পঞ্চপাণ্ডব-অসুখের চক্রপূরণ

অবসর নাকি দুই প্রকার। কিছু অবসর ঘোষণার মুহূর্তে প্রশ্ন ওঠে জোরেশোরে, ‘এখনই অবসর নিচ্ছেন কেন?’ আর বাকিদের ক্ষেত্রে প্রশ্নটা, ‘এখনো অবসর নিচ্ছেন না কেন?’

এবারের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি শেষে দুটি প্রশ্নই শোনা গেল। সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিয়ে স্টিভেন স্মিথ যখন বললেন, ‘ওয়ানডেটা আর খেলছি না’, একটা চাপা গুঞ্জন ভেসে এল, ‘সেকি! শেষ ম্যাচেই না ৭৩ রান করলেন! আরেকটু চেষ্টাচরিত করে ২০২৭ বিশ্বকাপটাও কি খেলে যেতে পারতেন না!’

তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার মতো প্রশ্নটাই উঠল জোরেশোরে। একই সঙ্গে মুশফিকুর রহিম আর মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে। দুজনই ব্যর্থ একটা টুর্নামেন্ট কাটানোর পর বাংলাদেশের ক্রিকেটপাড়ায় ধ্বনিত হলো সমস্বরে, ‘বয়স পেরিয়ে গেছে ৩৭-এর ঘর। এখনো না ছাড়লে কখন?’

কারণও আছে। মুশফিকের ব্যাটে রানের আকাল লম্বা সময় ধরেই। ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি নেই প্রায় দুই বছর; এক অঙ্কের রানে আউট হয়ে যাচ্ছেন, এমন ঘটনাও ঘটেছে অনেকবারই। আর তাঁর বয়সটাও যেহেতু ৩০-এর ডান অর্ধেই, প্রশ্ন ওঠাটা খুব স্বাভাবিকই ছিল, ’২৭ বিশ্বকাপে মুশফিককে ছাড়া গেলেই দেশ ও দশের মঙ্গল হবে কি না।

অদূর ভবিষ্যতের এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সঙ্গে সঙ্গে অতীতকেও অবশ্য হাতড়ে ফিরতে হলো মুশফিকের অবসর ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে। বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে লম্বা ওয়ানডে ক্যারিয়ার তাঁর, ম্যাচও খেলেছেন সবার চেয়ে বেশি ২৭৪টি; উইকেটের পেছনে বাংলাদেশের হয়ে রেকর্ড নস্টালজিক হওয়ার মতো মুহূর্ত তো কম উপহার দেননি এই জীবনে।

সবার আগে তো মনে পড়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওই ১৪৪ রানের ইনিংসটির কথা। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসেই এর চেয়ে স্মরণীয় কোনো ইনিংস আছে কি না, তর্কযোগ্য। দুবাইয়ের গরম জয় করে একা হাতেই বাংলাদেশকে জয় এনে দিয়েছিলেন এশিয়া কাপের সে ম্যাচে, বললে অত্যুক্তি হবে না মোটেই।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের একটু পুরোনো সমর্থক হলে তোমার মনে পড়তে পারে ২০১২ সালের এশিয়া কাপও। মুশফিক তখন দলের অধিনায়ক। শচীন টেন্ডুলকার সেদিন পূরণ করলেন সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি। কিন্তু ম্যাচটা শেষমেশ জিতল বাংলাদেশ, প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলার স্বপ্নটাও ডানা মেলল এরপরই। মুশফিকের ২৫ বলে অপরাজিত ৪৬ রান ছাড়া যেটা সম্ভব হতো না একদমই।

ধরে ধরে এমন ইনিংসের গল্প বলতে শুরু করলে পুরো রাতেও শেষ হবে কি না, সন্দেহ। বাংলাদেশ যে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে উঠল বিশ্বকাপে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২০১৫ সালের সেই ম্যাচেও মুশফিক ফিরেছিলেন ৮৯ রান করে। নিউজিল্যান্ডকে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাওয়াশের স্বাদ দিল যেবার বাংলাদেশ, সেই সিরিজের প্রথম ম্যাচেও তাঁর ব্যাটে ৯০ রান। সাদা বলের ক্রিকেটে মুশফিকের বিদায়ী ম্যাচেও রইল এই নিউজিল্যান্ড। তবে ৯০ নয়, ড্রেসিংরুমে তাঁকে ফিরতে হলো ২ রানেই।

এই নিউজিল্যান্ড ম্যাচেই ক্রিকেট ক্যারিয়ারের এপিটাফ লেখা হলো মাহমুদউল্লাহরও। সেই নিউজিল্যান্ড, ৩৩ রানে ৪ উইকেট হারানোর পরে কার্ডিফ-রূপকথা লিখে জয় এসেছিল যাদের বিপক্ষে। সাকিবের সঙ্গে মহাকাব্যিক ওই জুটিও কিন্তু মাহমুদউল্লাহরই ছিল।

তবে তখন সাল ২০১৭। এরপর যমুনায় যেমন অনেক জল গড়িয়েছে, আরেকটা চ্যাম্পিয়নস ট্রফি আসতে আসতে বাংলাদেশের দলের পরিস্থিতিও অনেক বদলেছে। আট বছর আগে মাহমুদউল্লাহ ছিলেন দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ, পঞ্চপাণ্ডবের সহদেব; কিন্তু ২০২৫-এ এসে মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল একটা প্রশ্ন, ‘আর কত?’

দলে মাহমুদউল্লাহর জায়গা নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল আরও আগে থেকেই। তাঁর সঙ্গে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলা আফতাব আহমেদরা ক্রিকেটের পাট চুকিয়ে কোচ হিসেবেও হাত পাকিয়ে ফেলেছেন বহুদিন, কিন্তু মাহমুদউল্লাহর ক্রিকেট ক্যারিয়ারই শেষ হচ্ছে না। মাঝে চন্ডিকা হাথুরুসিংহে জাতীয় দলের দায়িত্ব নিয়ে তাঁকে ছাড়াই দল ঘোষণা করলেন যখন, ধরে নেওয়া হয়েছিল, এবারই শেষ।

কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটে বরাবরই যা হয়, সুযোগ পাওয়া বাকিদের ধারাবাহিক ব্যর্থতা মনে করাতে বাধ্য করে, ‘আগেই ভালো ছিলাম’, মাহমুদউল্লাহর ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। তিনি দলে তো ফিরেছেনই, সঙ্গে যেন ফিরিয়ে এনেছিলেন ব্যাটের হারানো ধার।

বাংলাদেশের ব্যর্থতায় ভরা কানাগলির ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে একমাত্র আলোর রেখা বলা যেতে পারে মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিংকেই। প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ক্যারিয়ারের চারটি ওয়ানডে সেঞ্চুরির সব কটিই আইসিসি ইভেন্টে করার রেকর্ডও গড়লেন ওই বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১১১ রানের ইনিংসে। মাহমুদউল্লাহ যদি ক্যারিয়ারের চাকা তখনো থামিয়ে দিতেন, তবু হয়তো ফিরে আসার অনুপ্রেরণা হিসেবেই তিনি ধরা পড়তেন বেশির ভাগের চোখে। কিংবা মাহমুদউল্লাহ মনে পড়তেন কার্ডিফের রূপকথাসম সেঞ্চুরি থেকে অ্যাডিলেড আর নিদাহাস ট্রফির বীরত্বে।

কিন্তু যেহেতু মাহমুদউল্লাহ ক্যারিয়ার করতে চাইলেন আরও একটু লম্বা, শেষটা আর সুখকর হলো না। চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পরপরই তো ঘোষণা এল, কিন্তু সেই টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ হলো মোটে এক ম্যাচ। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচেও ৪ রানের বেশি করতে পারেননি।

বাংলাদেশি সমর্থকেরা অবশ্য চ্যাম্পিয়নস ট্রফির চেয়ে মাহমুদউল্লাহর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ভূমিকাকেই মনে রেখেছে বেশি। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলতে বাংলাদেশের চাই ১৯ বলে ৪৩, তখন নূর আহমেদের ওভারের ৫টি বল দেখেশুনে কাটিয়ে দিলেন অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান। এই ট্যাকটিকস নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল তীব্রভাবে। মাহমুদউল্লাহকে ছাপিয়ে অবশ্য দেশের ক্রিকেট-সংস্কৃতি নিয়েই প্রশ্ন উঠেছিল আরেকবার, এমন সম্মানজনক পরাজয়ের মানসিকতা নিয়ে আর কত দিন!

মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর শেষটাও যে সুখের হলো না, তাতে একটা তালিকাও পূর্ণ হলো যেন। ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে পঞ্চপাণ্ডবেরা বিতর্কে জড়াবেন, একটা অলিখিত নিয়মই যেন লেখা হয়ে গেছে। ২০২০ সালের পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ত্রিসীমানায় নেই, কিন্তু বিসিবির প্রতি অভিমান থেকে মাশরাফি এখনো আনুষ্ঠানিক বিদায় জানাননি ক্রিকেটকে। তামিমকে নিয়ে যতবার ‘বিদায়’ লেখা হয়েছে, তাতে মহাকাব্য না হোক, দুর্দান্ত এক রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনি হলেও হতে পারে। বিদায় বলেননি সাকিবও। তবে গোটা খেলোয়াড়ি জীবনে যেমন ছিলেন সবার চেয়ে এগোনো, বিতর্কিতদের তালিকাতেও সাকিবকেই রাখতে হচ্ছে সবার ওপরে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সাকিব এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট-ছাড়া তো বটেই, দেশও ছাড়া। যা দেখে-টেখে সাকিব-ভক্তদের মনে আফসোসের অন্ত নেই, বাংলাদেশ আসলে কিংবদন্তিদের মর্যাদা দিতে পারে না।

কিংবা তুমি বলতে পারো এভাবেও, কীভাবে কিংবদন্তিসম মর্যাদা ধরে রাখতে হয়, তারকারাও সেটা জানেন কি?

আরও পড়ুন