নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে
কাশবনে বৃষ্টি ঝরে, ঘাসবনে সাড়া পড়ে তার। মেঠোপথে দিনদুপুরেই আঁধার নামে, রাখাল ছেলে পথ ভুলে থমকে দাঁড়ায়। বকের সারি উড়ে এসে লুকিয়ে পড়ে চৌধুরীদের বাঁশবনে।
ফররুখ আহমদের বৃষ্টির ছড়ার সঙ্গে আমার ছেলেবেলা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। খুব ছোট তখন। গাঁয়ের ভেজা মেঠোপথ পেরিয়ে স্কুলে যেতে হয়। তখনকার স্কুলের সিলেবাসগুলোও অমনভাবেই সাজানো। ‘বৃষ্টির ছড়া’ যখন পড়ছি, তখন ঘোর বর্ষাকাল। স্কুলের কাছেই চৌধুরীদের ৩০ বিঘা আয়তনের বিশাল বাঁশবাগান। সেই ঘনকালো বাঁশবাগান পেরিয়ে স্কুলে আসি। বক, শালিক, কাকদের নিত্য আনাগোনা সেখানে। হঠাৎ যদি বৃষ্টি আসে, পাখিরা দল বেঁধে সেখানে ঘন বাঁশপাতার আড়ালে লুকিয়ে ফেলে নিজেদের। আমরাও পথভোলা রাখালের মতো থমকে যাই, বাঁশঝাড়ের নিচে আশ্রয় নিই। তারপর বৃষ্টি যখন ধরে আসে, আবার স্কুল বা বাড়ির পথ ধরি। বাঁশবাগান বৃষ্টির হাত থেকে পুরোপুরি বাঁচাতে পারে না। আবার পুরোপুরি ভেজাও না। বৃষ্টি কমলে বাঁশবাগান ছেড়ে স্কুলের মাঠে পা রাখি।
স্কুলে হয়তো ঘণ্টা পড়ে গেছে ততক্ষণে। মাঠে জমেছে গোড়ালিসমান পানি। তার ওপর চোরকাঁটার দাপট। চোরকাঁটা স্কুলের মাঠকে সুরক্ষা দেয়। সারা বছর দেখতে সবুজ কার্পেটের মতো, ছোট্ট ছোট্ট জমাট ঘাস। কিন্তু বৃষ্টি এলেই ৮-১০ ইঞ্চি শিষ বের হয়। সেই শিষ ভরে ওঠে চোরকাঁটায়। পরনে ফুলপ্যান্ট থাকলে চোরকাঁটার দল গেঁথে যায় প্যান্টের কাপড়ে। অবসর সময়ে কিংবা ছুটির পর বাড়ি ফিরে প্যান্ট থেকে খুঁটে খুঁটে চোরকাঁটা তোলার যে মজা ছিল, একালে মোবাইল গেমের যুগে ছেলেমেয়েরা সেই মজা কোথায় পাবে!
ক্লাস শুরু হয়, তখনই হয়তো আবার জোর বৃষ্টি নামে। স্কুলের টিনের চালের সেই বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ এত বছর পরও যেন স্পষ্ট শুনতে পাই। স্কুলের সামনে দারুণ একটা ফুলবাগান। চারপাশ কোমরসমান উঁচু ইটের পাঁচিল। ঘন ইটের নয়। একটা ইটের পর ফাঁকা, আবার ইট, আবার ফাঁকা। সব মিলিয়ে ইটের তৈরি রেলিং বললেই চলে। ২০ হাত পরপর একটা করে লোহার গ্রিলের গেট। বউন্ডারির বাইরে চোরকাঁটায় ভরা খেলার মাঠ।
স্কুলের ঘণ্টা পড়ার আগে, কিংবা টিফিন পিরিয়ডে আমরা সেই পাঁচিলে পা ঝুলিয়ে বসে গল্প করি, দুষ্টুমি, মারামারি—যত রকমের নিরীহ বাঁদরামি আছে, সব চলে।
বাউন্ডারির ভেতর স্কুলের ঘরগুলোর সামনে সার দিয়ে নানা রকম ফুলের গাছ লাগানো। গোলাপ, টগর, গন্ধরাজ, পেনসিল ক্যাকটাস, কাঠগোলাপ, জুনিপার ঝাউয়ের ঝোপ এবং একটা বাগানবিলাস। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে বাগানের ঠিক মাঝবরাবর দাঁড়িয়ে আছে একটা কদমগাছ। বর্ষা এলে ফুলে ফুলে ভরে যায়। ফুলের ভারে যেন কদমের ডাল নুয়ে পড়ে। পাঁচিলের ওপর থেকে ফুল পাড়া যায়। ফুল যে পাড়তে নেই, দেখেই সাধ মেটাতে হয়—সেই শৈশবে এই বোধ আমাদের হয়নি। কদম ফুল আর দশটা ফুলের চেয়ে আলাদা। এর প্রতি আমাদের টান দামি খেলনার চেয়েও বেশি। আমি অতটা চালাক-চতুর নই—তাই একটা ফুলও আমার কপালে জোটে না। দেখতে না দেখতে হাতের নাগালের সব ফুল সাবাড় করে ফেলে বন্ধুরা। তারপর আর যখন উপায় নেই নিচ থেকে পাড়ার, কেউ কেউ ক্লাসরুমের দেয়ালে ইটের খাঁজে খাঁজে পা রেখে উঠে পড়ে টিনের চালে। ঝুড়ি ঝুড়ি কদম ফুল পেড়ে আনে। বৃষ্টিধোয়া সেই ফুল যেন স্বর্গ থেকে নিয়ে এসেছে কেউ। মাঝেমধ্যে লাজশরমের মাথা খেয়ে বন্ধুদের কাছ থেকে ফুল চাই। কারও দয়া হলে মাঝেমধ্যে দেয়। তখন সে কী আনন্দ!
ফুল তো বেশিক্ষণ খেলার জিনিস নয়। স্কুল ছুটি হওয়ার আগে বৃষ্টিভেজা নরম মাটিতে কদম ফুলের কিশোরে সয়লাব হয়ে যায়। কদম ফুলের গন্ধও বেশ মিষ্টি। ঘোর বৃষ্টি মাথায় যখন ক্লাস করি, বাইরের মুষলধারে ভেজা জগৎটা হাতছানি দেয়, কিন্তু ক্লাস ছেড়ে বেরোনোর উপায় থাকে না, তখন কদম ফুলের এই মিষ্টি ঘ্রাণ মনকে সতেজ করে তোলে।
আমাদের সেই স্কুলমাঠের বাগানটা আজ আর নেই। নেই সেই কোমরসমান উঁচু পাঁচিলও। কিন্তু কদমগাছটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। বয়স বেড়েছে, মোটা হয়েছে, হয়েছে আরও উঁচু। গ্রামে গিয়ে কদমতলায় বসে শৈশবের সেই বৃষ্টির ছন্দ শোনার চেষ্টা করি। এখন তাই বৃষ্টিদিনের সেই স্মৃতিটুকুই সম্বল। আর জসীমউদ্দীনের ‘পল্লীবর্ষা’র ও লাইনগুলো—
আজিকার রোদ ঘুমায়ে পড়িছে ঘোলাটে মেঘের আড়ে
কেয়া-বন-পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জলধারে।
কাহার ঝিয়ারি কদম্ব-শাখে নিঝ্ঝুম নিরালায়,
ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!
২
বর্ষায় মাঠে পানি জমে। ধানখেত, পাটখেত ডুবে যায়। এ সময় নিচু জমিতে ‘শাইল কেলে’ নামে একধরনের কালো ধান থাকে। জমিতে বৃষ্টির পানি যত জমে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে ওঠে সেই ধান। পাটগাছগুলো আগেই বড় হয়ে গেছে। তাই বৃষ্টিতে ডুবে মরার ভয় পাটের নেই। তবে একটানা বৃষ্টি হলে সবজি ও মরিচের খেতগুলো পুরো নষ্ট যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আষাঢ়’ কবিতায় তাই লিখেছিলেন—
‘বাদলের ধারা ঝরে ঝর-ঝর,
আউশের খেত জলে ভর-ভর,
কালী-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার
ঘনিয়েছে দেখ্ চাহি রে।’
একটা ঝুম বৃষ্টির পরে খালে ঢল নামে। মাঠের পানি বিকট গর্জন করে হুড়মুড় করে গিয়ে পড়ে ছোট্ট ইছামতীর বুকে। সারা বছর শান্ত-ছোট্ট নদীটাও তখন অশান্ত হয়ে ওঠে। দুকূল ছাপিয়ে যায়। পাড় ভাঙে, পাড়ের অনেক গাছপালা উপড়ে গিয়ে নদীর বুকে ডুব দেয়। প্রবল বেগে ইছামতীতে স্রোত বয়। এই ছোট্ট ইছামতী এখান থেকে শ খানেক কিলোমিটার দূরে সাতক্ষীরায় গিয়ে বিশাল নদীতে রূপ নিয়ে সুন্দরবন ভেদ করে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে।
সারা বছর আমরা গোসল করি ইছামতীতে। বর্ষা এলে যেন সাজসাজ রব পড়ে নদীর বুকে। রাজ্যের দাম, শেওলা, কচুরিপানা স্রোতের তালে তালে দোল খেতে খেতে ভেসে যায়। ভেসে যায় শত শত কলাগাছও। নদীর এই আগ্রাসী রূপের কথাও রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—
‘পুবে হাওয়া বয়, কূলে নেই কেউ,
দু কূল বাহিয়া উঠে পড়ে ঢেউ,
দরদর বেগে জলে পড়ি জল ছলছল উঠে বাজি রে।
খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে…’
এ সময় নদীতে গোসল করা কিছুটা কঠিন। কারণ, গোসলের ঘাট ডুবে গেছে, এখন পাড় থেকে নদীতে নামলে সাঁতারপানি। সাঁতার না জানলে নদীতে নামা চলে না, কোথাও ঠাঁই নেই। কিন্তু গাঁয়ের ছেলেমেয়েদের কে রুখবে? পাঁচ-ছয় বছর বয়সেই সাঁতারে ওস্তাদ হয়ে ওঠে। আমি নিজে সাঁতার শিখেছিলাম চার বছর বয়সে। ভরা নদী পাড়ি দেওয়ার চ্যালেঞ্জে নামি। রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে। প্রবল স্রোত সামলে ওপারে যাওয়াটা বড্ড কঠিন। দম ধরে রাখা আরও কঠিন। কিন্তু আমরা একটা পদ্ধতি বের করে ফেলি। সোজা পাড়ি না দিয়ে না ১০০ মিটার উজানে চলে যাই। তারপর কোনাকুনি সাঁতার কেটে গিয়ে ওপারে উঠি।
নদীতে হয়তো সাঁতরাচ্ছি, কখন যে ঘন মেঘ জমে ওঠে ঈশান কোণে, টের পাইনি। তারপর হঠাৎই ভরদুপুরে সন্ধ্যার আঁধার নামে। বৃষ্টি নামে নদীতে। বৃষ্টির ফোঁটা চাবুকের মতো মাথায়-পিঠে বাড়ি মারে। সে ভারি ঝামেলার ব্যাপার। পিঠ বাঁচানোর জন্য ডুব দিই। পানির নিচ থেকে শুনি ইছামতীর বুকে বৃষ্টি পতনের শব্দ। এই শব্দ অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে আলাদা। ভালো লাগার অন্য রকম অনুভূতি তৈরি হয় তখন।
বর্ষার শুরুতেই মাঠ থেকে খাল বেয়ে যে বৃষ্টির ঢল নামে, তার উজানে ইছামতীর বুক থেকে ছোট দেশি মাছের দল উঠে আসে নিচু জমিতে। পুঁটি, মলা, ঢ্যালা, টাকি মাছেরা উজানের স্রোত ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে এগোয় মাঠের দিকে। মাঠের পানিতে ওরা ডিম ছাড়বে। কিন্তু মাঠে আর পৌঁছাতে পারে কই! খালের মুখে, মাঠে সরু নালায়, মানুষ ঘুনি-দেউড়ি নামের মাছ ধরা ফাঁদ পেতে রাখে। এসব ফাঁদে সহজেই ঢোকা যায়, কিন্তু বেরোনোর উপায় নেই। তারপরও কিছু মাছ এসব ফাঁকি দিয়ে মাঠে চলে যায়। ওরা ডিম পাড়ে, ছানাপোনার আঁতুড়ঘরও এই মাঠ। শরতের শেষে আবার যখন বৃষ্টির ঢল নামে, আবার যখন মাঠঘাট ডুবে যায়, মাঠের পানি একইভাবে খাল বেয়ে নেমে যায় ইছামতীর পাড়ে। ছোট মাছের পোনারা অনেকটাই সাবালক হয়ে ওঠে তত দিনে। ঢলের স্রোতে গা ভাসিয়ে তারা ইছামতীর ঠিকানায় পাড়ি দিতে চায়। বেশির ভাগই মানুষের হাতে ধরা পড়ে। বাকিরা নদীতে নেমে পড়ে।
বর্ষাকালে যখন মাছ ধরার ধুম পড়ে, সেই ধুমে আমিও অংশ নিই। শিটকি নামের তেকোনা ঠেলা জাল নিয়ে মাঝ ধরি। এ সময় বড় বড় পুঁটি আর ট্যাংরা ধরা পড়ে।
৩
তুমুল বৃষ্টি শুরু হলে আমরা বাবা-মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়ি রাস্তায়। ভিজতে। বৃষ্টিতে ভেজার যে মজা, সেটা আর কিছুর সঙ্গে তুলনা চলে না। তড়বড় করে বৃষ্টি পড়ে। গোড়ালিসমান পানি জমে উঠানে, রাস্তায়। আমরা ভিজে চলি। বৃষ্টি যখন ধরে আসে, তখন বাড়ি ফিরতে হয়। কিন্তু ছাদে পর্যাপ্ত পানি জমেছে। সরু নালা বেয়ে অত পানি একসঙ্গে বেরোতে পারে না। তাই বৃষ্টি থেমে গেলেও ছাদের সেই নালা থেকে পানি সরু ধারায় আছড়ে পড়ে মাটিতে। আমরা সেই ধারার নিচে দাঁড়াই, বাথরুমের শাওয়ারের মতো বৃষ্টির পানি আমাদের মাথায় পড়ে। সুড়সুড়ি লাগে মাথায়। তারপর নালার ধারা যখন শেষ হয়, তখন ঘরে উঠে আসি। মায়ের বকুনি খেতে হয়। কখনো কখনো জ্বর আসে।
বর্ষাকালে মাঠে খাদ্যসংকট দেখা দেয় শিয়াল-বেজি কিংবা গুইসাপদের। তখন এরা লোকালয়ে চলে আসে। বেজি আর গুইসাপ আসে দিনের বেলায়। শিয়াল আসে রাতে, কখনো কখনো দিনের বেলায়ও লোকচক্ষুর সামনে থেকে মুরগি কিংবা হাঁস নিয়ে পালায়। আমরা লাঠিসোঁটা নিয়ে ওদের ধাওয়া করি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে। পাঠখেত আর গোরস্তানে শিয়ালের বাস। বেজি আর গুইসাপের বাস মাঠজুড়ে—সহজে ওদের পাওয়া যায়!
বর্ষাকালে গ্রামে পথঘাটের দুই পাশ সবুজ হয়ে ওঠে। পথের দুই পাশে ঝোপঝাড়গুলো বৃষ্টির পানি থেকে নাইট্রোজেন শুষে লকলকিয়ে বেড়ে ওঠে। তাই গ্রামের মেঠোপথগুলো বড্ড অচেনা মনে হয় এ সময়। বৃষ্টিস্নাত রাস্তাঘাট বড্ড ভয়ংকর হয়ে ওঠে। একা একা চলতে গেলে গা ছমছম করে।
বৃষ্টির পানিতে মাটিতে যেসব ঝোপঝাড়ের বীজ জমা হয়, সেগুলোও দ্রুত অঙ্কুরিত হতে শুরু করে। বড় বড় গাছের ডালপালা সবুজ পাতায় ছেয়ে যায়। বাগান কিংবা ফসলের খেতের বেড়াগুলো ডগমগে বুনো লতায় ভরে ওঠে।
বর্ষায় ফল পাকে। বুনো ফল, ঘরের ফল দুটোই। এ সময়কার ভ্যাপসা গুমোট আবহাওয়া ফল পাকাতে ওস্তাদ। গাছের পেয়ারাগুলো পাকছে না। জোর একটা বৃষ্টির পরেই দেখা যায় ম্যাজিক। খেজুর পাকে এ সময়, জাম পাকে। গাঁয়ে জাম ও খেজুরের অর্থমূল্য নেই। গাছ যারই হোক, যে কেউ তা পাড়ার অধিকার রাখে। গাছের মালিক দেখলেও কিছু বলেন না। এটা চুরি নয়, প্রথা।
নানাদের কয়েকখানা খেজুরবাগান ছিল। বৃষ্টি হলে গাছি মামা গিয়ে এক কাঁদি ডাঁসা খেজুর এনে ঝুলিয়ে দিতেন রান্নাঘরের দরজায়। তারপর একটা-দুটো করে পাকে, আমরা ছিঁড়ে খাই।
এ সময় কাঁঠাল পাকে। আমার চাচাদের কাঁঠালবাগান ছিল। বড়রা কখন কাঁঠাল পেড়ে আমাদের খাওয়াবেন, সে ভরসায় থাকলে চলে না। আমার প্রায় সমবয়সী দুই ভাই শাহনূর আর ফিন্টু মিলে কাঁঠাল খাওয়ার ফন্দি আঁটি। বেশ বড়সড় একটা কাঁঠাল পেড়ে পুঁতে রাখা হলো বাগানের এক কোণে। ঝোপঝাড়ের আড়ালে। মাটির নিচে রাখলে কাঁঠাল দ্রুত পাকে। তাই এই ফন্দি। কিন্তু অত বড় কাঁঠাল তিন ভাই মিলে খেতে পারব কি না—সে কথা মাথায় আসেনি। আমাদের হিসাব ছিল ২৪ ঘণ্টা। অর্থাৎ পরদিন বিকেলে গিয়ে গর্ত থেকে পাকা কাঁঠাল বের করে খাওয়ার পরিকল্পনা করি। রাতে জোর বৃষ্টি হয়। পরদিন যথাসময়ে সেখানে গিয়ে দেখি গর্তের মুখ খোলা। কাঁঠাল গায়েব! কেউ কি চুরি করল? কাঁঠালের খোসা-বাকল পড়ে আছে। যে খেয়েছে, গুছিয়ে খায়নি। অর্থাৎ মানুষের কাজ নয় এটা। এভাবে কাঁঠাল খাওয়ার বুদ্ধি একমাত্র শিয়ালের আছে! আমাদের নিজের মতো করে কাঁঠাল খাওয়ার সাধ মিটে যায় সেদিন।
৪
বর্ষার কালো মেঘ দেখে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে…’
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শেষ বছরে বর্ষাকালে পড়েছিলাম কবিতাটা। বৃষ্টির ছড়া থেকে বেরিয়ে তখন আকাশে মেঘ দেখলেই আপন মনে বলে উঠতাম ‘ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে’। কিন্তু নিজেই বের হয়ে যেতাম। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, ‘ওই ডাকে ধেনু ঘন ঘন ঘন, ধবলীরে আন গোহালে।’ এ লাইনটার পেছনে একটা গল্প আছে। গাঁয়ে যাঁরা কখনো বাস করেননি, তাঁরা হয়তো ভাবেন উঠানে বা খোলা কোনো জায়গায় ধবলী নামের একটা গাভি বাঁধা আছে, কবি সেটাকে গোয়ালে নিয়ে আসতে বলছেন। ঘটনা হলো, আমাদেরও একটা গাভি ছিল। সকালে সেটা মাঠে বেঁধে রেখে আসতাম। এমন জায়গায়, যেখানে প্রচুর ঘাস আছে। লম্বা দড়ির মাথায় একটা খুঁটা লাগিয়ে সেটা মাটিতে পোঁতা হয়, মুগুর দিয়ে ঘা মেরে মেরে। দড়ির অন্য প্রান্তে গরু বাঁধা। দড়ি লম্বা, তাই অনেকটা জায়গা ঘুরে ঘুরে ঘাস খেতে পারে। সকালে বেঁধে রেখে আসতাম, সন্ধ্যায় ফিরিয়ে আনা হতো। কিন্তু বর্ষাকালে দুপুরের পরেই যদি মেঘ করে, গরু ভাবে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাড়িতে হয়তো তার বাছুর বাঁধা। তাই ঘন ঘন ডাকতে থাকে। সেই ডাক শুনে অথবা না শুনেই আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখলেই গরু আনতে ছুটে যেতাম মাঠে। ঠিক এমন দৃশ্য গোটা বাংলার ঘরে ঘরে চিত্রিত হতো এবং হয় এখনো। এ দৃশ্যটাই কবি ওই দুই লাইনে আঁকার চেষ্টা করেছেন।
বর্ষায় স্কুলমাঠে ফুটবলের আসর জমে। হাট লাগোয়া মাঠ, তাই দর্শকের অভাব হয় না। বৃষ্টির মাঝখানে একটু ফাঁক পেলেই ফুটবল খেলা জমে ওঠে। আমরা বাড়ি কিংবা দূরের মাঠ থেকেও ‘গোল’ হওয়ার পর দর্শকদের উল্লাসধ্বনি শুনতে পাই। হাট শেষে গাঁয়ের লোকেরা বাড়ি ফেরে, কেউ কাঁঠাল হাতে, কেউ–বা দড়িতে ইলিশ ঝুলিয়ে। শক্ত-আঠালো কাদায় প্যাচপেচে রাস্তা। জুতা-স্যান্ডেল বগলে নিয়ে হাটুরে লোকেরা সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে কাদার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে।
৫
আষাঢ়-শ্রাবণে অনেক দিনই মাঠে আটকা পড়েছি। গাঁয়ের আমবাগানগুলোতে ছোট্ট কুঁড়েঘর থাকে। রাতে পাহারা দেওয়ার জন্য। আম ফুরালেও কুঁড়েঘর থাকে সারা বছরই। কত বাদলামুখর দিনে মাঠে আটকে পড়ে ওসব কুঁড়েঘরে কাটিয়েছি। বৃষ্টির পর ভেজা গাছ থেকে টুপটুপ করে পনির ফোঁটা পড়ে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর নির্দিষ্ট ছন্দে। এই এক ফোঁটা বৃষ্টির জন্য আজও ঘর থেকে পালাতে রাজি। তারপর ধরো, পদ্ম কিংবা কচুপাতার কথা। সারা দিন বৃষ্টি হবে, কিন্তু পদ্ম কিংবা কচুপাতার গা একটু ভিজবে না। এক ফোঁটা পানি পাতার ঠিক মাঝখানে জমে থাকবে হীরার টুকরার মতো। কিন্তু ধরতে গেলেই ছিটকে মাটিতে পড়ে যাবে। এই দৃশ্য বর্ষাকাল ছাড়া আর কখন দেখবে!
এখন অনেকেই বৃষ্টিবিলাসের জন্য বর্ষাকালে কোনো ইকো রিসোর্টে গিয়ে দিন কাটিয়ে আসে। শহুরে বাবুদের জন্য এই বৃষ্টিবিলাস বেশ সুখের। কিন্তু গাঁয়ের মানুষেরা বৃষ্টিবিলাসে অভ্যস্ত, তাই তারা অত কিছু লক্ষ করে না। বৃষ্টির ছন্দে মাতাল হয় কেবল স্বপ্নবান কিছু কিশোর, যারা বিভূতিভূষণ, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ কিংবা জসীমউদ্দীনের মতো রোমান্টিসিজমে আক্রান্ত।
নব্বইয়ের দশকের সেই কিশোরেরা এখন মাঝবয়সী, তাঁদের বেশির ভাগই গ্রামে থাকেন। আমার মতো কিছু অভাগা স্বপ্নপূরণের আশায় শহরে পড়ে আছি, বর্ষা আমাদের জসীমউদ্দীনের মতোই নস্টালজিক করে, তাই তাঁর কবিতা থেকে ধার করে বৃষ্টির দিনে আওড়ে যাই—
আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলধারে,
বেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে।