টুনিদের স্কুলের সবচেয়ে ভয়ংকর ম্যাডামের নাম মারদানা ম্যাডাম। মহিলাদের গোঁফ থাকার কথা না কিন্তু টুনিদের স্কুলে বলাবলি করা হয় যে মারদানা ম্যাডামের গোঁফ আছে। কথাটা শুনে অনেকেই ভুরু কোঁচকাতে পারে, একজন মানুষের গোঁফ আছে কি নেই সেটা নিয়ে বলাবলি করার কী আছে? তার মুখের দিকে তাকালেই তো সেটা দেখা যাবে। কিন্তু আসলে তার মুখের দিকে তাকালে সেটা বোঝা যায় না, তার কারণ মারদানা ম্যাডামের গায়ের রং কুচকুচে কালো এবং তার গোঁফ যদি আসলেই থেকে থাকে সেটার রংও কুচকুচে কালো। তাই সেটা আলাদা করে দেখা যায় না। খুব কাছে গেলে অবশ্যই সেটা দেখা যাবে, কিন্তু কার ঘাড়ে দুইটা মাথা আছে যে মারদানা ম্যাডামের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করবে তার গোঁফ আছে কি নেই! যেসব ছেলেমেয়েকে মারদানা ম্যাডাম কাঁচা চিবিয়ে খেয়েছেন (ঠিক আক্ষরিক অর্থে নয়, ভয়ংকর শাস্তি দেওয়ার অর্থে) তারা সবাই একবাক্যে সাক্ষী দিয়েছে মারদানা ম্যাডামের নাকের নিচে ঝাঁটার মতো কালো গোঁফ। তারা আরও বলেছে যে তার চোখের মাঝে মোটা হয়ে থাকা লাল লাল রক্তনালি সেগুলো নাকি দপদপ করে কাঁপে এবং তার মুখে নাকি মাংসাশী প্রাণীর মতো গন্ধ। যা-ই হোক, এর সবগুলো পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব নয়, কাজেই কেউ কখনো এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করার চেষ্টা করেনি। টুনিদের ক্লাস-মনিটর বলেছে, মানুষ যখন বুড়ো হয় তখন নাকি সবার আগে গোঁফ পাকতে শুরু করে। কাজেই যদি সত্যি সত্যি মারদানা ম্যাডামের গোঁফ থেকে থাকে তাহলে আর কয়েক বছরের ভেতর সেগুলো পেকে সাদা হয়ে যাবে, তখন তাঁর কুচকুচে কালো রঙের মাঝে সাদা গোঁফ খুব স্পষ্টভাবে দেখা যাবে। তখন সব বিতর্ক বন্ধ হয়ে যাবে।
এই যে ভয়ংকর মারদানা ম্যাডাম তার থেকেও ভয়ংকর স্যার হচ্ছেন মতিউর স্যার। এই স্যারকে নিয়েও স্কুলে নানা রকম গুজব চালু আছে। যেটা সবচেয়ে বেশি চালু সেটা হচ্ছে উনিশ শ একাত্তর সালে মতিউর স্যার রাজাকার কমান্ডার ছিলেন, দেশ স্বাধীন হলে গ্রামের মানুষেরা ধরে তাঁর কান কেটে দিয়েছে। মতিউর স্যারের ডান কানটা নাকি রাবারের তৈরি, প্রতিদিন সকালে স্কুলে আসার সময় সুপার গ্লু দিয়ে কানটা নাকি লাগিয়ে নেন। বিষয়টা পরীক্ষা করা খুব সোজা, ডান কানটা ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিতে হবে কিন্তু সেটা কে করবে? তবে শোনা যায় পাস করে বের হয়ে গেছে এ রকম একজন ছাত্রী নাকি কিরা কেটে বলেছে, মতিউর স্যার একবার খুব জোরে হাঁচি দিয়েছিলেন, তখন নাকি তাঁর ডান কানটা খুলে এসেছিল, সে সেটা নিজের চোখে দেখেছিল। সত্যি সত্যি সেটা কেউ বলেছে, সেটা অবশ্য কখনোই প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। মতিউর স্যারের অনেকগুলো বেত আছে। একটা শিলং থেকে আনা হয়েছে, একটা বান্দরবানের, আরেকটা নেত্রকোনার। সরকার থেকে বেত মারা নিষেধ করে দেওয়ার পর মতিউর স্যারের মনের দুঃখে প্রায় হার্ট অ্যাটাকের মতো অবস্থা হয়েছিল। মতিউর স্যার এখনো মাঝেমধ্যে ক্লাসে বেতগুলো নিয়ে আসেন, বাতাসে শপাং শপাং করে মারেন আর ছাত্রছাত্রীদের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। যেহেতু বেত মারতে পারেন না, তাই গালিগালাজ করে মনের ঝাল মেটান। তাঁর গালির মতো বিষাক্ত গালি পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। যাকে একবার স্যার গালি দেন, কমপক্ষে এক মাস তার মন-মেজাজ খারাপ থাকে।
এই যে ভয়ংকর মতিউর স্যার তার থেকেও ভয়ংকর হচ্ছেন নার্গিস ম্যাডাম! কথাটা শুনে কেউ মনে করতে পারে নার্গিস ম্যাডাম বুঝি দেখতে মারদানা ম্যাডাম আর মতিউর স্যার থেকেও ভয়ংকর। কিন্তু আসলে সেটা সত্যি নয়, নার্গিস ম্যাডাম দেখতে অসাধারণ। দূর থেকে তাঁকে দেখলে মনে হয় সিনেমার নায়িকা, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, চুলগুলো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে রাখা, সেখানে বেলি ফুলের মালা, পরনে আকাশি-নীল তাঁতের শাড়ি। কথাবার্তা শুনলে মনে হয় ইন্ডিয়ান বাংলা সিরিয়ালের নায়িকা কথা বলছে। কিন্তু যারা তাঁকে চেনে তারা সবাই জানে নার্গিস ম্যাডাম হচ্ছেন ভয়ংকর থেকেও ভয়ংকর। শুধু চোখের দৃষ্টি দিয়ে নার্গিস ম্যাডাম যেকোনো ছাত্র কিংবা ছাত্রীর শরীরের সব রক্ত শুষে নিতে পারেন। একবার নাকি ক্লাস নাইনের একজন ছাত্রীর দিকে নার্গিস ম্যাডাম তিরিশ সেকেন্ড কোনো কথা না বলে তাকিয়ে ছিলেন, সেই ছাত্রী বাসায় গিয়েই অসুস্থ হয়ে পড়ল। হাসপাতালে গিয়ে তাকে দুই ব্যাগ এ পজিটিভ রক্ত দিতে হয়েছিল!
নার্গিস ম্যাডাম যখন ক্লাসে আসেন, তখন ক্লাসের ছেলেমেয়েরা মাঝেমধ্যে ভয়ে নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে যায়। শোনা যায়, নার্গিস ম্যাডাম যদি নিচু ক্লাসের কোনো ছেলে কিংবা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন ‘এই ছেলে’ কিংবা ‘এই মেয়ে’, তাহলে নাকি তাদের কাপড়ে বাথরুম হয়ে যায়।
সেই ভয়ংকর নার্গিস ম্যাডাম একদিন টুনিদের ক্লাসে এসে টুনির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই মেয়ে!’
টুনি সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেল। নার্গিস ম্যাডামের দিকে সরাসরি তাকানোর সাহস কারও নেই, তাই তাঁর নাকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জি, ম্যাডাম।’
পুরো ক্লাস তখন নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে। নার্গিস ম্যাডাম বললেন, ‘সেই দিন টেলিভিশনে দেখলাম একজন বড় সন্ত্রাসীকে ধরেছে বলে পুলিশ একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভকে পুরস্কার দিচ্ছে।’
টুনি ঢোঁক গিলে বলল, ‘জি, ম্যাডাম।’ গাবড়া বাবা সেজে থাকা গাল কাটা বকইর্যাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে ছোটাচ্চুকে একটা চেক দিয়েছিল, কয়েকটা টেলিভিশন চ্যানেলে সেটা দেখানো হয়েছিল, নার্গিস ম্যাডাম মনে হয় সেই অনুষ্ঠানটা দেখেছিলেন।
নার্গিস ম্যাডাম বললেন, ‘তোমাকে দেখলাম সেই প্রাইভেট ডিটেকটিভের পাশে সাজুগুজু করে দাঁড়িয়ে ছিলে।’ সাজুগুজু শব্দটা উচ্চারণ করার সময় একটা টিটকারির ভাব করলেন আর সেটা শুনে সারা ক্লাস শিউরে উঠল। টুনি ফ্যাকাশে মুখে বলল, ‘জি, ম্যাডাম?’
নার্গিস ম্যাডাম তাঁর ভ্রমরের মতো কালো চোখ বড় করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন, জানতে পারি?’
টুনি বলল, ‘প্রাইভেট ডিটেকটিভ হচ্ছেন আমার ছোট চাচা।’
‘সেই জন্যে তুমি টেলিভিশন ক্যামেরায় নিজের চেহারা দেখানোর জন্য সাজুগুজু করে তোমার ছোট চাচার লেজ ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে?’
সারা ক্লাস আবার শিউরে উঠল। টুনি ভাবল একবার বলে, আসলে সে মোটেই সাজুগুজু করে ছোটাচ্চুর লেজ ধরে দাঁড়িয়ে ছিল না। পুলিশের লোকেরা কীভাবে জানি খবর পেয়েছিল যে টুনি গাবড়া বাবার চুল আর দাড়ি টেনে খুলে ফেলেছিল, তাই তারাই ছোটাচ্চুর পাশে তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু নার্গিস ম্যাডামের মুখের ওপর সেই কথা বলা সম্ভব না, তাই সে কোনো কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
নার্গিস ম্যাডাম তাঁর ফুলের মতো ঠোঁটগুলো সাপের মতো বাঁকা করে বললেন, ‘শোনো মেয়ে। টেলিভিশনে চেহারা দেখানোর জন্য অজায়গায় কুজায়গায় নিজের মাথা ঢুকিয়ে দেবে না। যদি কোনো দিন নিজের যোগ্যতায় টেলিভিশনে তোমার চেহারা দেখাতে পারো, তাহলে ক্যামেরার সামনে যাবে। না হলে যাবে না। বুঝেছ?’
টুনি মাথা নেড়ে জানাল, সে বুঝেছে।
নার্গিস ম্যাডাম তখন পুরো ক্লাসকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘তোমাদেরও বলে রাখি, একজন মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার আত্মসম্মানবোধ। তোমরা কোনো দিন শুধু টেলিভিশনের ক্যামেরায় নিজের চেহারা দেখানোর জন্য এই আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দেবে না। যার আত্মসম্মানবোধ নেই, তার কিছু নেই।’ কিছু নেই কথাটা এমনভাবে উচ্চারণ করলেন যে মনে হলো ক্লাসরুমের ভেতর দিয়ে মেশিনগানের গুলি ছুটে গেল। সারা ক্লাস আতঙ্কে শিউরে উঠল।
ক্লাস শেষে নার্গিস ম্যাডাম চলে যাওয়ার পর সবাই টুনির কাছে ছুটে এল, সবাই জিজ্ঞেস করল সে ঠিক আছে কি না। একজন বলল, ‘বাসায় গিয়ে লবণ-পানি খাবি। তারপর শুয়ে থাকবি।’ আরেকজন বলল, ‘গরম পানি দিয়ে গোসল করে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বি।’
দুষ্টু টাইপের একজন বলল, ‘টেলিভিশনের ক্যামেরায় আমিও ঢুকে যাই। বইমেলায় গিয়ে আমি ক্যামেরাম্যানদের পেছনে পেছনে হাঁটি। যখনই দেখি কারও ইন্টারভিউ নিচ্ছে, তখনই পেছনে দাঁড়িয়ে যাই। একদিন আমাকে তিন চ্যানেলে দেখিয়েছিল!’
টুনি কিছু বলল না। সবাই ধরেই নিয়েছে টেলিভিশনে চেহারা দেখানোর জন্য সে বুঝি জোর করে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে গেছে! টুনির একবার মনে হলো সত্যি কথাটা বলে দেয় কিন্তু সে শেষ পর্যন্ত বলল না।
ক্লাসের ছেলেমেয়েরা চলে যাওয়ার পর টুনির কাছে এল তাদের ফার্স্ট গার্ল মৌটুসী। মৌটুসী লেখাপড়ায় খুব ভালো, তার চেহারাও খুব ভালো, সে খুব ভালো কবিতা আবৃত্তি করতে পারে, নজরুলগীতির কম্পিটিশনে সে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, মৌটুসী কারাতে ক্লাসে ভর্তি হয়ে রেড বেল্ট পর্যন্ত গিয়েছে, স্কুলের স্পোর্টসে সে লং জাম্পে ফার্স্ট হয়েছে, গণিত আর পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে সে মেডেল পেয়েছে। স্কুলের শেষে সে নাচের ক্লাসে যায় নাচ শিখতে, সে সুন্দর ছবি আঁকতে পারে, গল্প লেখার কম্পিটিশনে সে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আর কম্পিটিশনের লোকেরা যে বই লিখেছে, সেই বইয়ে তার গল্প ছাপা হয়েছে। এককথায় একজন মেয়ের যা যা ভালো গুণ থাকার কথা মৌটুসীর তার সবকিছু আছে, কিন্তু তার একটা অনেক বড় সমস্যা আছে সেটা হচ্ছে সে এক সেকেন্ডের জন্যও ভুলতে পারে না যে সে রূপে-গুণে সবার থেকে ভালো! সে কারণে অহংকারে তার মাটিতে পা পড়ে না আর তাই ক্লাসের কেউ তাকে দুই চোখে দেখতে পারে না। মৌটুসীর তাই ক্লাসে কোনো বন্ধু নেই, সে একা একা ঘুরে বেড়ায়।
আজকেও সে একা একা টুনির কাছে এল। এসে বলল, ‘আমি যখন নজরুলগীতি কম্পিটিশনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম তখন আমাকে টেলিভিশনে দেখিয়েছিল।’
টুনি মাথা নাড়ল, কোনো কথা বলল না। মৌটুসী তখন বলল, ‘যখন আমার গল্পটা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তখন পত্রিকায় আমার ইন্টারভিউ ছাপা হয়েছিল।’
টুনি এবারও মাথা নাড়ল, কোনো কথা বলল না। মৌটুসী বলল, ‘আমি যখন অলিম্পিয়াডে মেডেল পাই তখন আমাদের গ্রুপ ফটো তুলে সেই গ্রুপ ফটো সব পত্রিকায় ছাপা হয়।’
টুনি আবার মাথা নাড়ল, এবারও কোনো কথা বলল না। তখন মৌটুসী মনে হয় একটু রেগে গেল, রেগে গিয়ে বলল, ‘আমি তোমার মতো টেলিভিশনে নিজের চেহারা দেখাতে মামা-চাচাদের পেছনে ঘুরি না। টেলিভিশনের ক্যামেরা আমার কাছে আসে।’
টুনি সাধারণত রাগে না, কিন্তু এবার একটু রেগে গেল, কিন্তু সেটা প্রকাশ করল না। মৌটুসীর দিকে তাকিয়ে সে একটু হাসার ভঙ্গি করল।
মৌটুসী রেগে গিয়ে বলল, ‘তুমি আমার দিকে তাকিয়ে এভাবে হাসছ কেন?’
টুলি বলল, ‘তোমাকে দেখলে, তোমার কথা শুনলে আমার আনন্দ হয়, তাই আমি হাসি।’
মৌটুসী থতমত খেয়ে বলল, ‘আমাকে দেখলে আনন্দ হয়?’
টুনি মাথা নাড়ল। মৌটুসী জিজ্ঞেস করল, ‘কেন আনন্দ হয়?’
টুনি বলল, ‘তোমার চেহারা এত সুন্দর। তোমার এত গুণ সেই জন্য।’
মৌটুসী এবার হকচকিয়ে গেল, টুনি সত্যি বলছে না টিটকারি করছে সেটা সে বুঝতে পারল না, তাই সে হেঁটে হেঁটে চলে গেল।
টুনি একা একা চুপচাপ বসে রইল। তার মনটা খুব খারাপ হলো। সে ছোটাচ্চুর আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে জোর করে ঢুকে গিয়ে অনেক কিছু করেছে সত্যি, কিন্তু সেগুলো করেছে তার করতে ভালো লাগে বলে। টেলিভিশনে তার চেহারা দেখাবে, সেটা কখনো তার মাথাতেই আসেনি। এখন সবাই ভাবছে টেলিভিশনে চেহারা দেখানোর জন্য সে হ্যাংলার মতো ছোট চাচার পেছনে পেছনে তার লেজ ধরে ঘুরছে। কী লজ্জা। কী অপমান। কী দুঃখ। টুনির চোখে একেবারে পানি চলে আসছিল কিন্তু সে জোর করে চোখ থেকে পানি বের হতে দিল না। মুখটা শক্ত করে বসে রইল।
বাসাতে এসেও তার মনটা খারাপ হয়ে থাকল, সে কথা কম বলে, এমনিতেই সব সময় চুপচাপ থাকে, তাই বাসার কেউ সেটা টের পেল না। পরের দিন তার স্কুলে যেতেই ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু যদি স্কুলে না যায় সবাই কিছু একটা সন্দেহ করে বসে থাকবে, তাই সে স্কুলে গেল। স্কুলে এসেও সে তার নিজের সিটে চুপচাপ বসে রইল। আজকেও নার্গিস ম্যাডামের ক্লাস আছে, আজকে ক্লাসে এসে নার্গিস ম্যাডাম কী বলবেন, সেটা নিয়েও তার ভেতরে একটা অশান্তি।
কিন্তু হঠাৎ করে সবকিছু অন্য রকম হয়ে গেল। ক্লাস শুরু হওয়ার ঠিক আগে আগে ক্লাসের যে সবচেয়ে দুষ্টু ছেলে, সে খুবই উত্তেজিতভাবে ক্লাসে ঢুকে বেঞ্চে নিজের বইয়ের ব্যাগটা রেখে প্রায় ছুটে টুনির কাছে এসে হাজিল হলো। তার হাতে একটা পত্রিকা, পত্রিকাটা খুলে সে টুনিকে দেখিয়ে বলল, ‘টুনি! এই দ্যাখ!’
টুনি দেখল পত্রিকায় তার বিরাট একটা ছবি, চোখে চশমা, মুখে চাপা হাসি, হাতে কয়েকটা বই ধরে রেখেছে। ছবির নিচে বড় বড় করে লেখা ‘খুদে গোয়েন্দা।’ তার নিচে একটু বড় বড় করে লেখা, ‘কেমন করে ধরা হলো গাবড়া বাবা ওরফে গাল কাটা বকইর্যাকে।’ তার নিচে ছোট ছোট করে অনেক কিছু লেখা। যখন সবাই মিলে গাবড়া বাবাকে ধরে ফেলেছিল, তখন মনে আছে একজন মানুষ অনেকক্ষণ টুনির সঙ্গে কথা বলেছিল, তার অনেকগুলো ছবি তুলেছিল। সেই মানুষটা নিশ্চয়ই সাংবাদিক, সে নিশ্চয়ই খবরটা পত্রিকায় ছাপিয়ে দিয়েছে। টুনির খুব ইচ্ছে করছিল পত্রিকায় কী লিখেছে পড়ে দেখে কিন্তু সবার সামনে সেটা করতে তার একটু লজ্জা লাগল। তাই সে পত্রিকাটা একনজর দেখে চুপচাপ বসে রইল।
সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেটা বলল, ‘টুনি! তুই কোনো দিন আমাদের বলিসনি, তুই এত বড় ডিটেকটিভ!’
টুনি বলল, ‘আমি মোটেই বড় ডিটেকটিভ না।’
দুষ্টু ছেলেটা চিৎকার করে বলল, ‘বড় ডিটেকটিভ না হলে পত্রিকায় কোনো দিন এত বড় করে ছবি ছাপা হয়? মন্ত্রীদের ছবিও এত বড় করে ছাপা হয় না।’
দুষ্টু ছেলেটার চিৎকার শুনে অন্যেরাও চলে এল, তারা পত্রিকার ছবিটা আর নিচের ক্যাপশনটা পড়ে চিৎকারর করতে লাগল। আর সেই চিৎকার শুনে অন্যরা এসে পত্রিকাটা দেখে আরও জোরে চিৎকার করতে লাগল, পত্রিকাটা ধরে কাড়াকাড়ি করতে লাগল। সবাই মিলে টুনিকে ঘিরে লাফাতে লাগল, পত্রিকায় কী লিখেছে সেটা একজন আরেকজনকে ধাক্কাধাক্কি করে পড়তে লাগল। সবাই এলেও মৌটুসী দূরে তার সিটে বসে রইল, টুনিকে ঘিরে যে এত হইচই, চিৎকার-চেঁচামেচি সেটা নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখাল না। টুনির বুঝতে বাকি রইল না হিংসায় মৌটুসীর বুকের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। সে যখন কোনো মেডেল পায় তখন সে ক্লাসে এসে সেটা সবাইকে দেখানোর চেষ্টা করে, কেউ কোনো দিন সেটা ভালো করে দেখারও চেষ্টা করে না। কিন্তু আজ টুনিকে নিয়ে কত উত্তেজনা, তার হিংসা তো হতেই পারে।
ঠিক তখন ক্লাসের ঘণ্টা পড়ে গেল বলে টুনিকে ঘিরে উত্তেজনাটা আপাতত থেমে যেতে হলো।
নার্গিস ম্যাডাম যখন ক্লাসে ঢুকলেন তখন অন্যান্য প্রতিদিনের মতো ক্লাস একেবারে কবরের মতো নীরব হয়ে গেল। দেখে বোঝারও উপায় নেই ক্লাসে কোনো জীবিত মানুষ আছে, মনে হয় সবাই বুঝি নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে।
নার্গিস ম্যাডাম পড়াতে শুরু করলেন। ম্যাডাম বাংলা কবিতা পড়ান, এত সুন্দর কবিতা কিন্তু ছেলেমেয়েদের সেই কবিতা উপভোগ করার কোনো সুযোগ নেই, তারা নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে, কখন কিছু একটা ভুল হয়ে যায় আর ম্যাডাম চোখের দৃষ্টি দিয়ে তাদের রক্ত শুষে নেন।
নার্গিস ম্যাডাম কবিতাটা পড়ে শোনাতে শোনাতে হঠাৎ একটা কাগজের খচমচ শব্দ শুনে তাকালেন এবং দেখতে পেলেন তৃতীয় বেঞ্চের মাঝামাঝি একটা ছাত্র একটা খবরের কাগজ খুব সাবধানে পেছনের বেঞ্চে পাচার করার চেষ্টা করছে। খবরের কাগজটিতে টুনির ছবি ছাপা হয়েছে এবং সে এখনো দেখেনি। তার আর অপেক্ষা করার ধৈর্য ছিল না বলে নার্গিস ম্যাডামের ক্লাসেই এই ভয়ংকর দুঃসাহসের কাজটি করে ফেলার চেষ্টা করেছিল।
নার্গিস ম্যাডাম বললেন, ‘এই ছেলে, তুমি কী করছ?’
নার্গিস ম্যাডাম মোটেও গলা উঁচিয়ে বলেননি কিন্তু তবু মনে হলো ক্লাসে বুঝি একটা বজ্রপাত হয়েছে। যে দুজন অপরাধী, তাদের নার্গিস ম্যাডাম দাঁড়াতে বলেননি। কিন্তু দুজনই কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে গেল এবং দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল। তাদের দুই পাশে যারা বসে ছিল তারা যেকোনো মুহূর্তে বাথরুম হয়ে যেতে পারে আশঙ্কা করে দুই পাশে সরে গেল।
নার্গিস ম্যাডাম বললেন, ‘তোমাদের হাতে ওটা কী?’
একজন দুর্বলভাবে বলার চেষ্টা করল, ‘খ-খ-খ’ কিন্তু সে পুরো খবরের কাগজ বলে শেষ করতে পারল না। নার্গিস ম্যাডাম বরফের মতো শীতল আর চায়নিজ কুড়ালের মতো ধারালো চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলেন এবং দুজনকে দেখে মনে হলো তারা বুঝি টুকরো টুকরো হয়ে খসে পড়তে শুরু করেছে।
নার্গিস ম্যাডাম বললেন, ‘কী আছে খবরের কাগজে? কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর যে ক্লাসে বসেই পড়তে হবে?’
ছেলে দুটির একজন মাথা নেড়ে বলার চেষ্টা করল ‘না’। কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। অন্যজন বলল, ‘টু-টু-টু’ কিন্তু সে কথা শেষ করতে পারল না। সবাই বুঝে গেল সে টুনির নাম বলার চেষ্টা করছে। টেলিভিশনে টুনিকে দেখেই নার্গিস ম্যাডাম খুব বিরক্ত হয়েছিলেন, খবরের কাগজে তার ছবি দেখে ম্যাডাম কী করবেন, সেটা চিন্তা করে সবাই শিউরে শিউরে উঠতে লাগল। কেউ লক্ষ করল না বলে দেখতে পেল না শুধু মৌটুসীর মুখে একটা আনন্দের ছায়া পড়ল।
নার্গিস ম্যাডাম হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘খবরের কাগজটা দেখি।’
তৃতীয় বেঞ্চের ছেলেটা খবরের কাগজটা দ্বিতীয় বেঞ্চের ছেলেকে দিল, দ্বিতীয় বেঞ্চের ছেলেটা দিল প্রথম বেঞ্চের একজন মেয়েকে, সে সেটা দিল নার্গিস ম্যাডামকে। নার্গিস ম্যাডাম কাগজটা হাতে নিয়ে খুললেন। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ পড়ল টুনির বড় ছবিটাতে। তার চোখ বড় বড় হয়ে উঠল, মাথাটা একটু কাত করলেন (ভয়ে সারা ক্লাসই নিজেদের অজান্তে মাথা কাত করে ফেলল), তারপর পুরোটা পড়লেন। পড়ে মাথাটা সোজা করলেন (সারা ক্লাস মাথা সোজা করল), তারপর খবরের কাগজটা যত্ন করে ভাঁজ করে টেবিলের ওপর রাখলেন।
ক্লাসের সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল। সবার বুক ভয়ে-আতঙ্কে ধুকপুক করছে। যে দুজন ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল তারা তাদের হাঁটুতে আর জোর পাচ্ছে না, মনে হতে থাকে যেকোনো মুহূর্তে হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবে।
নার্গিস ম্যাডাম ডাকলেন, ‘টুনি।’
টুনি উঠে দাঁড়াল।
নার্গিস ম্যাডাম বললেন, ‘আমি গতকালকে বলেছিলাম তোমার চাচার লেজ ধরে তোমার টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে যাওয়া উচিত হয়নি। মনে আছে?’
টুনি শুকনো গলায় বলল, ‘মনে আছে ম্যাডাম।’
‘এখন দেখতে পাচ্ছি তুমি তোমার চাচার লেজ ধরে ক্যামেরার সামনে যাওনি, তুমি নিজের যোগ্যতাতেই গিয়েছ।’
টুনি একটু হকচকিয়ে গিয়ে নার্গিস ম্যাডামের দিকে তাকাল। আলোচনাটা কোন দিকে যাচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। এখন কি সে আগের থেকেও বড় অপরাধ করে ফেলেছে? কাজেই টুনি কিছু না বলে নার্গিস ম্যাডামের নাকের দিকে তাকিয়ে রইল।
নার্গিস ম্যাডাম শীতল গলায় বললেন, ‘এই পত্রিকার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তোমার চাচাই তোমার লেজ ধরে টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে গিয়েছেন। কথাটা কি ঠিক?’
টুনি গলাটা পরিষ্কার করে বলল, ‘আসলে আমরা কেউ টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে যাইনি। পুলিশ ডিপার্টমেন্ট একটা অনুষ্ঠান করেছিল, সেখানে গিয়েছিলাম। অনেক সাংবাদিক ছিল। তার মাঝে টেলিভিশন ক্যামেরা ছিল।’
ক্লাসের ছেলেমেয়ে হতবাক হয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারা কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না যে টুনি সরাসরি নার্গিস ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলছে। টুনিকে তখন তাদের মনে হতে থাকে বিশাল সাহসী একটা বাঘের বাচ্চা! কিংবা কে জানে বাচ্চা নয়—আস্ত বাঘ!
‘তুমি গতকাল আমাকে বিষয়টা বলোনি কেন?’ নার্গিস ম্যাডামের গলায় কিছু একটা ছিল, যেটা শুনে সারা ক্লাস কেমন যেন শিউরে উঠল।
টুনি কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করল। নার্গিস ম্যাডাম তাঁর গলাটা আরেকটু উঁচু করে এবারে ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন বলোনি?’
ক্লাসের বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলল। টুনি একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, ‘ভয়ে।’
নার্গিস ম্যাডামকে দেখে মনে হলো কথাটা শুনে খুব অবাক হয়েছেন। চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘কিসের ভয়ে?’
টুনি বলল, ‘আপনার ভয়ে।’
নার্গিস ম্যাডাম অবাক হয়ে বললেন, ‘আমার ভয়ে?’
টুনি কোনো কথা না বলে নার্গিস ম্যাডামের স্যান্ডেলের দিকে তাকিয়ে রইল। নার্গিস ম্যাডাম বললেন, ‘আমাকে তুমি ভয় পাও?’
টুনি মুখটা একটু ওপরে তুলে বলল, ‘সবাই ভয় পায়।’
‘সবাই ভয় পায়?’ নার্গিস ম্যাডাম অবাক হয়ে ক্লাসের দিকে তাকালেন। তাঁকে দেখে মনে হতে লাগল তিনি আশা করছেন সবাই এখন হা হা করে হেসে উঠবে, তারপর মাথা নেড়ে বলবে, ‘না না, আমরা ভয় পাই না! কেন ভয় পাব?’
কিন্তু কেউ সেটা বলল না। সবাই তার সামনের ছেলে কিংবা মেয়ের পেছনে মাথা লুকিয়ে ফেলল। একেবারে সামনের বেঞ্চে যারা আছে, তাদের লুকানোর কেউ নেই তাই তারা যতটুকু সম্ভব মাথা নিচু করে নিজের হাতের নখ কিংবা ডেস্কের ওপর রাখা বাংলা বইটার দিকে তাকিয়ে রইল।
নার্গিস ম্যাডাম কেমন যেন হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর টুনির দিকে তাকালেন, বললেন, ‘কী আশ্চর্য! কেন ভয় পায়?’
টুনি নার্গিস ম্যাডামের চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে তাঁর গলার লকেটের দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো কথা বলল না। ম্যাডাম বললেন, ‘টুনি! তুমি ডিটেকটিভ, তুমিই বলো, কেন আমাকে ভয় পায়?’
টুনি ঢোঁক গিলে বলল, ‘বলব?’
‘বলো।’
টুনি আরেকবার ঢোঁক গিলে বলল, ‘ভয় করছে ম্যাডাম।’
‘ভয়ের কিছু নেই। বলো।’
টুনি মনে মনে একবার দোয়া ইউনুস পড়ে বুকে ফুঁ দিল তারপর বলল, ‘আপনাকে সবাই ভয় পায় কারণ আপনি কোনো দিন হাসেন না।’
সারা ক্লাসের মনে হয় যে তাদের ওপর দিয়ে একটা টর্নেডো উড়ে গেল। সবার মনে হলো তারা সেই টর্নেডোতে উড়ে যাবে, সবকিছু ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই হলো না, নার্গিস ম্যাডাম কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর আস্তে আস্তে বললেন, ‘আমি হাসি না!’
নার্গিস ম্যাডাম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন, সরাসরি তাকানোর সাহস নেই বলে সবাই চোখের কোনা দিয়ে নার্গিস ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে রইল। তারা অবাক হয়ে দেখল নার্গিস ম্যাডামের ঠোঁটের কোনায় একটা সূক্ষ্ম হাসি উঁকি দিচ্ছে। মনে হলো ম্যাডাম হাসিটা চেপে রাখার চেষ্টা করছেন কিন্তু চেপে রাখতে পারছেন না, ধীরে ধীরে তাঁর সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ছে। তারপর সপ্তম আশ্চর্যের থেকেও বড় আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল। নার্গিস ম্যাডাম হঠাৎ ফিক করে একটু হেসে ফেললেন।
সারা ক্লাস তখন একসঙ্গে ফিক করে হেসে উঠল। ম্যাডাম যখন আরেকটু হাসলেন, ক্লাসের সবাই তখন আরেকটু হাসল। তারপর নার্গিস ম্যাডাম হাসতেই লাগলেন আর ক্লাসের সবাই হাসতে লাগল। টুনি শুধু অবাক হয়ে নার্গিস ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে রইল, ম্যাডাম যখন হাসেন তখন হঠাৎ করে তাঁর সেই ভয়ংকর চেহারাটা আর থাকে না, দেখে মনে হয় একেবারে স্বাভাবিক মানুষ।
নার্গিস ম্যাডাম তাঁর হাসি থামালেন, ছেলেমেয়েরা সঙ্গে সঙ্গে হাসি থামাল না, তারা আরও কিছুক্ষণ হাসল। ম্যাডাম তখন টেবিল থেকে খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে বললেন, ‘তোমরা সবাই টুনির ওপর লেখাটা পড়েছ?’
যে ব্যাপারটা আগে কখনো ছেলেমেয়েরা কল্পনা করেনি, সেটাই তারা করে ফেলল, তারা চিৎকার করে বলল, ‘না ম্যাডাম, সবাই পড়িনি।’
‘ঠিক আছে, আমি তাহলে পড়ে শোনাই।’ তারপর ম্যাডাম নিজে খবরের কাগজের লেখাটা পড়ে শোনালেন। ছেলেমেয়েরা শুনল, মাঝে মাঝে হাততালি দিল। টেবিলে থাবা দিল, এমনকি কয়েকবার আনন্দে চিৎকার করে উঠল। দশ মিনিট আগে তারা সেটা করতে পারবে কল্পনা পর্যন্ত করেনি।
শুধু মৌটুসী পাথরের মতো মুখ করে বসে রইল।
এরপর একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটে গেল। প্রথমে ক্লাসের ছেলেমেয়েরা, তারপর স্কুলের ছেলেমেয়েরা ডিটেকটিভ টুনির কাছে আসতে শুরু করল। বিচিত্র তাদের সমস্যা। যেমন একজন এসে বলল:
‘আমার গল্প বই পড়তে ভালো লাগে, আমার আব্বু-আম্মু আমাকে গল্প বই পড়তে দেয় না। কী করব?’
টুনি সমাধান দিল, ‘পাঠ্যবইয়ের নিচে গল্প বই রেখে পড়ে ফেলো।’
আরেকজন এসে বলল: ‘রাত্রে ঘুমাতে ভয় লাগে।’
টুনি জিজ্ঞেস করল, ‘কিসের ভয়?’
‘ভূতের।’
টুনি একটা কাগজে লিখল:
৬ ১ ৮
৭ ৫ ৩
২ ৯ ৪
তারপর সেটা তাকে দিয়ে বলল, ‘এই কাগজটা ভাঁজ করে বালিশের নিচে রেখে ঘুমাবে।’
‘এটা কী?’
‘ম্যাজিক স্কয়ার। ভূত একটা জিনিসকে খুব ভয় পায়, সেটা হচ্ছে অঙ্ক। আর অঙ্কের মাঝে সবচেয়ে বেশি ভয় ১৫ সংখ্যাটাকে। এই কাগজে যে সংখ্যা লেখা আছে সেটা যেভাবেই যোগ করবে ১৫ দেবে। ভূত এটাকে খুব ভয় পায়। বালিশের নিচে রাখলে তার বাবাও আসবে না।’
আরেকজন এসে বলল, ‘লেখাপড়া ভালো লাগে না।’
টুনি জিজ্ঞেস করল, ‘কেন?’
‘স্যার কী বলে বুঝি না।’
‘কেন?’
‘স্যার বোর্ডে কী লেখে সেটাও দেখি না।’
টুনি কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের চশমাটা খুলে তাকে দিয়ে বলল, ‘এটা পরে দেখো তো কেমন লাগে।’
চশমা পরে সে অবাক হয়ে বলল, ‘আরে! সবকিছু স্পষ্ট, একেবারে ঝকঝক করছে।’
টুনি বলল, ‘তোমার চোখ খারাপ হয়েছে। আব্বু-আম্মুকে বলে চোখের ডাক্তারের কাছে গিয়ে চশমা নাও।’
আরেকজন এসে বলল, ‘সানজিদা আমার খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় লিখেছে পাগল।’
টুনি বলল, ‘তুমি তার খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় লেখো ছাগল।’
ছাত্রছাত্রীরা শুধু যে নিজের সমস্যা নিয়ে আসতে লাগল তা নয়। বাসার বিভিন্ন মানুষের সমস্যা নিয়েও আসা শুরু করল। একজন এসে বলল, ‘ভাইয়া জানি কী রকম হয়ে গেছে। সারাক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ায় আর নিজেকে দেখে।’
টুনি জিজ্ঞেস করল, ‘চুলে জেল দেয়?’
‘হ্যাঁ।’
‘শরীরে পারফিউম?’
‘হ্যাঁ।’
‘বয়স কত? ষোলো-সতেরো?’
‘হ্যাঁ।’
টুনি বলল, ‘নরমাল। হরমোন কিক করেছে।’
যে সমস্যাটা নিয়ে এসেছে সে বলল, ‘তার মানে কী?’
‘তার মানে এই বয়সে ছেলেরা মেয়েদের সামনে নিজেদের সুন্দর দেখানোর জন্য সাজুগুজু করে।’
‘কেন?’
‘তুমি এখন বুঝবে না। তোমার বয়স যখন ষোলো-সতেরো হবে তখন বুঝবে।’
আরেকজন এসে বলল, ‘আব্বু হঠাৎ মোছ কেটে ফেলেছে। এখন আব্বুকে চেনা যায় না, দেখে মেয়েমানুষের মতো লাগে।’
টুনি জিজ্ঞেস করল, ‘বয়স কত? চল্লিশের কাছাকাছি?’
‘হ্যাঁ।’
‘নরমাল। তোমার আব্বুর মোচ পাকতে শুরু করেছে। প্রথমে একটা-দুইটা টেনে তুলে ফেলেছে, এখন আর কুলাতে পারছে না, তাই পুরোটা কামিয়ে ফেলেছে।’
শুধু যে বাসার সমস্যা নিয়ে এল তা-ই না, এক-দুজন তাদের মেডিকেল সমস্যাও নিয়ে এল। বেশির ভাগ সমস্যা অবশ্য কাউকে বলার মতো না। একটা-দুইটা হয়তো একটু চিন্তাভাবনা করে বলা যেতে পারে। যেমন একটা ছেলে অনেকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, ‘আমি যখন হিসু করি তখন রং হয় হলুদ, ফান্টার মতো।’
টুনি তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘বেশি করে পানি খাও তাহলে রং হবে সেভেনআপের মতো। আর যদি না খাও—’
ছেলেটা শুকনো মুখে বলল, ‘যদি না খাই?’
‘তাহলে আস্তে আস্তে তোমার হিসুর রং হয়ে যাবে কোকের মত।’
ছেলেটা ফ্যাকাশে মুখে তখনই ছুটে বের হয়ে গেল, একটু পরই দেখা গেল ঢক ঢক করে পানি খাচ্ছে।
তবে টুনির কাছে সবচেয়ে চমকপ্রদ সমস্যাটা নিয়ে এল মৌটুসী। একদিন যখন আশপাশে কেউ নেই তখন মৌটুসী তার কাছে এসে বলল, ‘টুনি, তুমি তো ডিটেকটিভ?’
টুনির ক্লাসের ছেলেমেয়েরা সবাই সবাইকে তুই করে বলে, মৌটুসী ছাড়া। তার সঙ্গে কারও ভাব নেই, তাই সে সবাইকে তুমি তুমি করে বলে। টুনি মৌটুসীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি ডিটেকটিভ এখনো হইনি। হওয়ার চেষ্টা করছি।’
মৌটুসী বলল, ‘দেখি তুমি কত বড় ডিকেটটিভ।’ তারপর সে ব্যাগ থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে টুনিকে দিয়ে বলল, ‘এই চিঠিটা কে লিখেছে বের করে দাও।’
টুনি কাগজটা খুলে দেখে পুরো চিঠিটা উল্টো করে লেখা। টুনি বলল, ‘যে লিখেছে সে তোমার পরিচিত। তাই এভাবে লিখেছে, যেন হাতের লেখা চিনতে না পারো।’
মৌটুসী বলল, ‘এটা কীভাবে পড়তে হবে জানো? একটা আয়নার সামনে ধরলে—’
টুনি বলল, ‘আয়না লাগবে না।’ তারপর কাগজটা জানালার আলোর দিকে উল্টো করে ধরল, মোটামুটি বেশ স্পষ্টভাবে লেখাটা সোজা হয়ে দেখা গেল। চিঠিতে লেখা:
মৌটুসী
আমি তোমাকে খুব হিংসা করি। আমরা
কেউ কিছু পারি না কিন্তু তুমি গান গাইতে
পারো, ছবি আঁকতে পারো, নাচতে পারো। শুধু
তাই না তুমি লেখাপড়াতেও এত ভালো।
সবচেয়ে বড় কথা তুমি দেখতে
এত সুন্দর। খোদা কেন সবকিছু একজনকে
দিল, আমাদের কেন কিছু দিল না?
ইতি একজন হিংসুক
টুনি চিঠিটা মৌটুসীকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই চিঠিটা তোমাকে কে লিখেছে বের করার কোনো দরকার নেই।’
‘কেন?’
‘এইটা সিরিয়াস কিছু না। কেউ ঠাট্টা করেছে।’
‘ঠাট্টা?’ মৌটুসী মনে হয় বেশ অবাক হলো। ‘ঠাট্টা কেন হবে?’
‘ঠাট্টা না হলে এগুলো লেখে না। যদি চিঠিতে তোমাকে গালাগাল করত, ভয় দেখাত তাহলে সেটা বের করতে মজা হতো। এটা খুবই পানসে চিঠি।’
‘তোমার কী মনে হয়, এটা কি ক্লাসের কোনো ছেলে লিখেছে?’
‘নাহ্। ছেলে লেখেনি।’
‘তুমি কীভাবে জানো?’
‘আমাদের ক্লাসের কোনো ছেলের এখনো হরমোন কিক করেনি। কোনো মেয়ে দেখতে সুন্দর কি না সেটা তারা জানে পর্যন্ত না! তাদের কাছে ছেলেমেয়ে সুন্দর-ভ্যাবলা সব এক। এখন তারা ক্রিকেট খেলা ছাড়া আর কিছু বোঝে না।’
‘তুমি কি বলতে পারবে এটা কে লিখেছে।’
‘পারব।’
‘কে?’
টুনি বলল, ‘সেটা তোমার জানার কোনো দরকার নেই।’ তারপর সে মৌটুসীর দিকে তাকিয়ে হাসার ভঙ্গি করল, যার অর্থ গোপন চিঠি নিয়ে আলোচনা শেষ। তাই একটু পরে মৌটুসী মন খারাপ করে চলে গেল।
পরের দিন সকাল বেলাতেই মৌটুসী আবার টুনির কাছে হাজির হলো। তার হাতে আরেকটা কাগজ। টুনিকে বলল, ‘এই যে আরেকটা চিঠি পেয়েছি, বলতে পারবে এটা কে লিখেছে?’
‘টুনি বলল, দেখি।’
মৌটুসী বলল, ‘এই চিঠিতে অনেক গালিগালাজ।’
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ। এই দেখো।’
টুনি চিঠিটা হাতে নিল, এইটাও উল্টো করে লেখা, টুনি কাগজটা উল্টো করে আলোতে ধরে রেখে পড়ল,
মৌটুসী
সাবধান! তোমার কারণে ক্লাসে আমাদের কত কষ্ট। স্যার ম্যাডামের বকাবকি শুনতে হয়। তাদের গালাগালি শুনতে হয়। তুমি এখনি সাবধান হয়ে যাও, তা না হলে তোমার ওপরে অনেক বিপদ। আমি তোমাকে ভয়ংকর শাস্তি দিব। তুমি কি চাও?
তোমার আজরাইল
টুনি চিঠিটা মৌটুসীকে ফেরত দিল। মৌটুসী বলল, ‘কে লিখেছে বলতে পারবে?’
টুনি জিজ্ঞেস করল, ‘তার আগে বলো, চিঠিটা পেলে কেমন করে? খামে করে বাসার ঠিকানায় পাঠিয়েছে?’
‘না।’
‘তাহলে?’
‘আমার ব্যাগের ভেতরে ছিল।’
‘ও!’ টুনি বলল, ‘তাহলে এইটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো দরকার নেই। ক্লাসের কেউ তোমার সঙ্গে মজা করছে।’
মৌটুসী বলল, ‘কিন্তু আমি জানতে চাই। তুমি না এত বড় ডিটেকটিভ, পত্রিকায় তোমার ছবি ছাপা হয়, আর এইটা বের করতে পারবে না?’
‘পারব।’
‘তাহলে বের করো।’
‘আমার এই চিঠির একটা কপি দরকার।’
‘ফটোকপি?’
‘না, ফটোকপি লাগবে না। আমি চিঠিটা পড়ি, তুমি একটা কাগজে লিখে দাও।’
টুনি তখন চিঠিটা পড়ল, মৌটুসী কাগজে লিখে দিল। টুনি চিঠিটা হাতে নিয়ে মৌটুসীকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি কাউকে সন্দেহ করো?’
মৌটুসী মুখ শক্ত করে বলল, ‘সেটা আমি কেন তোমাকে বলব?’
‘একজন ডিটেকটিভ যখন কেস সলভ করতে যায় তখন তাকে সবকিছু বলতে হয়।’
‘আমি যদি বলে দিই তাহলে তুমি কিসের ডিটেকটিভ?’
‘তুমি যদি জানো তাহলে আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন?’
‘আমি দেখতে চাই তুমি কত বড় ডিটেকটিভ?’
তাদের কথা শুনে ক্লাসের একটা ছেলে এগিয়ে এল, জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’
টুনি বলল, ‘কিছু না।’
মৌটুসী বলল, ‘টুনি কত বড় একজন ডিটেকটিভ সেটা পরীক্ষা করে দেখছিলাম।’
ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, ‘কীভাবে?’
‘আমার কাছে কে যেন চিঠি লিখছে। টুনিকে বলছিলাম বের করতে কিন্তু টুনি সেটা বের করতে পারছে না।’
‘কী চিঠি লিখছে?’
মৌটুসী বেশ উত্সাহ নিয়ে চিঠিটা বের করে দিল। ছেলেটা চিঠিটা হাতে নিয়ে বলল, ‘এ তো দেখি উল্টা লেখা।’
টুনি বলল, ‘কাগজটা উল্টো করে জানালার সামনে ধরো, তাহলে পড়তে পারবে।’
ছেলেটা জানালার সামনে ধরে চিঠিটা পড়ে চোখ বড় বড় করে বলল, ‘কী ভয়ংকর!’
কাজেই কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লাসের সবাই জেনে গল মৌটুসীর কাছে কে যেন গোপনে ভয়ংকর চিঠি পাঠাচ্ছে! মৌটুসী মনে হয় ব্যাপারটা বেশ পছন্দই করল, যখনই কেউ আসছে তাকেই চিঠিটা দেখাচ্ছে। মৌটুসী সব সময়ই সবার কাছ থেকে গুরুত্ব পেতে চায়।
পরের দিন মৌটুসী আরেকটা চিঠি নিয়ে এল, এই চিঠিটা আগের থেকেও লম্বা, আগের থেকেও বড়। এই চিঠিটাও কোনো একজন তার ব্যাগের ভেতরে রেখে দিয়েছে। চিঠিটা আরও ভয়ংকর। এই চিঠিটাতে শুধু যে মৌটুসীকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে তা নয়, শাস্তিটা কী হতে পারে সেটার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। (চুলের মাঝে চুইংগাম লাগিয়ে দেওয়া, ব্যাগের ভেতর বিষপিঁপড়া রেখে দেওয়া, শরীরের মাঝে মাকড়সা ফেলে দেওয়া, বাসার ভেতরে সাপ ছেড়ে দেওয়া) এ রকম ভয়ংকর চিঠি পেয়েও মৌটুসী খুব ঘাবড়ে গেল না। চিঠিটা টুনির হাতে দিয়ে বলল, ‘এই যে আরেকটা চিঠি!’
টুনি চিঠিটার মাঝে চোখ বুলিয়ে মৌটুসীকে ফিরিয়ে দিল। মৌটুসী জিজ্ঞেস করল, ‘পড়বে না?’
‘নাহ। পড়ার দরকার নাই।’
‘কেন?’
‘কী লিখতে পারে, মোটামুটি জানি।’
‘তাহলে বলো, কে লিখছে এই চিঠিগুলো।’
টুনি চুপ করে রইল। মৌটুসী ঠোঁট উল্টে বলল, ‘যদি বলতে না পারো তাহলে স্বীকার করে নাও তুমি বের করতে পারবে না।’
টুনি এবারও কথা বলল না। মৌটুসী তখন বলল, ‘তুমি কচু ডিটেকটিভ।’
টুনি কোনো কথা না বলে মৌটুসীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।
মৌটুসী বলল, ‘কী হলো, তুমি হাসছ কেন বোকার মতো?’
টুনি বলল, ‘তার আগে বলো তুমি কেন প্রতিদিন নিজের কাছে একটা করে চিঠি লেখো? তোমার কোনো কাজ নেই?’
মৌটুসীর মুখটা হাঁ হয়ে গেল, তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘আ-আ-আমি?’
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, ‘হ্যাঁ। তোমার প্রথম চিঠিটা পড়েই আমি বুঝেছিলাম, এ রকম চিঠি তুমি নিজে ছাড়া আর কেউ লিখবে না।’
মৌটুসী গলা উঁচিয়ে আপত্তি করে বলল, ‘না, আমি লিখি নাই।’
টুনি গলা নামিয়ে বলল, ‘মনে আছে আমি তোমাকে দিয়ে তোমার চিঠি কপি করিয়েছিলাম? কেন করেছিলাম জানো?’
‘কেন?’
‘দেখার জন্য গোপন চিঠি আর তোমার চিঠির বানান ভুল এক রকম হয় কি না।’
মৌটুসী মুখ শক্ত করে বলল, ‘আমার কোনো বানান ভুল হয় না।’
‘গোপন চিঠিতেও কোনো বানান ভুল হয় না। একটা ছাড়া—’
‘কোনটা?’
‘কী। ক দীর্ঘ ঈ-কার আর ক হ্রস্ব ই-কারের পার্থক্যটা তুমি শেখোনি, গোপন চিঠি যে লিখেছে সেও শেখেনি। লিখেছিলে, তুমি কি চাও? লেখার কথা ছিল তুমি কী চাও?’
মৌটুসীর মুখটা লাল হয়ে উঠল, ‘পার্থক্যটা কী?’
‘নার্গিস ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করো।’
মৌটুসী বলল, ‘তোমার সব কথা ভুল।’
‘ঠিক আছে।’
‘তুমি কচু ডিটেকটিভ।’
টুনি বলল, ‘ঠিক আছে। শুধু একটা জিনিস।’
‘কী জিনিস?’
‘গোপন চিঠিগুলো তুমি কীভাবে পেতে?’
‘আমার ব্যাগে।’
‘তোমার ব্যাগে আমিও প্রতিদিন একটা করে চিঠি দিয়েছি। আমার চিঠিগুলো তুমি পাওনি, কেন জানো? তার কারণ তুমি কোনো দিন তোমার ব্যাগে কোনো চিঠি খুঁজে দেখোনি! তুমি চিঠিগুলো নিজে বসে বসে লিখেছ, কেন ব্যাগে চিঠি খুঁজবে?’
মৌটুসী কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল, বলল, ‘তুমি কী লিখেছ চিঠিতে?’
‘বাসায় গিয়ে পড়ে দেখো। তোমাকে বলেছি নিজেকে চিঠি লেখা বন্ধ করতে।’
ঠিক এ রকম সময় কয়েকজন ছেলেমেয়ে তাদের দিকে এগিয়ে এল। একজন মৌটুসীকে জিজ্ঞেস করল, ‘মৌটুসী, আজকে কোনো চিঠি এসেছে?’
মৌটুসী কিছু বলার আগে টুনি বলল, ‘না, আসেনি।’
‘আসেনি?’
‘না। আর আসবে না।’
‘কেন?’
‘তার কারণ যে গোপনে চিঠি লিখত সে ধরা পড়ে গেছে।’
সবাই চিত্কার করে বলল, ‘কে? কে?’
টুনি বলল, ‘আমি তাকে বলেছি সে যদি আর গোপন চিঠি না লেখে তাহলে তার নাম আমি বলব না। সে রাজি হয়েছে।’
‘প্লিজ প্লিজ আমাদের বলো, আমরা কাউকে বলব না।’
টুনি বলল, ‘আমি মৌটুসীকে বলেছি, তোমরা মৌটুসীকে জিজ্ঞেস করো। সে যদি বলে আমার আপত্তি নেই।’
তারপর টুনি হেঁটে চলে গেল আর সবাই তখন মৌটুসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারা ভেবেছিল মৌটুসী গোপন পত্রলেখকের নাম বলবে।
কিন্তু দেখা গেল মৌটুসীর নাম বলতে আপত্তি আছে! সে মুখ শক্ত করে বসে রইল। এর পর থেকে মৌটুসীর কাছে গোপন চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেল।