দুষ্টু মেয়ের দল (পঞ্চম পর্ব)

অলংকরণ: তুলি

রাশেদা বসে পড়েছে রাস্তার ধারে। পথের মধ্যে ধুলা। পথের ধারে ঘাস। মারিয়া দূর্বাঘাস ছিঁড়ে নিল একমুঠো। মুখে নিয়ে চিবিয়ে চেপে ধরল রাশেদার ফাটা কপালে। রক্ত পড়া বন্ধ হলো খানিক পরে। এরই মধ্যে একটা রিকশাভ্যান এসে দাঁড়াল তাদের পাশে। ভ্যানওয়ালার নাম কাতলা কাশেম। রাশেদাদের কাছেই তাঁদের বাড়ি। রাশেদা তাঁকে ডাকে কাশেম চাচা বলে। কাশেম চাচার মাথাটা বড়। কাতলা মাছেরও নাকি মাথা বড়।

কাশেম চাচা বললেন, কী হইছে মা রাশেদা?

মারিয়া বলল, বদমাইশের বাচ্চারা ঢিলায়া রাশেদার মাথা ফাটাইয়া ফেলছে।

কাশেম চাচার ঘাড়ে একটা গামছা। তিনি এগিয়ে এসে রাশেদার কপালে গামছা বেঁধে দিলেন।

তারপর বললেন, আমার ভ্যানে উইঠা পড়ো। তোমগো বাড়ি পৌঁছাইয়া দেই।

রাশেদার বাড়িতে খবর চলে গেছে। রাশেদার মাথা ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। রাশেদার মা পাগলের মতো ছুটে আসছেন এদিকে। ও মা গো ও বাবা গো, আমার রাশেদারে মাইরা ফেলছে গো...বিলাপ করছেন তিনি।

তাঁর পেছনে ছুটছে একদল ছেলেমেয়ে। তাদের পেছনে একটা কুকুর আর দুইটা ছাগলছানা।

কাতলা কাশেম চাচার রিকশাভ্যান বাড়ির কাছের পোড়া জামগাছের কাছে পৌঁছানোর আগেই মা এসে হাজির। ও রাশেদা, তোর নাকি মাথা ফাইটা চার টুকরা হইছে?

রাশেদা বলল, না। পাঁচ টুকরা হইছিল। তিন টুকরা কুড়ায়া আনছি। আর দুই টুকরা ওইখানে পইড়া আছে।

মারিয়া বলল, না চাচি। ভালোই বেদনা পাইছে। কপালের কাছটা অনেকখানি কাইটা গেছে। রক্তও পড়ছে খুব।

মারিয়া রাশেদাকে ধরে নামাতে চেষ্টা করল। রাশেদা বলল, সর তো। আমি নিজেই নামতে পারমু।

একটু পরে আরেকটা রিকশাভ্যানে চড়ে হাজির হলেন বীণা আপা। বললেন, রাশেদা! রাশেদা কই?

রাশেদা তখন কলপাড়ে। মারিয়া হাতল চাপছে। রাশেদা হাতমুখ ধুচ্ছে। হাতে রক্ত। পায়ে ধুলা।

বীণা আপা বললেন, দেখি কী হয়েছে!

রক্ত পড়া থেমে গেছে। গামছাও খুলে ফেলা হয়েছে। কপালে একটা কাটা দাগ দেখা যাচ্ছে। কপালের ওপরের দিকে চামড়া কেটে গেছে।

বীণা আপা বললেন, অ্যান্টিসেপটিক কি দিয়েছ?

রাশেদা বলল, দূর্বাঘাস চাবায়া দিছি।

বীণা আপা বললেন, দূর্বাঘাস চাবায়া দিছি মানে! আরে দূর্বাঘাসের নিজের গায়েই তো কত রোগজীবাণু থাকতে পারে। ভালো করে ধোও জায়গাটা। ডেটল দিতে হবে। চলো আমার সঙ্গে। ওঠো ভ্যানে। ওষুধের ডিসপেনসারিতে চলো।

রাশেদা বলল, না, লাগব না।

যা বলি তাই শোনো।

বীণা আপা জোর করে রাশেদাকে তুললেন ভ্যানে। মারিয়া বলল, আমিও যাই আপনাগো লগে।

বীণা আপা বললেন, না, দরকার নাই। তোমার মা তোমার জন্য চিন্তা করছেন। তুমি তোমার বাড়িতে যাও।

মারিয়া নিজের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। তার পিঠে একটা ব্যাগ। ব্যাগে ভরা কাপড়চোপড়।

বাড়ির কাছাকাছি যেতেই সে দেখল, মা দাঁড়িয়ে আছেন।

মারিয়া ব্যাগ মাটিতে রেখে ছুটে গেল মায়ের কাছে। মাকে জড়িয়ে ধরে রাখল অনেকক্ষণ।

মা বললেন, তুই এত শুকায়া গেছিস ক্যান?

মারিয়া বলল, সব সময় ভিজা থাকব নাকি? বলেই সে কাঁদতে শুরু করল।

মা বললেন, কানতেছিস কেন?

মারিয়া বলল, তোমারে দেইখা মায়া লাগতেছে। আমার মা। তোমারে ছাইড়া কেমনে থাকলাম এত দিন। মা গো...

মা বললেন, রাশেদার কী হইছে?

বদমাইশ পোলাপানে ঢিল মারছে। কপালটা একটু কাইটা গেছে।

মা মারিয়ার চোখের পানি মুছে দিতে লাগলেন আঁচল দিয়ে।

সেই দুঃখে কানতেছিস?

না মা। সেই দুঃখে কানতেছি না। তোমারে আমি কতটা ভালাবাসি, সেইটা ভাইবা কানতাছি।

কান্দে না পাগলি। বলে নিজেই কাঁদতে লাগলেন মারিয়ার মা।

রাশেদাকে নিয়ে বীণা আপা পৌঁছালেন গঞ্জের ওষুধের দোকানে। কম্পাউন্ডার নিখিল বাবু দেখলেন রাশেদার কপালের কাটা জায়গাটা। তারপর তুলোতে ডেটলপানি মিশিয়ে জায়গাটা ভালো করে মুছে দিয়ে বললেন, আচ্ছা দিয়া দিতাছি একটা ব্যান্ডেজ। তাইলে বাইরের ধুলাবালি লাগব না। একটা টিটেনাস ইনজেকশন দিমু নাকি?

রাশেদা বলল, না, আমি টিটেনাস দিমু না।

বীণা বললেন, সব ছেলেমেয়ের না একটা টিটেনাসের কোর্স কমপ্লিট করতে হয়। আচ্ছা, ডাক্তারের কাছে শুনে নিয়ে সবাইকে একসাথে দেবার ব্যবস্থা করব। এই কাটায় টিটেনাস লাগবে মনে করেন?

লাগলেও উপায় নাই। আমার কাছে নাই। নিখিলবাবু বললেন।

না থাকুক। লাগবে কিনা বলেন।

আমি তো কম্পাউন্ডার মানুষ। ডাক্তারি কথা আমি না বলি। পাস করা ডাক্তাররা কইলে ভালা।

ঠিক আছে।

রাশেদা বলল, আপা, ইনজেকশন লাগব না। চলেন বাড়ি যাই। খিদা লাগছে। বাড়ি গিয়া ভাত খামু।

বীণা আপা বললেন, আমার বাড়ি চলো। আমার সঙ্গে খাবে।

না আপা।

কেন না?

আমার মায়ের লগে একসাথে খামু আপা।

রাশেদার চোখ ছলছল করছে। বীণা আপা বললেন, এই কথার পরে আর জোর করা চলে না। চলো তোমাকে তোমার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।

 ***

 সোমবার সকালবেলা মেয়েরা সবাই এসেছে স্কুলের মাঠে। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছে। এখন আকাশ পরিষ্কার। বাতাস বইছে। আরামদায়ক বাতাস।

মাঠের ঘাস ভেজা ভেজা। মইন স্যার এলেন। মইন স্যার বললেন, এই তোরা সবাই চইলা যা। তারপর ছড়া বানাতে লাগলেন,

খাইছি মেলা গোল।
প্যাট হইছে ঢোল।
এক কাপ চা
সবাই চইলা যা।
মন ভালো নাই।
খেলা বন্ধ তাই।

মারিয়া বলল, এর মানে কী?

মইন স্যার বললেন, আমরা মেলা গোল খাইছি রংপুরের কাছে। গ্রামের ইজ্জত শ্যাষ। পোলাপানে ঢিলাইয়া রাশেদার মাথা দিছে কিলাইয়া। এরপর আমি আর কোচ থাকতে পারি না। কোচ বদলানো দরকার। কোনো দল হাইরা গেলে তার কোচ সেই পদে বহাল থাকতে পারে না। পৃথিবীতে কোথাও এইটা হয় না। আমি হেড মিসট্রেসকে বলব আমারে বাদ দিতে। আমি আর খেলাব না তোদের।

মইন স্যার নিজেই এবার কান্না সামলাতে ব্যর্থ হলেন। গলা ধরে এল তাঁর। বিকৃত হয়ে যাচ্ছে কণ্ঠস্বর। চোখ দিয়েও দরদর করে পানি ঝরতে লাগল মইন স্যারের।

স্যারকে কাঁদতে দেখে মেয়েরাও কাঁদতে লাগল। এই সময় এলেন প্রধান শিক্ষিকা দীপা রানী।

তিনি বললেন, কী হয়েছে? তোমরা সবাই আমার স্কুল মাঠটাকে চোখের জলের নদী বানাচ্ছ কেন? চলবে না। স্টপ ক্রায়িং। সবাই কান্না থামাও।

সবাই কান্না থামাল। সবাই চুপ। হঠাৎ ডুকরে উঠল রুনা।

দীপা রানী বললেন, কী হলো?

কান্না থামাইতে পারতেছি না আপা।

না পারলেও থামাতে হবে। সমস্যা কী?

মইন স্যার বললেন,

কী বলব দিদি!
সুখে কি আর কাঁদি।
মনের মধ্যে দুখের নদী
বহে নিরবধি!

দীপা রানী বললেন, আপনি কি আপনার কাব্য থামাবেন?

জি ম্যাডাম।

বলেন, সমস্যা কী বলেন।

আমি আমার কোচ পদ থেকে পদত্যাগ করলাম। ব্যর্থতার সব দায় আমি নিজের ঘাড়ে নিলাম। আজকে আমার জন্য আমার মেয়ে রাশেদার মাথা ফাটা। আর আমার মাথা গেছে কাটা।

দীপা রানী বললেন, এই সব চলবে না। ভালো করে প্র্যাকটিস করান। সামনেরবার ভালো করতে হবে।

মইন স্যার বললেন,

আমি তো ব্যর্থ,

আমাকে দিয়ে কোচিং করানোর হবে কী অর্থ?

দীপা রানী বললেন, পারিব না এ কথাটি বলিও না আর, একবার না পারিলে দেখ শতবার।

মইন স্যার বললেন, আমাদের শিক্ষিত কোচ লাগবে। আমি ছিলাম বডি বিল্ডিংয়ের চ্যাম্পিয়ন। আমি তো আর ফুটবল কোচ ছিলাম না। আমি পারব না আপা। আমারে মাফ কইরা দেন।

এই কথা বলেই সোজা নিজের বাড়ির দিকে চলতে শুরু করলেন মইন স্যার।

স্যার, স্যার ও স্যার! আপনি আসেন। আমরা চেষ্টা কইরা দেখি। পারমু স্যার—মেয়েরা কত কাকুতি-মিনতি করল। মইন স্যার কারও কথাই শুনলেন না।

বাড়ি থেকে তিনি এক মাসের ছুটি চেয়ে একটা দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলেন স্কুলে, লোকমারফত।

সহকারী প্রধান শিক্ষক জয়নাল আবেদীন প্রধান শিক্ষিকাকে বললেন, আপা, আপনারে কইছিলাম, মেয়েদের দিয়া ফুটবল হইব না।

দীপা রানী বললেন, আপনাকে না বলছি, এই ব্যাপারে কোনো কথা বলবেন না।

জয়নাল আবেদীন কাশি দিলেন। কাশি দিতে গিয়ে তার নাক দিয়ে সর্দি বের হয়ে গেল।

দীপা রানী বললেন, যান। নাকমুখ পরিষ্কার করে আসেন। যান।

মইন স্যার স্কুলে আসেন না। স্কুলের মেয়েদের খেলা বন্ধ। রুনা আর লুনা বিকেলবেলা স্কুল ছুটির পর গেল রাশেদাদের বাড়ি। রাশেদা তখন তাদের উঠানে শুকাতে দেওয়া ডালের বড়ি মাদুর থেকে তুলে একটা গামলায় রাখছিল। উঠানে মুরগি চরছে। দুটো বিড়াল অলসভাবে ঘুমুচ্ছে ঘরের ছায়ায়। রুনা আর লুনা বলল, রাশেদা, ও রাশেদা।

রাশেদা বলল, কী রে রুনা, লুনা। তোরা?

রুনা বলল, মনটা খারাপ। তাই আইলাম গল্পগুজব করতে।

লুনা বলল, আমাদের ফুটবল খেলা বন্ধ। কী করব? আয় আড্ডা মারি।

রাশেদা বলল, একটাই উপায় আছে মইন স্যারকে আবার মাঠে আনার।

রুনা বলল, কী উপায়?

লুনা বলল, উপায় আছে? কী?

রাশেদা বলল, বীণা আপারে ধরতে হইব। বীণা আপা যদি মইন স্যাররে একটা ফোন দেয়, তাইলেই আর কিছু লাগব না।

মইন স্যার তখন তাঁর ঘরের সামনে বাঁশের টঙে বসে রেডিওতে ভাটিয়ালি গান শুনছেন। ‘আমার মনে যত দুঃখ সয়, বন্ধুয়ারে করো তোমার মনে যাহা লয়...’

তাঁর মাথার ওপরে একটা আমগাছ। আমগাছ থেকে আমপাতা ঝরছে।

তিনি উদাসভাবে হলুদ হয়ে আসা একটা আমপাতা তুলে নিলেন। আমপাতা মুখে দিয়ে চিবাতে লাগলেন আনমনে।

এই সময় তাঁর মোবাইল ফোন বেজে উঠল। তিনি ফোনটা হাতে তুলে নিলেন। নাম উঠেছে বীণা।

কম্পিত বক্ষে ফোনটা তুলে নিলেন মইন স্যার।

হ্যালো!

স্যার, আমি বীণা।

আমি কি আর তা জানি না?

স্যার, আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।

আমার সঙ্গে কথা? আমি খাই পাতা।

কী বলছেন এসব?

না না। মেলানোর জন্য বললাম। কিছু না।

মেলানোর জন্য আপনাকে কথা বলতে হবে না। আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।

জি বলে ফেলেন।

আপনাকে সামনাসামনি বলতে চাই।

সামনাসামনি?

জি। আপনি কালকে নদীর ধারে পাকুড়গাছের নিচে আসবেন। বিকেল তিনটায়।

জায়গাটা ভালো না। ওই গাছে ভূত থাকে শুনছি।

ভূতের গাছের নিচেই আপনাকে আসতে হবে। আগামীকাল তিনটায়।

জি আচ্ছা আসব।

মইন স্যার নিজের বুকের ধুকপুকানি নিজেই শুনতে পাচ্ছেন। তিনি ফোন রাখলেন। এরপর থেকে তিনি উদাস। তাঁর বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে তিনি একা এই বাড়িতে থাকেন। তাঁর অন্য ভাইয়েরা সবাই ঢাকায় থাকেন। মা তাঁকে ভাত দিয়েছেন। মাদুরে বসে তিনি ভাত খাবেন। রাতের খাওয়া। তিনি প্রথমে থালায় পানি নিলেন। হাত ধুলেন। থালাটাও ধুলেন। তারপর চামচে ভাত তুলে পানিভর্তি প্লেটে নিলেন। তারপর খেতে শুরু করে বুঝলেন প্লেটের পানি ফেলা হয়নি।

পরদিন আড়াইটার মধ্যে তিনি পাকুড়গাছের নিচে পৌঁছে গেলেন। গিয়ে দেখেন কেউ নেই। জায়গাটা ফাঁকা। ঘন জঙ্গলও আছে। ওই ওপাশে একটা পরিত্যক্ত মন্দির আছে। তাঁর নিজের গা ছমছম করতে লাগল। ওই ওদিকে শস্যখেতে রোদ ঝাঁ ঝাঁ করছে। গরু চরছে। একঝাঁক বাদুড় লটকে আছে অশ্বত্থগাছটায়। তিনি বারবার মোবাইল ফোন দেখছেন, কখন তিনটা বাজবে।

তিনটা পাঁচ মিনিটে বীণা এলেন একটা রিকশাভ্যানে। রিকশাভ্যান দূরে দাঁড়িয়ে রইল। তিনি এলেন গাছের নিচে।

তাঁকে দেখতে লাগছে পরির মতো। তিনি আজকে একটা কমলা রঙের জামা পরেছেন।

বীণা বললেন, স্যার কি অনেকক্ষণ আগে এসেছেন?

জি। আড়াইটায়।

তিনটার গাড়ি আড়াইটায় এলে তো সব প্যাসেঞ্জার ট্রেন মিস করবে। আমি স্যরি। আমি ১০ মিনিট লেট।

কোনো অসুবিধা হয় নাই।

পাকুড়গাছের ভূত আপনাকে ধরে নাই?

না।

আপনার কি মনে হয়, আমি নিজে ভূত? আপনার কি মনে হয় আমি বীণা সেজে এসেছি? আসলে আমি বীণা না। আমি ভূত। আমি চাইলেই এখন হাতটা লম্বা করে ডালটা ধরে ঝাঁকুনি দিতে পারি।

জি না। মনে হয় না। মইন স্যার দরদর করে ঘামছেন।

দেখেন। ওই কাক ওড়।

কোত্থেকে যেন ঢিল পড়ল গাছের ডালে। একঝাঁক কাক উড়ে উঠল। বাদুড়গুলো ঝুলেই রইল অন্ধকার ডালে।

মইন স্যার বললেন, ভূত বলে কিছু নাই।

বীণা বললেন, এই আমার ভূতের ছায়েরা। তোরা হাততালি দে।

হাততালির আওয়াজ পাওয়া যেতে লাগল।

মইন স্যার বললেন, আমাকে ভয় দেখায়া কোনো লাভ নাই। আমি বডিবিল্ডার। ওয়েট লিফটিংয়ে চ্যাম্পিয়ন ছিলাম।

কী বলে, ভয় নাকি পায় না? এই ভূতের ছায়েরা, ঢিল দে।

ধুপধুপ করে ঢিল পড়তে লাগল।

মইন স্যার ঘেমেনেয়ে উঠেছেন। তিনি বললেন, আমি আজকে আসি কেমন?

অমনি চারদিক থেকে একদঙ্গল মেয়ে এসে তাকে ঘিরে ধরল। তার ফুটবলার মেয়েরা।

বীণা আপা বললেন, স্কুলে যান না। ছুটি নিয়েছেন এক মাসের। এই সব কি চ্যাম্পিয়ন আর সাহসী মানুষের মতো কাজ? আপনি কালকে সকালে মাঠে আসবেন। আমিও আসব। আমি ল্যাপটপে ফুটবল কোচিংয়ের ম্যানুয়াল নামিয়েছি। ঢাকায় ইন্টারনেট থেকে নামানো হয়েছে। আমার কাছে সেসব চলে এসেছে। আপনি এখন আমার সঙ্গে চলেন স্কুলে। আপনাকে কোচিং ম্যানুয়ালটা দেখিয়ে দিচ্ছি। আপনি দেখলেই বুঝবেন। চলেন।

মেয়েরা সবাই পিছে। সবার আগে বীণা আপা। তারপর মইন স্যার। তারা স্কুলে যাচ্ছে।

রোদ মরে এসেছে। স্কুলের মাঠের ঘাসগুলোকেও হলুদ দেখাচ্ছে।

সবাই মিলে অসময়ে ক্লাসে ঢুকল। বীণা আপা আগে থেকেই ল্যাপটপ এনে রেখেছেন। দীপা রানীও এসেছেন সেখানে। মেয়েরাও সবাই বসল বেঞ্চে।

বীণা আপা ল্যাপটপ খুলে দেখালেন ফুটবল কোচিং ওয়ান টু থ্রি। মেয়েরাও দেখল। মইন স্যারও দেখলেন।

তিনি বললেন, পারব। এইবার পারব। কাল সকাল ছয়টায় সবাই চলে আয়। আবার প্র্যাকটিস করব।

ল্যাপটপটার চার্জ শেষ হয়ে গেল। বীণা আপা বললেন, আমাদের বাসায় সৌরবিদ্যুতে আবার চার্জ দিব। কাল সকালে আবার দেখতে পাবেন।

এবার আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে কোচিং শুরু হলো সুন্দরপুর স্কুলে। ফুটবলের কোচিং।

এর মধ্যে দুইটা ছেলে এল স্কুলে। তারা বোধ হয় হাইস্কুলে ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়ে। তারা প্রথমে গেল দীপা রানীর কাছে।

আপা, আমার নাম নুরুল আলম।

আপা, আমার নাম মিল্টন খন্দকার।

আপা, আমরা আপনার কাছে মাফ চাইতে আইছি।

কিয়ের মাফ?

আমরা না বুইঝা ঢিল মারছিলাম। রাশেদার মাথায় লাগছিল। আমরা আপনার কাছে ক্ষমা চাই।

দীপা রানী বললেন, দুইটা কাগজে এই কথা দুইজনে আলাদা আলাদাভাবে লিখে দাও। মাফ চাহিয়া দরখাস্ত লিখো। তারপর মাফ।

দুইটা ছেলের জীবনে এর চেয়ে বড় কষ্টকর কাজ আর বোধ হয় আসে নাই। তারা বলল, আপা, টিক চিহ্ন থাকলে ভালো হইত। টিক চিহ্ন দিয়া পরীক্ষা দিয়া ক্লাস সেভেনে উঠছি।

কথা কম—দীপা রানী ধমক দিলেন।

ওদের দুটো কাগজ দেওয়া হলো। ওরা দরখাস্ত লিখল। বানান ভুল ছিল অনেক। দীপা রানী বললেন, এইটা থাকল প্রমাণ হিসেবে। আজকে ক্ষমা করলাম। তবে আরেকবার এই ধরনের মারাত্মক অপরাধের ক্ষমা নাই। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করে দিব। জামিন পাবা না।

ওরা দুজন বলল, আপা, একটু ধলু মাতুব্বরকে ফোন করতে হইব। ওনারে বলেন যে আপনি মাফ করছেন। নাইলে আমগো খবরই আছে।

দীপা রানী হেসে ফেললেন। বুঝতে পারলেন কোত্থেকে কেন কী হচ্ছে।

আবার খেলার মৌসুম চলে এল। বেগম ফজিলাতুন্নেছা কাপ। ডিসেম্বরের এক তারিখে খেলা। শীত পড়ে গেছে। পুরো গ্রাম কুয়াশার চাদরে ঢাকা। এর মধ্যে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বাচ্চারা আসছে মাঠে। প্রথমে খেলতে হবে উপজেলা পর্যায়ে। তারপর জেলা পর্যায়ে। কী হবে এবার?

রাশেদা বলল, এইবার আমরা ভালো করুমই দেখিস।

মারিয়া বলল, হ। এইবার কি আর আমরা সুন্দরপুরের টিম নাকি? আমরা অহন স্পেনের টিম। ল্যাপটপ দেইখা ট্রেনিং নিছি। আমগো মাঠে কত সাজসরঞ্জাম আসছে। আমরা একেরে...কী কমু...

রুনা আর লুনার আব্বাও বিদেশ থেকে নানা উপকরণ পাঠিয়েছেন।

তিনি মোবাইল ফোনে ভিডিওতে মেয়েদের প্র্যাকটিস দেখেছেন। তিনি বলেছেন, মায়েরা, তোমরা এবার পারবা।

রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে ঘুমাতে পারে না রাশেদা। কালকে তাদের খেলা। কাশেমপুর প্রাইমারি স্কুলের সঙ্গে। তারা পারবে তো?

বল আসছে। সামনে ফাঁকা বার। রাশেদা দৌড়াচ্ছে। কিন্তু সে দৌড়াতে পারছে না। তার পা আটকে গেছে। একটা ধঞ্চে গাছের সঙ্গে ফিতা পেঁচিয়ে গেছে। ফাঁকা পোস্টে গোল দিতে পারছে না সে। সবাই তার নাম ধরে চিৎকার করছে রাশেদা রাশেদা...

চলবে...

আরও পড়ুন