ঋতুপর্ণা–মারিয়াদের যে লড়াইয়ের গল্প কেউ জানে না
আফঈদা খন্দকার তখনো তারকা হয়ে ওঠেননি। দুই বোন আফঈদা খন্দকার ও আফরা খন্দকার ফুটবল খেলেন। অংশ নেন বক্সিংয়েও। তেমনই একটা ইভেন্টে বাংলাদেশ যুব গেমসের বক্সিং রিংয়ে মেয়েরা খেলছেন। আর পল্টনের মোহাম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়ামের এক কোণে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন বাবা খন্দকার আরিফ হাসান প্রিন্স।
কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি, ‘কাঁদছেন কেন?’ বলেন, মেয়েরা সোনার মেডেল জিতেছে। এই আনন্দে কাঁদি।’
মেয়েদের নিয়ে এমন স্বপ্নবোনা বাবা আমি খুব কমই দেখেছি। আরিফ হাসানের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এক মেয়ে বক্সার। আরেক মেয়ে আফঈদা বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক। আফঈদাদের হাত ধরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নিয়েছে। আফঈদার বাবার মতো স্বপ্নবান বাবা এ দেশে বিরল। বিশেষ করে নারী দলে যেসব ফুটবলার খেলেন, তাঁদের বেশির ভাগকেই লড়াই করতে হয়। দেশের পশ্চাৎপদ এলাকা থেকে উঠে আসা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এই ফুটবলারদের জন্য এগিয়ে যাওয়ার পথে আরেকটা বাধা, তাঁরা নারী। তাঁদের সারাক্ষণ পরিবারের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। সমাজের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। মাঠে ও মাঠের বাইরেও লড়তে হয়। নারী ফুটবলারদের বেতন পর্যাপ্ত নয়। আবার যে সম্মানী দেওয়ার কথা, বাফুফের পক্ষ থেকে সেই বেতনও বাকি থাকে মেয়েদের। এত এত লড়াইয়ের পরও তাঁরা হার মানেন না। হার মানতে চান না।
জাতীয় দলের স্ট্রাইকার মোসাম্মৎ সাগরিকার কথা ধরা যাক। দলে জায়গা করে নিতে তাঁকে প্রচুর লড়াই করতে হয়েছে। অথচ ঠাকুরগাঁওয়ের রাঙ্গাটুঙ্গীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়ে সাগরিকার মন সারাক্ষণ টানত ফুটবল মাঠে। জার্সি, হাফপ্যান্ট পরে মেয়েরা ফুটবল খেলবে, এটা মোটেও ভালো চোখে দেখত না গ্রামবাসী। একই ভাবনা ছিল সাগরিকার বাবা লিটন আলীরও। কিন্তু মেয়ের জেদের কাছে হার মানতে হয়েছে একসময়।
এলাকার মানুষ বলত, ‘মেয়েমানুষ ফুটবল খেললে নষ্ট হয়ে যাবে।’ বাবা ভেবেছিলেন মেয়েকে কিছুদিন পর বিয়ে দিয়ে দেবেন। কিন্তু ফুটবলের টানে ঘর ছাড়েন সাগরিকা। ঠাকুরগাঁও থেকে পালিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। ২০২২ সালে হওয়া ঘরোয়া নারী ফুটবল লিগে খেলেন এফসি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হয়ে। প্রথম ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করেন। ওই আসরে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে জাতীয় দলের সাবেক কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের নজর কাড়েন।
২০২৩ সালের এপ্রিলে সিঙ্গাপুরে হয়েছিল এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের প্রথম পর্ব। নারী ফুটবল লিগে পারফরম্যান্সের সুবাদে বাংলাদেশের জার্সিতে খেলার সুযোগ পান সাগরিকা। এরপর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। একে একে বয়সভিত্তিক ফুটবল পেরিয়ে সর্বশেষ অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফের চ্যাম্পিয়ন দলেও খেলেছেন। টুর্নামেন্টে লাল কার্ড দেখে তিন ম্যাচ নিষিদ্ধ ছিলেন। এরপরও সাফের মোস্ট ভ্যালুয়েবল ফুটবলারের পুরস্কার জিতেছেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮ গোল করেছেন ঢাকায় ১১-২১ জুলাই অনুষ্ঠিত এই টুর্নামেন্টে। অথচ মেয়ে ফুটবল খেলে বলে এক মাস ধরে সাগরিকার সঙ্গে কোনো কথা বলেননি বাবা লিটন আলী। লিটন সাহেব অন্যের জমির ওপরে চায়ের দোকান দিয়ে সংসার চালান। এরপরও তিনি পিছিয়ে থাকা সমাজব্যবস্থার অর্গল ভেঙে মেয়ের পাশে দাঁড়াতে পারেননি। সাফ জেতার পর মেয়েই উল্টো তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। সেই মেয়ে সাফের পর এশিয়ান কাপেও খেলবেন।
ময়মনসিংহের কলসিন্দুরের ফুটবলার তহুরা খাতুনকে কখনো ফুটবল খেলতে দিতে চাইতেন না বাবা ফিরোজ মিয়া। কিন্তু সেই তহুরাকেই বলা হতো ময়মনসিংহের মেসি। তাঁর দ্রুতগতির ড্রিবলিং আর গতিময় ফুটবল দেখে, গোল করার সামর্থ্য দেখে ভালোবেসে এলাকাবাসী এই নাম দিয়েছিল।
ফিরোজ মিয়ার পাঁচ মেয়ে। তহুরা মেজ। ফুটবলে হাতেখড়ি ১০-১২ বছর বয়সে। বাড়ির আঙিনায়। বাড়ির আঙিনায় খেলা সেই তহুরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এখন দেশ–বিদেশের নানা মাঠে।
প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা ঋতুপর্ণাদের মতো নারী ফুটবলারদের বড় সমস্যা আবাসন। বাফুফের মতো ব্যস্ত দাপ্তরিক ভবনের চতুর্থ তলার ১১টি কক্ষে প্রায় ৭০ জন নারী ফুটবলার থাকেন। অথচ এই ভবনে নেই লিফট
একবারের ঘটনা। বয়সভিত্তিক সাফে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ১০ লাখ টাকা দেয় সরকার। সঙ্গে ওয়ালটনের পক্ষ থেকে উপহার একটা রেফ্রিজারেটর। মেয়ে একসঙ্গে এত টাকা পেয়েছেন, বাবা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। তিনি বলছিলেন, ‘প্রথমে মেয়ে যখন ফোন করে বলে আমি তো বিশ্বাস করতে চাইনি। একটু পর মনে হলো আমার মেয়ে তো মিথ্যা কথা বলে না।’
মেয়েকে ফুটবল খেলতে বাধা দিতেন বাবা। তবে নিজের ইচ্ছায় নয়। প্রতিবেশীর কথা শুনেই নাকি তহুরাকে খেলতে দিতে চাইতেন না। এরপর আমি তহুরাকে ডেকে বলি, ‘মাগো তুমি খেলা ছেড়ে দাও।’ তবে বাবাকে অনুরোধ করে তহুরা আরেকবার খেলার অনুমতি চেয়েছিলেন। বাবা এরপর আর কখনো না করেননি।
ময়মনসিংহ থেকে উঠে আসা মিডফিল্ডার মারিয়া মান্দার লড়াইয়ের গল্পটা অন্য রকম। বাবা বীরেন্দ্র মারাত যখন মারা যান, তখন মারিয়া মান্দা পড়তেন তৃতীয় শ্রেণিতে। মারিয়ার ছোট ভাই দানিয়েল মান্দা ছিল মায়ের গর্ভে। সেই থেকে চার ভাইবোনকে নিয়ে মারিয়া মান্দার মা এনতা মান্দার লড়াইটা শুরু।
ময়মনসিংহের মন্দিরগোনা গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন মারিয়া। যখন কলসিন্দুর স্কুলে মফিজ স্যারের কাছে ফুটবলের অনুশীলন করতেন, গ্রামের অন্যরা নানা সমালোচনা করত। অনেক বাবা-মা পড়াশোনার ক্ষতি হওয়ার ভয়ে মেয়েদের খেলতে পাঠাতে চাইতেন না। কিন্তু মারিয়ার মা তেমন ছিলেন না। মেয়েকে ফুটবল মাঠে পাঠাতেন।
অথচ মারিয়ার মা অন্যের জমিতে কাজ করতেন একসময়। ধানের মৌসুমে ধান লাগাতেন। মৌসুম শেষে ধান কাটার কাজ করতেন। এ জন্য দিনে ২০০ টাকা পারিশ্রমিক পেতেন। শত অভাবেও মারিয়ার কোনো চাওয়া কখনো অপূর্ণ রাখতেন না। ছোটবেলায় একবার বুট কিনতে চাইলে চাল বিক্রি করে সেটা কিনে আনেন মা। খেলার অন্য সরঞ্জামও কতবার কিনে দিয়েছেন এভাবে!
আরেকটা ঘটনা বলি। মারিয়া মান্দার লড়াইয়ের আরেকটা বড় উদাহরণ এটা।
মারিয়া মান্দাদের গ্রামের নেতাই নদে সেতু নেই। ভোরে নৌকা পাওয়া যেত না। কীভাবে ওপারে পৌঁছানো যাবে, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা হতো। এমনও হয়েছে, মাঝিকে ফোন করে আগেই বলে রাখতেন মারিয়ার মা। কোনো কোনো দিন মাঝি না থাকলে মারিয়ার মা নৌকা বেয়ে খরস্রোতা নদ পার করে দিয়ে আসতেন। এসব লড়াইয়ের ফল পেয়েছেন মারিয়া। আজ তিনি সফল ফুটবলার।
মারিয়া মান্দার সতীর্থ ঋতুপর্ণা চাকমার কষ্টটা আরও বেশি। তাঁকে পরিবার থেকে কখনো বাধা দেয়নি ফুটবল খেলতে। কিন্তু রাঙামাটির মগাছড়ি গ্রামে এতটুকু উন্নতি হয়নি। ছোট বাঁশের সাঁকো, পাহাড়ি পথ আর ঝিরি ও দুর্গমতা মাড়িয়ে যেতে হয় ঋতুপর্ণা চাকমাদের বাড়ি।
যেখানে এখনো টিনের চালা ও বাঁশের বেড়ার একটি ঘরে থাকেন ঋতুপর্ণা। চার বোন ও এক ভাইয়ের সংসারে ঋতুর বয়স যখন ১১ তখন ক্যানসারে মারা যান তাঁর বাবা। একমাত্র ভাই পার্বণ চাকমাও দুই বছর আগে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যায়। বাবা-ভাইবিহীন সংসার টেনে নিচ্ছেন তাঁর মা ভুজপতি চাকমা। চার বোনের মধ্যে ছোট ঋতুপর্ণা। বড় তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। তাই বাড়িতে একাই থাকেন মা ভুজপতি চাকমা। সেই মা–ও ক্যানসারে ভুগছেন। মায়ের চিকিৎসার জন্যও দুশ্চিন্তায় থাকেন ঋতুপর্ণা।
স্বপ্ন ছিল ঋতুপর্ণা নিজের এলাকায় একটা বাড়ি করবেন। সরকার তাঁকে একটা জায়গায় দিয়েছে। কিন্তু জেলা প্রশাসনের বরাদ্দ দেওয়া জায়গায় বাড়ি নির্মাণের কাজ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ আছে। প্রতিশ্রুত বাড়ি নির্মাণের ফাইল আটকে আছে মন্ত্রণালয়ে।
প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা ঋতুপর্ণাদের মতো নারী ফুটবলারদের বড় সমস্যা আবাসন। বাফুফের মতো ব্যস্ত দাপ্তরিক ভবনের চতুর্থ তলার ১১টি কক্ষে প্রায় ৭০ জন নারী ফুটবলার থাকেন। অথচ এই ভবনে নেই লিফট। দৈনিক একাধিকবার ট্রেনিং, জিম সেরে সেই ভবনের সিঁড়ি বেয়ে ক্লান্ত মেয়েদের পৌঁছাতে হয় কক্ষে। একেকটি কক্ষে ছয় থেকে আটজনকে থাকতে হয় গাদাগাদি করে।
কিন্তু যে মেয়েরা বাংলাদেশকে এত বড় সাফল্য এনে দিচ্ছেন, তাঁদের জন্য আরও ভালো সুযোগ–সুবিধা প্রয়োজন বলে মনে করেন জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার রেহানা পারভীন, ‘আমাদের ফুটবলাররা যেখানে থাকে, ওটার পরিবর্তন করা দরকার। ওদের আবাসনব্যবস্থা আরও উন্নত করা উচিত।’
যদিও বাফুফে ভবনে মেয়েদের আর গাদাগাদি করে থাকতে হবে না, এমন আশ্বাস এরই মধ্যে দিয়েছেন বাফুফের নারী কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার, ‘এই মেয়েদের বাফুফে ভবন থেকে সরিয়ে নিয়ে যাব। আমাদের পরিকল্পনা আছে বিকেএসপি বা অন্য কোনো জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে। এক্সক্লুসিভভাবে ওদের রেখে দেব। যেখানে ওরা শুধু ট্রেনিংয়ের মধ্যেই থাকবে।’
আগামী বছর ১-২১ মার্চ অস্ট্রেলিয়ায় বসবে নারী এশিয়ান কাপের আসর। যেখানে স্বাগতিক হিসেবে সরাসরি খেলবে অস্ট্রেলিয়া। আরও খেলবে গত আসরের চ্যাম্পিয়ন চীন। যারা এশিয়ান কাপে নবমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় সরাসরি খেলার সুযোগ পেয়েছে। রানার্সআপ দক্ষিণ কোরিয়া ও তৃতীয় জাপানও সরাসরি খেলবে।
এশিয়ান কাপের ১২ দলের মধ্যে বাকি আটটি দল বাছাইপর্ব পেরিয়ে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ ‘সি’ গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে খেলবে অস্ট্রেলিয়ায়। বাছাইপর্বে বাংলাদেশ হারিয়েছে বাহরাইন, মিয়ানমার ও তুর্কমেনিস্তানকে।
এরই মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় দু–দুবার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। টানা দুবারের সাফজয়ী নারীদের দক্ষিণ এশিয়ায় আদৌ প্রমাণের কিছু ছিল? সাফ চ্যাম্পিয়ন দলটিকে এশিয়ার মঞ্চে খেলার সুযোগ সেভাবে দিত না বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)।
টাকা নেই, এমন অজুহাতে তো ২০২৩ সালে অলিম্পিক বাছাই খেলতে মিয়ানমারে পাঠানো হয়নি নারী ফুটবলারদের। ২০২২ সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগে কোনো প্রস্তুতি ম্যাচই খেলতে পারেননি মনিকা চাকমারা। জাতীয় নারী দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন অনেক আগেই বলেছিলেন, ছেলেদের আগে মেয়েরা বিশ্বকাপে খেলবে। সেই স্বপ্নের দুয়ারে বাংলাদেশ। সেটা কীভাবে সম্ভব, তা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। ২০২৭ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ থাকছে বাংলাদেশের। যদি অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠেয় এশিয়া কাপের সেরা ছয় দলের মধ্যে থাকতে পারে বাংলাদেশ তাহলে খেলতে পারবে বিশ্বকাপে। তবে পরের দুই দলের মধ্যে থাকলেও সুযোগ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আন্তমহাদেশীয় প্লে-অফে অংশ নিতে হবে। আর এশিয়ান কাপের সেরা আটে থাকলে ২০২৮ সালের লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকেও খেলার সুযোগ পেতে পারে বাংলাদেশের মেয়েরা।
বাংলাদেশের মেয়েরা একটা বিশাল অসাধ্য সাধন করেছে। মোসাম্মৎ সাগরিকা, রুপনা চাকমারা প্রথমবার খেলবেন এশিয়ান কাপের মঞ্চে। বিশ্বকাপের স্বপ্ন তো হাতছোঁয়া দূরত্বে।
ঋতুপর্ণা যখন ইউরোপের ফুটবলারদের মতো অবিশ্বাস্য রংধনু শটে প্রতিপক্ষের জালে গোল দেন, উল্লাসে মেতে ওঠে পুরো বাংলাদেশ। সাগরিকা যখন হ্যাটট্রিক করে উদ্যাপনে ব্যস্ত থাকেন, সেই আনন্দে চোখে জল এসে পড়ে দর্শকদের। কিন্তু এই মেয়েরা কতটা লড়াই আর সংগ্রাম করে, কতটা কাঁটার পথ মাড়িয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেন, তা কজনই–বা জানে?
অথচ মেয়ে ফুটবল খেলে বলে এক মাস ধরে সাগরিকার সঙ্গে কোনো কথা বলেননি বাবা লিটন আলী। লিটন সাহেব অন্যের জমির ওপরে চায়ের দোকান দিয়ে সংসার চালান। এরপরও তিনি পিছিয়ে থাকা সমাজব্যবস্থার অর্গল ভেঙে মেয়ের পাশে দাঁড়াতে পারেননি। সাফ জেতার পর মেয়েই উল্টো তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। সেই মেয়ে সাফের পর এশিয়ান কাপেও খেলবেন।
ময়মনসিংহের কলসিন্দুরের ফুটবলার তহুরা খাতুনকে কখনো ফুটবল খেলতে দিতে চাইতেন না বাবা ফিরোজ মিয়া। কিন্তু সেই তহুরাকেই বলা হতো ময়মনসিংহের মেসি। তাঁর দ্রুতগতির ড্রিবলিং আর গতিময় ফুটবল দেখে, গোল করার সামর্থ্য দেখে ভালোবেসে এলাকাবাসী এই নাম দিয়েছিল।
ফিরোজ মিয়ার পাঁচ মেয়ে। তহুরা মেজ। ফুটবলে হাতেখড়ি ১০-১২ বছর বয়সে। বাড়ির আঙিনায়। বাড়ির আঙিনায় খেলা সেই তহুরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এখন দেশ–বিদেশের নানা মাঠে।
একবারের ঘটনা। বয়সভিত্তিক সাফে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ১০ লাখ টাকা দেয় সরকার। সঙ্গে ওয়ালটনের পক্ষ থেকে উপহার একটা রেফ্রিজারেটর। মেয়ে একসঙ্গে এত টাকা পেয়েছেন, বাবা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। তিনি বলছিলেন, ‘প্রথমে মেয়ে যখন ফোন করে বলে আমি তো বিশ্বাস করতে চাইনি। একটু পর মনে হলো আমার মেয়ে তো মিথ্যা কথা বলে না।’
মেয়েকে ফুটবল খেলতে বাধা দিতেন বাবা। তবে নিজের ইচ্ছায় নয়। প্রতিবেশীর কথা শুনেই নাকি তহুরাকে খেলতে দিতে চাইতেন না। এরপর আমি তহুরাকে ডেকে বলি, ‘মাগো তুমি খেলা ছেড়ে দাও।’ তবে বাবাকে অনুরোধ করে তহুরা আরেকবার খেলার অনুমতি চেয়েছিলেন। বাবা এরপর আর কখনো না করেননি।
ময়মনসিংহ থেকে উঠে আসা মিডফিল্ডার মারিয়া মান্দার লড়াইয়ের গল্পটা অন্য রকম। বাবা বীরেন্দ্র মারাত যখন মারা যান, তখন মারিয়া মান্দা পড়তেন তৃতীয় শ্রেণিতে। মারিয়ার ছোট ভাই দানিয়েল মান্দা ছিল মায়ের গর্ভে। সেই থেকে চার ভাইবোনকে নিয়ে মারিয়া মান্দার মা এনতা মান্দার লড়াইটা শুরু।
ময়মনসিংহের মন্দিরগোনা গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন মারিয়া। যখন কলসিন্দুর স্কুলে মফিজ স্যারের কাছে ফুটবলের অনুশীলন করতেন, গ্রামের অন্যরা নানা সমালোচনা করত। অনেক বাবা-মা পড়াশোনার ক্ষতি হওয়ার ভয়ে মেয়েদের খেলতে পাঠাতে চাইতেন না। কিন্তু মারিয়ার মা তেমন ছিলেন না। মেয়েকে ফুটবল মাঠে পাঠাতেন।
অথচ মারিয়ার মা অন্যের জমিতে কাজ করতেন একসময়। ধানের মৌসুমে ধান লাগাতেন। মৌসুম শেষে ধান কাটার কাজ করতেন। এ জন্য দিনে ২০০ টাকা পারিশ্রমিক পেতেন। শত অভাবেও মারিয়ার কোনো চাওয়া কখনো অপূর্ণ রাখতেন না। ছোটবেলায় একবার বুট কিনতে চাইলে চাল বিক্রি করে সেটা কিনে আনেন মা। খেলার অন্য সরঞ্জামও কতবার কিনে দিয়েছেন এভাবে!
আরেকটা ঘটনা বলি। মারিয়া মান্দার লড়াইয়ের আরেকটা বড় উদাহরণ এটা।
মারিয়া মান্দাদের গ্রামের নেতাই নদে সেতু নেই। ভোরে নৌকা পাওয়া যেত না। কীভাবে ওপারে পৌঁছানো যাবে, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা হতো। এমনও হয়েছে, মাঝিকে ফোন করে আগেই বলে রাখতেন মারিয়ার মা। কোনো কোনো দিন মাঝি না থাকলে মারিয়ার মা নৌকা বেয়ে খরস্রোতা নদ পার করে দিয়ে আসতেন। এসব লড়াইয়ের ফল পেয়েছেন মারিয়া। আজ তিনি সফল ফুটবলার।
মারিয়া মান্দার সতীর্থ ঋতুপর্ণা চাকমার কষ্টটা আরও বেশি। তাঁকে পরিবার থেকে কখনো বাধা দেয়নি ফুটবল খেলতে। কিন্তু রাঙামাটির মগাছড়ি গ্রামে এতটুকু উন্নতি হয়নি। ছোট বাঁশের সাঁকো, পাহাড়ি পথ আর ঝিরি ও দুর্গমতা মাড়িয়ে যেতে হয় ঋতুপর্ণা চাকমাদের বাড়ি।
যেখানে এখনো টিনের চালা ও বাঁশের বেড়ার একটি ঘরে থাকেন ঋতুপর্ণা। চার বোন ও এক ভাইয়ের সংসারে ঋতুর বয়স যখন ১১ তখন ক্যানসারে মারা যান তাঁর বাবা। একমাত্র ভাই পার্বণ চাকমাও দুই বছর আগে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যায়। বাবা-ভাইবিহীন সংসার টেনে নিচ্ছেন তাঁর মা ভুজপতি চাকমা। চার বোনের মধ্যে ছোট ঋতুপর্ণা। বড় তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। তাই বাড়িতে একাই থাকেন মা ভুজপতি চাকমা। সেই মা–ও ক্যানসারে ভুগছেন। মায়ের চিকিৎসার জন্যও দুশ্চিন্তায় থাকেন ঋতুপর্ণা।
স্বপ্ন ছিল ঋতুপর্ণা নিজের এলাকায় একটা বাড়ি করবেন। সরকার তাঁকে একটা জায়গায় দিয়েছে। কিন্তু জেলা প্রশাসনের বরাদ্দ দেওয়া জায়গায় বাড়ি নির্মাণের কাজ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ আছে। প্রতিশ্রুত বাড়ি নির্মাণের ফাইল আটকে আছে মন্ত্রণালয়ে।
প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা ঋতুপর্ণাদের মতো নারী ফুটবলারদের বড় সমস্যা আবাসন। বাফুফের মতো ব্যস্ত দাপ্তরিক ভবনের চতুর্থ তলার ১১টি কক্ষে প্রায় ৭০ জন নারী ফুটবলার থাকেন। অথচ এই ভবনে নেই লিফট। দৈনিক একাধিকবার ট্রেনিং, জিম সেরে সেই ভবনের সিঁড়ি বেয়ে ক্লান্ত মেয়েদের পৌঁছাতে হয় কক্ষে। একেকটি কক্ষে ছয় থেকে আটজনকে থাকতে হয় গাদাগাদি করে।
কিন্তু যে মেয়েরা বাংলাদেশকে এত বড় সাফল্য এনে দিচ্ছেন, তাঁদের জন্য আরও ভালো সুযোগ–সুবিধা প্রয়োজন বলে মনে করেন জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার রেহানা পারভীন, ‘আমাদের ফুটবলাররা যেখানে থাকে, ওটার পরিবর্তন করা দরকার। ওদের আবাসনব্যবস্থা আরও উন্নত করা উচিত।’
যদিও বাফুফে ভবনে মেয়েদের আর গাদাগাদি করে থাকতে হবে না, এমন আশ্বাস এরই মধ্যে দিয়েছেন বাফুফের নারী কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার, ‘এই মেয়েদের বাফুফে ভবন থেকে সরিয়ে নিয়ে যাব। আমাদের পরিকল্পনা আছে বিকেএসপি বা অন্য কোনো জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে। এক্সক্লুসিভভাবে ওদের রেখে দেব। যেখানে ওরা শুধু ট্রেনিংয়ের মধ্যেই থাকবে।’
আগামী বছর ১-২১ মার্চ অস্ট্রেলিয়ায় বসবে নারী এশিয়ান কাপের আসর। যেখানে স্বাগতিক হিসেবে সরাসরি খেলবে অস্ট্রেলিয়া। আরও খেলবে গত আসরের চ্যাম্পিয়ন চীন। যারা এশিয়ান কাপে নবমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় সরাসরি খেলার সুযোগ পেয়েছে। রানার্সআপ দক্ষিণ কোরিয়া ও তৃতীয় জাপানও সরাসরি খেলবে।
এশিয়ান কাপের ১২ দলের মধ্যে বাকি আটটি দল বাছাইপর্ব পেরিয়ে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ ‘সি’ গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে খেলবে অস্ট্রেলিয়ায়। বাছাইপর্বে বাংলাদেশ হারিয়েছে বাহরাইন, মিয়ানমার ও তুর্কমেনিস্তানকে।
এরই মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় দু–দুবার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। টানা দুবারের সাফজয়ী নারীদের দক্ষিণ এশিয়ায় আদৌ প্রমাণের কিছু ছিল? সাফ চ্যাম্পিয়ন দলটিকে এশিয়ার মঞ্চে খেলার সুযোগ সেভাবে দিত না বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)।
টাকা নেই, এমন অজুহাতে তো ২০২৩ সালে অলিম্পিক বাছাই খেলতে মিয়ানমারে পাঠানো হয়নি নারী ফুটবলারদের। ২০২২ সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগে কোনো প্রস্তুতি ম্যাচই খেলতে পারেননি মনিকা চাকমারা। জাতীয় নারী দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন অনেক আগেই বলেছিলেন, ছেলেদের আগে মেয়েরা বিশ্বকাপে খেলবে। সেই স্বপ্নের দুয়ারে বাংলাদেশ। সেটা কীভাবে সম্ভব, তা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। ২০২৭ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ থাকছে বাংলাদেশের। যদি অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠেয় এশিয়া কাপের সেরা ছয় দলের মধ্যে থাকতে পারে বাংলাদেশ তাহলে খেলতে পারবে বিশ্বকাপে। তবে পরের দুই দলের মধ্যে থাকলেও সুযোগ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আন্তমহাদেশীয় প্লে-অফে অংশ নিতে হবে। আর এশিয়ান কাপের সেরা আটে থাকলে ২০২৮ সালের লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকেও খেলার সুযোগ পেতে পারে বাংলাদেশের মেয়েরা।
বাংলাদেশের মেয়েরা একটা বিশাল অসাধ্য সাধন করেছে। মোসাম্মৎ সাগরিকা, রুপনা চাকমারা প্রথমবার খেলবেন এশিয়ান কাপের মঞ্চে। বিশ্বকাপের স্বপ্ন তো হাতছোঁয়া দূরত্বে।
ঋতুপর্ণা যখন ইউরোপের ফুটবলারদের মতো অবিশ্বাস্য রংধনু শটে প্রতিপক্ষের জালে গোল দেন, উল্লাসে মেতে ওঠে পুরো বাংলাদেশ। সাগরিকা যখন হ্যাটট্রিক করে উদ্যাপনে ব্যস্ত থাকেন, সেই আনন্দে চোখে জল এসে পড়ে দর্শকদের। কিন্তু এই মেয়েরা কতটা লড়াই আর সংগ্রাম করে, কতটা কাঁটার পথ মাড়িয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেন, তা কজনই–বা জানে?