চ্যাম্পিয়ন সাগরিকা: বাবা চাইতেন না মেয়ে ফুটবল খেলুক, পাশে ছিলেন মা

বাড়িতে সাগরিকার বাবা লিটন ইসলাম ও মা আনজুয়ারা। গতকাল ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার রাঙাটুঙ্গি গ্রামেছবি: রাজিউল ইসলাম
খেলার মাঠে সাগরিকা
ছবি: প্রথম আলো

বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে খেলার মাঠে যেতেন সাগরিকা। বড়দের খেলা দেখতেন। একসময় তাদের সঙ্গে অনুশীলনে যোগ দেওয়া শুরু করেন। এভাবেই মাঠ ও ফুটবল পেয়ে বসে তাঁকে। একদিন মেয়ের ফুটবল খেলার বিষয়টি কানে গেল বাবা লিটনের। মেয়েকে বাধা দিলেন। এমনকি মেয়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করলেন।

এভাবে কেটে গেল কয়েক দিন। সাগরিকার পাশে দাঁড়ান মা আনজুয়ারা। একদিকে স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, অন্যদিকে বাবাকে খুশি করার কৌশল বলতেন মেয়েকে। সাগরিকাও ছাড়ার পাত্র নন। বাবাকে নানা কাজে সহযোগিতা করতে থাকেন। একদিন বাবা রাজি হলেন, আবার মাঠে যাওয়া শুরু হলো সাগরিকার।

ট্রফি হাতে সাগরিকা
ছবি: প্রথম আলো

এটা বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২০ জাতীয় নারী ফুটবল দলের সময়ের আলোচিত খেলোয়াড় সাগরিকার কথা। তাঁর বাড়ি ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলার রাঙাটুঙ্গি গ্রামে। রাঙাটুঙ্গি ইউনাইটেড মহিলা ফুটবল একাডেমির সদস্য সাগরিকা। বাবা লিটন ইসলাম (৩৭) পেশায় দিনমজুর। মা গৃহিণী। দুই ভাইবোনের মধ্যে সাগরিকা ছোট। এলাকায় লিটা নামেই তাঁর পরিচিতি। সম্প্রতি বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল সাফ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। নেপালকে ৪-০ গোলে পরাজিত করেছে বাংলাদেশ। যার সব কটি গোলই এসেছে সাগরিকার পা থেকে। গতকাল বুধবার সাগরিকার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে মা-বাবা ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো।

বুধবার বেলা ১১টায় রানীশংকৈল উপজেলা শহরের মাদ্রাসা মোড়ের এক চা–দোকানিকে সাগরিকার বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞাসা করতেই বলে উঠলেন, ‘ওহ আমাদের ফুটবলার সাগরিকা। এখান থেকে ছয় কিলোমিটার হবে।’ বেশ আগ্রহ ও গর্বভরে ঠিকানাও বলে দিলেন তিনি। ফুটবল খেলার কারণে এখন শুধু উপজেলাতেই নয়, জেলা শহরেও সাগরিকা ও রাঙাটুঙ্গি গ্রাম খুবই পরিচিত নাম।

বাড়িতে সাজিয়ে রাখা বিভিন্ন সময়ে পাওয়া সাগরিকার পুরস্কার— মেডেল, ট্রফি
ছবি: প্রথম আলো

পাকা সড়ক থেকে নেমে প্রায় ২০০ মিটার কাঁচা রাস্তা। তারপর আলপথ ধরে যেতে হয় সাগরিকাদের বাড়ি। খাসজমিতে বসবাস তাঁদের। বাঁশের বেড়া ও টিনের চালার একটি ঘর। পাশেই দুই কক্ষের একটি পাকা ঘর যা গত বছর উপজেলা প্রশাসন থেকে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির উঠোনেই দেখা দেখা মিলল সাগরিকার মা–বাবার। নানি-খালাসহ প্রতিবেশী কয়েকজন বারান্দায় বসে গল্প করছিলেন। তার কিছুক্ষণ আগেই মাকে ফোন করেছিলেন সাগরিকা। সেই রেশ তখনো ছিল।

মেয়ের সাফল্যে চোখেমুখে আনন্দের ঢেউ বাবা লিটনের। বছর দুয়েক আগে বাড়ির পাশে চায়ের দোকান করতেন। মেয়ের ফুটবলপ্রেমী হয়ে ওঠার গল্প শোনালেন লিটন। বললেন, ‘মুই জানু মেয়ে তো স্কুলতে যাচ্ছে। ফুটবল খেলাবা যাচ্ছে এইডা জানু না। দোকানত লোকলা আসে কহচে তোর বেটিডাক ফুটবল খেলাবা দিলো। হাফ পেন পিন্দেহেনে জঙ্গলবিলাশ মাঠোত ফুটবল খেলাবা যাছে।’ এ কথা শুনে বাড়িতে এসে মেয়েকে শাসন করেন তিনি। স্ত্রীকে বলেন, ‘হামরা গরিব মানুষ। হাফ পেন পিন্দে ফুটবল খেলাবা যাছে মেয়ে, পরে বিহার বয়স হলে বিহায় দিবা পারিমনি। আইজ থাকি খেলাধুলা বন্ধ।’

আরও পড়ুন

প্রায় এক মাস বাবার সঙ্গে কথা নেই সাগরিকার। মায়ের সহায়তায় বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তারপরও মাঠে গেছেন। বাবার রাগ ভাঙানোর জন্য তাঁর সঙ্গে কৃষিকাজেও সহযোগিতা করেছেন। ফুটবল একাডেমির পরিচালক তাজুল ইসলামও বুঝিয়েছেন লিটনকে। এরই মধ্যে ২০২২ সালে নারী লীগে খেলার সুযোগ আসে সাগরিকার। শুনে বাবা লিটনের মন নরম হতে শুরু করে। লিটন বলেন, মেয়ে যখন ঢাকায় খেলার ডাক পেল, তখন মনটা যেন কেমন হয়ে গেল। মেয়ের সঙ্গে কথা বলেননি এ কারণে নিজের মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করল। তারপর মেয়েকে ডেকে বললেন, ‘যা বেটি তুই যেহেতু খেলাধুলা পছন্দ করিস। তোকে আর বাধা দেব না। তবে হ্যাঁ স্বীকার করতে হবে আমার স্ত্রী আর ওই তাজুল স্যারের কারণেই মেয়ে আজ এত বড় খেলোয়াড় হয়েছে।’

সাগরিকার শৈশবের স্কুল পূর্ব বলদ্বানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা এখন নিয়মিত ফুটবল খেলে
ছবি: প্রথম আলো

ঘরে ঢুকে আলমারি খুলে মা আনজুয়ারা দেখালেন বিভিন্ন সময়ে পাওয়া সাগরিকার পুরস্কার— মেডেল, ট্রফি। থরে থরে সাজানো চ্যাম্পিয়ন, রানার্সআপ হওয়ার ট্রফিগুলো যেন সাক্ষী হয়ে সাগরিকার অব্যক্ত কথাগুলো বলে যাচ্ছে। আনজুয়ারা বলেন, প্রথম যখন টিভিতে মেয়ের খেলা দেখায়, বাড়িতে টিভি ছিল না। পরে স্থানীয় এক ব্যক্তি একটি টিভি কিনে দিয়েছেন। টাকা জমিয়ে মেয়ের উপহার ও পুরস্কারগুলোর যত্ন নিতে কিছুদিন আগে আলমারি কিনেছেন। তিনি আরও বলেন, যারা একসময় নানা কথা বলত, এখন তারাই আগ্রহ নিয়ে মেয়ের খেলা দেখার জন্য বাড়িতে আসে। সারাক্ষণ কেউ না কেউ বাসায় আসতেই থাকে। খুবই ভালো লাগে।

আরও পড়ুন

সাগরিকার প্রশংসায় পঞ্চমুখ তার শৈশবের স্কুল পূর্ব বলদ্বানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। এখান থেকেই ২০২০ সালে পঞ্চম শ্রেণি শেষ করেছেন সাগরিকা। প্রধান শিক্ষক খালিদা বানু সেই সেই সময়ে সাগরিকার নেতৃত্বে পাওয়া বিভিন্ন ট্রফি ও ছবি বের করে দেখালেন। বললেন, ‘আমাদের স্কুল কয়েকবার জেলা-উপজেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন-রানার্সআপ হয়েছে। যেদিন টুর্নামেন্টে আমাদের দলের খেলা থাকত, দূরদুরন্ত থেকে মানুষ খেলা দেখতে আসত। আজ আমাদের মেয়ের এত নামডাক হয়েছে। এটা অনেক বড় আনন্দের। ঈদের সময় বাড়িতে আসছিল আমাদের সঙ্গে দেখা করে গেছে।’