ট্রেবল জয়ের কথা বলে শূণ্য হাতে ফিরলেন কোচ, ছাড়লেন দল

চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালের তখনও মিনিট বিশেক বাকি। একে একে শূণ্য হতে শুরু করেছে ইন্টারের দর্শকসারি। কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েছেন, কেউ কেউ স্বান্তনা দিচ্ছেন পাশের সমর্থককে। সবার মনে প্রশ্ন যেন একটাই–এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। ঘর থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে এসে মাথা নিচু করে ফিরে যাওয়ার সংকল্প তাদের ছিল না কখনো। তবে কেন? ফাইনাল শেষে সিমোন ইনজাঘির শূণ্য দৃষ্টি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল হতাশা। 

এক মাস আগের ইন্টার মিলানের সঙ্গে বর্তমান ইন্টার মিলানের পার্থক্য আকাশ-পাতাল। নেরাজ্জুরিদের চোখে মুখে তখন ছিল শিরোপার স্বপ্ন। একটা নয়, দুইটা নয়, একেবারে ট্রেবলের স্বপ্ন। সেখান থেকে দলটি ফিরেছে খালি হাতে। দলের অবস্থা এতটাই হতাশাগ্রস্থ যে খোদ কোচ সিমোন ইনজাঘি ইতালি ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন সৌদি আরবে। এক মাসের ব্যবধানে ইন্টার মিলানের এই পতন চমকে দিয়েছে পুরো ফুটবল বিশ্বকে। বার্সেলোনার মতো দূর্দান্ত ফর্মে থাকা দলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে ওঠা দলের অবিশ্বাস্য পতনের পেছনে রহস্যটা কী? 

ফাইনাল হেরে কান্নায় ভেঙে পরেছেন আলেহান্দ্রো বাস্তোনি। ছবি: এক্স

নিজেদের মাটিতে দূর্দান্ত ফর্মে থাকা বার্সেলোনাকে ৪-৩ গোলে হারিয়ে রীতিমত চমকে দিয়েছিল ইন্টার মিলান। নির্ধারিত সময় শেষে যোগ করা অতিরিক্ত সময়ে দলকে খাদের কিনারা থেকে বাচিয়ে এনেছিলেন ফ্রান্সেস্কো আচেরবি। এক্সট্রা টাইমে বার্সেলোনাকে হারিয়ে নিশ্চিত চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল নিশ্চিত করে ইন্টার। কোয়ার্টার ফাইনালে বায়ার্নকে হারিয়ে প্রেস কনফারেন্সে কোচ সিমোন ইনজাঘি বড় মুখ করে বলছিলেন, ট্রেবল নয় একেবারে চার শিরোপার দিকে নজর রাখছেন তিনি। তাঁর অহংকারই যেন কাল হয়েছে দলের জন্য। 

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ইতালিয়ান সিরি আ ছিল ইন্টারের হাতের মুঠোয়। দ্বিতীয় স্থানে থাকা নাপোলি থেকে ইনজাঘির দল এগিয়ে ছিল আট পয়েন্টের ব্যবধানে। সেখান থেকে টানা তিন ম্যাচে আট পয়েন্ট হারিয়ে নাপোলির কাছাকাছি চলে আসে নেরাজ্জুরিরা। এরপরেও লিগে আশা ছিল। কিন্তু একের পর এক পয়েন্ট হারানোর মিছিলে নেমে সেই আশা পরিণত হয় দূরাশায়। 

এর মধ্যেই আঘাত হানে কোপা ইতালিয়ার সেমি ফাইনাল। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী এসি মিলানের বিপক্ষে প্রথম লেগ শেষ হয়েছিল ১-১ গোলে। পরের লেগে যেকোনো ব্যবধানে জয় উৎরে নিয়ে যেতে পারতো ইন্টারকে। কিন্তু ইতালিয়ান সুপার কাপের মতো সেমি ফাইনালে এসে এসি মিলানের কাছে রীতিমত পর্যদুস্ত হলো ইন্টার। ৩-০ গোলের ব্যবধানে হেরে ছিটকে গেল কোপা ইতালিয়ার লড়াই থেকে। তখনও লিগ আর চ্যাম্পিয়নস লিগের স্বপ্ন বেঁচে ছিল বৈকি। কিন্তু সেখানেও নিজেদের দোষে সবটা হারিয়েছে ইন্টার।

আরও পড়ুন
অ্যান্তোনিও কন্তের নাপোলির কাছে সিরি আ হারিয়েছে ইন্টার। ছবি: এক্স

কোপা ইতালিয়া থেকে ছিটকে যাবার পর যেখানে সবটা গুছিয়ে নেওয়ার কথা ইনজাঘির, সেখানে বোলোনিয়া, রোমার কাছে হেরে নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল মেরেছে ইন্টার। নাপোলির সঙ্গে লড়াই যখন হাড্ডাহাড্ডি তখন লিগের ৩৭তম ম্যাচে এসে লাৎজিওর সঙ্গে করেছে ড্র। সেই ২ পয়েন্টই কাল হয়েছে তাদের জন্য। এতগুলো সুযোগ দেওয়ার পর নিশ্চয় প্রতিপক্ষ বসে থাকবে না। সেই সুযোগের সৎব্যবহার করেছে নাপোলি। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পয়েন্ট হারিয়েছে তারাও। কিন্তু ঠিক যে সময়ে দরকার ছিল, সেই সময়ে ঠিকই পয়েন্ট ছিনিয়ে এনেছে তারা। শেষ পর্যন্ত লিগের শীর্ষ দুই দলের মধ্যে পয়েন্টের পার্থক্য রইল মাত্র ১। এক মৌসুমের ব্যবধানে আবারও স্কুদেত্তো জেতার স্বপ্ন ধূলিস্বাৎ হলো শেষ দিন এসে।

হোয়াও নেভেস আর ভিতিনহার কাছে পর্যদুস্ত হয়েছে ইন্টারের মাঝমাঠ। ছবি: এক্স

শেষ মুহূর্তে বেঁচে ছিল ইন্টারের চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার স্বপ্ন। দুই বছর আগেও একই স্বপ্নে বিভোর হয়ে ইস্তান্বুলে পৌঁছে গিয়েছিল ইন্টার মিলান। সেবার ইস্তান্বুল তাদের বরণ করে নিয়েছিল নতুন এক চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ী দলকে। ইন্টার মিলানকে হতাশ করে চ্যাম্পিয়নস লিগ ঘরে তুলেছিল ম্যানচেস্টার সিটি। মিউনিখের অ্যালিয়াঞ্জ অ্যারেনায় সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল আরেকবার। তবে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে যে লজ্জার ইতিহাস গড়বে ইন্টার, তা হয়তো স্বপ্নেও ভাবেনি তারা। 

লুইস এনরিকের আক্রমণাত্বক ফুটবলের সামনে পাত্তাই পায়নি ইনজাঘির ইন্টার। আক্রমণাত্বক পিএসজিকে সামলাতে ইন্টার শুরু করেছিল রক্ষণ শক্ত করে। আর সেটাই ঘুরিয়ে দিয়েছে ম্যাচের মোড়। ফ্লুইড ডায়নামিক আর পজিশনিংয়ের কারণে শুরু থেকেই খেই হারিয়ে ফেলেছিল ইন্টার। পুরো ম্যাচে আর সেই খেই খুঁজে পায়নি তারা। পিএসজির গোলবন্যা শুরু করেছিলেন ইন্টারের প্রাক্তন খেলোয়াড় আশরাফ হাকিমি। অতঃপর ১৯ বছর বয়সী তরুণ দেজিরে দুয়ের গোল। দুই গোলের পর ম্যাচ থেকে পুরোপুরি ছিটকে যায় ইন্টার। কোন প্রতিরোধই গড়তে পারেনি তারা। না রক্ষণে, না আক্রমণে। লাওতারো মার্তিনেজ, মার্কাস থুরাম সবাই যেন ঠাই দাঁড়িয়ে ছিলেন মাঠে। তাদের উপর দিয়ে চলা তুফান থেমেছে ৫-০ ব্যবধানে। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের সবচেয়ে বড় হারের তকমা এখন তাদের নামের পাশে। 

আরও পড়ুন
চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসের ফাইনালে সবচেয়ে বড় হার ইন্টারের। ছবি: এক্স

ইন্টার মিলানের এই ভরাডুবির পর পদত্যাগ করেছেন কোচ সিমোন ইনজাঘি। চার বছর ইন্টারে কাটিয়ে অবশেষে যোগ দিয়েছেন সৌদি আরবের ক্লাব আল হিলালে। চার বছরে ছয় ট্রফি এনে দেওয়া ইনজাঘি নিজের শেষটা আরও ভালোভাবে আশা করেছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের কি নিদারুণ চিত্র, যে ক্লাব বিশ্বকাপের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি, সেখানে তার খেলা হচ্ছে বটে। কিন্তু ভিন্ন এক ডাগআউটে। ইনজাঘির ফেলে যাওয়া শুণ্যস্থান পূরণ করছেন ইন্টারের সাবেক ডিফেন্ডার ক্রিশ্চিয়ান চিভু। ইন্টারকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এখন তাঁর কাঁধে। কিন্তু তিন বছরে দুইবার চ্যাম্পিয়নস লিগ হারানো, ট্রেবলের এত কাছে থেকেও জিততে না পারার রেশ আরও অনেকদিন বয়ে বেড়াতে হবে তাদের। 

আরও পড়ুন