নতুন বাংলাদেশের ‘পরীক্ষা’ ভূটানের বিপক্ষে

ফুটবল জগতে সবচেয়ে অগুরুত্বপূর্ণ খেলার তালিকা করলে সবার শীর্ষে থাকবে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচের কথা। র‍্যাংকিংয়ে সামান্য প্রভাব ফেলা ছাড়া আর কোনো কাজেই আসে না ম্যাচগুলো। কোচেরা তাই নিজেদের নিত্যনতুন কৌশলের পসরা সাজিয়ে বসেন, বাজিয়ে নেন নতুন খেলোয়াড়দের। এছাড়া প্রীতি ম্যাচের গুরুত্ব নেই বললেই চলে।

কিন্তু আজকের কথা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভূটানের বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচটা নামেই শুধু প্রীতি ম্যাচ। পুরো দেশ এখন কাঁপছে ফুটবলজ্বরে। বাংলাদেশের ফুটবলকে নিয়ে এর আগে কবে এমন উত্তেজনা দেখা গিয়েছে তা ঘেঁটে দেখতে ফিরে যেতে হবে বহু বছর আগে। এই উত্তাপের কারণ হামজা চৌধুরী।

হামজা চৌধুরীকে নিয়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, উত্তেজনা পুরো এশিয়াজুড়ে। প্রিমিয়ার লিগ মাতানো খেলোয়াড় বাংলাদেশের জার্সি গায়ে জড়াচ্ছেন, উত্তেজনার পারদ বাড়াতে এর চেয়ে বেশি আর কী লাগে! এর আগেও বাংলাদেশে এসেছেন, গ্রামের বাড়ি ঘুরে গিয়েছেন। কিন্তু মাঠে খেলা দেখবার সৌভাগ্য হয়নি কারও। ভুটান ম্যাচ দূর করছে সেই দুরাশা। প্রায় ৩ বছর পর বাংলাদেশের জাতীয় স্টেডিয়ামে আবারও ফিরছে ফুটবল। সংস্কার শেষে নতুন মাঠে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবেন হামজা চৌধুরী-- এই দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় এখন দেশের ফুটবলপ্রেমীরা।

তবে হামজা শুধু শুরু। ফুটবলের উত্তেজনা দ্বিগুণ করেছে বাংলাদেশের বাকি ফুটবলাররা। হামজার দেখাদেখি বাংলাদেশের বিমান ধরেছেন ফাহামিদুল ইসলাম। খেলোয়াড় হিসেবে অবশ্য হামজার মতো তারকাখ্যাতি নাই তাঁর। ইতালির চতুর্থ বিভাগে খেলেন বটে, কিন্তু দক্ষতা আর মানসিকতার দিক থেকে যোজন যোজন এগিয়ে। বাঁ পাশে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে চাইলে ফাহামিদুল ইসলাম একাই যথেষ্ট।

এই দুইজন তো নতুন সংযুক্তি, পুরাতনদের কথা তো তোলাই হয়নি। বাংলাদেশের জার্সিতে বহু আগে থেকে পারফর্ম করে আসছেন জামাল ভুইয়া। দলের অধিনায়ক একসময় ছিলেন ডেনমার্কে। সেখান থেকে ক্যারিয়ার গড়েছেন বাংলাদেশে। সঙ্গে ফিনল্যান্ড থেকে তারিক কাজী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সৈয়দ কাজেম শাহ-- সবাই ক্যারিয়ার গড়েছেন বাংলাদেশে।

ভূটান প্রীতি ম্যাচের গুরুত্ব তাই ছাড়িয়ে গিয়েছে এই পর্যায়ে এসে। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের ফুটবল ধুঁকছে একটা ব্রেকথ্রুর জন্য। জাতীয় দলের ম্যাচে গ্যালারি ছিল ফাঁকা, রিয়াল-বার্সা নিয়ে মাতামাতির মধ্যে বাংলাদেশ বরাবরই হয়েছে অবহেলিত। যতই আগ্রহ থাকুক না কেন, বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অব ফুটবল আকর্ষণ করতে পারেনি কাউকে। হামজা-ফাহামিদুল বদলে দিয়েছেন সেই সমীকরণ। সেই সমীকরণের প্রথম উদাহরণ ছিল ভারতের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচ। আজ তার টেস্ট পরীক্ষা।

প্রতিপক্ষে হিসেবে ভূটান তেমন বড় কোনো দল নয়, যদিও ফুটবলের দূর্দিনে তারাই আবির্ভূত হয়েছিল বাংলাদেশের ত্রাস হিসেবে। তাদের বিপক্ষে হেরে টানা ২ বছর আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ হারিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই ভূটানের বিপক্ষে বাংলাদেশের পরীক্ষা নিজেদের প্রমাণ করার। কোচ হাভিয়ের কাবরেরা, বাফুফের নতুন বোর্ড নতুন খেলোয়াড়দের স্বাগত জানিয়েছেন দুই হাতে। সেই খেলোয়াড়েরা এখন কতটা ফিরিয়ে দিতে পারেন সমর্থকদের, তার প্রমাণ মিলবে আজ সন্ধ্যা ৭টায়।

হামজা-ফাহামিদুল এসেই সবটা বদলে দেবেন—এমন আশা করা হয়তো বোকামি। ফুটবলের মতো দলগত খেলায় একজনের ভুলই শেষ করে দিতে পারে সবটা। কোচের কৌশল থেকে শুরু করে চাপের মুখে স্নায়ুর জোর—ফুটবলে প্রতিটি মুহূর্তের গুরুত্ব অপরিসীম।

হামজা-ফাহামিদুলরা যেভাবে বড় হয়েছেন, যে পরিবেশে খেলেছেন। সেখান থেকে এসে বাংলাদেশে মানিয়ে নেওয়া সহজ কথা নয়। তাদের স্কিল ও পরিবেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য যোজন-যোজন। শুরুতে তাই এই ভয়টাও ছিল, পরিবেশের সঙ্গে মানাতে না পেরে আবার বিভেদ না তৈরি হয়ে যায়। আজকের ম্যাচটা সেই পরীক্ষারও সময়। কীভাবে বিদেশে বড় হওয়া স্কিলফুল খেলোয়াড়দের সঙ্গে মানিয়ে নেন বাংলাদেশের তপু বর্মন, শেখ মোরসালিন, আল আমিনরা। কারণ যতদিন না মাঠের ১১ জন যতদিন না দল হয়ে উঠবে, ততদিন যত নামি দামি খেলোয়াড়েরাই জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চড়াক না কেন, সাফল্য ধরা দেবে না বাংলাদেশের।

ভুটান ম্যাচে তাই বাংলাদেশের জার্সিতে হামজা-জামাল-ফাহামিদুলরা থাকবেন মাঠে। গ্যালারি থেকে তাদের উৎসাহ দিবেন কানাডা থেকে দেশে ফেরা শামিত সোম। আর ইংল্যান্ড থেকে কিউবা মিশেল। দুইজনেরই সকল কাগজপত্র সম্পন্ন, শুধু অভিষেকের অপেক্ষায়। আর তাদের সবার সঙ্গে দ্বাদশ খেলোয়াড় হিসেবে থাকবে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ। টিভি পর্দার সামনে নতুন বাংলাদেশের পরীক্ষা দেখতে তুমি প্রস্তুত তো?