মা, তোমার কাছে কোনোদিন বড় হতে চাই না

ছবি: এআই আর্ট

‘মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে/ মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।’ পঙ্‌ক্তি দুটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’ কবিতার। কবিতাটি প্রথম শুনেছি মায়ের মুখে। ছোটবেলায় মায়ের কোলে মাথা রেখে যখন ঘুমানোর বায়না করতাম, মা আমাকে কবিতা শোনাতেন, গল্প বলতেন। আমি যদিও ভূতের গল্প শুনতে চাইতাম, কিন্তু ঘুরেফিরে মা আমাকে রাজকুমারের গল্পই বলতেন। গল্প শেষ হলে কপালে চুমু দিতেন। তখন আমি অবাক হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করতাম, ‘মা, আমিই কি এই রাজকুমার?’ মা বলতেন, ‘তা কেন হবে, তুমি তো আমার বীরপুরুষ।’ বলে মা কবিতা পড়তেন, ‘রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে/ রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।/ সন্ধে হল, সূর্য নামে পাটে,/ এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে।’

সেই ছোট্ট আমি বড় হয়েছি। রসায়নে অনার্স শেষ করেছি। কিছুদিন আগে মাস্টার্সও শেষ হলো। লেখাপড়ার প্রসঙ্গ আসতেই একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। লেখাপড়ায় খারাপ ছিলাম না। একাডেমিক প্রোফাইলে কোনো দ্বিতীয় শ্রেণি নেই। তবে কারও সঙ্গে প্রতিযোগিতা করিনি কখনো। আজও কোনো বিষয়ে প্রতিযোগিতা করি না, করবও না কখনো। প্রতিযোগিতা সব সময় নিজের সঙ্গে নিজের। লক্ষ্য সব সময় নিজেকে অতিক্রম করার। এ ভাবনার জন্মও হয়েছে মায়ের জন্য। মা কখনো আমাকে বলেননি, অঙ্কে এক শ পেতে হবে, ইংরেজিতে নব্বই। রোল ১ হতে হবে। ডাক্তার হতে হবে কিংবা ইঞ্জিয়ার হতে হবে। মা সব সময় বলেন, ‘চেষ্টার কোনো ত্রুটি যেন না থাকে। তোমার যেটা ভালো লাগে, করো। তারপর যা হওয়ার হবে।’

আমাদের সময়ে পঞ্চম শ্রেণিতে আলাদা করে বৃত্তি পরীক্ষা হতো। বৃত্তি পরীক্ষা উপলক্ষে সারা বছর ধরে দিতে হতো মডেল টেস্ট। গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম। মডেল টেস্ট পরীক্ষার জন্য আলাদা কেন্দ্র ছিল। একটি ইউনিয়নের সব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওই কেন্দ্রে গিয়ে মডেল টেস্ট পরীক্ষা দিতে হতো। সারা বছরে যতগুলো মডেল টেস্ট হয়, সব কটিতে আমিই ছিলাম প্রথম। সবার ধারণা ছিল, ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাব। উপজেলার সেরা শিক্ষকের কাছে পড়তাম। বাবা বাড়িতেও একজন শিক্ষক রেখেছিলেন পড়া দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু বৃত্তি পরীক্ষার তিন-চার দিন আগে ফুটবল খেলতে গিয়ে পা ভেঙে গেল। ভীষণ যন্ত্রণা। পড়তে পারি না। বসে লিখতে পারি না। মা পড়ে পড়ে শোনান। আমি বলি, ‘পরীক্ষা দেব না, মা। পরীক্ষায় পারব না বসে লিখতে।’ মা বলেন, ‘অংশগ্রহণ তো করো। বৃত্তি পেতেই হবে, এমন তো কোনো কথা নেই।’ আমি বলি, ‘বৃত্তি না পেলে সবাই বলবে, মডেল টেস্টে প্রথম হয়ে লাভটা কী হলো!’ মা বলেন, ‘না দিলেও বলবে। তা ছাড়া কে কী বলল, তাতে কী আসে–যায়।’

আমাদের নতুন বাড়িতে বসার ঘরের একেবারে দরজার পাশেই বেসিন। আমি বেল্টের জুতা পরি। কোথাও বেরোনোর সময় জুতা পরে এক পা লাফ দিয়ে বেসিন থেকে হাত ধুয়ে মায়ের আঁচলে হাত মুছি। মুখ মুছি।

সত্যি সত্যি আমি সাধারণ গ্রেডেও বৃত্তি পাইনি। বাড়ির সবাই অসন্তুষ্ট। বাবার কলিগ, পরিচিত অনেকের ছেলে-মেয়েরা বৃত্তি পেয়েছে। ‘মা আমাকে আশকারা দিয়ে মাথায় তুলেছে’সহ নানা কথা মাকে তখন শুনতে হয়েছে। আজও আমি কোনো ভুল করলে বাড়ির সবাই মাকেই বকাবকি করে। আমার জন্য মায়ের দিকে আঙুল তোলে। মনে আছে, বৃত্তি না পাওয়ায় বাড়ির অনেকেই আমার সঙ্গে বেশ কিছুদিন ভালো করে কথা বলেনি। কিন্তু মা, বিশাল আকাশের মতো পরম মমতা নিয়ে পাশেই ছিলেন। সেদিনও ভাত মেখে গালে তুলে খাইয়ে দিয়েছিলেন।

মা আমাকে কখনো থামতে দেননি। আমার মা সংসার অন্তঃপ্রাণ। লেখাপড়া জানা মাকে কখনো যেমন বোকা মনে হয়, কখনো আবার মনে হয় বুদ্ধিমতী। বাবার সঙ্গে দ্বিমত, তর্কবিতর্ক যে হয় না, তা নয়। তবে মাকে কখনো রাগ করে নানুর বাড়ি যেতে দেখিনি। আমি ঢাকা থেকে বাড়ি গেলে যত রাতই হোক, মা জেগে বসে থাকেন। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাত গরম করেন। আমি খেতে ভালোবাসি, মাছ–মাংস, এটা–সেটা রেঁধে রাখেন।

আমাদের নতুন বাড়িতে বসার ঘরের একেবারে দরজার পাশেই বেসিন। আমি বেল্টের জুতা পরি। কোথাও বেরোনোর সময় জুতা পরে এক পা লাফ দিয়ে বেসিন থেকে হাত ধুয়ে মায়ের আঁচলে হাত মুছি। মুখ মুছি। আমার মায়ের পছন্দ-অপছন্দের যে শাড়িই পরনে থাক না কেন, মা না বলেন না। ঢাকায় আসার সময় বড় রাস্তার মাথা পর্যন্ত হেঁটে আসেন। বলেন, ‘গাড়িতে কেউ কিছু দিলে খাবে না। গিয়েই ফোন করবে।’ আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলি। মায়ের আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে ভ্যানে উঠে রওনা দিই। মনে মনে বলি, ‘মা, তুমি আজীবন আমার সঙ্গে এভাবেই থেকো। আমি তোমার কাছে, বাবার কাছে কোনো দিন বড় হতে চাই না, বড় হব না।’

আরও পড়ুন