শেষবিদায়ের আগের সকাল
২০২৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। আমাদের পরিবারের জীবন যেন আচমকা থমকে গেল। আমার দাদি ছিলেন আমাদের পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু। আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। অচেতন অবস্থায় তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসা হলো। তিনি কাউকে চিনতে পারছিলেন না, কথা বলছিলেন না। চিকিৎসা শুরু হলো। কুষ্টিয়ায় প্রাথমিক পরীক্ষায় ধরা পড়ে, তাঁর মস্তিষ্কের ৪ ভাগের ৩ ভাগজুড়ে টিউমার ছড়িয়ে পড়েছে। ডাক্তারদের ভাষায়, এটা ক্যানসারে রূপ নিয়েছে।
প্রথম ধাক্কা
স্কয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, ‘এই রোগীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া যাবে না। অপারেশন করলেও ৯৯ শতাংশ আশঙ্কা, উনি টেবিল থেকেই আর ফিরে আসবেন না।’ সেই প্রথম আমি আমার বাবাকে কাঁদতে দেখি—ভেঙে পড়তে দেখি একজন সন্তানকে, যিনি নিজের অসুস্থ মাকে অসহায়ভাবে কষ্ট পেতে দেখছিলেন। কোনো সন্তান যেন কখনো এমন মুহূর্তের সামনে না পড়ে।
আশার আলো, মৃত্যুর ছায়া
সব চেষ্টাই চলছিল। ঢাকা মেডিকেল ছিল শেষ আশ্রয়। পরিবেশ ছিল প্রতিকূল; কিন্তু ডাক্তারদের আন্তরিকতা ছিল চোখে পড়ার মতো। বেশ কিছুদিন ভর্তি থাকার পর নিউরো বিভাগের প্রধানের নেতৃত্বে একটা মেডিকেল মিটিং হয়। সবকিছু বুঝে সব ঝুঁকি জেনেও আমরা সিদ্ধান্ত নিই—অপারেশন করাব।
ছয় ঘণ্টা ধরে চলে মস্তিষ্কের জটিল অপারেশন। আল্লাহর কৃপায় দাদি টিকে যান, এমনকি ১৩ মিনিট অক্সিজেন সাপোর্ট ছাড়া জীবিত ছিলেন। চিকিৎসকেরাও বিস্মিত। আমরা ভেবেছিলাম, হয়তো এ যুদ্ধ আমরা জিতে গেছি।
কিন্তু না, ২০ ফেব্রুয়ারি, সেই দিন, সেই সকাল—রিপোর্ট জানিয়ে দিল, ক্যানসার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
শেষ আশ্রয়, শেষ দিনগুলো
পরবর্তী পথ ছিল শুধুই সেবা ও ভালোবাসা দিয়ে বেঁচে থাকার সময়টুকু কিছুটা সহনীয় করে তোলা। সিরাজগঞ্জ খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজে রেডিয়েশন থেরাপি শুরু হলো। ডাক্তারদের মতে, কেমো দিলে মৃত্যুই হবে। তাই আমরা ধাপে ধাপে রেডিয়েশনে গেলাম। এর মধ্যে ঈদ এল; কিন্তু ঘরে কোনো আনন্দ এল না। দাদিকে ঈদের ছুটিতে বাড়ি আনা হলো—শেষবারের মতো পরিচিত মুখগুলো দেখতে দিতে।
মে মাসে দাদির শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি শুরু হলো। সব সময় দাদির পাশে আমরা সবাই থাকতাম। আমি তাঁর হাত ধরে বসে থাকতাম, যদি কখনো তিনি আমার নাম বলেন, কিছু চান, অথবা শুধু চোখ মেলে তাকান। কিছুই বলতেন না, তবু তাঁর পাশে থাকা ছিল আমাদের একমাত্র দায়িত্ব।
শেষ রাত, শেষ সকাল
১৮ মে রাত থেকে দাদির শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হতে থাকে। অক্সিজেন লেভেল কমতে থাকে, পড়ে যেতে থাকে পালস। নার্সরা বলছিলেন বাসায় খবর দিতে; কিন্তু আমি সাহস পাইনি। কীভাবে বলব আমার বাবাকে, ‘তোমার মা আর খুব বেশি সময় বেঁচে থাকবেন না।’
১৯ মে মধ্যরাতে আমাকে একটি ‘বন্ডে’ সই করতে বলা হলো। হাত কাঁপছিল। সেই রাতে আমি একা থাকতে পারিনি। আমার সমবয়সী কাজিন রাফিদকে বললাম, ‘আজ তুই থাক। আমি পারছি না।’
রাতভর আমরা দুজন দুই পাশে বসে সুরা-কালেমা পড়েছি। আমার দাদির ঠান্ডা, নিস্তেজ হাত দুটো ধরে রেখেছিলাম। যেন মৃত্যুর মধ্যেও তাঁকে ভালোবাসার ছায়ায় রাখা যায়।
২০ মে সকাল ৭টা ৩০ মিনিট নাগাদ অক্সিজেন লেভেল খুব নিচে নেমে যায়। ৭টা ৫৬ মিনিটে আমার বড় ভাইয়ের ফোন আসে—আমি জানিয়ে দিই, ‘ভাইয়া, দাদি মনে হয় মারা গেছেন…’ নার্সরা বললেন, ‘এমন হয় মাঝে মাঝে’, কিন্তু আমার হৃদয় জানত—সব শেষ।
শেষ স্পর্শ, শেষ দায়িত্ব
হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী নার্সরা কাফনের কাপড় পরাতে আসেন। আমি বললাম, ‘দেখিয়ে দিন, আমি পরাব।’ তাঁরা অবাক হয়ে বলেন, ‘আপনি পারবেন না।’ আমি বলি, ‘এরপর তো আর কোনো দিন পারব না।’
সেই শেষবার, আমি আমার দাদির গায়ে হাত দিলাম। এরপর আর কখনো পারিনি।
এক বছর হয়ে গেল, একটা দিনও কথা হয় না তোমার সঙ্গে...আজ এক বছর হয়ে গেছে। তুমি আর আমার সঙ্গে কথা বলো না। আমার জন্য চিন্তা করো না, আমাকে ভালোবাসো না। তুমি শুধু থেকে গেছ প্রতিটি নীরবতায়। এখন আর কোনো কিছুই ভালো লাগে না। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আমি খুঁজি তোমার সেই আশীর্বাদের হাত, সেই কোমল গলা।
তোমার নাতি এখনো সেই হাত খুঁজে ফেরে…
লেখক: শিক্ষার্থী, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি, ঢাকা