কিছু মানুষ কেন কলম কামড়ায়
দৃশ্যটা বেশ পরিচিত। পরীক্ষার হল কিংবা ক্লাসে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছ। হঠাৎ খেয়াল করলে, হাতের কলমটা মুখের ভেতরে এবং নিজের অজান্তেই প্লাস্টিকের খাপটা চিবিয়ে চ্যাপটা করে ফেলেছ! শৈশবে হয়তো এর জন্য বড়দের বকুনি শুনেছ। আমরা একে নিছকই একটা বাজে অভ্যাস বলে উড়িয়ে দিই। কিন্তু মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, কলম, পেনসিল বা শার্টের হাতা চিবানো আমাদের মস্তিষ্কের একধরনের বিশেষ ভাষা। এটা কেবল অভ্যাস নয়, বরং আমাদের অবচেতন মনের অস্থিরতা। কেন আমরা এমন করি? এর পেছনে বিজ্ঞান কী বলে? চলো, মনের সেই গোপন দরজায় উঁকি দেওয়া যাক।
মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এই আচরণকে বলা হয় সেলফ-স্টিমুলেটরি বিহেভিয়ার বা সংক্ষেপে স্টিমিং। ব্যাপারটা একটু সহজ করে বলা যাক। ধরো, তুমি খুব দুশ্চিন্তায় আছ কিংবা কোনো জটিল সমস্যার সমাধান খুঁজছ। এ সময় তোমার মস্তিষ্ক অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই বাড়তি চাপ বা উত্তেজনা কমানোর জন্য মস্তিষ্কের একটা নির্গমন পথ দরকার হয়। কারও ক্ষেত্রে সেটা পা নাচানো, কারও ক্ষেত্রে নখ কামড়ানো বা কলম চিবানো।
চিবানোর সময় আমাদের চোয়ালের পেশিগুলোয় যে নড়াচড়া হয় এবং দাঁতের ওপর যে চাপ পড়ে, তা মস্তিষ্কে একধরনের সংকেত পাঠায়। এই সংকেত মস্তিষ্ককে শান্ত করতে এবং মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে। অর্থাৎ তুমি যখন কলম চিবাও, তখন নিজের অজান্তেই নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করো।
তবে মানুষ যে সব সময় টেনশন থেকেই কলম চিবায়, ব্যাপারটা তা নয়। স্কটস ভ্যালি ও দ্য ফোকাসের মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, গভীর মনোযোগ বা একাগ্রতার সঙ্গেও এর সম্পর্ক আছে।
আমরা যখন খুব কঠিন কোনো কাজ করি, তখন আমাদের মস্তিষ্ক বাইরের সব শব্দ বা দৃশ্য থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। চিবানোর মতো একটা একঘেয়ে বা ছন্দময় কাজ মস্তিষ্ককে বাইরের বিশৃঙ্খলা আটকাতে সাহায্য করে। খেয়াল করলে দেখবে, পরীক্ষার হলে কোনো কঠিন প্রশ্নের উত্তর ভাবার সময় চাপে এই প্রবণতা বেড়ে যায়। তখন কলমটা হয়ে ওঠে তোমার চিন্তার সঙ্গী।
বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের একটা তত্ত্ব আছে—ওরাল ফিক্সেশন। জন্মের পর মানুষের প্রশান্তির প্রথম উৎসই হলো মুখ। মায়ের দুধ খাওয়া বা আঙুল চোষার মাধ্যমে শিশুরা নিরাপত্তা অনুভব করে। বড় হয়ে আমরা সেই অভ্যাস ছেড়ে দিই ঠিকই, কিন্তু অবচেতন মনে সেই নিরাপত্তার আকাঙ্ক্ষাটা থেকে যায়।
তাই যখনই আমরা মানসিক চাপ বা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি, আমাদের হাত অবচেতনভাবেই মুখের কাছে চলে যায়। সেটা কলম চিবানো হোক বা শার্টের হাতা মুখে দেওয়া, সবই সেই আদিম প্রশান্তির খোঁজে।
কিছু মানুষের মস্তিষ্ক অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা। তাদের সব সময় কিছু না কিছু অনুভূতির দরকার হয়। চুপচাপ বসে থাকা তাদের জন্য কঠিন।
তারা যখন কলমের শক্ত প্লাস্টিক বা পেনসিলের কাঠের গঠন দাঁত দিয়ে অনুভব করে, তখন তাদের স্নায়ুতন্ত্র আরাম পায়। বিশেষ করে যারা একটু চঞ্চল প্রকৃতির বা যাদের এডিএইচডি আছে, তাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এডিএইচডি মানে অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার। এটি এমন একটি অবস্থা, যার জন্য মানুষের মনোযোগ সহজে ছুটে যায়। মাথায় অনেক ভাবনা ঘোরে এবং শরীর ও মন একটু বেশিই চঞ্চল হয়ে পড়ে।
তবে মাঝেমধ্যে কলম চিবানো খুব বড় কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু টাইডস মেন্টাল হেলথের বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, যদি দেখো তুমি কলম চিবিয়ে প্লাস্টিক গিলে ফেলছ বা পেনসিলের কাঠ খেয়ে ফেলছ, তবে সাবধান হতে হবে! একে বলা হয় পিকা। এটা হলো অখাদ্য বস্তু খাওয়ার একধরনের মানসিক রোগ। এ ছাড়া অতিরিক্ত চিবানোর ফলে দাঁতের এনামেল নষ্ট হয়ে যেতে পারে, দাঁতে ফাটল ধরতে পারে এবং পেটে জীবাণু ঢুকে সংক্রমণ হতে পারে।
তাহলে সমাধান কী? যদি দেখো এই অভ্যাস তোমার পিছু ছাড়ছে না, তবে নিজেকে দোষ দেবে না। মনে রাখবে, এটা তোমার মস্তিষ্ক শান্ত হওয়ার কৌশল। তবে কলমের বদলে নিরাপদ কোনো বিকল্প বেছে নিতে পারো। কিছু চিবানোর ইচ্ছা হলে চুইংগাম চিবাতে পারো। হাতের কাছে রাখতে পারো একটা স্ট্রেস বল। কলম মুখে না দিয়ে বলটা চাপতে পারো। হাত ব্যস্ত থাকলে আর কলম কামড়াতে হবে না।
মোদ্দাকথা, কলম কামড়ানো কোনো নোংরামি বা বেয়াদবি নয়। মানুষ গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকলে অথবা ভেতরে ভেতরে খুব উদ্বিগ্ন থাকলে কলম কামড়াতে পারে।
সূত্র: টাইডস মেন্টাল হেলথ, ফোকাস ডট নিউজ ও ফাংশনাল স্মাইল ডটকম