রকিব হাসানের ‘ক্যাম্পাসে ভূত’ (দ্বিতীয় পর্ব)

অলংকরণ: ধ্রুব এষ

কিশোরকে প্রফেসর জনসনের অফিসে পৌঁছে দিলেন ডিন। প্রফেসরের বয়স দেখে অবাক হলো কিশোর। একজন যুবক। বয়স বত্রিশ-তেত্রিশের বেশি হবে না। ইংরেজি পড়ান। দীর্ঘ দেহ, লম্বা এলোমেলো বাদামি চুল, পরনে টুইডের জ্যাকেট আর স্ল্যাকস।

‘বিজ্ঞানের ব্যাপারে কিছুই জানি না আমি,’ হেসে বললেন প্রফেসর জনসন। ‘আমার ধারণা, লরার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের প্রধান কারণটা ছিল সাহিত্য—আমি ইংরেজি সাহিত্য পড়াই—সাহিত্য ভালোবাসত ও। ওর রুক্ষতা, ধারাল জিব কেউ সহ্য করতে পারত না, কিন্তু এই নিষ্ঠুরতার আড়ালে ওর কোমল মনটার খোঁজ পেয়ে গিয়েছিলাম আমি, বুঝে গিয়েছিলাম বড়ই নিঃসঙ্গ আর অসুখী মানুষ লরা। আর বুঝতে পেরেছিলাম বলেই ওর সঙ্গে আমার সময় খুব ভালো কাটত।’

‘দুর্ঘটনার রাতে আপনার সঙ্গে ওঁর দেখা হয়েছিল?’ জানতে চাইল কিশোর।

‘হ্যাঁ,’ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন জনসন। ‘সত্যি কথাটা হলো, ওটা দুর্ঘটনা ছিল না, ইচ্ছা করেই নিজের গাড়িটাকে পাহাড়ের নিচে ফেলে দিয়েছিল ও।’

ভেতরে ভেতরে চমকে গেল কিশোর, তবে চেহারায় সেটা প্রকাশ পেতে দিল না। আরও অনেক কথা বললেন প্রফেসর জনসন। তিনি জানান, ঘটনার দিন একটা বৈজ্ঞানিক সম্মেলন থেকে ফিরে এসেছিলেন প্রফেসর লরা ওয়াইল্ডার। সম্মেলনে সবার সামনে তাঁর আবিষ্কৃত ফ্লোরিয়াম পেনটোজের ওপরে লেখা একটা প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন। ভেবেছিলেন, এই আবিষ্কারের জন্য অনেক বাহবা পাবেন তিনি, প্রশংসা কুড়াবেন। কিন্তু তাঁর সহকর্মী বিজ্ঞানীরা মোটেও স্বাগত জানালেন না আবিষ্কারটাকে, প্রশংসা তো দূরের কথা, বরং কেউ কেউ এত বেশি শীতলতা দেখালেন, মনে মনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন লরা। তাঁর ধারণা হয়েছিল, রুক্ষ ব্যবহার আর বিশ্রী চেহারার জন্যই তাঁকে বেশি করে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।

‘বিকেলে ভগ্ন, বিধ্বস্ত চেহারা আর ভয়ংকর মেজাজ নিয়ে ফ্যাকাল্টিতে ফিরে এলেন তিনি,’ প্রফেসর জনসন বললেন। ‘সবার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে লাগলেন। বললেন, কেউ তাঁকে দেখতে পারে না। নিজের গবেষণাগারে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলেন। কয়েক ঘণ্টা থাকলেন সেখানে। তারপর রাত-দুপুরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন, প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে। তারপর অ্যাক্সিডেন্ট করলেন।’

‘তিনি থাকতেন কোথায়?’ কিশোর জিগ্যেস করল।

‘ক্যাম্পাসের কাছেই একটা অ্যাপার্টমেন্টে, ওপরতলায় ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন। বাড়িটার মালিক এক বৃদ্ধ দম্পতি,’ জনসন জবাব দিলেন। ‘তাঁর মৃত্যুর পর অন্য কেউ গরজ না দেখানোয় বাড়িওয়ালার কাছ থেকে তাঁর জিনিসপত্রগুলো আমি নিয়ে এসে আমার গ্যারেজে ফেলে রেখেছি। ওগুলো ওখানেই পড়ে আছে এখনো।’

আগ্রহে জ্বলে উঠল কিশোরের চোখ। ‘তার মানে, লরার বান্ধবী কোরি অ্যালেঙ্গারের কাছ থেকে আসা চিঠিগুলো আপনি দেখেছেন?’

‘হ্যাঁ।’ হাসলেন রিড জনসন। ‘একটা আজব বন্ধুত্ব বলে মনে হয়েছে আমার।’

কৌতূহলী হয়ে জিগ্যেস করল কিশোর, ‘কেন?’

‘কারণ, কোরি অ্যালেঙ্গার আর লরার স্বভাবে বড়ই অমিল ছিল বলে মনে হয়েছে আমার। বোধ হয় ছোটবেলায় স্কুলজীবন থেকেই দুজনের বন্ধুত্ব। না হলে বন্ধুত্ব হওয়ার কথা নয়। চিঠি পড়ে মনে হয়েছে, কোরি খুব হাসিখুশি, মিষ্টভাষী, আর আকর্ষণীয় চেহারার মহিলা। সমাজে খুব জনপ্রিয়, অনেক ভক্ত তাঁর।’ জনসন যোগ করলেন, লরা যদিও খামগুলো রাখেননি, তবু চিঠি পড়েই বোঝা যায়, ওগুলো এসেছে ফ্রেঞ্চ রিভিয়ারা, মেক্সিকো আর পৃথিবীর যত গ্ল্যামারাস রিসোর্ট থেকে। সবশেষে বললেন, ‘চিঠিগুলো পড়তে চাইলে পড়তে পারো।’

‘থ্যাংকস,’ খুশি হয়েই জবাব দিল কিশোর। ‘পড়লে হয়তো কিছু জানতে পারব।’ তারপর, লরার বোনঝি টিনার সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করল ও। জনসন জানান, স্টোনভিল হোটেলে উঠেছে টিনা। আচমকা কিশোরকে ফ্যাকাল্টি ক্লাবে লাঞ্চ খাবার দাওয়াত দিয়ে বসলেন তিনি। বললেন, টিনাও খেতে আসবে।

অবাকই হলো কিশোর। এতটা আশা করেনি। রাজি হয়ে গেল।

ছিপছিপে তরুণী টিনা, বয়স বিশ-বাইশের বেশি হবে না। ফোলানো সোনালি চুল, সবুজ চোখ, মুখের মেকআপের সঙ্গে মিলিয়ে সবুজ রং লাগিয়েছে পাপড়িতে। তাকানোর সময় ঘন ঘন নাচাচ্ছে সেগুলো। কথায় আমেরিকার উত্তরাঞ্চলের কাউবয়দের মতো টান। যদিও কণ্ঠস্বরটা বেশ মিষ্টি, তবু নাকি স্বরে কথা বলাতে কানে লাগে। কোথায় থাকে জিগ্যেস করে জানতে পারল কিশোর, টেক্সাসে।

ফ্যাকাল্টি ক্লাবের সেদিনকার স্পেশাল ডিশ এগ বেনেডিক্টের অর্ডার দিয়েছেন জনসন।

‘আমার ফুপুর ওই রাসায়নিক প্যাটেন্টটার দাম কত হতে পারে বলে তোমার ধারণা?’ খেতে খেতে জিগ্যেস করল টিনা।

‘আমি জানি না,’ মাথা নাড়ল কিশোর।

‘আমার ধারণা ছিল জানো, যেহেতু তোমার চাচা এ কেসটা ডিল করছেন, রিগবি ড্রাগ কোম্পানির সঙ্গে নিশ্চয় যোগাযোগ আছে।’

‘আছে। তবে রয়্যালটি কত দেওয়া হবে, সে সম্পর্কে চাচাও বোধ হয় কিছু জানেন না,’ জবাব দিল কিশোর। তারপর বিষয়টা ব্যাখ্যা করল, যেহেতু ফ্লোরিয়াম পেনটোজ বানাতে কোন অনুঘটক ব্যবহার করেছিলেন লরা, সেটা এখনো জানে না কোম্পানি, বানিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারেনি, রয়্যালটি কত হতে পারে, সেটাও বোঝার কথা নয় তাদের।

অধৈর্য আর সন্দিহান মনে হলো সোনালি চুলওয়ালা মেয়েটাকে।

‘কই, আমি তো কোনো অনুঘটকের কথা কখনো শুনিনি,’ রুক্ষ শোনাল টিনার কণ্ঠ। তারপর কথায় কথায় লরার সঙ্গে তার সম্পর্ক কী, সেটা জানাল। টিনার মা লরার সৎবোন। তবে লরা আর তাঁর বোনের বয়স এগারো-বারো হতেই সংসারটা ভেঙে গিয়েছিল।

‘লরা নিশ্চয় দক্ষিণ-পশ্চিমে বড় হননি,’ জনসন মন্তব্য করলেন। ‘কারণ, তাঁর কথায় সে রকম টান ছিল না।’

‘আপনার খালা রিচমন্ড কলেজের প্রফেসর, জানলেন কী করে আপনি?’ টিনাকে জিগ্যেস করল কিশোর।

‘এখানকার ক্যাম্পাসের ভূতের কথাটা টেলিভিশনে দেখেছি আমি,’ টিনা জবাব দিল। ‘রিচমন্ড কলেজের ক্যাম্পাস-ভূত নিয়ে একটা স্টোরি তৈরি করেছে ওরা। টিভির রিপোর্টার জানিয়েছে, লরা ওয়াইল্ডার নামে দুর্ঘটনায় মৃত একজন প্রফেসর একটা কেমিক্যাল আবিষ্কার করেছিলেন, যেটার প্যাটেন্ট বিক্রি করা হয়েছে রিগবি ড্রাগ কোম্পানি নামের একটা কোম্পানির কাছে। ভাবলাম, ওই মৃত প্রফেসরই আমার খালা নয়তো?’ টিনা জানাল, কীভাবে ওর মৃত মায়ের কাগজপত্র ঘেঁটে ঘেঁটে মায়ের হাতের লেখা একটা নোট বের করেছে ও, যাতে রিচমন্ড কলেজের জনৈক বিজ্ঞানী লরা ওয়াইল্ডারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্টের উল্লেখ রয়েছে।

টিনার খালা রিচমন্ড কলেজে পড়ান, আগে থেকেই সেটা জানে টিনা—এ ব্যাপারে গোড়া থেকেই সন্দেহ ছিল কিশোরের, গুরুত্ব দেয়নি, তবে টিনার সব কথা শোনার পর এ বিষয়ে আকৃষ্ট হলো।

‘ইয়ে, শোনো,’ খেতে খেতে বলে উঠলেন হঠাৎ প্রফেসর জনসন, ‘লরা কোথায় থাকত, সেটা কি তোমরা দেখতে চাও? আমি তোমাদের দেখাতে পারি।’

খুব একটা আগ্রহ দেখাল না টিনা। তবে সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহী হয়ে উঠল কিশোর।

এ সময় টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল একজন ওয়েটার। ‘এক্সকিউজ মি, আপনাদের মধ্যে কার নাম কিশোর পাশা?’ মাথা ঝাঁকিয়ে কিশোর বোঝাল, ওর নাম কিশোর পাশা। ওয়েটার তখন বলল, ওর ফোন এসেছে। কলেজের ডিন মিস্টার হ্যারল্ড তার সঙ্গে কথা বলতে চান।

‘তুমি নিশ্চয় প্রফেসর জনসনের সঙ্গে ক্লাবে লাঞ্চ করছ,’ কিশোর ফোন ধরলে ডিন হ্যারল্ড বললেন। ‘আমার মনে হয় একটা বিষয় তোমাকে খুব আগ্রহী করবে, কিশোর, তাই ফোন করলাম। লরা ওয়াইল্ডারের পত্রলেখক বান্ধবী কোরি অ্যালেঙ্গার হুট করেই আমার অফিসে এসে হাজির হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাও?’

‘নিশ্চয়ই চাই!’ উত্তেজিত কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। জানাল, আধঘণ্টার মধ্যেই ডিনের অফিসে হাজির হয়ে যাবে ও।

টেবিলে ফিরে এসে খবরটা প্রফেসর জনসন আর টিনাকে জানাল কিশোর। আপাতত লরার বাসায় যাওয়া বন্ধ রেখে প্রথমে ডিনের অফিসে যেতে চায় ও। ঠিক হলো, বেলা তিনটায় লরার বাসায় যাবে।

খাওয়া সেরে, বিল মিটিয়ে দিয়ে ডায়নিং রুম থেকে বেরোল তিনজনে। ক্লাবের লবি ধরে এগোনোর সময় চিঠির বাক্সে তাঁর নামে কোনো চিঠি এসেছি কি না, দেখলেন প্রফেসর। একটা মেসেজ পেলেন। পড়তে পড়তে বিস্ময় ফুটল তাঁর চেহারায়।

‘কিছু হয়েছে?’ জানতে চাইল কিশোর।

নীরবে মেসেজটা তার হাতে তুলে দিলেন প্রফেসর। তাতে লেখা রয়েছে:

বিষয়টা তোমার কাছে অদ্ভুত লাগতে পারে, রিড, কিন্তু এখন আমি সত্যিই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছি, ভবিষ্যৎ দেখতে পাই। আজ যখন তোমরা ক্লাবের ডায়নিং রুমে বসে লাঞ্চ করছিলে, তোমার টেবিলে বসা কালো কোঁকড়া চুল ছেলেটার মাথা ঘিরে একধরনের আভা জ্বলজ্বল করতে দেখেছি। আমার বিশ্বাস, প্রেতজগতের কোনো প্রেতাত্মা ভর করতে চাইছে ছেলেটার ওপর। ওকে সাবধান থাকতে বোলো।

মেসেজটায় কোনো সই নেই। মুখ তুলে প্রশ্ন করল কিশোর, ‘কে লিখেছে এটা?’

অস্বস্তিভরা ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালেন জনসন। ‘বুঝতে পারছি না। কলেজে প্যারসাইকোলজিতে যারা বিশ্বাস করে, তাদের কেউ হতে পারে। অতিলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে গবেষণা করে ওরা, আধিভৌতিক বিষয়েও আগ্রহ আছে ওদের। ওদেরই কেউ হয়তো ঘটনাটা ঘটতে দেখে সাবধান করে দিয়েছে।’

ভূতে চিঠি লিখেছে, যদিও এ কথাটা বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর, তবু কেন যেন ওর মেরুদণ্ডে শিরশির করে উঠল।

আরও পড়ুন