রাতটা এখনও রোনালদোর

রাতটা লেখা ছিল লামিন ইয়ামালের নামে। বয়সটা মাত্র ১৭, তাতে কী? ফুটবল পায়ে তার স্কিল দেখে তা বোঝার কোন আনকাশই নেই। তার পারফরম্যান্স শুধু দল না, চুপ করিয়ে দিয়েছে নিন্দুকের মুখও। ফ্রান্সের বিপক্ষে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর ব্যালন ডি’অরের তালিকাতেও সামনের সারিতে ছিল তার নাম। অ্যালিয়াঞ্জ অ্যারেনায় রাতটা তাই প্রস্তুত হয়ে ছিল লামিন ইয়ামালের জন্য। 

চল্লিশ পেরোনো ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর জন্য এসব তৈরি থাকা রাত বড্ড ঠুনকো ব্যাপার। কার কপালে ‘ডিজার্ভ তত্ত্ব’ লেখা, তার তিনি থোড়াই কেয়ার করেন। বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে, প্রফেশনাল ফুটবলে ২৩ বছরের অভিজ্ঞতা। এমন ফাইনাল বহু বছরে একবার আসে, আর সেটা যদি হয় পর্তুগালের জার্সিতে, তবে সেখানে অন্য কোন কিছু খাটে না। রোনালদো নামটাই যথেষ্ট সব সমীকরণ বদলে দিতে। চল্লিশে এসেও যে তার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি, তার চাক্ষুস প্রমাণ যেন এবারের ন্যাশনস কাপ। 

রোনালদো জার্মানিতে পা দিয়েছিলেন অনিশ্চিত ক্লাব ক্যারিয়ার নিয়ে। আল নাসেরের সঙ্গে তার চুক্তিটা আর বাড়ছে না। ভবিষ্যৎ গন্তব্য কোথায়, সে নিয়েও নিশ্চিত নন নিজে। পর্তুগালের আর্মব্যান্ড তার হাতে থাকা উচিত কী না, সে নিয়েও আছে বিশাল আলোচনা সমালোচনা। রোনালদো সে তর্ক থামিয়ে দিয়েছেন প্রথম ম্যাচেই। জার্মানির বিপক্ষে জয়সূচক গোল। তার গোলে ভর করে দ্বিতীয়বারের মতো ন্যাশনস কাপের ফাইনালে পর্তুগাল। নিন্দুকদের থামাতে এর বেশিকিছু দরকার ছিল না।  

আরও পড়ুন
ব্যর্থ মনোরথে বাড়ি ফিরেছেন ইয়ামাল। ছবি: এক্স

অপর সেমি ফাইনালে ফ্রান্সকে নিয়ে রীতিমত ছেলেখেলা করেছে স্পেন। আরও নির্দিষ্ট করে বললে লামিন ইয়ামাল। ফরাসি ডিফেন্ডাররা রীতিমত ধরাশায়ী হয়েছে ১৭ বছর বয়সী ফরোয়ার্ডের কাছে। দুই গোল দিয়ে হয়েছেন ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ। এক পারফরম্যান্সে ব্যালন ডি’অরের গ্রাফে তরতর করে উঠে গিয়েছিল তার নাম। স্বর্ণালি বলের লড়াইয়ে ন্যাশনস কাপের ফাইনাল ছিল ইয়ামালের শেষ পরীক্ষা। আর সেটা উৎরাতেই গিয়েই যত বিপত্তি। 

সেমির ইয়ামাল যতটা জ্বলজ্বল করেছেন, ফাইনালের ইয়ামাল ঠিক ততটাই চুপসে গিয়েছেন ইয়ামালের সম্পূর্ণ স্পটলাইট কেড়ে নিয়েছেন নুনো মেন্ডেস। পর্তুগিজ রক্ষণের বামপাশ রক্ষার দায়িত্ব ছিল মেন্ডেসের কাঁধে। লড়াইটা ছিল ইয়ামালকে আটকানোর। মেন্ডেস শুধু সে দায়িত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করেই ক্ষান্ত হননি, টেনে নিয়ে গিয়েছেন পুরো ম্যাচকে। ১০৪ মিনিট খেলেও নিজের খোলস থেকে বের হতে পারেননি ইয়ামাল। সঙ্গে দুটো গোলেই রেখেছেন সরাসরি অবদান।

ম্যাচের শুরুতেই মাঋন জুবিমেন্দির গোলে পিছিয়ে পরেছিল পর্তুগাল। সেখান থেকে দলকে সমতায় ফেরান নুনো। রোনালদোর সাজিয়ে দেওয়া বল থেকে পেদ্রো নেতোর বাড়ানো পাস ডিফেন্ডারদের বোকা বানিয়ে জড়িয়েছেন জালে। প্রথমার্ধের শেষ মিনিটে স্পেনকে আবারও এগিয়ে নেন মিকেল ওইয়ারসাবাল। অতঃপর ৬১ মিনিটে দলকে সমতায় ফেরান ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। তবে গোলের পুরো ক্রেডিটটা যাবে নুনোর নামের পাশে। দুই ডিফেন্ডারকে গতি দিয়ে বোকা বানিয়ে প্রবেশ করেন ডি-বক্সে, অতঃপর শট। লে নরমাদের পায়ে লেগে বল ভেসে যায় শূন্যে। শূন্যে ভেসে থাকা বল নামতেই ডিফেন্ডার কুকুরেয়াকে বোকা বানিয়ে রোনালদো বল জড়িয়ে দেন জালে। পরপর দুইবার এগিয়ে গিয়েও ম্যাচের লীড নিজের কাছে রাখতে পারেনি স্পেন। 

আরও পড়ুন
ম্যাচশেষে মেন্ডেসকে নিয়ে সতীর্থদের উল্লাস। ছবি: এক্স

অন্যদিকে চোট আর ক্লান্তি জাপটে ধরেছিল রোনালদোকে। যে কারণে ৮৮ মিনিটে নিজেই সংকেত দেন তাকে মাঠ থেকে উঠানোর। এরপর থেকেই যেন বদল যায় পর্তুগালের ট্যাক্টিকস। পুরো দলের চেষ্টা ছিল ম্যাচটাকে পেনাল্টিতে নিয়ে যাওয়ার। কারণ টাইব্রেকারে গেলেই বদলে যাবে সমীকরণ। কারণ সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন তাদের রক্ষাকর্তা ডিয়েগো কস্তা। 

হলোও তাই। নির্ধারিত সময়ের পর অতিরিক্ত সময়, ফলাফল ২-২। ম্যাচ গড়ালো টাইব্রেকারে। পর্তুগিজ শ্যুটারদের কাছে পাত্তাই পাননি উনাই সিমোন। অন্যদিকে ইসকোর শট জালে প্রবেশ করেছিল ডিয়েগো কস্তার হাত স্পর্শ করে। কিন্তু স্প্যানিশ অধিনায়ক আলভেরো মোরাতার শটে সে ভুল হয় নি। লাফিয়ে পরে থামিয়ে দিয়েছেন সেই শট।   হাতে লেগে প্রবেশ করেছিল জালে। এক শটেই নিশ্চিত হয়েছে জয়। রুবেন নেভেসের পঞ্চম শট নিশ্চিত করেছে শিরোপা। 

আরও পড়ুন
দুই দশক ধরে পর্তুগালকে এভাবে কাধে করে বয়ে নিয়েছেন রোনালদো। ছবি: এক্স

২১ বছর পর যে কোন মঞ্চে স্পেনকে হারানো। জার্মানিকে ২৫ বছর পর। ন্যাশন্স কাপের ফাইনালে পর্তুগাল যখন পা দিয়েছিল, দুই অসম্ভবকে সম্ভব করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন রোনালদো। সেটা অবশ্য পর্তুগালের জার্সি গায়ে চড়ানোর পর থেকেই। ২০০৩ সালে তার অভিষেকের আগে পর্তুগালের ইতিহাস আটকে ছিল সেমি ফাইনাল পর্যন্ত। আন্তর্জাতিক মঞ্চে পর্তুগালের দৌড় সেই ডার্ক হর্স হওয়া পর্যন্তই। রোনালদো এসে বদলে দিয়েছিলেন সব সমীকরণ। ২০০৪ ইউরোতে প্রথম ফাইনাল, অতঃপর ২০১৬ সালে এসে প্রথম ইউরো। ১৯ সালে ন্যাশনস কাপ আর ২০২৫ সালে এসে দ্বিতীয় ন্যাশনস কাপ। পর্তুগালের ফুটবল ইতিহাসে তৃতীয় আন্তর্জাতিক শিরোপা। সবগুলোই রোনালদোর হাত ধরে। জাতীয় দলে খেলার জন্য জানপ্রাণ দিয়ে দেওয়া একজন খেলোয়াড়ের জন্য এর থেকে বেশি সৌভাগ্যের আর কী-ই বা হতে পারে?

আরও পড়ুন