কেমন ছিল ফুটবলের প্রাচীন ফর্মেশন

দল গঠনের জন্য খেলোয়াড়দের অবস্থান এবং তাঁদের মধ্যকার মাঠের সম্পর্ক নির্ধারণের জন্য ফর্মেশন করা হয়। দুটি বিষয় মাথায় রেখে কোচ ফর্মেশন তৈরি করে। বিরোধী দলের প্রতিরক্ষা সম্পর্কে জানা এবং তাঁদের দুর্বলতাকে কাজে লাগানো। সংখ্যার মাধ্যমে ফর্মেশন নির্ধারণ করা হয়। প্রথম দিকে ডিফেন্ডারদের এবং স্ট্রাইকারদের রাখা হয় শেষের দিকে। গোলকিপারদের অবশ্য ফর্মেশনের তালিকায় রাখা হয় না। চলো, আজ জানা যাক ফুটবল ইতিহাসের কিছু শক্তিশালী ফর্মেশন নিয়ে।

হার্বার্ট চ্যাপম্যান
হার্বার্ট চ্যাপম্যান | ব্রিটিশ ম্যানেজার হার্বার্ট চ্যাপম্যান ম্যানেজারের সংজ্ঞাই পরিবর্তন করে দিয়েছেন। তিনিই প্রথম ফর্মেশনের ধারণা দেন। তিনি ডব্লিউ এম (W M) আকৃতির ফর্মেশন নিয়ে কাটাছেঁড়া করে ফর্মেশন আরও উন্নতি করেন। তাঁর এই চিন্তাভাবনা ফুটবলকে আরও আধুনিক করে তোলে। ফুটবলে এই অভিনব পন্থার কারণে সে সময় তাঁর দল আধিপত্য বিস্তার করে। তাঁকে এনে দেয় ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে হাডার্সফিল্ড এবং আর্সেনালের শিরোপা।

প্রাচীন ফর্মেশন

১-২-৭

ফুটবল খেলায় শুরুর দিকে ফরোয়ার্ডদের কাছে পাস দেওয়ার নিয়ম ছিল না। আরও স্পষ্ট করে বললে, যে খেলোয়াড়ের কাছে বল থাকবে সে তার সামনের কোনো খেলোয়াড়ের কাছে বল পাস দিতে পারবে না। তাই তারা পাশের বা পেছনের খেলোয়াড়কে বল পাস দিত। যদিও পাস দেওয়াটাই তখন খেলার ভাবমূর্তি নষ্ট করার পর্যায়ে ছিল। পাস দেওয়ার পরিবর্তে বরং যে বল পেত সে একাই মাঝমাঠ থেকে বল টেনে নিয়ে ড্রিবলিং করতে করতে গোল দেওয়ার চেষ্টা করত। সতীর্থরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখত আর পেছনে দৌড়াত।

১-২-৭ ফর্মেশন

২-৩-৫ (পিরামিড)

১৮৮৬ সালে নিয়ম পরিবর্তন করে ফরোয়ার্ডদের কাছে পাস দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। তবে পাস দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। যার কাছে পাস দেওয়া হবে তার এবং গোলের মধ্যে কমপক্ষে তিনজন বিরোধী দলের খেলোয়াড় থাকতে হবে। এতে রক্ষণভাগ সামলানো আরও কঠিন হয়ে যায়। ১৮৮০–এর দশকে রক্ষণভাগ সামলাতে ২-৩-৫ ফর্মেশনের সৃষ্টি হয়।

১-২-৭ ফর্মেশনের ইতি

১৮৭২ সাল। হ্যাম্পডেন পার্ক। পরাক্রমশালী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলতে নামে স্কটল্যান্ডের প্রতিনিধিত্বকারী কুইন্স পার্ক দল। ইংল্যান্ড তখনো ৭ ফরোয়ার্ড নিয়ে খেলছে। ১-২-৭ ফর্মেশনে খেলার জন্য বুদ্ধির চেয়ে গায়ের জোর বেশি প্রয়োজন পড়ত। এখানে বলে রাখি, ১৯ শতকের ফুটবলে সব দলই বেশি বেশি ফরোয়ার্ড নিয়ে খেলতে চাইত। কারণ, তখন খেলোয়াড়দের একমাত্র লক্ষ্য ছিল গোল দেওয়া। গোল ঠেকানোর জন্য রক্ষণভাগে কেউ গুরুত্ব দিত না। তুলনামূলক শক্তিশালী এবং লম্বা খেলোয়াড়েরা একটানে বল নিয়ে গোল দিয়ে আসত। কারণ, সামনের খেলোয়াড়কে তো পাস দেওয়ার নিয়ম ছিল না। যাহোক, কুইন্স পার্ক দলের খেলোয়াড়েরা মোটেই ইংল্যান্ডের চেয়ে শক্তিশালী ছিল না। ফলে তারা ফর্মেশনে সামান্য পরিবর্তন করে। তারা একজন ফরোয়ার্ডকে ডিফেন্ডারে পাঠিয়ে দেয়। অর্থাৎ ফর্মেশন দাঁড়ায় ২-২-৬। এতে সুবিধা হলো, কুইন্স পার্কের খেলোয়াড়েরা যেহেতু কম শক্তিশালী, তাই তারা টানা দৌড়ে গোল না দিয়ে পাস দিয়ে খেলতে শুরু করে। ওদিকে রক্ষণভাগ শক্তিশালী হওয়ায় ইংল্যান্ডও গোল দিতে পারে না। এতেই সফল হয় কুইন্স পার্ক। শক্তিশালী ইংল্যান্ডের সঙ্গে ০–০ গোলে ড্র করে। ২-২-৬ ফর্মেশনের জনপ্রিয়তার মুখে ১-২-৭ ফর্মেশন মুখ থুবড়ে পড়ে।

৩-২-২-৩ (ডব্লিউ এম)

ফুটবলকে আরও আক্রমণাত্মক করতে ১৯৫২ সালে অফসাইডের নিয়ম সংশোধন করা হয়। নতুন নিয়ম অনুসারে, বল ও গোলের মাঝে বিপরীত দলের অন্তত দুজন খেলোয়াড় না থাকলে অফসাইড হবে। আগের নিয়মে তিনজন খেলোয়াড় থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। আক্রমণভাগ আরও শক্তিশালী করার জন্য হার্বার্ট চ্যাপম্যান ৩-২-২-৩ বা ডব্লিউ-এম (দেখতে ইংরেজি অক্ষর W ও M–এর মতো) ফর্মেশন গঠন করেন।

৩-২-২-৩ ফর্মেশন

৩-২-৩-২ (এম-ইউ)

১৯৫৩ সালে লন্ডনের ওয়েম্বেলিতে হাঙ্গেরি ও ইংল্যান্ডের মধ্যে একটি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। হাঙ্গেরি তখনকার অলিম্পিক ফুটবলের চ্যাম্পিয়ন দল। স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষের সেই ম্যাচে হাঙ্গেরি প্রথম এম-ইউ ফর্মেশন ব্যবহার করে। এদিকে ইংল্যান্ড তখন খেলছে চ্যাপম্যান উদ্ভূত ৩-২-২-৩ ফর্মেশনে। নতুন এই ফর্মেশনে হাঙ্গেরি সাফল্য পায়। শক্তিশালী ইংল্যান্ডকে হারায় ৬-৩ গোলে। ওয়েম্বেলিতে ওই ম্যাচেও প্রথম পরাজয়ের স্বাদ পায় থ্রি লায়ন্সরা।

৩-২-৩-২ ফর্মেশন

৪-২-৪

আক্রমণাত্মক খেলাকে ধরে রেখেই একটি নতুন ফর্মেশনের আবির্ভাব হয় ৪-২-৪। এই ফর্মেশনে খেলেই ব্রাজিল ১৯৫৮ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপ জয় করে। কাগজে এই ফর্মেশন দেখে মনে হয় মাঝমাঠ কম শক্তিশালী। কিন্তু বাস্তবে ঘটনাটি অন্য রকম। আক্রমণাত্মক খেলার সময় তারা ৩-৩-৪ ফর্মেশনে এবং রক্ষণাত্মকভাবে খেলার সময় ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলত। খেলার মাঠেই অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করত।

৪-২-৪ ফর্মেশন

অন্যান্য ফর্মেশন

১৯২০ ও ৩০-এর দশকে ইউরোপ জুড়ে ফুটবল খেলার নতুন নিয়ম ছড়িয়ে পড়ে। এখানে সেই বিখ্যাত নিয়মগুলোর দু-একটি আলোচনা করা হলো।

দানুবিয়ান স্কুল

১৯২০-এর দশকে অস্ট্রিয়ান, চেক প্রজাতন্ত্র ও হাঙ্গেরিয়ানরা পিরামিড ফর্মেশনকে (২-৩-৫) পরিবর্তন করে একটি নতুন রূপ দেয়। ফলে আগের চেয়ে বেশি পাস দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয় নতুন এই ফর্মেশনে। ১৯৩০–এর দশকের গোড়ার দিকে অস্ট্রিয়ানরা এই ফর্মেশন ব্যবহার করে অনেক উন্নতি করেছিল। ১৯৩৪ বিশ্বকাপে অর্জন করেছিল চতুর্থ স্থান।

দ্য মেথড বা পদ্ধতি

১৯৩০–এর দশকে ইতালীয় জাতীয় দলের কোচ ভিত্তোরিও পোজো দানুবিয়ান স্কুলের তৈরি ফর্মেশন আরও উন্নতি করেন। পোজো মধ্যমাঠ আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন। দুজন ফরোয়ার্ডকে মাঝমাঠে নিয়ে যান। ফলে নতুন ফর্মেশন দাঁড়ায় ২-৩-২-৩। পোজোর এই নতুন ফর্মেশন দারুণ সাফল্য লাভ করে। এই ফর্মেশন ব্যবহার করেই ১৯৩৪ ও ১৯৩৮ বিশ্বকাপে ইতালি পরপর দুবার বিশ্বকাপ জেতে। ইতিহাসে পোজোই একমাত্র কোচ, যিনি পরপর দুটি বিশ্বকাপ জিতেছেন।

আরও পড়ুন

তির্যক পদ্ধতি

১৯৪০–এর দশকে ব্রাজিলের কোচ ফ্লাভিও কস্তা একটি নতুন একক ফর্মেশন তৈরি করেছিলেন। সেই ফর্মেশনই ডায়াগোনাল বা তির্যক পদ্ধতি বলে। কস্তার এই একক ফর্মেশন অনেকটা ডব্লিউ-এম পদ্ধতির মতোই ছিল। সামান্য একটু পার্থক্যই ফর্মেশনকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। কস্তা কস্তা বাঁ পাশের দুজন মিডফিল্ডারকে ডান পাশের মিডফিল্ডারদের চেয়ে সামান্য এগিয়ে রাখেন। এতেই সাফল্য ধরা দেয়। কস্তা দারুণ উপভোগ করেছিলেন এই ফর্মেশন। কিন্তু ১৯৫০ বিশ্বকাপের মাঝপথে কস্তা আবার প্রচলিত ডব্লিউ-এম ফর্মেশনে ফিরে যায়। ফলে বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচটি হেরে যায় উরুগুয়ের কাছ। হারের পেছনে বড় কারণ ছিল কস্তার ওই ডব্লিউ-এম ফর্মেশনে ফিরে যাওয়া। ব্রাজিলের ফুটবলের ইতিহাসে ওই দিনটি কালো দিন হিসেবে বিবেচিত হয়।

মনে হচ্ছিল এলিয়েনের সঙ্গে খেলছি
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির সঙ্গে ৭-১ গোলে হারার পর বলেছিলেন ইংল্যান্ডের সেড ওয়েন

ফর্মেশনের ক্রমবিকাশ

প্রতিনিয়ত দলগুলোর পজিশন পরিবর্তনের কারণে আমূল বদলে গেছে ফর্মেশনের ইতিহাস।

১৮৬৭: প্রথম অফসাইড নিয়ম চালু হয়।

১৮৭২: রয়্যাল ইঞ্জিনিয়ার ১-২-৭ ফর্মেশনে খেলে এফএ (FA) কাপ জেতে।

১৮৮৯: প্রেস্টন নর্থ এন্ড ২-৩-৫ ফর্মেশনে খেলে ইংলিশ লিগ এবং এফএ কাপ জেতে।

১৯২৫: অফসাইডের নিয়ম পরিবর্তন হয় এবং সূচনা হয় ডব্লিউ-এম ফর্মেশনের।

১৯৩৪: ইতালির ভিত্তোরিও পোজো ২-৩-২-৩ ফর্মেশনে খেলিয়ে পরপর দুটি বিশ্বকাপ জেতে। তাঁর এই ফর্মেশন ‘দ্য মেথড’ নামে পরিচিত।

১৯৫৩: হাঙ্গেরি ডব্লিউ-এম ফর্মেশনের দুর্বলতা খুঁজে বের করায় এম-ইউ ফর্মেশনের সূচনা হয়।

১৯৫৮: ব্রাজিল ৪-২-৪ ফর্মেশনে খেলে বিশ্বকাপ জেতে।

১৯৬৬: মিডফিল্ড শক্তিশালী করে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ জেতে।

১৯৭০: ডাচ ফুটবল ক্লাব আয়াক্স প্রথমবার টানা তিনটি ইউরোপিয়ান কাপ জেতে।

১৯৯০: এসি মিলান আধুনিক ফর্মেশন ৪-৪-২ সূচনা করে।

২০২০-এর দশক: বর্তমানের শক্তিশালী ফর্মেশনগুলো হলো ৪-৩-৩ এবং ৪-২-৩-১।