কড়া কোচ পিটার বাটলারের অধীনেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন
২ জুলাই কি বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসের সেরা রাত? খেলার জগতে বাংলাদেশের অর্জনের খাতাটা বেশ ছোট। জয়ের পাল্লায় নতুন পালক যুক্ত হয় কালেভদ্রে। সেই হিসাবে বাংলাদেশের নারীদের অর্জনকে সেরা বললেও যেন কম হয়ে যাবে। বাংলাদেশের মেয়েরা প্রথমবারের মতো সুযোগ পেয়েছে এশিয়ান কাপে।
বাংলাদেশের যে এশিয়ান কাপ খেলার অভিজ্ঞতা নেই, তা নয়। ১৯৮০ সালে কুয়েত এশিয়ান কাপে একবার সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশ পুরুষ দল। কিন্তু এরপর থেকে বাংলাদেশে ফুটবলের গ্রাফ শুধু নিচের দিকেই নেমেছে। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ পুরুষ দল যখন একের পর এক হতাশা উপহার দিচ্ছিল, নারীরা জ্বেলে গিয়েছিলেন আশার আলো। সুযোগ-সুবিধা কিংবা অর্থ—সব দিক দিয়েই যোজন যোজন পিছিয়ে নারীরা। কিন্তু বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করার বেলায় নারীদেরই পাওয়া যায় সামনের সারিতে।
তাই বলে যে ঝড় আঘাত হানেনি, তা কিন্তু নয়। কিছুদিন আগেই হুট করেই কোচ পিটার বাটলারের বিপক্ষে বিদ্রোহ করে বসেন বাংলাদেশের ১৮ জন নারী ফুটবলার। অভিযোগ ছিল ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করেন কোচ, জীবনযাপন থেকে শুরু করে ট্রেনিং—সবকিছুতেই ইংলিশ যেন কড়া হেডমাস্টার। বাফুফের নতুন কমিটি সেবার একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সাধারণত জাতীয় দলের বিদ্রোহে খেলোয়াড়দের পক্ষ নিতে দেখা যায় বোর্ড কর্মকর্তাদের। হাজার হলেও কোচ আসবে যাবে, কিন্তু খেলোয়াড়েরা তো জাতীয় সম্পদ। কিন্তু বাফুফে পক্ষ নিয়েছিল পিটার বাটলারের। শেষ সুযোগ দিয়েছিল খেলোয়াড়দের ফিরে আসার, ১০ জন ফিরেছেন। সাবিনা খাতুন, কৃষ্ণা রানী সরকার, সানজিদা আক্তারের মতো সিনিয়র খেলোয়াড়েরা গোঁ ধরে বসে ছিলেন। পিটার বাটলারকে দল সাজাতে হয়েছিল অভিজ্ঞদের ছাড়াই। কিন্তু সঠিক কোচের ওপর বাজি ধরলে কী হতে পারে, তার প্রমাণ যেন আজকের এই অর্জন।
এশিয়ান কাপের বাছাইপর্ব খেলার আগে চারটি প্রীতি ম্যাচ খেলেছিল বাংলাদেশ। বিদ্রোহী ফুটবলারদের ছাড়া সাজানো সেই দল মুখ থুবড়ে পড়েছিল প্রতিপক্ষের সামনে। অনেকে ট্রল করেছিলেন। কিন্তু পিটার বাটলার ভরসা রেখেছিলেন তাঁর শিষ্যদের ওপর। কঠিন সমীকরণের সামনে প্রিমিয়ার লিগ খেলা কোচ সাজানো শুরু করলেন নতুন কৌশল। এশিয়ান কাপে সুযোগ পেতে চাইলে হতে হবে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন। যেখানে প্রতিপক্ষ হিসেবে আছে মিয়ানমারের মতো শীর্ষ সারির দল। কিন্তু নতুন কৌশলের বাংলাদেশ ছিল অপ্রতিরোধ্য। প্রথম ম্যাচেই মিলল তার প্রমাণ।
বাংলাদেশের থেকে ৩৬ ধাপ এগিয়ে থাকা বাহরাইনকে ৭-০ গোলে হারিয়ে এশিয়ান কাপ বাছাইপর্ব শুরু করে বাংলাদেশ। অথচ এই ম্যাচের আগে বাংলাদেশের রেকর্ড কী ছিল জানো? ৫ ম্যাচের ৫টিতেই হার! এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে কখনো জয়ের দেখাই পায়নি বাংলাদেশ। গতবার তো ঠিক সময়ে এন্ট্রি ফি দিতে না পারায় অলিম্পিক বাছাইপর্বে প্রবেশের টিকিটই মেলেনি ‘বাঘিনীদের’। সেই বাঘিনীরা মাঠে প্রবেশ করেই বদলে দিয়েছেন সব সমীকরণ। প্রথমার্ধেই বাংলাদেশ এগিয়ে যায় ৫-০ গোলে। দ্বিতীয় অর্ধে যুক্ত হয় আরও দুই গোল।
কিন্তু বাংলাদেশের মূল ভয়টা ছিল মিয়ানমারকে নিয়ে। সাফের কোনো দল এখন পর্যন্ত মিয়ানমারকে হারাতে পারেনি। তার ওপর আবার খোদ মিয়ানমারের মাঠেই ম্যাচ। র্যাঙ্কিংয়ে ৭৩ ধাপ এগোনো দলটি সব দিক দিয়েই এশিয়ান কাপে বাংলাদেশের বড় প্রতিপক্ষ। তাই তাদের বিপক্ষে বাটলার খেলা সাজিয়েছিলেন প্রতিপক্ষকে ফাঁদে ফেলে।
মিয়ানমারকে বাংলাদেশের অর্ধে সুযোগ দেওয়া মানেই বিপদ। তাই বাংলাদেশের ডিফেন্স ছিল হাই লাইনে। অর্থাৎ নিজেদের অর্ধে মিয়ানমারকে কোনো সুযোগই দেবে না বাংলাদেশ। আর যদি কালেভদ্রে মিয়ানমারের ফরোয়ার্ডরা প্রবেশও করে, তবে আটকে যাবে অফসাইড ট্র্যাপে। অনেকটা এই মৌসুমের বার্সেলোনার মতো। হলোও তা-ই, মিয়ানমারের একের পর এক আক্রমণ আটকে গেল হাই লাইন ডিফেন্সে, নয়তো অফসাইডের ফাঁদে। জোনাল ওভারলোড আর প্রেসিংয়ের কাছে দিশাহারা ছিল মিয়ানমারের আক্রমণ। তবে ডিফেন্সের রাজকীয় পারফরম্যান্সের মধ্যে সব আলো কেড়ে নিলেন ঋতুপর্ণা চাকমা। প্রথমার্ধে ঋতুপর্ণার নেওয়া ফ্রি-কিক আটকে গিয়েছিল দেয়ালে। ফিরতি শটে ফ্রি-কিকের দেয়াল, গোলরক্ষক—সবাইকে বোকা বানিয়ে বল জড়িয়ে দেন জালে। ডি-বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া দূরপাল্লার শট বাংলাদেশকে এনে দেয় আনন্দের প্রথম মুহূর্ত।
সেখানেই শেষ না। দ্বিতীয়ার্ধে ঋতুপর্ণার পা থেকে আসে নিজের আইকনিক গোল। ডি-বক্সের পাশ থেকে ক্রসিং শটে ওস্তাদ ঋতু। এ যেন শট এবং ক্রসের মিশেল। উইং থেকে বাড়ানোর ধরন দেখে মনে হবে স্ট্রাইকারের জন্য ক্রস বাড়াচ্ছেন ঋতু। কিন্তু সময় ঘনিয়ে আসতেই স্পষ্ট হলো; লক্ষ্য স্ট্রাইকার নয়, জাল। ততক্ষণে গোলরক্ষকের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। এর আগেও এভাবে মুগ্ধ করেছেন ২১ বছর বয়সী ঋতুপর্ণা, আর এবার বাংলাদেশকে পৌঁছে দিলেন এশিয়ান কাপের মঞ্চে। ঋতুপর্ণার দুই গোলে ভর করে প্রথমবারের মতো মিয়ানমারকে হারাল বাংলাদেশ। যদিও এশিয়ান কাপে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে তারও ঘণ্টাখানেক পর। সন্ধ্যায় একই গ্রুপে বাহরাইন-তুর্কমেনিস্তানের ম্যাচ ড্র হয়েছে ২-২ গোলে। এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বের নিয়ম অনুযায়ী দুই দলের পয়েন্ট সমান হলে দেখা হবে হেড টু হেড। আর মিয়ানমারকে হারিয়ে হেড টু হেডে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। ফলে শেষ ম্যাচে হারলেও কোনো চিন্তা নেই বাঘিনীদের।
কিন্তু র্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে থাকা তুর্কমেনিস্তানের বিপক্ষে হারার কথা ভাবতেও পারছেন না বাঘিনীরা। এশিয়ান কাপ নিশ্চিত হয়েছে তো কী, ম্যাচ বাই ম্যাচ জিতেই এশিয়ান কাপে যোগ দেবে বাংলাদেশ।
এবারের এশিয়া কাপে অংশ নেবে মোট ১২টি দল। এর মধ্যে সরাসরি সুযোগ পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া (স্বাগতিক), চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। গত এশিয়ান কাপের শীর্ষ তিন দল সরাসরি সুযোগ পায় এশিয়ান কাপের মঞ্চে। আর বাকি দলগুলোকে ভাগ করা হয় আটটি গ্রুপে। প্রতিটি গ্রুপের শীর্ষ দল সুযোগ পায় এশিয়ান কাপের মঞ্চে। বাছাইপর্ব খেলে এশিয়ান কাপে সুযোগ পাওয়া প্রথম দল বাংলাদেশ।
এশিয়ান কাপ থেকে বাংলাদেশের সুবর্ণ সুযোগ আছে বিশ্বকাপ নিশ্চিত করার। এশিয়ান কাপের শীর্ষ ৬-এ থাকতে পারলেই সরাসরি সুযোগ মিলবে ২০২৭ বিশ্বকাপে। এ ছাড়া ৭ ও ৮ নম্বরে থাকলে মিলবে বাছাইপর্ব খেলার সুযোগ। এশিয়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে তাই বাংলাদেশি মেয়েদের নজর এখন বিশ্বমঞ্চে।
পিটার বাটলারের ওপর বাফুফের ভরসা বদলে দিয়েছে বাংলাদেশের নারী ফুটবলের চিত্র। একজন অভিজ্ঞ কোচ আর তার অধীনে যোগ্য সেনানীরা থাকলে কীভাবে বদলে যেতে পারে দলের চিত্র, তার যথাযথ প্রমাণ যেন বাংলাদেশের নারী দল। র্যাঙ্কিংয়ে ১২৮ নম্বরে থাকা বাংলাদেশ এখন এশিয়ার শীর্ষ ১২ দলের মধ্যে একটি। এশিয়ার বড় মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করবে নিজের দেশকে। এর থেকে বড় গর্বের মুহূর্ত, নিকট অতীতে আর কখনো এসেছে কি?