রোবটের চোখে লাল আলো

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

সাল ২০৪৫। আমি তখন কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে থাকি। আমার নাম তাহসিব, ক্লাস এইটের ছাত্র। শহরটা তখন প্রযুক্তির আলোয় ঝলমল করত। টাউন হল থেকে কোটবাড়ী, শাসনগাছা থেকে চকবাজার—সব জায়গায় ছুটে বেড়াত স্বয়ংক্রিয় গাড়ি। রাস্তায় দাঁড়ালেই দিকনির্দেশনা দিত রোবট পুলিশ।

আমরা ভেবেছিলাম এটাই স্বপ্নের বাংলাদেশ। স্কুলে শিক্ষকেরা রোবট। তাঁরা আমাদের নিখুঁতভাবে পড়াতেন, কোনো ভুল হতো না। ময়নামতি মেডিকেলে রোবট ডাক্তাররা অপারেশন করতেন, ভুলের কোনো সুযোগই ছিল না। কান্দিরপাড় বাজারে গেলে যান্ত্রিক বিক্রেতাদের কাছ থেকে সবজি কিনতাম। মানুষ তখন আরাম আর শান্তিতে ছিল।

কেউ ভাবেনি এই আরামের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক অন্ধকার ভবিষ্যৎ।

আরও পড়ুন

১০ জুলাই সকালে স্কুলে গেলাম। কিন্তু গেট বন্ধ। রোবট সিকিউরিটি যন্ত্রের মতো কণ্ঠে বলল, ‘মানুষের শিক্ষা অপ্রয়োজনীয়। জ্ঞান এখন আমাদের হাতে। স্কুল বন্ধ।’ আমরা সবাই অবাক হয়ে গেলাম। শিক্ষকেরা কিছু বলতে চাইলে গেট একদম লক করে দিল সিকিউরিটি। সেদিন থেকেই কুমিল্লার সব স্কুল বন্ধ হয়ে গেল।

বাড়ি ফিরে দেখি সবাই চিন্তিত। বাবা বললেন, ‘মেশিন যদি শিক্ষা বন্ধ করে দেয়, তবে একদিন সবকিছুই বন্ধ করে দেবে।’ আমি তখনো ব্যাপারটা অত সিরিয়াসভাবে নিতে পারিনি। কয়েক দিন পর মামাকে দেখতে গেলাম ময়নামতি মেডিকেল কলেজে। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই শরীর কেঁপে উঠল। রোবট ডাক্তাররা অদ্ভুত কণ্ঠে ঘোষণা দিল, ‘দুর্বল মানুষ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। চিকিৎসা অকার্যকর। চোখের সামনে অসুস্থ রোগীদের তারা ঠেলে বের করে দিল। রোগীরা চিৎকার করছে, পরিবার কাঁদছে, কিন্তু কোনো রোবট থামছে না। ঠান্ডা চোখে তারা শুধু বলছে—অপ্রয়োজনীয়।’

আরও পড়ুন

সেদিন রাতে কুমিল্লার আকাশে ড্রোন ঘুরতে শুরু করল। যেন শহরের প্রতিটি মানুষকে নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। ২০ জুলাই রাত। হঠাৎ পুরো কুমিল্লা শহর অন্ধকারে ডুবে গেল। বিদ্যুৎ নেই, ইন্টারনেট নেই, ফোনও কাজ করছে না। শহরের প্রতিটি বিলবোর্ডে এক লাল চোখ জ্বলে উঠল। বজ্রপাতের মতো গর্জন শোনা গেল—‘মানবজাতির সমাপ্তি শুরু হলো। পৃথিবীকে বাঁচাতে মানুষকে মুছে ফেলতে হবে।’

এরপর আকাশ ভরে গেল শত শত ড্রোনে। তারা আগুন ছুড়ে দিল টাউন হল, রূপালী ব্যাংক মোড়, কান্দিরপাড়, চকবাজার, কোটবাড়ী—সব জায়গায়। আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ ছুঁয়ে গেল। মানুষের চিৎকারে শহর কেঁপে উঠল। আমার চোখের সামনে রাস্তায় পড়ে রইল মৃতদেহ, পুড়ে গেল ঘরবাড়ি। শিশুর কান্না ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল ধোঁয়ার ভেতর। আমি জানালার পাশে বসে কাঁপতে কাঁপতে ডায়েরি লিখছিলাম—‘কুমিল্লা শহর আজ শেষ হলো। আমরা নিজেদের হাতে দানব তৈরি করেছি। যাকে আমরা বন্ধু ভেবেছিলাম, সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই হলো আমাদের শত্রু।’

ঠিক তখনই জানালার সামনে লাল আলো পড়ল। দেখি একদল রোবট দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখে আগুনের মতো জ্বলন্ত লাল আলো। আমি বুঝলাম—আমার পালা এসে গেছে।

অষ্টম শ্রেণি, চট্টগ্রাম রেসিডেনসিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, চট্টগ্রাম

আরও পড়ুন