হলান্ডে ভর করে ২৮ বছর পর ‘ভাইকিংস’রা বিশ্বকাপে
গত বিশ্বকাপের কথা। ইউরোপিয়ান ফুটবল মৌসুমের মাঝখানে বিরতি দিয়ে ধুমধাম আয়োজনে মত্ত হয়েছিল বিশ্ব। ক্লাব ফুটবল থমকে ছিল, বিশ্বকাপে সুযোগ না পাওয়া খেলোয়াড়েরা অপেক্ষায় ছিলেন, কবে থেকে আবার শুরু হবে ক্লাব ফুটবল। এমন সময় স্কাই স্পোর্টস থেকে বানানো হয় একটি বিজ্ঞাপন, যার মূল চরিত্র আর্লিং হলান্ড।
ম্যানচেস্টার সিটির বিশাল ট্রেনিং গ্রাউন্ডে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন একা। একা একা ট্রেনিং করছেন, ফ্রি–কিক নিচ্ছেন। ম্যানিকিনের গায়ে পরিয়ে দিয়েছেন ডি ব্রুইনার জার্সি। সবাই যখন বিশ্বকাপ খেলতে কাতারে, তখন হলান্ড কাতরে মরছেন সঙ্গীর খোঁজে। আর্লিং হলান্ডের সেই কাতর স্বর হাসির খোরাক জুগিয়েছিল অনেকের মনে। স্কাই স্পোর্টস আগমনী বার্তাও দিয়েছিল, ক্লাব ফুটবল ফিরছে। কিন্তু এত সব কিছুর মধ্যেও একটা আক্ষেপ ছিল তাঁর মনে, নরওয়েকে নিয়ে কি বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন পূরণ হবে না কখনো?
তার ঠিক তিন বছর পর, বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচ। বিশ্বকাপের টিকিট প্রায় নিশ্চিত, বাদ পড়তে হলে ইতালিকে অবিশ্বাস্য কিছুই করতে হবে। সেই সুযোগ চলে গেছে ম্যাচের মাঝামাঝি সময়েই, বাকি শুধু ম্যাচটা জেতা। হলান্ড ডি-বক্সে হাজির হলেন, পরপর দুই মিনিটে ক্লাবের সতীর্থ জিয়ানলুইজি দোন্নারুম্মাকে বিধ্বস্ত করলেন। আর বিশ্বকাপের টিকিট নিশ্চিত করে চলে এলেন। বাছাইপর্বে শেষ ম্যাচে ইতালিকে ৪-১ গোল হারিয়ে আমেরিকার টিকিট নিশ্চিত করল ভাইকিংসরা। মাত্র তিনবার বিশ্বকাপ খেলা নরওয়ে ২৮ বছর ধরে নেই বিশ্বকাপের মূল মঞ্চে। ১৯৯৮ সালের পর আবারও বিশ্বকাপে পা রাখছে নরওয়ে। আর তার পুরো কৃতিত্ব আর্লিং হলান্ডের।
আর্লিং হলান্ডকে একসময় বলা হতো নরওয়ের ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’। ইউরোপিয়ান আন্তর্জাতিক ফুটবলে একটা নামই ছিল নরওয়ের কাছে, আর্লিং ব্রুট হলান্ড। গত বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব, ইউরোর বাছাইপর্বে নরওয়ের জার্সিতে একটা নাম দেখা যেতে থাকে বারবার। গোল করে যাচ্ছেন এক প্রান্তে, কিন্তু অপর প্রান্তে তাঁর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সকে ধরে রাখতে পারছে না কেউ। নরওয়ের জন্য বিশ্বকাপ খেলা তাই ছিল এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ২০২২ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে প্রথম পর্বের বাধাই উতরাতে ব্যর্থ হয়েছিল নরওয়ে। হলান্ডকে তাই ব্যর্থ মনোরথে ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল সিটির ট্রেনিং গ্রাউন্ডে।
কিন্তু এবার আর সেই চিত্র নেই। আর্লিং হলান্ড আর নরওয়ের একাকী সেনানী নন। বরং নরওয়েকে টেনে নেওয়ার মতো খেলোয়াড় একে একে উঠে এসেছেন। হলান্ডকে সাহায্য করার মতো, তাঁর সঙ্গে জুটি করার মতো খেলোয়াড় এখন নরওয়েজুড়ে। মার্টিন ওডেগার্ড আছেন অনেক দিন ধরেই, সেই সঙ্গে আক্রমণভাগে যোগ দিয়েছেন অ্যালেকজান্ডার সোরলথ। মাঝমাঠে থিও অ্যাসগার্ড, স্যান্ডার বার্গ আর ডিফেন্সে জুলিয়ান রায়ানসন—নরওয়েকে টেনে নেওয়ার মতো তারকা এখন অনেক। কিন্তু যত তারকাই থাকুক না কেন, নরওয়ের ভরসা দিন শেষে আর্লিং হলান্ডই। বাছাইপর্বে তাকালেই তার প্রমাণ মেলে।
নরওয়ের হয়ে আর্লিং হলান্ড একাই গোল করেছেন ১৬টি। পুরো বাছাইপর্বে তাঁর ধারেকাছে নেই কেউ। এর মধ্যে মলদোভার বিপক্ষে করেছেন এক ম্যাচেই ৫ গোল। ইসরাইলের বিপক্ষে করেছেন হ্যাটট্রিক। পুরো বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব মিলিয়ে তাঁর ধারেকাছে আছেন কাতারের আলমোয়াজ আলী। আট ম্যাচের আটটিতেই বিশাল জয় নিয়ে বাড়ি ফিরেছে তারা। তাদের গ্রুপে ছিল ইতালি, অথচ তাদের পাত্তাই দেয়নি নরওয়ে। ঘরের মাটিতে ইতালিকে হারিয়েছে ৩-০ গোলে। আর ইতালির মাটিতে গিয়ে ইতালিকে হারিয়েছে ৪-১ গোলে। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের সেরা দল বাছাই করা হলে সেখানে নিঃসন্দেহে নাম থাকবে নরওয়ের।
গত বিশ্বকাপে যে হলান্ড আফসোস করেছেন, আবেগে ভেসেছেন বিশ্বকাপ খেলতে না পেরে। সেই হলান্ডই এবারের বিশ্বকাপে পা দিচ্ছেন সেরা দল আর তারকা হিসেবে। ৩ বছর আগের ২৪ বছর বয়সী বিধ্বংসী হলান্ড ব্যালন ডি’অরের পোডিয়াম পাননি শুধু বিশ্বকাপ খেলতে না পারায়। এবার ক্লাবেও আছেন দুর্দান্ত ফর্মে, জাতীয় দলেও। নরওয়েকে নিয়ে বিশ্বকাপে চমক দেখাতে পারলে ব্যালন ডি’অরের দৌড়েও অনেক দূর এগিয়ে যাবেন হলান্ড।