দুঃস্বপ্নের মতো হার দিয়ে ‘ভঙ্গ’ এশিয়া কাপের স্বপ্ন

রেফারির শেষ বাঁশি বাজার পর ক্যামেরা চোখ খুঁজে নিয়েছিল হামজা দেওয়ান চৌধুরীর মুখ। পুরো ম্যাচের জনপ্রিয় তারকার চোখে মুখে তখন কষ্টের ছায়া। ফিরে আসার গল্প প্রতিদিন লেখা হয় না। কিন্তু সেই ফিরে আসার গল্প লেখার পরও যখন হাসিমুখে তার সমাপ্তি ঘটে না, তখন হতাশা ছাড়া অন্যকিছু সামনে ধরা দেয় না। হংকংয়ের বিপক্ষে ম্যাচটা যেন সেরকমই এক দুঃস্বপ্নের প্রতিচ্ছ্ববি।

ম্যাচের আগেই বাংলাদেশকে এক দফা তাতিয়ে দিয়েছিলেন হংকংয়ের কোচ। সংবাদ সম্মেলনে সরাসরি বলেই দিয়েছিলেন, হামজা চৌধুরী সর্বোচ্চ তাঁর বেঞ্চে জায়গা করে নিতে পারেন। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। বাংলাদেশ তার কোনো পালটা উত্তর দেয়নি, অপেক্ষায় ছিল মাঠের ফুটবলে প্রমাণ করার। সেটা প্রমাণ করতে হামজা চৌধুরীর লেগেছিল মাত্র ১৩ মিনিট। পেনাল্টি বক্সের সামান্য বাইরে থেকে নেওয়া দূর্দান্ত এক ফ্রি কিক জড়িয়ে যায় জালে। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যান সেই হামজা চৌধুরীই। ইংলিশ লিগ ডিফেন্স আর মাঝমাঠ সামলানো হামজা যেন বাংলাদেশের রক্ষাকর্তা হয়ে উঠেছেন ৪ ম্যাচেই। ৪ ম্যাচে ২ গোল তার প্রমাণমাত্র। তবে বাংলাদেশের ম্যাচ যেন থেমে গিয়েছিল সেই জায়গাতেই। কারণ পরবর্তী ৫০ মিনিট বাংলাদেশের ম্যাচে চোখে পড়েছে শুধু ভুল পাস, ভুল সিদ্ধান্ত আর হামজা চৌধুরীর হতাশা।

আরও পড়ুন
হামজার দূর্দান্ত ফ্রি কিকে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ।
ছবি: প্রথম আলো

পেছনে ফিরে ম্যাচের একাদশ নিয়েই কথা শুরু করতে হয়। স্প্যানিশ কোচ হাবিয়ের কাবরেরা দল সাজিয়েছিলেন নিজের সেরা অস্ত্রদের ছাড়াই। সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে বাংলাদেশের মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ ছিল ফাহামিদুল ইসলাম আর শমিত সোমের হাতে। কিন্তু এই ম্যাচের মূল একাদশে ছিলেন না তাঁদের কেউ। বরং হাভিয়ের কাবরেরা ভরসা রেখেছেন সোহেল রানা সিনিয়র, সোহেল রানা জুনিয়রের ওপর। বাঁ পাশে ফয়সাল আহমেদ আর সাদ উদ্দিন তো বরাবরের মতো জায়গা দখল করে রেখেছেন একাদশে। মুখস্থ একটি একাদশ নিয়ে নামার খেসারত প্রথমার্ধেই টের পেল বাংলাদেশ। বরাবরের মতো হামজা চৌধুরী ছাড়া মাঝমাঠে দায়িত্ব নেওয়ার মতো নেই কেউ। ছন্নছাড়া মাঝমাঠ দিয়ে যেমন বল নিয়ে প্রবেশ করেছে হংকং, তেমনই আক্রমণ ভাগেও কোবো বলের যোগান হয়নি। যার ফল বাংলাদেশ পেয়েছে প্রথমার্ধের শেষ মুহূর্তে। ডিফেন্সের ভুলে গোল হজম করে বসে বাংলাদেশ। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে এগিয়ে যায় হংকং। গোলরক্ষক মিতুল মারমার ভুলে বাংলাদেশের জালে গোল করেন রাফায়েল মেরকিস।

৬০ মিনিটে শুভবুদ্ধির উদয় হয় কোচ হাভিয়ের কাবরেরার। একসঙ্গে মাঠে নামেন শমিত সোম, জামাল ভুঁইয়া আর ফাহমিদুল ইসলাম। মাঝমাঠে যেন প্রাণ ফেরে বাংলাদেশের। কিন্তু এর মধ্যেই ডিফেন্সে অমনোযোগী হওয়ার খেসারত দেয় বাংলাদেশ। সাদ উদ্দিনের দুই দুই পায়ের মাঝ দিয়ে বল গেল গোলমুখে, ফাঁকায় থাকা মেরকিস ব্যবধান করলেন ১-৩। বাংলাদেশের সামনে তখন নিশ্চিত পরাজয়। কিন্তু ভিনদেশ থেকে বাংলাদেশের টানে আসা তারকাদের মনে ছিল ভিন্ন কিছু। মুহূর্তেই বদলে গেল বাংলাদেশের খেলার ধরণ। জামাল ভূঁইয়ার ফ্রি কিক থেকে আসা বল চমৎকারভাবে বক্সে দিয়েছেন ফাহামিদুল। সেখান থেকে গোলরক্ষকের ভুলে বল পেয়ে গেলেন মোরসালিন। ৮৪ মিনিটে ব্যবধান কমাল বাংলাদেশ।

অতিরিক্ত সময় যোগ হলো ৯ মিনিট। ৯৮ মিনিটে গিয়ে ভাগ্য আরেকবার সুপ্রসন্ন হলো বাংলাদেশের। মোরসালিনের বাড়ানো কর্নার থেকে দলকে সমতায় ফেরান শমিত সোম। কানাডিয়ান লিগে খেলা বাংলাদেশি তারকার এটাই ছিল দেশের জার্সিতে প্রথম গোল। আর প্রথম গোলটাই হয়ে থাকতে পারত স্মরণীয়।

আরও পড়ুন
শমিত সোমের প্রথম গোল বাংলাদেশের জার্সিতে।
ছবি: প্রথম আলো

কিন্তু ভঙ্গুর ডিফেন্স সেই সমতা ধরে রাখতে পারল না দুই মিনিটও। ম্যাচের শেষ মিনিটে ডি-বক্সে ফাঁকা দাঁড়িয়ে ছিলেন রাফায়েল মেরকিস। তাঁর বাড়ানো আলতো শট থামাতে ব্যর্থ হয়েছেন মিতুল মারমা। ম্যাচের শেষ শটে তিন পয়েন্ট নিশ্চিত করে হংকং। ঘরের মাটিতে বাংলাদেশের লড়াই শেষ হয় হার দিয়ে।  

এই হার দিয়ে এশিয়ান কাপে খেলার স্বপ্ন অনেকটাই মিইয়ে গিয়েছে বাংলাদেশের। ৩ ম্যাচ শেষে বাংলাদেশের পয়েন্ট মাত্র ১। সেটা এসেছে ভারতের মাটিতে ০-০ গোলের ড্র থেকে। নিজেদের মাটিতে সিঙ্গাপুর আর হংকংয়ের বিপক্ষে ভালো খেলেও হারতে হয়েছে তাদের। হামজা-শমিতদের দূর্দান্ত পারফরম্যান্স ম্লান হয়ে গিয়েছে কোচের প্রশ্নবিদ্ধ কৌশল আর সতীর্থদের বাজে পারফরম্যান্সে।

হংকংয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের একমাত্র খুশির সংবাদ ছিল জায়ান আহমেদ। ২১ বছর বয়সী লেফট ব্যাককে ম্যাচের শেষ মুহুর্তে নামিয়েছিলেন কোচ। নেমেই বাঁ প্রান্ত দিয়ে দূর্দান্ত কিছু আক্রমণের সূচনা করেছেন তিনি। ডিফেন্সেও নিজের নামের সুবিচার করেছেন। প্রথমবারের মতো খেলতে নেমে যে তড়িৎ গতি আর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন, তা অনেক অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের কাছ থেকেও আসেনি।

২৮ ঘন্টা ফ্লাইট পারি দিয়ে কানাডা থেকে বাংলাদেশে আসা শমিত, কিংবা ১২ ঘন্টা ফ্লাইট পারি দিয়ে ইতালি থেকে আসা ফাহামিদুল দলের জন্য যতটা খেটেছেন, তার অর্ধেকও যদি অন্য কারো কাছ থেকে পাওয়া যেত, তাহলে হয়তো পুরো তিনটি পয়েন্ট নিয়েই ফিরতে পারত বাংলাদেশ। কিন্তু কোচের প্রশ্নবিদ্ধ কৌশল আর খেলোয়াড়দের উদাসীনতার বলি হয়েছে বাংলাদেশের সমর্থকরা। একটি পয়েন্টের আশা দেখেও শেষ পর্যন্ত পয়েন্ট ছাড়াই ফিরতে হয়েছে বাংলাদেশকে।

আরও পড়ুন