টেলিগ্রাফের সর্বকালের সেরা ৩০ টেস্ট ফাস্ট বোলারের তালিকায় নেই স্টুয়ার্ট ব্রড, ব্রেট লি, কিংবা শোয়েব আখতার

কোলাজ: দ্য টেলিগ্রাফ

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক পত্রিকা ‘টেলিগ্রাফ’ সর্বকালের সেরা ৩০ টেস্ট ফাস্ট বোলারের নাম প্রকাশ করেছে। এই ফিচারের লেখক স্কাইল্ড বেরি ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার ক্রিকেটবিষয়ক প্রধান লেখক। তিনি ৫০০টির বেশি টেস্ট ম্যাচ সরাসরি দেখেছেন। সেই অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই তৈরি করেছেন এই তালিকা। সেই তালিকা আমরা জানব, কিন্তু তার আগে কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার।

কিসের ভিত্তিতে বেরি এই তালিকা করলেন? ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্স নাকি নিজের পছন্দ অনুযায়ী? এসব বিষয় তিনি খোলাসা করে বলেননি। তবে তিনি একটি শর্তের কথা জানিয়েছেন। বেরি বলেছেন, ‘আমার সম্পাদকেরা আমাকে একটি কঠিন কাজ দিয়েছেন—৫০০টিরও বেশি টেস্ট ম্যাচ দেখার অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে সর্বকালের সেরা ৩০ জন ফাস্ট বোলারের একটি তালিকা তৈরি করা। এটা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। কিন্তু আমি নিজেকে একটু সাহায্য করার জন্য একটি মানদণ্ড ঠিক করেছি। সেটা হলো, এই তালিকার বোলারদের অবশ্যই ৮০ মাইলের (১২৯ কিলোমিটার) বেশি গতিতে বল করতে হবে। এই শর্তের কারণে, অ্যালেক বেডসার, মরিস টেট, সিড বার্নস বা জর্জ লোম্যানের মতো কিংবদন্তিরা এই তালিকায় জায়গা পাননি। এমনকি ক্যারিয়ারের শেষের দিকে কপিল দেবও মিডিয়াম পেস বোলারের ক্যাটাগরিতে চলে গিয়েছিলেন।’

প্রশ্ন হলো, স্টুয়ার্ট ব্রড, ব্রেট লি, শোয়েব আখতাররা তো সব সময় ১২৯ কিলোমিটারের বেশি গতিতে বল করেছেন। তাহলে এই কিংবদন্তি খেলোয়াড়েরা কেন নেই এই তালিকায়? ব্রড ৬০৪ উইকেটের মালিক। টেস্টে ব্রেট লির উইকেট ৩১০টি, জহিরের খানের আছে ৩১১ উইকেট। তাহলে কোন নিয়মানুসারে তাঁদের বাদ দেওয়া হলো? বেরির করা তালিকায় তো মাত্র ৪১ উইকেট পাওয়া ক্রিকেটারও আছেন! এসব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি বেরির লেখায়।

পাঠকেরা অবশ্য এই তালিকা ভালোভাবে নেননি। এই লেখা পর্যন্ত ওই ফিচারে ৫৪০টি কমেন্ট পড়েছে। সেখানে চার্লস ব্যানসন নামে এক পাঠক লিখেছেন, ‘বুমরাহ সেরা? হা হা। এটা যদি প্রথম অনুচ্ছেদে বলতেন, তাহলে আমি লেখাটা পড়ে সময় নষ্ট করতাম না। তার ওপর ওর অ্যাকশনটাও প্রশ্নবিদ্ধ। ও কি বোলিং করছে নাকি?’

মেমেন্টো ভিভের নামে একজন লিখেছেন, ‘বেরি, সুনীল গাভাস্কারকে বিশ্বের দ্রুততম বোলারদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করুন। তিনি কোনো বডি আর্মার বা হেলমেট ছাড়াই সেরা বোলারদের মোকাবিলা করেছেন।’

রব নর্থ লিখেছেন, ‘জেমস অ্যান্ডারসনের উইকেট ৭০৪টি। আর তাঁকে আপনি রেখেছেন ২২ নম্বরে? আমার তো মনে হচ্ছে এটা ক্লিকবেট লেখা।’

এমন আরও অনেক মজার মজার কমেন্ট আছে এই লেখার কমেন্ট বক্সে। তবে স্কাইল্ড বেরি এসব কমেন্ট পড়ে খুশি হয়েছেন নাকি দুঃখ পেয়েছেন, তা জানা যায়নি। তিনি নিজেও একটা কমেন্ট করেছেন। সেখানে লিখেছেন, ‘এই লেখাটা অনেক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে বেশির ভাগই গঠনমূলক। এটা দেখে ভালো লাগছে। আজ বিকেল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে আমি অনলাইনে থাকব আরও আলোচনায় অংশ নিতে!’

আসলে বেরি আলোচনায় অংশ নিয়েছেন কি না, তা জানা যায়নি। হয়তো তিনি উপভোগই করছেন বিষয়টা। চলো, তাঁর তালিকার সেরা ১০ বোলারের ব্যাপারে জেনে নিই।

১০. ওয়াকার ইউনুস

৮৭ টেস্ট, ৩৭৩ উইকেট, গড় ২৪, প্রতি ৪৪ বলে একটি উইকেট।

১৯৯১-৯২ সালে ওয়াকার ইউনুস পিঠে চোট পান। তার আগে দুটি কারণে খুব প্রশংসিত হয়েছিলেন তিনি। তাঁর রানআপ ছিল সবচেয়ে লম্বা এবং রিভার্স সুইং ইয়র্কার ছিল সবচেয়ে দ্রুতগতির। পাকিস্তানের সাবেক টেস্ট অধিনায়ক ইমরান খানের কাছে তিনি এই সুইং শিখেছিলেন। তাঁর ক্যারিয়ারের টেস্ট উইকেটের অর্ধেকেরও বেশি বোল্ড বা এলবিডব্লিউ উইকেট। বিশেষ করে ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের পক্ষে তাঁর বল খেলা খুব কঠিন ছিল। ১৯৯১ সালে তিনি কাউন্টি দল সারের হয়ে ১৪ গড়ে ১১৩টি উইকেট নিয়েছিলেন।

৯. ডেল স্টেইন

৯৩ টেস্ট, ৪৩৯ উইকেট, গড় ২৩, প্রতি ৪২ বলে একটি উইকেট।

দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক পেসার ডেল স্টেইন
ডেল স্টেইনের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট

উইকেট নেওয়ার পর ডেল স্টেইনকে মাঠে যতটা ভয়ংকর দেখাত, তেমনটা আর কাউকে লাগেনি। উইকেট পাওয়ার পর তিনি এমন ভঙ্গি করতেন যেন কোনো শিকারকে বেয়নেট বা বর্শা দিয়ে বিদ্ধ করছেন। তাঁর চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরোত। দ্রুতগতির আউটসুইং আর বাউন্সার ছিল স্টেইনের প্রধান অস্ত্র। তাঁর বলে ১০৯ জন ব্যাটসম্যান উইকেটকিপারের হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট হয়েছেন। উইকেট নেওয়ার ক্ষেত্রে দক্ষিণ আফ্রিকান এই ফাস্ট বোলারের স্ট্রাইক রেট প্রায় বুমরাহর মতোই।

৮. শন পোলক

১০৮ টেস্ট, ৪২১ উইকেট, গড় ২৩, প্রতি ৫৮ বলে একটি উইকেট।

একজন আদর্শ ফার্স্ট বোলারের সব গুণই ছিল শন পলকের মধ্যে। লম্বা, ছিপছিপে গড়নের পোলকের গতিও বেশ ভালো ছিল। অনেকটা অ্যালান ডোনাল্ডের মতো বোলিংয়ের মতোই ভয়ংকর ছিল তাঁর বল মোকাবিলা করা। মজা করার ছলেই হোক বা ব্যাটসম্যানদের আতঙ্কিত করার জন্যই হোক, প্রায়ই হেলমেটে বল লাগানোর মতো বাউন্সার মারতেন পোলক। তখন অবশ্য কনকাশন সাবস্টিটিউট চালু হয়নি।

৭. মিচেল জনসন

৭৩ টেস্ট, ৩১৩ উইকেট, গড় ২৮, প্রতি ৫৮ বলে একটি উইকেট।

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটার মিচেল জনসন
এএফপি ফাইল ছবি

২০১৩-১৪ সালে ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর ফাস্ট বোলার ছিলেন মিচেল জনসন। তখনই হয়তো তিনি ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটিয়েছেন। তাঁর ছোড়া শর্ট বলগুলো ব্যাটসম্যানের পাঁজরের হাড় বা মুখের দিকে এমনভাবে এগিয়ে যেত, মনে হতো যেন আগুনের গোলা। সেই মৌসুমে ইংল্যান্ড অ্যাশেজ জিততে বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিল। দলে ছিল অ্যালিস্টার কুক ও কেভিন পিটারসেনের মতো বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান। কিন্তু জনসনের বোলিংয়ের সামনে তাঁরা ৫-০ ব্যবধানে উড়ে গিয়েছিলেন। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকাও একই পরিণতি ভোগ করে। তখন ৮ টেস্টে জনসন ৫৯ উইকেট নিয়েছিলেন মাত্র ১৫ গড়ে।

৬. ওয়াসিম আকরাম

১০৪ টেস্ট, ৪১৪ উইকেট, গড় ২৩, প্রতি ৫৪ বলে একটি উইকেট

ইমরান খানের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন তিনি। নতুন বল বা পুরোনো বল—সবকিছুতেই ওয়াসিমের দক্ষতার পরিধি ছিল ইমরান খানের মতোই। তবে তিনি ছিলেন বাঁহাতি। তাই তিনি রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে বল করে ব্যাটসম্যানের পায়ের পাতা বরাবর রিভার্স সুইং করাতে পারতেন। এতে এমন একটা কোণ তৈরি হতো যেন এক্সট্রা কভার থেকে বল ছোড়া হচ্ছে। ওয়াসিম আকরাম দেশের মাটিতে এমন পিচে টেস্ট খেলেছেন, যেখানে সিম মুভমেন্ট প্রায় ছিলই না। এ কারণেই তাঁকে জনসনের চেয়ে ওপরে রাখা হয়েছে।

৫. গ্লেন ম্যাকগ্রা

১০৪ টেস্ট, ৪১৪ উইকেট, গড় ২৩, প্রতি ৫৪ বলে একটি উইকেট

গ্লেন ম্যাকগ্রা।
ফাইল ছবি

গ্লেন ম্যাকগ্রার টেস্ট পরিসংখ্যান দেখলে মনে হবে এটা ওয়াসিম আকরামের টেস্ট পরিসংখ্যান। কারণ, টেস্ট ম্যাচ, গড়, উইকেট, বলপ্রতি উইকেট—সবই সমান। তিনি নিখুঁতভাবে অফ স্টাম্পের ওপর বা ঠিক বাইরে বল করে ব্যাটসম্যানকে বিট করতে পারতেন। ওয়ানডে ম্যাচগুলো ধরলে তাঁর আন্তর্জাতিক উইকেটসংখ্যা প্রায় এক হাজার ছুঁয়েছিল।

৪. ইমরান খান

৮৮ টেস্ট, ৩৬২ উইকেট, গড় ২৩, প্রতি ৫৪ বলে একটি উইকেট

উইকেট পেতে যে দক্ষতাগুলো অর্জন করতে হয়, তার প্রায় সব কটিই শিখেছিলেন ইমরান খান। যদিও তিনি রিভার্স সুইংয়ের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। সরফরাজ নওয়াজের কাছ থেকে রিভার্স সুইং শিখেছিলেন ইমরান। এশিয়া এবং এশিয়ার বাইরেও সমানভাবে সফল ছিলেন ডানহাতি এই বোলার। পাকিস্তানে তিনি ১৯ গড়ে ১৬৩টি উইকেট নিয়েছেন। তাঁর মতো করে আর কেউ বাতাসে বুমেরাংয়ের মতো সুইং করাতে পারতেন না।

৩. কার্টলি অ্যামব্রোস

৯৮ টেস্ট, ৪০৫ উইকেট, গড় ২১, প্রতি ৫৪ বলে একটি উইকেট

একমাত্র আধুনিক বোলার যাঁকে কখনো মনের মতো পিটিয়ে রান নিতে পারেনি ব্যাটসম্যানরা। কারণ, তাঁকে মারার চেষ্টা করলেই তিনি একটি হাই ফুল টস মেরে ব্যাটারকে আতঙ্কিত করে তুলতেন। তখন হাই ফুল টসে নো বল হতো না। তবে তাঁর মতো এতটা ধারাবাহিকভাবে কেউউ ‘ব্যাক অব লেংথ’ বল করতে পারেননি। এ জন্যই তাঁর ইকোনমি রেট ছিল অসাধারণ। যদিও তিনি আরেকটু ফুল লেংথে বল করলে হয়তো আরও বেশি উইকেট পেতেন। পার্থে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিনি ১ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ৭ উইকেট।

২. ম্যালকম মার্শাল

৮১ টেস্ট, ৩৭৬ উইকেট, গড় ২১, প্রতি ৪৭ বলে একটি উইকেট

১৯৭৫ ও ১৯৭৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুটি বিশ্বকাপ জয় মিস করেছেন মার্শাল। কিন্তু সব ফরম্যাটেই সফল হওয়ার মতো দক্ষতা তাঁর ছিল। তিনি যে শুধু দুই দিকে সুইংই করাতে পারতেন, তা–ই নয়, দুদিকে কাটও করতে পারতেন। সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল তাঁর বাউন্সার।

১. জশপ্রীত বুমরাহ

৪৬ টেস্ট, ২১০ উইকেট, গড় ২০, প্রতি ৪২ বলে একটি উইকেট

জশপ্রীত বুমরাহ

বুমরাহ নিঃসন্দেহে টেস্ট ক্রিকেটের সেরা ফাস্ট বোলার এবং সাদা বলের ক্রিকেটেও সেরা ফাস্ট বোলার হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য। ফ্রন্ট-ফুট নো বল নিয়ম চালু হওয়ার পর থেকে আর কোনো বোলার তাঁর মতো এত কাছ থেকে ব্যাটসম্যানকে বল ডেলিভারি দিতে পারেননি। কবজি মোচড়ানোর পাশাপাশি আঙুলের ব্যবহারের কারণে তাঁকে বোঝা বেশ কঠিন। অবশ্য পরিসংখ্যানও বুমরাহর শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলে। ২০-এর নিচে গড় এবং ২০০টির বেশি উইকেট নেওয়া একমাত্র বোলার তিনি। অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মাটিতে তাঁর গড় ১৭।

এ তালিকার বাকি ২০ জনের নাম যথাক্রমে প্যাট কামিন্স (৩০১ উইকেট), অ্যালান ডোনাল্ড (৩৩০ উইকেট), ড্যানিস লিলি (৩৫৫ উইকেট), অ্যালান ডেভিডসন (১৮৬ উইকেট), রে লিন্ডওয়াল (২২৮ উইকেট), রিচার্ড হ্যাডলি (৪৩১ উইকেট), হ্যারল্ড লারউড (৭৮ উইকেট), মাইকেল হোল্ডিং (২৪৯ উইকেট), ফ্রাঙ্ক টয়সন (৭৬ উইকেট), জন স্নো (২০২ উইকেট), কাগিসো রাবাদা (৩৩৬ উইকেট), জেমস অ্যান্ডারসন (৭০৪ উইকেট), ফ্রেড ট্রুম্যান (৩০৭ উইকেট), অ্যান্ডি রবার্টস (২০২ উইকেট), কোর্টনি ওয়ালশ (৫১৯ উইকেট), মিচেল স্টার্ক (৩৮৭ উইকেট), জোয়েল গার্নার (২৫৯ উইকেট), ওয়েস হল (১৯২ উইকেট), মাইক প্রক্টর (৪১ উইকেট) এবং জ্যাক গ্রেগরি (৮৫ উইকেট)।

আরও পড়ুন