তিন বন্ধুর উদ্দেশে উদ্ভাসিত হাসল টনি।
‘হাই!’ একসঙ্গে বলে উঠল ওরা।
প্যাসেঞ্জারস সিট থেকে এক লোক নেমে এল। খাটো, ছিপছিপে লোকটির কালো চুল পনিটেইল করে বাঁধা। পরনে ওয়ার্কস্যুট, ব্যাগি শর্টস আর হাতাকাটা ফ্লানেলের শার্ট।
‘এ হচ্ছে আমার রুমমেট আর প্রিয় বন্ধু জন ওয়েদারবার্ড,’ বলল টনি, ‘জন, এরা কিশোর, মুসা আর রবিন।’
জন ট্রাকটাকে পাক খেয়ে ওদের দিকে এগিয়ে এল। মুখে বন্ধুভাবাপন্ন হাসি, চোখের মণি কালো। শার্টের পকেট কলম দিয়ে ঠাসা। বেল্টে আটকানো চাবির গোছা হাঁটার ফাঁকে টুংটাং শব্দ করল।
জনের সঙ্গে হাত মেলাল ছেলেরা। বাঘার সঙ্গে টনি আর জন পরিচিত হতেই দুজনকেই ভেজা চুমো উপহার দিল ও।
‘কাজে লেগে পড়া যাক,’ আকাশের দিকে চেয়ে বলল জন, ‘মাঝরাতে বৃষ্টি নামবে, বাজি ধরতে পারি।’ দড়িদড়া খুলতে শুরু করল ও।
রয় ওর গাড়িতে উঠে পড়ল।
‘আসার পথে হোটেলটা পড়েছিল,’ বলল রয়, ‘যাই, রুমটা দেখে নিই।’ গাড়ি চালিয়ে চলে গেল ও। হুডের তলা থেকে এবার সামান্য ধোঁয়া বেরোল।
‘আমরা হাত লাগাব?’ প্রশ্ন করল রবিন।
জন মৃদু হাসল ওর দিকে তাকিয়ে।
‘তবে তো খুবই ভালো হয়।’
‘আমরা দড়িগুলো খুলছি, তোমরা গোটাও,’ বলল টনি, ‘মাটিতে শুইয়ে রাখলেই হবে।’
বাঘাকে দাঁড়াতে বলে কাজে লেগে পড়ল ছেলেরা। কমিনিট বাদে সব দড়িদড়া খোলা হয়ে গেল। জন আর টনি ত্রিপলটা টেনে মাটিতে নামাল।
কিশোর যখন দেখল কী আছে ওটার নিচে, তখন লাফিয়ে পিছু হটল। ও সরাসরি তাকিয়ে আছে এক টির৵ানোসরাসের মাথার দিকে!
‘এ হচ্ছে টিরোন,’ হেসে উঠে বলল টনি, ‘একসঙ্গে জুড়লে ওকে আরও দারুণ দেখায়।’
ঢোক গিলল কিশোর।
‘কোথায় পেয়েছেন ওটাকে?’ প্রশ্ন করল।
‘আমরা কিনেছি,’ বলল টনি।
দাঁত বের করে হাসল মুসা।
‘ডাইনোসর স্টোর থেকে?’
‘না, যে টিরোনকে তৈরি করেছে, তার কাছ থেকে,’ বলল টনি, ‘সে চেয়েছিল একটা ডাইনোসর থিম পার্ক করবে, কিন্তু মাঝখানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। তা–ই দেখে আমরা টিরোন আর ট্রাকটা কিনেছি।’
‘ইস, ডাইনোসর দিয়ে আপনারা কী করবেন?’ প্রশ্ন করল রবিন।
‘টাকা তুলব,’ বলল টনি, ‘জন আর আমি শিশুদের ডাইনোসর সম্পর্কে শেখাব। ছোটখাটো একটা জাদুঘর করার ইচ্ছা আছে আমাদের।’
‘টিরোন হবে তার প্রধান আকর্ষণ,’ যোগ করল জন।
‘টিরোনকে প্রথম যখন বার্নে দেখি, তখন এখনকার মতো টুকরো টুকরো ছিল। আমি একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম ডেভেলপ করে ওকে দিয়ে চলাফেরা করাচ্ছি, কথা বলাচ্ছি। ওকে নিয়ে গোটা দেশ ঘুরে টাকা জোগাড় করি আমরা, ডোনেশন তুলি।’
‘রয়ও কি শিক্ষক নাকি?’ প্রশ্ন করল কিশোর।
‘না, ওর সঙ্গে আমাদের ওয়াইয়োমিংয়ে পরিচয়। ও কাজ খুঁজছিল, তাই ওকে হায়ার করেছি আমরা,’ জানাল টনি, ‘ও হোটেল রুম বুক করা, ফ্লায়ার বানানো, শো করার জোগাড় করা ইত্যাদি কাজ করে। জাদুঘর তৈরি হলে সেখানেও কাজ করতে চায় ও।’
ট্রাক বেডে উঠল জন।
‘টনি, এটাকে জুড়ে ফেলি এসো,’ বলল ও।
‘কীভাবে জোড়েন?’ প্রশ্ন করল কিশোর।
‘সোজা। ইরেক্টর সেট দিয়ে মডেল বানানোর মতোই,’ জানাল জন। ট্রাক বেডে রাখা এক বাক্স বড় নাট, বোল্ট আর তার দেখাল ও।
‘টিরোন কিসের তৈরি?’ রবিনের প্রশ্ন, ‘ভারী নাকি?’
‘না,’ জানাল টনি। জনের কাছ থেকে টির৵ানোসরাসের লেজটা নিয়ে আলতো করে মেঝেতে শুইয়ে দিল।
‘বেশির ভাগটাই ফাইবার গ্লাস আর রাবার। হাড়গুলো অ্যালুমিনিয়াম। দাঁত, পায়ের নখ আর চোখ প্লাস্টিকের।’
ছেলেরা আলগোছে দুই ইঞ্চি লম্বা একটা দাঁত স্পর্শ করল।
‘দেখতে একদম সত্যিকারের মতো!’ বলল মুসা।
‘সাবধান, কিছু কিছু কিনারা কিন্তু খুব ধারালো,’ বলল জন। হেসে সবুজ ব্যান্ড-এইডে মোড়া একটা আঙুল নাচাল।
রয়ের লাল গাড়ি হাজির হলে সবাই সেদিকে তাকাল। রয় গাড়ির ভেতর থেকে একগাদা কাগজ হাতে বেরিয়ে এল।
‘তোমরা সাহায্য করবে?’ বলল ও, ‘শহরে এই ফ্লায়ারগুলো ছড়িয়ে দিতে পারবে?’
রবিনের হাতে ফ্লায়ারগুলো দিল রয়। সবচেয়ে ওপরেরটায় চোখ রাখল ও। একটা টির৵ানোসরাসের ছবির নিচে এই কথাগুলো লেখা:
‘এসো, কথা বলা টির৵ানোসরাস টিরোনের সঙ্গে পরিচিত হও!
হাইস্কুলের পেছনে, জুলাইয়ের ৪ তারিখ, দুপুরবেলা। মাথাপিছু ১ ডলার দর্শনী।’
‘তোমরা তিনজন ফ্রি পাবে,’ বলল টনি, রবিনের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল।
‘খাইছে!’ বলল মুসা।
‘কাদের দেব এগুলো?’ প্রশ্ন করল কিশোর।
‘যাকে খুশি,’ বলল রয়, ‘যারা ডাইনোসর ভালোবাসে।’
রবিন ফ্লায়ারগুলো তিন ভাগ করল। সবাই একটা করে স্তূপ নিল।
‘আপনারা একটু বাঘাকে দেখে রাখবেন?’ প্রশ্ন করল কিশোর।
‘নিশ্চয়ই,’ জানাল রয়।
ছেলেরা ফ্লায়ার নিয়ে মূল রাস্তার দিকে এগোল।
এক ঘণ্টা বাদে ফিরে এল ওরা।
‘আগামীকাল পুরো শহর টিরোনকে দেখতে আসছে!’ জানাল কিশোর।
‘খুব ভালো! ওকে এখন কেমন লাগছে তোমাদের?’ প্রশ্ন করল টনি।
পেছনের পা আর লেজের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে টিরোন। ওর দেহ আর লেজ একটা স্কুলবাসকে ছাড়িয়ে গেছে, ও লম্বায় কিশোরদের বাড়ির প্রায় সমান। বাঘা ওর একটা প্লাস্টিকের পায়ের নখ শুঁকছে।
‘কী বলব... মানে... ।’ কথা হারিয়ে ফেলেছে কিশোর।
হেসে উঠল টনি আর জন।
‘এটা তো ছোট,’ বলল জন, ‘প্রাপ্তবয়স্ক টি-রেক্স এর চেয়ে অনেক বড়। এসো, তোমাদের দেখাই এটার পেটের ভেতর কী আছে।’
একটা চাবি বের করে টিরোনের এক পাশে ছোট্ট এক ফুটোয় ঢোকাল জন। চাবি মোচড় দিতেই খুদে একটা ধাতব রিং লাফিয়ে বেরিয়ে এল। জন রিংটা ধরে টানতেই কবজা লাগানো একটা দরজা হাট হয়ে খুলে গেল।
‘খাইছে! দেখাই যায়নি!’ বলে উঠল মুসা।
রাবারের একটা ওয়েজ তুলে নিল জন। দরজাটা খোলা রাখতে ব্যবহার করল ওটাকে। এবার দোরগোড়া দিয়ে হাত বাড়িয়ে টেনে নামাল ভাঁজ করা একসার কবজা লাগানো সিঁড়ি।
‘দেখো,’ বলল ও।
‘ওদের দুজনের নাক ডাকে,’ বলে টনি আর রয়কে ইঙ্গিতে দেখাল, ‘তা ছাড়া তারার আলোয় ঘুমাতে ভালো লাগে আমার। প্লাস, টিরোনকেও গার্ড দেওয়া হয়। সকালে আমি হোটেলে গিয়ে ওদের শাওয়ার ব্যবহার করব।’
ছেলেরা সিঁড়িতে হাঁটু গেড়ে বসে ডাইনোসরের পেটের ভেতর উঁকি দিল। দেয়ালগুলোকে সাপোর্ট দিচ্ছে অ্যালুমিনিয়ামের বার। একসার হুক যন্ত্রপাতি, দড়ির কুণ্ডলী আর তার ধরে রেখেছে। কোনো জানালা নেই। ভেতরে বেজায় গরম।
একটুকরো কার্পেট দিয়ে আংশিক ঢাকা মেঝেটা। কার্পেটের মাঝখানে ছোট একটা টেবিলের ওপর একটা ল্যাপটপ। মেঝের ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে একগোছা ধূসর কম্পিউটারের তার। কয়েকটা তার ডাইনোসরটার বুক বেয়ে উঠে উধাও হয়ে গেছে ঘাড় ও মাথার ভেতর।
‘কম্পিউটার সব করে,’ বলল জন, ‘আমি টিরোনের লেজ, মুখ আর সামনের পা নাড়াতে পারি স্রেফ মাউস ক্লিক করে।’
ছেলেদের নিয়ে টিরোনের পেটের ভেতর ঢুকল ও।
‘টিরোনের মাথায় একটা লাউডস্পিকার বসিয়েছি,’ ব্যাখ্যা করল জন। খুদে একটা মাইক্রোফোন দেখাল ছেলেদের, ‘এতে কথা বললে মনে হয় যেন টিরোনই কথা বলছে।’
‘খাইছে, ওকে দিয়ে এখন কথা বলাতে পারবেন?’ মুসার প্রশ্ন।
‘সে জন্য আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে,’ বলল জন, ‘আমরা জার্নি করে খুব ক্লান্ত। অন্তত দশ ঘণ্টা ঘুমাব।’
ছেলেরা আর জন বেরিয়ে এল টিরোনের পেট থেকে। দরজা লাগিয়ে দিল জন।
‘আপনারা কি শাংরি-লায় উঠেছেন?’ প্রশ্ন করল রবিন।
‘টনি আর রয় উঠেছে,’ বলল জন। ‘আমি এখানেই বিছানা পেতে নেব।’ ট্রাকের ভেতর থেকে একটা স্লিপিং ব্যাগ বের করে মাটিতে ফেলল ও।
‘আপনি বাইরে ঘুমান কেন?’ কিশোরের প্রশ্ন।
দাঁত বের করে হাসল জন।
‘ওদের দুজনের নাক ডাকে,’ বলে টনি আর রয়কে ইঙ্গিতে দেখাল, ‘তা ছাড়া তারার আলোয় ঘুমাতে ভালো লাগে আমার। প্লাস, টিরোনকেও গার্ড দেওয়া হয়। সকালে আমি হোটেলে গিয়ে ওদের শাওয়ার ব্যবহার করব।’
‘ভালো বার্গার কোথায় পাওয়া যায় বলতে পারো?’ রয় জিজ্ঞেস করল ছেলেদের, ‘আর সকালের নাশতা?’
‘কেলিস ডাইনার!’ একবাক্যে জানাল কিশোর।
রবিন মেইন স্ট্রিটের দিকে আঙুল তাক করল।
‘ওটা পেট শপ আর ফিটনেস সেন্টারের মাঝখানে।’
‘ধন্যবাদ। কাল দেখা হবে,’ বলল টনি।
ওরা তিনজন লাল গাড়িটায় উঠল। বড় রাস্তার দিকে গাড়ি হাঁকাল রয়। এ সময় মাথার ওপর বাজ গুড় গুড় করে উঠলে বাড়ির দিকে দৌড় দিল তিন বন্ধু।
চলবে...