লাল পাহাড় (পঞ্চম পর্ব)

অলংকরণ: আরাফাত করিম

সকাল ১০টায় রাব্বির ঘুম ভাঙাল ঝরনা খালা।

‘আর কত ঘুমাবি? ওঠ! একটা লোক এসেছে তোর কাছে।’

‘কে?’

‘নাম বলল কৌশিক। অভদ্র একটা লোক।’

খালার কথায় ঘুম ছুটে গেল রাব্বির!

‘অভদ্র কেন?’

‘অবশ্যই অভদ্র। আমাকে তুমি তুমি করে বলল, এই যে আপু রাব্বিকে একটু ডেকে দাও তো...যেন আমি ক্লাস এইট–নাইনের একটা বাচ্চা মেয়ে!’

রাব্বি লাফিয়ে উঠে ছুটল বাইরে, কৌশিকদার কাছে। পেছন থেকে চেঁচাল ঝরনা খালা, ‘এই কোথায় যাস? নাশতা খেয়ে যা! টেবিলে নাশতা দেওয়া হয়েছে কিন্তু!’

বাইরে এসে রাব্বি দেখে কৌশিকদা দুই পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে কায়দা করে সিগারেট টানছে। তার এই সিগারেট টানার ভঙ্গিটা বেশ লাগে রাব্বির। কৌশিকদার কপালের বাঁ পাশে একটা ছোট্ট টেপ মারা।

‘কৌশিকদা?’

‘কী রে, বন্ধের দিনে এত ঘুমাস নাকি তুই?’

‘কই না তো। পরে কী হলো কৌশিকদা? তোমার কপালে ব্যান্ডেজ?’

‘তুই চলে যাওয়ার পর আমি আবার গিয়েছিলাম ওই বাড়িতে, রেকি করতে। তখন দেখি সেই দুই লোক। কথা নাই বার্তা নাই ওরা হঠাৎ আমাকে আক্রমণ করে বসল।’

‘বলো কী? তারপর?’

‘তারপর এই যে!’

বলেই কৌশিকদা পকেট থেকে যেটা বের করল, তা দেখে হকচকিয়ে গেল রাব্বি।

‘ওই লোকটার পিস্তল তোমার কাছে?’

‘রাব্বি! নাশতা খেতে আয় বলছি।’ হঠাৎ চেঁচিয়ে ডাকল ঝরনা খালা। ঝরনা খালা যে কখন পেছনের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, টেরই পায়নি ওরা। কৌশিকদা চট করে পিস্তলটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে বলে, ‘ঠিক আছে, তুই যা নাশতা খেয়ে আয়। আমি মোড়ের টংদোকানে আছি। তোর সঙ্গে আরও কথা আছে। জলদি আসিস।’

কৌশিকদা চলে যেতেই নাশতার টেবিলে বসল রাব্বি। ঝরনা খালা এ বাসায় এলেই প্রথম কদিনে সংসারের দায়িত্ব নিয়ে ফেলে। তার বড় বোনকে রেস্ট দেয়। আর নিজের যত ইউটিউবের এক্সপেরিমেন্টাল নাশতা, সব শুরু করে দেয়। অবশ্য খেতে বেশ মজারই হয় খাবারগুলো। আজ পিৎজার মতো কিছু একটা বানিয়েছে মনে হলো। নাকি পিৎজাই? কে জানে। খেতে অবশ্য মন্দ নয়। দ্রুত খাচ্ছিল রাব্বি। কৌশিকদা অপেক্ষা করছে তার জন্য।

‘ওই অভদ্র লোকটা তোকে কী দেখাল রে?’

খালার প্রশ্নে চমকে উঠল রাব্বি!

‘কই? কিছু না তো!’

‘কিছু না মানে? আমি স্পষ্ট দেখেছি।‘

‘ক্কী…কী দেখেছ?’ রাব্বি ঢোঁক গেলে!

‘লোকটা তোকে একটা পিস্তল দেখাল। এর মানে কী?’ পিৎজার টুকরাটা গলায় আটকে গেল রাব্বির।

‘না না…কী বলছ?’

চেয়ার টেনে পাশে বসল ঝরনা খালা।

‘লোকটা কে বলত?’

‘উ-উনি তো সায়েন্সের টিচার। স্যার জগদীশ চন্দ্র কলেজের।’

‘তো? তোর সঙ্গে কী?’

‘না, মানে উনি আমার ফ্রেন্ড…মানে আমাদের পাড়ার সবার ফ্রেন্ড।’

‘ও, ওই বুড়া অভদ্রটা তোর ফ্রেন্ড? পিস্তল নিয়ে ঘোরে!’ রাব্বি দেখল ঘটনা জটিল হয়ে যাচ্ছে। ঝরনা খালা বিষয়টা প্যাঁচাচ্ছে।

‘না না, ওটা খেলনা পিস্তল। উনি খুব ভালো!’ বলে সে একরকম ছুটে বের হয়ে গেল। চেঁচিয়ে বলল, ‘রাতে তোমাকে সব বলব খালা।’ ঝরনা খালা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল।

কৌশিকদা টংদোকানে চা খাচ্ছিল। রাব্বিকে দেখে চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরাল।

‘কী রে, কী এত নাশতা খেলি?’

‘ইয়ে খালা পিৎজার মতো কী একটা বানিয়েছে, ওটাই খাচ্ছিলাম...’

‘ওই পিচ্চি মেয়েটা তোর খালা?’

‘হ্যাঁ, ঝরনা খালা তো ডাক্তার, মানে এ বছরই ডাক্তারি পড়া শেষ হবে।’

‘বলিস কী? ওই পিচ্চি মেয়ে ডাক্তার...! আচ্ছা শোন, ওই বাড়িতে ঢুকতে হবে দু–এক দিনের মধ্যে। নাহলে হচ্ছে না। ওই বাড়ির ভেতর কিছু একটা রহস্য রয়েছে। আচ্ছা তোর ক্লান্টু কইরে?

‘ক্লান্টু তো আবার উধাও!’

‘গুড, নিশ্চয়ই ওই বাসায় ঢুকেছে। ঢোকার পথটা বের করতে হবে, তুই ঢুকবি আমার সঙ্গে?’

‘অবশ্যই।’

‘হুম... কিন্তু…’

‘কোনো কিন্তু না কৌশিকদা, আমি যাব তোমার সঙ্গে।’

‘আচ্ছা, তোর অন্য বন্ধুরা এখনো আসেনি?’

‘শুধু রনি এসেছে।’

‘আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে।’

‘কী প্ল্যান?’

‘আচ্ছা তুই যা এখন, পরে বলব।’

‘কবে ঢুকব আমরা ওই বাসায়?’

‘আমি জানাব তোকে, গেলাম,’ বলে হনহন করে উল্টো দিকে হাঁটতে লাগল কৌশিকদা। রাব্বি তখনই দেখল মা আর ঝরনা খালা আসছে। মা গম্ভীর গলায় বলল, ‘রাব্বি বাসায় যাও।’ মাকে বেশ গম্ভীর মনে হলো। খালা কি পিস্তলের কথা বলেছে কিছু? কৌশিকদার কী দরকার ছিল ওই সময়ে পিস্তলটা বের করার?’

বাসায় এসে লাল পাহাড় বইটা আর খুঁজে পেল না রাব্বি। কী আশ্চর্য! গেল কোথায় বইটা? বিছানায় বালিশের পাশে রেখেছিল ফিরে এসে পড়বে বলে, এখন নেই। নেই তো নেই, একবারেই উধাও! এর মানে কী? তন্নতন্ন করে খুঁজল রাব্বি। না, কোথাও নেই, কোনো ঘরেই নেই। একটু পরই মা আর ঝরনা খালা ফিরে এল। দুজনের হাতেই নানান জিনিসপত্র। হয়তো বাজারে গিয়েছিল।

‘ঝরনা খালা, লাল পাহাড় বইটা দেখেছ? খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘আমি তো জানি না। তোর ঘরে আমি ঢুকিইনি। পেয়ে যাবি, ভালো করে খুঁজে দেখ।’ রাব্বি হতাশ হয়ে বিছানায় শুয়ে ভাবতে লাগল, কোথায় যেতে পারে বইটা। কোনো জিনিসই নাকি হারায় না। শুধু জায়গা বদল করে। এখন বদল করা নতুন জায়গাটা কোথায় হতে পারে, এটা নিয়ে ভাবতে হবে। রাব্বি চোখ বন্ধ করে ভাবা শুরু করল। ঠিক তখনই ঝরনা খালা ঢুকল।

‘রাব্বি, বই পেয়েছিস?’

‘না।’

‘শাবাশ। তোর ফ্রেন্ডকে দিসনি তো?’

‘কোন ফ্রেন্ড?’

‘আরে, ওই যে পিস্তলবাজ অভদ্র লোকটা। দেখলাম তোরা দুজন মোড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিস ভুশ ভুশ করে।’

‘কী বলছ? আমি সিগারেট খাব কেন? সিগারেট খাচ্ছিল কৌশিকদা।’

‘ওই একই কথা। সিগারেটখোরের পাশে যে থাকে, সে–ও স্মোকার, প্যাসিভ স্মোকার; তারও খাওয়া হয়ে যায়। তোর সায়েন্সের টিচার এটা জানে না? আচ্ছা বল এবার।’

‘কী বলব?’

‘সব বলবি। ওই চৌশিক না ফৌশিক লোকটার সঙ্গে তোর কী? পিস্তল দেখাল কেন তোকে?’

ঢোঁক গিলল রাব্বি। ভালো ফ্যাসাদে পড়া গেল।

‘আসলে হয়েছে কী ঝরনা খালা, একটা ঘটনা ঘটেছে। আর সেটা নিয়ে কৌশিকদা তদন্ত করছে।’

‘ও, তোর কৌশিকদা গোয়েন্দা?’

‘না মানে...উনি তো সায়েন্সের টিচার। আমি ঘটনাটা বললাম, তখন উনি বললেন এটা তদন্ত করবেন।’

‘তা ঘটনাটা কী?’

‘ঘটনাটা হচ্ছে, আমাদের ক্লান্টু মাঝেমধ্যে উধাও হয়ে একটা বাসায় চলে যায়। সেই বাসাটা খুব রহস্যময়। ভয়ংকর দুটি লোক ওই বাসা পাহারা দেয়। ওদের হাতে পিস্তল আছে। তো ওরা কৌশিকদাকে আক্রমণ করেছিল গতকাল। কৌশিকদা আবার ব্ল্যাকবেল্ট, মারামারি করে ওদের পিস্তল কেড়ে নিয়েছে, অবশ্য কৌশিকদাও মার খেয়েছে। দেখলে না, কপালে ব্যান্ডেজ! তো ওই বাসায় কৌশিকদা খুব শিগগির ঢুকবে...’

রাব্বি ভীত চোখে তাকাল ঝরনা খালার দিকে, সব বলা কি ঠিক হলো? যদিও অনেকটাই রেখেঢেকে বলেছে। ঝরনা খালা সরু চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

‘ও… খেলনা পিস্তল এখন সত্যি পিস্তল হয়ে গেছে, না?’

‘না মানে, ওটা...’

‘শোন রাব্বি।’ খালার গলা এখন যথেষ্ট কঠিন। ‘তোকে পরিষ্কার বলছি। ওই লোকের সঙ্গে মিশবি না। তুই তোর বয়সী ছেলেদের সঙ্গে মিশবি, খেলবি। ওই লোকের সঙ্গে ফের যদি কথা বলতে দেখি, আমি কিন্তু তোর মা–বাবাকে সব খুলে বলব...সাবধান!’

‘কিন্তু আমার ক্লান্টু…’

‘তোমার ক্লান্টু এমনিতেই ফিরে আসবে। পালা পশু–পাখি হারায় না, ওরা ফিরে আসে। আমি কোনো পিস্তলবাজ অভদ্র লোকের সঙ্গে তোমাকে দেখতে চাই না। ইজ ইট ক্লিয়ার?’ মাথা নাড়ল রাব্বি।

লাল পাহাড় বইটা আর পেলই না রাব্বি। মন খারাপ করে শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল, নিজেও জানে না। ঘুমিয়ে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল। ...লাল পাহাড় বইটার সেই ক্লোন ছেলেটা যেন তাকে বলছে ‘রাব্বি, বইটা খুঁজে বের করো। ওটা তোমার পড়তেই হবে, নইলে কিন্তু মহা বিপদ হবে তোমার। ওই বইয়ের ৪ নম্বর চ্যাপ্টারে এর সমাধান আছে। পৃষ্ঠা ৪৮, ৪৯ পড়তে হবে...খুব ভালোভাবে পড়বে...’

রাব্বি যখন ঘুমিয়ে এই জটিল স্বপ্ন দেখছিল, তখন বাইরে কৌশিকদা এসে হাজির। দুবার রাব্বির নাম ধরে ডাকতেই ঝরনা খালা গম্ভীর মুখে বের হয়ে এল। যথারীতি কৌশিকদা সিগারেট ফুঁকছে। সিগারেটখোর লোকদের ঝরনা খালা দুচোখে দেখতে পারে না। তার মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল।

‘কাকে চাইছেন?’

‘রাব্বি, রাব্বি আছে না?’

‘আছে।’

‘ওকে একটু ডেকে দিন।’

‘ওকে কী দরকার?’

‘ওর সঙ্গে একটু দরকার ছিল।’

‘দেখুন আপনার বয়স কত আর ওর বয়স কত? ওকে ওর বয়সী বাচ্চাদের সঙ্গে মিশতে দিন। হোয়াই ইউ?’

ঝরনা খালার হঠাৎ আক্রমণে কৌশিকদা একটু যেন ভড়কে গেল!

‘না মানে... দেখুন আপনি নিশ্চয়ই রাব্বির খালা, ডাক্তারি পড়ছেন?’

‘হু, তো?’

‘আসলে একটা জটিল ঘটনা ঘটেছে রাব্বির সঙ্গে, বিষয়টা আপনাকে ইন ডিটেইল বুঝতে হবে, পুরোপুরি হার্ডকোর সায়েন্সের ব্যাপার। প্যারালাল ওয়ার্ল্ডের মতো একটা ঘটনা ঘটেছে। আমি কি ভেতরে এসে ছবি এঁকে আপনাকে বোঝাতে পারি? এক কাপ কফি খেতে খেতে...আপনি নাকি দারুণ কফি বানান, রাব্বি বলছিল!’

‘সরি। আপনি এখন আসুন। আর কখনো রাব্বির খোঁজে আসবেন না। রাব্বিও যাবে না আপনার কাছে। আর আরেকটা কথা।’

‘কী?’

‘মেয়েদের সামনে এভাবে ভুশ ভুশ করে সিগারেট খাবেন না। এটা একধরনের অভদ্রতা,’ বলে ঝরনা খালা কৌশিকদার মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিল। কৌশিকদা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবল। তারপর হাঁটা দিল বাসার দিকে। ঝামেলা হয়ে গেল। রাব্বির কাছ থেকে আরও কিছু জানার ছিল। কিন্তু ওর খালা তো মনে হচ্ছে ওকে ভালো টাইট দিয়েছে।

মোড়টা ঘুরতেই আবার সেই লোক দুটো। তারা আবার এসেছে। এবার কি পিস্তল উদ্ধার করতে এসেছে!

‘কী চান আপনারা?’

লোক দুটো কথা বলল না। দুজন দুদিক থেকে ঘিরে ধরল কৌশিকদাকে। প্রথম লোকটির ভাব দেখে মনে হচ্ছে দুই হাতে ট্র্যাডিশনাল হরাইজন্টাল পাঞ্চ মারার তালে আছে, তার মানে তার দুই হাতের কনুই দুটো বাইরের দিকে থাকবে, ভেতরে শরীরের মেইনস্ট্রিম ফাঁকা। ওই ফাঁকা জায়গা দিয়ে একটা কিক মারা যেতে পারে...সোজা গিয়ে লাগবে থুতনিতে! দ্বিতীয় লোকটাকে অত প্রফেশনাল মনে হচ্ছে না। সে এখনো বুঝে উঠতে পারছে না, কীভাবে আক্রমণ করবে। প্রথমজনের আক্রমণের অপেক্ষায় আছে।

শেষ মুহূর্তে কৌশিক মিত্র পরিকল্পনা বদলাল। যারা খুব ভালো ফাইটার, তারা নাকি এমনটাই করে, শেষ মুহূর্তে আক্রমণের ভঙ্গি বদলে ফেলে। কৌশিক মিত্র চক্করবক্কর শার্ট পরা প্রথম লোকটার মেইনস্ট্রিম দিয়ে আক্রমণ করল...থুতনিতে নয়, পেটের নরম পেশিতে, লোকটা মোটেই প্রস্তুত ছিল না! এক লাথিতেই কাজ হলো, মুখে অদ্ভুত একটা শব্দ করে ছিটকে পড়ল চিত হয়ে। আর উঠল না। দ্বিতীয় লোকটা হঠাৎ পড়িমরি করে ছুটে পালাল।

এত সহজেই বিজয়! কৌশিক মিত্র হৃষ্টচিত্তে হাঁটা দিল বাসার দিকে। বাসায় গিয়ে পরিকল্পনাটা একটু বদলানো যাক। রাব্বির ঝরনা খালা এসে সব উল্টে-পাল্টে দিয়েছে আজ!

(চলবে...)

আরও পড়ুন