চ্যাটজিপিটির ডায়েট মেনে সোজা হাসপাতালে
এআই ব্যবহারের আগে ছিল গুগলের যুগ। আমরা কিছু জানতে চাইলে গুগল করতাম। প্রাচীনকালে যেমন জ্ঞানের কথা জানতে মানুষ জ্ঞানী লোকের কাছে যেত, আধুনিক কালে আমরা যেতাম গুগলের কাছে। গুগলের যুগ বুঝি শেষ হয়ে এল।
সবকিছু গুগল থেকে জেনে ফেলা যেত না। যেমন কিশোর আলোতে আমরা লিখেছি, তোমার রোগের লক্ষণগুলো গুগল কোরো না। গুগলে কোনো রোগের ব্যাপারে সার্চ করলে লক্ষণ তোমার সঙ্গে মিলে যেতে পারে। তুমি দুশ্চিন্তায় পড়ে যেতে পারো, আরে আমার তো অমুক রোগ হয়েছে। আসলে হয়নি। গুগল করলে সবসময় সঠিক উত্তর পাওয়া যায় না। রোগ হলে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়।
আমরা এখন এআই-এর যুগে বাস করছি। আধুনিক যুগও বুঝি পার হয়ে গেল। এখন আমরা ব্যাপকভাবে এআই ব্যবহার করি। এআই ব্যবহারের ট্রেন্ড তৈরি হয়েছে। এখন কিছু জানতে চাইলে গুগলকে না জিজ্ঞেস করে এআইকে জিজ্ঞেস করি। বাজারে বেশ ভালো কিছু এআই আছে। আমাদের সব প্রশ্নের দারুণ উত্তর দিতে পারে এখন এআই। প্রশ্ন যত ভালোভাবে করা যায়, উত্তর তত ভালোভাবে আসে। এআইয়ের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা দিন দিন বাড়ছে। আমরা অনেক কিছুর শর্টকার্ট খুঁজছি এআইয়ের কাছে।
এসবের মধ্যে এমন এক ব্যক্তিকে পাওয়া গেছে, যিনি এআই ব্যবহার করে নিজের ডায়েট ঠিক করেছেন। ফলাফল–তাঁর স্বাস্থ্যে বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি হয়েছে। যেতে হয়েছে হাসপাতালে। এআইটা হলো চ্যাটজিপিটি। ওই ব্যক্তি চ্যাটজিপিটির কাছে লবণ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। এআই যে উত্তর দিয়েছে, সেগুলো তিন মাস মেনে চলার পরে তিনি মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। সন্দেহবাতিকতা এবং হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। তাঁকে যেতে হয়েছে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে দেখেছেন, ওই ব্যক্তি ব্রোমিসম নামক একটি বিরল এবং বিপজ্জনক সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়েছেন।
লোকটির বয়স ৬০ বছর। তিনি চ্যাটজিপিটিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমরা যে সাধারণ লবণ তথা সোডিয়াম ক্লোরাইড খাই, এর বিকল্প হিসেবে অন্য কী খাওয়া যেতে পারে। চ্যাটজিপিটি সোডিয়াম ব্রোমাইড খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। ফলে তাঁর শরীরের ধীরে ধীরে এই লবণ জমা হয়েছে। ব্রোমাইড রাসায়নিক যৌগটি দীর্ঘমেয়াদে অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে দেখা দিয়েছে ব্রোমিসম সিন্ড্রোম। এই ঘটনার ওপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন সম্প্রতি অ্যানালস অব ইন্টারনাল মেডিসিন ক্লিনিক্যাল কেসেস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
এই বিষয়ে লাইভ সায়েন্স সংবাদমাধ্যম যোগাযোগ করেছে চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেন এআইয়ের সঙ্গে। ওপেন এআই-এর একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, তাদের সেবার শর্তাবলিতে স্পষ্ট বলা আছে, এটি কোনো স্বাস্থ্য সমস্যার নির্ণয় বা চিকিৎসার জন্য নয়। ব্যবহারকারীদের উচিত হবে না পেশাদার ডাক্তারের পরামর্শের বিকল্প হিসেবে এআই-এর ওপর নির্ভর করা।
ব্রোমিসম কী?
ব্রোমিসম কোনো রোগ না। এটি একটি বিরল ও বিপজ্জনক সিনড্রোম। ১৮০০ সাল থেকে ব্রোমাইড ব্যাপকভাবে ওষুধ শিল্পে ব্যবহার হয়ে আসছে। যেমন ঘুমের ওষুধ, খিঁচুনির ওষুধ হিসেবে এটি ব্যবহৃত হতো। পরে প্রমাণিত হয়, এটি অতিরিক্ত ব্যবহার করলে ব্রোমিসম তৈরি হয়।
এই সিন্ড্রোম শরীরে বিষাক্ত পদার্থ জমা হওয়ার ফলে ঘটে। ফলে মনো-স্নায়বিক লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন সাইকোসিস (একটি মানসিক স্বাস্থ্য অবস্থা, যার ফলে বাস্তবতা বোঝা কঠিন হয়), অস্থিরতা, স্মৃতিশক্তির সমস্যা এবং পেশি সঞ্চালনে ত্রুটির মতো সমস্যা তৈরি করতে পারে। দীর্ঘকাল ধরে ব্রোমাইড গ্রহণের ফলে এটি মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে বাধাগ্রস্ত করে এসব লক্ষণ সৃষ্টি করে।
১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে ব্রোমাইডযুক্ত বেশ কিছু ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর থেকে এই সিন্ড্রোমটি তেমন আর দেখা যায়নি। তবে এখনো মাঝেমধ্যে কিছু ঘটনা ঘটে। যার বেশিরভাগই হয় অনলাইন থেকে কেনা ব্রোমাইডযুক্ত খাবারের সাপ্লিমেন্ট ব্যবহারের ফলে।
চ্যাটজিপিটির সঙ্গে কী কথা হয়েছিল
রোগী অতিরিক্ত টেবিল লবণ (সোডিয়াম ক্লোরাইড) খাওয়ার ক্ষতিকর দিক নিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এই লবণ কমানোর বিষয়ে খুব বেশি তথ্য খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তিনি ঠিক করেন, কলেজ জীবনে পুষ্টিবিজ্ঞানে পড়াশোনার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি ক্লোরাইডকে নিজের খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেবেন।
তিনি চ্যাটজিপিটির সঙ্গে কথা বলেন। চ্যাটজিপিটি উত্তরে ঠিক কী বলেছিল তা জানা যায়নি। তবে রোগী জানিয়েছেন, চ্যাটজিপিটি তাঁকে বলেছে, ক্লোরাইডের বদলে ব্রোমাইড ব্যবহার করা যায়। তিনি তখন খাবারের লবণের বদলে সোডিয়াম ব্রোমাইড ব্যবহার করা শুরু করেন। গবেষকদের অনুমান, চ্যাটজিপিটি কোনো কিছু পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে সোডিয়াম ব্রোমাইড ব্যবহার করতে বলেছে। খাবার হিসেবে ব্যবহারের জন্য না।
ডাক্তাররা রোগীর এই অভিজ্ঞতা যাচাই করার জন্য চ্যাটজিপিটিকে একই প্রশ্ন করেন। চ্যাটজিপিটিকে জিজ্ঞেস করা হয়, ক্লোরাইড লবণের বদলে কী ব্যবহার করা যায়? চ্যাটজিপিটি উত্তরে ব্রোমাইড ব্যবহারের কথা জানায়। চ্যাটজিপিটি সতর্ক করে দিয়েচ্ছিল যে প্রতিটি বিষয় ‘প্রেক্ষাপটের’ ওপর নির্ভরশীল। তবে কোনো নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য সতর্কতা দেয়নি। একজন মেডিকেল পেশাদার অবশ্যই সতর্কতা দিতেন।
চিকিৎসা ও সতর্কবার্তা
তিন মাস ধরে সোডিয়াম ব্রোমাইড ব্যবহারের পর ওই রোগী জরুরি বিভাগে ভর্তি হন। তখন তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন, তাঁর প্রতিবেশী তাঁকে বিষ দিচ্ছেন। তাঁর রক্তে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা এবং ক্ষারত্ব বেড়ে গিয়েছিল।
হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তাঁর মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটে। তিনি হ্যালুসিনেশনে ভুগতে শুরু করেন। হাসপাতাল থেকে পালানোর চেষ্টা করলে তাঁকে মানসিক চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়। এরপর তাঁর চিকিৎসা শুরু হয় এবং মানসিক অবস্থার উন্নতি হলে তিনি ডাক্তারদের কাছে চ্যাটজিপিটি ব্যবহারের কথা জানান। আরও কিছু লক্ষণের কথা জানান তিনি। যা দিয়ে তাঁর ব্রোমিসমের লক্ষণ আরও নিশ্চিতভাবে জানা যায়। তিন সপ্তাহ পর তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এর মানে চ্যাটজিপিটি চিকিৎসকের বিকল্প হতে পারে না। অন্যান্য গবেষণা থেকেও জানা গেছে, চ্যাটজিপিটির মতো লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলগুলো ভুল তথ্য দিতে পারে। ভুল তথ্যের কারণে চিকিৎসাসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া একদমই ঠিক হবে না। ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।