রোবটের দীর্ঘশ্বাস (দ্বিতীয় পর্ব)

অলংকরণ: সাদাত
দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে ভূমিধসের কারণ অনুসন্ধান করতে এসেছে জাফর-শারিতা দম্পতি। ভূমিকম্পের আগে সংকেত জানাবে, এমন সেন্সর বসাচ্ছে দুজন মিলে। ওদিকে হিমপাহাড়ের উত্তর প্রান্তঘেঁষা গ্রাম কিরিঞ্চায় তাদের বেসক্যাম্প। জাফর-শারিতাসহ গবেষণায় আসা বৈজ্ঞানিক দলটির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ইউসুফ আছে সেখানে। পৃথিবীর প্রথম সফল সাইবর্গ ইউসুফ পাশা। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের হয়ে কাজ করে এই বায়োনিকম্যান।

তিন

উনিশ নম্বর সেন্সরটির কাছে বসে আছে জাফর। কাছেই ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসে শারিতা। কোলের ওপর রাখা পোর্টেবল টেস্ট ইক্যুইপমেন্ট। সেন্সর থেকে আসা সংকেত ধরছে একটা যন্ত্র, সঙ্গে সঙ্গেই রিডিং দিচ্ছে ডায়ালে। ভুরু কুঁচকে ডায়ালের দিকে তাকিয়ে আছে সে। অবাক হয়ে গেছে।

আরও আধা মিনিট তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ডায়ালের দিকে তাকিয়ে থাকল শারিতা, তারপর পুরো সেটটার বিশেষ বিশেষ অংশ পরীক্ষা করে দেখল। নাহ্, যন্ত্রটা তো ঠিকই আছে। তাহলে?

স্বামীর দিকে মুখ তুলে তাকাল শারিতা, ‘ওয়্যারিংগুলো ঠিকমতো করেছিলে?’

সেন্সরের অ্যানটেনা আরও ওপরের দিকে তুলে দিতে ব্যস্ত জাফর। স্ত্রীর দিকে না তাকিয়েই পাল্টা প্রশ্ন করল সে, ‘কেন?’

‘ওয়্যারিংগুলো ঠিকঠাক করেছিলে কি না জানতে চাইছি।’

‘নিশ্চয়ই! কিন্তু কেন?’

‘সন্দেহ হচ্ছে আমার!’

যন্ত্রটার ওপর আবার ঝুঁকে পড়ল শারিতা। ডায়ালটা খুলে নিল দক্ষ হাতে। টেনেটুনে ওয়্যারিং দেখে নিয়ে শ্রাগ করল। ‘অদ্ভুত রিডিং দিচ্ছে ডায়াল,’ বলল শারিতা। ‘আশপাশে যেন কোথাও আগ্নেয়গহ্বর–জাতীয় কিছু আছে মনে হচ্ছে!’

‘কী বললে?’ ফিরে তাকাল জাফর। ‘এখানে আগ্নেয়গিরি আসবে কোত্থেকে? বাংলাদেশে কোনো কালেও আগ্নেয়গিরি ছিল না।’

‘সেটা তো আমিও জানি। কিন্তু রিডিংটা দিচ্ছে কী রকম দেখো না!’ হিমপাহাড়ের দিকে হাত তুলে দেখাল শারিতা, ‘ওদিকেই কোথাও আছে।’

পাহাড়টার দিকে তাকাল জাফর। মুখের ওপর খাড়া এসে পড়ছে রোদ। দুই হাত কপালের ওপর তুলে আড়াল করে রাখতে হচ্ছে। ‘যন্ত্রটায় কোনো দোষ নেই তো?’

মাথা নাড়ল শারিতা, ‘ভালোমতো দেখেছি আমি। কোনো গোলমাল নেই।’

‘স্ট্রেঞ্জ!’

‘এক কাজ করো। সেন্সরটার পজিশন জানিয়ে হিমপাহাড় বেসের টেস্ট ইক্যুইপমেন্টে রিডিং দেখতে বলো তো ইউসুফকে। শোনা যাক কী রিডিং পাচ্ছে ও।’

মাইক্রোফোনটা তুলে নিল শারিতা। রেডিওর সুইচ অন করল। ‘হ্যালো, শারিতা বলছি! শারিতা!’

কড়কড় করে উঠল রেডিও। ঝড় বওয়ার মতো শব্দ উঠল দু–একবার। কথা শোনা গেল এরপর, ‘হিমপাহাড় বেস। বলে যাও,’ ইউসুফের গলা।

‘ইউসুফ’, জিজ্ঞেস করল শারিতা, ‘উনিশ নম্বর সেন্সরের রিডিং পাচ্ছ?’

‘রিডিং টেপ হচ্ছে, কিন্তু আমি দেখছি না এখন। আশফাক খান আর আবু তাহেরের অপেক্ষায় আছি। ওরা এলেই এখান থেকে সরে যাব। বেস চেঞ্জ করব।’

‘অ্যানটেনার গোলমাল সেরেছে?’

‘এখন তো ঠিকই আছে।’

‘বেশ, বলল শারিতা, এক কাজ করো। রিডিং ডায়ালটা অন করো। উনিশ নম্বর থেকে পাঠাব। দেখো তো কোনো গন্ডগোল আছে কি না?’

সেন্সরের ট্রান্সমিটার সেকশনটা অন করল জাফর।

‘সংকেত যাচ্ছে?’ মাইক্রোফোনে বলল শারিতা।

‘হ্যাঁ,’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ডায়ালের দিকে তাকিয়ে আছে ইউসুফ। আবু তাহের আর আশফাক খান এসে দাঁড়িয়েছেন পেছনে, টের পেয়ে একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল, তারপর আবার মন দিল ডায়ালের দিকে। শারিতার ‘গন্ডগোল’ শব্দটা আগন্তুক দুজনের কানেও গেছে।

টেকনাফে জন্ম আবু তাহেরের। পার্বত্য চট্টগ্রামের এদিককার অঞ্চল তার ভালোমতো চেনা। ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানে অগাধ জ্ঞান। অথচ বয়স একেবারে কম, মাত্র পঁচিশ। সবদিক বিবেচনা করেই হিমপাহাড়ের বৈজ্ঞানিক অভিযানে সঙ্গে নেওয়া হয়েছে তাকে।

পঞ্চাশ কোটি টাকা দামের সাইবর্গকে আগলে রাখা এবং তার সত্যিকারের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করার দায়িত্বটা আশফাক খানের ওপরই দিয়েছে প্রতিষ্ঠান। সে জন্যই ইউসুফের সঙ্গে এসেছেন তিনি।

মিনিটখানেক গভীর মনোযোগে ডায়ালের রিডিং দেখল ইউসুফ। তারপর উঠে গিয়ে তাঁবু থেকে একটা ছোট টিভি–জাতীয় সেট নিয়ে এল। জেনারেটরের সঙ্গে কানেকশন দিয়ে চালু করে টিউনিং করতেই কতগুলো আঁকাবাঁকা রেখা ফুটে উঠল স্ক্রিনে।

ভুরু কুঁচকে গেল ইউসুফের। মাইক্রোফোনটা ঠোঁটের কাছে এনে বলল, ‘শারিতা-জাফর, মনে হচ্ছে কোনো আগ্নেয়গুহার কাছাকাছি আছো তোমরা!’

‘ইমপসিবল! তা কী করে সম্ভব!’ ফিসফিস করে বলল আবু তাহের। ‘বাংলাদেশে আগ্নেয়গিরি! কল্পনাই করা যায় না!’

‘জাফর-শারিতা, শুনতে পাচ্ছ তো তোমরা?’ জিজ্ঞেস করল ইউসুফ।

‘পাচ্ছি। এই গোলমালই অবাক করেছে আমাদের,’ জবাব দিল শারিতা। ‘ছেড়ো না। ধরে থাকো।’

‘একটু সরিয়ে বসানো দরকার, দেখা যাক সেন্সর কী রিডিং দেয়,’ বলল জাফর। এগিয়ে গিয়ে বসে পড়ল সে। কাজ শুরু করল। সেন্সরটা তুলে আনল। অ্যানটেনা আর প্রোব খুলে নিয়ে সার্কিট পরীক্ষা করায় মন দিল।

ডান হাতের তালুর ওপর থুতনি রেখে বসে বসে স্বামীর কাজ দেখছে শারিতা।

‘নাহ্, কোথাও কোনো গোলমাল নেই,’ মাথা দুলিয়ে আপন মনেই বলল জাফর।

‘দেখো তো সার্কিটের কোথাও ক্রস কানেকশন হয়ে গেছে কি না?’ সন্দেহ যাচ্ছে না শারিতার। ‘টিনের টুকরাটাকরা লেগে থাকতে পারে সার্কিট বোর্ডের পেছনে। বাড়তি তার বেরিয়ে থাকাও বিচিত্র নয়।’

‘বিচিত্র নয়’, স্বীকার করল জাফর। ‘কিন্তু তাতে সার্কিট অচল হতে পারে, জ্বলে যেতে পারে, কিন্তু গোটা এক আগ্নেয়গিরি আবিষ্কার করে ফেলতে পারে না।’

নড়েচড়ে বসল শারিতা। বাঁ হাতের তালু এনে ঠেকাল থুতনিতে। জানল না, ওদের কয়েক গজ দূরে ঘন বনের মধ্যে লুকিয়ে বসে চুপচাপ ওদের দিকে তাকিয়ে আছে বিশাল একটা প্রাণী। লম্বায় আট ফুটের কাছাকাছি। অনেকটা গরিলার মতো দেখতে। পায়ের পাতা, হাতের তালু আর মুখমণ্ডল ছাড়া বাকি শরীর লম্বা বাদামি রোমে ঢাকা। দুদিকে ছড়ালে এক হাতের মধ্যমা থেকে অন্য হাতের মধ্যমার দূরত্ব ফুট দশেক হবে। ইচ্ছা করলে দুই হাতে দুজন শক্তসমর্থ জোয়ান লোককে অনায়াসে তুলে নিতে পারে।

সেন্সরের সিলিকনের তৈরি সার্কিট পরীক্ষা করতে ব্যস্ত জাফর। বসে বসে তা–ই দেখছে শারিতা। পেছনের জঙ্গলের দিকে নজর নেই কারোরই। এই সুযোগে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল দানবটা। ভারী পায়ের তলায় শুকনা খুটোপাতা ভাঙার ক্ষীণ আওয়াজ উঠল। জঙ্গলে ছোটখাটো অনেক জন্তু-জানোয়ার আছে। এ ধরনের খুটখাট শব্দ প্রায় সর্বক্ষণই করে ওরা। বাদামের শক্ত খোসা কাটছে হয়তো কাঠবিড়ালি, কিংবা শুকনা ঘাসপাতা মাড়িয়ে ছোটাছুটি করছে গেছো ইঁদুর। তাই শব্দটা শুনে থাকলেও খুব একটা কেয়ার করল না স্বামী-স্ত্রী।

বড়জোর দুই কদম এগিয়েছে দানবটা, এমন সময় কথা বলে উঠল রেডিও। পরিষ্কার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে ইউসুফের। ধরে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে পড়েছে সে।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল দানবটা। রেডিওতে ভেসে আসা কথা শুনছে কান পেতে।

‘শারিতা-জাফর!’ বলল ইউসুফ, ‘কাজ কদ্দূর?’

পায়ের কাছে ফেলে রাখা মাইক্রোফোনটা তুলে নিল শারিতা। চোখ জাফরের হাতের সেন্সরের দিকে।

শারিতা জবাব দিল, ‘ইউসুফ, জাফর সার্কিটটা ভালোমতো পরীক্ষা করে দেখছে।’

‘সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেছে?’

‘এখন পর্যন্ত না। লাইনে থাকো। পেলে সঙ্গে সঙ্গে জানাব।’

‘ঠিক আছে,’ বলল ইউসুফ।

সবে টেবিলে মাইক্রোফোনটা নামিয়েছে ইউসুফ, গর্জন শোনা গেল রেডিওর স্পিকারে। আজব কোনো জানোয়ারের কুৎসিত ভয়ংকর চাপা গর্জন। পরক্ষণে নারীকণ্ঠের ভয়ার্ত চিৎকার। চেয়ারে পিঠ সোজা হয়ে গেছে ইউসুফের। নিমেষে সতর্ক হয়ে উঠেছে তার বায়োনিক ব্রেন।

টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন আশফাক খান আর আবু তাহের।

মাইক্রোফোনটা থাবা দিয়ে তুলে নিল ইউসুফ।

‘শারিতা! শারিতা!’ চিৎকার করে বলল সে। ‘কথা বলছ না কেন? কী হয়েছে?’

বারবার জাফর আর শারিতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করল ইউসুফ।

কিন্তু কোনো জবাবই পেল না আর।

চার

আশফাক খানের জিপ চালাচ্ছে ইউসুফ। পেছনে আসছে পিকআপ ও দুটি ট্রাক। ইউসুফের পাশে বসে পথনির্দেশ দিচ্ছে আবু তাহের। পাহাড়ের উত্তর ধার ঘেঁষে কাঁচা রাস্তা ধরে ঝাঁকি খেতে খেতে ছুটে চলেছে ক্যারাভানটা।

অপেক্ষাকৃত সরু আরেকটা কাঁচা রাস্তায় এসে পড়েছে প্রথম রাস্তাটা। ছোট-বড় পাথরে বোঝাই এই দ্বিতীয় রাস্তাটা উঠে গেছে পাহাড়ের ওপর দিকে। এটা ধরে মাইল দুয়েক এগোলেই পাওয়া যাবে জাফরদের ক্যাম্প।

পথ খুবই খারাপ। খাড়া তো বটেই, তার ওপর কাঁচা পাহাড়ি রাস্তা পাথরে বোঝাই। তার ওপর আবার ঝড়ে উপড়ে পড়া গাছ পড়ে আছে। গাড়ি নিয়ে এগোনো গেল না আর। বাধ্য হয়ে নেমে পড়তে হলো ওদের।

জিপ থামিয়ে নেমে পড়ল ইউসুফ। একে একে নেমে এলেন আশফাক খান আর আবু তাহের। পেছনে পিকআপ আর ট্রাক দুটিও থেমে পড়েছে।

জনা ছয়েক গার্ডকে সঙ্গে নেবেন ঠিক করলেন আশফাক খান। অন্যদের গাড়ি নিয়ে বেস ক্যাম্পে ফেরত যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।

উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে ইউসুফ। জাফর আর শারিতার জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ওদের সাহায্য দরকার বুঝতে পারছে, কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে ক্রমেই।

এদিককার পথঘাট ইউসুফের অচেনা। আবু তাহের চেনে। সে জন্যই সঙ্গে নেওয়া হয়েছে তাকে। তবে ওর সঙ্গে সাধারণ মানুষের গতিতে হেঁটে যেতে হলে এক-দেড় ঘণ্টার ধাক্কা। অথচ এটুকু পথ জিপের চেয়েও দ্রুত পাড়ি দিয়ে ফেলতে পারত ইউসুফ, পথটা যদি চেনা থাকত।

এগিয়ে চলল ওরা। সাধ্যমতো দ্রুত চলার চেষ্টা করছে আবু তাহের, সঙ্গে আশফাক খান আর গার্ডরা। কিন্তু ইউসুফের জন্য এটা শামুকের গতি। ক্রমেই বিরক্ত হয়ে পড়ছে সে।

প্রায় সোয়া ঘণ্টা পর জাফরদের ক্যাম্পের তাঁবুটা চোখে পড়ল। এখনো অন্তত ১০০ গজ দূরে আছে। আর থাকতে পারল না ইউসুফ। ছুটতে শুরু করল। বায়োনিক গতিবেগ। সামনের রাস্তায় ডালপালা ছড়িয়ে পড়ে থাকা একটা বিশাল গাছ স্বাছন্দ্যে লাফিয়ে পেরিয়ে গেল। দেখে হাঁ হয়ে গেল আবু তাহের। সে জানে না, ইউসুফ বায়োনিক ম্যান।

‘খাইছে!’ দাঁড়িয়ে গেল আবু তাহের। আশফাক খানের দিকে তাকাল। ‘লোকটা মানুষ নাকি! অত জোরে ছোটে! অত বড় একটা গাছ লাফিয়ে পেরিয়ে গেল! ঘটনাটা কী?’

‘সে অনেক কথা। পরে বলব,’ এড়িয়ে গেলেন আশফাক খান। তা ছাড়া এখন অত কথা বলার সময় বা ধৈর্য কোনোটাই নেই। ‘এ তো কিছুই না। আরও অনেক আজব কাণ্ড করবে সে, দেখো। এখন চলো, যাই।’

যেকোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার জন্য তৈরি হয়েই ক্যাম্পের সামনে এসে দাঁড়াল ইউসুফ। কিন্তু তেমন কোনো বাধা এল না। জাফরদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, যন্ত্রপাতি জায়গামতোই পড়ে আছে। শুধু মানুষ দুজন অনুপস্থিত। যেন কয়েক মিনিট আগেই কোথাও গেল, আবার ফিরে আসবে। বায়োনিক চোখটা ব্যবহার করল ইউসুফ। কাছেপিঠে কোথাও কিছু নেই। দিগন্তের দিকে তাকাল। কিছু থাকলে দুরবিন দিয়ে দেখার মতোই পরিষ্কার দেখতে পাবে সে বহুদূর থেকেও। কিন্তু নাহ্! কিচ্ছু নেই। কয়েকবার জোরে জাফর আর শারিতার নাম ধরে ডাকল সে। বায়োনিক মাইক্রোফোনে জোর আওয়াজ উঠল। কিন্তু সাড়া দিল না কেউ।

পৌঁছে গেল আবু তাহের, আশফাক খান আর গার্ডরা। প্রায় দুই মাইল বিচ্ছিরি পথ হেঁটে এসে দরদর করে ঘামছে সবাই। হাঁপাচ্ছে।

জাফর আর শারিতার আশ্চর্য ব্যবহারের চেয়ে ইউসুফের কাণ্ডকারখানা কম আজব ঠেকছে না আবু তাহেরের কাছে। সোজা ইউসুফের কাছে এসে দাঁড়াল সে। ‘এই যে সাহেব, অত জোরে ছুটলেন কী করে আপনি? হেঁটে তো নয়, যেন উড়ে এসেছেন। ঘোড়ার মাংসপেশি লাগিয়েছেন নাকি পায়ে?’

‘আয়ুতেবাহারমহারিষ্ট সিরাপ। কবিরাজি এক সাংঘাতিক ওষুধ। এক বোতল সতেরো শ পঞ্চাশ টাকা। খেয়ে দেখুন, আপনিও অমন ছুটতে পারবেন।’ আশফাক খানের মতোই প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল ইউসুফ। তার আসল পরিচয় যত কম লোকে জানে, ততই ভালো। বায়োনিক ম্যান হলেও একজন সিক্রেট এজেন্টের কাজ করতে হয় তাকে।

কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন আশফাক খানও। জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইউসুফ, ওদের কোনো সাড়া পেলে? কী হলো, বুঝছ কিছু?’

‘নাহ্!’ এদিক–ওদিক মাথা দোলাল ইউসুফ। ‘অত চেঁচালাম, কোনো সাড়া নেই! কোথায় গেল, তা-ও বুঝতে পারছি না!’

‘হুঁ!’ কী যেন ভাবলেন আশফাক খান। তারপর আবু তাহেরের দিকে ফিরে বললেন, ‘তাহের, এদিককার পথঘাট জঙ্গল তো তোমার চেনা। গার্ডদের নিয়ে খুঁজে দেখো তো একটু ভালো করে, প্লিজ!’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাচ্ছি আমি,’ ঘাড় নেড়ে চলে গেল আবু তাহের।

ফিরে তাকালেন আশফাক খান। ততক্ষণে জাফর আর শারিতার পড়ে থাকা জিনিসপত্রের দিকে নজর দিয়েছে ইউসুফ। এগিয়ে গেলেন তিনি।

‘কোনো রকম ধস্তাধস্তির চিহ্ন তো দেখছি না,’ বললেন আশফাক খান।

শারিতার ব্যাগটা তুলে নিল ইউসুফ। চেন খোলাই আছে। ফাঁক করে ভেতরে উঁকি দিল সে। একে একে সমস্ত জিনিস বের করল ভেতর থেকে। ‘দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিচ্ছু খোয়া যায়নি।’

ব্যাগটা নামিয়ে রেখে আশপাশটা দেখায় মন দিল ইউসুফ। পনেরো সেকেন্ডের মধ্যেই আবিষ্কার করল রেডিওটা। হাত তুলে আশফাক খানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘রেডিও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণ এটাই।’

এগিয়ে গিয়ে দুজনেই ঝুঁকে বসল দুমড়ানো রেডিওটার কাছে।

‘কাজটা কার? তোমার মতো আরও কেউ আছে নাকি?’

অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে ইউসুফের দিকে তাকালেন আশফাক খান।

‘বড় হ্যামার দিয়ে পিটিয়ে এ রকম ভর্তা করা যেতে পারে,’ ইউসুফ বলল। ‘কিন্তু আশপাশে কোথাও তো দেখছি না জিনিসটা!’

‘কিংবা পা দিয়ে মাড়িয়েছে। তোমার মতো বায়োনিক পা।’

উঠে দাঁড়ালেন আশফাক খান। আশপাশের মাটিতে নজর বোলাতে লাগলেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গর্তটা আবিষ্কার করলেন। এটাতেই সেন্সর বসিয়েছিল জাফররা।

‘শুধু হ্যামারটাই নয়, আরও একটা জিনিস নেই,’ বললেন আশফাক খান।

‘কী?’ ফিরে তাকাল ইউসুফ।

‘সেন্সর। কোথায় ওটা?’

উঠে এসে গর্তটার কাছে বসল ইউসুফ। ‘ঠিকই বলেছেন। অন্যান্য টেস্ট ইক্যুইপমেন্ট পড়ে আছে দেখছি, কিন্তু সেন্সরটা...’

‘সেন্সরটা খুঁজে পেতেই হবে,’ জোর গলায় বললেন আশফাক খান।

‘এবং আমার দুই বন্ধুকেও। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছি না, এভাবে কোথায় গায়েব হয়ে গেল ওরা!’

‘কিডন্যাপ হতে পারে!’

‘তা পারে!’

‘সেন্সরটাও গায়েব। কেন?’

‘বুঝলাম না। জিনিসটা কারও দরকার হলে চুরি করে নিয়ে গেলেই হতো। দুজন মানুষকে কিডন্যাপ করল কেন?’

‘সেটাই তো ভাবছি!’

আবু তাহেরের চিৎকার শোনা গেল, ‘ইউসুফ সাহেব! মিস্টার খান!’

শাঁই করে ঘুরে দাঁড়ালেন আশফাক খান। বসা অবস্থায়ই চরকির মতো ঘুরল ইউসুফ। আবু তাহেরকে দেখা যাচ্ছে না।

‘তাহের, কোথায় তুমি?’ চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল ইউসুফ।

‘এই যে এখানে,’ পুবের জঙ্গল থেকে ভেসে এল আবু তাহেরের কণ্ঠ।

বাঁ চোখের ইনফ্রারেড সিস্টেম চালু করে দিল ইউসুফ। শব্দের উৎস বরাবর তাকাতেই জঙ্গলের মধ্যে বসা আবু তাহেরকে দেখতে পেল। মাটির দিকে তাকিয়ে কী দেখছে।

উঠে পড়ল ইউসুফ। আশফাক খানকে নিয়ে জঙ্গলের দিকে চলল।

‘কী হলো?’ আবু তাহেরের কাছে পৌঁছে জিজ্ঞেস করলেন আশফাক খান, ‘ওদের পেয়েছ নাকি?’

‘না,’ জবাব দিল আবু তাহের, ‘কিন্তু আরেকটা জিনিস পেয়েছি।’ হাত তুলে মাটির দিকে দেখাল সে। নরম মাটিতে বসে গেছে পায়ের ছাপটা। বিশাল। লম্বায় আঠারো ইঞ্চি, চওড়ায় ছয়।

‘কোনো জানোয়ারের?’ জিজ্ঞেস করলেন আশফাক খান।

‘ভালুক নাকি?’ ইউসুফ জানতে চাইল।

মাথা নেড়ে দুজনের প্রশ্নের জবাব দিল আবু তাহের। ‘উঁহু। এদিকে ভালুকটালুক নেই কিছু। আর এত বড় ভালুক থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমেরিকার সাসকোয়াচ কিংবা হিমালয়ের ইয়েতি হলে মানিয়ে যেত। কিন্তু ওগুলোও কল্পিত। বাস্তবে নেই।’

‘তাহলে কিসের পায়ের ছাপ?’ আশফাক খানের প্রশ্ন।

‘ছোটবেলায় দাদুর কাছে গল্প শুনতাম হিমপাহাড়ে রাক্ষস থাকে। মানুষের মতো দুই পায়ে হাঁটে। সারা গায়ে বড় বড় রোম। মানুষ খায়। সে জন্য কোনো দিন এই পাহাড়ের ধারেকাছে আসতাম না আমরা। কাঠুরেরাও একা গাছ কাটতে আসার সাহস পেত না।’

রূপকথা, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু চোখের সামনে অত বড় ছাপটাকে দেখে অবিশ্বাস করেন কী করে? ভুরু কুঁচকে চিন্তিত ভঙ্গিতে ছাপটার দিকে তাকালেন আবার আশফাক খান। জবাব দিতে পারলেন না। তারপর হঠাৎ যেন চমক ভাঙল। মুখ তুলে গার্ডদের হুকুম দিলেন, ‘ছড়িয়ে পড়ো সবাই। এদিকের জঙ্গলটাকে ঘিরে ফেলো।’ বিশাল পদচিহ্নটার দিকে তাকালেন তিনি আবার। বারবার চোখ যাচ্ছে ওটার দিকে। ‘সন্দেহজনক কিছু দেখলেই হুইসেল বাজাবে।’

কে কোন দিকে যাবে, নির্দেশ দিতে শুরু করলেন আবু তাহের।

ইউসুফের দিকে তাকালেন আশফাক খান।

হিমপাহাড়ের দিকে ইঙ্গিত করে ইউসুফ বলল, ‘আমি ওদিকে যাচ্ছি।’

ভুরু কুঁচকালেন আশফাক খান, ‘চূড়ায় উঠে দেখতে চাও?’

‘না,’ মাথা নাড়ল ইউসুফ। ‘একটা আগ্নেয়গুহা আছে সিগন্যাল দিয়েছে জাফর আর শারিতার সেন্সর। পার্বত্য চট্টগ্রামে কখনো কোনো কালে আগ্নেয়গিরি ছিল বলে শোনা যায়নি। তার মানে ওই সিগন্যাল খুবই রহস্যময়। জবাবটা জানা দরকার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, রহস্যময় এই পায়ের ছাপের মালিকও ওদিকেই কোথাও আছে।’

‘ইনফ্রারেডে কিছু দেখতে পেয়েছ?’

‘না।’ হিমপাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বলল ইউসুফ, ‘গুহাটা যদি থেকে থাকে, খুঁজে বের করব ওটা। নিজের চোখে দেখতে চাই আমি কী ঘটছে ওখানে। কিছু একটা আছেই ওখানে, আমি শিওর। টেলিমেট্রি অ্যানালাইসিস কম্পিউটার ভুল করতে পারে না।’

‘নষ্ট তো হয়ে যেতে পারে।’

‘হয়নি। তাহলে রিডিংই দিত না।’

‘বেশ, যাও,’ বললেন আশফাক খান। ‘কিন্তু নিজের দিকে খেয়াল রেখো।’

‘এখন আর সাধারণ মানুষ নই আমি, অতএব...’

‘অসাধারণ শত্রু তো থাকতে পারে।’

হাসল ইউসুফ। ‘ভাববেন না। হারাতে হবে না আমাকে। আমার ৫০ কোটি টাকা দামের দেহটাকে অত সহজে নষ্ট হতে দিচ্ছি না।’

হিমপাহাড়ের দিকে রওনা হলো ইউসুফ। বায়োনিক গতিতে ছুটল। রাস্তা ভালো হলে ঘণ্টায় ষাট মাইল বেগে ছুটতে পারে সে। কিন্তু এখানে রাস্তা খারাপ, ঘন জঙ্গলে ছাওয়া। প্রাণপণ চেষ্টায় গতিবেগ পনেরো থেকে বিশের মধ্যে রাখতে পারল।

যতই ওপরে উঠছে পাতলা হয়ে আসছে গাছপালা। জাফররা যেখানে ক্যাম্প করেছিল, তার কয়েক হাজার ফুট ওপরে উঠে একটু থামল ইউসুফ। সামনে রাস্তা মোটামুটি ভালো। বনজঙ্গল তেমন নেই। যদিও খাড়া, কিন্তু বেশি একেঁবেঁকে না গিয়ে সোজাসুজি উঠেছে পথ। যদ্দূর মনে হয়, হরিণ, বুনো শুয়োর আর অন্যান্য বন্য প্রাণী নিয়মিত যাতায়াত করে এ পথে।

মাথার ওপরে এক জায়গায় শেষ হয়ে গেছে বনের সীমানা। পাহাড়ের চূড়াটা স্পষ্ট চোখে পড়ছে।

বনের প্রান্তসীমার কাছাকাছি এসে আবার থামল ইউসুফ। এদিক–ওদিক তাকিয়ে একটা বড় গাছ পছন্দ করল। গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়াল। ওপর দিকে তাকাল। গোড়া থেকে প্রায় ২০ ফুট ওপরে মোটাসোটা একটা ডাল। ভার সইতে পারবে।

লাফ দিল ইউসুফ। শাঁ করে উঠে গেল শূন্যে। নিঃশব্দে এসে নামল ডালটায়। উড়ে এসে বাজপাখি যেমন করে নামে। যেন ওজন নেই তার, হালকা তুলো। ডালটা একটু কাঁপল না পর্যন্ত। মাথার ওপরের একটা সরু ডাল ধরে দাঁড়াল সে। সামনের ঝোপঝাড়ে ছাওয়া জমির দিকে তাকাল। তার সাধারণ চোখে কিছুই দেখল না। কিন্তু ফাঁকিতে পড়ল না বায়োনিক চোখটা। ঠিকই দেখতে পেল জিনিসটা। ৫০ থেকে ৬০ গজ দূরে একটা কাঁটালতায় লেগে ছিঁড়ে আটকে আছে কাপড়ের ছোট্ট একটা টুকরো।

হাওয়ায় ভেসে আবার নিচে নেমে এল ইউসুফ। দৌড়াতে দৌড়াতে কাপড়ের টুকরোটার কাছে এসে থামল। হাত বাড়িয়ে ছাড়িয়ে নিল কাঁটায় আটকানো কাপড়ের ছেঁড়া টুকরোটা। একনজর দেখেই চিনল। জাফরের শার্ট থেকে ছিঁড়েছে। টুকরোটা পকেটে রেখে দিল সে।

তার অনুমান ঠিক। এদিকেই নিয়ে আসা হয়েছে জাফর আর শারিতাকে। আগ্নেয়গুহা থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না, কারণ আগ্নেয়গিরিই নেই, তবে এদিকে অস্বাভাবিক কিছু একটা যে আছে, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। নইলে রিডিং দিত না সেন্সর।

পাহাড়ের আরও ওপরে উঠে চলল সে।

ওপর থেকে যে তার ওপর নজর রাখা হচ্ছে টের পেল না ইউসুফ। বিশাল টিভির পর্দায় তার গতিবিধি ফুটে উঠেছে। হিমপাহাড়ের চূড়ার সামান্য নিচে পাহাড় খুঁড়ে কৃত্রিম গহ্বর সৃষ্টি করে তাতে তৈরি করা হয়েছে অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার। এই গবেষণাগারেরই একটা কক্ষে বসে টিভির পর্দায় তাকে দেখছে দুজন পুরুষ আর এক তরুণী। তরুণীর নাম টোরা। পুরুষদের একজনের নাম হিগ। আরেকজন রাটিন। টেলিভিশনের পর্দাটা তিন বাই পাঁচ ফুট। কোণগুলো সমকোণ। সারা ঘর বিচিত্র সব যন্ত্রপাতিতে ঠাসা।

আজব ধরনের পোশাক মানুষগুলোর পরনে। পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে চেহারারও কিছু কিছু অমিল আছে।

অবাক হয়ে ইউসুফকে দেখছে তিনজনই। আর দশজন সাধারণ মানুষ যে সে নয়, বুঝে ফেলেছে ওরা।

‘আশ্চর্য!’ দীর্ঘক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকার পর নীরবতা ভাঙল হিগ। ‘লোকটার গতি দেখেছ!’

‘অস্বাভাবিক, সত্যি!’ রাটিন বলল।

‘অবিশ্বাস্য!’ বলল টোরা। ‘এমনকি আমাদের কাছেও।’

‘নাহ্, ওকে পরীক্ষা করে দেখতে হচ্ছে,’ বলল হিগ।

উঠে পর্দার আরও কাছে এসে দাঁড়াল টোরা। তীক্ষ্ণ চোখে ইউসুফের গতিবিধি লক্ষ করছে। সাংঘাতিক খাড়াই বেয়ে তীব্র গতিতে ধেয়ে আসছে ইউসুফ। বিন্দুমাত্র পা হড়কাচ্ছে না। অজানা পথে চলছে, সামান্যতম দ্বিধা নেই।

‘ঠিকই বলেছ,’ টোরা বলল। কণ্ঠস্বরে তীব্র কৌতূহল। ‘গুড আইডিয়া! ওকে পরীক্ষা করে দেখা উচিত।’

‘নিশ্চয় নিজের সঙ্গীদের খুঁজতে এসেছে লোকটা। সেন্সরটাও ফেরত চায় হয়তো। জানতে চায় সঙ্গীরা এবং সেন্সর গায়েব হওয়ার পেছনে কারণটা কী।’ টিভির পর্দার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল হিগ। ‘টোপ দেওয়া যাক।’

‘ভিটু?’ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে হিগের দিকে তাকাল রাটিন।

‘ভিটুকে টোপ বানিয়ে লাভ হবে বলে মনে না।’

‘তাহলে?’ জানতে চাইল টোরা।

দীর্ঘ এক মুহূর্ত ভাবল হিগ। তারপর ডান হাত তুলে দুই আঙুলে চুটকি বাজাল। ‘ডক্টর জাফর আবদুল্লাহকে ফেরত পাঠাব। কিন্তু মেয়েটাকে রেখে দেব। কী বলো?’

‘চমৎকার প্রস্তাব!’ সমস্বরে বলে উঠল অন্য দুজন।

বনের একেবারে প্রান্তে পৌঁছে গেছে ইউসুফ। গাছপালা শেষ। এরপর থেকে শুরু হয়েছে ঘাসে ঢাকা জমি।

চোখ তুলে জমির ওপারে ঝোপঝাড়গুলোর দিকে তাকাল ইউসুফ। ওই জায়গাটাই সন্দেহজনক মনে হলো তার কাছে। বায়োনিক চোখের সাহায্যে চারদিকটা একবার পরীক্ষা করে দেখল সে। তারপর পা বাড়াল।

আধা মাইল পরেই জায়গাটা পেয়ে গেল সে। প্রথম দৃষ্টিতে আর দশটা সাধারণ ঝোপের মতোই মনে হলো। সাধারণ মানুষের চোখ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু ইউসুফের বায়োনিক চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না।

থমকে থেমে দাঁড়াল ইউসুফ। উবু হয়ে বসল। ছোট ছোট কয়েকটা ভাঙা ডাল সন্দেহ জাগিয়েছে তার।

বিশাল ঝোপটার ভেতরে বায়োনিক চোখের দৃষ্টি ফেলল ইউসুফ। মাতালের মতো টলতে দেখল জাফরকে। ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল জাফর। বনের দিকে এগোল।

‘জাফর!’ ঝোপঝাড় ভেঙে ছুটল ইউসুফ।

চিৎকার শুনে ফিরে তাকাল জাফর। চোখে অদ্ভুত শূন্য দৃষ্টি।

‘জাফর!’ ওর দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিল ইউসুফ। ‘কী হয়েছে তোমার? ভালো আছো?’

বার দুই জোরে জোরে মাথা ঝাড়ল জাফর। মগজটা সাফ করে নিতে চাইছে যেন।

‘কে?...ও ইউসুফ! এখানে কী করে এলে?’

‘তোমাদের খুঁজতে এসেছি। আশফাক খান, আবু তাহের আর গার্ডরাও এসেছে। নিচে আছে ওরা।’

মাটিতে পড়ে আছে একটা গাছের মরা গুঁড়ি। ঝড়ে উপড়ে পড়েছিল। ধপ করে ওটাতে বসে পড়ল জাফর। বোকা বোকা চোখে তাকাল ইউসুফের দিকে। ঘোরের মধ্যে যেন জিজ্ঞেস করল, ‘আমাদের খুঁজছ?’

স্তব্ধ হয়ে গেল ইউসুফ। এমন ভঙ্গিতে কথা বলছে কেন লোকটা?

চারপাশে তাকাল জাফর। ‘শারিতা কোথায়?’

‘এ প্রশ্ন তো আমারও!’ ইউসুফ বলল। জাফরের মতোই চারদিকে তাকাতে লাগল সে। পুরো ক্ষমতা ব্যবহার করছে বায়োনিক চোখের। উত্তরে বায়োনিক দুরবিনের ক্ষমতাসীমারও ওপারে একটা অস্বাভাবিক নড়াচড়া দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার। কিন্তু ভালোমতো দেখা না যাওয়ায় বুঝতে পারল না কিসের নড়াচড়া। ইনফ্রারেড ম্যাগনিফিকেশন পুরো ব্যবহার করল সে। হ্যাঁ, কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে এবার। মানুষের মতোই দুই পেয়ে একটা জীব, কিন্তু আরও বড়। মানুষের চেয়ে অনেক অনেক দ্রুত দৌড়াচ্ছে। আবু তাহেরের দাদুর গল্পের রাক্ষসের কথা মনে পড়ল ইউসুফের।

‘এখানেই থাকো,’ বলেই ছুটল সে। জঙ্গলের আরও গভীরে ক্রমে ঢুকে যাচ্ছে জীবটা। পিছু নিল সে।

‘ইউসুফ!’ টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল জাফর। ইউসুফকে অনুসরণ করার চেষ্টা করতে করতে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘শারিতা কোথায়, শারিতা...?’

মাথা ঘুরে উঠল তার। চোখে অন্ধকার দেখছে। কিছু একটা অবলম্বনের জন্য হাত বাড়াল। কিন্তু শুধুই বাতাস ঠেকল হাতে। কাটা কলাগাছের মতো দড়াম করে মাটিতে আছড়ে পড়ল সে। অজ্ঞান হয়ে গেল।

চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরে গেল ইউসুফ। ঝড়ের গতিতে ছুটে এল। উপুড় হয়ে পড়ে আছে জাফর। ধরে তাকে চিত করে শোয়াল। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল জঙ্গলের দিকে। কিন্তু জীবটার ছায়াও দেখা যাচ্ছে না আর।

রাক্ষসের চিন্তা বাদ দিল আপাতত ইউসুফ। ঝুঁকে বসে জাফরের একটা হাত তুলে নিল নিজের হাতে। নাড়ি দেখল। গতি কম, কিন্তু দুর্বল নয়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জাফরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। অস্বাভাবিক কিছু আবিষ্কারের চেষ্টা করছে। নেই। আস্তে করে হাতটা নামিয়ে রেখে প্যান্টের ডান পা-টা ঊরু পর্যন্ত গুটিয়ে নিল।

একটা গোপন কুঠুরি বসানো আছে ডান ঊরুতে। টুল বক্স আছে ওতে। খুদে একটা অক্সিজেন ট্যাংক আছে বাক্সটায়। আর আছে শ্বাস ফেলার নলযুক্ত একটা মাস্ক। একটা প্রচণ্ড শক্তিশালী খুদে ট্রানসিভারও আছে। যন্ত্রটা এতই শক্তিশালী, পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় খবর আদান–প্রদান করা যাবে এর সাহায্যে। মাঝেমধ্যে বিশেষ অ্যাসাইনমেন্টে গেলে এই চেম্বারে একটা পিস্তলও নিয়ে নেয় ইউসুফ।

টুলস রাখার চেম্বারের ওপরের প্লাস্টিকের আবরণ সরাল সে। ভেতরে কয়েকটা খুদে সুইচ। একটা সুইচ টিপতেই একটা প্লাস্টিকের দরজা সরে গেল। ভেতর থেকে টুলবক্স বের করে ট্রানসিভারটা বের করে নিল। একটা বিশেষ সুইচ টিপতেই আশফাক খানের কাছে রাখা রিসিভারে সংকেত পাঠাতে শুরু করল ট্রানসিভার। কয়েক সেকেন্ড পরেই উত্তর এল।

কথা বললেন আশফাক খান। ‘বলো, ইউসুফ!’

‘হিমপাহাড়ের পশ্চিম ঢালে আছি আমি, বনরেখা বরাবর। জাফরকে পেয়েছি। অজ্ঞান হয়ে গেছে সে।’

‘শারিতাকে পাওনি? সেন্সরটা?’

‘না।’

‘জাফরকে জঙ্গল থেকে বের করে আনতে পারবে?’

‘পারব। মাইল দুই ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বয়ে আনতে সময় একটু বেশি লাগবে আরকি।’

‘ঠিক আছে। জাফর আর শারিতার কী হয়েছে বুঝতে পেরেছ কিছু?’

‘না। জাফর কিচ্ছু বলতে পারছে না। নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো আচরণ করছে।’

‘হুঁ। ডাক্তার সাহেব দেখলেই বুঝতে পারবেন।’

‘আরেকটা কথা। শুনলে চমকে যাবেন। আবু তাহেরকে বলুন, তার পূর্বপুরুষেরা মিথ্যে বলেনি।’

‘মানে?’

‘বিশালদেহী রাক্ষসটা আমার আশপাশেই কোথাও আছে,’ বলল ইউসুফ।

‘মানে?’ আবার একই প্রশ্ন করলেন আশফাক খান।

‘দেখেই বুঝেছি, অতি ভয়ংকর ওই দানব!’

(চলবে...)

আরও পড়ুন