প্রতিশোধের প্রতীক্ষা

ছবি: উয়েফা

গতকাল সুইজারল্যান্ডের নিয়নে অনুষ্ঠিত হয়েছে চ্যাম্পিয়নস লিগ ২০২৩-২৪ মৌসুমের কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালের ড্র। এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ বেশ কিছু কারণেই একটু বিশেষ। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এবারই শেষবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগে দেখা যাবে গ্রুপ পর্বের লড়াই। পরের মৌসুম থেকে বদলে যাবে ফরম্যাট, বদলে যাবে ড্রয়ের নিয়মও। এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ কোয়ার্টার ফাইনাল যে কারণে বিশেষ হয়ে থাকবে সবার কাছেই।

এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ বিশেষ হয়ে থাকার আরেকটা কারণ আছে বৈকি। এবারের কোয়ার্টার ফাইনালের লাইনআপ পুরোটাই হট ফেবারিটদের আস্তানা। প্রতিবারই শেষ আটে দু–একটা চমক থাকে। বড় দলকে তাক লাগিয়ে সেরা আটে জায়গা করে নেয় কোনো একটি আন্ডারডগ দল। এবারের কোয়ার্টারে সে রকম কিছু নেই। তাই বলে যে চ্যাম্পিয়নস লিগ রং হারিয়েছে, তা কিন্তু নয়; বরং এবারের কোয়ার্টার ফাইনাল হয়ে উঠেছে প্রতিশোধের লড়াই। প্রতিটি লড়াইয়ের পেছনে রয়েছে ইতিহাস, কেউ চাইবে তা পুনরাবৃত্তি করতে, কেউ চাইবে তা ভুলে নতুন ইতিহাস গড়তে।

রিয়াল মাদ্রিদ-ম্যানচেস্টার সিটি

নকআউট পর্বে চারবারের লড়াইয়ে দুবার করে শেষ হাসি হেসেছে দুই দল
ছবি: রয়টার্স

ধীরে ধীরে চ্যাম্পিয়নস লিগের নিয়মিত প্রতিপক্ষে পরিণত হয়ে যাচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ আর ম্যানচেস্টার সিটি। দুই লিগের দুই সেরা দল, সেরা কোচের মুখোমুখি কে না দেখতে চায়? আর সেটা যদি হয় পরপর তিন মৌসুম? তাহলে তো কথাই নেই। শেষ পাঁচ মৌসুমে মোট ৮ বার দেখা হয়েছে দুই দলের এবং প্রতিবারই নকআউট পর্বে। এবারই অবশ্য প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে দেখা দুই দলের।

একদম শুরু থেকে শুরু করা যাক, রিয়াল-সিটির নকআউট পর্বে প্রথম দেখা ২০১৫-১৬ মৌসুমের সেমিফাইনালে। সেবার দুই লেগ মিলিয়ে ১-০ গোলের জয় দিয়ে ফাইনালের টিকিট কাটে রিয়াল।

দ্বিতীয়বার দেখা হয় করোনা আক্রান্ত ২০১৯-২০ মৌসুমের রাউন্ড অফ সিক্সটিনে। সেবার দুই লেগে ২-১ গোলের জয় নিয়ে পরের পর্বের টিকিট কাটে সিটি। ২০২১-২২ মৌসুমে শেষ হাসি হাসে রিয়াল মাদ্রিদ। প্রথম লেগে ৪-৩ গোলের জয় তুলে নিলেও, রিয়ালের মাঠে এসে শেষ পর্যন্ত হাসি ধরে রাখতে পারেনি সিটি। ম্যাচের ৮৮ মিনিট পর্যন্ত এগিয়ে থাকলেও শেষ মুহূর্তে দুই গোল দিয়ে ম্যাচের গল্প বদলে দেন রদ্রিগো। অতঃপর ৩-১ গোলে জিতে ফাইনালের টিকিট কাটে রিয়াল। ২০২১-২২ মৌসুমের সেমি ফাইনালকে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের অন্যতম সেরা কামব্যাক স্টোরি হিসেবেও আখ্যা দেন অনেকে।

গত মৌসুমে শেষ হাসি হাসে ম্যানচেস্টার সিটি। প্রথম লেগ ১-১ গোলে ড্র হলেও দ্বিতীয় লেগে ৪-০ গোলের বিশাল জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে তারা। রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে নিজেদের প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে পা রাখে সিটি।

আরও পড়ুন

এই মৌসুমে লড়াইটা আরও জমজমাট। নকআউট পর্বে চারবারের লড়াইয়ে দুবার করে শেষ হাসি হেসেছে দুই দল। এবারে দেখার পালা কে এগিয়ে যায়? আর ডাগআউটের লড়াইটা ভুলে গেলে তো চলবে না। কার্লো আনচেলত্তির মুখোমুখি পেপ গার্দিওলা। দুই এলিট কোচের লড়াই দেখার জন্য মুখিয়ে আছেন সবাই।

পিএসজি-বার্সেলোনা

চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বিদায়ের পর মেসিকে দি মারিয়ার সান্ত্বনা।
ছবি: রয়টার্স

কামব্যাকের কথা যখন আসল, তখন চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসের অন্যতম সেরা কামব্যাকের কথা না বললেই নয়। পিএসজিকে ৬-১ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করা সে ম্যাচের কথা এখনো বার্সেলোনার সমর্থকদের চোখে জল এনে দেয়। বার্সেলোনা সমর্থকদের জন্য এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ আরও বেশি স্মরণীয়। দুই মৌসুম পর আবারও চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে তারা। গত দুই মৌসুমে গ্রুপ পর্বের বাধাই পেরোতে পারেনি তারা, খেলতে হয়েছিল ইউরোপা লিগ। বার্সেলোনার মতো দলের কাছে এর থেকে বেশি লজ্জার আর কী-ই বা হতে পারে?

আরও পড়ুন

শেষ যে বার চ্যাম্পিয়নস লিগের নক আউট পর্ব খেলেছিল বার্সা, সে বার হারতে হয়েছিল এই পিএসজির কাছেই। ২০২০-২১ মৌসুমে রাউন্ড অফ সিক্সটিনে পিএসজির কাছে নিজেদের মাটিতে ৪-১ গোলে হেরে বিদায় নিতে হয়েছিল চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে। এছাড়াও নেইমার-কান্ড নিয়ে বার্সা-পিএসজির একটা দ্বন্দ্ব তো আছেই। বার্সেলোনার চাইবে প্রতিশোধটা ইউরোপের সবচেয়ে বড় মঞ্চ থেকেই নিতে।

অন্যদিকে মেসি-নেইমারের পর এমবাপ্পেকেও হারানোর পথে পিএসজি। এমবাপ্পে চাইবেন পিএসজিতে নিজের ইতি চ্যাম্পিয়নস লিগ দিয়ে রাঙিয়ে দিয়ে যেতে। সব মিলিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখার জন্য প্রস্তুত ফুটবলপ্রেমীরা।

আর্সেনাল বনাম বায়ার্ন মিউনিখ

সব মিলিয়ে শেষ তিন দেখায় বায়ার্ন-আর্সেনালের স্কোরলাইন ১৫-৩!
ছবি: রয়টার্স

ছয় মৌসুম পর চ্যাম্পিয়নস লিগে ফিরে এসেছে আর্সেনাল। একটা সময় ছিল যখন আর্সেনাল ছাড়া উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ কল্পনাই করা যেত না। কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গারের অধীন টানা ১৭ মৌসুম চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলেছিল তারা। ২০০৬ সালে অল্পের জন্য শিরোপা ছুঁয়ে দেখা হয়নি তাদের। সেসব এখন অতীত। মিকেল আরতেতার অধীন নতুন আর্সেনাল কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হবে ছয়বারের চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী বায়ার্ন মিউনিখ। আর এই লড়াই মনে করিয়ে দিয়েছে তাদের পুরোনো দ্বন্দ্বের কথা।

ছয় মৌসুম আগে আর্সেনালের শেষ চ্যাম্পিয়নস লিগ ম্যাচের প্রতিপক্ষ ছিল বায়ার্ন মিউনিখ। সেবার চ্যাম্পিয়নস লিগের নকআউট পর্বের ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল দুই দল। সেদিনের সেই স্মৃতি ভুলে যাওয়ারই চেষ্টা করবে আর্সেনাল। ঘরের মাটিতে সেদিন ৫-১ গোলের লজ্জাজনক হার নিয়ে ফিরতে হয়েছিল গানার্সদের। শুধু তাই নয়, এর আগের লেগেও ৫-১ গোলে বিধ্বস্ত হয়েছিল আর্সেনাল। দুই লেগ মিলিয়ে ১০-২ গোলে হেরে নিজের চ্যাম্পিয়নস লিগের যাত্রা শেষ করেছিল গানার্সরা। আরও পেছনে যদি ফিরতে চাই, ২০১৫-১৬ মৌসুমেও গ্রুপ পর্বে মুখোমুখি হয়েছিল দুই দল। সেবার লন্ডনে প্রথম দেখায় আর্সেনাল ২-০ গোলে জিতলেও ফিরতি লেগে নিজেদের মাটিতে আর্সেনালকে ৫-১ গোলে হারিয়েছিল বায়ার্ন। সব মিলিয়ে শেষ তিন দেখায় বায়ার্ন-আর্সেনালের স্কোরলাইন ১৫-৩!

আরও পড়ুন

সেই দলের কেউই এখন আর আর্সেনালে নেই। তাই বলে এত সহজে বায়ার্নের চুনকালি মেখে দেওয়া ইতিহাস ভুলে যাওয়ার কথা না গানার্সদের। বায়ার্ন স্ট্রাইকার থমাস মুলার ইতিমধ্যে হুংকার দিয়ে রেখেছেন। ফলাফল যে পক্ষেই যাক না কেন, জমজমাট এক ম্যাচের অপেক্ষার পুরো বিশ্ব।

আতলেতিকো মাদ্রিদ-বরুসিয়া ডর্টমুন্ড

চার কোয়ার্টার ফাইনালের মধ্যে আতলেতিকো–বরুসিয়া ম্যাচটি নিয়েই উত্তেজনা বেশ কম
ছবি: রয়টার্স

চার কোয়ার্টার ফাইনালের মধ্যে আতলেতিকো–বরুসিয়া ম্যাচটি নিয়েই উত্তেজনা বেশ কম। ইতিহাসও সেই তুলনায় নেই বললেই চলে। এর আগে মাত্র চারবার দেখা হয়েছে দুই দলের। প্রতিবারই গ্রুপ পর্বে, দুদলই দুবার করে জয় নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। এবারই প্রথম নকআউট পর্বে দেখা দুই দলে। বাকি ছয় দলের তুলনায় তাদের নিয়ে সাধারণ দর্শকদের মধ্যে উত্তেজনা কম থাকতে পারে। কিন্তু ফুটবলপ্রেমী মাত্রই জানেন, চ্যাম্পিয়নস লিগের রাতে কতটা ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে আতলেতিকো মাদ্রিদ ও বরুসিয়া ডর্টমুন্ড। শক্তিমত্তার দিক দিয়ে দুই দলের অবস্থানই কাছাকাছি। আর সমর্থনের দিক দিয়ে? বরুশিয়া আর আতলেতিকোর মাঠকে বলা হয়ে প্রতিপক্ষের জন্য নরক। সেখানে প্রবেশ করা যায়, পয়েন্ট নিয়ে বের হওয়া যায় না। অন্য ম্যাচগুলো একপেশে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও এই ম্যাচকে যে জমজমাট হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে আশঙ্কা নেই কারোর।

আরও পড়ুন