দুষ্টু মেয়ের দল (সপ্তম পর্ব)

অলংকরণ: তুলি

মইন স্যার ঘামছেন। কপালে ঘাম জমছে তাঁর। বৃষ্টির দিনে টিনের চালের নিচে যেভাবে অ্যাবাকাসের গুটির মতো বৃষ্টির ফোঁটা জমে, তেমনি করে তাঁর কপালে ঘাম। তাঁর সামনে বীণা।

ঢাকার ধানমন্ডি মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের হোস্টেলের গেটে দাঁড়িয়ে আছেন দুজনে। আকাশ নীল। সকালের রোদটা এখনো আরামদায়কভাবে শুয়ে আছে মাঠের ঘাসে। দূরে ট্র্যাকস্যুট পরে শরীরচর্চা করছে একদল মেয়ে।

মাথার ওপরে ইলেকট্রিক তার। কতগুলো কাক লাইন ধরে বসে আছে তার ওপর। মনে হয়, তারাও লেফট-রাইট করতে চায়।

বীণা বললেন, স্যার বলেন, কী বুঝে নেব?

উদাস হয়ে গেলেন মইন স্যার। আকাশের দিকে তাকালেন। এই মুহূর্তে আকাশের দিকে মুখ করে রাখা নিরাপদ নয়। কারণ, ইলেকট্রিসিটির তারে কাক বসে আছে। ঢাকার কাক অত্যন্ত বেরসিক। কেউ যখন মাথা নিচু করে থাকে, তখন খুবই ভদ্র আচরণ করে তারা। কিন্তু আকাশের দিকে তাকালেই ওপর থেকে বর্জ্য নিক্ষেপ করা তাদের অভ্যাস।

বীণা বললেন, আকাশের দিকে হাঁ করে তাকাবেন না। কাকগুলো এইখানে বাথরুম সারে।

সঙ্গে সঙ্গে মাথা নামালেন মইন স্যার। আর অমনি  আকাশ থেকে নেমে এল কাকের উপহার। পড়ল গিয়ে মইন স্যারের মাথার ওপরে। সাদা হয়ে গেল চুল।

বীণা হাসতে লাগলেন। হাসতে হাসতে তাঁর চোখে পানি চলে এল।

তারপর তিনি তাঁর ব্যাগে হাত দিলেন। ব্যাগে টিস্যু পেপার থাকে। সেটা দিয়ে তিনি মইন স্যারের মাথার চুল থেকে কাকের পাঠানো উপহার বর্জ্য মুছে দিতে লাগলেন।

মইন স্যারের মনে হতে লাগল, তাঁর জীবন ধন্য হয়ে গেছে। বীণা মনে হয় খুব মিষ্টি একটা সুগন্ধি ব্যবহার করেন। সেই সুগন্ধির সৌরভে বাতাস ম-ম করছে। আহা, সারাটা জীবন ধরে এই মেয়েটি যদি তাঁর মাথার চুলে তাঁর চাঁপাকলির মতো আঙুল বোলাত, তাহলে একেবারে স্বর্গসুখে ভরে থাকত তাঁর জীবনটা।

মইন স্যারের চুলের ময়লা পরিষ্কার করে দিয়ে বীণা বললেন, আপনি কী বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, দিলেন না তো। আমি যাই। আমার হাত ধুতে হবে। আপনিও যান। মাথা পরিষ্কার করেন। তিন টাকা দিয়ে একটা মিনিপ্যাক শ্যাম্পু কিনে নিয়ে চুলটা ভালো করে ধোবেন।

মইন স্যার তখন মুখে কিছুই বলতে পারলেন না। কিন্তু ঘরে ফিরে এসে তিনি একটা কবিতা লিখলেন:

কাক করে কা কা
শহরের নাম ঢাকা
ঢাকার কাক কালো
বীণা খুবই ভালো
বীণা দিল চুলে হাত
ঘুম আসে না সারা রাত
বীণার চুল কালো
তাকে বাসি ভালো

কিন্তু এই কবিতাটাও ছিঁড়ে ফেললেন তিনি। কারও নাম ধরে কবিতা লেখা তাঁর উচিত নয়।

 ***

সব খেলোয়াড়ের জন্যই একটা করে মোবাইল ফোন কিনলেন বীণা। দামি ফোন নয়, দুই হাজার টাকা করে একটা ফোন। মোট ১৫টা ফোন কিনতে হলো। তাঁর ৩০ হাজার টাকা খরচা হয়ে গেল। কিন্তু এই টাকা খরচ করতে তাঁর একটুও কষ্ট হলো না। কারণ, তাঁর মনে খুশির অন্ত নাই। তাঁদের দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

গ্রামে যখন সবাই মিলে তাঁরা ফিরে এলেন, এসে দেখলেন, এলাহি কাণ্ড।

একদল ঢাকওয়ালা বাসস্ট্যান্ডেই তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।  

তাঁরা বাস থেকে নামতেই ঢাক বাজাতে লাগল ঢাকওয়ালারা।

উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, উপজেলা শিক্ষা অফিসার—সবাই সেখানে উপস্থিত। প্রত্যেকের গলায় একটা করে রঙিন কাগজের মালা পরিয়ে দেওয়া হলো।

তাঁদের জন্য বিশেষভাবে সাজানো রিকশাভ্যান তৈরি করে রাখা হয়েছে। সামনে-পেছনে মোটরসাইকেলের বহর। ঢাক বাজাতে বাজাতে তারা গ্রামে প্রবেশ করল।

***

তহুরার বাড়ি থেকে ফোন এসেছে রাশেদার কাছে।

নতুন ফোন পেয়ে তারা নিজেদের মধ্যে ফোনালাপ করে নাকি খুব!

রাশেদার মা ফোন ধরলেন।

তহুরা বলল, চাচি, এট্টু রাশেদারে দেন না। আমি তহুরা।

রাশেদার মা তখন উঠানের খোলা চুলায় লাকড়ি ঠেলছেন। ভাতে বলক এসেছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে খানিক আগে। রাশেদা তার ঘরে হারিকেনের আলোয় লেখাপড়া করছে।

চারদিকে ঝিঁঝির ডাক। চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে ঘন হয়ে। উঠানের এক কোণেও জোনাকির আলো বিন্দু বিন্দু জ্বলছে।

রাশেদার মা চিৎকার করলেন, রাশেদা! রাশেদা তোর ফোন।

রাশেদা দৌড়ে এল ঘর থেকে।

কেডায় কল করছে?

তহুরা।

কী চায়?

আমি কী জানি!

রাশেদা ফোন নিয়ে কানে দিয়ে উঠানের আরেক কোণের দিকে যায়। ওই দিকে অন্ধকারে একটা বিড়াল শুয়ে আছে। বিড়ালের চোখ দুটি জ্বল জ্বল করছে।

কী ফ্রেন্ড, এত রাইতে ফোন দিছস ক্যান? রাশেদা বলল।

দাওয়াত দিতে ফোন দিছি। কাইলকা রাইতের বেলা আমগো বাড়িতে আইস। তহুরা বলল।

কিয়ের দাওয়াত?

আমার বিয়ার দাওয়াত।

বিয়া?

হ।

তোর?

হ।

তুই না ক্লাস ফাইভে পড়িস?

হ।

তাইলে তোর কেমনে বিয়া হয়!

হওয়াইলেই হয়।

যা! ফাইজলামি করিস না তো। এইসব বিয়াশাদি নিয়া ইয়ার্কি রগড় আমার ভালো লাগে না।

আমারও ভালো লাগে না। আমার কাইলকা বিয়া। পাত্র খুব বড়লোক। আগের বউ মইরা গেছে। সেই পক্ষে কোনো পোলা-মাইয়া নাই। এইবার পাত্র বাচ্চা দেইখা বিয়া করব। পাত্র কন্ট্রাক্টর। তার মটরসাইকেল আছে। সে আমারে দেখতে আইব আইজকা রাইতে। পছন্দ হইলে আজকা রাইতেই বিয়া। তুই আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড। তোরে জানাইলাম। বিয়া খাইতে চইলা আয়। মায়ে কইছে, আজকা পোলাও পাক করব। মা চাউল ধুইতে লাগছে। মুরগিগুলান তো সব ঘরে আটকানোই আছে। আব্বা একটু পরে মুরগি ধইরা জবাই করা শুরু করব। মুরগির কোর্মা হইব। পাত্রপক্ষ কয়জন আহে ঠিক নাই। বাবায় কইছে, পাত্র যদি আমারে পছন্দ কইরা ফেলে, তাইলে খাসিও জবাই হইব। আমার নিজের পোষা দুইটা কালো খাসি আছে। বেশি বড় না। মাংস হেভি টেস্ট হইব। পোলাও-কোরমা খাইতে চাইলে ফ্রেন্ড চইলা আয়।

রাশেদা বলল, আমি একলাই আমু, নাকি আমাগো পুরা ফুটবল টিম লইয়া আসুম।

না না। দুইটা বাচ্চা খাসিতে আট কেজি মাংস হইব। আমগো টিম আইলে মাংস শর্ট পড়ব। খালি তুই আয়। আর মারিয়ারে লইয়া আয়।

রাশেদা বলল, তুই কি হাচা হাচা কইতাছস, না ইয়ার্কি করতাছস?

তহুরা বলল, এই রকম একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়া আমি ইয়ার্কি করুম? আমি কি পাগলি?

রাশেদা ফোন রেখে খানিকক্ষণ চুপ করে থাকল।

মা চুলা থেকে ভাতের হাঁড়ি নামালেন। বললেন, ওই কী হইছে?

রাশেদা বলল, তহুরার বিয়া।

কুন দিন?

আইজকা রাইতেই।

কস কী?

হ। দাওয়াত দিল। পোলাও-কোর্মা খাওনের দাওয়াত।

কী করবি?

যাই, পোলাও-কোর্মা খাইয়া আহি।

কস কী?

ও মা! খামু না! কত দিন পোলাও-কোর্মা খাই না।

রাশেদা ফোন করল মারিয়াকে। ফ্রেন্ড, ভালো শাড়ি পর। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগা। চল, পাত্রপক্ষের সঙ্গে যদি আর দুইটা লোক থাকে, তাইলে তোরে কি আমারে পছন্দ কইরা বিয়া কইরা লইয়া যাইতে পারে। তাইলে এক হাঁড়ি পোলাওয়ে তিনটা বিয়া সারা যাইব।

মারিয়া বলল, হইছেটা কী?

হইব আর কী! তহুরার বিয়া।

মারিয়া ছুটে চলে এল রাশেদার বাড়িতে। কস কী? এখন আমরা কী করুম?

খাড়া, আগে বীণা আপারে ফোন দেই।

বীণা আপার ফোন বাজে। তিনি ধরেন না।

তারপর একসময় তিনি ফোন ধরলেন। এই কী হয়েছে? এতবার কল করছ কেন?

আপা, সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে! তহুরার বিয়া।

কখন?

আজকা রাইতেই।

ও হো! আমি তো ঢাকায়।

আপনি ঢাকায়! বলেই রাশেদা কাঁদতে লাগল।

বীণা আপা বললেন, তোমরা দীপারানী দিদিকে ফোন করো। মফিজ স্যারকে ফোন করো। আমি দেখি কী করা যায়।

দীপারানী হেডমিস্ট্রেসের ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

একটু পরে ফোনে পাওয়া গেল মইন স্যারকে।

রাশেদা বলল, স্যার, শুনছেন? তহুরার বিয়া।

মইন স্যার বললেন, ইহা কিয়া? তহুরার বিয়া।

রাশেদা বলল, স্যার চলেন। আমরা তহুরার বাড়ি ঘেরাও করুম। তহুরার বিয়া হইতে দিমু না।

মইন স্যার বললেন, দাঁড়াও একটু বীণার সাথে কথা বলে নিই।

টিমের ১০ জন মেয়েকে পাওয়া গেল সেই রাতে। তারা সবাই স্কুলের মাঠে জড়ো হয়েছে। বাকিরা আসে নাই। মইন স্যারও আছেন। তারা তিনটা রিকশাভ্যান ভাড়া করে রওনা দিল তহুরার বাড়ির দিকে।

পাকুড়পাড়ায় তহুরার বাড়ি। তার বাবা একজন কাঠমিস্ত্রি। তিনি একটা বড় কাজ পেয়েছেন। একটা বাড়িতে সবগুলো দরজা-জানালার কাজ। সেই বাড়িটা সরকারি একটা অফিস। তাঁর কন্ট্রাক্টর তহুরাকে কী কারণে দেখে থাকবে। সেই লোক এখন তহুরাকে বিয়ে করতে চায়। তহুরার বাবা রাজি।

বীণা আপা কী কী যেন বুদ্ধি দিয়েছেন মেয়েদের। বাজারের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েরা দোকান থেকে কিনল কতগুলো সুপারগ্লু।

আর এরই মধ্যে তারা জঙ্গল থেকে সাবধানে কেটে নিয়েছে কতগুলো বিছুটি পাতা।

তহুরাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, হ্যাজাক বাতি জ্বলছে। কতগুলো প্লাস্টিকের চেয়ার আনা হয়েছে।

একটু পরে মোটরসাইকেলের শব্দ আর হেডলাইটের আলোয় পুরো এলাকা চমকিত হয়ে উঠল।

কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে লাগল।

মোট ১২ জন এসেছে বরপক্ষ। এর মধ্যে মোটরসাইকেলে চড়ে দুজন মহিলাও এসেছেন।

তাঁদের বসার জন্য চেয়ার এগিয়ে দিল ফুটবলার মেয়েরা। সবার হাতে হাতে একটা করে ব্লেড।

সবাই প্রতিটা চেয়ারে সুপারগ্লু লাগিয়ে দিল।

সবচেয়ে বেশি করে সুপারগ্লু লাগাল রাশেদা। এই চেয়ারটা দেওয়া হলো বর সাহেবকে। তিনি পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে এসেছেন। তাঁর গলায় সোনার চেইন, হাতে ঘড়িও দেখা যাচ্ছে।

তাঁরা বসলেন।

তাঁদের শরবত এনে দেওয়া হলো।

বরপক্ষ শরবত খেল। তারপর মেয়েকে আনা হবে তাঁদের সামনে। তহুরার ছোট্ট শরীরটা একটা শাড়ি দিয়ে প্যাঁচানো হয়েছে। তাকে ধরে ধরে সামনে আনলেন তার খালা।

পাত্রপক্ষের মুরব্বি বললেন, সালাম দাও সবাইকে। বলো আসসালামু আলাইকুম।

তহুরা সবাইকে সালাম করল।

ওয়ালাইকুম আসসালাম।

মা, তোমার নাম বলো।

মোছাম্মৎ তহুরা বেগম।

তুমি কী কী রানতে পারো।

তহুরা বলল, আমি ভাত রানতে পারি। ডিম সিদ্ধ করতে পারি। আর কিছু পারি না।

আর কিছুই পারো না?

আমি পেনাল্টি শুট ভালো মারতে পারি।

মইন স্যার বললেন, হ হ। এইটা সে ভালো পারে।

মুরব্বি বললেন, সেইটা কোন পদের রান্না? আমি তো কোনো দিনও খাই নাই। ওইটা কি চাইনিজ?

রাশেদা বলল, না চাইনিজ না। ইংলিশ।

আর কী পারো মা?

আমি কর্নার কিক ভালো নিতে পারি।

এইটাও কি ব্রিটিশ?

না। এইটা মোগলাই। রাশেদা বলল।

এরই মধ্যে পাত্রপক্ষের অস্বস্তি শুরু হয়ে গেছে। তাদের কাপড়চোপড় চেয়ারের সঙ্গে লেগে গেছে। সুপারগ্লু কাপড় ভেদ করে তাদের চামড়ায় লেগেছে। বাইরের বাতাসে সেই গ্লু শুকিয়েও গেছে। তারা আর উঠতে পারছে না। নড়তে পারছে না। তারা উঠতে চাইলে চেয়ারও তাদের সঙ্গে উঠে যাচ্ছে। আর চামড়ায় ব্যথা লাগছে প্রচণ্ড।

এইটা কী হইল? এই তোমরা চেয়ারে কী দিছ?

কী বেইজ্জতি অবস্থা। উঠতে গেলেই ব্যথা লাগছে। চামড়া ছিঁড়ে যেতে চাইছে।

একটু পরে একটা টেম্পো এসে হাজির তহুরাদের বাড়ির খুলিতে। ভটভট শব্দ করে এল ভ্যান। তার পেছনে এলেন ধলু মাতুব্বর। মোটরসাইকেল চালিয়ে এসেছেন তিনি। ভ্যান থেকে নামল ছয়জন পুলিশ।

ধলু মাতুব্বর বললেন, ক্লাস ফাইভে পড়া মেয়েকে বিয়া করতে কে চান?

 সোনার চেইন পরা লোকটা বলল, আমিই তো চাইছিলাম।

পুলিশ বলল, ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। নাবালিকা বিবাহ করার চেষ্টা করায় আপনাকে থানায় নেওয়া হবে। ইউএনও সাহেব নিজে আপনার বিচার করবেন। ম্যাজিস্ট্রেট ওখানে বসে আছেন। চলেন...

যামু যে উঠুম কেমনে? পায়জামা ছিঁইড়া গেলে মায়া নাই। কিন্তু পাছার চামড়া যে ছিঁইড়া যায়...

ছিঁড়লে ছিঁড়বে। আপনারা ওঠেন। এই বরপক্ষের আর কেউ যাইতে চান থানায়? নাকি বর একলা যাইব? পুলিশের কমান্ডার বললেন।

না না। আমরা কেউ যামু না। আমরা তারে নিষেধ করছি। সে নিজেই আমগো ডাইকা আনছে।

তাইলে শুধু বররেই অ্যারেস্ট করা হইল।

তহুরার বাবা বললেন, এইটা কোনো কথা! এরপর আমি আমার মাইয়ারে বিয়া দিমু কেমনে?

তহুরা বলল, আমি বিয়া দরকার হইলে করুম না বাবা।

বিয়া করবি না তো কী করবি?

বিয়া করুম না। ফুটবল খেলুম।

আরে ফুটবল রে! এই ফুটবলই এই গ্রামটারে খাইল।

ধলু মাতুব্বর বললেন, কী বললা? ফুটবল গ্রামটারে খাইল! এইটারেও বান্দেন তো পুলিশ সাহেব।

তহুরার বাবা বললেন, না না, আমি তা কই নাই। পোলাও-কোর্মা রান্না হইছে। আপনেরা খাইয়া যান।

বরপক্ষের লোকদের তখন চেয়ার থেকে নিজেদের ছাড়িয়ে নিতে পেরেশানি চলছে। আর পোলাও-কোর্মা? কোনো রকমে ‘আহ, উহু, মরে গেলাম গো’ বলতে বলতে তারা নিজেদের ছাড়িয়ে নিল চেয়ারের আঠা থেকে।

তারপর মোটরসাইকেল চালিয়ে তারা বিদায় নিল।

শুধু বরটাকে পুলিশ নিয়ে গেল থানায়।

মারিয়া বলল, চাচি, পোলাও বাড়েন। আমরা হেল্প করতাছি। আইজকা আমরা পোলাও-কোর্মা খাইয়াই যামু।

তারা পেট ভরে পোলাও-কোর্মা খেতে লাগল।

তহুরার মা বলল, ভাগ্যিস তোমরা সময়মতো আইছিলা। নাইলে আমার জানের টুকরা তহুরারে ওরা বিয়া কইরা লইয়া যাইত। আমার মাইয়ার কি বিয়ার বয়স হইছে নাকি, কও দেহি! আল্লাহ তাআলা তোমাদের ঠিক সময়মতো পাঠাইছেন। নেও, তোমরা বেশি কইরা খাও। এটারে কয় রিজিক। কার খাওনের কথা আছিল আর কে খাইতাছে।

রাশেদা বলল, চাচি, পাক খুব ভালা হইছে। একটু লবণ দেন দেহি।

মারিয়া বলল, চাচি, আমারে আগে কইতেন, আমি গাছ থাইকা দুইটা লেবু পাইড়া আনতাম। লেবু কচলায়া খাইলে পোলাওয়ের টেস্ট লাগে হেভি।

***

দীপারানী বললেন, তোমাদের ঢাকায় যেতে হবে। ঢাকায় অনূর্ধ্ব-১৪ জাতীয় দল বানানো হচ্ছে। আমাদের ১২ জনকে সেই টিমের জন্য ডাকা হয়েছে।

রাশেদা বলল, আমরা যদি সেই টিমে যাই, তাইলে কী হইব?

তোমাদের ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচ খেলতে বিদেশে পাঠানো হবে। প্রথমে তোমরা যাবে শ্রীলঙ্কা।

রাশেদা বলল, শ্রীলঙ্কায় কি খালি লঙ্কা খাইতে হইব?

তা তো জানি না। আমি কুনুদিন শ্রীলঙ্কা গেছি নাকি।

এই মেয়েরা এখন সবাই পড়ে হাইস্কুলে। হাই স্কুলটাও প্রাইমারি স্কুলের সঙ্গেই। কিন্তু ঢাকা থেকে খবর এসেছে প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার কাছেই।

রাশেদা বাড়ি ফিরে বলল, মা, ঢাকা যাইতে হইব।

মা বললেন, ক্যান রে?

আমরা বিদেশে যামু ফুটবল খেলতে।

কস কী! দেশের মধ্যে থাকলেই আমগো কলিজা পুড়ে। আবার বিদেশ!

চলছে...

আরও পড়ুন