পুরোনো টাওয়ার (প্রথম পর্ব)

অলংকরণ: আরাফাত করিম

এক

মোটরসাইকেলের হ্যান্ডেলবারে চেপে বসল কিশোর আর রবিনের হাত। আতঙ্কিত চোখে তাকাল উল্টো পাশ থেকে ধেয়ে আসা গাড়িটার দিকে। সংকীর্ণ রাস্তার একবার এপাশে যাচ্ছে, একবার ওপাশে যাচ্ছে। সোজা ছুটে আসছে ওদের দিকে।

‘ধাক্কা লাগবে! ঢাল বেয়ে উঠে পড়তে হবে আমাদের, জলদি!’ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। ব্রেক কষে রাস্তার পাশে মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে ফেলল ওরা, লাফিয়ে নামল।

‘আরও জোরে ছোটো!’ বাঁধের খাড়া গা বেয়ে উঠতে উঠতে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।

ওদের অবাক করে, আচমকা তীব্রগতিতে ডানে কাটল বেপরোয়া ড্রাইভার। দুই চাকায় ভর দিয়ে কাত হয়ে ঢুকে পড়ল ডান পাশের শাখা রাস্তাটায়। এই বুঝি উল্টে গেল, ভাবল ছেলেরা। কিন্তু না, নিরাপদেই মাটিতে নেমে এসেছে বাকি দুই চাকা। তীরবেগে ছুটে গেল চোখের আড়ালে।

‘বাপরে!’ সশব্দে চেপে রাখা দম ছাড়ল রবিন। ‘চল, খেপা লোকটা ফিরে আসার আগেই কেটে পড়ি। জানোই তো, ওদিকে রাস্তাটা কানাগলি।’

হাঁচড়ে-পাঁচড়ে মোটরসাইকেলের কাছে ফিরে এল ছেলেরা। দ্রুতবেগে বাইক ছোটাল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সামনের মোড়টা পার হয়ে যেতে চায়। পথের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে, খানিকক্ষণ নীরবে চালিয়ে গেল ওরা।

ওদের ডানে, পাথরে তৈরি বাঁধ ঢালু হয়ে সোজা পানির কিনারায় নেমে গেছে। পথের উল্টো দিকে খাড়া হয়ে আছে এবড়োেথবড়ো একটা টিলা। আঁকাবাঁকা এই রাস্তাটা খুব একটা ব্যবহার করে না কেউ। ভীষণ সরু, কোনোমতে পাশ কাটাতে পারে দুটি গাড়ি।

‘রাস্তার কিনারা থেকে পড়ে গেলে আর রক্ষা নেই,’ বলল কিশোর। ‘সোজা এক শ ফুট নিচে গিয়ে পড়তে হবে।’

‘ঠিকই বলেছ,’ সায় দিল রবিন। ‘অবশ্য নিচে পড়ার আগেই পাথরে বাড়ি লেগে ভর্তা হয়ে যাবে।’ হাসল সে। ‘হুঁশিয়ার, কিশোর। রাশেদ আঙ্কেলের কাগজগুলো কিন্তু জায়গামতো পৌঁছে দিতেই হবে।’

চকিতে জ্যাকেটের পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিল কিশোর। গুরুত্বপূর্ণ কাগজগুলোর অস্তিত্ব অনুভব করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। হেসে বলল, ‘না, ঠিকই আছে।’

হেসে বলল রবিন, ‘আঙ্কেল তো দেশের সেরা গোয়েন্দাদের একজন, তাই না? আর গোয়েন্দা হিসেবে আমরাও খুব একটা খারাপ করছি না, কী বলো? নিজের প্রশংসা নিজেই করলাম।’

কিশোর আর রবিন দুজনে বন্ধু, রকি বিচ হাইস্কুলে পড়ে। শনিবারের এই সকালে ওরা খুশি হয়েই কিশোরের চাচা রাশেদ পাশার কাগজগুলো পৌঁছে দিতে রাজি হয়েছে।

প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে আমেরিকার রকি বিচ শহরে থাকে ওরা।

যা–ই হোক, উপকূলঘেঁষা সংকীর্ণ রাস্তা ধরে ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলেছে মোটরসাইকেল দুটি। গন্তব্য উডেনভিল। পরের মোড়টার কাছে এসে মসৃণভাবে বাঁক নিল ওরা। দীর্ঘ, খাড়া একটা ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল। এখানে পথটা চেপে এসে একটা ফিতের রূপ নিয়েছে। যাচ্ছেতাই রকমের ভাঙাচোরা।

‘একবার পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে গেলে, রাস্তা আর এতটা খারাপ থাকবে না,’ উঁচু–নিচু পথে ঝাঁকি খেতে খেতে বলল কিশোর। ‘ওখান থেকে উডেনভিল পর্যন্ত রাস্তাটা ভালোই হবে।’

ঠিক তখনই মোটরসাইকেলের ভটভট আওয়াজ ছাপিয়ে একটা গাড়ির গর্জন কানে এল ওদের। তীব্রবেগে পেছন থেকে ধেয়ে আসছে। চকিতে পেছনে তাকাল ওরা।

‘আগের লোকটাই তো মনে হচ্ছে!’ চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ‘সর্বনাশ!’

সঙ্গে সঙ্গে মোটরসাইকেলের গতি কমিয়ে আনল ওরা। যতটা সাহসে কুলায়, খাদের কিনারায় সরে এল। লাফিয়ে সাইকেল থেকে নেমে এমনভাবে দাঁড়াল দুজন, যাতে প্রয়োজন হলেই আবার লাফ দিয়ে সরে যেতে পারে।

বুলেটের মতো ওদের দিকে ধেয়ে এল গাড়িটা। ধাক্কা দেওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে ঝটকা দিয়ে হুইল ঘুরিয়ে নিল ড্রাইভার। তীব্রবেগে পাশ কাটিয়ে চলে গেল সেডানটা।

আটকে রাখা নিশ্বাস ছাড়ল কিশোর। ‘আরেকটু হলেই গেছিলাম!’

এত জোরে গেল গাড়িটা যে ওটার নম্বর প্লেট বা ড্রাইভারের চেহারা, কোনোটাই দেখার সুযোগ হলো না ওদের। একঝলক শুধু লোকটার হ্যাটবিহীন মাথায় ঝাঁকড়া লাল চুল চোখে পড়ল।

‘পরে কখনো যদি ধরতে পারি,’ বিড়বিড় করল রবিন, ‘ওকে যে আমি...আমি...’ উত্তেজনায় হুমকিটা শেষ করতে পারল না রবিন।

কিশোর ততক্ষণে সামলে উঠেছে। ‘নিশ্চয়ই কোনো রেস প্র্যাকটিস করছে লোকটা,’ সামনের বাঁকে হারিয়ে যাওয়া গাঢ় নীল সেডানটার দিকে তাকিয়ে বলল সে।

আবার যাত্রা শুরু করল ওরা। বাঁক ঘুরে আসতে আসতে বেপরোয়া চালকের কোনো চিহ্নও দেখতে পেল না কোথাও। উডেনভিল শহর চোখে পড়ল নিচের উপত্যকায়।

‘এতক্ষণে দেশের আরেক প্রান্তে চলে গেছে লোকটা,’ বলল রবিন।

‘যদি ফাটলে ঢুকে গিয়ে না থাকে কিংবা পাহাড় টপকে না যায়,’ যোগ করল কিশোর।

উডেনভিলে পৌঁছে কাগজপত্রগুলো একজন উকিলের কাছে দিয়ে আসতে গেল কিশোর। রবিন রইল মোটরসাইকেলের পাহারায়। কিশোর ফিরে এলে বলল রবিন, ‘অন্য রাস্তা ধরে রকি বিচে ফিরলে কেমন হয়? ওই বিশ্রী ভাঙাচোরা পথটায় আর যেতে ইচ্ছে করছে না।’

‘আমার মনের কথাটা বলেছ। ফেরার পথে মুসার ওখানেও একবার ঢুঁ মেরে যাওয়া যাবে।’

ওদের বন্ধু মুসা আমান। রকি বিচ শহরের বাইরে মুসাদের ফার্মহাউস। ওর জীবনের একমাত্র গর্বের বস্তু উজ্জ্বল হলুদ রঙের একটা জেলপি গাড়ি। যেটার নাম রেখেছে ও ‘ইয়েলো বেবি’। গাড়িটার ‘ইঞ্জিনের ক্ষমতা’ বাড়ানোর জন্য প্রতিদিনই কিছু না কিছু কারিগরি করছে ওটায়।

প্রথম কিছুদূর আগের রাস্তা ধরেই এগিয়ে গেল কিশোর আর রবিন। তারপর একটা কাঁচা রাস্তায় মোড় নিল। পথটা গিয়ে ঠেকেছে মূল হাইওয়ের সঙ্গে। মুসাদের ফার্মহাউসটাও ওখানেই।

মুসাদের বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা, এমন সময় আচমকা ব্রেক কষল কিশোর। পথের ধারে একটা গভীর খাদের তলায় গজিয়ে উঠেছে কিছু ঝোপঝাড়। সে রকম একটা ঝোপের দিকেই ওর নজর।

‘েদখো দেখো, কে যেন অ্যাকসিডেন্ট করেছে! সেই পাগলা ড্রাইভারটাই নাকি কে জানে।’

লম্বা হয়ে গজিয়ে ওঠা ঝোপের ভেতর উল্টে পড়ে আছে একটা নীল সেডান। ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। আকাশের দিকে চাকা, দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে আছে একটা আবর্জনার স্তূপের মতো।

‘নিচে কেউ আছে কি না দেখা দরকার!’ চেঁচিয়ে উঠল রবিন।

কালভার্টের নিচে নামতে লাগল ওরা। বুক ধুকপুক করছে—লোকটার অবস্থা কতটা খারাপ দেখতে হবে ভেবে!

কাছে এসে গাড়ির ভেতর উঁকি দিল ওরা। কিন্তু আহত বা নিহত, কাউকেই চোখে পড়ল না।

‘অ্যাকসিডেন্টটা মনে হয় বেশ কিছুক্ষণ আগে হয়েছে,’ বলল রবিন। ‘আর...’

এগিয়ে এসে উল্টে থাকা ইঞ্জিনের গায়ে হাত রাখল কিশোর। ‘রবিন, এটা এখনো গরম,’ বলল সে। ‘একটু আগেই অ্যাকসিডেন্টটা হয়েছে। এখন আমি শিওর, এটা সেই লাল-চুলো লোকটারই গাড়ি।’

‘কিন্তু লোকটার কী হলো?’ রবিনের প্রশ্ন। ‘সে কি বেঁচে আছে? কেউ উদ্ধার করে নিয়ে গেছে? না কী হলো?’

কাঁধ ঝাঁকাল কিশোর। ‘একটা জিনিস অবশ্য বলতে পারি। ড্রাইভারই হোক বা অন্য কেউই হোক, গাড়ির লাইসেন্স প্লেটটা খুলে নিয়ে গেছে, যাতে কার গাড়ি শনাক্ত না করা যায়।’

পুরো ঘটনাটায় হতভম্ব হয়ে গেল ছেলেরা। তবে আপাতত এখানে কিছু করার নেই ওদের। তাই কালভার্ট থেকে উঠে এল ওরা। মোটরসাইকেল স্টার্ট দিল। খানিক বাদে মুসাদের বাড়ি দেখা গেল দৃষ্টিসীমায়। পুরোনো অগোছালো একটা ফার্মহাউস, পেছনে আপেলের বাগান। গলিতে ঢুকে বারান্দায় মুসাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ওরা।

‘এই, কী খবর!’ হেঁকে উঠল রবিন।

ওদের দেখেই গলি ধরে ছুটে এল মুসা। স্বাস্থ্যবান এক নিগ্রো কিশোর। খেতে খুব ভালোবাসে। সব সময়ই হাতে একটা আপেল বা পকেটভর্তি থাকে বিস্কুটে। হাসি লেগেই থাকে মুখে, আর সব সময় রসিকতা। কিন্তু আজ গোয়েন্দাদের মনে হলো, কিছু একটা হয়েছে ওর। মোটরসাইকেল থামিয়ে লক্ষ করল, বন্ধুর চিরাচরিত উত্ফুল্ল ভাবভঙ্গিটা যেন অনুপস্থিত আজ।

‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর।

‘ঝামেলা হয়ে গেছে,’ জবাব দিল মুসা। ‘একেবারে ঠিক সময়ে এসেছ তোমরা। আমার ইয়েলো বেবিকে নিয়ে যেতে দেখেছ কাউকে?’

আদর করে জেলপিটার নাম রেখেছে সে ইয়েলো বেবি। শূন্য দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে তাকাল কিশোর আর রবিন।

‘তোমার গাড়ি? কই, দেখলাম না তো,’ বলল রবিন। ‘ঘটনাটা কী?’

‘চুরি হয়ে গেছে ওটা!’

‘চুরি!’

‘হ্যাঁ। ইয়েলো বেবিকে নিতে গ্যারেজে এসে দেখি, গায়েব,’ শোকে মুহ্যমান হয়ে বলল মুসা।

‘তালা দেওয়া ছিল না গাড়িতে?’

‘সেটাই তো সবচেয়ে অদ্ভুত। গ্যারেজের দরজা খোলা থাকলেও গাড়িটা তালা দেওয়া ছিল। কীভাবে নিয়ে গেল, বুঝলাম না।’

‘পেশাদার চোরের কাজ,’ বলল কিশোর। ‘গাড়িচোরদের কাছে সব সময় নানা রকম চাবি থাকে। তা মুসা, ঘটনাটা কখনকার কিছু বলতে পারো?’

‘এই ধরো, পনেরো িমনিট। কারণ ওই সময় ওটা নিয়ে গ্যারেজে ঢুকি আমি।’

‘তাহলে আর সময় নষ্ট করছি কেন!’ চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ‘চল চোরটাকে ধরতে যাই!’

‘কিন্তু কোন দিকে গেছে, সেটাই তো জানি না,’ মুখ গোমড়া করে বলল মুসা।

‘আমরা যেদিক দিয়ে এসেছি, সেদিকে ওকে দেখিনি। নিশ্চয়ই উল্টো দিক দিয়ে গেছে,’ যুক্তি দেখাল কিশোর।

‘আমার পেছনে উঠে বসো, মুসা,’ বলল রবিন। ‘আমাদের মতো তাড়াতাড়ি ছুটতে পারবে না ইয়েলো বেবি। সময়মতো ধরে ফেলতে পারব!’

‘আর গাড়িতে তেলও রয়েছে কম,’ উত্তেজিত হয়ে বলল মুসা। লাফ দিয়ে মোটরসাইকেলে উঠে বসল। ‘এতক্ষণে হয়তো তেল ফুরিয়ে গেছে। থামতে বাধ্য হবে চোর।’

খানিক বাদেই তীরবেগে রাস্তা ধরে গাড়িচোরের সন্ধানে ছুটতে লাগল ওরা!

অলংকরণ: আরাফাত করিম

দুই

মুসার জেলপিটার রং ক্যাটকেটে হলুদ, দূর থেকেই চোখে পড়ে। কাজেই গাড়িচোরটাকে ধরে ফেলার ব্যাপারে পুরো আস্থা আছে ওদের।

‘রকি বিচে যথেষ্ট পরিচিত ইয়েলো বেবি,’ বলল কিশোর। ‘কারও না কারও চোখে নিশ্চয়ই পড়েছে ওটা।’

‘খুবই অদ্ভুত লাগছে আমার কাছে,’ বলল রবিন। ‘ও রকম একটা গাড়ি নিয়ে গেল চোর! সচরাচর সাধারণ চেহারা আর স্বাভাবিক রঙের গাড়িই তো পছন্দ চোরদের। পালিয়ে যেতে সুবিধে।’

‘এমনও হতে পারে,’ বলল কিশোর, ‘গাড়িটা বিক্রির জন্য নেয়নি চোর। কোনো কারণে হয়তো তাড়াহুড়ো করে নিয়েছে, কিছুদূর গিয়ে ফেলে রেখে যাবে।’

‘দেখ!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা। একটা সবজিখেতের দিকে ইশারা করল। কতগুলো লোক বাঁধাকপি লাগাচ্ছে। ‘ওদের জিজ্ঞেস করে দেখা যাক, ইয়েলো বেবিকে দেখেছে কি না।’

‘ঠিক,’ বলে মোটরসাইকেল থামাল কিশোর।

দ্রুত পায়ে বেড়া টপকাল সে। এদিকে লাফিয়ে ওদিকে লাফিয়ে, সারি সারি চারা গাছ ডিঙিয়ে, অবশেষে প্রথম চাষির কাছে পৌঁছাল।

‘ঘণ্টাখানেকের ভেতর কি কোনো হলুদ জেলপিকে যেতে দেখেছেন এদিক দিয়ে?’ জিজ্ঞেস করল সে।

খুনখুনে বৃদ্ধ চাষি উবু হয়ে বসে নিড়ানি চালাচ্ছিল। এক হাত কানের পাশে ধরে চেঁচিয়ে বলল, ‘অ্যাঁ?’

‘বলছি যে এদিক দিয়ে উজ্জ্বল হলুদ রঙের একটা গাড়ি নিয়ে কোনো লোককে যেতে দেখেছেন?’ গলা চড়িয়ে বলল কিশোর।

হাঁক দিয়ে সঙ্গীদের ডাকল বৃদ্ধ। সবাই এসে জড়ো হতে, ওভারঅলের পকেট থেকে এক কৌটা খইনি বের করল সে। খানিকটা খইনি দাঁতের গোড়ায় ঘষে লাগিয়ে ফুচুত করে থুতু ফেলল।

ধীরেসুস্থে বলল সবার উদ্দেশে, ‘আমরা কি কোনো জেলপিকে যেতে দেখেছি?’

অন্য তিন চাষি, সবাই, বৃদ্ধ, জবাব দিল না কেউ। তার বদলে যার যার হাতের নিড়ানি নামিয়ে রাখল। তারপর খইনির কৌটাটা ঘুরতে লাগল হাত থেকে হাতে।

অস্থিরতায় ঠোঁট কামড়াতে লাগল কিশোর। ‘দয়া করে একটু জলদি বলুন। গাড়িটা চুরি হয়েছে। আমরা চোরটাকে ধরার চেষ্টা করছি!’

‘তাই নাকি?’ বলল ওদের একজন। ‘একটা গাড়ি?’

‘হ্যাঁ। উজ্জ্বল হলুদ রঙের জেলপি,’ জবাব দিল কিশোর।

আরেকজন তার হ্যাটটা নামাল মাথা থেকে, কপালের ঘাম মুছল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘মনে হয় একটু আগে একটা গাড়িকে যেন দেখেছিলাম খানিক আগে।’

‘হলুদ রঙের?’ উত্তেজিত হয়ে উঠল কিশোর।

‘অ্যাঁ, না...হলুদ না। লাল রঙের একটা ট্রাক।’

অনেক কষ্টে মেজাজ ঠিক রাখল কিশোর। ‘দেখুন, আপনাদের কেউ কি...’

‘গাড়িটা কি নতুন, একেবারে চকচকে?’ ওকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল দলের চতুর্থ বৃদ্ধ।

‘না, পুরোনো। কিন্তু উজ্জ্বল হলুদ রং করা,’ ধৈর্য হারানোর উপক্রম হলো কিশোরের।

‘আমার ভাইপোর একটা হলুদ গাড়ি ছিল,’ বলল চাষি। ‘তবে গাড়ি আমার একদম ভালো লাগে না, বুঝলে কি না।’

‘না হে, তোমার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না,’ আরেকজন বলল। ‘আজকালকার পোলাপান, গাড়ি পছন্দ করবে না? তবে বেপরোয়া না চালালেই হলো।’

বাধা দিয়ে বলল কানে কম শোনা চাষিটা, ‘ফার্মের ট্রাক চালালেই হয়, তাহলে আর বেপরোয়া চালাতে পারবে না, ঝক্কিও কম।’ খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসল বৃদ্ধ। তারপর কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বুঝলে, বাবা, সাহায্য করতে পারলাম না। হলুদ গাড়ি দেখিনি আমরা। আশা করি, তোমরা নিজেরাই গাড়িটা খুঁজে বের করতে পারবে।’

‘সে কথাটা আগে বললেই পারতেন।’ মেজাজ খিঁচড়ে গেছে কিশোরের। বন্ধুদের কাছে ফিরে এল সে। ‘শুধু শুধুই সময় নষ্ট করলাম। বুড়োগুলো পাগল। চল।’

রকি বিচে ঢুকতেই দেখল, একটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। মুখ উজ্জ্বল হলো কিশোরের। মেয়েটা ট্রেসি, মুসার খালাতো বোন ফারিহার বান্ধবী। তিন গোয়েন্দারও বন্ধু। কয়েকটা কেসে ওদের সাহায্য করেছে। রকি বিচ হাইস্কুলে ওদের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে।

বাদামি চোখের সুন্দরী মেয়েটার সামনে গিয়ে মোটরসাইকেল থামাল ওরা। ট্রেসির হাতে একটা দুমড়ানো প্যাকেট। চেহারায় বিরক্তি।

‘হাই, ট্রেসি!’ হেঁকে উঠল কিশোর। ‘চেহারাটা এমন বাংলা পাঁচের মতো করে রেখেছ কেন?’

তিক্ত হাসি হাসল ট্রেসি। ‘তোমাদের তিন বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, ভাবতেই পারিনি। তা, কোথাও চললে নাকি?’ মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল ওর। হাতের প্যাকেটটা উঁচু করে দেখাল, ‘এই দেখ!’ ঝাঁজালো কণ্ঠে বলল সে। ‘সব তোমার দোষ, মুসা!’

ঢোঁক গিলল মুসা। ‘আ-আমার দোষ? মানে?’

‘ওই যে রাস্তার ওপারের মিসেস থমসন আজ কয়েক দিন ধরে অসুস্থ। তার জন্য একটা কেক বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম।’

‘খুব ভালো কথা,’ রবিন বলল। ‘তাতে মুসার দোষটা কোথায়?’

ট্রেসি বলল, ‘এত জোরে গাড়ি হাঁকিয়ে এল লোকটা যে লাফ দিয়ে সরতে হলো আমাকে। হাত থেকে পড়ে গেল প্যাকেটটা। কেকটা মনে হয় আর আস্ত নেই!’

‘কোন লোকটা?’ আবার জানতে চাইল রবিন।

‘ওই যে, যাকে গাড়ি দিয়েছে মুসা।’

‘আরে, ওই লোকটাকেই তো খুঁজছি আমরা, ট্রেসি!’ হঠাৎ বুঝতে পেরে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। ‘মুসা ওকে গাড়ি ধার দেয়নি। লোকটা চুরি করেছে!’

‘অ্যাঁ?’ আঁতকে উঠল ট্রেসি।

‘লোকটা কি রকি বিচের দিকে যাচ্ছিল?’ জিজ্ঞেস করল রবিন।

‘হ্যাঁ। আর যে জোরে ইয়েলো বেবিকে ছোটাচ্ছে, তাতে ওকে ধরার আশা নেই তোমাদের।’

গুঙিয়ে উঠল মুসা। ‘এইমাত্র মনে পড়ল, তেলের মিটার কাজ করছে না ওটার। তার মানে মনে হচ্ছে, যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে বেশি তেল আছে ট্যাংকে। কে জানে কোথায় নিয়ে যায় আমার বেবিকে!’

‘পুলিশ হেডকোয়ার্টারে গেলেই পারি,’ পরামর্শ দিল কিশোর। ‘ট্রেসি, লোকটার বর্ণনা দিতে পারবে?’

‘অস্পষ্ট এক ঝলক শুধু দেখলাম,’ বলল ট্রেসি। ‘চেহারাটা ভালোমতো দেখিনি। তবে লোকটার চুল লাল।’

‘লাল চুল!’ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। ‘কি মনে হয়, রবিন, আমরা যাকে দেখেছি সেই লোকই নাকি? অ্যাকসিডেন্ট করেছে যার গাড়ি?’

মাথার চুলে আঙুল বোলাল রবিন। ‘কাকতালীয় ঘটনা অনেক সময় ঘটে। হয়তো খুব বেশি আহত হয়নি লোকটা, হেঁটে মুসাদের বাড়ি পর্যন্ত যেতে পেরেছে।’

‘তারপর বেবিকে নিয়ে চলে গেছে!’ ককিয়ে উঠল মুসা।

তুড়ি বাজাল কিশোর। ‘ধরো, এমনটাই ঘটেছে! তাহলে ধরা যেতে পারে, অ্যাকসিডেন্ট করা গাড়িটাও ওর না...’

‘তার মানে ওই গাড়িটাও চুরি করে এনেছে!’ বাধা দিয়ে বলল রবিন। ‘নিজের গাড়ি হলে এত সহজে মায়া কাটিয়ে ওখান থেকে চলে যেতে পারত না।’

‘হ্যাঁ। চোরাই গাড়ি বলেই তাড়াহুড়ো করে চলে গেছে...।’

‘কিসের কথা বলছ তোমরা, বল তো?’ জিজ্ঞেস করল ট্রেসি।

‘পরে ফোন করে জানাব তোমাকে, ঠিক আছে?’ কথা দিল কিশোর। ‘এখন তাড়া আছে।’

ট্রেসিকে ‘গুডবাই’ জানিয়ে তাড়াতাড়ি শহরের দিকে ছুটল ছেলেরা। সরাসরি চলে এল রকি বিচের পুলিশপ্রধান, ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারের অফিসে। লম্বা, স্বাস্থ্যবান লোক পুলিশ চিফ। রাশেদ পাশা আর তিন গোয়েন্দার সঙ্গে ভালো পরিচয় আছে তাঁর। মাঝেসাঝে কঠিন কঠিন কেসে প্রাইভেট ডিটেকটিভ রাশেদ পাশার সাহায্য নেন তিনি, সেই সঙ্গে তিন গোয়েন্দারও।

চিফের অফিসে ঢুকে দেখল ওরা, উত্তেজিত তিনজন লোকের সঙ্গে কথা বলছেন চিফ। একজন বৃদ্ধ জোহান ক্রেইট, শহরের ফেরিঘাটের টিকিট বিক্রেতা। অন্যজন পুলিশম্যান রিকি জার্সি। শেষের জন ডগলাস ফ্রেড, খাটো, গাট্টাগোট্টা এক লোক। বরাবরের মতো একটা চেক স্যুট পরনে, মাথায় নরম ভেলভেটের হ্যাট। নিজেকে প্রাইভেট ডিটেকটিভ পরিচয় দেয় সে। রকি বিচ পুলিশে জায়গা করে নেওয়ার জন্য মরিয়া।

‘আবারো ফ্লেচারকে পটানোর চেষ্টা করছে ফ্রেড,’ মুচকি হেসে ফিসফিস করল রবিন। চিফের সঙ্গে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল ওরা।

পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, কোনো কারণে ভয় পেয়েছে জোহান ক্রেইট। এমনিতেই ভিতু লোকটা। বহু বছর ধরে ফেরিঘাটের টিকিট কাউন্টারে, জানালার ওধারে ঠায় বসে থাকে একটা উঁচু টুলে।

‘মাত্র সকালের রসিদগুলো গুনতে শুরু করেছি,’ তীক্ষ্ণ স্বরে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে যাচ্ছে জোহান, ‘ঠিক তখনই এসে নাকের ডগায় রিভলবার ধরল লোকটা!’

‘এক মিনিট,’ বলে নবাগতদের দিকে ফিরলেন ক্যাপ্টেন ফ্লেচার। ‘তোমাদের আবার কী ঘটল?’

‘একটা চুরির ঘটনা জানাতে এসেছি,’ বলল মুসা। ‘আমার হলুদ গাড়িটা চুরি হয়ে গেছে।’

‘আরে, ওই উন্মাদ লোকটাও একটা গাড়ি নিয়ে এসেছিল,’ চিৎকার করে উঠল জোহান। ‘হলুদ রঙের!’

‘তাই নাকি!’ উত্তেজনা প্রকাশ পেল ডগলাস ফ্রেডের গলায়। ‘সূত্র পেলাম একটা!’ সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে পেনসিল আর নোটবুক বের করল সে।

‘আমার ইয়েলো বেবি!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

টেবিল চাপড়ে শান্ত হতে বললেন ফ্লেচার। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘এসবের সঙ্গে বেবির সম্পর্ক কী?’

অলংকরণ: আরাফাত করিম

মুসা জানানোর পর জোহানের ঘটনাটা জানালেন চিফ। ‘এক লোক ফেরিবোটের অফিসে এসে মিস্টার জোহানের ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তখনই একজন যাত্রী এসে পড়ায় লোকটা পালিয়ে যায়।’

চিফ থামতে কিশোর বলল, ‘আমিও একটা ঘটনা জানাতে চাই, ক্যাপ্টেন।’ মুসাদের ফার্মের কাছ থেকে সামান্য দূরে অ্যাকসিডেন্ট হওয়া নীল সেডানটার কথা জানাল সে।

‘এখনই কয়েকজন লোক পাঠাচ্ছি ওখানে।’ ঘণ্টা বাজিয়ে তাঁর লোকদের ডেকে এনে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন চিফ।

এরপর রবিন বলল, ‘পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, মুসার গাড়িচোর আর ফেরিবোট অফিসে হামলাকারী একই লোক!’

‘লোকটার চুলের রং লক্ষ করেছেন?’ মিস্টার জোহানকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ফ্রেড বাধা দিল, ‘তাতে কী আসে যায়?’

‘তাতে অনেক কিছুই এসে-যেতে পারে, মিস্টার ফ্রেড,’ জবাব দিল কিশোর। ‘কী রং, মিস্টার জোহান?’

‘গাঢ় বাদামি, ছোট ছোট করে ছাঁটা।’

একে অন্যের দিকে তাকাল কিশোর আর রবিন, ধাঁধায় পড়ে গেছে। ‘আপনি শিওর, রংটা লাল নয়?’ জানতে চাইল রবিন।

চেয়ারে ঝুঁকে এলেন চিফ ফ্লেচার। ‘কিছু একটার পেছনে লেগেছ মনে হচ্ছে তোমরা? এই লোকটার ব্যাপারে কি কোনো তথ্য আছে তোমাদের কাছে?’

‘আমাদের বলা হয়েছে,’ জবাব দিল রবিন, ‘মুসার গাড়ি নিয়েছে যে লোকটা, তার চুল লাল। আমাদের আরেক বন্ধুও তাকে দেখেছে।’

‘তাহলে নিশ্চয়ই জেলপিটা বাদামি-চুলো কারও কাছে দিয়েছে লাল চুলো লোকটা,’ উপসংহারে এলেন চিফ।

এই সময় ছোটখাটো নার্ভাস চেহারার একজন লোককে নিয়ে আসা হলো। ফেরিবোট অফিসে হামলার সময় যে যাত্রীটা ওখানে গিয়েছিল, এ সেই লোক। চিফ ফ্লেচার ওকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

নবাগত নিজের পরিচয় দিল বিল হাউই বলে, লস অ্যাঞ্জেলেসে থাকে। জানাল, টিকিট বুথের অফিস থেকে রিভলবার হাতে একজনকে পালিয়ে যেতে দেখেছে সে।

‘চুলের রং কী ছিল তার?’ সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল কিশোর। ‘লক্ষ করেছিলেন?’

জবাব দিল লোকটা, ‘আমার নজর আটকে ছিল লোকটার হাতের পিস্তলের দিকে। তবে ও গাড়িতে ওঠার পর তার লাল চুল চোখে পড়েছিল আমার।’

তাজ্জব মনে হলো ডগলাস ফ্রেডকে। ‘আপনি বলছেন, ওর লাল চুল।’ মিস্টার জোহানের দিকে ফিরল তথাকথিত ডিটেকটিভ। ‘আর আপনি বলছেন ওর চুল বাদামি! কিছু একটা গোলমাল না থেকেই পারে না!’ বিভ্রান্ত হয়ে মাথা নাড়তে লাগল সে।

অন্য সবাইও কমবেশি অবাক হয়েছে। ঠিক কখন লাল চুল চোখে পড়ল মিস্টার হাউইয়ের, আরেকবার বলতে অনুরোধ করল কিশোর।

‘গাড়িতে উঠে ঝুঁকে পড়ে আবার যখন মাথা তুলল, তখনই দেখলাম,’ বলল লস অ্যাঞ্জেলেস নিবাসী।

পরস্পরের দিকে তাকাল কিশোর আর রবিন। দুজনের মনে একই ভাবনা: এমন কি হতে পারে যে লাল চুলটা আসলে পরচুলা ছিল, মিস্টার হাউই লক্ষ করার ঠিক আগ মুহূর্তে ওটা মাথায় পরে নিয়েছিল চোরটা? তবে চুপ করে রইল দুজনই। বলে ফ্রেডের সঙ্গে তর্কে জড়াতে রাজি নয়।

চোরটার চুলের রং নিয়ে তর্ক জুড়ে দিল জোহান আর হাউই। শেষ পর্যন্ত আরেকবার টেবিল চাপড়ে পরিস্থিতি শান্ত করতে হলো চিফ ফ্লেচারকে। ‘মুসার গাড়ি আর হামলাকারী লোকটার সন্ধানে সতর্কবার্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি আমি। এর বেশি কিছু মনে হয় আপাতত করার নেই।’

চোরটাকে ধরতে না পারলেও পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে খুশিমনে বেরিয়ে এল গোয়েন্দারা। কেসটা নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ওরা।

‘আজ রাতে চাচার সঙ্গে কথা বলব, রবিন,’ কিশোর বলল। ‘হয়তো কোনো সূত্র দিতে পারবে চাচা।’

‘সেটাই আশা করি, বন্ধুরা,’ মোটরসাইকেলে উঠতে উঠতে বলল মুসা।

একই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে কিশোর আর রবিনের মাথায়। রহস্যগুলো নিয়ে। বুঝতে পারছে, আরেকটা নতুন কেস পেতে চলেছে ওরা।

(চলবে...)

আরও পড়ুন