ফুটবলের আধুনিক ফর্মেশন

ফুটবল শুরু হওয়ার প্রথম ১০০ বছরে মাত্র কয়েকটি ফর্মেশনে নিয়মিত খেলা হতো। সে সময় একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্যবহার করা হতো শুধু একটি ফর্মেশন। এখনকার মতো এত এত ফর্মেশন ছিল না। সব কটি দল একই ফর্মেশনে খেলত। ফলে শরীরে যাদের বেশি জোর ছিল বা যারা বেশি ট্যাকল ও ড্রিবলিং করতে জানত, তারাই হতো বিজয়ী। ১৯৬০–এর দশক থেকে ফুটবল কৌশলগতভাবে অনেক উন্নতি লাভ করেছে।

আরিগো সাচ্চি
আরিগো সাচ্চি | যদিও তিনি কখনো পেশাদার ফুটবল খেলেননি, কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে তিনি এসি মিলানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। খেলোয়াড়েরা তাঁকে কোচ হিসেবে পেয়ে প্রথমে তেমন সন্তুষ্ট ছিলেন না। কিন্তু সাচ্চি কাউকে নিরাশ করেননি। ফুটবলে তিনি সবচেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছেন ৪-৪-২ ফর্মেশন ব্যবহার করে। তবে তিনি এই ফর্মেশনে কিছুটা কাটাছেঁড়া করেছিলেন। এই ফর্মেশনে মাঠে একটা বড় গ্যাপ তৈরি হয়। সাচ্চি খেলোয়াড়দের নিজের ইচ্ছামতো ওপরে ও নিচের দিকে খেলিয়ে সেই গ্যাপ পূরণ করেছেন। ফলে সাফল্য ধরা দিতে বাধ্য হয়েছে আরিগো সাচ্চির কাছে। তিনি সর্বকালের সেরা পাঁচ কোচের একজন।   

আধুনিক ফর্মেশন

৪-৪-২

প্রাথমিকভাবে আধুনিক ফর্মেশন বলা যায় ৪-৪-২ ফর্মেশনকে। যদিও এই ফর্মেশনে মিডফিল্ডারদের দায়িত্ব তুলনামূলক বেশি ছিল। প্রয়োজন অনুসারে চার মিডফিল্ডারদের একজন আক্রমণভাগ সামলাতেন এবং একজন সামাল দিতেন রক্ষণভাগ। ফলে খেলার মাঠে ফর্মেশন দাঁড়াত ৪-২-৪। আবার মাঝেমধ্যে প্রয়োজন অনুসারে দুই স্ট্রাইকারের একজন নিচের দিকে নেমে মধ্যভাগ সামাল দিতেন। দুই স্ট্রাইকার একসঙ্গে খেলার কারণে তাঁদের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া থাকাটা ছিল বাধ্যতামূলক।

৪-৪-২ ফর্মেশন

৩-৫-২ বা ৫-৩-২

দুটি ফর্মেশনের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো, দ্বিতীয়টির তুলনায় প্রথমটি বেশি আক্রমণাত্মক। কারণ, প্রথমটিতে মিডফিল্ডার পাঁচজন হলেও দ্বিতীয়টিতে তিনজন। তবে দুই ফর্মেশনের যেকোনোটাতেই মূল ভরসা হলো দুই পাশের খেলোয়াড়েরা। যাঁদের সাধারণত উইং ব্যাক বলা হয়। তাঁরা প্রয়োজন অনুসারে একই সঙ্গে আক্রমণভাগ ও রক্ষণভাগ সামাল দিতে পারবেন।

৪-৩-৩

মূলত ৪-২-৪ ফর্মেশনের চেয়ে ৪-৩-৩ ফর্মেশন আরও আক্রমণাত্মক। ১৯৬২ বিশ্বকাপে ৪-৩-৩ ফর্মেশন ব্রাজিল উদ্ভাবন করেছিল। তিনজন মিডফিল্ডার বিভিন্নভাবে খেলতে পারেন। প্রয়োজনমতো তাঁরা ওঠানামা করতে পারেন ওপরে ও নিচে। অনেক দলই এখন এই ফর্মেশনে খেলা শুরু করেন। অথবা প্রথমে অন্য ফর্মেশনে খেলা শুরু করলেও গোলের প্রয়োজনে এই ফর্মেশনে খেলেন।

৪-৩-৩ ফর্মেশন

৪-৫-১

এটিও একটি রক্ষণাত্মক ফর্মেশন। এই ফর্মেশনে পাঁচজন মিডফিল্ডার খেলেন। একজন স্ট্রাইকার থাকলেও দলের প্রয়োজনে মধ্যমাঠ থেকে একজন এসে তাঁকে সাহায্য করেন। ব্রিটিশ দল চেলসি এই ফর্মেশন ব্যবহার করে পরপর দুবার ২০০৫ ও ২০০৬ সালে প্রিমিয়ার লিগ জিতেছিল।

৪-৫-১ ফর্মেশন

৪-২-৩-১

যৌক্তিকভাবে এই ফর্মেশনে মাঠের উভয় দিকে সমানভাবে খেলোয়াড়দের দখলে থাকে। এই ফর্মেশনে খেলোয়াড়েরা মাঠের চারপাশে ঘুরেফিরে খেলার সুযোগ পান। মাঝমাঠের ওপরের দিকের তিন খেলোয়াড়ের দুজন মাঝমাঠ সামাল দেন এবং অন্যজন স্ট্রাইকারের সঙ্গে আক্রমণভাগে চলে যান। এই ফর্মেশন ব্যবহার করে ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্স ব্রাজিলকে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে দিয়েছিল। ইউরোপ মহাদেশে এই ফর্মেশন খুব জনপ্রিয়।   

৪-২-৩-১ ফর্মেশন

অন্যান্য আধুনিক ফর্মেশন

 বেশির ভাগ ফর্মেশনই পুরো ফুটবল বিশ্ব গ্রহণ করেছে। তবে এমন কয়েকটি ফর্মেশন আছে, যা শুধু নির্দিষ্ট কোনো দল বা জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এ রকম উল্লেখযোগ্য দুটি ফর্মেশন হলো ক্যাটেনাচ্চো ও টোটাল ফুটবল। টোটাল ফুটবল বলতে বোঝায় ফুটবল খেলার এমন একটি আক্রমণাত্মক কৌশল, যেখানে গোলরক্ষক ছাড়া দলের সব খেলোয়াড় খেলা চলাকালে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে।

আরও পড়ুন

ক্যাটেনাচ্চো (১-৪-৩-২)

ক্যাটেনাচ্চো একটি ইতালীয় শব্দ। এর অর্থ ‘ডোর বোল্ট’ বা বন্ধ দরজা। এই ফর্মেশনে গোলরক্ষকের সামনে ডিফেন্ডারদের মাধ্যমে একটি শক্ত দেয়াল তৈরি করা হয়। এই ফর্মেশনে মূলত জোর দেওয়া হয় রক্ষণভাগে। খেলোয়াড়দের সব সময় চেষ্টা থাকে প্রতিপক্ষের জালে শুরুতেই একটি গোল ঢুকিয়ে দিতে। একটা গোল দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। মাঝমাঠের ওপরে আর তাঁরা ওঠেন না। বাকিটা সময় শুধু খেয়াল রাখতে হবে, প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়েরা যাতে কোনোভাবেই গোল না দিতে পারেন। এই ফর্মেশন অনুযায়ী প্রয়োজনে তিন মিডফিল্ডারও রক্ষণভাগ সামাল দিত। গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনা ও পোল্যান্ডের মধ্যকার ম্যাচটা অনেকটা এ রকম ছিল। যদিও পোল্যান্ড এই ফর্মেশন ব্যবহার করেনি। কিন্তু তাঁদের মাথায় ওই চিন্তাটাই ছিল, গোল যত আটকে দেওয়া যায়, ততই লাভ। তাঁদের এই বুদ্ধিতেই শেষ ম্যাচ হেরেও গোল ব্যবধানে মেক্সিকোকে ছাড়িয়ে শেষ ষোলোতে উঠেছে পোলিশরা।

ক্যাটেনাচ্চো ফর্মেশন

যেভাবে জন্ম হলো ক্যাটেনাচ্চোর

১৯৪০-এর দশকের শেষের দিকে ক্যাটেনাচ্চো ইতালিতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সালেনিটানার সাবেক ম্যানেজার (পড়তে হবে কোচ) জিপো ভাইনি এই ফর্মেশন উদ্ভাবন করেন। তিনি একদিন কিছু জেলেকে মাছ ধরতে দেখেন। জেলেরা প্রথমে একটি জাল দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করছেন। তার ঠিক পেছনে আরও একটি জাল রাখা হয়েছে, যাতে প্রথম জাল থেকে কোনো মাছ বেরিয়ে গেলেও যেন ওই দ্বিতীয় জালে আটকে পড়ে। জেলেদের ওই মাঝ ধরতে দেখে তাঁর মাথায় এই ফর্মেশনের চিন্তাটা আসে।

টোটাল ফুটবল

১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে আয়াক্স ও নেদারল্যান্ডসের কোচ রিনাস মিশেল মাঠে খেলোয়াড়দের অভূতপূর্ব স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। আগেই বলেছি, টোটাল ফুটবলে খেলোয়াড়দের নির্দিষ্ট কোনো পজিশন থাকে না। যদিও ওই সময় নেদারল্যান্ডস দলের ফর্মেশন ছিল অনেকটা ৪-৩-৩ ফর্মেশনের মতো। কিন্তু টোটাল ফুটবলের ফর্মেশন অনুযায়ী স্ট্রাইকার একই সঙ্গে সামলাত রক্ষণভাগ, মাঝমাঠ ও আক্রমণভাগ। তেমনি মাঝমাঠের কোনো খেলোয়াড়ও একই সঙ্গে মাঠজুড়ে খেলতেন। অর্থাৎ প্রয়োজন অনুসারে যেকোনো খেলোয়াড়কে যেকোনো জায়গায় খেলার দক্ষতা থাকতে হতো। এই ফর্মেশন পদ্ধতি তখন বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৯৭৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে পশ্চিম জার্মানি ও ১৯৭৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে তারা হেরে যায়।

টোটাল ফুটবল ফর্মেশন

বৈচিত্র্যময় ফর্মেশন

দ্য ডায়মন্ড

এই ফর্মেশনে খেলে আলফ রামসির ইংল্যান্ড ১৯৯৬ বিশ্বকাপে জিতেছিল। এই ফর্মেশনে মাঝমাঠ শক্তিশালী থাকে। ফলে মাঝমাঠ থেকে খেলোয়াড় এসে আক্রমণভাগেও সাহায্য করতে পারেন। ২০০৭ সালে এসি মিলান এই ফর্মেশনে খেলে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছিল।

দ্য ক্রিসমাস ট্রি

ফর্মেশনের আকৃতির কারণেই এ রকম নাম দেওয়া হয়েছে। ৪-৩-২-১ ফর্মেশন ৪-৩-৩ ফর্মেশনের চেয়ে আরও বেশি আক্রমণাত্মক। একজন স্ট্রাইকারের পেছনে আরও দুজন খেলোয়াড় ব্যাকআপ হিসেবে খেলতে পারেন। টেরি ভেনেবলসের ইংল্যান্ড এই ক্রিসমাস ট্রি ফর্মেশন ব্যবহার করে ১৯৯৬ ইউরোতে সফল হয়েছিল।

ভবিষ্যতের ফর্মেশন: ৪-৬-০

২০০৩ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে একটি কোচিং সম্মেলনে ব্রাজিলের সাবেক কোচ কার্লোস আলবার্তো পেরেইরা ঘোষণা করেছিলেন, ৪-৬-০ হবে ভবিষ্যতের ফর্মেশন। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হতে চলেছে। ২০১২ সালে স্পেন কোনো নির্ধারিত স্ট্রাইকার ছাড়াই ইউরো কাপ জিতেছিল। স্ট্রাইকারের পরিবর্তে মিডফিল্ডাররা সুযোগ তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওপরে উঠিয়ে গিয়েছিলেন।