লঙ্কাকাণ্ড
কীর্তিমারী সদর থানার ইন্সপেক্টর রইসের মুখের দিকে তাকালেই তার মনের ভাব পড়তে পারে ছায়াসঙ্গী কামাল। বহুদিনের অভ্যাস বলে কথা। কামাল জানে, এ মুহূর্তে রেগে বোম হয়ে আছে ইন্সপেক্টর রইস।
জাঁদরেল পুলিশ অফিসাররা কখনোই রাগ প্রকাশ করে না, বরং নীরব হয়ে যায় আরও। এই লক্ষণ সকাল থেকেই দেখছে কামাল। না, পুরোপুরি ঠিক হলো না। সকালেও রইসের মেজাজ ভালোই ছিল। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, অ্যাডিশনাল এসপি রায়হান স্যারের ফোন আসার পর থেকেই চেহারা থমথমে হতে শুরু করেছে রইসের।
বিশেষ কোনো কাজ ছিল না, এমনিতেই সকাল সকাল থানায় এসে রইসের রুমের কোনায় একটা চেয়ারে বসে সাতপাঁচ ভাবছিল কামাল। মাথাভর্তি কাকের বাসার মতো চুলওয়ালা একহারা গড়নের কামালের পরনে মলিন জামাকাপড়, আচরণে বিনীত ভাব। এমনিতে ওর কাজ রইসের সোর্স হিসেবে কাজ করা, কীর্তিমারী জেলা শহরের নানান খবর রইসকে এনে দেওয়া। আজকে স্রেফ সালাম দিতে এসেছিল সে রইসকে। তারপর হয়তো বস্তিতে নিজের ছাপরাঘরে ফেরত গিয়ে রাশি রাশি বইয়ের স্তূপের কোনো একটায় ডুব দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। রইসের হাতেও বিশেষ কোনো কেস নেই, আগের কিছু কেসের কাগজপত্রের কাজ এগিয়ে রাখছিল সে।
খানিক বাদে যখন ফোনটা বেজে উঠল, সেটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই যে আড়ষ্ট হয়ে উঠেছিল রইস, সেটা কামালের ক্ষুরধার চোখ এড়ায়নি। রইস কিন্তু চুপচাপ শুনল ওপ্রান্তের কথা, মাঝেমধ্যে কেবল বিনীত ভঙ্গিতে ‘জি স্যার, অবশ্যই স্যার’ করল খালি।
ফোনটা কেটে দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রইল খানিকক্ষণ রইস। হাত গুটিয়ে নিয়েছে কাগজ থেকে। কামাল চুপ, জানে যে ওর জানার মতো কোনো ব্যাপার হলে রইস নিজেই বলবে ওকে।
হলোও তা-ই। বিনা দরকারে গলা খাঁকারি দিল রইস, তারপর বলল, ‘বুঝলে কামাল, তুমিই ভালো আছ।’
একটা হাসি উপহার দিল কেবল কামাল, কারণ ও জানে, রইসের কথাটা ভূমিকামাত্র। রইস দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘সরকারি চাকরি মানে কেবল সরকারের আদেশ মানা নয়। বসের কিছু আবদার পূরণ করাও। সে রকম কিছুই করতে যাই এখন, চলো।’
ব্যাপারটা যে পুরোপুরি অফিশিয়াল না, সেটা ইন্সপেক্টর রইসের যাত্রা-প্রস্তুতি দেখেই বোঝা গেল। সঙ্গে কোনো কনস্টেবল নেই, শুধু বাইক নিয়ে রওনা হলো। কামাল বাইক চালাচ্ছে, রইস পেছনে।
উত্তরবঙ্গের পুরোনো মফস্সল শহর কীর্তিমারী। দালানকোঠা বহু পুরোনো, রাস্তাঘাট সরু, তবে গাড়িঘোড়া লোকজন প্রচুর। কামাল দক্ষ হাতে বাইক চালাচ্ছে, কেবল মাঝেমধ্যে ওর চোখ চলে যাচ্ছে আকাশের দিকে। আগস্টের শেষ, বাংলা ক্যালেন্ডারে ভাদ্র মাস পড়েছে। একদিন ঝুমবৃষ্টি, আরেক দিন কাঠফাটা রোদ—এভাবেই চলছে। গতকালকে রোদের খরতাপ সইবার পরে আজকে বৃষ্টিতে ভেজাই সম্ভবত কীর্তিমারীবাসীর নিয়তি। আকাশে পাক খাচ্ছে কালচে মেঘ, তবে বেশ বাতাসও আছে। মেঘ কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা।
কীর্তিমারী সদর থানাটা শহরের পুরোনো অংশে। রইস আর কামাল চলেছে নতুন শহরের দিকে। পুরোনো শহরে দু-তিনতলার বেশি দালান নেই, নতুন শহরে কিন্তু দালানগুলোর চেষ্টা, কে কার ওপরে মাথা তুলতে পারে।
গন্তব্যের কাছাকাছি এসে নিজে থেকেই পরিস্থিতি খোলাসা করল রইস। ‘অ্যাডিশনাল এসপি রায়হান স্যার ফোন দিয়েছিলেন। ওনার পরিবার বেশ পয়সাওয়ালা, জানো মনে হয়। এক মামা কীর্তিমারীতে থাকেন। এখানেই ব্যবসা-বাণিজ্য। ওবায়দুল হাসান নাম।’
কীর্তিমারী শহরের নতুন-পুরোনো সব খবর যেমন কামালের কাছে থাকে, তেমনি পুরোনো বাসিন্দাদেরও ভালোমতো চেনে সে। ‘চিনি, স্যার। ওনার তো একটা নতুন বিল্ডিং বানাইতাছে, আমরা যেদিক যাইতিছি সেদিক। এখনো কাজ শেষ হয় নাই মনে হয়।’
‘হ্যাঁ, হাসান টাওয়ার মনে হয়। এখনো উদ্বোধন করেনি। ওই তো, দেখা যাচ্ছে।’ রইস আঙুল তুলল। তার দরকার ছিল না অবশ্য, এত উঁচু বিল্ডিং কীর্তিমারীতে আর নেই। পরিষ্কার ফুটে আছে মেঘের পটভূমিতে। শুধু উচ্চতা নয়, অদ্ভুত আকারটাও নজর কেড়ে নেয়। ছাদটা বেশ খানিক সামনে বাড়ানো, তারপর তিন-চারতলা ধরে বাঁক খেয়ে দালানের বাকি শরীরটার সঙ্গে মিশেছে। গোটা দালানটা নীলচে কাচে মোড়া।
রইস-কামালের গন্তব্য অবশ্য হাসান টাওয়ার নয়। শহরের নতুন অংশের প্রধান রাস্তার এক পাশে হাসান টাওয়ার, আর কামালকে তার উল্টো পারে বাইক থামাতে বলল রইস। না বললেও চলত অবশ্য, রাস্তার ওপরে একটা জটলা দেখেই কামাল বুঝতে পারত যে ওরা জায়গামতো চলে এসেছে।
স্যুট-টাই পরা বেঁটেখাটো টাকমাথা এক ভদ্রলোক এই জটলার প্রধান ব্যক্তি, সেটা বোঝা গেল উনি এগিয়ে আসাতে। ‘ইন্সপেক্টর রমিজ! চলে এসেছেন?’
‘রমিজ নয়, রইস,’ মৃদু হেসে বলল রইস। ‘আপনিই ওবায়দুল হাসান সাহেব?’
‘আচ্ছা, আচ্ছা।’ কথাটা হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়ে আসল কথায় গেলেন ওবায়দুল সাহেব, ‘আমার ভাগনে রায়হান আপনাকে সব খুলে বলেছে নিশ্চয়ই।’
‘স্যার খুব কমই বলেছেন আসলে। আপনি সম্ভবত প্রথমে সরাসরি মামলা করতে চাচ্ছিলেন। স্যার আমাকে বললেন বিষয়টা একবার সরেজমিন দেখতে, তারপর মামলা নেওয়ার মতো হলে পরবর্তী আনুষ্ঠানিকতায় যেতে।’ রইস বলল।
‘রায়হান যদি বুঝত এখানে আমার বিরুদ্ধে কত বড় ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তাহলে মামলা করার আগে এসব দেখা-টেখার দরকার হতো না।’ হাত নেড়ে বললেন ওবায়দুল সাহেব। ভদ্রলোক তড়বড়িয়ে দ্রুত কথা বলেন। ‘আচ্ছা, যা-ই হোক, এসেই তো পড়েছেন। আগে দেখুন, এই যে, রাস্তার ওই পাড়ে আমার হাসান টাওয়ার। দুই দিন আগে কেবল কাচ লাগিয়েছি, ভেতরের কাজ বাকি। একদম বিদেশের বিল্ডিংয়ের মতো হয়েছে, তাই না? আমার বিদেশে পড়ুয়া ছেলের ডিজাইন করা। এসব দেখলে শত্রুদের চোখ টাটায়, ভাই ব্যবসা করতে গিয়ে কম তো শত্রু হলো না। সে যাকগে, আজকে আপনাকে ডেকেছি আরেকটা সমস্যার জন্য। দেখতেই পাচ্ছেন, রাস্তার এপারেও আমার প্রপার্টি আছে।’
রইস খেয়াল করেনি, কিন্তু কামাল আশপাশে চোখ চালিয়ে ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছে। রাস্তার এপারে ফুটপাতের ওপর অনেকগুলো নতুন দোকানে একটা সারি গজিয়েছে। তার মধ্যে তিনটা খুব সহজেই নজর কেড়ে নেয়। তার কারণ খুব সহজ, সেগুলোর রংচঙে বিদেশি ধাঁচ। ওরা এ মুহূর্তে যে দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা যেন প্যারিসের কোনো রেস্টুরেন্ট। ফিকে সবুজ রঙের কাঠের প্যানেলিং করা দোকানের সামনেরটা, বিরাট কাচের জানালা। একই রঙের কাঠের দরজা। খানিকটা দেশি সংমিশ্রণও ঘটেছে—জানালার ওপরে লোহার রোলিং শাটার ফেলার ব্যবস্থা। চোরচোট্টাদের তো ঠেকাতে হবে!
একটা বিচিত্র জিনিস কামালের কেবল চোখে পড়তে শুরু করেছে, কিন্তু ততক্ষণে ওবায়দুল সাহেবই সেটার দিকে এগিয়ে গেছেন। সঙ্গের লোকগুলোও, যারা আসলে তাঁর কর্মচারী। ‘দেখুন! শত্রুর কাণ্ড দেখুন!’
রইস আর কামালও এগিয়ে গেল। বিশালদেহী রইসের কাঁধের পাশ দিয়ে উঁকি দিয়ে কামাল তা–ই দেখল, যা ওর চোখে পড়েছিল, একটা জানালার নিচে সবুজাভ কাঠের প্যানেলিংয়ের এক জায়গা কালচে হয়ে আছে। স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে, পোড়ার দাগ।
‘দেখুন!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন ওবায়দুল সাহেব। ‘শত্রুরা আমার কত বড় ক্ষতি করতে চায় দেখুন। আগুন দেওয়ার চেষ্টা করেছিল ওরা! ভাগ্যিস, কাঠে ঠিকমতো লাগেনি। একটু পুড়েই নিজে নিজে নিভে গেছে।’
রইস গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। ‘কবে ঘটেছে এটা?’
কামাল খেয়াল করল, ওবায়দুল হাসান সাহেবের কর্মচারীরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। ওবায়দুল সাহেব বিরক্তকণ্ঠে বললেন, ‘এটাই হয়েছে একটা সমস্যা। কেউ ঠিকমতো বলতে পারছে না। দাগটা আবিষ্কার হয়েছে গতকাল দুপুরে। আমার এই রেস্টুরেন্ট এখনো খোলেনি, বুঝলেন, আগামী সপ্তাহে খোলার কথা। বিল্ডিং করছি, আবার রেস্টুরেন্ট দিচ্ছি—এগুলো মানুষের সহ্য হবে কেন! তাই একদম সময় বুঝে আগুনটা দিয়েছে, যাতে আমার তিনটা দোকানই...’
ওবায়দুল সাহেবের কথার তোড়ে বাধা দিয়ে রইস বলল, ‘এখানে তিনটা দোকান আপনার?’
‘জি হ্যাঁ। এই যে রেস্টুরেন্ট, তার দুই পাশে, দেখতেই পাচ্ছেন, ফার্নিচারের বিশাল দোকান আর কাপড়ের দোকান। ফার্নিচারের দোকানে বহু টাকার মাল আছে, বুঝতেই পারছেন। আবার কাপড়ের দোকানটাও ফেলনা নয়। সব বিদেশি ব্র্যান্ডের জিনিস।’
‘আগুনটা কে দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে মনে হয়?’ রইস প্রশ্ন করল।
‘মনে হওয়া নয় শুধু, আমি প্রায় নিশ্চিত যে কে আগুন দিয়েছে! সে জন্যই তো সরাসরি মামলা করতে চাচ্ছিলাম। বদিউর রহমান, আমার সাবেক ব্যবসায়িক পার্টনার। আমাদের জয়েন্ট ভেঞ্চার রহস্যময়ভাবে ব্যর্থ হবার পর বছর দশেক আগে নিজেই ব্যবসা খুলে বসে। তারপর তরতর করে উন্নতি। এখন খালি আমার পেছনে লাগতে আসে। আমি যেখানে নতুন কোনো প্রপার্টি করি, তারও করা চাই। আমি কোথাও দোকান খুললে, সে-ও নকল করে একটা দোকান দিয়ে বসবে। ওই যে দেখুন।’ আঙুল তুলে দেখালেন ওবায়দুল সাহেব।
রইস আর কামাল তাকিয়ে দেখল, রাস্তার উল্টো পাশে হাসান টাওয়ারের সঙ্গেই দুটো দোকান দেখাচ্ছেন ওবায়দুল সাহেব। একটা রেস্টুরেন্ট, আরেকটা রেডিমেড জামার দোকান।
‘আমার হাসান টাওয়ারের দুই পাশ দখল করেছে। কে জানে কোন শয়তানি বুদ্ধি আঁটছে!’ চোখমুখ শক্ত করে বললেন ওবায়দুল সাহেব।
‘আপনি সন্দেহ করছেন, বদিউর সাহেবের লোক আপনার দোকানে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করেছে?’ রইস বলল।
‘লোক না, লোক না!’ হাত, পা, মাথা নেড়ে তীব্র প্রতিবাদ জানালেন ওবায়দুল সাহেব, ‘বদিউর নিজেই দিয়েছে!’
‘উনিই আগুন দিছে, এটা আপনার ক্যান মনে হইল?’ কামাল এতক্ষণে প্রথম প্রশ্ন করল।
ওবায়দুল হাসানের চাউনি দেখে মনে হলো উনি ভাবছেন, এ আবার কে! উত্তর অবশ্য উৎসাহের সঙ্গেই দিলেন। ‘কীভাবে আবার! রেস্টুরেন্টটা এখনো চালু হয়নি, কিন্তু আমার অন্য দুটো দোকানের কর্মচারীরা দেখেছে, বদিউর বারবার হাঁটে এপাশের ফুটপাত দিয়ে। মাঝেমধ্যে থেমে পড়ে। এদিক-ওদিক তাকায়। সন্দেহজনক ভঙ্গি।’
কয়েকজন কর্মচারী মাথা নেড়ে একমত হলো।
‘ভেবে দেখুন! ওর এদিকে কাজ কী? ওর দোকান তো রাস্তার উল্টো পাশে। এদিকে সন্দেহজনক ঘোরাফেরার উদ্দেশ্য একটাই, আমার সম্পত্তির কীভাবে ক্ষতি করা যায় তার ফিকির খোঁজা।’
রইস হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। রেস্টুরেন্টের কাছে গিয়ে কাঠের প্যানেলিংয়ের গায়ে পোড়া দাগটা আবার দেখতে শুরু করল ভালো করে। লম্বাটে পোড়া, খানিকটা তির্যক। পোড়াটা সমান নয়, মাঝের অংশটুকু বেশি কালো আবার কিনারাগুলো আবছা। মানে আগুনের তাপটা ওসব জায়গায় ভালো করে লাগেনি। তবে রইসের দৃষ্টি কেড়ে নিল পোড়াটার নিচের কিনারা।
স্বভাবসুলভ তীব্র প্রতিক্রিয়া জানালেন ওবায়দুল সাহেব। ‘তাহলে সিগারেটের টুকরা কই? আমরা কোনো জিনিস সরাইনি। খালি একটা লোহার ভাঙা চেয়ার ছিল এখানে, ওটা সরিয়ে রেখেছি আপনাদের দেখার সুবিধার জন্য।’
কামাল নেই পাশে। তার খোঁজে এদিক-ওদিক তাকাল রইস। ফুটপাতের কিনারায় গিয়ে উদাস চোখে রাস্তার উল্টো পাশে তাকিয়ে আছে কামাল। ভুরু কুঁচকে গেল রইসের, কামাল কখনো এ রকম অমনোযোগী হয় না সাধারণত। ডাক দিল সে। বসের ডাক শুনে ঘোর ভাঙল যেন কামালের, দ্রুত পাশে চলে এল।
‘দাগটা একটু অদ্ভুত না?’ রইস বলল।
‘জি স্যার।’ কামাল একমত হলো, তারপর সেই জিনিসটা দেখাল, যেটা খাপছাড়া লেগেছে রইসের কাছে। ‘দাগটার নিচের দিকখান দেখেন। ওইংকা ক্যান?’
ও রকম কেন, সেটা জানতে চাচ্ছে রইসও। দাগের অন্য কিনারাগুলো ধীরে ধীরে শুরু হয়ে মাঝখানে এসে গাঢ় হয়েছে, কিন্তু নিচের প্রান্তটা হুট করে শেষ হয়েছে প্রায় সমান একটা পাশ নিয়ে। বা বলা যায়, নিচের দিক থেকে হঠাৎ পোড়া দাগটা শুরু হয়েছে অনুভূমিক একটা লাইন ধরে।
‘আমার ধারণা, কোনো একটা কাপড়ে আগুন লাগিয়ে সেটা ফেলা হয়েছিল কাঠের প্যানেলিংয়ের ওপর।’ রইস অনিশ্চিত কণ্ঠে বলল। ‘সেটারই কিনারার ছাপ।’
‘তাইলে সেই কাপড়টা কোন্টে গেল, স্যার?’ সঠিক প্রশ্নটা তুলল কামাল।
তাই তো! ওবায়দুল সাহেবের কর্মচারীদের প্রশ্ন করে জানা গেল, তারা কেউ ওখানে জ্বলন্ত কোনো কাপড় বা কাগজের টুকরো দেখেনি। একটু ছাইও না। সত্যি বলতে কি, আগুনের শিখাও কেউ দেখেনি। সারা দিন কেউ ছিল না এখনো চালু না হওয়া রেস্টুরেন্টের সামনে, বিকেলে একজন এসেছিল বিদ্যুৎ লাইনের মিস্ত্রিকে নিয়ে। সে-ই পোড়া দাগটা দেখতে পায়।
‘এমনকি হতে পারে না যে অন্য কেউ আগুনটা দিয়েছে? ভুলবশতও হতে পারে। সিগারেটের টুকরা থেকে?’ রইস ওবায়দুল সাহেবকে বলল।
স্বভাবসুলভ তীব্র প্রতিক্রিয়া জানালেন ওবায়দুল সাহেব। ‘তাহলে সিগারেটের টুকরা কই? আমরা কোনো জিনিস সরাইনি। খালি একটা লোহার ভাঙা চেয়ার ছিল এখানে, ওটা সরিয়ে রেখেছি আপনাদের দেখার সুবিধার জন্য।’
‘তাইলে বদিউর সাহেব আগুন দিলেন কেমন করিয়া?’ বিনীত কণ্ঠে প্রশ্ন করল কামাল।
‘সেটা বের করার কাজ পুলিশের,’ গম্ভীর স্বরে বললেন ওবায়দুল সাহেব। ‘আমার ধারণা, কোনোভাবে লাইটার বা ব্লো টর্চ দিয়ে আগুন ধরানোর চেষ্টা করেছিল সে বা তার কোনো চামচা, যখন দেখল আগুনটা লাগছে না, তখন ভেগেছে।’
‘বদিউর সাহেবকে কোথায় পাব, বলতে পারেন?’ রইস জিজ্ঞেস করল।
‘কোথায় আবার! ওই ওর দুটো দোকানের কোনো একটাতেই আছে শয়তানটা। একটু আগে ঢুকতে দেখলাম। সারা দিন নিজের কোনো না কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সময় কাটায় সে। দেখলেই চিনবেন, মাথায় কাঁচা-পাকা চুল আর মোটা ফ্রেমের চশমা পরা। আপনার মতোই গোঁফ আছে।’ ওবায়দুল সাহেব বললেন, ‘দেখুন, ওর সঙ্গে এত কথা বলার কিছু নেই। থানায় চলুন, মামলা করব আমি। তারপর বদিউরকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সব জানতে পারবেন। আমার ভাগিনা রায়হানের সঙ্গে কথা বলে নিতে পারেন চাইলে,’ শেষের কথাটা মুখ একটু উঁচিয়ে ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটিয়ে বললেন ওবায়দুল সাহেব।
‘স্যারের সাথে কথা হয়েছে আমার। মামলা নেবার আগে পুরো জিনিসটা ভালোভাবে খতিয়ে দেখার পরামর্শটা ওনারই।’ রইস শান্ত কণ্ঠে বলল।
থতমত খেলেও সেই ভাবটা বেশিক্ষণ চেহারায় ধরে রাখলেন না ওবায়দুর সাহেব। ‘যান, কথা বলুন তাহলে বদিউরের সাথে। শয়তানটা এতক্ষণে না পালালেই বাঁচি।’ এবার রইসকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পকেট থেকে ফোন বের করলেন তিনি, সম্ভবত ভাগনের কাছে জানতে চাইবেন যে বদিউর রহমানকে সরাসরি গ্রেপ্তারের আদেশ তিনি দেননি কেন।
রইস ঘুরল। কামাল কিন্তু পাশে নেই, খানিকটা দূরে ফুটপাতের কিনারায় দাঁড়িয়ে হাসান টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে সে। রইস দুবার ডাকার পর ঘোর ভাঙল তার, তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এল।
‘কী হলো?’ প্রশ্ন করল রইস। ‘বদিউর সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে হবে। চলো।’
‘আকাশ দেখতিছিলাম স্যার। বাতাস হইতাছে, মনে হয় খানিক পরে মেঘ কাটি যাবে।’ কামাল বলল।
‘গেলে যাক। এই ঝামেলাটা শেষ করে থানায় ফিরতে পারলে বাঁচি। মেঘ-বৃষ্টি নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।’
‘বৃষ্টি হইলে রহস্যের সমাধানটা কয়েক দিন পিছি যাবে, স্যার।’ বলল কামাল। ওর চোখে একটা ক্ষুরধার দৃষ্টি ঝকঝক করছে। ‘এই দুই বড়লোক মিলিয়া একটা লঙ্কাকাণ্ড বাধাইবেন মনে হইতেছে। বৃষ্টিতে আগুন নেভে, কিন্তু আজকে মনে হইতেছে বৃষ্টি হইলেই আগুন জ্বলবে!’ যা বলল সেটার কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই যোগ করল সে, ‘চলেন স্যার। যত তাড়াতাড়ি করা যায়।’
‘করলে করুক। কিন্তু উনি যেন মাথায় রাখেন, আমিও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নই। প্রতিপক্ষকে কীভাবে চোখে চোখ রেখে মোকাবিলা করতে হয়, সেটা ওনার থেকেই শেখা। আদালতে হোক, কিংবা বাইরে হোক, ওনার যেমন ষন্ডামার্কা কর্মচারী আছে, আমারও আছে। আমার হয়ে লড়তে পিছপা হবে না ওরা।’
রইস আর কামাল নিশ্চিত ছিল না কোন দোকানটায় পাওয়া যাবে বদিউর সাহেবকে। রেডিমেড জামার দোকানটাতেই ঢুকল প্রথমে। ভাগ্য সহায়, কারণ কাউন্টারের পেছনে যে লোকটা বসে আছেন, তিনিই নিশ্চয়ই বদিউর সাহেব। কাঁচা–পাকা চুল, গোঁফ আর চশমার বর্ণনা তো মিলছেই, তা ছাড়া পুলিশের জামা পরা একজনকে ঢুকতে দেখেই চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ওনার। দুর্বল কণ্ঠে বললেন, ‘আমার কর্মচারীরা লাঞ্চে গেছে। কোনো কিছু নিতে চাইলে দেখতে পারেন। অবশ্য আমার মনে হচ্ছে না আপনারা জামাকাপড় কিনতে এসেছেন।’
‘ঠিক ধরেছেন বদিউর সাহেব।’ কাউন্টারের কাছে এগিয়ে নিজের পরিচয় দিল রইস। কামাল পেছনে রইল, চোখ ঘুরিয়ে দোকানের সবকিছু দেখছে।
সামান্য দু–এক কথায় পর আসল প্রসঙ্গে চলে গেল রইস। ‘শুনেছি আপনি আর ওবায়দুল সাহেব আগে ব্যবসায়িক পার্টনার ছিলেন। এখন তিনি দাবি করছেন, আপনি চেষ্টা করছেন ওনার দোকানপাটে আগুন দেওয়ার।’
বদিউর সাহেবের চেহারাটা আরও এক দফা ফ্যাকাশে হলো। ‘ওবায়দুল ভাই আমার শ্রদ্ধার পাত্র। ওনার সঙ্গে আমার ব্যবসাটা সাফল্যের মুখ দেখেনি, দুঃখের বিষয়। কিন্তু ওনার থেকে ব্যবসার খুঁটিনাটি অনেক কিছু শিখেছি আমি। ওবায়দুল ভাইয়ের কোনো ক্ষতি করার কথা আমি ভাবতেও পারি না।’
‘ওনার কর্মচারীরা নাকি আপনাকে দেখেছে ওই দোকান দুটির পাশে বারবার হাঁটাহাঁটি করতে।’ রইস বলল।
‘ফুটপাতটা সরকারি। তা ছাড়া আমি কেন ওদিকে হাঁটাহাঁটি করি, তার কারণটা ব্যক্তিগত।’ বদিউর সাহেব কণ্ঠে খানিকটা জোর আনার চেষ্টা করে বললেন।
‘আপনি জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে আগুন ধরানোর চেষ্টা করেছেন, ওবায়দুল সাহেবের অভিযোগ এটা।’ বলল রইস।
বদিউর সাহেবের চেহারায় এখনো রং ফেরেনি, কিন্তু একটা ক্ষীণ হাসি ফুটতে দেখা গেল তাঁর ঠোঁটের নিচে। ‘ইন্সপেক্টর সাহেব, ওবায়দুল ভাই মনে হয় ঠিক করে ফেলেছেন যে আমার বিরুদ্ধে মামলা করবেন। তাই না?’
অস্বস্তি চেপে রইস উত্তর দিল, ‘জি।’
‘করলে করুক। কিন্তু উনি যেন মাথায় রাখেন, আমিও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নই। প্রতিপক্ষকে কীভাবে চোখে চোখ রেখে মোকাবিলা করতে হয়, সেটা ওনার থেকেই শেখা। আদালতে হোক, কিংবা বাইরে হোক, ওনার যেমন ষন্ডামার্কা কর্মচারী আছে, আমারও আছে। আমার হয়ে লড়তে পিছপা হবে না ওরা।’
এই কথার কোনো জবাব হয় না। ‘আসি, বদিউর সাহেব।’ বলে কামালকে নিয়ে বেরিয়ে বসতে যাবে, কিন্তু কামাল নড়ছে না।
‘উনি যে দোকান দিছেন, আপনিও ঠিক একই রকম দোকান দিছেন রাস্তার এপাকে।’ কামাল বলে উঠল। ‘কারণটা কওয়া যাইবে?’
মুচকি হাসিটা ধরে রেখে বদিউর সাহেব বললেন, ‘না। কারণটা ওবায়দুল ভাইকে জিজ্ঞেস করবেন, ওনার জানা আছে। না-জানার ভান করলে অবশ্য অন্য কথা। যাকগে, আপনাদের তদন্তের জন্য শুভকামনা রইল।’
ফুটপাতে বেরিয়ে এল রইস আর কামাল। রইস মাথায় পুলিশ ক্যাপ বসাতে-বসাতে বলল, ‘বড় সহজ লোক নন বদিউর সাহেব, বোঝা যাচ্ছে। কেমন যেন নার্ভাস দেখাচ্ছে, অথচ বোঝা যাচ্ছে যে বিনা যুদ্ধে কখনো হার স্বীকার করেন না।’
রইসের কথা যেন কানেই ঢুকছে না কামালের, ঘাড় বাঁকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ও। ‘স্যার, দেখেন, বাতাসে মেঘ কাটি যাইতেছে! মনে হয় আরেকটু পরেই রোদ উঠবে। আমাদের রহস্যখান সমাধান হইতে মনে হয় আর বেশি বাকি নাই।’
চোখ কোঁচকাল রইস। ‘কী বলছ, কামাল? রহস্য এত তাড়াতাড়ি আবার সমাধান হবে কীভাবে?’
এবারও যেন কথাটা শুনতে পায়নি কামাল। ‘স্যার, ওই যে ওবায়দুল সাহেব হাত নাড়ি ডাকতেছে আমাদেরকে। চলেন ওনার ওই দিকে যাই।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগোল রইস। ঠিক বলেছে কামাল, তাড়াতাড়ি এখানকার ঝামেলা চুকিয়ে থানায় ফিরতে হবে। অনেক কাজ জমে আছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত নির্দেশ না থাকলে একজন এএসআইকে পাঠিয়েই কাজ সারত সে।
রাস্তা পেরিয়ে ওপাশে যেতেই ওবায়দুল সাহেব জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, ‘কী, সব অস্বীকার করল সে, তাই না? আপনার সময় নষ্ট হবে শুধু শুধু, বলেছিলামই তো। তাহলে চলুন থানায়, মামলাটা করে ফেলি বদিউরের বিরুদ্ধে।’ কোটের পকেট থেকে আইফোনটা বের করলেন তিনি। ‘তার আগে আমার ভাগনে মানে আপনার রায়হান স্যারের সঙ্গে কথা বলে নিই আবার। এবার নিশ্চয়ই...’
‘একটু অপেক্ষা করেন, স্যার।’ কামাল বলে উঠল।
সব কটা চোখ ঘুরে গেছে ওর দিকে। ওবায়দুল সাহেব অবিশ্বাসের সুরে বলে উঠলেন, ‘কী বললে?’
‘বললাম, একটু অপেক্ষা করেন। বদিউর সাহেব আপনার দারুণ শিষ্য, স্যার, সব গুণগুলা পাইছেন। উনি কিন্তু আপনার সঙ্গে সমানতালে লড়বেন। আদালতে বলেন, রাস্তায় বলেন। তবে আপনার মনে হয়, খানিক অপেক্ষা করলেই সব বুঝি যাবেন। আন্দাজি রক্তক্ষয় হবে না।’
রাগের চোটে চেহারা লাল হয়ে গেছে ওবায়দুল সাহেবের। ‘তোমার সাহস তো কম না! আমাকে অপেক্ষা করতে বলার তুমি কে হে? রইস সাহেব, এসব কাদের নিয়ে আসেন? পুলিশের সোর্স এ রকম বেয়াদব হয়?’
যেন ওবায়দুল সাহেবের মেজাজের সঙ্গে মিল রেখেই ঝকমকে রোদ নামল। চামড়ায় রীতিমতো আঁচ লাগতে শুরু করেছে এরই মধ্যে।
ভেতরে–ভেতরে ভীষণ বিরক্ত হয়ে উঠেছে রইসও। কামাল মাঝেমধ্যে খাপছাড়া আচরণ করে বটে, কিন্তু আজকেরটা বড্ড বেশি মনে হচ্ছে। ‘কামাল, তোমার আর কিছু বলার দরকার নেই। আমি বিষয়টা দেখছি।’
কামাল যেন শুনতেই পায়নি রইসের কথা। ‘স্যার। আপনি সরি দাঁড়ান। তিন পাও পেছনে চলি যান।’
ওবায়দুল সাহেব কুলকুল করে ঘামতে শুরু করেছেন, মনে হয় ক্রোধের আতিশয্যেই। এবার তোতলাতে শুরু করলেন, ‘তুমি...তোমার সাহস তো কম না! এই, তুমি বদিউরের হয়ে কাজ করছ নাকি?’
রইস কিছু বুঝে ওঠার আগেই কামাল নির্বিকার ভঙ্গিতে সামনে এগোল, খামচে ধরল ওবায়দুল সাহেবের কোটের আস্তিন।
ওবায়দুল সাহেবের কর্মচারীরা বিপদ আঁচ করে এগিয়ে এসেছিল আগেই। হুট করে মাথা বিগড়ানো কামালকে থামাতে ওরা তৎপর হলো এবার। কামাল টেনে সরানোর চেষ্টা করছে ওবায়দুল সাহেবকে, ওকে তিন দিক থেকে পাকড়াও করতে এগোল তিনজন।
চেষ্টা করাই সার। ওবায়দুল সাহেবের পাশের একটা কর্মচারী যন্ত্রণায় কাতরে উঠে হুড়মুড়িয়ে পিছিয়ে গেল, চোখেমুখে তীব্র আতঙ্ক।
‘আপনার ছেলে পাস করে বের হলে নিশ্চয়ই দারুণ আর্কিটেক্ট হবেন, কিন্তু আপাতত হাসান টাওয়ার ভেঙে ঠিক না করলে সমস্যাটার সমাধান হবে না।’ রইস বলল। ‘এটা একটা বিপজ্জনক ঘটনা, পৌরসভাতে রিপোর্ট করতেই হবে।’ সে যা বলল না সেটা হচ্ছে, এবার আর অ্যাডিশনাল এসপি ভাগনের প্রভাব খাটাতে পারবেন না ওবায়দুল সাহেব।
‘আরে, কী হলো তোমার?’ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে বললেন ওবায়দুল সাহেব।
‘আগুন, স্যার! ঘাড়ের ওপরে কে য্যান আগুনের ছ্যাঁকা দিল!’ কর্মচারীটা ঘাড়ে একটা হাত চেপে ধরে বলল।
ওবায়দুল সাহেবকে ততক্ষণে খুব শান্তভাবে টেনে এক পাশে সরিয়ে এনেছে কামাল। ‘স্যার, ও ঠিকই কইছে। আগুন। আপনি সরি না দাঁড়াইলে আপনাকেও ছ্যাঁকা দেবে।’
‘ক্কে-কে ছ্যাঁকা দিচ্ছে? ভৌতিক কারবার নাকি!’ ওবায়দুল সাহেবের চেহারাটা হয়েছে দেখার মতো।
‘আগে এইটা দেখেন স্যার।’ আঙুল নির্দেশ করে বলল কামাল।
সবাই তাকাল। রেস্টুরেন্টের বাইরের কাঠের প্যানেলিংয়ের একটা জায়গায় একটা কয়েনের সমান হয়ে পড়েছে একটা উজ্জ্বল আলোর রশ্মি। চোখধাঁধানো। এতটাই যে কাঠের গা থেকে ধোঁয়া উঠতে শুরু করেছে রীতিমতো।
‘এই যে, এইভাবে আগের দিনের ওই পোড়া দাগটা তৈরি হইছিল,’ ম্লান হেসে বলল কামাল। ‘দেখেন, আগের দিনের পোড়াটার একটু পাশেই কাঠটা পুড়াচ্ছে ওটা।’
রইস এতক্ষণে বলতে পারল, ‘তার মানে এই রশ্মিটা আসছে...’
আরেকবার আঙুল তুলল কামাল, এবার বিপরীত দিকে। ‘ওবায়দুল সাহেবের প্রিয় হাসান টাওয়ার থাকিয়া।’
কামালের ব্যাখ্যা চুপচাপ শুনল সবাই। ‘ওই যে দেখেন, বিল্ডিংটার ওপরের দিকটা সামনের দিকে আগানো। তারপর গা-টা ভেতরের দিকে ঢালু হয়া নিচের দিকে নামছে। সেটা আবার নীল রঙের কাচ দিয়া ঢাকা।’
বুঝে গেছে রইস। ‘রিফ্লেকটিভ কাচ। আলো প্রতিফলিত হয় বেশির ভাগটাই। পুরো বিল্ডিংটা একটা অবতল দর্পণ হিসেবে কাজ করছে। সূর্যের আলো একটা বিন্দুতে একখানে করছে। সেটা যখন কাঠের গায়ে পড়ছে, কাঠটা পুড়িয়ে কালো করে দিতে শুরু করেছে। তবে একেবারে দাউ দাউ করে জ্বলানোর জন্য যথেষ্ট না।’
‘তবে মানুষের চামড়া পোড়ানোর জন্য যথেষ্ট,’ কামাল বলল। ‘এই জন্যই ওবায়দুল সাহেবকে সরতে কইতিছিলাম; কারণ, উনি আরেকটু নড়লেই রশ্মিটা ওনার গায়ে পড়ত। ওনার কর্মচারী ওই জায়গাতে গিয়াই ছ্যাঁকাটা খাইছে।’
ততক্ষণে কর্মচারীরা ছোটাছুটি করে রেস্টুরেন্টের শাটার নামিয়ে ফেলেছে, আর কোথা থেকে টুকরা টিন এনে হেলান দিয়ে দিল কাঠের প্যানেলিংয়ের গায়ে। এবার আর পোড়ার ভয় নেই।
‘তুমি এই জন্যই রোদ ওঠার অপেক্ষা করছিলে, তাই না?’ রইস বলল।
‘জি স্যার। বিল্ডিংয়ে কাচ লাগাইছে দুই দিন আগে মাত্র। তার মধ্যে এক দিনই রোদ উঠছিল, গতকাইল, ওই দিন ওই পোড়া দাগটা হইছে। আজকে সকালে রইদ থাকায় কিছু হয় নাই। একটু আগে রইদ উঠছে, ওই জন্য বিল্ডিংটা আবার অবতল দর্পণের মতো কাজ করতিছে। প্রথমবার বিল্ডিংটা দেখিয়াই সন্দেহ হইছিল আমার। বাইরের দেশে এ রকম অনেকগুলা কেস আছে। কিন্তুক রইদ না উঠলে নিশ্চিত হবার পাচ্ছিলাম না।’
ওবায়দুল সাহেব যেন চুপসে গেছেন। ‘আমার ছেলের ডিজাইন করা বিল্ডিং...আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না।’ একটু চুপ থেকে যেন নিজেকেই বললেন, ‘আমেরিকায় আর্কিটেকচারে পড়ছে ও। সেকেন্ড ইয়ারে। ও নকশা করে পাঠিয়েছে, দেশে আমার পরিচিত এক আর্কিটেক্ট কেবল সেটা নিজের ফার্মের হয়ে চূড়ান্ত করেছে।’
‘আপনার ছেলে পাস করে বের হলে নিশ্চয়ই দারুণ আর্কিটেক্ট হবেন, কিন্তু আপাতত হাসান টাওয়ার ভেঙে ঠিক না করলে সমস্যাটার সমাধান হবে না।’ রইস বলল। ‘এটা একটা বিপজ্জনক ঘটনা, পৌরসভাতে রিপোর্ট করতেই হবে।’ সে যা বলল না সেটা হচ্ছে, এবার আর অ্যাডিশনাল এসপি ভাগনের প্রভাব খাটাতে পারবেন না ওবায়দুল সাহেব।
সে রকম কোনো ইচ্ছাও ওবায়দুল সাহেবের আছে বলে মনে হচ্ছে না। একবার কেবল দুর্বল কণ্ঠে বললেন, ‘কিন্তু পোড়া দাগটা ও রকম লম্বা কেন? নিচের দিকটা সমান কেন?
‘সূর্য সরবার ধরলে আলোর রশ্মিটাও সরবার ধরে, তাই দাগটা লম্বা। আর ওই দিন একটা লোহার চেয়ার রাখা আছিল এইখানে। সেইটাত যখন বাধা পাইছে তখন পোড়া দাগটা থামি গেছে।’ কামাল বলল।
‘যাক, তুমি একটা বড় ভুল–বোঝাবুঝির অবসান ঘটালে, কামাল।’ ওবায়দুল সাহেব বললেন। ‘যদিও আমার মনে হয় না যে বদিউর ওর প্রতিযোগিতা থামাবে। আমার দোকানের পাশে দোকান দিয়েছে...’
‘স্যার, এটা কিন্তু ব্যবসার একটা সাধারণ নিয়ম। ফাঁকা জায়গা, নতুন দোকানপাট। এইখানে আপনার নতুন দোকান একাই সব ব্যবসা করবে, তাই খদ্দের ধরার জন্য উনিও ও রকম দোকান দিয়েছেন।’ রইস বলল। কলেজে পড়া কমার্সের জ্ঞান কাজে লাগছে তার।
বড় করে একটা শ্বাস ছাড়লেন ওবায়দুল সাহেব। ‘দেখি, বদিউরের সঙ্গে কথা বলতে হবে। একটু একগুঁয়ে সে, কিন্তু ভালো মানুষ। ওর হার্ট অ্যাটাক আর ওপেন হার্ট সার্জারি হওয়ার পরে দেখতে যাওয়া উচিত ছিল। বেটার লেট দ্যান নেভার।’
‘অবশ্যই কথা কবেন স্যার ওনার সঙ্গে। আর আরেকটা জিনিস বুঝি গেলাম। ওনাকে খুব ফ্যাকাশে দেখাইতেছিল। আমরা ভাবতিছিলাম, অপরাধের ভয়। আসলে তো ওনার হৃদ্রোগ আছে,’ কামাল বলল।
রইস পিঠ চাপড়ে দিল কামালের। ‘শাব্বাশ, কামাল। কীর্তিমারীর দুই বড় ব্যবসায়ীর মধ্যে একটা লঙ্কাকাণ্ড হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিলে তুমি।’
কামাল কিছু বলল না, তার বদলে ঝকঝকে একটা লাজুক হাসি ফুটল ওর মুখে। রোদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে যেন সেটার উজ্জ্বলতা।