ছড়া ও ছবিতে মুক্তিযুদ্ধ: শেষ পর্ব

অলংকরণ: রাকিব

আবার লড়াই শুরু
বাজি রেখে জানকে
হটাতেই হবে ভাই
আইয়ুব খানকে।

ছয় ও এগারো দফা
আদায়ের লক্ষ্যে
মিছিলের পুরোভাগে
গুলি খেল বক্ষে—
এ দেশের দুরন্ত
নির্ভীক সন্তান
আজো গাই সব্বাই
শহীদের জয়গান।
উনসত্তর সালে
ঘটনাটা ঘটল
মুহূর্তে সারা দেশে
সে খবর রটল

দেশবাসী প্রতিবাদে
সোচ্চার হলো ফের
রাজপথে লাশ পড়ে
মতিউর, আসাদের।

প্রাণ দিয়ে দেশে ওরা
আগুন যে জ্বালাল
আন্দোলনের মুখে
আইয়ুব পালাল।

আমরা যে মতিউর
আসাদের ভাই
ওঁদের স্মৃতির প্রতি
শ্রদ্ধা জানাই।

পূর্বের সম্পদ পশ্চিমে যায়
আমরা অসুখে মরি ওরা সুখ পায়।
আমাদের শ্রমে আর আমাদের ঘামে
গড়ে ওঠে সবকিছু তাহাদের নামে।
ওরাই কর্তা সেজে ঘোরে দিনরাত
জোটে না তো আমাদের দুটো ডালভাত।
আচরণে মনে হয় আমরা তো দাস।
ওদের সেবাই করে যাব বারো মাস।

আইয়ুবের পথ ধরে ইয়াহিয়া খান
আমাদের ফুল দিয়ে বানাল বাগান
অথচ ব্যাপার শোনো, আজব ব্যাপার
সে বাগানে আমাদের নেই অধিকার!
আমরা ফোটাই ফুল ওরা মধু খায়
কত আর অনাচার বলো সওয়া যায়?

সুতরাং প্রতিবাদ শুরু পুনরায়
ইয়াহিয়া খুঁজে কোনো পায় না উপায়।
শেষমেশ ইয়াহিয়া সত্তর সালে
দিল যে ইলেকশন নতুন এক চালে।

আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর
কণ্ঠে নিলেন তুলে বাঙালির সুর।
বিপুল ভোটেই শেষ হলো তাঁর জয়
বাঙালিরা অধিকার পাবে নিশ্চয়।

কিন্তু ঘটল ফের আজব ব্যাপার
প্রধানমন্ত্রী হওয়া হলো নাকো তাঁর।
ভুট্টো ও ইয়াহিয়া চালল যে চাল
সেই চালে সবকিছু হলো বানচাল।
সবাই বুঝল এটা ভাঁওতাবাজি
শোষণ করার এক নয়া কারসাজি।
একতাবদ্ধ হয় বাঙালি জাতি
সংগ্রামে সব্বাই সবার সাথি।
হাতে হাত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবাই
অধিকার আদায়ের দাবি তোলে তাই।

স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল বুকের মাঝে আঁকা
সম–অধিকারে হবে সবার বেঁচে থাকা।
শোষণহীন এক সমাজ গড়ে তুলব সবাই, আর—
প্রাণে প্রাণে হাসি–গানে সাজাব সংসার।
কেউ খাবে আর কেউ খাবে না রীতির হবে শেষ
কান্না ভুলে উঠবে হেসে সোনার বাংলাদেশ।
যুদ্ধের প্রস্তুতি নেই
বাঙালিরা তবু লড়বেই।
যায় যাবে, যাক এই প্রাণ
গাইবেই মুক্তির গান

দরিদ্র কৃষকের ছেলে
লাঙল জোয়াল সব ফেলে
চলে গেল যুদ্ধের মাঠে
এভাবেই দিনরাত কাটে।

দেশটাকে খুব ভালোবেসে
দল ও মত নির্বিশেষে
সবাই যুদ্ধে দিল পাড়ি
সে কাহিনি ভুলতে কি পারি?
গাঁয়ের সরলমতী মা
ছেলেকে বলেন, ওরে যা
শত্রুতে দেশ গেল ছেয়ে
তোরা কি দেখবি চেয়ে চেয়ে?
দেশের এই দুর্যোগক্ষণে
লড়তে হবে যে প্রাণপণে।
ঘরে বসে থাকিস নে বাছা
আগে এই দেশটাকে বাঁচা।

ছেলে বলে প্রাণপ্রিয় মাকে—
ভীরুরাই ঘরে বসে থাকে।
আমরা তো মোটে ভীরু নই
শত্রুকে শেষ করবই।

মা বলেন, খোকা তুই ওরে
ফিরবি নতুন এক ভোরে।
শোধ করে জন্মের ঋণ
দেশটাকে করবি স্বাধীন।
দেশটা মুক্ত হলে পরে
তবে তুই ফিরবি এ ঘরে।
গামছায় বেঁধে চিড়ে-গুড়
ছেলে যায় দূর বহুদূর
সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শেষে
ফিরে আসে যোদ্ধার বেশে।

কৃষক শ্রমিক আর চাষা
সকলের বুকে ভালোবাসা
দেশের জন্যে প্রাণ কাঁদে
সাহসেই বুক ওরা বাঁধে।
অনাচার সইবে না আর
ছাত্র- জনতা একাকার।

ভয়ে বুক কাঁপে দুরু দুরু
এভাবে লড়াই হলো শুরু।

হানাদার বাহিনী যে কত গ্রাম জ্বালাল
এক কোটি লোক এই দেশ ছেড়ে পালাল।
বর্বর মিলিটারি অস্ত্রটা উঁচিয়ে
নিরীহ মানুষ মারে বেয়নেটে খুঁচিয়ে।
রেহাই পেল না মাতা, পুত্র ও কন্যা
তাদের চোখের জলে রক্তের বন্যা।
মানবিকতার ধার ওরা মোটে ধারেনি
নিষ্পাপ ফুটফুটে শিশুকেও ছাড়েনি।

নিমেষে উজাড় হলো লোকালয়, বস্তি
সারা দেশ কোনোখানে নেই কোনো স্বস্তি।
আগুনে পুড়িয়ে মারে গুলি করে বিদ্ধ
মানুষ মারতে ওরা পটু ও প্রসিদ্ধ।
ওরা তো মানুষ নয়, ওরা পশুতুল্য
মানুষের জীবনের নেই কোনো মূল্য।
পশুরা নির্বিচারে করে গণহত্যা
নিজেদের দেশ, তবু নেই নিরাপত্তা।

মাথা উঁচু করে তাই বাঙালিরা দাঁড়াল
শত্রুর দিকে হাত মুঠি করে বাড়াল।
ছিনিয়ে আনতে হবে এ দেশে মুক্তি
মাটির সঙ্গে হলো এ রকম চুক্তি।

আকাশ বাতাস নদী সবকিছু কাঁপিয়ে
শত্রুর বিরুদ্ধে পড়ে ওরা ঝাঁপিয়ে।
গেরিলাযোদ্ধা ওরা, কী দারুণ দক্ষ
কুপোকাত হানাদার বিরুদ্ধ পক্ষ

শত্রুর ভয়ে ওরা পিছু হটে যায়নি
যায় যদি যাক প্রাণ, ভয় ওরা পায়নি।
আর তাই হাসিমুখে বুকে গুলি খেয়েছে
মুক্তির গান তবু প্রাণ দিয়ে গেয়েছে।

নিরস্ত্র বাঙালিরা প্রাণপণে লড়ল
নয় মাস পরে দেশ মুক্ত যে করল।
এক নদী রক্তের বিনিময়ে শেষটায়
স্বাধীনতা এল এই প্রাণপ্রিয় দেশটায়।

তিরিশ লক্ষ প্রাণের দামে
পেলাম স্বাধীনতা
শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি
আজকে তাঁদের কথা।

মায়ের বোনের সম্মান আর
শহীদ ছেলের দান—
এই আমাদের পতাকা আর এই আমাদের গান।

(শেষ)