লাল পাহাড় (অষ্টম পর্ব)

অলংকরণ: আরাফাত করিম

আমতলায় জরুরি মিটিং।

কৌশিকদার ব্যাপারটা এখন মোটামুটি সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। জিনিসটাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য রনি ডালপালা গজিয়ে একটা গল্পই ফেঁদে বসল। সে নাকি কৌশিকদাকে পঞ্চম মাত্রার জগতে একঝলক দেখে ফেলেছে!

‘কী বলছিস?’ মিলু বিস্ময় প্রকাশ করল। ‘তাহলে কি কৌশিকদা এখন মানুষ থেকে এলিয়েন হয়ে গেছে? চেহারাটা কেমন হয়েছে বল তো?’

‘বললাম তো, আমি দেখেছি মাত্র একঝলক। ধর, এক সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগ সময়ে যতটুকু দেখা সম্ভব।’

‘তুই কী করে বুঝলি, এক সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগ সময়ে দেখেছিস?’

‘ভার্নিয়ার স্কেল দিয়ে সময় মেপেছিলি তখন, তাই না?’ হি হি করে হেসে উঠল সবাই।

‘উফ্, তোরা থামবি, প্লিজ?’ রাব্বি চেঁচিয়ে উঠল। বলল, ‘আমাদের এখন সবচেয়ে জরুরি কাজটা করতে হবে। কৌশিকদাকে পঞ্চম মাত্রার জগৎ থেকে চতুর্থ মাত্রার জগতে ফিরিয়ে আনতে হবে।’

‘সেটা কীভাবে?’

‘আচ্ছা, তোরা যে স্কুলের ল্যাব থেকে ইনফ্রারেড চশমাটা চুরি করলি, সেটা দিয়ে অন্ধকারে দেখেছিস, চশমাটা কাজ করে?’ নেলির কথায় খুবই আহত হলো রাব্বি। গম্ভীর হয়ে বলল—

‘এটা চুরি নয়।’

‘তাহলে কী।’

‘এটা বিজ্ঞান গবেষণার একটা অংশ।’

‘এহ্, বিজ্ঞান গবেষণার একটা অংশ না হাতি...তোরা দুটোই চোর। স্কুল খুললেই আমি বিজ্ঞান স্যারকে বলে দেব, তোরা ল্যাবের ইনফ্রারেড চশমা চুরি করেছিস। তোরা সব চোরের দল।’ বলে নেলি উঠে দাঁড়ায়। তার মানে সে আর এই দলে নেই। রাব্বি খুবই বিরক্ত হয়ে রনির দিকে তাকাল। রনি সব ফাঁস করে দিয়েছে। এখন সামলাও।

‘তুই আমাদের চোর বললি কেন?’ এবার রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠল রনি।

‘বাহ্‌, চোরকে চোর বলব না তো কি সাধু বলব?’

‘তাই বলে আমরাও চোর নাকি? আমরা তো ওদের সঙ্গে চশমা চুরি করতে যাইনি।’ পাশ থেকে ঝন্টু বলে।

‘চোরের সঙ্গে যারা থাকে তারাও চোর! আমি চোরদের সঙ্গে নেই।’ বলে হন হন করে হেঁটে চলে গেল নেলি।

তুই একটা আস্ত গাধা। তোর জন্য এখন আমরা সবাই চোর হয়ে গেলাম। কেন নেলিকে বলতে গেলি এসব?’ বিরক্ত হয়ে বলল রাব্বি।

‘কী? আমি গাধা?’ হঠাৎ রনি ঝাঁপিয়ে পড়ল রাব্বির ওপর। সত্যি, অনেক দিন নিজেদের মধ্যে মারামারি হয় না। অন্যরা হইহই করতে লাগল। রনি আর রাব্বি জাপটা-জাপটি করে মারপিট শুরু করে দিল। একবার রনি ওপরে, একবার রাব্বি ওপরে...আবার রাব্বি নিচে রনি ওপরে—এই চলতে লাগল...।

মারামারি অবশ্য খুব বেশিক্ষণ চলল না। সবকিছুই একটা সময় থামে। ওদের দুজনের মারামারিও থামল। দুজনই হাঁপাচ্ছে। কে জিতল ঠিক বোঝা গেল না। তবে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে। বাড়ির পথ ধরল সবাই। শুধু বসে রইল রাব্বি আর রনি।

‘কী লাভ হলো? সেই তো তুই আর আমিই বসে রইলাম। সবাই চলে গেল।’ বলল রাব্বি।

‘তুই আমাকে গাধা বললি কেন সবার সামনে?’

‘গাধার মতো কাজ করলে বলব না? কেন সবাইকে বলতে গেলি? এখন সবাই আমাদের চোর বলছে। এটা তো টপ সিক্রেট ছিল আমাদের দুজনের মধ্যে।’ রনি কিছু না বলে মুখ গোঁজ করে বসে রইল। হঠাৎ গলা নামিয়ে ফেলল রাব্বি। ‘তুই এই উদ্ধার পর্বে আমার সঙ্গে আছিস কি নেই, বল।’

‘আছি। কিন্তু কখন কী করব আমরা?’

‘কাল সন্ধ্যায় আমাদের অ্যাডভেঞ্চার।’

‘তার আগে বল, লাল পাহাড় বইটার ওই দুটো পাতা তুই ওই ইনফ্রারেড চশমায় পড়তে পেরেছিলি?’

‘পুরো ঘর অন্ধকার করে পৃষ্ঠা দুটো পড়তে পেরেছি।’

‘কী লেখা ছিল?’

‘লেখা...দাঁড়া...।’ বলে দুটো সিগারেটের খালি প্যাকেট কুড়িয়ে আনল রাব্বি। ‘এই দেখ, একটা প্যাকেট খুলে ফেললাম। এখন এটা দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ দুই মাত্রার একটা জগৎ হয়ে গেল। এই জগতের কেউ না খোলা প্যাকেটটা দেখতে পাবে না। কারণ, না খোলা প্যাকেটটার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর উচ্চতা আছে। মানে তিন মাত্রার জগৎ। কী বুঝলি?’

‘কিছুই বুঝিনি।’ বলল রনি। হাল ছাড়ল না রাব্বি। বলেই চলল, ‘কিন্তু এই না খোলা সিগারেটের প্যাকেটটার ছায়া যখন পড়বে, তখন সেই ছায়াটা কিন্তু দুই মাত্রার, দুই মাত্রার জগৎ সে ছায়া দেখতে পারবে। কারণ, দুজনই দুই মাত্রার...’

‘ছায়া দেখে লাভ কী?’

‘এই সময় ওদের ওপর দুটো বড় মানুষের ছায়া এসে পড়ল। রাব্বি তাকিয়ে দেখে সেই রহস্যময় লোক দুটো দাঁড়িয়ে। চকরাবকরা শার্টের লোকটা যার কোমরে একটা পিস্তল ছিল, সে এখনো সেই শার্টই পরে আছে। লোকটার কি ওই একটাই শার্ট?

আমতলার মিটিং থেকে সাইদ, ঝন্টু, মিলু ফিরছিল। নেলিদের বাসার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখে নেলি আর মিতু গল্প করছে। ওদের দেখে নেলি চেঁচিয়ে উঠল। ‘কিরে, চোর দুটো কই রে?’

‘তুই কাজটা ঠিক করিসনি।’ দাঁড়িয়ে পড়ে সাইদ। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, ‘ওরা এখন মারামারি করছে।’

‘মারামারি করছে?’ নেলি অবাক হলো! ‘মারামারি করবে কেন?’

‘হ্যাঁ। রনির নাক দিয়ে দেখলাম রক্ত পড়ছে। আর রাব্বির থুতনি কেটে গেছে।’ মারামারির একটা লোমহর্ষ বর্ণনা দিতে লাগল ওরা তিনজন মিলে, যার অনেকটাই মিথ্যা। নেলি ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল। তাকে কিঞ্চিৎ বিচলিত মনে হচ্ছে। মিতু বলল, ‘কী হয়েছে রে?’ সে এসবের কিছুই জানে না। নেলি কিছু বলল না।

বাসায় ঢুকতেই ক্যাক করে রাব্বির কানটা ধরলেন মা।

‘কিরে, আবার মারামারি করে এসেছিস?’

কী আশ্চর্য, মা বুঝল কী করে? তখনই তার নজর গেল শার্টের পকেটের দিকে। সেটা ছিঁড়ে ঝুলছে। একটুখানি কোনোরকমে লেগে আছে। নিশ্চয়ই রনি কোনো এক ফাঁকে টান দিয়েছিল মারামারির সময়।

‘কার সঙ্গে মারামারি করেছিস বল?’

‘অ্যা...ইয়ে...কারও সঙ্গে না।’

‘ও, একা একাই মারপিট করেছিস?’

‘আপা, ছেড়ে দাও।’ রাব্বি অবাক হয়ে দেখে ঝর্ণা খালা! কখন এল ঝর্ণা খালা?

‘আয় বীরপুরুষ, তোকে একটু ফার্স্ট এইড দিয়ে দিই। থুতনির কাছটায় খামচির দাগ দেখতে পাচ্ছি। কনুই ছিলে গেছে। কানের নিচে নিশ্চয়ই ঘুষি খেয়েছিস। একটু ফুলে গেছে দেখতে পাচ্ছি। তা মারপিটে জিতেছিলি তো, নাকি হেরেছিস?’

রাব্বি অবশ্য তখন অন্য কিছু ভাবছিল। কারও সঙ্গে কৌশিকদার পুরো ব্যাপারটা শেয়ার করা দরকার। সেটা কি ঝর্ণা খালা হতে পারে? পাড়ার বন্ধুরা তো তাকে চশমাচোর বানিয়ে ফেলেছে। ওই দিকে কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। রনিও শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, দুপুরের পর ওই ভয়ংকর লোক দুটো যখন এল, ঠিক তখন সিঅ্যান্ডবির দারোয়ানটা না এলে ওদের হয়তো খবরই ছিল। লোক দুটো নিশ্চয়ই কোনো মতলব নিয়ে এসেছিল। দারোয়ানকে দেখে লোক দুটো চুপচাপ সরে গেল। আর ওই ফাঁকে পালাল ওরা দুজন। রনি তখন বলছিল, ‘আমি মনে হয় এত কিছুর মধ্যে থাকতে পারব না রে...মা নতুন প্রাইভেট টিউটর রেখেছে, খুব কড়া...।’ রাব্বির মনে হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত সে কি একা হয়ে গেল?

রাতে অবশ্য ঝর্ণা খালা ধরলেন রাব্বিকে। সব খুলে বলল রাব্বি। ইনফ্রারেড চশমা দিয়ে অন্ধকারে লাল পাহাড় বইয়ের ৪৮-৪৯ পাতা পড়ার কথাও বলল। দুই মাত্রা আর তিন মাত্রার যে ব্যাখ্যা লাল পাহাড় বইয়ের ৪৮-৪৯ পাতায় আছে, সেটাও একটু বলল, অন্তত সে যা বুঝেছে।

‘ইনফ্রারেড চশমা কোথায় পেলি?’ খালার প্রশ্নে সতর্ক হয়ে গেল রাব্বি।

‘অ্যা ...এক বন্ধুর কাছে ছিল।’

‘কোন বন্ধু?’ খালার চোখে কিঞ্চিৎ সন্দেহ যেন।

‘রনি। রনির বাসায় অনেক কিছু আছে। মাস্টার কি, বাইনোকুলার, ইনফ্রারেড চশমা...’

‘দেখি, চশমাটা আন তো, আমি একটু ট্রাই করি।’

ঘর অন্ধকার করে ঝর্ণা খালা লাল পাহাড় বইয়ের ৪৮-৪৯ পাতা পড়ার চেষ্টা করল। কিন্তু খালা নাকি কিছুই দেখতে পেল না। হিজিবিজি কিছু দাগ দেখতে পেল শুধু।

লাইট জ্বালিয়ে খালা বলল, ‘অনেক হয়েছে, এখন ঘুমা! সকালে এ নিয়ে ভাবা যাবে।’

‘খালা, তোমার ভাইভা কেমন হয়েছে?’

‘হয়েছে মোটামুটি। তোর কৌশিকদাকে পেলে একটা ধন্যবাদ দেব। সে সময়মতো না বললে হয়তো ফাইনাল ইয়ারে ফেল হয়ে যেত রে।’

‘আচ্ছা খালা, একটা কথা বলব?’

‘বল।’

‘আচ্ছা, তুমি চতুর্থ মাত্রা থেকে কৌশিকদার পঞ্চম মাত্রায় চলে যাওয়াটা বিশ্বাস করেছ তো?’

খালা ঠোঁট কামড়াল একটুক্ষণ। তারপর বলল, ‘না, এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি!’

রাতে শুয়ে রাব্বি ভাবতে লাগল। তার মনে হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত সে এই পুরো ব্যাপারটায় একদম একাই হয়ে গেল। খালাও মনে হচ্ছে বিশ্বাস করতে পারছে না পুরোপুরি। তবে রাব্বির কেন যেন মনে হচ্ছে, সব গন্ডগোল ওই পুরোনো লাল দোতলা দালানটায়। যে বাসার আশপাশে চকরাবকরা শার্ট পরা রহস্যময় লোক দুটো ঘুরঘুর করে। যে বাসায় হঠাৎ হঠাৎ ক্লান্টু চলে যায়। কোন পথ দিয়ে যায় ক্লান্টু? অনেক দিন ক্লান্টুর দেখা নেই। ক্লান্টুর ওপর নজর রাখতে হবে। ওর পিছু পিছু যেতে হবে একদিন। কৌশিকদা একবার বলেও ছিল এ রকম কিছু...ভাবতে ভাবতে রাব্বির চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে।...একটা স্বপ্নও দেখে ফেলে রাব্বি। যেন সে আর রনি মারামারি করতে করতে একটা পাহাড়ের ধারে চলে এসেছে গড়িয়ে গড়িয়ে। আরেকটু হলেই দুজন একসঙ্গে গড়িয়ে পড়বে গভীর খাদে। তখন কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, ‘রাব্বি কৌশিকদাকে পাওয়া গেছে...রাব্বি কৌশিকদাকে পাওয়া গেছে!’

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে, ক্লান্টু বারান্দায় বসে তার জন্য বরাদ্দ বাটিতে কিছু খাচ্ছে। নিশ্চয়ই মা কিছু দিয়েছে। রাব্বি ক্লান্টুর গলায় চুলকে দিল। ফিসফিস করে বলল, ‘এই ক্লান্টু, তুই কোথায় যাস বল তো? এরপর গেলে আমাকে নিবি কিন্তু, আমার ধারণা ওখানেই কোথাও কৌশিকদা আছে...।’ হঠাৎ ক্লান্টু মুখ তুলে তাকাল রাব্বির দিকে। যেন সে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে রাব্বি কী বলতে চায়। মুখে কু কু শব্দ করল।

পরদিন শুক্রবার। সবাই নিজ নিজ বাসায় ছুটির দিন উপভোগ করছে। রাব্বিও বাসায়। সে সারা দিন ক্লান্টুকে নজরে রাখল। পাঁচটার দিকে ক্লান্টু হঠাৎ ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল কোনো কারণ ছাড়াই। তারপর ছুটতে লাগল। রাব্বি প্রস্তুত ছিল। সে-ও পিছু নিল ক্লান্টুর। লীনাদের বাসার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখে লীনা রকিং চেয়ারে দুলছে, হাতে কমিকস। রাব্বিকে দেখে উঠে দাঁড়াল। রাব্বি অবশ্য ফিরেও তাকাল না। ছুটতে লাগল ক্লান্টুর পিছু পিছু।

রাব্বির মনে হলো, সে যেন যুগ যুগ ধরে ছুটছে। ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো, নিচের ঘাসের মাটি শেষ হয়ে কেমন লালচে মাটি শুরু হয়েছে। ভেজা ভেজা লাল মাটি তার কাপড়ের জুতায় চট চট করে লেগে যাচ্ছে। ক্লান্টু মাঝেমধ্যে দাঁড়াচ্ছে, পেছন ফিরে মুখে কেমন একধরনের কু কু শব্দ করছে। তারপর আবার ছুটছে। যেন বলছে, ‘আমাকে অনুসরণ করো...আমি তোমাকে ঠিক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি...।’ হঠাৎ রাব্বির মনে হলো, জায়গার ধরনটা বদলে গেছে। দুই পাশে গাছ, গাছের পাতাগুলো অচেনা। একটা পুরোনো লাল ইটের বিল্ডিং, শেওলা ধরা, কেমন একটা পচা গন্ধ নাকে আসছে। হঠাৎ একটা দরজার সামনে দাঁড়াল ক্লান্টু। রাব্বিও দাঁড়াল। দরজা দুটো যেন আপনি আপনি খুলে গেল কিংবা কে জানে, হঠাৎ দমকা বাতাসে খুলে গেল কি না! রাব্বি ঢুকে গেল ভেতরে।

ভেতরে ঢুকেই চিনতে পারল সেই পুরোনো বাসাটা। ভেতরে দামি দামি সব জিনিস। সেই হুইলচেয়ারটা আছে। কিন্তু বুড়ি মহিলাটা বসে নেই চেয়ারে। এই সময় ক্লান্টু একটা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কুঁই কুঁই শব্দ করতে লাগল। যেন বলতে চাচ্ছে, এই দরজাটা খোলো। রাব্বি এগিয়ে গেল। ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। হতভম্ব হয়ে গেল রাব্বি। ঘরের ভেতরে একটা বিছানায় শুয়ে আছে কৌশিকদা। শুয়ে থাকার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে সে অসুস্থ।

‘রাব্বি এসেছিস?’

‘তু...তুমি?’

‘সময় কম, জলদি কর। জানালার কাছে টেবিলের ড্রয়ারে পিস্তল আছে। যেটা দিয়ে একবার গুলি করেছিলি। সেটা নিয়ে আয়।’

‘কেন?’

‘আহ্‌! যা বলছি, জলদি কর।’

রাব্বি হুকুম পালন করল। পিস্তল হাতে সে এখন দরজায় দাঁড়িয়ে।

‘এনেছিস?’

‘হ্যাঁ।’

‘এখন দেখ, ঠিক আমার মাথার ওপরে একটা সাদা বল।’

‘দেখেছিস?’

‘কই, না তো।’

‘ভালো করে লক্ষ কর।’

‘হ্যাঁ, দেখেছি।’ রাব্বি দেখতে পেল একটা আবছা সাদা পাঁচ নম্বরি ফুটবল কৌশিকদার নাক বরাবর একটু ওপরে স্থির হয়ে আছে নাকি ঘুরছে, বোঝা যাচ্ছে না। বলটা মাঝেমধ্যেই সাদা থেকে ধূসর রঙের হয়ে যাচ্ছে...!

‘ওই বলটা লক্ষ্য করে গুলি কর। কয়েকটা গুলি কর।’

‘কী বলছ? যদি তোমার গায়ে লেগে যায়!’

‘আহ্‌! জলদি কর। হাতে একদম সময় নেই। ওরা সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যেমন পারে আলোকে। আমি পঞ্চম মাত্রায় আছি। জলদি গুলি কর, প্লিজ রাব্বি। ভয় নেই, ভুল করে আমার গায়ে গুলি লাগলেও আমি মরব না, পঞ্চম মাত্রায় কেউ মরে না। জলদি জলদি জলদি...’ কৌশিকদার গলা শেষের দিকে কেমন আর্তনাদের মতো শোনাল। রাব্বি পিস্তলের মাঝ বরাবর বলটা সই করল, তারপর দম বন্ধ করে ট্রিগারে টান দিল। একবার ...দুবার...তিনবার...!! বদ্ধ ঘরে পিস্তলের শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো...বুম...বুম...বুম...!

‘তুই কৌশিকদাকে মেরে ফেললি?’

পেছন ফিরে তাকিয়ে রাব্বি হতভম্ব হয়ে গেল। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে নেলি।

‘তু...তুই!?’

‘তোকে ফলো করে চলে এসেছি।’ এই সময় ক্লান্টু কুঁই কুঁই শব্দ করে অস্থির হয়ে পা আছড়াতে লাগল মেঝেতে। রাব্বি তাকিয়ে দেখে, কৌশিকদা যেখানে শুয়ে ছিল, সেখানে আর নেই। বিছানাটা শূন্য, বলটাও আর নেই। রাব্বি ক্লান্টুর আচরণ দেখে বুঝে গেছে, ক্লান্টু কী বলতে চায়। সে পিস্তলটা জায়গামতো রেখে নেলির হাত ধরে টান দিল। ছুটতে লাগল ক্লান্টুর পিছে পিছে! এবারও ক্লান্টু তাদের পথপ্রদর্শক।

ওদিকে পাড়ায় তোলপাড়। রাত দশটা বাজে, নেলি বাসায় নেই। কোথায় গেছে মেয়েটা? কার সঙ্গে গেছে? নেলির মা ওর সব বন্ধুবান্ধবীকে ডেকে পাঠিয়েছেন। সবাই এসেছে। শুধু রাব্বি নেই। ঝন্টু ফিসফিস করল মিলুর কানে কানে।

‘আমার মনে হয় কী জানিস?’

‘কী?’

‘রাব্বি নেলিকে কিডন্যাপ করেছে।’

‘কী পাগল–ছাগলের মতো কথা বলিস তুই?’

‘আরে, ওই দিন দেখলি না নেলি রাব্বিকে চোর বলল, তাতেই রাব্বি খেপে গিয়ে...’

‘উফ্‌ চুপ কর। জি বাংলার হিন্দি সিরিয়াল দেখে দেখে তোর মাথাটা সত্যিই একদম গেছে।’

‘আরে, আজকাল এসব হচ্ছে...’

ঠিক তখনই দেখা গেল নেলি, রাব্বি আর ক্লান্টুকে। তিনজনই রীতিমতো হাঁপাচ্ছে। নেলির মা ছুটে এসে জাপটে ধরলেন মেয়েকে।

‘কোথায় ছিলি?’

‘উফ্‌! আর বোলো না। আমি, রাব্বি আর ক্লান্টু বেড়াতে গিয়েছিলাম ওদিকে, নদীর ধারটায়। তারপর পথ হারিয়ে ফেললাম। ভাগ্যিস ক্লান্টু ছিল। পরে ক্লান্টুই আমাদের পথ দেখিয়ে আনল।’ বলে হি হি করে হাসতে লাগল নেলি।

রাব্বি টের পেল, তার পাড়ার বন্ধুরা সবাই তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। তারা নিশ্চয়ই হিসাব মেলাতে পারছে না। কাল নেলি ওদের চোর বলল, এই নিয়ে কথা–কাটাকাটি হলো। আবার এসব কারণে রনির সঙ্গে রাব্বির মারপিটও হলো। আবার সেই নেলির সঙ্গেই রাব্বি বেড়াতে গেল নদীর ধারে...!

রাব্বি কিছুই হয়নি এমন ভাব করে তাকাল বন্ধুদের দিকে। বলল,

‘তোরা এত রাতে এখানে কী করিস?’ ওরা কেউ উত্তর দিল না। তখনো সবার মুখ হাঁ হয়ে আছে। রাব্বি ভাবল, রাতে মাছি থাকে না, নইলে নির্ঘাত সবার মুখে একটা–দুটো করে মাছি ঢুকে যেত নিশ্চয়ই।

(চলবে...)

আরও পড়ুন