রিয়ালের আক্রমণভাগে নতুন আশা
দীর্ঘ এক মৌসুম শেষে ইউরোপিয়ান লিগের খেলোয়াড়েরা ফিরেছেন বিশ্রামে। কিন্তু এই বিশাল মৌসুমে সবচেয়ে বড় চমক হিসেবে হাজির হয়েছেন কে? সে প্রশ্নের উত্তরে অনেকের মনেই আসবে একটি নাম—রিয়াল মাদ্রিদের গঞ্জালো গার্সিয়া।
গঞ্জালো গার্সিয়া এখনো বড় কিছু করে ফেলেননি। বরং রিয়াল মাদ্রিদে খেলেন বলেই হয়তো আলাদা করে পরিচিতি আছে তাঁর। নইলে এতদিনেও নিজেকে চেনানোর মতো কিছু করতে পারেননি বলে তাঁকে সরিয়ে রাখা হতো আলোচনা থেকে। অন্তত এভাবেই ভাবা হচ্ছিল রিয়াল মাদ্রিদে। নিজেদের একাডেমি নিয়ে বরাবরই একটু উদাসীন রিয়াল মাদ্রিদ। বড় বড় তারকা যে নাম লেখাননি, তা নয়। কিন্তু যুব দল থেকে কেউ রিয়ালে নাম লেখাবেন, নিয়মিত জায়গা করে নেবেন—এমনটা ভাবা বেশ কঠিন। সেই কঠিন জিনিসটাই করে দেখিয়েছেন গঞ্জালো গার্সিয়া। আর এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান আর কারও নয়—রিয়ালের নতুন কোচ শাবি আলোনসোর।
ক্লাব বিশ্বকাপে রিয়াল মাদ্রিদ গিয়েছিল বড় আশা নিয়ে। আরেক তরুণ স্ট্রাইকার এন্ড্রিকের চোটে ভাগ্যের শিকে খুলেছিল ২১ বছর বয়সী গঞ্জালো গার্সিয়ার। সেই ভাগ্যই তাঁকে টেনে নিয়ে গেল রিয়াল মাদ্রিদের মূল একাদশে। খেলা শুরুর আগে পেটের পীড়ায় হাসপাতালে ভর্তি হন কিলিয়ান এমবাপ্পে। তাঁর জায়গায় কোনো জোড়াতালি নয়, প্রমাণিত স্ট্রাইকারের ওপর ভরসা রাখলেন শাবি। যে ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ে রিয়াল মাদ্রিদের একাদশে সুযোগ পেয়েছিলেন গার্সিয়া, সেখানে তিনি টিকে রইলেন নিজের যোগ্যতায়।
নতুন কোচ হিসেবে শাবি যে ভরসা রেখেছিলেন গার্সিয়ার ওপর, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন স্প্যানিশ স্ট্রাইকার। প্রথম ম্যাচে আল হিলালের বিপক্ষে একমাত্র গোল। যে গোলে ড্র নিশ্চিত করে রিয়াল। দ্বিতীয় ম্যাচে গোলের দেখা পাননি, কিন্তু দুর্দান্ত এক অ্যাসিস্ট মন কেড়ে নিয়েছিল সবার। তৃতীয় ম্যাচে আরবি সালসবার্গের বিপক্ষে আবারও গোল। গোলের ধারা চলল জুভেন্তাস আর ডর্টমুন্ডের বিপক্ষেও। জুভেন্তাসের বিপক্ষে একমাত্র আর ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে গোলের খাতা খুলেছিলেন তিনি। এককথায় রিয়াল মাদ্রিদকে ক্লাব বিশ্বকাপে যদি কেউ সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন, তবে সেই নামটা হবেন গঞ্জালো গার্সিয়া। প্রতি ম্যাচে গোল অ্যাসিস্ট করে মাতিয়ে রেখেছেন তিনি। পারেননি শুধু এক ম্যাচে, আর সে ম্যাচেই কুপোকাত হয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ।
গঞ্জালো গার্সিয়া রিয়ালকে ফিরিয়ে নিয়েছেন পুরোনো দিনে। বহু বছর ধরেই রিয়াল একাদশে একজন ‘পিওর স্ট্রাইকার’-এর অভাব ছিল। লম্বা সময় ধরে রিয়ালকে টেনে নিয়ে গেছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। তাঁর আমলে করিম বেনজেমা থাকতেন ছায়া হয়ে। অতঃপর করিম বেনজেমা যখন ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে লাইমলাইট পেলেন, ততদিনে তিনি পিওর নাম্বার নাইন থেকে পরিণত হয়েছেন ‘৯.৫’-এ। নাম্বার নাইন আর নাম্বার টেনের অসাধারণ এক সংমিশ্রণ। ‘ফক্স ইন দ্য বক্স’ বলতে ঠিক যা বোঝায়, তা রাউলের বিদায়ের পর আর পায়নি রিয়াল। রাউল, রোনালদো নাজারিও ছিলেন রিয়ালের শেষ ‘পিওর স্ট্রাইকার’। রিয়াল যেন বহু বছর পর এসে তা খুঁজে পেয়েছে গঞ্জালো গার্সিয়ার মধ্যে। গার্সিয়ার খেলার ধরনও তাই চোখে লেগে থাকার মতো কিছু না।
বল পায়ে কোনো কারিকুরি নেই, মাঝমাঠে অযথা ড্রিবলিং নেই। শুধু একটা পারফেক্ট পাসের অপেক্ষা। নিচ থেকে সেটা নিশ্চিত হলেই গোল। নিচে নেমে এসে ডিফেন্ড করতে কিংবা সতীর্থদের সাহায্য করতে তাঁর বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। কিন্তু এক টাচে যেটা করে ফেলা সম্ভব, তার জন্য ১০ সেকেন্ড সময় নষ্ট করতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই গঞ্জালোর। শাবি আলোনসো নিজেও ছিলেন এ রকম খেলোয়াড়। ফলে দুজনের রসায়নটা জমে হয়েছে ক্ষীর।
গঞ্জালো গার্সিয়া রিয়াল মাদ্রিদেরই একজন। সেই ২০১৪ সালে যোগ দিয়েছিলেন রিয়ালে। সেখান থেকে শুরু করে একে একে পাড়ি দিয়েছেন রিয়ালের সব ধাপ। সময়টা একটু বেশি লেগেছে সত্য, কিন্তু নিজেকে চেনাতে কোনো ভুল করেননি। মাঝখানে এক বছর পরিবারের সঙ্গে থাকতে যোগ দিয়েছিলেন মায়োর্কায়। আবারও ফিরে এসে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন রিয়ালের জন্য। কাগজে–কলমে রিয়ালের জার্সিতে অভিষেক হয়েছে ২০২৩ সালে। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত তা সীমাবদ্ধ ছিল ২ থেকে ৫ মিনিটের ক্যামিওতে। ক্লাব বিশ্বকাপে যখন সুযোগ পেলেন, তখনই মেলে ধরলেন নিজেকে।
আর এ কারণেই কিনা রিয়াল মাদ্রিদের মূল দলে জায়গা করে নিলেন গার্সিয়া। ক্লাব বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স দেখে তাঁকে ‘৯’ নম্বর জার্সি তুলে দেওয়ার কথা ভেবেছিল রিয়াল। স্প্যানিশ পত্রিকায় খবরও বেরিয়েছিল। কিন্তু সেই খবর খবরই থেকে গেছে। এমবাপ্পের রেখে যাওয়া ‘৯’ নম্বর জার্সি পেয়েছেন ব্রাজিলিয়ান তরুণ তারকা এন্ড্রিকে। গঞ্জালো গার্সিয়া পেয়েছেন এন্ড্রিকের ‘১৬’। কিন্তু জার্সিতে কী আসে যায়? রিয়াল মাদ্রিদে দিন শেষে পারফরম্যান্সটাই আসল। যে গার্সিয়ার মধ্যে রাউলের ছায়া খুঁজে পাচ্ছে রিয়াল সমর্থকেরা, সেই আশা কতটা পূরণ করতে পারেন, সে প্রশ্নই এখন সবার মনে। আর সে উত্তর না হয় মৌসুম শুরুর জন্যই তুলে রাখা যাক।